07-10-2022, 09:58 PM
বন্ধনহীন গ্রন্থি
১.
পেশায় চিকিৎসক হওয়ায়, আমি পরিচিত-অপরিচিত সকলেরই চিকিৎসা করে থাকি।
চিকিৎসক হিসেবে ইদানিং আমার কিছু সুনামও হয়েছে।
ইতিমধ্যে একদিন খবর পেলাম, আমার মাসতুতো ভাইয়ের বউ নাকি খুব মনোকষ্টে রয়েছে।
আমার মাসির বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে, গ্রামের দিকে।
মাসির একটাই ছেলে; আমার চেয়ে মোটে এক বছরের ছোটো। ওর বিয়ে হয়েছে তাও প্রায় বছর-দুয়েক হয়ে গেল।
আমার মেসো ব্যাঙ্কে ভালো চাকরি করতেন। তিনি নিজের গ্রামেই বেশ বড়ো করে দোতলা বাস্তুভিটে বানিয়েছিলেন। আমার ভাই সস্ত্রীক সেই বাড়িতেই থাকে।
মেসো রিটায়ারমেন্টের পরে-পরেই মারা গিয়েছেন। এখন মাসি পেনশন পান। তবে মাসিও কয়েক মাস হল প্যারালাইসিসে ডানদিক সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে। কথা-টতাও আর বিশেষ বলে উঠতে পারে না।
মাসি থাকে একতলায়। মাসির দেখা-শোনা করবার জন্য একজন মহিলা অ্যাটেনডেন্ট আছে। ভাইয়ের সংসার দোতলায়।
আমার মাসতুতো ভাইটা একটা অকর্মার ঢেঁকি। পড়াশোনা বেশি দূর করেনি। কলেজ-লাইফ থেকেই কাঁড়ি-কাঁড়ি মদ গিলে, পথে-ঘাটে মাতলামি করতে-করতে বেশ কয়েকবার বাইক অ্যাকসিডেন্ট ঘটিয়ে, হাত-পা ভেঙে হাসপাতাল ঘুরে এসেছে। দু-একবার তার মধ্যে যমে-মানুষে টানাটানিও হয়ে গিয়েছিল।
তারপর তো মেসো বেঁচে থাকতেই, এই ভালো পরিবারের মেয়েটির সঙ্গে, ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে যায়। সংসারের টানে যদি ছেলের সুমতি ফেরে, এই আশায়।
কিন্তু আমার অপগণ্ড ভাইটা বিয়ের পরেও বিশেষ বদলায়নি। ও এই মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সেই, মদ গিলে-গিলে কেমন যেন খেঁকুড়ে হয়ে, বুড়িয়ে গিয়েছে। ওর ওই হাড়-হাভাতে চেহারা দেখলে, এখন ওকে আমার চেয়েও অনেক বুড়ো বলে মনে হয়।
ভাই, মেসোর সুপারিশেই গ্রামের পঞ্চায়েত অফিসে মামুলি একটা কাজের সুযোগ পেয়েছিল। এখন তো শুনি, সেখানেও নিয়মিত যায় না। বিয়ের পর দু-বছরের বেশি গড়িয়ে গেলেও, এখনও ও শয্যাশায়ী মাসিকে নাতির মুখ-দর্শন করাতে পারেনি।
এদিকে নতুন খবর শুনলাম, সেই পাষণ্ডটা ইদানিং ঘরের বউ ছেড়ে, বাজারের দিকের একটা নষ্টা মেয়েছেলের ঘরে রাতের পর রাত বেহেড মাতাল হয়ে পড়ে থাকছে।
এই দুঃখে, বেচারি ওর বউটা নাকি ডানহাতের কব্জিতে ব্লেড চালিয়ে এক রাতে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল…
২.
