25-10-2022, 09:47 PM
বৃত্ত
মা চলে যাবার পর থেকেই আগের ফ্ল্যাটটা একদম ভাল লাগছিল না ঈশানের। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে বাড়িতে ফিরলেই মনে হতো ঘরটা এক্কেবারে খাঁ খাঁ করছে যেন! বাবা তো অনেক ছোটবেলা থেকেই নেই, দিম্মা আর মা ই ছিলেন ঈশানের সবকিছু। দিম্মা তবু বয়সের জ্বালায়, আর বেশ একটু ভুগেই মারা গেছিলেন, তাই সেটা মেনে নিতে পেরেছিল ঈশান। কিন্তু... মা? নাহ্! সবকিছু আরেকদিকে... আর নিজের হাতে প্রিয়তম মানুষটির দাহ করার যে অসহায়ত্ব... তা অন্যদিকে।
একা হয়ে গেলেও মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল ঈশান আপ্রাণ। এমনকি অফিসে বেশি বেশি করে সময় কাটিয়েছে। ডেডলাইনের আগেই অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে দিয়েছে। বাড়ি ফেরার জন্য ক্লান্ত শরীরে পার্কিং লটে এসেই মনে পড়েছে বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করে নেই! সেই হোম ডেলিভারির ঠান্ডা খাবার... আর বিছানায় শুয়ে এদিক ওদিক করে রাত্তিরটুকু কাটানো...
আর উইকেন্ডগুলো তো আরও খারাপ! দেরী করে ঘুম থেকে ওঠাই সার... তারপরেই মনে হতো কি হবে সারাটা দিন! মন ঠিক করার জন্য সিনেমা দেখেছে, মদ টদ খেয়েছে উইকএন্ডে... কিন্তু মনের গভীরে ঢুকে থাকা একাকীত্ব কাটেনি।
তাই শেষমেষ বাড়িটা বিক্রিই করে দিল। এমনিতেই একতলায় ফ্ল্যাটটা ছিল, একটু বৃষ্টিতেই রাস্তায় জল জমে যায়। মাকে অনেকবার বলেওছিল ঈশান, নতুন কোথাও শিফট করতে, কিন্তু মা রাজি হননি। খালি বলতেন "এই একতলাই আমার ভাল... হাঁটুতে যে ব্যথা..."।
এখন যে ফ্ল্যাটটা নিয়েছে ঈশান, সেটা ওয়ান বি এইচ কে হলেও খোলামেলা বেশ। একটা ছোট্ট বারান্দা আছে। ছুটির দিনগুলোতে ওখানে বসে বসে নিউজপেপার পড়তে, চা-সিগারেট খেতে খুব ভাল লাগে ওর। নতুন বাড়ি বলেই হয়ত এখন আর খুব একটা একা লাগে না। না, মায়ের অভাব, মায়ের গায়ের গন্ধ, মায়ের রান্না, মায়ের বকাঝকা, আবার রাতে ঘুমের মধ্যেই মা ঘরে এসে যেভাবে গায়ে চাদর দিয়ে যেতেন, ফ্যান আর এসি একসঙ্গে চলছে দেখে, সবটাই খুব মিস করে ঈশান। কিন্তু, এখন মেনে নিয়েছে "আছে দুঃখ আছে মৃত্যু।" ওর থেরাপিস্ট, মানে যাঁর কাছে ও কিছুদিন কাউন্সেলিং করেছিল উনিও ওর ইম্প্রুভমেন্ট দেখে খুব খুশি। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি বোধহয় অফিসে ওর টিম লিডার। সেদিনই হাসতে হাসতে বলছিলেন "ঈশান রে, তুই যে হারে তড়িঘড়ি অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট করছিলি, আমি তো টেনশানে পড়ে যাচ্ছিলাম যে তোকে এরপরে কি কাজ দেব!"
