20-10-2022, 07:49 PM
*******প্রত্যাবর্তন*******
কিছুটা বাধ্য হয়েই প্রতুল আজ তার মাকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে। আজ প্রায় পাঁচ বছর পর বিমলাদেবী ফিরেছেন নিজের বাড়ি----- ছেলে আর বৌমার বাড়িতে। সোহিনী অবশ্য এতে মোটেই খুশি নয়। কিন্তু ওই যে বললাম কিছুটা বাধ্য হয়েই শাশুড়িকে মেনে নিতে হবে আজ। প্রতুল আর সোহিনীর ছেলে অর্ক যখন দু মাসের তখন ছেলে আর বৌমার সাথেই থাকতেন বিমলা দেবী । সোহিনী কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি করে, তাই আবার বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। তাই প্রতুল নিজেই গরজ করে একটা রান্নার লোক রেখে দিয়েছিল। তাছাড়া বাসন মাজা ,কাপড় কাঁচা, ঘর দুয়ার পরিষ্কার করা এসবের জন্যও আলাদা লোক রাখা আছে। কিন্তু কথায় বলে মায়ের মন। প্রতুল ছোটবেলা থেকেই মোচার ঘন্ট, চুনো মাছের চচ্চড়ি ,কুমড়া ফুলের বড়া এসব পছন্দ করে। কিন্তু রান্নার মাসি এত কিছু ঝামেলা নিতে নারাজ। তাছাড়া সোহিনী এখনকার দিনের মেয়ে। অয়েলি ফুড তার মোটেই পছন্দ নয় । তাই বিমলা দেবী নিজের হাতেই সেগুলো বানাতেন ছেলের জন্য। প্রতুলের জন্য বিভিন্ন রকম আচার বানানো, ছাদে বরি দেওয়া এসব করেই সময় কাটতো তার। সোহিনীর সাথে শাশুড়ির সম্পর্ক কোনদিনই মধুর নয় । তবুও সুখী সংসারের তকমা এঁটে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল । অশান্তি চরণে পৌঁছালো অর্ক হবার পর। বিমলা দেবী তার সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকেই ছুটে আসেন নাতিকে কোলে নেবার জন্য। নিজের হাতে খাইয়েও দেন। যদিও এসব কাজের জন্য সোহিনী একজন আয়া ঠিক করেছে। তবুও বিমলাদেবী আগেকার দিনের মানুষ । নাতিকে নিজে হাতে খাইয়ে ,স্নান করিয়ে ,ঘুম পাড়িয়ে তৃপ্তি পান। ছেলে আর নাতির প্রতি এই অপত্য স্নেহই তার বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার কারণ। আজ কিন্তু সেই নাতির কারণেই তার আবার ফিরে আসা। হ্যাঁ,শুনতে অবাক লাগলেও অর্কই বাধ্য করেছে তার ঠাম্মিকে ফিরে আসতে।
মা বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাওয়ার পর থেকে বেশ আনন্দে কাটতে থাকে দিনগুলো। প্রতুল আর সোহিনীর ক্যারিয়ারে ও রং লেগেছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রমোশন পেয়েছে প্রতুল। শ্যাম্পেনের বোতল খুলে সোহিনীকে নিয়ে সেলিব্রেটও করেছে । শুধু মাকেই কিছু জানানো হয়নি। এদিকে অর্ক বড় হতে থাকে। প্রতুল আর সোহিনীও সময়ের সাথে সাথে ব্যস্ত থেকে ব্যস্ততর হয়ে উঠতে থাকে দৈনন্দিন জীবনে। অর্ক এখন আর রাতের বেলা সোহিনীর সাথে ঘুমায় না । ছোট বাচ্চা তারও ইচ্ছে করে সারাদিন পর মাকে কাছে পেয়ে মায়ের বুকে মুখ বুজে ঘুমোতে। ফলে সোহিনীর রাতে ঠিক ঘুম হয় না । চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে। অফিসে কলিগরা হাসাহাসি করে তাকে নিয়ে। তাই অর্ক আজকাল আয়া মাসির কাছেই ঘুমোয়।ঘুমোয় বললে ভুল হবে ঘুমের ভান করে পেছনে ঘুরে পড়ে থাকে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে। মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু উপায় তো নেই। আর আয়ামাসি, তারো কি সময় আছে নাকি? ফেসবুকে কত বন্ধু তার। আচ্ছা ঠাম্মি কি এখনো জেগে আছে ?