26-12-2018, 02:42 PM
১৭।।
প্রণববাবু ঘুরে যাবার পর বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে, এক সন্ধ্যায়, ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ঘরে ঢোকে পৃথা তড়িঘড়ি... ‘ইশ... খুব ভুল হয়ে গেছে আজকে...’ মনে মনে ভাবে... সকালবেলায় বেরুবার সময় সাধারণত যে ব্যাগটা নিয়ে অফিসে যায়, সেটা আজকে নেয় নি, আর তার ফলে ছাতাটাও বের করতে ভুলে গিয়েছিল ওই ব্যাগটা থেকে। ফেরার পথে এই রকম ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে কে জানতো... একেবারে চুপচুপে ভিজে গিয়েছে... কতক্ষন অটোর জন্য দাঁড়িয়েছিল... এমন জায়গায় অটো স্ট্যান্ডটা যে একটু যে শেডের তলায় দাঁড়াবে, তারও যো নেই... দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে হয়েছে ওকে...
পায়ের জুতোটাকে কোনরকমে খুলে হাতের ব্যাগটাকে সোফার ওপরে ছুড়ে দিয়ে বাথরুমের দিকে দৌড়ায়... এ ভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ড্রইংরুমের মেঝেটা ভিজে নোংরা হয়ে যাবে শুধু শুধু... পরে তো তাকেই সেই কাদা পরিষ্কার করতে হবে। বাথরুমে যাবার পথেই জামার বোতামগুলো খুলতে থাকে দ্রুত হাতে, ঢুকেই বাথরুমের দরজাটাকে আলগোছে টেনে ভিজিয়ে রেখে গা’য়ের থেকে টেনে জামাটা খুলে ফেলে দেয় বালতিটার মধ্যে... হাত দেয় জিন্সের বোতামে... ভিজে গিয়ে একেবারে সেঁটে গিয়েছে পায়ের সাথে জিন্সটা... বোতাম আর চেন খুলে কোমর থেকে দেহটাকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে নেড়ে নেড়ে টেনে নামায় শরীর থেকে প্যান্টটাকে... ‘ইশ... কি কুক্ষনেই না আজকেই জিন্স শার্ট পরে অফিসে গিয়েছিলাম... কুর্তি হলে তাও একটু হালকা হত... এতো একেবারে ভিজে ভারী হয়ে উঠেছে...’ জিন্সটারও জায়গা হয় বালতির মধ্যে... নজর পড়ে নিজের শরীরে পরে থাকে ব্রা প্যান্টির দিকে... ‘দেখ কি অবস্থা... ও গুলোও তো দেখছি ভিজে গিয়েছে... মরণ আর কি... বৃষ্টি হবার আর সময় হলো না... আর একটু পরে নামতে পারতো... ততক্ষনে বাড়ি পৌছে যেতাম... ক’দিন ধরেই গা’টা ম্যাজম্যাজ করছে, তার ওপর এই ভাবে ভিজলাম, জ্বর না আবার এসে যায়...’ হাত ঘুরিয়ে অভ্যস্থ হাতে ব্রায়ের হুকটা আলগা করতে করতে ভাবে পৃথা।
প্যান্টিটা খুলে দাঁড়ায় শাওয়ারের নিচে... কলটা খুলতেই ছাদের রিজার্ভারের জমা ঠান্ডা জল ছিটিয়ে পড়ে নগ্ন দেহের ওপরে... হটাৎ করে গায়ের ওপরে এসে পড়া ঠান্ডা জলে কাঁপুনি ধরে যায় তার... ‘উউউহুহুহুহু...’ করে চিৎকার করে ওঠে... ভিষন শীত করতে থাকে তার... হাত দুটোকে জড়ো করে ধরে বুকের ওপরে... একটু একটু করে জলের ঠান্ডা ভাবটা সয়ে যেতে থাকে শরীরের তাপমাত্রার সাথে... সেও স্বাভাবিক হয় যেন একটু... এবার ভালো করে জলের ধারার নীচে দাঁড়িয়ে শরীরের ওপরে জলটা নিতে থাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে... চোখদুটো বন্ধ করে রাখে আরামে... নিরাবরণ নিটোল তম্বী শরীরটা বেয়ে জলের ধারা মাথার থেকে নেমে ধেয়ে যায় মাটির দিকে।
বাথরুম থেকে বড় তোয়ালেটা সারা শরীরে জড়িয়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় ড্রইংরুমের মধ্যে... তোয়ালের খুঁটটা গুঁজে রাখে পায়রার মত দুটো নরম বুকদুটোকে ঢেকে রেখে... শেষ প্রান্তটা গিয়ে হাঁটুর অনেক ওপরেই শেষ হয়ে যায়... নিটোল কাঁধদুটো থাকে সম্পূর্ণ নিরাবরণ... ‘সর্বনাশ... বাইরের দরজাটাই বন্ধ করি নি? দেখেছ অবস্থা!’ বাইরের দরজাটার দিকে তাকিয়ে নিজের ভুলে আঁতকে ওঠে পৃথা... দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ফাঁক হয়ে থাকা দরজাটার দিকে... হাতের চাপে ঢেলে দেয় দরজাটাকে... ইয়েল লকের খট করে আওয়াজ তুলে বন্ধ হয়ে যায় দরজাটা... ‘ইশ... দেখেছ কান্ড আমার... যদি কেউ ঢুকে পড়তো এখন? এ বাবা... আমিও তো একেবারে ন্যাংটো হয়ে চান করছিলাম...’ যেন নিশ্চিন্ত হতেই একবার উঁকি মারে আধো অন্ধকার কিচেনের মধ্যে... তারপর গিয়ে আলো জ্বালে বেডরুমে... ভালো করে চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে নেয় একবার... খেয়াল করে ঘরের লাগোয়া বারান্দার দরজার ছিটকিনিটার দিকে... ‘নাঃ... বাবাহঃ... কেউ ঢোকে নি... ইশ... কি ভুলটাই না করে বসেছিলাম...’ ঘুরে দাঁড়ায় আয়নার সামনে... নিজেই নিজেকে ভেঙচি কাটে আয়নার প্রতিফলনের মধ্যে দিয়ে... জানলার ওপারে তখন অঝরে ঝরে চলেছে বৃষ্টি।
কড়্... কড়্... কড়াৎ... মেঘে ঢাকা সন্ধ্যের কালো আকাশটাকে চিরে বিকট শব্দে বাজটা পড়ল... আকস্মিক বাজের শব্দে চমকে উঠলো পৃথা... তারপরই ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেল... একটা নিশ্ছিদ্র কালো অন্ধকার ওকে যেন জড়িয়ে ধরল চতুর্দিক থেকে...