তবে, মোটামুটি অবস্থাটা শুধরে এলেও এই পাড়ায় সেভাবে কারো সাথে আলাপ নেই... ফ্ল্যাটেও চেনা কেউ নেই... এটাই অস্বস্তির। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে, যেখানে মেইনটেনেন্স সংক্রান্ত আলোচনা হয়, কার বাড়ির সামনে নোংরা পড়ে আছে, কে জানলা দিয়ে রাস্তার কুকুরকে বিস্কুট ছুঁড়তে গিয়ে কার মাথায় পড়েছে... কে লিফটের দরজা ঠিক করে আটকায় না... এইসব নিয়ে ঝগড়া হয় দিনভর। ঈশান ভয়ে ভয়েই ওই গ্রুপটা এড়িয়ে চলে। মাত্র আঠেরোটা ফ্ল্যাট নিয়ে বাড়ি, কিন্তু মতামত আঠেরো হাজার রকম!
আজ বিশ্বকর্মা পুজো। শনিবার, তাই অফিসও ছুটি। বেশ ফুরফুরে মনে ঘুম থেকে উঠল ঈশান। দুদিন ধরেই আকাশের মুখ ভার। পুজোটা বোধহয় এবারও গেল! একটু মনটা খারাপই হয়ে গেল ওর। একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ঈশান। ধোঁয়া ছাড়ল... আহ... শান্তি!
আর প্রায় তক্ষুণি, চোখ পড়ে গেল পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দার দিকে। ওদের এই বাড়িটা জি প্লাস সিক্স। তার ওপরে ছাদ। একেকটা ফ্লোরে তিনটে করে ফ্ল্যাট, একটা ওয়ান, একটা টু আর একটা থ্রি বি এইচ কে। আর তিনটে ফ্ল্যাটেরই বারান্দাগুলো মোটামুটি একই লাইনে তৈরি, তাই পাশের ব্যালকনির দিকে চোখ চলেই যায়।
থ্রি বি এইচ কে তে একজন ভদ্রলোক থাকেন, তিনিই আবার এই ফ্ল্যাটের সেক্রেটারি। বেশ ব্যস্ত মানুষ। ফোনে থাকতেই বেশিরভাগ সময় দেখেছে ঈশান ওঁকে।
আর টু বিএইচকেটায় একজন ভদ্রমহিলা থাকেন। ঈশানের থেকে কয়েক বছরের বড়ই হবেন। বাড়িতে আর কে আছে ও জানে না, তবে মহিলা সারা শনি-রবিবার জুড়ে "বাবাই,,বাবাই" বলে ছেলেকে ডাকতে থাকেন। ছেলেটির সাড়া পায়নি এখনও ঈশান, তবে খুব শান্ত ছেলে নিশ্চয়ই। আর, উনি বোধহয় সিঙ্গল মাদার। ওর মায়েরই মতো,,প্রায়। নইলে আর কারো আওয়াজ কেন পাওয়া যায় না বাড়িতে। যদিও মাত্রই মাস তিনেক হয়েছে ঈশান এসেছে এই ফ্ল্যাটে। কারো সাথেই আলাপ পরিচয়টুকুও হয়নি, সেক্রেটারি ভদ্রলোক ছাড়া।
"সাত সমুন্দর পার... তেরে পিছে পিছে আ গ্যায়ি" গান শুরু হয়ে গেল হঠাৎ করেই। আর একটা ইয়াব্বড় হাসি এসে গেল ঈশানের মুখে। এই গানটাকে ওর এই বিশেষ দিনটার 'অ্যান্থেম' মনে হয়!এই তো, এবার বেশ পুজো পুজো ভাব আসছে। পরের সপ্তাহে মহালয়া... তারপরেই তো...। যদিও ঈশান এবার কলকাতা থাকবে না, আগে থেকেই টিকিট কেটে রেখেছিল, পঞ্চমীর রাতেই পাড়ি দিচ্ছে নর্থবেঙ্গল।
কিন্তু পুজোর শুরু হয়ে গেল... আজ একটু স্পেশ্যাল কিছু খেলে কেমন হয়? আগে, ওই বাড়িতে থাকাকালীন রোজ হোম ডেলিভারির খাবার খেত, পেট খারাপ হয়ে যেত প্রায়ই। এখন নিজেই কিছুকিছু রান্না শিখেছে। সামান্যই... ডাল সেদ্ধ করে ফোড়ন দেওয়া, ভাত বানানো, ডিম ভাজা এইসব। তবু এখন অনেকটা ভাল আছে। ইউটিউবের একটা রান্নার চ্যানেল দেখেই শিখেছে ও, আর মনে মনে ভেবেছে "মা এতবার করে বলতেন আগে, কেন যে কিছু শিখিনি!"