সেও কি অর্কর মত রাতের বেলা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে? তারও কি অর্কর মত মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছা করে? ঠাম্মির কথা অবশ্য খুব বেশি মনে নেই অর্কর। ঠাম্মিকে যখন সে শেষ বার দেখে তখন তার বয়স এই বছরখানেক হবে। সকালে ঢুলুঢুলু চোখে সে যখন প্রতুল বা সোহিনীর গা ঘেসে গিয়ে দাঁড়ায় তখন কাছে টেনে নেওয়া তো দূরের কথা প্রতুল বলে ওঠে-- গুড মর্নিং মাই সান। যাও বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও তুমি না গুড বয়। আয়াকে ডেকে অর্ককে নিয়ে যেতে বলে। আচ্ছা গুড বয়রা না হয় সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। কিন্তু গুড বাবা মায়েরা কি করে বলুন তো? কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজের পাতায় মন দেয় ,নাকি খুব টায়ার্ড লাগছিল বলে কাল রাতের ইনকমপ্লিট চ্যাটিং গুলো কমপ্লিট করে।
প্রতিদিন প্রতুল আর সোহিনী যখন অফিসে বেরিয়ে যায় অর্ক উপরের ব্যালকনি থেকে তাকিয়ে থাকে। সারাদিন যে কতবার ব্যালকনিতে এসে বাড়ির গেটের দিকে তাকায়! ওই নিষ্পাপ মায়া ভরা চোখ দুটো কাকে খুঁজে বেড়ায় সারাদিন কে জানে !এই ভাবেই কেটে যায় মাসের পর মাস। আস্তে আস্তে অর্কর মধ্যেও বদল আসে। এখন সে আর ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় না ,রাতে মায়ের কাছে শোয়ার জন্য বায়নাও করে না ,হঠাৎ কেমন যেন বড় হয়ে গেছে ছেলেটা। প্রতুল আর সোহিনী অফিস থেকে ফিরলে ছুটে আসে না । এর আগে ওরা ফিরলে কথার পাহাড় নিয়ে বসতো অর্ক। দুপুরে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো কেমন করে জালনার গ্রিলে আটকে থাকে, পাশের বাড়ির টাবলু দাদা কেমন করে জমা জলে কাগজের নৌকা বানিয়ে ছাড়ে, কেমন করে দুপুরে বুলু পিসি কাকের ডিম- বকের ডিম বানিয়ে ভাত খাওয়ায়, ডোরেমন কেমন করে কথা বলে, ছোটা ভীম কেমন করে ফাইট করে আরো কত কিছু। আজকাল কেমন যেন গুম মেরে গেছে ছেলেটা। সব সময় ঘরের কোন কোনায় চুপ করে বসে থাকে। কোন কিছু নিয়ে বায়না করে না। যে যা বলে তাই শোনে। এখন আর বুলু মাসিকে কাকের ডিম বানিয়ে খাওয়াতে হয় না। চুল আচড়ানোর জন্য চিরুনি হাতে বা দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে ছুটতেও হয় না। এতদিনে যেন একটু স্বস্তি পেয়েছে প্রতুল আর সোহিনী। ছেলের এই রিসার্ভ মুডটা বেশ ভালো লাগে ওদের ।হাই ক্লাস আর সফিস্টিকেটেড ছেলেদের তো এটাই লক্ষণ। তারা জানতেও পারে না বা হয়তো কোনদিন জানতে চায়নি তাদের ব্যস্ততাময় জীবনে সন্তানের প্রতি অবহেলা অর্ককে কোন অন্ধকার জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একদিন বুলু মাসি প্রতুলকে অফিসে ফোন করে জানায় অর্ক আজ সকাল থেকে কোন কথা বলছে না, কিছু জিজ্ঞাসা করলে শুধু ঘাড় নেড়ে বা চোখের ইশারায় উত্তর দিচ্ছে। প্রথমে প্রতুল বা সোহিনী কেউই ব্যাপারটাকে সেরকম গুরুত্ব দেয়নি। বাচ্চাদের মন কখন কেমন খেয়ালে মাতে তা ওরাই জানে। কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো একই অবস্থা। সোহিনী বকাবকিও করে দেখেছে কিন্তু কোন ফল হয়নি। ইদানিং আরো একটা ব্যাপার তারা লক্ষ্য করেছে ছেলের মধ্যে। ঘরে কারো সাথে কথা না বললেও যখন একা থাকে তখন যেন কারো সাথে কথা বলে অর্ক, খেলে, গল্প করে। আজ শনিবার তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে ছেলেকে নিয়ে ওরা দুজন গেছে একজন নামকরা চাইল্ড স্পেশালিস্ট এর কাছে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে সব বলতে উনি যা বললেন তা শুধু প্রতুল বা সোহিনীর নয়, আমাদের মত সমস্ত আধুনিক বাবা-মায়ের জানা উচিত। তিনি বললেন অর্কর আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী তার একাকীত্ব। বাচ্চারা যখন কথা বলার জন্য বা খেলার জন্য মনের মত কাউকে পায় না, যখন তাদের শিশু মন কাউকে বারবার আঁকড়ে ধরতে চেয়েও বিফল হয় তখন নিরুপায় হয়ে তারা নিজেদের একটা কল্পনার জগত তৈরি করে। সেখানেই তৈরি হয় বন্ধু আর তখন তার সাথেই শুরু হয় কথাবার্তা খেলাধুলা সবকিছু। এতে বাচ্চা বাস্তব জগত থেকে সরে গিয়ে কল্পনার জগতে বাঁচতে শুরু করে। গোড়া থেকেই এর প্রতিকার না হলে শেষে কি হবে কেউ জানে না।
আজ ঘরের ছবিটা যেন একটু অন্যরকম লাগছে । সোহিনী বাড়ি ফিরে নিজেই খাওয়াতে বসেছে ছেলেকে। প্রতুল পাশে বসে টিভিতে ডোরেমন চালিয়ে ইচ্ছা করেই যেন একটু বেশি মজা পাওয়ার অভিনয় করছে। কিন্তু এভাবে কতদিন ?অফিস থেকেও বেশি দিনের ছুটি নেওয়া যাবে না। দুজনে মিলে চাকরি না করলে ফ্ল্যাটের ইএমআই, এতগুলো পলিসি, কারলোন সব চালাবে কেমন করে ?অথচ ডাক্তার বলেছে অর্ক নর্মাল অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে। যেটা তিল তিল করে শেষ হয়ে গেছে সেটাকে তিল তিল করেই গড়ে তুলতে হবে। যে ভালোবাসার অভাবে তার এই অবস্থা, কোন মেডিসিন নয় একমাত্র কোন আপন জনের মমতাই পারে এই সমস্যার সমাধান করতে। বড় দোটানায় পড়েছে প্রতুল আর সোহিনী। হঠাৎ প্রতুলের মনে পড়ে যায় মায়ের কথা, একমাত্র উনিই পারেন তাদের এই ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে। অথচ এতদিন সেটা মাথাতেই আসেনি। আসলে মাকে বাতিল করে রাখাটা যেন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কথাটা সোহিনীকে বলতেই প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও পরে নিরুপায় হয়েই রাজি হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে আসেন বিমল দেবী, অর্ক কিন্তু খুব সহজভাবেই মিশে যায় ওনার সাথে। যেন কত দিনের চেনা। ধীরে ধীরে অর্ক ফিরতে থাকে স্বাভাবিক অবস্থায়। বিমলা দেবী নাতিকে রামায়ণ -মহাভারতের গল্প শোনান, নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে নাতির ভেজা মাথা মুছিয়ে দেন, সন্ধ্যেবেলায় নাতি সাথে বসে ছোটা ভীম দেখেন, বিকেলে পার্কে গিয়ে আইসক্রিম খান। অর্কও কম যায় না। সেও ঠাম্মীর দেওয়া গোপালের ভোগ চুরি করে খায় ,রাক্ষসের মুখোশ পরে ঠাম্মিকে ভয় দেখায়, চশমা লুকিয়ে রাখে আরো কত কি। রাতে যখন নাতিকে বুকে নিয়ে ঘুমান বিমলা দেবী ,তখন ওদের দেখলে মনে হয় কত সুখ কত শান্তি ঘিরে আছে ওদের। কোন একাকীত্বই আজ আর ছুঁতে পারে না ঠাম্মি আর অর্ককে।