চুপ করে খানিক এক ভাবে দাঁড়িয়ে রইল ওখানটাতেই... একটু একটু করে অন্ধকারটা চোখের মধ্যে সয়ে আসতে লাগলো... জানলা দিয়ে আসা বাইরের সন্ধ্যের আলোয় অস্পষ্ট ভাবে চোখে পড়তে লাগলো ঘরের মধ্যেটা... ধীর পদক্ষেপে খুব সাবধানে বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো ড্রইংরুমের মধ্যে... ‘ইশ... এখানেটা তো আরো বেশি অন্ধকার... নিশ্চয় বাজ পড়ে কোথাও কোন ট্রান্সফর্মার উড়েছে... নয়তো এই ভাবে কারেন্ট যেতো না...’ একা একা কথা বলে... হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে... তাকের ওপর থেকে মোমবাতি আর দেশলাইটা পেড়ে জ্বালায় সেটি... মোমের নরম আলোয় ভরে যায় কিচেনটা... সাবধানে হাতে জ্বলন্ত মোমবাতিটা ধরে ফিরে আসে ড্রইংরুমে... এগিয়ে গিয়ে বাইরের দরজার লকটাকে তুলে দেয় ভালো করে... তারপর গুটিগুটি পায়ে মোমবাতির শিখাটাকে হাতের তেলোর আড়াল করে এগিয়ে চলে বেডরুমের দিকে। বেডরুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই জানলা থেকে ঠান্ডা এক ঝলক বাতাস হৈ হৈ করে ঢুকে দুম করে নিভিয়ে দেয় মোমবাতিটাকে... ‘যাহঃ... দূর... ভাল্লাগে না...’ নিভে যাওয়া মোমবাতিটাকে হাতের মধ্যে ধরে স্বগক্তি করে পৃথা... সেটাকে বেডসাইড টেবিলের ওপরেই রেখে দিয়ে সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে অফ্ করে দেয় ঘরের আলোটাকে তারপর এগিয়ে যায় ঘরের জানলাটার কাছে... জানলার পাল্লাদুটো খুলে দেয়... বাইরের থেকে ঠান্ডা বাতাসের সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ছাট এসে লাগে ওর চোখে মুখে... ভালো লাগায় মনটা ভরে যায়... জানলার ফ্রেমটায় হাত রেখে মুখটাকে যথাসম্ভব বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে... মুখের ওপরে জলের ঝাপটা নিতে থাকে মনের আনন্দে।
ওই ভাবে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে মাথাটাকে হেলিয়ে জানলার ফ্রেমে ঠেস দিয়ে... অন্ধকার ঘরের মধ্যে একলা সে... কেমন যেন আস্তে আস্তে মনটা ভারী হয়ে ওঠে... প্রণববাবু ফিরে যাবার পর থেকেই মাঝে মধ্যেই আজকাল কিছু ভালো লাগে না তার... থেকে থেকে বুকের মধ্যেটায় একটা না চেনা বোঝা চেপে বসে যেন... হারিয়ে ফেলে নিজেকে এক দুঃসহ চাপা কষ্টের আবর্তে...
জানলার ফ্রেমে মাথা রেখেই মৃধু স্বরে গুনগুন করে গান ধরে আপন মনে...
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের ‘পরে, বুকের ‘পরে।।
পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে-
নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রানে।
নিশিদিন এই জীবনের সুখের ‘পরে দুখের ‘পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে।
যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে,
তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে।
যা-কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা,
তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা।
নিশিদিন এই জীবনের তৃষার ‘পরে, ভুখের ‘পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে।।
কেন জানা নেই, পৃথার চোখের কোল দিয়ে আনমনে গড়িয়ে পড়তে থাকে নোনা জলের ধারা। গানটা শেষ করে চুপ করে আরো খানিকক্ষন ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে বৃষ্টির ছাঁটের মুখে... চোখের উষ্ণ জলের সাথে মিশে যায় বৃষ্টির ঠান্ডা জল। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন গায়ের থেকে তোয়ালেটা মাটিতে খসে পড়ে গিয়েছে, খেয়ালও নেই তার... ওই ভাবেই নগ্ন দেহে দাঁড়িয়ে থাকে সে বাইরের পানে তাকিয়ে। সেদিনের পর থেকে কিছুতেই সরিয়ে রাখতে পারছে না অর্নবকে মনের মধ্যে থেকে... একি হয়ে গেলো... একটা কল্পসুখের মধ্যে সে ভেসে ছিল, কিন্তু হটাৎ করে যেন তাকে টেনে হিঁচড়ে বাস্তবের কঠিন মাটির ওপরে আছড়ে ফেলে দিয়ে গেলেন ওই ভদ্রলোক... প্রণববাবু... তার জীবনের সব প্রাণচ্ছলতা যেন কি করে নিমেশে উবে গেল এক ফুৎকারে... তার মনে হচ্ছিল যেন জীবনের সমস্ত রঙ গন্ধ কেউ এক লহমায় মুছে দিয়ে গিয়েছে... একটা বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।
হটাৎ করে ওর সেই অস্বস্থিটা যেন ফিরে আসে... সিরসির করে ওঠে নগ্ন শরীরটা... মনে হয় অন্ধকার ঘরের মধ্যে কারুর উপস্থিতি... অনুভব করার চেষ্টা করে নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ... বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই পৃথার মধ্যে এই অনুভূতিটা আরো বেশি করে চেপে বসেছে... শুধু অনুভূতিই বা এখন আর বলে কি করে সে? হাতে গরম বেশ কিছু প্রমাণও তো পেয়েছে ইতিমধ্যেই। ওর জায়গায় যদি অন্য কোন মেয়ে থাকতো, ও নিশ্চিত, এতদিনে পাততাড়ি গুটিয়ে পালাতো ফ্ল্যাট থেকে সে। কিন্তু ও সেটা হতে দিতে পারে না। এত সহজে পিছিয়ে যাবার মেয়ে, পৃথা নয়। প্রথম প্রথম খেয়াল করতো ওর অনুপস্থিতিতে কিচেনে রাখা বিস্কিটের কৌটোটা হয়তো ঠিক জায়গায় নেই, বা ফ্রীজে রাখা রান্না করে রেখে দেওয়া খাবারের ঢাকাটা খোলা... গায়ে মাখেনি সেটা নিয়ে আগে, ভেবেছে হয়তো তারই ভুল, কিন্তু যত দিন গিয়েছে, ততই ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কমে এসেছে। শেষে ইচ্ছা করেই দেখে রাখতো ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কোনটা কি ভাবে রয়েছে, ফিরে দেখেছে যে, হ্যা, ঠিক যা ভেবেছে তাই, সরে গিয়েছে আগের অবস্থান থেকে খাবারের জিনিসগুলো। শুধু এটাই নয়, বাইরের থেকে ঘরে ঢুকলেই ওর মনে হতো যেন ওর অনুপস্থিতিতে ঘরের মধ্যে কেউ ছিল, দরজার চাবী ঘোরাবার আওয়াজে সরে গিয়েছে। প্রমাণস্বরূপ কতদিন হয়েছে ঘরে ঢুকে দেখেছে যে ফ্যানটাকে ঘুরতে, কিন্তু ও একেবারেই সুনিশ্চিত যে বেরুবার সময় ও সমস্ত সুইচ অফ করে দিয়েই বেরিয়েছিল। অস্বীকার করবে না পৃথা, প্রথম দিকে বেশ ভয় ভয়ই করতো তার, কিন্তু যত দিন গেছে, তত বুঝেছে, যেই থাকুক না কেন তার এই ফ্ল্যাটে, আর যাই করুক সে, কিন্তু তার ক্ষতি কক্ষনো করবে না... কেন জানে না পৃথা, একটা বিশ্বাস বুকের মধ্যে বাসা বেঁধে ছিল... তাই এটা নিয়ে কোন শোরগোলও আর করে নি, কতকটা ইচ্ছা করেই। বিশেষ করে সুশান্তকে তো এই ব্যাপারে কোন কথাই বলে নি ও। কারণ পৃথা জানতো যে সুশান্ত যদি এই সব ঘটনা জানতে পারে, আগে ওকে এই ফ্ল্যাটটার থেকে সরাবে, আর সেটা ও কোন মতেই চায় না... কেন চায় না, সেটা তো ওর থেকে আর ভালো কেউ জানে না। শুধু আগের মত বেখায়াল থাকে না। আজকাল চান করার সময় বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করতে ভোলে না, বা রাত্রেও আগের মত একেবারে নগ্ন দেহে ঘুমায় না। শোবার সময় ব্রা প্যান্টি না পড়লেও, একটা পাতলা স্লিপ গায়ে তুলে নেয়। ব্যাপারটা ভৌতিক না কি অন্য কিছু, তার উত্তরও সঠিক ভাবে নেই ওর কাছে... প্রণববাবুর কাছ থেকে অর্নবের শেষ পরিসমাপ্তির কথা শোনার পরও যেন এখন একটা কোথাও ক্ষীণ আশা বুকের মধ্যে বাসা বেঁধে রয়েছে তার...