সে যাই হোক, কিছুদিন আগেই ওই চ্যানেলটায় 'চিকেন পিসপাস' নামের একটি ওয়ান পট মিল শিখেছে ঈশান। খুব সোজা রান্না। আজ নাহয় সেটাই বানাবে। স্পেশ্যাল আর হেলদি, দুটোই হবে।
রেসিপি মেনে সবকিছু দিয়ে গ্যাসটা জ্বালিয়ে দিল ও। ব্যাস! এবার একটুখানির অপেক্ষা, তারপরেই এক্কেবারে ব্রাঞ্চ। এই ফাঁকে স্নানটা সেরে নিলে কেমন হয়?
স্নানের পরে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল... এদিকে প্রেশার কুকারে সিটি আর পড়ে না! খিদেও পেয়েছে জব্বর! কি হল রে বাবা!
তড়িঘড়ি একচিলতে রান্নাঘরটায় গিয়ে দেখে গ্যাস অন, কিন্তু আগুন জ্বলছে না... গ্যাস শেষ!
বাড়ি চেঞ্জের সময়ে মায়ের নাম থেকে নিজের নামে ট্রান্সফার করেছিল গ্যাস ঈশান। তখনই একেবারে দুটো গ্যাসই রিফিল হয়ে গেছিল। এতদিন প্রথম গ্যাসটাই চলেছে... আজ শেষ হল... কিন্তু ও যে গ্যাস সিলিন্ডার লাগাতে পারে না! কি হবে! এদিকে এত খাবার... সব প্রেশার কুকারে বসানো... নষ্ট হবে? খিদেও পেয়েছে খুব... এখন অর্ডার দিলে আসতে আসতেই জাস্ট মরে যাবে ঈশান...
কেন যে এটুকুও শেখেনি ও! মা কতবার বলেছেন...
বাধ্য হয়েই পাশের ফ্ল্যাটে গেল ঈশান। সেক্রেটারি কাকু বলেছিলেন "কোনোরকম দরকারে বলো"... আর আজ তো মহা দরকার... এক্কেবারে পেটের দায়!
"সান্যালদারা কেউ নেই..." আওয়াজ শুনে চমকে উঠল ঈশান।
টু বিএইচকের মেয়েটি।
"নেই? তাহলে কি হবে?" বোকার মতো বলে উঠল ও।
মেয়েটিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যেন। তারপর বলল "কিছু দরকার ছিল...মানে যদি আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে..."
"ইয়ে... আসলে আমার গ্যাস শেষ হয়ে গেছে..."
"ও হো! আমাদের এখানের ডিষ্ট্রিবিউটারের নাম্বার নেই আপনার কাছে? যদিও আজ তো পাওয়া যাবে না... পুজোর দিন... কাল হয়ত..." বলে ওঠে মেয়েটি।
"না না, আমার আছে... মানে আরেকটা সিলিন্ডার আছে। কিন্তু আমি লাগাতে পারি না..." অসহায় গলায় বলল ঈশান।
"আচ্ছা... আমি লাগিয়ে দেব? আমি পারি।"
"দেবেন?"
"শিওর!" বলেই ঘরের ভিতরে তাকিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে "বাবাই, আমি এক্ষুণি আসছি, এই আঙ্কেলের বাড়ি থেকে, কেমন?"
"আপনার ছেলে কিন্তু খুব শান্ত, কোনো আওয়াজই করে না। খুব লক্ষ্মী ছেলে।" সিলিন্ডার পাল্টানোর পরে বলল ঈশান।
"হ্যাঁ, খুব শান্ত! আসলে রেসকিউড বাচ্চা তো! এখনও ট্রমার মধ্যে থাকে। আমি কাছে বেশিক্ষণ না থাকলেই ভয় পায়, ভাবে আমিও যদি ছেড়ে যাই! "
"রেসকিউড বাচ্চা?"