আমার মাসতুতো ভাইয়ের বউয়ের নাম, রূপাঞ্জনা; ডাকনাম, রূপা।
রূপা সম্পন্ন ঘরের সুশ্রী মেয়ে। ছিপছিপে দোহারা গড়ন। গায়ের রং দুধে-আলতা। মুখটা সামান্য লম্বাটে, তবে মিষ্টি।
ওর ছেলেবেলায় বাবা মারা গিয়েছিলেন। তাই ও মামারবাড়িতে একরকম থেকেই মানুষ হয়েছে।
পাঁচ মামাই এই আদরের একমাত্র ভাগ্নির বিয়েতে, খুব ধুমধাম করেছিলেন।
আমার মেসোর গ্রামে সুনাম ছিল ভালোই। তাই ভিন্-গাঁয়ের পাঁচটা লোকও তাঁকে খুব শ্রদ্ধা-ভক্তি করত। তাই মেসোর ছেলের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ করতে, রূপার মামারা এক-কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।
৩.
একদিন সকালের ট্রেনে, সব কাজ ফেলে রেখে, আমি মাসির বাড়ি গিয়ে পৌঁছালাম।
ঝকঝকে সুন্দর বাড়িটা নিঃস্তব্ধ। যেন একটা মনমরা প্রেতপুরী হয়ে রয়েছে।
ভাই যথারীতি বাড়িতে নেই। খোঁজ করে জানলাম, ও নাকি গত দু-তিনদিন টানা বাড়ি ফেরেনি। সম্ভবত খালপাড়ের বস্তির সেই ছোটোলোক রেণ্ডিটার ঘরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রয়েছে…
মাসির সঙ্গে গিয়ে দেখা করলাম আগে। মাসির শরীরটা বিছানায় মিশে গিয়েছে। আর উঠে বসতেও পারে না। আমাকে দেখে, দু-চোখের কোল ভিজিয়ে, কাঁপা-কাঁপা হাত নাড়ল শুধু। আমি এগিয়ে গিয়ে তখন মাসির শীর্ণ, আর ঠাণ্ডা হাত দুটো চেপে ধরলাম। মায়ের নিজের বোনের প্রতি আমারও তো একটা টান রয়েছে। তাই চোখ দুটো আমারও আর্দ্র হয়ে উঠল।
মাসির সঙ্গে দেখা করে আমি দোতলায় উঠে এলাম।
রূপা আমাকে ডাইনিংয়ের গোল টেবিলে, চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে দিল। তাড়াতাড়ি আমার জন্য চাও করে নিয়ে এল।
ভাইয়ের বিয়ের পর আমি এ বাড়িতে একবার কী দু'বার এসেছি মাত্র। তাই রূপার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের বিশেষ সুযোগ হয়নি।
আমি তাই চায়ে চুমুক দিতে-দিতে বললাম: "রূপা, কী ব্যাপার শুনছি এ সব?"
রূপা, আমার কথা শুনে, তাড়াতাড়ি পাশের রান্নাঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়ল।
আমি বুঝলাম, ও লজ্জা পেয়েছে। তা ছাড়া মেয়েটির চোখের নীচে ক্লান্তি, আর দুঃখের ছাপ স্পষ্ট। নিশ্চই সারা রাত ও স্বামীকে কাছে না পেয়ে, একা-একা কেঁদেছে। তাই ওর সুন্দর মুখখানা এখনও শুকনো, বাসি ফুলের মতো হয়ে রয়েছে যেন।
রূপা আমার সামনে থেকে পালাতে চাইছে। কিন্তু আমি তো আজ এখানে এসেছি, নিকটতম গার্জেন হিসেবে, ওদের এই সমস্যাটার একটা বিহিত করতেই।
অপগণ্ড ভাইটা বাড়িতে নেই। তাকে বোঝানোও বেকার হবে। কারণ, সে তো পাঁড় মাতাল একখানা। আর মাসিও এখন ইনভ্যালিড।
ফলে আমাকে এখন যা হোক একটা সমাধান, রূপাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়েই করতে হবে।
৪.
আমি ডাক্তার মানুষ। এ সব ঘরোয়া সাংসারিক অশান্তির কীই বা সুরাহা করতে পারব?
কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মাসির দিকের পরিবারে এমন কেউ নেই যে, এই বিপদের দিনে মাসির পরিবারকে, বিশেষত এই অসহায়া মেয়েটিকে একটু সৎ কিছু পরামর্শ দেবে।
তাই বাধ্য হয়েই আমাকে আজ সব কাজ ফেলে, এখানে ছুটে আসতে হয়েছে।
আমি গলা তুলে তখন বললাম: "রূপা, দেখো, পালিয়ে গেলে তো কোনও সমস্যার সমাধান হবে না। এ বাড়িতে সুস্থ-সবল মানুষ বলতে, এখন একমাত্র তুমিই আছ।
মাসি বিছানার রুগি। আর আমার ভাইটা তো থেকেও নেই।
এমতোবস্থায় তোমাকেই তো সংসারের হালটা ধরতে হবে, বলো। ছেলেমানুষের মতো সুইসাইড অ্যাটেমপ্ট করাটা কোনও কাজের কথা নয়…"
আমার কথা শুনে, রূপা চোখ মুছে, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে, রান্নাঘরের দরজার মুখে এসে দাঁড়াল।
আমি তখন ওকে ডেকে, আমার সামনে বসতে বললাম।
ও তখন আমার মুখোমুখি চেয়ারটা টেনে নিয়ে, নিঃশব্দে বসে পড়ল।
আমি খেয়াল করলাম, রূপার শরীরে যৌবনের যখন খুশিতে রাজত্ব করবার কথা, ঠিক তখনই ওর শরীরটা যেন রোগা হয়ে, শুকিয়ে বেতসলতার মতো হয়ে যাচ্ছে। এ যে চরম মানসিক দুর্ভোগ, আর রাতের পর রাত জেগে-জেগে কেঁদে কূল ভাসানোর ফল, সেটা আমার চিকিৎসকের দৃষ্টি দিয়ে, ভালোই অনুভব করতে পারলাম।
আমি সম্পর্কে রূপার ভাসুর হই। কিন্তু ওর এই দুঃখ জর্জর ও মলিন শাড়ি বেষ্টিত শরীরটার দিকে আপাতভাবে এক ঝলক তাকিয়েও কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, ওর শরীরের আনাচে-কানাচে যৌবন এখন উন্মুখ চাতক পাখি হয়ে অপেক্ষা করে রয়েছে। কিন্তু আমার পাষণ্ড ভাইটির জন্য, এমন ফুলের মতো মিষ্টি মেয়েটার জীবন, অকালেই ঝরা শিউলির মতো, পড়ে-পড়ে নষ্ট হতে বসেছে।
৫.
আমি আরও কিছু বলে ওঠবার আগেই, সিঁড়ির মুখে উঁকি দিয়ে মাসির অ্যাটেনডেন্ট মহিলাটি, রূপাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল: "বউদি, আমি একটু বাড়ি যাচ্ছি এখন। ছেলেটার জ্বর হয়েছে, বাড়ি থেকে ফোন করল।
আমি মাসিমাকে স্নান-খাওয়া করিয়ে, একপ্রস্থ হাগিয়ে-মুতিয়ে নতুন ডায়াপার পড়িয়ে দিয়ে গিয়েছি।
আমি আবার রাত আটটা নাগাদ আসব। তখনই মাসিমাকে রাতের খাবারটা খাওয়াব। আমি নিজে না আস্তে পারলে, সুলতাকে পাঠিয়ে দেব; তুমি কোনও চিন্তা কোরো না।
তুমি শুধু বিকেলের চা-বিস্কুটটা একটু বুড়িকে খাইয়ে দিয়ে এসো। কেমন?"
রূপা সব কথা শুনে, আস্তে করে শুধু ঘাড় নাড়ল। আয়াটা তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।
কিছুক্ষণ পরে যখন বাইরের গ্রিলের দরজাটা একবার খোলা ও তারপর বন্ধ হওয়ার শব্দ হল, তখন আমি বুঝতে পারলাম, এখন এ বাড়িতে, নীচের ঘরে শয্যাশায়ী মাসি ছাড়া, সুস্থ-সবল লোক বলতে কেবল আমি, আর রূপাই উপস্থিত রয়েছি।
এই ভাবনাটাই, হঠাৎ আমার মধ্যে কেমন যেন একটা রক্তের চাঞ্চল্য বাড়িয়ে তুলল…
রূপা চুপ করে আমার সামনের চেয়ারটায় বসে, মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল।
আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললাম: "কী ব্যাপার, তুমি হঠাৎ অ্যাতো ভেঙে পড়ছ কেন? তোমাদের সংসারে তো আর টাকার অভাব তেমন কিছু নেই। মাসি এখনও পেনশন পান, তা ছাড়া মেসোর ভালোই ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকাপয়সা আছে বলেও তো শুনেছি…"
রূপা ম্লান হেসে বলল: "টাকা দিয়ে কী হবে? আমি কী টাকা চিবিয়ে খাব? এ বাড়িতে একটাও কোনও মানুষ আছে যে, যার সঙ্গে আমি মন খুলে দুটো কথা কইতে পারব!"