তাই, এখনো ওই অনুভুতিটা হতেই শিরদাঁড়া দিয়ে কেমন একটা সিরসিরানি বয়ে যায় তার... মেয়েলি স্বজ্ঞায় হাতটা চলে যায় নিজের বুকের ওপরে... হাত পড়তেই খেয়াল হয় নিজের শরীরটা নিরাবরণ... তার অজান্তে কখন তোয়ালেটা শরীর থেকে খসে পড়ে গিয়েছে... একবার ভাবে তোয়ালেটা তুলে জড়িয়ে নেয় শরীরে... কিন্তু পরক্ষনেই সে ইচ্ছা ঝেড়ে ফেলে দেয় মনের থেকে... ওই রকম নগ্ন ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে... ইচ্ছা করে নিজের এই নিটোল নগ্ন শরীরটাকে ঘরের মধ্যে উপস্থিত কায়াহীনের সামনে মেলে ধরে রাখতে... ইন্দ্রীয়টা সজাগ হয়ে ওঠে আরো... বোঝার চেষ্টা করে ঘরের মধ্যে থাকা দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিটাকে।
হটাৎ কানে আসে ড্রইংরুম থেকে বেজে ওঠা মোবাইলের আওয়াজ... প্রায় চমকে ওঠে সে এই ভাবে হটাৎ করে আওয়াজ পেয়ে... ধড়াস করে ওঠে বুকের মধ্যেটায়... কিন্তু তারপরই হেসে ফেলে নিজের বোকামী দেখে... মাটির থেকে তোয়ালেটা হাতে তুলে নিয়ে ওই অবস্থাতেই দ্রুত এগিয়ে যায় মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ লক্ষ্য করে। অন্ধকারের মধ্যেই সোফাটার অবস্থান আন্দাজ করে হাতের মধ্যে ধরা তোয়ালেটাকে ছুড়ে দেয়... তারপর হাতড়ায় সেন্টার টেবিলের ওপরে মোবাইলটার জন্য... বেজেই চলেছে, কিন্তু কোথায় সেটা? বিরক্ত হয়ে ওঠে মনটা... পরক্ষনেই মনে হয় যে মোবাইলটা ব্যাগ থেকে বেরই করা হয় নি ঘরে ঢোকার পর... সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এগোতে যায় সোফার দিকে... মনে পড়ে ঘরে ঢুকে সোফার ওপরেই ছুড়ে রেখে দিয়েছিল কাঁধের থেকে ব্যাগটা, গা’য়ের থেকে ভিজে জামা খোলার তাগিদে। ‘উফফফ্...’ যেতে গিয়ে পায়ে ধাক্কা লাগে সেন্টার টেবিলের কোনাটায়... আরো যেন বিরক্তি ছেয়ে ধরে মনের মধ্যে... ব্যথা পাওয়া জায়গায় হাত বোলাতে বোলাতেই এগিয়ে যায় সোফার দিকে... হাতের আন্দাজে কিছুক্ষন আগে ছুড়ে রাখা তোয়ালের নিচ থেকে টেনে বের করে ব্যাগটা... চেন খুলে তাড়াতাড়ি মোবাইলটা বের করে কলার নামের ওপরে চোখ রাখে পৃথা... ‘বাপী?...’ নিমেশে যেন মনের মধ্যে জমে থাকার শত বিরক্তি গুলো কোন এক জাদুর স্পর্শে উবে যায় সাথে সাথে... মুখটা চকচক করে ওঠে এক অপার্থিব ভালো লাগায়... কল রিসিভ করে কানে তোলে ফোনটাকে... ‘হ্যা বাপী... বলো...’ গলার স্বরে আদুরে আভাস মিশে যায়।
‘এতক্ষন কোথায় ছিলিস রে মা? সেই তখন থেকে ফোন বাজছে?’ ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে পৃথার বাবার উদবিগ্ন স্বর।
‘আর বোলো না বাপী, এখানে এই কিছুক্ষন আগে ঝুপ করে লোডশেডিং হয়ে গেলো, তাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না ফোনটা... সেই জন্যেই তো ফোনটা তুলতে দেরী হলো...’ বলে পৃথা। ফোনটা কানে নিয়ে ফিরে আসে বেডরুমে... খাটের ওপরে বালিসটাকে টেনে বেডরেস্টে রেখে ভালো করে হেলান দিয়ে বসে বলে ‘হটাৎ তুমি ফোন করলে? তোমরা ঠিক আছো তো?’ এবার পৃথার উদবিগ্ন হবার পালা।
‘হ্যা রে মা, আমরা ঠিক আছি... আসলে তুই ফোন করিস নি আজকে সন্ধ্যেবেলায়, তাই তোর মা একটু অস্থির হয়ে উঠছিল, সেই জন্য ভাবলাম একবার ফোন করে দেখি... এই নে, মায়ের সাথে কথা বল...’ বোঝা গেল কথাগুলো বলে ফোনটা এগিয়ে দিলেন নিজের স্ত্রী’য়ের দিকে।
‘ইশ... সত্যিই তো... মাকে ফোন করতে একদম ভুলে গিয়েছি...’ মনে মনে ভাবে পৃথা। আসলে প্রতিদিনই নিয়ম করে অফিস থেকে ফিরে একবার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে পৃথা, এটা অবস্য ওর মায়েরই কড়া নির্দেশ... মেয়ে যতক্ষন না বাড়ি ফিরে ফোন করে, ততক্ষন যে ওনারা দুশ্চিন্তায় থাকে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। পৃথা এই নিয়ে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ও বড় হয়েছে, এখন এই রকম দুশ্চিন্তা করার কোন মানেই হয় না, কিন্তু তবুও, শোনেন নি ওর মা, মেয়ে যতই বড় হোক না কেন, তবুও, সে এত দূরে থাকে, সেখানে একবার ফিরে ফোন করলে যে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েকে। অগত্যা, সেটাই দস্তুর হয়ে গিয়েছে কোলকাতায় আসা ইস্তক... প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে মাকে একবার ফোন করে কথা বলতেই হয় তাকে। কিন্তু আজকে বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েই সব কিছু গন্ডগোল হয়ে গিয়েছে... ভিজে জামা ছেড়ে চান করে হয়তো ফোন করতো, কিন্তু তার মধ্যে লাইটটাও গেছে নিভে... তাই মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছে ফোন করার ব্যাপারটা।
‘তুই কি রে তিতির? একটা ফোন করতে এত অনিহা... জানিস আমরা কত টেনশন নিয়ে বসে থাকি তোর ফোনের অপেক্ষায়... এটা আর কবে বুঝবি বলতো... একটা ফোন করতে পারিস না? বুঝবি বুঝবি... যখন মা হবি তখন বুঝবি যে বাবা মা কি রকম টেনশন করে সন্তানদের জন্য... আর কি ভাবে বোঝাবো তোকে...’ একের পর এক সুনামীর মত মায়ের অভিমান ভেসে এসে আছড়ে পড়তে থাকে পৃথার কানের মধ্যে... তাকে কিছু বলার সুযোগই দেন না...
শেষে একটু গলাটা তুলেই বলে ওঠে পৃথা, ‘আরে বাবা, তুমি থামবে? আগে শুনবে তো কেন ফোন করি নি...’
‘হ্যা, আর কি শোনাবি... ওই তো বলবি অফিসের এত কাজের চাপ যে ফোন করতেই ভুলে গিয়েছি... সেটাই তো হয় রে... সন্তান যখব বড় হয় তখন এই ভাবেই বাবা মায়েদের ভুলে যায় তারা...’ শেষে দিকে সম্ভবতঃ গলাটাই ধরে আসে পৃথার মায়ের...
‘আরে বাবা, না না, সে সব কিচ্ছু নয়... আজকে অফিস থেকে ফেরার পথে একেবারে ভিজে গিয়েছিলাম... তাই...’ আর কথা শেষ করতে পারে না পৃথা... তার আগেই প্রায় ঝাপিয়ে পড়েন তার মা, ফোনের মধ্যেই...
‘সে কি রে তিতির... তুই বৃষ্টিতে ভিজেছিস... কি করে?... কেন ছাতা ছিল না... তাও ভিজলি কি করে? এখনও ভিজে কাপড়েই রয়েছিস না কি রে? এ বাবা, সেটা আগে বলবি তো... ঠান্ডা লাগে নি তো? টেম্পারেচার নিয়েছিস... জ্বর এসে যায় নি তো?...’ এবার শুরু হয় উদবিগ্ন প্রশ্নের ধারা।
‘আরে না, সেই রকম কিছ নয়... আজকে ছাতাটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম... তাই আসার সময় একটু ভিজে গিয়েছি... তাও অনেক আগে...’ বলে বোঝাতে যায় মাকে...
