Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
মুক্তি

 
কাল রাত্তিরে বাড়ি ফিরেই শুয়ে পড়েছিলেন শামিমা।
খুব টায়ারিং একটা দিন গেছে কাল!
সকালে বাড়িতে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন - সাদা সালোয়ার কামিজ পরে। ওঁর সোশ্যাল মিডিয়া টিম ভিডিও বানিয়েছে যত্ন করে। তারপর মানানসই গান বসিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোড করেছে। পতাকা উত্তোলনের মতো আবেগপূর্ণ কাজ হলেও প্রায় শ্যুট করার মতো করেই হয়েছে - তিনবার রিটেকও করতে হয়েছে। বেস্ট অফ থ্রি! যে ভিডিওতে এক্সপ্রেশান সবচেয়ে ভাল এসেছে, সেটাকেই আরও একটু এডিট, কালার কারেকশান করতে হয়েছে টিমকে।
এরপরে একটা রেস্তোরাঁয় যেতে হয়েছিল, গেস্ট হিসেবে। সেখানে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ফুড ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়েছে - সেখানে স্পেশ্যাল অ্যাপিয়ারেন্স। সন্ধ্যেবেলা সরকারের পক্ষ থেকে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে যেতে হয়েছিল।
ক্লান্ত লাগে আজকাল শামিমার। কিন্তু... কিছু যে করার নেই!
কোনো একটা অনুষ্ঠানে না গেলেই পিছিয়ে পড়তে হবে ইঁদুর দৌড়ে। এমনিতেই এখন একঝাঁক নতুন ছেলেমেয়ে এসে গেছে অভিনয় জগতে। সিনেমা থেকে ওয়েবসিরিজ - দাপিয়ে অভিনয় করছে তারা। এরমধ্যে শামিমার মতো অভিনেত্রীরা টিকে আছেন বেশিরভাগই এন্ডোর্সমেন্ট, অর্থাৎ বিজ্ঞাপনের জেরে। আর বিজ্ঞাপন করতে গেলে দরকার পাবলিক, সাধারণ মানুষের চোখের সামনে থাকা। তারজন্য চাই জনসংযোগ। সেজন্যই ছোট ছোট ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেওয়া... বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া... যাতে প্রেস কভারেজ পাওয়া যায়...
তবে, বয়স হচ্ছে - আজকাল খুব ক্লান্ত লাগে শামিমার!
মেঘে মেঘে তো কম বেলা হল না! মাত্র আঠেরো বছর বয়সেই প্রথম সুযোগ মিলেছিল, একটি বাংলা ছবিতে, নায়িকার বোন হিসেবে। নাচের ওপর ছিল ছবিটি। ছোটবেলা থেকেই নাচের তালিম নেবার সূত্রে নাচ এবং অভিব্যক্তি - দুইই ভাল লেগেছিল দর্শকদের। তারপর আরেকটি বাংলা ছবি করে পাড়ি দিয়েছিলেন মুম্বাইতে। মা খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, সবসময় বলতেন "তোকে পারতেই হবে। রূপ-গুন সবার থাকে না। তোর আছে, পারবি তুই।"
তা, মায়ের কথাতেই হোক, বা ভাগ্যের জেরে, বিখ্যাত বিনায়ক ফিল্মসের চোখে পড়ে গেছিলেন উনি। তারপর... লম্বা পথ। কখনও চড়াই, কখনও বা শুধুই হতাশা। এভাবেই যে কিভাবে এতগুলো বছর কেটে গেল...
আঠেরোয় শুরু করেছিলেন 'নর্তকী' দিয়ে, তারপর হিন্দিতে প্রথম সুপারহিট 'ঝুটি মনজিল' 'দেশভক্ত', 'খিলোনা' 'নদীয়া পার' 'মোহে রং দে' - মাঝের বাইশ বছরে হিট ছবি ঝুলিতে কম নেই ওঁর। তবে এখন... ক্লান্ত লাগে মাঝেমাঝেই। বাইশ বছর ধরে একটানা চলছে তো চলছেই। তবে কাজ না থাকার থেকে কাজ করে ক্লান্ত হওয়া ভাল। নইলে যে কি হবে...
আগেকার দিনে নাকি নায়িকারা নিজেদের আসল বয়স বলতেন না কিছুতেই। কিন্তু এখন ইন্টারনেটের যুগ - কিছুই লুকোনো থাকে না। তাই বছর পাঁচেক আগে ওঁর পি আর টিমের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ওঁকে 'এভারগ্রীন বিউটি' হিসেবে প্রোজেক্ট করা হবে। বলা হবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, যোগব্যায়াম - এসব করেই তরতাজা আছেন উনি। চল্লিশ ছুঁইছুঁই চেহারাতেও তারুণ্যের ঝলক। মোমমসৃন ত্বক। ক্ষীনকটি। এভাবে প্রোজেক্ট করার সুফলও পাওয়া গেছিল অচিরেই। এখন নিজের পোষাক লাইন, মেকআপ সামগ্রী এবং যোগব্যায়াম শেখানোর অ্যাপ - সবই আছে ওঁর।
সবই আছে - তাও যেন কিছুই নেই!