"হ্যাঁ... ওর আগের মালিক একটা চায়ের দোকানে ফেলে রেখে গেছিল... সেই থেকেই আমার কাছে... যদিও আমাকেই একরকম রেসকিউ করেছে ও।"
"মালিক মানে?"
"মানে... ওহ্, আপনি বোঝেননি না? ও আসলে বার্ক করে না খুব একটা তো... ও তো আমার চারপেয়ে সন্তান... বয়স হয়ে গেছিল, ওর আগের মালিক... জাস্ট ফেলে গেছিল ওকে, জানেন? সারা গায়ে পোকা... কিছু খেত না... সেই থেকে আমার কাছে... আমার সবটা জুড়ে আছে ও..."
"ও হো... না আমি জানতাম না..."
"আসুন না, আলাপ করবেন। যদিও ও এখনও আমাকে আর আমার যে দিদি আসেন, সারাদিন থাকেন, সেই রীতাদি ছাড়া কাউকে এখনও ভরসা করতে পারে না... ভয় পায়..."
"আর আপনার বাড়ির অন্য লোকজনেদের?" অভদ্রতা জেনেও জিজ্ঞেস করে ফেলে ঈশান।
খুব ইন্টারেস্টিং মহিলা তো!
"অন্য আর কেউ নেই আসলে আমার। মা -বাবা কেউ নেই। আর একজন ছিল, কিন্তু ছিলও না... তাই তাকেও মুক্তি দিয়েছি।" হাসতে হাসতেই বলল মেয়েটি। কিন্তু চোখে যেন গভীর বিষাদ!
"আই অ্যাম স্যরি।" মাথা নাড়ে ঈশান।
"প্লিজ ডোন্ট বী! আই অ্যাম নট স্যরি। ভুল সময়ে, একজন ভুল মানুষকে ভালবেসেছিলাম বড্ড। সংসার পেতেছিলাম অনেক স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সে আমাকে আমার এই মোটাসোটা শরীরটার বাইরে আর কিছুই ভাবতে পারেনি। তাই আমার একটা সামান্য পরীক্ষাতেও পাশ করতে পারেনি। তা... আগে কষ্ট ছিল একটা... এখন আর নেই! এভাবেই ভাল আছি আমি। আর, আমার ছোট্ট বাবাই সোনা তো আছেই..."।
"দেখুন, আত্মসম্মানের চেয়ে বড় আর কিছু হয় না। আর... আপনি মোটাসোটা না... আমার এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে না... কিন্তু না বলে থাকতেও পারছি না... আপনি বিখ্যাত পেইন্টার রুবেনের পেইন্টিং এর মতো... আপনি... আপনি 'রুবেনেস্ক'..."
"রুবেনেস্ক মানে?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি।
"প্লিজ, গুগলে দেখে নেবেন। আর যেভাবে আমাকে হেল্প করলেন, অযাচিতভাবে... তাতে বোঝা যায়, ইউ আর আ ভেরী কাইন্ড লেডি। ইউ আর র্যাদার এনচ্যানটিং!" এভাবে... কতবছর কাউকে বলেনি কিছু ঈশান...
"আপনার নামটাই তো জানা হলো না" বলে উঠল মেয়েটি। একটু একটু ব্লাশ করছে যেন!
"আমার নাম ঈশান। মা অবশ্য 'ভোলা' বলে ডাকতেন, শিবের নাম বলে"। আগে ভোলা নামটায় লজ্জা পেত ঈশান, এখন ভাল লাগে!
"ঈশান! খুব সুন্দর নাম।"
"আর আপনি?" বড্ড ইচ্ছে করছে নামটা জানতে...
"দয়িতা। দয়িতা সেন। মাঝে কিছুদিন 'মিত্র' হয়েছিলাম যদিও।"
দয়িতার দিকে ভাল করে একবার তাকাল ঈশান।
তারপর এক পা এগিয়ে গেল।
বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে...
তারপর যদি কিছু... কখনও কিছু....
দুজনেই যে বড় একা!
আর ভালবাসা না পাওয়া, ভালবাসা না দেওয়া - দুইইই যে বড় কষ্টের...
পাড়ায় তখনই কারা যেন চেঁচিয়ে বলে উঠল "ভোওওওকাট্টা....!"