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এ যুক্তির কোনও উত্তর নেই আমার কাছে।
তবুও আমি বললাম: "কিন্তু আত্মহত্যা করলেই কী সব সমস্যার সমাধান হবে তোমার?"
রূপা আবার চোখ থেকে নেমে আসা জল মুছল। ওর গোলাপি গালে অশ্রুর কালচে রেখা, একটা মলিন দাগ রেখে গেল। ও বলল: "কার জন্য বেঁচে থাকব বলুন তো? ওদিকে আমার মাও কোভিডে মারা গেলেন গত বছর, আর এদিকে শাশুড়িও তো প্রায় মৃত্যুশয্যায়।
বিয়ের পর স্বামীর সাহচর্যও তো একদিনের জন্যও পেলাম না।
তাও যদি কোল ভরে একটা সোনার চাঁদ আসত আমার…"
শেষ কথাটুকু বলতে-বলতে, রূপা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। রূপার মায়ের মৃত্যু-সংবাদ আমার কাছে ছিল না। আর শেষকালে ও যে কথাটা বলল, সেটা তো যে কোনও বিবাহিত মেয়েরই জীবনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা হয়; সেটাই স্বাভাবিক। তাই হঠাতে ওকে এ ব্যাপারে কী যে সান্ত্বনা দেব, আমি ভেবে পেলাম না…
(ক্রমশ)
১.
পেশায় চিকিৎসক হওয়ায়, আমি পরিচিত-অপরিচিত সকলেরই চিকিৎসা করে থাকি।
চিকিৎসক হিসেবে ইদানিং আমার কিছু সুনামও হয়েছে।
ইতিমধ্যে একদিন খবর পেলাম, আমার মাসতুতো ভাইয়ের বউ নাকি খুব মনোকষ্টে রয়েছে।
আমার মাসির বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে, গ্রামের দিকে।
মাসির একটাই ছেলে; আমার চেয়ে মোটে এক বছরের ছোটো। ওর বিয়ে হয়েছে তাও প্রায় বছর-দুয়েক হয়ে গেল।
আমার মেসো ব্যাঙ্কে ভালো চাকরি করতেন। তিনি নিজের গ্রামেই বেশ বড়ো করে দোতলা বাস্তুভিটে বানিয়েছিলেন। আমার ভাই সস্ত্রীক সেই বাড়িতেই থাকে।
মেসো রিটায়ারমেন্টের পরে-পরেই মারা গিয়েছেন। এখন মাসি পেনশন পান। তবে মাসিও কয়েক মাস হল প্যারালাইসিসে ডানদিক সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে। কথা-টতাও আর বিশেষ বলে উঠতে পারে না।
মাসি থাকে একতলায়। মাসির দেখা-শোনা করবার জন্য একজন মহিলা অ্যাটেনডেন্ট আছে। ভাইয়ের সংসার দোতলায়।
আমার মাসতুতো ভাইটা একটা অকর্মার ঢেঁকি। পড়াশোনা বেশি দূর করেনি। কলেজ-লাইফ থেকেই কাঁড়ি-কাঁড়ি মদ গিলে, পথে-ঘাটে মাতলামি করতে-করতে বেশ কয়েকবার বাইক অ্যাকসিডেন্ট ঘটিয়ে, হাত-পা ভেঙে হাসপাতাল ঘুরে এসেছে। দু-একবার তার মধ্যে যমে-মানুষে টানাটানিও হয়ে গিয়েছিল।
তারপর তো মেসো বেঁচে থাকতেই, এই ভালো পরিবারের মেয়েটির সঙ্গে, ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে যায়। সংসারের টানে যদি ছেলের সুমতি ফেরে, এই আশায়।
কিন্তু আমার অপগণ্ড ভাইটা বিয়ের পরেও বিশেষ বদলায়নি। ও এই মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সেই, মদ গিলে-গিলে কেমন যেন খেঁকুড়ে হয়ে, বুড়িয়ে গিয়েছে। ওর ওই হাড়-হাভাতে চেহারা দেখলে, এখন ওকে আমার চেয়েও অনেক বুড়ো বলে মনে হয়।
