Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
# অণুগল্প

 
মায়ের সাথে আজ 'কাজের বাড়ি' এসেছে পিউ। অন্যদিন ওদের পাশের ঘরের কমলা পিসিদের ঘরে থাকে ও। মা সকালে দুই বাড়ি ঠিকে কাজ করে, ততক্ষণ কমলা পিসিদের ঘরে বসে দিদার সঙ্গে গপ্পো করে। কিন্তু এই 'দিন হল কমলা পিসিদের বাড়িশুদ্ধু সবার জ্বর। তাই মা আজ আর ওখানে রাখতে পারেন নি। অবশ্য মা যে দুই বাড়ি কাজ করেন, তারমধ্যেও এক বাড়ির দাদু-দিদা তাঁদের মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেছেন, তাই শুধু একটা বাড়িতেই কাজ আছে মায়ের। নিজের লাল ফ্রক পরে বেশ আনন্দ করেই মায়ের সঙ্গে এই 'জ্যেঠিমা' দের বাড়িতে এসেছে ও।
"আরে শিবানী, এসে গেছিস এত তাড়াতাড়ি? যাক, আমার ভালোই হলো, আজ শ্রাবণ মাসের প্রথম সোমবার। আমি বুড়োশিবতলায় যাব একটু। আমিও তাড়াহুড়ো করছি।" দরজা খুলেই বলে উঠেছিলেন ওই জ্যেঠিমা। আর অবাক হয়ে দেখছিল ওঁকে পিউ। কী সুন্দর দেখতে! আর লাল ফ্রক পরে আছে, এই জ্যেঠিমাটাও লাল নাইটি জামা পরে আছেন!
"ওমা, এটা তোর মেয়ে বুঝি?" ওকে দেখেই জিজ্ঞেস করেছিলেন জ্যেঠিমা।
"হ্যাঁ গো, বৌদি, ওকে পাশের যে ঘরে রাখি, তাদের সবার জ্বর। তাই নিয়ে এলাম। এমনিতেই সময় খারাপ।" কিন্তু কিন্তু করে বলে উঠেছিলেন মা।
"তা ভাল করেছিস। ওকে কিছু খেতে দে আগে। আমি তাহলে স্নানে যাই? মন্দিরে একটু আগে যেতে পারলে ভাল হয়।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ বৌদি, আমি সব কাজ সেরে নিচ্ছি। তুমি ভেবো না। আজ প্রথম সোমবার, ভিড় হবে এমনিতেই।" বলে কাজে চলে গেলেন পিউয়ের মা। ওকে একটা চেয়ারে বসতে বলে।
চেয়ারে বসে ঘরটা দেখছিল পিউ মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী সুন্দর করে সাজানো! ওদের তো একটা ছোট্ট ঘর - বারান্দাতে মা রান্না করে। কমলা পিসি আর ওরা একটাই বাথরুম ব্যবহার করে। আর এই বাড়িটা কী সুন্দর! এক একটা দেওয়ালে এক একরকম রং! আবার কত্ত বড় একটা টিভি! কত বই! আচ্ছা, বড় হলে এরকম অনেক বই পড়তে পারবে? ওর মা তো সবসময় বলেন "তোকে অনেক লেখাপড়া করতে হবে রে মা। আমাদের সময়ে এত কিছু ছিল না। পেট চালাব না লেখাপড়া করব! বাবা ইকলেজ ছাড়িয়ে দিলেন। কত কাঁদাকাটা করেছি। তুই কিন্তু অনেক পড়বি। আমি আরও চারবাড়ি কাজ ধরব দরকার হলে।" তা, পিউ এখনও অনেক ছোট, তাই এত কিছু বোঝে না ও।
মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘরে রাখা খাবার টেবিলের দিকে নজর গেল। টেবিলের ওপর একটা ঝুড়ি মতো আছে, সেখানে অনেক গুলো ফল রাখা। আর পাশেই মিষ্টির প্যাকেট। এই বাড়ির জ্যেঠিমা যে ওকে কিছু খেতে দিতে বলেছিলেন, কই মা দিলেন না তো! মা ভুলে গেলেন দিতে? সকালে দুটো বিস্কুট খেয়েছে মাত্র, এখন খিদে পাচ্ছে তো... মায়ের ওপর অভিমান হচ্ছে খুব পিউয়ের। মা বলেছেন অন্য কারো খাবারে আর জিনিসে লোভ না করতে, তাই মনে মনে অন্য কথা ভাবতে শুরু করে পিউ।
"বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগি, মহাদেব! মা, কিছু হবে?" ডাক শুনে তাকায় পিউ। ঘরের পাশেই বারান্দা, সেখান থেকে আওয়াজ আসছে। চুপি চুপি উঁকি মেরে দেখে একজন বয়স্ক দাদু দাঁড়িয়ে আছেন। নোংরা একটা জামা পরা, হাতে একটা লাঠি, আর একটা ছোট্ট বাটি। দাদুটা কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
দেখে বুকটা টনটন করে উঠল পিউয়ের। ওদের বাড়িতে এমনি কেউ এলে মা ফেরাতে বারণ করেন। ওদের অভাবের সংসারেও মা কিছু খুচরো কয়েন পয়সা রেখে দেন ভিক্ষে দেবার জন্য। তবে ওকে বলা আছে জানলা দিয়েই পয়সা দিয়ে দেবার জন্য। ভুলেও যেন দরজা না খোলে। অনেকে নাকি ছেলেধরা হয়। ওকে নিয়ে গিয়ে বিক্কিরি করে দেবে, আর মায়ের দেখা পাবে না!
কিন্তু এই দাদুটার কি হবে! উনি যে কিছু চাইছেন! মা যে ওকে বসিয়ে দিয়ে কোথায় চলে গেলেন ভগবান জানে! মা থাকলে মা ঠিক কিছু না কিছু দিতেন দাদুটাকে।
" মা, কিছু হবে না?" বলে ঘুরে দাঁড়ালেন দাদুটা।
আহা, এত রোদ, আবার মাঝে মাঝে বিষ্টি পড়ছে - দাদুটা ছাতা নেন নি কেন? আচ্ছা, দাদুর কি বাড়িতে কেউ নেই? ওর মায়ের মতো? না না, ওর মায়ের তো আছে - এই দাদুটার কি কেউ নেই? তাই কি এভাবে ভিক্ষে করেন?
আহা রে!
চোখে জল আসছিল পিউয়ের।
দাদুটা বোধহয় কিচ্ছু খাননি। ওর তো খিদে পেয়েছে। তাহলে দাদুটার কত কষ্ট হচ্ছে!
তাড়াতাড়ি করে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চোখ পড়ল ফলের ঝুড়ির ওপর। এই তো, মিষ্টি - দই সব আছে। এই বাড়ির জ্যেঠিমাটা এত ভাল, কিছু মনে করবেন না নিশ্চয়ই! হয়ত ভাববেন পিউই খেয়ে নিয়েছে। উনি তো কত সুন্দর করে মা কে বললেন "ওকে কিছু খেতে দে আগে!" উনি কিছু মনে করতেই পারেন না!
যেমন ভাবা তেমন কাজ! তাড়াতাড়ি করে মিষ্টি আর দইটা দিয়ে দিল বারান্দার গ্রিল দিয়ে। আর তক্ষুণিই "পিউউউউউ এটা কি করলি তুই?" শুনে চমকে গেল ও।
মা এসেছেন। হাতে একটা ছোট্ট প্লেটে কি যেন খাবার।
"কে ওখানে? কি দিলি তুই?" মা খুব রেগে গেছেন।
"মা একজন দাদু... খাবার চাইছিলেন তাই আমি... এখানে মিষ্টি ছিল..." ভয়ে ভয়ে বলল পিউ।
"এখান থেকে নিয়ে দিয়ে দিলি? ওটা পুজোর জন্য রাখা ছিল। ওফ! তোকে নিয়ে যে আমি কি করি!" মা প্রচন্ড চিৎকার করছেন।
"তুমি তো আমাকে কিছু খেতে দাও নি, যে সেখান থেকে ওনাকে দেব। তাই..."
