30-10-2022, 01:55 PM
(This post was last modified: 24-09-2023, 01:56 PM by মহাবীর্য্য দেবশর্ম্মা. Edited 8 times in total. Edited 8 times in total.)
সরলবাবুর সরলতা
শ্রী মহাবীর্য্য দেবশর্ম্মা
শ্রী মহাবীর্য্য দেবশর্ম্মা
সরলবাবু আদ্যন্ত সহজ সরল। তাঁহার সরলতার কারণে তাঁহাকে বহুবার বিড়ম্বনায় পড়িতে হইয়াছে, লোকে তাঁহাকে কহিয়াছে, "সরলবাবু আপনি এত সরল কেন! একটু জটিল হন, জটিল নিতান্তই না হইতে পারিলে অন্ততঃপক্ষে যৌগিক হন কিন্তু সরল থাকিবেন না। সরল থাকিলে লোকে আপনাকে কষিয়া ফেলিবে আর পরীক্ষায় গাদা গাদা নম্বর তুলিবে!" কিন্তু সরলবাবু শতচেষ্টা করিয়াও জটিল হইতে পারিলেন না। তাঁহার আপিসের লোকজন অবধি মন্তব্য করিয়াছে, 'আজকাল অন্ধপুত্রের নাম যখন পদ্মলোচন হইতেছে তখন সরলবাবুর নিজনামের প্রতি এহেন মোহ বড়ই বেদনাদায়ক!' বিষয়টি বেদনাদায়ক সরলবাবুর পক্ষেও, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ যাতনা তিনি নিরবধি সহিতেছেন।
অদ্য আপিসে আসিয়াই একখানি গুঞ্জন শুনিলেন সরলবাবু। কোন এক কুলাঙ্গার নাকি বাটীর পুরুষমানুষদের অনুপস্থিতির সুযোগ লহিয়া বাটীভ্যন্তরে প্রবেশিয়া বাটীর যুবতী বধূদের সর্ব্বনাশ করিতেছে! শুনিয়াই সরলবাবুর বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দ করিল, আননখানি শুকাইয়া পাংশু হইয়া গেল, জ্বিহার জল সরিল না।
সরলবাবুও বৎসরখানেক বিবাহ করিয়াছেন। একখানি পরমাসুন্দরী রমণীর সহিত তাঁহার এক শুভদিনে বিবাহ হইয়াছে। মনেপ্রাণে সরলবাবু তাঁহার স্ত্রীর প্রতি সকল মনোযোগ ঢালিয়া দিয়াছেন। আপন বৌয়ের কথা স্মরণ করিলেই সরলবাবুর হৃদিভ্যন্তরে ফল্গু নদী বহিয়া যায়। আপিসে থাকিয়াও চিত্ত দুর্ব্বল হইয়া যায় কখন বাড়ি ফিরিব এই ভাবনায়। এহেন সময়ে এমন কুলাঙ্গারের আগমণের খবর পাহিয়া সরলবাবু যারপরনাই ভয়ভীত হইলেন। অশনিসঙ্কেতের ভীরুতা সরলবাবুর মনের জটিলতা বাড়াইয়া তুলিল। বিস্তর ভাবিয়াও সরলবাবু এ সরলের সমাধান করিতে পারিলেন না। তাঁহার বাটীতে কেবল তাঁহার ভার্যা একাকী রহিয়াছে! বারংবার নিজ পত্নীর সুন্দর মুখখানি সরলবাবুর মানসপটে ভাসিয়া উঠিতে লাগিল। কর্ত্তব্য ও প্রেমের টানাটানিতে সরলবাবু বেজায় সমস্যায় পড়িলেন। অগত্যা বড়বাবুর নিকট তদ্বির করিয়া তিনি সেইদিন দ্বিপ্রহরেই ছুটি লইলেন এবং নিজ বাটীর পথে গমণ করিলেন।