মা চলে যাবার পর থেকেই আগের ফ্ল্যাটটা একদম ভাল লাগছিল না ঈশানের। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে বাড়িতে ফিরলেই মনে হতো ঘরটা এক্কেবারে খাঁ খাঁ করছে যেন! বাবা তো অনেক ছোটবেলা থেকেই নেই, দিম্মা আর মা ই ছিলেন ঈশানের সবকিছু। দিম্মা তবু বয়সের জ্বালায়, আর বেশ একটু ভুগেই মারা গেছিলেন, তাই সেটা মেনে নিতে পেরেছিল ঈশান। কিন্তু... মা? নাহ্! সবকিছু আরেকদিকে... আর নিজের হাতে প্রিয়তম মানুষটির দাহ করার যে অসহায়ত্ব... তা অন্যদিকে।
একা হয়ে গেলেও মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল ঈশান আপ্রাণ। এমনকি অফিসে বেশি বেশি করে সময় কাটিয়েছে। ডেডলাইনের আগেই অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে দিয়েছে। বাড়ি ফেরার জন্য ক্লান্ত শরীরে পার্কিং লটে এসেই মনে পড়েছে বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করে নেই! সেই হোম ডেলিভারির ঠান্ডা খাবার... আর বিছানায় শুয়ে এদিক ওদিক করে রাত্তিরটুকু কাটানো...
আর উইকেন্ডগুলো তো আরও খারাপ! দেরী করে ঘুম থেকে ওঠাই সার... তারপরেই মনে হতো কি হবে সারাটা দিন! মন ঠিক করার জন্য সিনেমা দেখেছে, মদ টদ খেয়েছে উইকএন্ডে... কিন্তু মনের গভীরে ঢুকে থাকা একাকীত্ব কাটেনি।
তাই শেষমেষ বাড়িটা বিক্রিই করে দিল। এমনিতেই একতলায় ফ্ল্যাটটা ছিল, একটু বৃষ্টিতেই রাস্তায় জল জমে যায়। মাকে অনেকবার বলেওছিল ঈশান, নতুন কোথাও শিফট করতে, কিন্তু মা রাজি হননি। খালি বলতেন "এই একতলাই আমার ভাল... হাঁটুতে যে ব্যথা..."।
এখন যে ফ্ল্যাটটা নিয়েছে ঈশান, সেটা ওয়ান বি এইচ কে হলেও খোলামেলা বেশ। একটা ছোট্ট বারান্দা আছে। ছুটির দিনগুলোতে ওখানে বসে বসে নিউজপেপার পড়তে, চা-সিগারেট খেতে খুব ভাল লাগে ওর। নতুন বাড়ি বলেই হয়ত এখন আর খুব একটা একা লাগে না। না, মায়ের অভাব, মায়ের গায়ের গন্ধ, মায়ের রান্না, মায়ের বকাঝকা, আবার রাতে ঘুমের মধ্যেই মা ঘরে এসে যেভাবে গায়ে চাদর দিয়ে যেতেন, ফ্যান আর এসি একসঙ্গে চলছে দেখে, সবটাই খুব মিস করে ঈশান। কিন্তু, এখন মেনে নিয়েছে "আছে দুঃখ আছে মৃত্যু।" ওর থেরাপিস্ট, মানে যাঁর কাছে ও কিছুদিন কাউন্সেলিং করেছিল উনিও ওর ইম্প্রুভমেন্ট দেখে খুব খুশি। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি বোধহয় অফিসে ওর টিম লিডার। সেদিনই হাসতে হাসতে বলছিলেন "ঈশান রে, তুই যে হারে তড়িঘড়ি অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট করছিলি, আমি তো টেনশানে পড়ে যাচ্ছিলাম যে তোকে এরপরে কি কাজ দেব!"