"তাবলে তুই ঠাকুরের জন্য রাখা প্রসাদ দিয়ে দিবি? ওফ! এটা আমার কাজের বাড়ি। এখানে কাজ করে আমি টাকা পাই, আমাদের খাওয়া - পরা চলে। একটা দিন তোকে নিয়ে এলাম, আর সেইদিনই সর্বনাশ করলি তুই আমার..." মা এগিয়ে আসছেন এবার মারার জন্য!
চোখ বন্ধ করে ফেলে পিউ!
"কি হয়েছে রে শিবানী? ওকে মারছিস কেন? " হঠাৎ বলে ওঠেন জ্যেঠিমাটা।
কান্নাভেজা চোখে সেদিকে তাকায় পিউ। স্নান করে এসেছেন উনি। মাখন মাখন লাগছে দেখতে! কান্নাও যেন ভুলে যায় ও।
"কী বলি বৌদি। কে এক 'দাদু' এসেছিল ভিক্ষা নিতে। আর কিছু না পেয়ে টেবিলে মিষ্টির প্যাকেট, দইয়ের ভাঁড় দেখে সেটাই দিয়ে দিয়েছে আবার উলটে আমাকে বলছে তুমি ওকে খেতে দিতে বলেছিলে, আমি দিই নি, আমার দোষ, তাই যা হাতের সামনে পেয়েছে দিয়ে দিয়েছে। এরপরেও মারব না?" বলে উঠলেন মা।
"তাই, পিউ? " জিজ্ঞেস করলেন জ্যেঠিমা।
"হ্যাঁ... মা আমাকে বলেছেন কাউকে না ফেরাতে। আর এই দাদুটার অনেক বয়েস। লাঠি নিয়ে হাঁটেন। আর কিছু দেখতে পাইনি গো... তাই দিয়ে দিছি..." কাঁদতে কাঁদতে বলে পিউ। বুঝে গেছে আজ আরও মার আছে কপালে!
একটু চুপ করে থাকেন জ্যেঠিমা।
তারপর বলেন "শিবানী, তুই ওকে বকিস না। ওর মধ্যেও শিশু ভোলানাথ আছেন। আর বুড়োশিবতলায় যাঁর কাছে আমি যেতাম, তিনিও যে ভিখারী! তিনি সর্বশক্তিমান তবু ভিক্ষুক! তিনি দেবাদিদেব, আবার অন্নপূর্ণা মায়ের অন্নভোগ প্রার্থী! তাই পিউ ওর 'দাদু'কে মিষ্টি দিয়ে কোনো অন্যায় করে নি... বরং আমার চোখ খুলে দিয়েছে। শুধু শ্রাবণ মাসের সোমবার কেন... যদি রোজ একজনকেও সামান্য কিছুও দেওয়া যায়... "
নিজের মনেই বিড়বিড় করে কথা বলছিলেন জ্যেঠিমা। চোখে জল। মা শুনতে শুনতে কাঁদছিলেন।
শুধু পিউ আর কাঁদছিল না। ওর মনে পড়ছিল মিষ্টির প্যাকেটটা দেখে ওই দাদুটা কেমন সুন্দর করে ফোকলা দাঁতে হেসে উঠেছিলেন! উনি এবার মজা করে দই-মিষ্টি খাবেন। তারপর জল। পেট ভরবে ওনার। কী মজা!
এই বাড়ি থেকে বুড়োশিবতলা বেশ দূরে... নইলে পিউ দেখতে পেত ত্রিভুবনেশ্বর আজ হাসছেন খুব। অবিকল সেই 'দাদু' মতো হাসি!

[+] 3 users Like ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 20-10-2022, 09:58 AM



Users browsing this thread: 21 Guest(s)