পারমিতাচ্যাটার্জী
কিছুটা বাধ্য হয়েই প্রতুল আজ তার মাকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে। আজ প্রায় পাঁচ বছর পর বিমলাদেবী ফিরেছেন নিজের বাড়ি----- ছেলে আর বৌমার বাড়িতে। সোহিনী অবশ্য এতে মোটেই খুশি নয়। কিন্তু ওই যে বললাম কিছুটা বাধ্য হয়েই শাশুড়িকে মেনে নিতে হবে আজ। প্রতুল আর সোহিনীর ছেলে অর্ক যখন দু মাসের তখন ছেলে আর বৌমার সাথেই থাকতেন বিমলা দেবী । সোহিনী কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি করে, তাই আবার বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। তাই প্রতুল নিজেই গরজ করে একটা রান্নার লোক রেখে দিয়েছিল। তাছাড়া বাসন মাজা ,কাপড় কাঁচা, ঘর দুয়ার পরিষ্কার করা এসবের জন্যও আলাদা লোক রাখা আছে। কিন্তু কথায় বলে মায়ের মন। প্রতুল ছোটবেলা থেকেই মোচার ঘন্ট, চুনো মাছের চচ্চড়ি ,কুমড়া ফুলের বড়া এসব পছন্দ করে। কিন্তু রান্নার মাসি এত কিছু ঝামেলা নিতে নারাজ। তাছাড়া সোহিনী এখনকার দিনের মেয়ে। অয়েলি ফুড তার মোটেই পছন্দ নয় । তাই বিমলা দেবী নিজের হাতেই সেগুলো বানাতেন ছেলের জন্য। প্রতুলের জন্য বিভিন্ন রকম আচার বানানো, ছাদে বরি দেওয়া এসব করেই সময় কাটতো তার। সোহিনীর সাথে শাশুড়ির সম্পর্ক কোনদিনই মধুর নয় । তবুও সুখী সংসারের তকমা এঁটে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল । অশান্তি চরণে পৌঁছালো অর্ক হবার পর। বিমলা দেবী তার সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকেই ছুটে আসেন নাতিকে কোলে নেবার জন্য। নিজের হাতে খাইয়েও দেন। যদিও এসব কাজের জন্য সোহিনী একজন আয়া ঠিক করেছে। তবুও বিমলাদেবী আগেকার দিনের মানুষ । নাতিকে নিজে হাতে খাইয়ে ,স্নান করিয়ে ,ঘুম পাড়িয়ে তৃপ্তি পান। ছেলে আর নাতির প্রতি এই অপত্য স্নেহই তার বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার কারণ। আজ কিন্তু সেই নাতির কারণেই তার আবার ফিরে আসা। হ্যাঁ,শুনতে অবাক লাগলেও অর্কই বাধ্য করেছে তার ঠাম্মিকে ফিরে আসতে।
মা বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাওয়ার পর থেকে বেশ আনন্দে কাটতে থাকে দিনগুলো। প্রতুল আর সোহিনীর ক্যারিয়ারে ও রং লেগেছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রমোশন পেয়েছে প্রতুল। শ্যাম্পেনের বোতল খুলে সোহিনীকে নিয়ে সেলিব্রেটও করেছে । শুধু মাকেই কিছু জানানো হয়নি। এদিকে অর্ক বড় হতে থাকে। প্রতুল আর সোহিনীও সময়ের সাথে সাথে ব্যস্ত থেকে ব্যস্ততর হয়ে উঠতে থাকে দৈনন্দিন জীবনে। অর্ক এখন আর রাতের বেলা সোহিনীর সাথে ঘুমায় না । ছোট বাচ্চা তারও ইচ্ছে করে সারাদিন পর মাকে কাছে পেয়ে মায়ের বুকে মুখ বুজে ঘুমোতে। ফলে সোহিনীর রাতে ঠিক ঘুম হয় না । চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে। অফিসে কলিগরা হাসাহাসি করে তাকে নিয়ে। তাই অর্ক আজকাল আয়া মাসির কাছেই ঘুমোয়।ঘুমোয় বললে ভুল হবে ঘুমের ভান করে পেছনে ঘুরে পড়ে থাকে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে। মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু উপায় তো নেই। আর আয়ামাসি, তারো কি সময় আছে নাকি? ফেসবুকে কত বন্ধু তার। আচ্ছা ঠাম্মি কি এখনো জেগে আছে ?