তবে, মোটামুটি অবস্থাটা শুধরে এলেও এই পাড়ায় সেভাবে কারো সাথে আলাপ নেই... ফ্ল্যাটেও চেনা কেউ নেই... এটাই অস্বস্তির। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে, যেখানে মেইনটেনেন্স সংক্রান্ত আলোচনা হয়, কার বাড়ির সামনে নোংরা পড়ে আছে, কে জানলা দিয়ে রাস্তার কুকুরকে বিস্কুট ছুঁড়তে গিয়ে কার মাথায় পড়েছে... কে লিফটের দরজা ঠিক করে আটকায় না... এইসব নিয়ে ঝগড়া হয় দিনভর। ঈশান ভয়ে ভয়েই ওই গ্রুপটা এড়িয়ে চলে। মাত্র আঠেরোটা ফ্ল্যাট নিয়ে বাড়ি, কিন্তু মতামত আঠেরো হাজার রকম!
আজ বিশ্বকর্মা পুজো। শনিবার, তাই অফিসও ছুটি। বেশ ফুরফুরে মনে ঘুম থেকে উঠল ঈশান। দুদিন ধরেই আকাশের মুখ ভার। পুজোটা বোধহয় এবারও গেল! একটু মনটা খারাপই হয়ে গেল ওর। একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ঈশান। ধোঁয়া ছাড়ল... আহ... শান্তি!
আর প্রায় তক্ষুণি, চোখ পড়ে গেল পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দার দিকে। ওদের এই বাড়িটা জি প্লাস সিক্স। তার ওপরে ছাদ। একেকটা ফ্লোরে তিনটে করে ফ্ল্যাট, একটা ওয়ান, একটা টু আর একটা থ্রি বি এইচ কে। আর তিনটে ফ্ল্যাটেরই বারান্দাগুলো মোটামুটি একই লাইনে তৈরি, তাই পাশের ব্যালকনির দিকে চোখ চলেই যায়।
থ্রি বি এইচ কে তে একজন ভদ্রলোক থাকেন, তিনিই আবার এই ফ্ল্যাটের সেক্রেটারি। বেশ ব্যস্ত মানুষ। ফোনে থাকতেই বেশিরভাগ সময় দেখেছে ঈশান ওঁকে।
আর টু বিএইচকেটায় একজন ভদ্রমহিলা থাকেন। ঈশানের থেকে কয়েক বছরের বড়ই হবেন। বাড়িতে আর কে আছে ও জানে না, তবে মহিলা সারা শনি-রবিবার জুড়ে "বাবাই,,বাবাই" বলে ছেলেকে ডাকতে থাকেন। ছেলেটির সাড়া পায়নি এখনও ঈশান, তবে খুব শান্ত ছেলে নিশ্চয়ই। আর, উনি বোধহয় সিঙ্গল মাদার। ওর মায়েরই মতো,,প্রায়। নইলে আর কারো আওয়াজ কেন পাওয়া যায় না বাড়িতে। যদিও মাত্রই মাস তিনেক হয়েছে ঈশান এসেছে এই ফ্ল্যাটে। কারো সাথেই আলাপ পরিচয়টুকুও হয়নি, সেক্রেটারি ভদ্রলোক ছাড়া।
"সাত সমুন্দর পার... তেরে পিছে পিছে আ গ্যায়ি" গান শুরু হয়ে গেল হঠাৎ করেই। আর একটা ইয়াব্বড় হাসি এসে গেল ঈশানের মুখে। এই গানটাকে ওর এই বিশেষ দিনটার 'অ্যান্থেম' মনে হয়!এই তো, এবার বেশ পুজো পুজো ভাব আসছে। পরের সপ্তাহে মহালয়া... তারপরেই তো...। যদিও ঈশান এবার কলকাতা থাকবে না, আগে থেকেই টিকিট কেটে রেখেছিল, পঞ্চমীর রাতেই পাড়ি দিচ্ছে নর্থবেঙ্গল।
কিন্তু পুজোর শুরু হয়ে গেল... আজ একটু স্পেশ্যাল কিছু খেলে কেমন হয়? আগে, ওই বাড়িতে থাকাকালীন রোজ হোম ডেলিভারির খাবার খেত, পেট খারাপ হয়ে যেত প্রায়ই। এখন নিজেই কিছুকিছু রান্না শিখেছে। সামান্যই... ডাল সেদ্ধ করে ফোড়ন দেওয়া, ভাত বানানো, ডিম ভাজা এইসব। তবু এখন অনেকটা ভাল আছে। ইউটিউবের একটা রান্নার চ্যানেল দেখেই শিখেছে ও, আর মনে মনে ভেবেছে "মা এতবার করে বলতেন আগে, কেন যে কিছু শিখিনি!"