ভাই, মেসোর সুপারিশেই গ্রামের পঞ্চায়েত অফিসে মামুলি একটা কাজের সুযোগ পেয়েছিল। এখন তো শুনি, সেখানেও নিয়মিত যায় না। বিয়ের পর দু-বছরের বেশি গড়িয়ে গেলেও, এখনও ও শয্যাশায়ী মাসিকে নাতির মুখ-দর্শন করাতে পারেনি।
এদিকে নতুন খবর শুনলাম, সেই পাষণ্ডটা ইদানিং ঘরের বউ ছেড়ে, বাজারের দিকের একটা নষ্টা মেয়েছেলের ঘরে রাতের পর রাত বেহেড মাতাল হয়ে পড়ে থাকছে।
এই দুঃখে, বেচারি ওর বউটা নাকি ডানহাতের কব্জিতে ব্লেড চালিয়ে এক রাতে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল…
২.
আমার মাসতুতো ভাইয়ের বউয়ের নাম, রূপাঞ্জনা; ডাকনাম, রূপা।
রূপা সম্পন্ন ঘরের সুশ্রী মেয়ে। ছিপছিপে দোহারা গড়ন। গায়ের রং দুধে-আলতা। মুখটা সামান্য লম্বাটে, তবে মিষ্টি।
ওর ছেলেবেলায় বাবা মারা গিয়েছিলেন। তাই ও মামারবাড়িতে একরকম থেকেই মানুষ হয়েছে।
পাঁচ মামাই এই আদরের একমাত্র ভাগ্নির বিয়েতে, খুব ধুমধাম করেছিলেন।
আমার মেসোর গ্রামে সুনাম ছিল ভালোই। তাই ভিন্-গাঁয়ের পাঁচটা লোকও তাঁকে খুব শ্রদ্ধা-ভক্তি করত। তাই মেসোর ছেলের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ করতে, রূপার মামারা এক-কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।
৩.
একদিন সকালের ট্রেনে, সব কাজ ফেলে রেখে, আমি মাসির বাড়ি গিয়ে পৌঁছালাম।
ঝকঝকে সুন্দর বাড়িটা নিঃস্তব্ধ। যেন একটা মনমরা প্রেতপুরী হয়ে রয়েছে।
ভাই যথারীতি বাড়িতে নেই। খোঁজ করে জানলাম, ও নাকি গত দু-তিনদিন টানা বাড়ি ফেরেনি। সম্ভবত খালপাড়ের বস্তির সেই ছোটোলোক রেণ্ডিটার ঘরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রয়েছে…
মাসির সঙ্গে গিয়ে দেখা করলাম আগে। মাসির শরীরটা বিছানায় মিশে গিয়েছে। আর উঠে বসতেও পারে না। আমাকে দেখে, দু-চোখের কোল ভিজিয়ে, কাঁপা-কাঁপা হাত নাড়ল শুধু। আমি এগিয়ে গিয়ে তখন মাসির শীর্ণ, আর ঠাণ্ডা হাত দুটো চেপে ধরলাম। মায়ের নিজের বোনের প্রতি আমারও তো একটা টান রয়েছে। তাই চোখ দুটো আমারও আর্দ্র হয়ে উঠল।
মাসির সঙ্গে দেখা করে আমি দোতলায় উঠে এলাম।
রূপা আমাকে ডাইনিংয়ের গোল টেবিলে, চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে দিল। তাড়াতাড়ি আমার জন্য চাও করে নিয়ে এল।
ভাইয়ের বিয়ের পর আমি এ বাড়িতে একবার কী দু'বার এসেছি মাত্র। তাই রূপার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের বিশেষ সুযোগ হয়নি।
আমি তাই চায়ে চুমুক দিতে-দিতে বললাম: "রূপা, কী ব্যাপার শুনছি এ সব?"