সেও কি অর্কর মত রাতের বেলা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে? তারও কি অর্কর মত মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছা করে? ঠাম্মির কথা অবশ্য খুব বেশি মনে নেই অর্কর। ঠাম্মিকে যখন সে শেষ বার দেখে তখন তার বয়স এই বছরখানেক হবে। সকালে ঢুলুঢুলু চোখে সে যখন প্রতুল বা সোহিনীর গা ঘেসে গিয়ে দাঁড়ায় তখন কাছে টেনে নেওয়া তো দূরের কথা প্রতুল বলে ওঠে-- গুড মর্নিং মাই সান। যাও বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও তুমি না গুড বয়। আয়াকে ডেকে অর্ককে নিয়ে যেতে বলে। আচ্ছা গুড বয়রা না হয় সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। কিন্তু গুড বাবা মায়েরা কি করে বলুন তো? কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজের পাতায় মন দেয় ,নাকি খুব টায়ার্ড লাগছিল বলে কাল রাতের ইনকমপ্লিট চ্যাটিং গুলো কমপ্লিট করে।
প্রতিদিন প্রতুল আর সোহিনী যখন অফিসে বেরিয়ে যায় অর্ক উপরের ব্যালকনি থেকে তাকিয়ে থাকে। সারাদিন যে কতবার ব্যালকনিতে এসে বাড়ির গেটের দিকে তাকায়! ওই নিষ্পাপ মায়া ভরা চোখ দুটো কাকে খুঁজে বেড়ায় সারাদিন কে জানে !এই ভাবেই কেটে যায় মাসের পর মাস। আস্তে আস্তে অর্কর মধ্যেও বদল আসে। এখন সে আর ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় না ,রাতে মায়ের কাছে শোয়ার জন্য বায়নাও করে না ,হঠাৎ কেমন যেন বড় হয়ে গেছে ছেলেটা। প্রতুল আর সোহিনী অফিস থেকে ফিরলে ছুটে আসে না । এর আগে ওরা ফিরলে কথার পাহাড় নিয়ে বসতো অর্ক। দুপুরে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো কেমন করে জালনার গ্রিলে আটকে থাকে, পাশের বাড়ির টাবলু দাদা কেমন করে জমা জলে কাগজের নৌকা বানিয়ে ছাড়ে, কেমন করে দুপুরে বুলু পিসি কাকের ডিম- বকের ডিম বানিয়ে ভাত খাওয়ায়, ডোরেমন কেমন করে কথা বলে, ছোটা ভীম কেমন করে ফাইট করে আরো কত কিছু। আজকাল কেমন যেন গুম মেরে গেছে ছেলেটা। সব সময় ঘরের কোন কোনায় চুপ করে বসে থাকে। কোন কিছু নিয়ে বায়না করে না। যে যা বলে তাই শোনে। এখন আর বুলু মাসিকে কাকের ডিম বানিয়ে খাওয়াতে হয় না। চুল আচড়ানোর জন্য চিরুনি হাতে বা দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে ছুটতেও হয় না। এতদিনে যেন একটু স্বস্তি পেয়েছে প্রতুল আর সোহিনী। ছেলের এই রিসার্ভ মুডটা বেশ ভালো লাগে ওদের ।হাই ক্লাস আর সফিস্টিকেটেড ছেলেদের তো এটাই লক্ষণ। তারা জানতেও পারে না বা হয়তো কোনদিন জানতে চায়নি তাদের ব্যস্ততাময় জীবনে সন্তানের প্রতি অবহেলা অর্ককে কোন অন্ধকার জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একদিন বুলু মাসি প্রতুলকে অফিসে ফোন করে জানায় অর্ক আজ সকাল থেকে কোন কথা বলছে না, কিছু জিজ্ঞাসা করলে শুধু ঘাড় নেড়ে বা চোখের ইশারায় উত্তর দিচ্ছে। প্রথমে প্রতুল বা সোহিনী কেউই ব্যাপারটাকে সেরকম গুরুত্ব দেয়নি। বাচ্চাদের মন কখন কেমন খেয়ালে মাতে তা ওরাই জানে। কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো একই অবস্থা। সোহিনী