‘অনেক আগে ভিজেছিস... এখনও সেই ভিজে জামা কাপড়েই রয়েছিস নাকি? শিগগির ছেড়ে ফেল ভিজে কাপড় জামা... এই জন্যই চিন্তা হয় তোকে নিয়ে... তোকে বরাবর বলেছি ভিজে জামা কাপড়ে থাকবি না... এই জন্যই চাইনি দূরে গিয়ে একা থাকিস... কিন্তু শুনলে তো মেয়ে মায়ের কথা... আর শুনবেই বা কেন? মায়ের কথা তো... তার মূল্যই বা কতটুকু...’
‘তুমি এবার থামবে? নাকি ফোনটা রাখবো?’ এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করে পৃথার... একে মনটা ভালো নেই, তার ওপরে মায়ের এই অনর্থক বকবকানি... ভালো লাগে?
এবার আর কোন কথা আসে না ফোনের ওপার থেকে... পৃথাও বোঝে ঝাঁঝিয়ে ওঠাটা একটু কাজ দিয়েছে হয়তো, আর তা না হলে অভিমানে মুখ ভার হয়েছে মায়ের... গলার স্বরটাকে স্বাভাবিক করে বলে সে, ‘না, মা, রাগ করছ কেন? আমি তো ভিজে জামা কাপড় সব ছেড়েই ফেলেছি... আর দেখ, চানও করে নিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে... সত্যিই... বিশ্বাস করো...’
মেয়ের কথায় একটু আস্বস্থ হন ভদ্রমহিলা, গলাটা নামিয়ে বলেন, ‘ঠিক তো মা, চান করে নিয়েছিস তো... আজকে আর রাতে আর ফ্যান চালিয়ে শুস না... লক্ষ্মী মা আমার... দেখ... তুই ওখানে একা আছিস, খুব চিন্তায় থাকি রে মা...’
হেসে ফেলে পৃথা... ‘উফ্ এত চিন্তা করো না মাদার ইন্ডিয়া... তোমার তিতির এখন বড় হয়ে গেছে... সেই ছোট্টটি আর নেই... এখন নিজেই সব কিছু একা সমলাতে পারে... বুঝলে?’
‘ছাই বড় হয়েছিস... এখনও তো খাইয়ে না দিলে খাস না... সেখানে কত যে বড় হয়েছিস তা আমার জানা আছে...’ বলে ওঠেন পৃথার মা।
‘তুমি এখনও ঝগড়া করবে আমার সাথে?’ আদুরে গলায় বলে ওঠে পৃথা।
মেয়েকে এই ভাবে বলতে শুনে আর রাগ করে থাকতে পারেন না ওর মা, ‘না রে মা, রাগ নয়, চিন্তা হয়... একা একা থাকিস তো... তাই... একটু সাবধানে থাকিস, কেমন... আর যদি শরীর খারাপ লাগে ডাক্তার দেখিয়ে নিতে ভুলিস না... আমাদেরও সাথে সাথে ফোন করিস... এই নে... বাবা আবার ব্যস্ত হচ্ছে, কথা বল বাবার সাথে...’
হটাৎ ড্রইংরুমের আলোটা জ্বলে ওঠে... কারেন্ট চলে আসে... আগেই বেডরুমের আলোর সুইচটা নিভিয়ে রাখাতে ঘরের আলোটা আর জ্বলেনি তাই... তবুও ড্রইংরুমের থেকেই বেশ খানিকটা আলো এসে ঘরটাকে আলোকিত করে তোলে... ঘরের আলো জ্বালাবার আর খুব প্রয়োজন হয় না।
বাইরে তখনও নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে... ঝিরঝিরে বৃষ্টির জলের ছাট এসে ঢুকছে ঘরের মধ্যে... পৃথা বিছানা ছেড়ে উঠে এগিয়ে যায় জানলার কাছে, শার্সিগুলো বন্ধ করে দেয় টেনে... দিয়ে ফিরে আসে বিছানায় আবার।
‘ভিজে গেছিস শুনলাম তোর মায়ের কাছে... এখন ঠিক আছিস তো?’ বাবার গলা পায় ফোনের মধ্যে।
‘হ্যা বাপী, আমি ঠিক আছি... তোমরা চিন্তা করো না...’ বলে থামে একটু, তারপর হটাৎ করে মনে পড়ে যেতে বলে ওঠে, ‘বাপী, তোমার প্রেশারের অসুধটা আনিয়েছিলে? ওটা তো শেষ হয়ে যাবার কথা এত দিনে।’
‘হ্যা, হ্যা, আনিয়ে নিয়েছি, তোকে আর ওখানে বসে আমার অসুধের কথা চিন্তা করতে হবে না রে মা... তুই একটু সাবধানে থাকিস, তোর মা বড্ড চিন্তা করে তোকে নিয়ে।’
‘হুম... আমার মা শুধু চিন্তা করে, আর আমার মিষ্টি বাপী এক্কেবারেই ভাবে না তার প্রিন্সেসকে নিয়ে, তাই তো?’ হাসতে হাসতে বলে বাবার কথার জবাবে।
‘না, মানে, আমারও চিন্তা হয় না যে তা নয়, তাও...’ আমতা আমতা করেন ভদ্রলোক।
‘থাক, জানা আছে আমার, আমার বাপীর কাছে আমি কি... আচ্ছা, এবার রাখো... কারেন্ট এসে গেছে...’ হাসতে হাসতে বলে পৃথা।
‘সেকি রে, এতক্ষন কারেন্ট ছিল না?’ প্রশ্ন করেন পৃথার বাবা।
‘না তো... আর সেই সাথে কি বৃষ্টি হচ্ছে বাপী কি বলবো... সেই সন্ধ্যে থেকে নেমেছে, সমানে চলছে... এই এত্তো বড় বড় ফোঁটা... জানলা বন্ধ করে দিতে হয়েছে, এত ছাঁট আসছে...’ হাত নেড়ে বলতে থাকে নিজের বাবাকে।
‘দেখিস মা, সাবধানে থাকিস... কেমন... এবার রাখি?’ বলেন ভদ্রলোক।
‘হ্যা, হ্যা, রাখো... তোমরাও সাবধানে থেকো... কেমন... লাভ ইয়ু বাপী... মাকেও চিন্তা করতে বারণ কোরো...’ বলে ফোনটা কেটে দেয় পৃথা।
‘নাঃ, আজ আর রাত্রে কিছু খাবো না... ভাল্লাগছে না... চোখগুলোও কেমন জ্বালা জ্বালা করছে, কে জানে, জ্বর আসবে কি না? মা শুনলে তো লাফাতো... ভাজ্ঞিস কিছু বলি নি... দেখি, শুধু একটু হরলিক্স গুলে খেয়ে শুয়ে পড়বো... কাল সকালে যা হোক দেখা যাবে’খন...’ ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ায় বিছানা ছেড়ে... মাথাটা কেমন ভার লাগে... হাতের তেলোটা উলটে ছোয়ায় কপালে, একটু যেন গরম মনে হয়। কিচেনে যাবে মনে করেও আর যায় না, বাথরুমের দিকে এগোয়। কোমডের ওপরে বসে হিসি করে হাল্কা হয় খানিকটা, তারপর উঠে হাতে জল নিয়ে পরিষ্কার হয়ে ফিরে আসে আবার বেডরুমেই। আসার পথে ড্রইংরুমের আলোটাও নিভিয়ে দেয়। মনে হয় কেমন যেন শীত শীত করছে... ঘরের ফ্যানটার রেগুলেটর ঘুরিয়ে একটু কমিয়ে দিয়ে কাবার্ড থেকে একটা গোল গলার টি-শার্ট বের করে পড়ে নেয় গায়ে... তারপর বালিশটা টেনে শুয়ে পড়ে বিছানায়... হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিলের ওপরে রাখা অর্নবের ছবিটায় একবার আলতো করে হাত বোলায়... ‘একটু পরে না হয় উঠে হরলিক্সটা করে নেবো’খন’ ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করে পৃথা।
প্রণববাবু ঘুরে যাবার পর বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে, এক সন্ধ্যায়, ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ঘরে ঢোকে পৃথা তড়িঘড়ি... ‘ইশ... খুব ভুল হয়ে গেছে আজকে...’ মনে মনে ভাবে... সকালবেলায় বেরুবার সময় সাধারণত যে ব্যাগটা নিয়ে অফিসে যায়, সেটা আজকে নেয় নি, আর তার ফলে ছাতাটাও বের করতে ভুলে গিয়েছিল ওই ব্যাগটা থেকে। ফেরার পথে এই রকম ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে কে জানতো... একেবারে চুপচুপে ভিজে গিয়েছে... কতক্ষন অটোর জন্য দাঁড়িয়েছিল... এমন জায়গায় অটো স্ট্যান্ডটা যে একটু যে শেডের তলায় দাঁড়াবে, তারও যো নেই... দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে হয়েছে ওকে...