রূপা, আমার কথা শুনে, তাড়াতাড়ি পাশের রান্নাঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়ল।
আমি বুঝলাম, ও লজ্জা পেয়েছে। তা ছাড়া মেয়েটির চোখের নীচে ক্লান্তি, আর দুঃখের ছাপ স্পষ্ট। নিশ্চই সারা রাত ও স্বামীকে কাছে না পেয়ে, একা-একা কেঁদেছে। তাই ওর সুন্দর মুখখানা এখনও শুকনো, বাসি ফুলের মতো হয়ে রয়েছে যেন।
রূপা আমার সামনে থেকে পালাতে চাইছে। কিন্তু আমি তো আজ এখানে এসেছি, নিকটতম গার্জেন হিসেবে, ওদের এই সমস্যাটার একটা বিহিত করতেই।
অপগণ্ড ভাইটা বাড়িতে নেই। তাকে বোঝানোও বেকার হবে। কারণ, সে তো পাঁড় মাতাল একখানা। আর মাসিও এখন ইনভ্যালিড।
ফলে আমাকে এখন যা হোক একটা সমাধান, রূপাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়েই করতে হবে।
৪.
আমি ডাক্তার মানুষ। এ সব ঘরোয়া সাংসারিক অশান্তির কীই বা সুরাহা করতে পারব?
কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মাসির দিকের পরিবারে এমন কেউ নেই যে, এই বিপদের দিনে মাসির পরিবারকে, বিশেষত এই অসহায়া মেয়েটিকে একটু সৎ কিছু পরামর্শ দেবে।
তাই বাধ্য হয়েই আমাকে আজ সব কাজ ফেলে, এখানে ছুটে আসতে হয়েছে।
আমি গলা তুলে তখন বললাম: "রূপা, দেখো, পালিয়ে গেলে তো কোনও সমস্যার সমাধান হবে না। এ বাড়িতে সুস্থ-সবল মানুষ বলতে, এখন একমাত্র তুমিই আছ।
মাসি বিছানার রুগি। আর আমার ভাইটা তো থেকেও নেই।
এমতোবস্থায় তোমাকেই তো সংসারের হালটা ধরতে হবে, বলো। ছেলেমানুষের মতো সুইসাইড অ্যাটেমপ্ট করাটা কোনও কাজের কথা নয়…"
আমার কথা শুনে, রূপা চোখ মুছে, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে, রান্নাঘরের দরজার মুখে এসে দাঁড়াল।
আমি তখন ওকে ডেকে, আমার সামনে বসতে বললাম।
ও তখন আমার মুখোমুখি চেয়ারটা টেনে নিয়ে, নিঃশব্দে বসে পড়ল।
আমি খেয়াল করলাম, রূপার শরীরে যৌবনের যখন খুশিতে রাজত্ব করবার কথা, ঠিক তখনই ওর শরীরটা যেন রোগা হয়ে, শুকিয়ে বেতসলতার মতো হয়ে যাচ্ছে। এ যে চরম মানসিক দুর্ভোগ, আর রাতের পর রাত জেগে-জেগে কেঁদে কূল ভাসানোর ফল, সেটা আমার চিকিৎসকের দৃষ্টি দিয়ে, ভালোই অনুভব করতে পারলাম।
আমি সম্পর্কে রূপার ভাসুর হই। কিন্তু ওর এই দুঃখ জর্জর ও মলিন শাড়ি বেষ্টিত শরীরটার দিকে আপাতভাবে এক ঝলক তাকিয়েও কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, ওর শরীরের আনাচে-কানাচে যৌবন এখন উন্মুখ চাতক পাখি হয়ে অপেক্ষা করে রয়েছে। কিন্তু আমার পাষণ্ড ভাইটির জন্য, এমন ফুলের মতো মিষ্টি মেয়েটার জীবন, অকালেই ঝরা শিউলির মতো, পড়ে-পড়ে নষ্ট হতে বসেছে।
৫.