বিছানা থেকে উঠে একটু স্ট্রেচিং করলেন শামিমা। একটু স্পট জাম্পিং। অন্যান্যদিন মুখ হাত ধুয়ে যোগব্যায়াম করেন বা জিমে যান উনি। সেখানেও ফটো শুট হয়। যেমন আজ বাড়ির লনে ম্যাট পেতে ব্যায়াম করার পালা। ওঁর টিমের একজন তার ভিডিও করবে। সেটা পার্ট করে করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়া হবে। এসবই প্ল্যানের অঙ্গ। কোনও কোনওদিন জিমে যাবার সময় পাপারাৎজিরা দাঁড়িয়ে থাকেন, সেদিন ইচ্ছে করেই একটু অন্যরকম জামা-কাপড় পরতে হয়। সবই নিউজে থাকার জন্য...
অথচ আজকাল সত্যি একটু অন্যভাবে জীবন কাটাতে ইচ্ছে করে ওঁর। মনে হয় কদিনের জন্য সাধারণ একটা মেয়ে হয়ে ঘুরে বেড়াতে। বেশ একটা পাহাড়ি এলাকায় ছোট্ট হোমস্টে হবে... কাছেই কোথাও কুলুকুলু বয়ে যাবে নদী। কাঠের বারান্দায় বসে পাহাড়ের রংবদল দেখতে দেখতেই সময় কেটে যাবে। মাঝে মাঝে কফির কাপে চুমুক। ইচ্ছে হলে যে বইটা লেখার ইচ্ছে অনেকদিন - সেই বইটার দুটো একটা পরিচ্ছদ লেখা... আর ইচ্ছেমত খাবার, দেদার ঘুম!
গত কয়েকবছর ধরেই এরকম ইচ্ছে করে, কিন্তু হয় আর কোথায়!
মাকে বললেই বলবেন "বেশ তো, ইউরোপে হলিডে করে এসো।" পি আর টিম টাই-আপ প্রোপোজাল নিয়ে আসবে। বেড়াতে গিয়েও সেইসব প্রোডাক্টকে প্রোমোট করতে হবে। সেইসব হোটেলেই থাকতে হবে। ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে হবে। নিজের মতো করে নিজের জীবন কাটানোর স্বাধীনতা একেবারেই নেই ওঁর। এমনকি কিছু লিখতে চান, এমনটা মা কে বলার পরে মা বলেছিলেন "বেশ বেশ - হেলদি ফুড হ্যাবিট আর লাইফস্টাইলের ওপর লেখ। বা ওয়েট লস। পাবলিক এগুলোই চায়।" ওঁর টিমও সহমত হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। 'ডিভা' লেখা 'বেঙ্গলি' উপন্যাসের থেকে এইধরণের বইয়ের বাজার অনেক ভাল। পেপারব্যাক আর কিন্ডল এডিশান বের করা হবে... ব্র্যান্ডিং আরও ভাল হবে।
আর শামিমার চাওয়া? নাহ্, সে তো সব বন্ধক রেখেছে...
ষাট পেরিয়েও মা প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী এখনও। উঠতে বসতে বুঝিয়ে দিতে কসুর করেন না শামিমা 'শামিমা' হয়েছেন ওঁর জন্য। মাঝেমাঝে যে শামিমা প্রতিবাদ করেননি তা না। বলে উঠেছেন "আর আমার ট্যালেন্ট, আম্মি? সেটা কিছু না?" মা হাত নেড়ে বলে উঠেছেন "ওরকম ট্যালেন্ট কতলোকের থাকে! সবাই কি তোর মতো হতে পারে? দেখ মেয়ে, টাকা- টাকা! টাকার চেয়ে বড় দোস্ত -ইয়ার কেউ নয়। আর এটাই খাটার বয়স! খেটে যা।" আবার কখনও চোখে জল এনে বলেছেন "কার জন্য বলি এসব? তোর জন্যই তো... আজ তোর আব্বু থাকলে..." কথা শেষ হবার আগেই হার মেনে নেন শামিমা। কুমাতা যে কেউ হতে পারেন না!
এভাবেই চলে এসেছে জীবন। কখনও পচা শামুকে পা কেটেছে। কখনও বা হৃদয় ভেঙেছে। হ্যাঁ, কাকে ভালবাসবে, কাকে না - মা নির্ধারণ করে দিয়েছেন সবটাই। তাই বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও সাহিলের সাথে ফ্লার্ট করতে হয়েছে শামিমাকে, যাতে ওঁর ছবির লিড রোল পাওয়া যায়। আবার 'মিডিওকার' অভিজিৎকে - বলা হয়নি, বলতে পারা যায় নি কিছুই... অথচ, সেই গভীর বাঙ্ময় চোখদুটি... ভুলতে পারেননি আজও।
এখন অবশ্য মেনেই নিয়েছেন উনি। প্রেমহীন একটা জীবন কাটাতে হবে। অর্থসর্বস্ব এবং অর্থহীন একটি জীবন! তবে, সেই জীবনও এখন ব্র্যান্ডিং হবার অপেক্ষায়। এভারগ্রিন এবং লোনলি বিউটি। নিঃসঙ্গ সুন্দরী!