পায়ের জুতোটাকে কোনরকমে খুলে হাতের ব্যাগটাকে সোফার ওপরে ছুড়ে দিয়ে বাথরুমের দিকে দৌড়ায়... এ ভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ড্রইংরুমের মেঝেটা ভিজে নোংরা হয়ে যাবে শুধু শুধু... পরে তো তাকেই সেই কাদা পরিষ্কার করতে হবে। বাথরুমে যাবার পথেই জামার বোতামগুলো খুলতে থাকে দ্রুত হাতে, ঢুকেই বাথরুমের দরজাটাকে আলগোছে টেনে ভিজিয়ে রেখে গা’য়ের থেকে টেনে জামাটা খুলে ফেলে দেয় বালতিটার মধ্যে... হাত দেয় জিন্সের বোতামে... ভিজে গিয়ে একেবারে সেঁটে গিয়েছে পায়ের সাথে জিন্সটা... বোতাম আর চেন খুলে কোমর থেকে দেহটাকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে নেড়ে নেড়ে টেনে নামায় শরীর থেকে প্যান্টটাকে... ‘ইশ... কি কুক্ষনেই না আজকেই জিন্স শার্ট পরে অফিসে গিয়েছিলাম... কুর্তি হলে তাও একটু হালকা হত... এতো একেবারে ভিজে ভারী হয়ে উঠেছে...’ জিন্সটারও জায়গা হয় বালতির মধ্যে... নজর পড়ে নিজের শরীরে পরে থাকে ব্রা প্যান্টির দিকে... ‘দেখ কি অবস্থা... ও গুলোও তো দেখছি ভিজে গিয়েছে... মরণ আর কি... বৃষ্টি হবার আর সময় হলো না... আর একটু পরে নামতে পারতো... ততক্ষনে বাড়ি পৌছে যেতাম... ক’দিন ধরেই গা’টা ম্যাজম্যাজ করছে, তার ওপর এই ভাবে ভিজলাম, জ্বর না আবার এসে যায়...’ হাত ঘুরিয়ে অভ্যস্থ হাতে ব্রায়ের হুকটা আলগা করতে করতে ভাবে পৃথা।
প্যান্টিটা খুলে দাঁড়ায় শাওয়ারের নিচে... কলটা খুলতেই ছাদের রিজার্ভারের জমা ঠান্ডা জল ছিটিয়ে পড়ে নগ্ন দেহের ওপরে... হটাৎ করে গায়ের ওপরে এসে পড়া ঠান্ডা জলে কাঁপুনি ধরে যায় তার... ‘উউউহুহুহুহু...’ করে চিৎকার করে ওঠে... ভিষন শীত করতে থাকে তার... হাত দুটোকে জড়ো করে ধরে বুকের ওপরে... একটু একটু করে জলের ঠান্ডা ভাবটা সয়ে যেতে থাকে শরীরের তাপমাত্রার সাথে... সেও স্বাভাবিক হয় যেন একটু... এবার ভালো করে জলের ধারার নীচে দাঁড়িয়ে শরীরের ওপরে জলটা নিতে থাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে... চোখদুটো বন্ধ করে রাখে আরামে... নিরাবরণ নিটোল তম্বী শরীরটা বেয়ে জলের ধারা মাথার থেকে নেমে ধেয়ে যায় মাটির দিকে।
বাথরুম থেকে বড় তোয়ালেটা সারা শরীরে জড়িয়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় ড্রইংরুমের মধ্যে... তোয়ালের খুঁটটা গুঁজে রাখে পায়রার মত দুটো নরম বুকদুটোকে ঢেকে রেখে... শেষ প্রান্তটা গিয়ে হাঁটুর অনেক ওপরেই শেষ হয়ে যায়... নিটোল কাঁধদুটো থাকে সম্পূর্ণ নিরাবরণ... ‘সর্বনাশ... বাইরের দরজাটাই বন্ধ করি নি? দেখেছ অবস্থা!’ বাইরের দরজাটার দিকে তাকিয়ে নিজের ভুলে আঁতকে ওঠে পৃথা... দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ফাঁক হয়ে থাকা দরজাটার দিকে... হাতের চাপে ঢেলে দেয় দরজাটাকে... ইয়েল লকের খট করে আওয়াজ তুলে বন্ধ হয়ে যায় দরজাটা... ‘ইশ... দেখেছ কান্ড আমার... যদি কেউ ঢুকে পড়তো এখন? এ বাবা... আমিও তো একেবারে ন্যাংটো হয়ে চান করছিলাম...’ যেন নিশ্চিন্ত হতেই একবার উঁকি মারে আধো অন্ধকার কিচেনের মধ্যে... তারপর গিয়ে আলো জ্বালে বেডরুমে... ভালো করে চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে নেয় একবার... খেয়াল করে ঘরের লাগোয়া বারান্দার দরজার ছিটকিনিটার দিকে... ‘নাঃ... বাবাহঃ... কেউ ঢোকে নি... ইশ... কি ভুলটাই না করে বসেছিলাম...’ ঘুরে দাঁড়ায় আয়নার সামনে... নিজেই নিজেকে ভেঙচি কাটে আয়নার প্রতিফলনের মধ্যে দিয়ে... জানলার ওপারে তখন অঝরে ঝরে চলেছে বৃষ্টি।
কড়্... কড়্... কড়াৎ... মেঘে ঢাকা সন্ধ্যের কালো আকাশটাকে চিরে বিকট শব্দে বাজটা পড়ল... আকস্মিক বাজের শব্দে চমকে উঠলো পৃথা... তারপরই ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেল... একটা নিশ্ছিদ্র কালো অন্ধকার ওকে যেন জড়িয়ে ধরল চতুর্দিক থেকে...