বকাবকিও করে দেখেছে কিন্তু কোন ফল হয়নি। ইদানিং আরো একটা ব্যাপার তারা লক্ষ্য করেছে ছেলের মধ্যে। ঘরে কারো সাথে কথা না বললেও যখন একা থাকে তখন যেন কারো সাথে কথা বলে অর্ক, খেলে, গল্প করে। আজ শনিবার তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে ছেলেকে নিয়ে ওরা দুজন গেছে একজন নামকরা চাইল্ড স্পেশালিস্ট এর কাছে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে সব বলতে উনি যা বললেন তা শুধু প্রতুল বা সোহিনীর নয়, আমাদের মত সমস্ত আধুনিক বাবা-মায়ের জানা উচিত। তিনি বললেন অর্কর আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী তার একাকীত্ব। বাচ্চারা যখন কথা বলার জন্য বা খেলার জন্য মনের মত কাউকে পায় না, যখন তাদের শিশু মন কাউকে বারবার আঁকড়ে ধরতে চেয়েও বিফল হয় তখন নিরুপায় হয়ে তারা নিজেদের একটা কল্পনার জগত তৈরি করে। সেখানেই তৈরি হয় বন্ধু আর তখন তার সাথেই শুরু হয় কথাবার্তা খেলাধুলা সবকিছু। এতে বাচ্চা বাস্তব জগত থেকে সরে গিয়ে কল্পনার জগতে বাঁচতে শুরু করে। গোড়া থেকেই এর প্রতিকার না হলে শেষে কি হবে কেউ জানে না।
আজ ঘরের ছবিটা যেন একটু অন্যরকম লাগছে । সোহিনী বাড়ি ফিরে নিজেই খাওয়াতে বসেছে ছেলেকে। প্রতুল পাশে বসে টিভিতে ডোরেমন চালিয়ে ইচ্ছা করেই যেন একটু বেশি মজা পাওয়ার অভিনয় করছে। কিন্তু এভাবে কতদিন ?অফিস থেকেও বেশি দিনের ছুটি নেওয়া যাবে না। দুজনে মিলে চাকরি না করলে ফ্ল্যাটের ইএমআই, এতগুলো পলিসি, কারলোন সব চালাবে কেমন করে ?অথচ ডাক্তার বলেছে অর্ক নর্মাল অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে। যেটা তিল তিল করে শেষ হয়ে গেছে সেটাকে তিল তিল করেই গড়ে তুলতে হবে। যে ভালোবাসার অভাবে তার এই অবস্থা, কোন মেডিসিন নয় একমাত্র কোন আপন জনের মমতাই পারে এই সমস্যার সমাধান করতে। বড় দোটানায় পড়েছে প্রতুল আর সোহিনী। হঠাৎ প্রতুলের মনে পড়ে যায় মায়ের কথা, একমাত্র উনিই পারেন তাদের এই ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে। অথচ এতদিন সেটা মাথাতেই আসেনি। আসলে মাকে বাতিল করে রাখাটা যেন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কথাটা সোহিনীকে বলতেই প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও পরে নিরুপায় হয়েই রাজি হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে আসেন বিমল দেবী, অর্ক কিন্তু খুব সহজভাবেই মিশে যায় ওনার সাথে। যেন কত দিনের চেনা। ধীরে ধীরে অর্ক ফিরতে থাকে স্বাভাবিক অবস্থায়। বিমলা দেবী নাতিকে রামায়ণ -মহাভারতের গল্প শোনান, নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে নাতির ভেজা মাথা মুছিয়ে দেন, সন্ধ্যেবেলায় নাতি সাথে বসে ছোটা ভীম দেখেন, বিকেলে পার্কে গিয়ে আইসক্রিম খান। অর্কও কম যায় না। সেও ঠাম্মীর দেওয়া গোপালের ভোগ চুরি করে খায় ,রাক্ষসের মুখোশ পরে ঠাম্মিকে ভয় দেখায়, চশমা লুকিয়ে রাখে আরো কত কি। রাতে যখন নাতিকে বুকে নিয়ে ঘুমান বিমলা দেবী ,তখন ওদের দেখলে মনে হয় কত সুখ কত শান্তি ঘিরে আছে ওদের। কোন একাকীত্বই আজ আর ছুঁতে পারে না ঠাম্মি আর অর্ককে।
পারমিতাচ্যাটার্জী