সে যাই হোক, কিছুদিন আগেই ওই চ্যানেলটায় 'চিকেন পিসপাস' নামের একটি ওয়ান পট মিল শিখেছে ঈশান। খুব সোজা রান্না। আজ নাহয় সেটাই বানাবে। স্পেশ্যাল আর হেলদি, দুটোই হবে।
রেসিপি মেনে সবকিছু দিয়ে গ্যাসটা জ্বালিয়ে দিল ও। ব্যাস! এবার একটুখানির অপেক্ষা, তারপরেই এক্কেবারে ব্রাঞ্চ। এই ফাঁকে স্নানটা সেরে নিলে কেমন হয়?
স্নানের পরে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল... এদিকে প্রেশার কুকারে সিটি আর পড়ে না! খিদেও পেয়েছে জব্বর! কি হল রে বাবা!
তড়িঘড়ি একচিলতে রান্নাঘরটায় গিয়ে দেখে গ্যাস অন, কিন্তু আগুন জ্বলছে না... গ্যাস শেষ!
বাড়ি চেঞ্জের সময়ে মায়ের নাম থেকে নিজের নামে ট্রান্সফার করেছিল গ্যাস ঈশান। তখনই একেবারে দুটো গ্যাসই রিফিল হয়ে গেছিল। এতদিন প্রথম গ্যাসটাই চলেছে... আজ শেষ হল... কিন্তু ও যে গ্যাস সিলিন্ডার লাগাতে পারে না! কি হবে! এদিকে এত খাবার... সব প্রেশার কুকারে বসানো... নষ্ট হবে? খিদেও পেয়েছে খুব... এখন অর্ডার দিলে আসতে আসতেই জাস্ট মরে যাবে ঈশান...
কেন যে এটুকুও শেখেনি ও! মা কতবার বলেছেন...
বাধ্য হয়েই পাশের ফ্ল্যাটে গেল ঈশান। সেক্রেটারি কাকু বলেছিলেন "কোনোরকম দরকারে বলো"... আর আজ তো মহা দরকার... এক্কেবারে পেটের দায়!
"সান্যালদারা কেউ নেই..." আওয়াজ শুনে চমকে উঠল ঈশান।
টু বিএইচকের মেয়েটি।
"নেই? তাহলে কি হবে?" বোকার মতো বলে উঠল ও।
মেয়েটিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যেন। তারপর বলল "কিছু দরকার ছিল...মানে যদি আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে..."
"ইয়ে... আসলে আমার গ্যাস শেষ হয়ে গেছে..."
"ও হো! আমাদের এখানের ডিষ্ট্রিবিউটারের নাম্বার নেই আপনার কাছে? যদিও আজ তো পাওয়া যাবে না... পুজোর দিন... কাল হয়ত..." বলে ওঠে মেয়েটি।
"না না, আমার আছে... মানে আরেকটা সিলিন্ডার আছে। কিন্তু আমি লাগাতে পারি না..." অসহায় গলায় বলল ঈশান।
"আচ্ছা... আমি লাগিয়ে দেব? আমি পারি।"
"দেবেন?"
"শিওর!" বলেই ঘরের ভিতরে তাকিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে "বাবাই, আমি এক্ষুণি আসছি, এই আঙ্কেলের বাড়ি থেকে, কেমন?"
"আপনার ছেলে কিন্তু খুব শান্ত, কোনো আওয়াজই করে না। খুব লক্ষ্মী ছেলে।" সিলিন্ডার পাল্টানোর পরে বলল ঈশান।
"হ্যাঁ, খুব শান্ত! আসলে রেসকিউড বাচ্চা তো! এখনও ট্রমার মধ্যে থাকে। আমি কাছে বেশিক্ষণ না থাকলেই ভয় পায়, ভাবে আমিও যদি ছেড়ে যাই! "
"রেসকিউড বাচ্চা?"