চুপ করে খানিক এক ভাবে দাঁড়িয়ে রইল ওখানটাতেই... একটু একটু করে অন্ধকারটা চোখের মধ্যে সয়ে আসতে লাগলো... জানলা দিয়ে আসা বাইরের সন্ধ্যের আলোয় অস্পষ্ট ভাবে চোখে পড়তে লাগলো ঘরের মধ্যেটা... ধীর পদক্ষেপে খুব সাবধানে বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো ড্রইংরুমের মধ্যে... ‘ইশ... এখানেটা তো আরো বেশি অন্ধকার... নিশ্চয় বাজ পড়ে কোথাও কোন ট্রান্সফর্মার উড়েছে... নয়তো এই ভাবে কারেন্ট যেতো না...’ একা একা কথা বলে... হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে... তাকের ওপর থেকে মোমবাতি আর দেশলাইটা পেড়ে জ্বালায় সেটি... মোমের নরম আলোয় ভরে যায় কিচেনটা... সাবধানে হাতে জ্বলন্ত মোমবাতিটা ধরে ফিরে আসে ড্রইংরুমে... এগিয়ে গিয়ে বাইরের দরজার লকটাকে তুলে দেয় ভালো করে... তারপর গুটিগুটি পায়ে মোমবাতির শিখাটাকে হাতের তেলোর আড়াল করে এগিয়ে চলে বেডরুমের দিকে। বেডরুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই জানলা থেকে ঠান্ডা এক ঝলক বাতাস হৈ হৈ করে ঢুকে দুম করে নিভিয়ে দেয় মোমবাতিটাকে... ‘যাহঃ... দূর... ভাল্লাগে না...’ নিভে যাওয়া মোমবাতিটাকে হাতের মধ্যে ধরে স্বগক্তি করে পৃথা... সেটাকে বেডসাইড টেবিলের ওপরেই রেখে দিয়ে সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে অফ্ করে দেয় ঘরের আলোটাকে তারপর এগিয়ে যায় ঘরের জানলাটার কাছে... জানলার পাল্লাদুটো খুলে দেয়... বাইরের থেকে ঠান্ডা বাতাসের সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ছাট এসে লাগে ওর চোখে মুখে... ভালো লাগায় মনটা ভরে যায়... জানলার ফ্রেমটায় হাত রেখে মুখটাকে যথাসম্ভব বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে... মুখের ওপরে জলের ঝাপটা নিতে থাকে মনের আনন্দে।
ওই ভাবে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে মাথাটাকে হেলিয়ে জানলার ফ্রেমে ঠেস দিয়ে... অন্ধকার ঘরের মধ্যে একলা সে... কেমন যেন আস্তে আস্তে মনটা ভারী হয়ে ওঠে... প্রণববাবু ফিরে যাবার পর থেকেই মাঝে মধ্যেই আজকাল কিছু ভালো লাগে না তার... থেকে থেকে বুকের মধ্যেটায় একটা না চেনা বোঝা চেপে বসে যেন... হারিয়ে ফেলে নিজেকে এক দুঃসহ চাপা কষ্টের আবর্তে...
জানলার ফ্রেমে মাথা রেখেই মৃধু স্বরে গুনগুন করে গান ধরে আপন মনে...
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের ‘পরে, বুকের ‘পরে।।
পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে-
নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রানে।
নিশিদিন এই জীবনের সুখের ‘পরে দুখের ‘পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে।
যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে,
তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে।
যা-কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা,
তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা।
নিশিদিন এই জীবনের তৃষার ‘পরে, ভুখের ‘পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে।।
কেন জানা নেই, পৃথার চোখের কোল দিয়ে আনমনে গড়িয়ে পড়তে থাকে নোনা জলের ধারা। গানটা শেষ করে চুপ করে আরো খানিকক্ষন ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে বৃষ্টির ছাঁটের মুখে... চোখের উষ্ণ জলের সাথে মিশে যায় বৃষ্টির ঠান্ডা জল। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন গায়ের থেকে তোয়ালেটা মাটিতে খসে পড়ে গিয়েছে, খেয়ালও নেই তার... ওই ভাবেই নগ্ন দেহে দাঁড়িয়ে থাকে সে বাইরের পানে তাকিয়ে। সেদিনের পর থেকে কিছুতেই সরিয়ে রাখতে পারছে না অর্নবকে মনের মধ্যে থেকে... একি হয়ে গেলো... একটা কল্পসুখের মধ্যে সে ভেসে ছিল, কিন্তু হটাৎ করে যেন তাকে টেনে হিঁচড়ে বাস্তবের কঠিন মাটির ওপরে আছড়ে ফেলে দিয়ে গেলেন ওই ভদ্রলোক... প্রণববাবু... তার জীবনের সব প্রাণচ্ছলতা যেন কি করে নিমেশে উবে গেল এক ফুৎকারে... তার মনে হচ্ছিল যেন জীবনের সমস্ত রঙ গন্ধ কেউ এক লহমায় মুছে দিয়ে গিয়েছে... একটা বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।
হটাৎ করে ওর সেই অস্বস্থিটা যেন ফিরে আসে... সিরসির করে ওঠে নগ্ন শরীরটা... মনে হয় অন্ধকার ঘরের মধ্যে কারুর উপস্থিতি... অনুভব করার চেষ্টা করে নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ... বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই পৃথার মধ্যে এই অনুভূতিটা আরো বেশি করে চেপে বসেছে... শুধু অনুভূতিই বা এখন আর বলে কি করে সে? হাতে গরম বেশ কিছু প্রমাণও তো পেয়েছে ইতিমধ্যেই। ওর জায়গায় যদি অন্য কোন মেয়ে থাকতো, ও নিশ্চিত, এতদিনে পাততাড়ি গুটিয়ে পালাতো ফ্ল্যাট থেকে সে। কিন্তু ও সেটা হতে দিতে পারে না। এত সহজে পিছিয়ে যাবার মেয়ে, পৃথা নয়। প্রথম প্রথম খেয়াল করতো ওর অনুপস্থিতিতে কিচেনে রাখা বিস্কিটের কৌটোটা হয়তো ঠিক জায়গায় নেই, বা ফ্রীজে রাখা রান্না করে রেখে দেওয়া খাবারের ঢাকাটা খোলা... গায়ে মাখেনি সেটা নিয়ে আগে, ভেবেছে হয়তো তারই ভুল, কিন্তু যত দিন গিয়েছে, ততই ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কমে এসেছে। শেষে ইচ্ছা করেই দেখে রাখতো ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কোনটা কি ভাবে রয়েছে, ফিরে দেখেছে যে, হ্যা, ঠিক যা ভেবেছে তাই, সরে গিয়েছে আগের অবস্থান থেকে খাবারের জিনিসগুলো। শুধু এটাই নয়, বাইরের থেকে ঘরে ঢুকলেই ওর মনে হতো যেন ওর অনুপস্থিতিতে ঘরের মধ্যে কেউ ছিল, দরজার চাবী ঘোরাবার আওয়াজে সরে গিয়েছে। প্রমাণস্বরূপ কতদিন হয়েছে ঘরে ঢুকে দেখেছে যে ফ্যানটাকে ঘুরতে, কিন্তু ও একেবারেই সুনিশ্চিত যে বেরুবার সময় ও সমস্ত সুইচ অফ করে দিয়েই বেরিয়েছিল। অস্বীকার করবে না পৃথা, প্রথম দিকে বেশ ভয় ভয়ই করতো তার, কিন্তু যত দিন গেছে, তত বুঝেছে, যেই থাকুক না কেন তার এই ফ্ল্যাটে, আর যাই করুক সে, কিন্তু তার ক্ষতি কক্ষনো করবে না... কেন জানে না পৃথা, একটা বিশ্বাস বুকের মধ্যে বাসা বেঁধে ছিল... তাই এটা নিয়ে কোন শোরগোলও আর করে নি, কতকটা ইচ্ছা করেই। বিশেষ করে সুশান্তকে তো এই ব্যাপারে কোন কথাই বলে নি ও। কারণ পৃথা জানতো যে সুশান্ত যদি এই সব ঘটনা জানতে পারে, আগে ওকে এই ফ্ল্যাটটার থেকে সরাবে, আর সেটা ও কোন মতেই চায় না... কেন চায় না, সেটা তো ওর থেকে আর ভালো কেউ জানে না। শুধু আগের মত বেখায়াল থাকে না। আজকাল চান করার সময় বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করতে ভোলে না, বা রাত্রেও আগের মত একেবারে নগ্ন দেহে ঘুমায় না। শোবার সময় ব্রা প্যান্টি না পড়লেও, একটা পাতলা স্লিপ গায়ে তুলে নেয়। ব্যাপারটা ভৌতিক না কি অন্য কিছু, তার উত্তরও সঠিক ভাবে নেই ওর কাছে... প্রণববাবুর কাছ থেকে অর্নবের শেষ পরিসমাপ্তির কথা শোনার পরও যেন এখন একটা কোথাও ক্ষীণ আশা বুকের মধ্যে বাসা বেঁধে রয়েছে তার...