আমি আরও কিছু বলে ওঠবার আগেই, সিঁড়ির মুখে উঁকি দিয়ে মাসির অ্যাটেনডেন্ট মহিলাটি, রূপাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল: "বউদি, আমি একটু বাড়ি যাচ্ছি এখন। ছেলেটার জ্বর হয়েছে, বাড়ি থেকে ফোন করল।
আমি মাসিমাকে স্নান-খাওয়া করিয়ে, একপ্রস্থ হাগিয়ে-মুতিয়ে নতুন ডায়াপার পড়িয়ে দিয়ে গিয়েছি।
আমি আবার রাত আটটা নাগাদ আসব। তখনই মাসিমাকে রাতের খাবারটা খাওয়াব। আমি নিজে না আস্তে পারলে, সুলতাকে পাঠিয়ে দেব; তুমি কোনও চিন্তা কোরো না।
তুমি শুধু বিকেলের চা-বিস্কুটটা একটু বুড়িকে খাইয়ে দিয়ে এসো। কেমন?"
রূপা সব কথা শুনে, আস্তে করে শুধু ঘাড় নাড়ল। আয়াটা তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।
কিছুক্ষণ পরে যখন বাইরের গ্রিলের দরজাটা একবার খোলা ও তারপর বন্ধ হওয়ার শব্দ হল, তখন আমি বুঝতে পারলাম, এখন এ বাড়িতে, নীচের ঘরে শয্যাশায়ী মাসি ছাড়া, সুস্থ-সবল লোক বলতে কেবল আমি, আর রূপাই উপস্থিত রয়েছি।
এই ভাবনাটাই, হঠাৎ আমার মধ্যে কেমন যেন একটা রক্তের চাঞ্চল্য বাড়িয়ে তুলল…
রূপা চুপ করে আমার সামনের চেয়ারটায় বসে, মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল।
আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললাম: "কী ব্যাপার, তুমি হঠাৎ অ্যাতো ভেঙে পড়ছ কেন? তোমাদের সংসারে তো আর টাকার অভাব তেমন কিছু নেই। মাসি এখনও পেনশন পান, তা ছাড়া মেসোর ভালোই ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকাপয়সা আছে বলেও তো শুনেছি…"
রূপা ম্লান হেসে বলল: "টাকা দিয়ে কী হবে? আমি কী টাকা চিবিয়ে খাব? এ বাড়িতে একটাও কোনও মানুষ আছে যে, যার সঙ্গে আমি মন খুলে দুটো কথা কইতে পারব!"
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এ যুক্তির কোনও উত্তর নেই আমার কাছে।
তবুও আমি বললাম: "কিন্তু আত্মহত্যা করলেই কী সব সমস্যার সমাধান হবে তোমার?"
রূপা আবার চোখ থেকে নেমে আসা জল মুছল। ওর গোলাপি গালে অশ্রুর কালচে রেখা, একটা মলিন দাগ রেখে গেল। ও বলল: "কার জন্য বেঁচে থাকব বলুন তো? ওদিকে আমার মাও কোভিডে মারা গেলেন গত বছর, আর এদিকে শাশুড়িও তো প্রায় মৃত্যুশয্যায়।
বিয়ের পর স্বামীর সাহচর্যও তো একদিনের জন্যও পেলাম না।
তাও যদি কোল ভরে একটা সোনার চাঁদ আসত আমার…"
শেষ কথাটুকু বলতে-বলতে, রূপা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। রূপার মায়ের মৃত্যু-সংবাদ আমার কাছে ছিল না। আর শেষকালে ও যে কথাটা বলল, সেটা তো যে কোনও বিবাহিত মেয়েরই জীবনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা হয়; সেটাই স্বাভাবিক। তাই হঠাতে ওকে এ ব্যাপারে কী যে সান্ত্বনা দেব, আমি ভেবে পেলাম না…
(ক্রমশ)