বাটীর ভিতরে প্রবেশ করিয়াই সরলবাবুর কানে তাঁহার পত্নীর আর্তনাদ শুনাইয়া দিল। তাঁহার পত্নী যেন যাতনায় কাহিল হইয়া "আরও জোরে! আরো জোরে!" কহিয়া চিৎকার করিতেছে! তবে কী কেহ তাঁহার ধর্মপত্নীকে নিপীড়ন করিতেছে! আশঙ্কায় চিত্ত শঙ্কুল হইল সরলবাবুর। তিনি তীব্র গতিতে "রমা! ভয় নাই! ভয় নাই! আমি আসিতেছি! আমি আসিতেছি!" কহিতে কহিতে তিনতলার চিলেকোঠার পানে ধাবিত হইলেন। তিনতলায় পৌঁছাইয়া, চিলেকোঠার দরজার নিকট ক্ষণিক থামিলেন সরলবাবু। যে পাপিষ্ঠ দুরাত্মা তাঁহার পত্নীকে এমন যন্ত্রণা দিয়াছে তাহার মুখামুখি হইবার জন্যই বোধকরি একটু দম লইলেন। তাহার পর কপাটখানির উপর সজোরে ধাক্কা দিলেন।
অর্গলহীন কপাট মুহূর্তেই খুলিয়া গেল কিন্তু ভিতরের দৃশ্য দর্শন করিয়া তাঁহার বিবরের অবস্থা বিসদৃশ হইল। তাঁহার প্রাণপ্রিয়া, তাঁহার ভার্যা, তাঁহার আপন পত্নী রমাদেবী পালঙ্কের উপর সম্পূর্ণ উলঙ্গ হইয়া বসিয়া আছে। তাহার মুখ কিংকর্তব্যবিমূঢ়! স্বামীকে দেখিয়া কোনক্রমে সামনের চাদরখানি টানিয়া আপন লজ্জা নিবারণ করিল। সরলবাবু হাঁফাইতে হাঁফাইতে গৃহে প্রবেশিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "তোমারে কোন মহাপাষণ্ড নির্যাতন করিতেছিল?" শুষ্কমুখে ভীত হরিণীর ন্যয় রমা নিরুত্তর রহিল। তাহার মুখে ভয়ের আভাষ! সরলবাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, "তোমার কপালে ঘাম কেন, তুমি হাঁফাইতেছই বা কেন এবং তোমার শরীরে সামান্যতম বস্ত্রখণ্ডও বা নাই কেন?" এতগুলি প্রশ্ন করিয়া সরলবাবু ভাবিলেন হয়ত রমা এত সকল প্রশ্নের একসাথে জবাব দিতে পারিবে না। কিন্তু রমাদেবীর ওষ্ঠ সামান্য নড়িল, "আমার বুকে বিস্তর ব্যাথা হইতেছিল এবং ঘামিতেছিলাম তাই নির্বস্ত্র হইয়া তিনতলায় শুইয়াছিলাম। আমার মনে হইতেছে আমার বোধকরি হার্টফেল করিবে!" ইহা শুনিয়া সরলবাবু ঘামিয়া গেলেন। বড় সাধের উর্ব্বশী পত্নী তাঁহার রমা, উহাকে হারাইয়া তিনি কিরূপেই বা বাঁচিবেন; এই ভাবনায় সরলবাবু কাতর হইলেন! এখনি রমাকে বৈদ্যবাটী লহিয়া যাইতে হইবে, উহার আশু চিকিৎসার প্রয়োজন রহিয়াছে। এইসব ভাবনায় ভাবিত হইতে হইতে সরলবাবুর নজর নিম্নের ভূতলে পড়িল, দেখিলেন পালঙ্কের নীচ হইতে দুইখানি পা বাহির হইয়া রহিয়াছে। সরলবাবু নিম্নে ঝুঁকিয়া দেখিলেন খাটের নীচে তাঁহার পড়শী শ্যামলবাবু বস্ত্রহীন হইয়া মেঝেতে শুইয়া আছেন! ইহা দেখিয়া সরলবাবু ক্রোধান্বিত হইয়া কহিলেন, "ছিঃ! শ্যামলবাবু! ছিঃ! আমার ধর্মপত্নীর হার্টফেল হইবার দশা আর আপনি কিনা ল্যাংটো হইয়া লুকোচুরি খেলিতেছেন। পাষণ্ডতারও সীমা থাকে!"
সরলবাবু সরল ছিলেন এবং আজন্ম সরলই রহিয়া গেলেন। বৎসারাক্রান্ত হইতে না হইতে রমা এক কন্যার জন্ম দিল। সরলবাবু প্রসূতিকক্ষে রমাকে চুম্বন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন ইহার কী নাম দিবে?" রমা সলজ্জ্ব কন্ঠে কহিল, "শ্যামলী!"
(সমাপ্ত)