তাই, এখনো ওই অনুভুতিটা হতেই শিরদাঁড়া দিয়ে কেমন একটা সিরসিরানি বয়ে যায় তার... মেয়েলি স্বজ্ঞায় হাতটা চলে যায় নিজের বুকের ওপরে... হাত পড়তেই খেয়াল হয় নিজের শরীরটা নিরাবরণ... তার অজান্তে কখন তোয়ালেটা শরীর থেকে খসে পড়ে গিয়েছে... একবার ভাবে তোয়ালেটা তুলে জড়িয়ে নেয় শরীরে... কিন্তু পরক্ষনেই সে ইচ্ছা ঝেড়ে ফেলে দেয় মনের থেকে... ওই রকম নগ্ন ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে... ইচ্ছা করে নিজের এই নিটোল নগ্ন শরীরটাকে ঘরের মধ্যে উপস্থিত কায়াহীনের সামনে মেলে ধরে রাখতে... ইন্দ্রীয়টা সজাগ হয়ে ওঠে আরো... বোঝার চেষ্টা করে ঘরের মধ্যে থাকা দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিটাকে।
হটাৎ কানে আসে ড্রইংরুম থেকে বেজে ওঠা মোবাইলের আওয়াজ... প্রায় চমকে ওঠে সে এই ভাবে হটাৎ করে আওয়াজ পেয়ে... ধড়াস করে ওঠে বুকের মধ্যেটায়... কিন্তু তারপরই হেসে ফেলে নিজের বোকামী দেখে... মাটির থেকে তোয়ালেটা হাতে তুলে নিয়ে ওই অবস্থাতেই দ্রুত এগিয়ে যায় মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ লক্ষ্য করে। অন্ধকারের মধ্যেই সোফাটার অবস্থান আন্দাজ করে হাতের মধ্যে ধরা তোয়ালেটাকে ছুড়ে দেয়... তারপর হাতড়ায় সেন্টার টেবিলের ওপরে মোবাইলটার জন্য... বেজেই চলেছে, কিন্তু কোথায় সেটা? বিরক্ত হয়ে ওঠে মনটা... পরক্ষনেই মনে হয় যে মোবাইলটা ব্যাগ থেকে বেরই করা হয় নি ঘরে ঢোকার পর... সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এগোতে যায় সোফার দিকে... মনে পড়ে ঘরে ঢুকে সোফার ওপরেই ছুড়ে রেখে দিয়েছিল কাঁধের থেকে ব্যাগটা, গা’য়ের থেকে ভিজে জামা খোলার তাগিদে। ‘উফফফ্...’ যেতে গিয়ে পায়ে ধাক্কা লাগে সেন্টার টেবিলের কোনাটায়... আরো যেন বিরক্তি ছেয়ে ধরে মনের মধ্যে... ব্যথা পাওয়া জায়গায় হাত বোলাতে বোলাতেই এগিয়ে যায় সোফার দিকে... হাতের আন্দাজে কিছুক্ষন আগে ছুড়ে রাখা তোয়ালের নিচ থেকে টেনে বের করে ব্যাগটা... চেন খুলে তাড়াতাড়ি মোবাইলটা বের করে কলার নামের ওপরে চোখ রাখে পৃথা... ‘বাপী?...’ নিমেশে যেন মনের মধ্যে জমে থাকার শত বিরক্তি গুলো কোন এক জাদুর স্পর্শে উবে যায় সাথে সাথে... মুখটা চকচক করে ওঠে এক অপার্থিব ভালো লাগায়... কল রিসিভ করে কানে তোলে ফোনটাকে... ‘হ্যা বাপী... বলো...’ গলার স্বরে আদুরে আভাস মিশে যায়।
‘এতক্ষন কোথায় ছিলিস রে মা? সেই তখন থেকে ফোন বাজছে?’ ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে পৃথার বাবার উদবিগ্ন স্বর।
‘আর বোলো না বাপী, এখানে এই কিছুক্ষন আগে ঝুপ করে লোডশেডিং হয়ে গেলো, তাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না ফোনটা... সেই জন্যেই তো ফোনটা তুলতে দেরী হলো...’ বলে পৃথা। ফোনটা কানে নিয়ে ফিরে আসে বেডরুমে... খাটের ওপরে বালিসটাকে টেনে বেডরেস্টে রেখে ভালো করে হেলান দিয়ে বসে বলে ‘হটাৎ তুমি ফোন করলে? তোমরা ঠিক আছো তো?’ এবার পৃথার উদবিগ্ন হবার পালা।
‘হ্যা রে মা, আমরা ঠিক আছি... আসলে তুই ফোন করিস নি আজকে সন্ধ্যেবেলায়, তাই তোর মা একটু অস্থির হয়ে উঠছিল, সেই জন্য ভাবলাম একবার ফোন করে দেখি... এই নে, মায়ের সাথে কথা বল...’ বোঝা গেল কথাগুলো বলে ফোনটা এগিয়ে দিলেন নিজের স্ত্রী’য়ের দিকে।
‘ইশ... সত্যিই তো... মাকে ফোন করতে একদম ভুলে গিয়েছি...’ মনে মনে ভাবে পৃথা। আসলে প্রতিদিনই নিয়ম করে অফিস থেকে ফিরে একবার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে পৃথা, এটা অবস্য ওর মায়েরই কড়া নির্দেশ... মেয়ে যতক্ষন না বাড়ি ফিরে ফোন করে, ততক্ষন যে ওনারা দুশ্চিন্তায় থাকে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। পৃথা এই নিয়ে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ও বড় হয়েছে, এখন এই রকম দুশ্চিন্তা করার কোন মানেই হয় না, কিন্তু তবুও, শোনেন নি ওর মা, মেয়ে যতই বড় হোক না কেন, তবুও, সে এত দূরে থাকে, সেখানে একবার ফিরে ফোন করলে যে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েকে। অগত্যা, সেটাই দস্তুর হয়ে গিয়েছে কোলকাতায় আসা ইস্তক... প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে মাকে একবার ফোন করে কথা বলতেই হয় তাকে। কিন্তু আজকে বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েই সব কিছু গন্ডগোল হয়ে গিয়েছে... ভিজে জামা ছেড়ে চান করে হয়তো ফোন করতো, কিন্তু তার মধ্যে লাইটটাও গেছে নিভে... তাই মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছে ফোন করার ব্যাপারটা।
‘তুই কি রে তিতির? একটা ফোন করতে এত অনিহা... জানিস আমরা কত টেনশন নিয়ে বসে থাকি তোর ফোনের অপেক্ষায়... এটা আর কবে বুঝবি বলতো... একটা ফোন করতে পারিস না? বুঝবি বুঝবি... যখন মা হবি তখন বুঝবি যে বাবা মা কি রকম টেনশন করে সন্তানদের জন্য... আর কি ভাবে বোঝাবো তোকে...’ একের পর এক সুনামীর মত মায়ের অভিমান ভেসে এসে আছড়ে পড়তে থাকে পৃথার কানের মধ্যে... তাকে কিছু বলার সুযোগই দেন না...
শেষে একটু গলাটা তুলেই বলে ওঠে পৃথা, ‘আরে বাবা, তুমি থামবে? আগে শুনবে তো কেন ফোন করি নি...’
‘হ্যা, আর কি শোনাবি... ওই তো বলবি অফিসের এত কাজের চাপ যে ফোন করতেই ভুলে গিয়েছি... সেটাই তো হয় রে... সন্তান যখব বড় হয় তখন এই ভাবেই বাবা মায়েদের ভুলে যায় তারা...’ শেষে দিকে সম্ভবতঃ গলাটাই ধরে আসে পৃথার মায়ের...
‘আরে বাবা, না না, সে সব কিচ্ছু নয়... আজকে অফিস থেকে ফেরার পথে একেবারে ভিজে গিয়েছিলাম... তাই...’ আর কথা শেষ করতে পারে না পৃথা... তার আগেই প্রায় ঝাপিয়ে পড়েন তার মা, ফোনের মধ্যেই...
‘সে কি রে তিতির... তুই বৃষ্টিতে ভিজেছিস... কি করে?... কেন ছাতা ছিল না... তাও ভিজলি কি করে? এখনও ভিজে কাপড়েই রয়েছিস না কি রে? এ বাবা, সেটা আগে বলবি তো... ঠান্ডা লাগে নি তো? টেম্পারেচার নিয়েছিস... জ্বর এসে যায় নি তো?...’ এবার শুরু হয় উদবিগ্ন প্রশ্নের ধারা।
‘আরে না, সেই রকম কিছ নয়... আজকে ছাতাটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম... তাই আসার সময় একটু ভিজে গিয়েছি... তাও অনেক আগে...’ বলে বোঝাতে যায় মাকে...