ব্রাশ করে চোখে মুখে জল দিতে দিতে নিজেকে দেখছিলেন শামিমা। চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আর... কিছু ফাইন লাইনস! চল্লিশ আসছে যে!
'চল্লিশ' শব্দটি মনে পড়তেই গতকালের সন্ধ্যা মনে পড়ে গেল শামিমার। ঝাঁ চকচকে হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনেকদিন পরে দেখা হয়েছিল সেতারবাদক পন্ডিত আজহার খাঁ সাহেবের সঙ্গে। উনি প্রায় চল্লিশবছর ধরে বাজাচ্ছেন! তবে এখন আর অনুষ্ঠানে বাজান না। কাল বলছিলেন "কোনো দুঃখ নেই আমার জানো! নো রিগ্রেট অ্যাট অল! আই লিভড মাই লাইফ অ্যাজ পার মাই উইশ! যতদিন ইচ্ছে হয়েছে সবার জন্য বাজিয়েছি। এখন নিজের জন্য বাজাই...একা... কাউকে অ্যালাও করি না। পরিবারকে যা দেবার, সব দেওয়া হয়ে গেছে।" বলতে বলতে হাসছিলেন উনি। চোখে মুখে কত বলিরেখা - তবু সে হাসি তারার মতো উজ্জ্বল!
একটু হাসলেন শামিমা।
তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন।
অনেকটাই তো করেছেন উনিও। অভিনয় কমে এলেও ব্যবসা থেকে আয় মন্দ না। এবার থেকে অন্তত নিজের জীবনের রাশটা নিজের হাতে নিলে হয় না? চলে যাবে ঠিকই, বরং আজকাল যে নিজেকে পন্য মনে হয় - সেটা থেকে মুক্ত হবে।
মা! আম্মি!
হ্যাঁ, আম্মি সত্যিই অনেক করেছেন। নইলে এতদিন হয়ত কোথায় কোন মাঝবয়সী লোকের বিবি হয়ে সংসার সামলাতে ব্যস্ত থাকত। কিন্তু সেজন্য তো এতগুলো বছর কেটে গেল! বাইশ বছর! দ্য গোল্ডেন ইয়ার্স!
মুখটা ভাল করে মুছে বাইরে এলেন শামিমা। ব্যায়ামের পোষাক পরলেন। এইসময়েও ওঁকে হাল্কা মেক আপ করতে হয়। চোখের কালি, স্পট ঢাকার জন্য কনসিলার... গালে রক্তিম আভার জন্য চিক টিন্ট! ভিডিওতে যাতে সুন্দর লাগে। অথচ আর পাঁচজন কি ব্যায়াম করার আগে সাজগোজ করেন?
এক্কেবারে তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলেন উনি ঘর থেকে। মা দেখে অবাক হয়ে বললেন "কেমন একটা লাগছে আজ তোকে! গালটা শুকনো?"
"তাই? আসলে আজ মুখে কিছু লাগাইনি... তাই হয়ত।" হেসে বলে ওঠে ও।
"ওমা! কেন? তাই তো কেমন একটা লাগছে।" বলেন মা।
"কেমন লাগছে আম্মি?"
"কেমন আর... একটু বুড়োটে..." মা বরাবরই স্ট্রেট ফরোয়ার্ড!
"তা তো হবেই আম্মি! আমি কি আর ইয়াং আছি! বয়স বাড়ছে না আমার? " খুব মজা হচ্ছে আজ শামিমার।
"এভাবে কেউ দেখে ফেললে?" যেন শিউরে ওঠেন মা।
"বাহ্, তাতে কি হয়েছে? আমিই না ইন্টারভিউতে বলি আত্মবিশ্বাসের চেয়ে বেশি কিচ্ছু হয় না! কনফিডেন্স ইজ দ্যা বেস্ট মেক আপ? তা আমি তো কনফিডেন্ট, তাহলে আর কিসের সমস্যা?"
"হায় আল্লা! পাগল হয়ে গেছিস নাকি তুই?"
"না মা, পাগল ছিলাম... গোলাপী চশমা পরা পাগল... এখন সুস্থ হচ্ছি..." হাসতে হাসতে বলেন শামিমা।
সামনে অনেক কাজ...
বেড়াতে যাবেন খুব শিগগিরি... নিজের পছন্দের জায়গায়... একা! কোনো ছবি থাকবে না সেখানে - শুধুই ছবির মতো কিছু দিন...
একটা কবিতার বই...
সাদা খাতা একটা...
আর... অভিজিৎ কে একবার ফোন করা... কোনো কিছুর আশা না করে... শুধু নিজের কথাটা বলার জন্য....
চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেন শামিমা...
বাতাসে স্বাধীনতার গন্ধ...

Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 22-10-2022, 10:38 AM



Users browsing this thread: 15 Guest(s)