"হ্যাঁ... ওর আগের মালিক একটা চায়ের দোকানে ফেলে রেখে গেছিল... সেই থেকেই আমার কাছে... যদিও আমাকেই একরকম রেসকিউ করেছে ও।"
"মালিক মানে?"
"মানে... ওহ্, আপনি বোঝেননি না? ও আসলে বার্ক করে না খুব একটা তো... ও তো আমার চারপেয়ে সন্তান... বয়স হয়ে গেছিল, ওর আগের মালিক... জাস্ট ফেলে গেছিল ওকে, জানেন? সারা গায়ে পোকা... কিছু খেত না... সেই থেকে আমার কাছে... আমার সবটা জুড়ে আছে ও..."
"ও হো... না আমি জানতাম না..."
"আসুন না, আলাপ করবেন। যদিও ও এখনও আমাকে আর আমার যে দিদি আসেন, সারাদিন থাকেন, সেই রীতাদি ছাড়া কাউকে এখনও ভরসা করতে পারে না... ভয় পায়..."
"আর আপনার বাড়ির অন্য লোকজনেদের?" অভদ্রতা জেনেও জিজ্ঞেস করে ফেলে ঈশান।
খুব ইন্টারেস্টিং মহিলা তো!
"অন্য আর কেউ নেই আসলে আমার। মা -বাবা কেউ নেই। আর একজন ছিল, কিন্তু ছিলও না... তাই তাকেও মুক্তি দিয়েছি।" হাসতে হাসতেই বলল মেয়েটি। কিন্তু চোখে যেন গভীর বিষাদ!
"আই অ্যাম স্যরি।" মাথা নাড়ে ঈশান।
"প্লিজ ডোন্ট বী! আই অ্যাম নট স্যরি। ভুল সময়ে, একজন ভুল মানুষকে ভালবেসেছিলাম বড্ড। সংসার পেতেছিলাম অনেক স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সে আমাকে আমার এই মোটাসোটা শরীরটার বাইরে আর কিছুই ভাবতে পারেনি। তাই আমার একটা সামান্য পরীক্ষাতেও পাশ করতে পারেনি। তা... আগে কষ্ট ছিল একটা... এখন আর নেই! এভাবেই ভাল আছি আমি। আর, আমার ছোট্ট বাবাই সোনা তো আছেই..."।
"দেখুন, আত্মসম্মানের চেয়ে বড় আর কিছু হয় না। আর... আপনি মোটাসোটা না... আমার এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে না... কিন্তু না বলে থাকতেও পারছি না... আপনি বিখ্যাত পেইন্টার রুবেনের পেইন্টিং এর মতো... আপনি... আপনি 'রুবেনেস্ক'..."
"রুবেনেস্ক মানে?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি।
"প্লিজ, গুগলে দেখে নেবেন। আর যেভাবে আমাকে হেল্প করলেন, অযাচিতভাবে... তাতে বোঝা যায়, ইউ আর আ ভেরী কাইন্ড লেডি। ইউ আর র্যাদার এনচ্যানটিং!" এভাবে... কতবছর কাউকে বলেনি কিছু ঈশান...
"আপনার নামটাই তো জানা হলো না" বলে উঠল মেয়েটি। একটু একটু ব্লাশ করছে যেন!
"আমার নাম ঈশান। মা অবশ্য 'ভোলা' বলে ডাকতেন, শিবের নাম বলে"। আগে ভোলা নামটায় লজ্জা পেত ঈশান, এখন ভাল লাগে!
"ঈশান! খুব সুন্দর নাম।"
"আর আপনি?" বড্ড ইচ্ছে করছে নামটা জানতে...
"দয়িতা। দয়িতা সেন। মাঝে কিছুদিন 'মিত্র' হয়েছিলাম যদিও।"
দয়িতার দিকে ভাল করে একবার তাকাল ঈশান।
তারপর এক পা এগিয়ে গেল।
বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে...
তারপর যদি কিছু... কখনও কিছু....
দুজনেই যে বড় একা!
আর ভালবাসা না পাওয়া, ভালবাসা না দেওয়া - দুইইই যে বড় কষ্টের...
পাড়ায় তখনই কারা যেন চেঁচিয়ে বলে উঠল "ভোওওওকাট্টা....!"