‘অনেক আগে ভিজেছিস... এখনও সেই ভিজে জামা কাপড়েই রয়েছিস নাকি? শিগগির ছেড়ে ফেল ভিজে কাপড় জামা... এই জন্যই চিন্তা হয় তোকে নিয়ে... তোকে বরাবর বলেছি ভিজে জামা কাপড়ে থাকবি না... এই জন্যই চাইনি দূরে গিয়ে একা থাকিস... কিন্তু শুনলে তো মেয়ে মায়ের কথা... আর শুনবেই বা কেন? মায়ের কথা তো... তার মূল্যই বা কতটুকু...’
‘তুমি এবার থামবে? নাকি ফোনটা রাখবো?’ এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করে পৃথার... একে মনটা ভালো নেই, তার ওপরে মায়ের এই অনর্থক বকবকানি... ভালো লাগে?
এবার আর কোন কথা আসে না ফোনের ওপার থেকে... পৃথাও বোঝে ঝাঁঝিয়ে ওঠাটা একটু কাজ দিয়েছে হয়তো, আর তা না হলে অভিমানে মুখ ভার হয়েছে মায়ের... গলার স্বরটাকে স্বাভাবিক করে বলে সে, ‘না, মা, রাগ করছ কেন? আমি তো ভিজে জামা কাপড় সব ছেড়েই ফেলেছি... আর দেখ, চানও করে নিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে... সত্যিই... বিশ্বাস করো...’
মেয়ের কথায় একটু আস্বস্থ হন ভদ্রমহিলা, গলাটা নামিয়ে বলেন, ‘ঠিক তো মা, চান করে নিয়েছিস তো... আজকে আর রাতে আর ফ্যান চালিয়ে শুস না... লক্ষ্মী মা আমার... দেখ... তুই ওখানে একা আছিস, খুব চিন্তায় থাকি রে মা...’
হেসে ফেলে পৃথা... ‘উফ্ এত চিন্তা করো না মাদার ইন্ডিয়া... তোমার তিতির এখন বড় হয়ে গেছে... সেই ছোট্টটি আর নেই... এখন নিজেই সব কিছু একা সমলাতে পারে... বুঝলে?’
‘ছাই বড় হয়েছিস... এখনও তো খাইয়ে না দিলে খাস না... সেখানে কত যে বড় হয়েছিস তা আমার জানা আছে...’ বলে ওঠেন পৃথার মা।
‘তুমি এখনও ঝগড়া করবে আমার সাথে?’ আদুরে গলায় বলে ওঠে পৃথা।
মেয়েকে এই ভাবে বলতে শুনে আর রাগ করে থাকতে পারেন না ওর মা, ‘না রে মা, রাগ নয়, চিন্তা হয়... একা একা থাকিস তো... তাই... একটু সাবধানে থাকিস, কেমন... আর যদি শরীর খারাপ লাগে ডাক্তার দেখিয়ে নিতে ভুলিস না... আমাদেরও সাথে সাথে ফোন করিস... এই নে... বাবা আবার ব্যস্ত হচ্ছে, কথা বল বাবার সাথে...’
হটাৎ ড্রইংরুমের আলোটা জ্বলে ওঠে... কারেন্ট চলে আসে... আগেই বেডরুমের আলোর সুইচটা নিভিয়ে রাখাতে ঘরের আলোটা আর জ্বলেনি তাই... তবুও ড্রইংরুমের থেকেই বেশ খানিকটা আলো এসে ঘরটাকে আলোকিত করে তোলে... ঘরের আলো জ্বালাবার আর খুব প্রয়োজন হয় না।
বাইরে তখনও নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে... ঝিরঝিরে বৃষ্টির জলের ছাট এসে ঢুকছে ঘরের মধ্যে... পৃথা বিছানা ছেড়ে উঠে এগিয়ে যায় জানলার কাছে, শার্সিগুলো বন্ধ করে দেয় টেনে... দিয়ে ফিরে আসে বিছানায় আবার।
‘ভিজে গেছিস শুনলাম তোর মায়ের কাছে... এখন ঠিক আছিস তো?’ বাবার গলা পায় ফোনের মধ্যে।
‘হ্যা বাপী, আমি ঠিক আছি... তোমরা চিন্তা করো না...’ বলে থামে একটু, তারপর হটাৎ করে মনে পড়ে যেতে বলে ওঠে, ‘বাপী, তোমার প্রেশারের অসুধটা আনিয়েছিলে? ওটা তো শেষ হয়ে যাবার কথা এত দিনে।’
‘হ্যা, হ্যা, আনিয়ে নিয়েছি, তোকে আর ওখানে বসে আমার অসুধের কথা চিন্তা করতে হবে না রে মা... তুই একটু সাবধানে থাকিস, তোর মা বড্ড চিন্তা করে তোকে নিয়ে।’
‘হুম... আমার মা শুধু চিন্তা করে, আর আমার মিষ্টি বাপী এক্কেবারেই ভাবে না তার প্রিন্সেসকে নিয়ে, তাই তো?’ হাসতে হাসতে বলে বাবার কথার জবাবে।
‘না, মানে, আমারও চিন্তা হয় না যে তা নয়, তাও...’ আমতা আমতা করেন ভদ্রলোক।
‘থাক, জানা আছে আমার, আমার বাপীর কাছে আমি কি... আচ্ছা, এবার রাখো... কারেন্ট এসে গেছে...’ হাসতে হাসতে বলে পৃথা।
‘সেকি রে, এতক্ষন কারেন্ট ছিল না?’ প্রশ্ন করেন পৃথার বাবা।
‘না তো... আর সেই সাথে কি বৃষ্টি হচ্ছে বাপী কি বলবো... সেই সন্ধ্যে থেকে নেমেছে, সমানে চলছে... এই এত্তো বড় বড় ফোঁটা... জানলা বন্ধ করে দিতে হয়েছে, এত ছাঁট আসছে...’ হাত নেড়ে বলতে থাকে নিজের বাবাকে।
‘দেখিস মা, সাবধানে থাকিস... কেমন... এবার রাখি?’ বলেন ভদ্রলোক।
‘হ্যা, হ্যা, রাখো... তোমরাও সাবধানে থেকো... কেমন... লাভ ইয়ু বাপী... মাকেও চিন্তা করতে বারণ কোরো...’ বলে ফোনটা কেটে দেয় পৃথা।
‘নাঃ, আজ আর রাত্রে কিছু খাবো না... ভাল্লাগছে না... চোখগুলোও কেমন জ্বালা জ্বালা করছে, কে জানে, জ্বর আসবে কি না? মা শুনলে তো লাফাতো... ভাজ্ঞিস কিছু বলি নি... দেখি, শুধু একটু হরলিক্স গুলে খেয়ে শুয়ে পড়বো... কাল সকালে যা হোক দেখা যাবে’খন...’ ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ায় বিছানা ছেড়ে... মাথাটা কেমন ভার লাগে... হাতের তেলোটা উলটে ছোয়ায় কপালে, একটু যেন গরম মনে হয়। কিচেনে যাবে মনে করেও আর যায় না, বাথরুমের দিকে এগোয়। কোমডের ওপরে বসে হিসি করে হাল্কা হয় খানিকটা, তারপর উঠে হাতে জল নিয়ে পরিষ্কার হয়ে ফিরে আসে আবার বেডরুমেই। আসার পথে ড্রইংরুমের আলোটাও নিভিয়ে দেয়। মনে হয় কেমন যেন শীত শীত করছে... ঘরের ফ্যানটার রেগুলেটর ঘুরিয়ে একটু কমিয়ে দিয়ে কাবার্ড থেকে একটা গোল গলার টি-শার্ট বের করে পড়ে নেয় গায়ে... তারপর বালিশটা টেনে শুয়ে পড়ে বিছানায়... হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিলের ওপরে রাখা অর্নবের ছবিটায় একবার আলতো করে হাত বোলায়... ‘একটু পরে না হয় উঠে হরলিক্সটা করে নেবো’খন’ ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করে পৃথা।