07-10-2022, 10:37 AM
কলকাতার মত এখানেও কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। জঙ্গলের বৃষ্টি কেমন হয়, ধারণা ছিল না কাবেরীর। সারারাত অনবরত জলের শব্দ। ঘুম ভাঙলো ভোরে। জানালা খুলে চমকে উঠল কাবেরী। বাড়ীর ঠিক উল্টো দিকেই বিস্তীর্ণ পাহাড় আর ঢাল জুড়ে শাল, মহুয়ার জঙ্গল। সকালে চকচকে রোদ। ধুলোবালি মুছে যাওয়াতে ক্লোরিফিল উজ্জ্বল গাছ যেন আরো চকচকে। বাইরে বেরিয়ে এলো কাবেরী। এই দোতলা বাড়ি সহ ষোল কাঠা বাগানবাড়ি। বাগানবাড়ি বললে ভুল হবে, ঝোপ ঝাড় আর পাহাড়ের ঢালে ইতিউতি কয়েকটা শাল-শিমুল গাছ।
কাবেরী মুগ্ধ হয়ে দেখছিল মায়ের দিক থেকে তার পূর্বপুরুষের এই বসত বাড়ি। এককালে বাড়ির চারপাশে পাঁচিল ছিল বোঝা যায়। কোথাও তার এখনো ভগ্নাংশ রয়ে গেছে। ভোরের বাতাস এসে কাবেরীর গায়ে পড়ছে। বাড়ির সামনেও পাহাড়। চারদিক যেন পাহাড় আর পাহাড়।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরোলো ওরা। ভোরের শীতল বাতাসটা আর নেই। এ জঙ্গলের আরেক বৈপরীত্যধর্মী রূপ। এখন তীব্র গরম আর কাঠফাটা রোদ। যদিও গাছ গাছালির ভিড়ে এই ছায়াটাও প্রশান্তির।
আলমগীর রাঁচির ছেলে। ঝরঝরে বাংলা বলে। সদ্য বিয়ে করেছে, শ্বশুরবাড়ি মুর্শিদাবাদে। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারছে বেশ।
অসীম জিজ্ঞেস করল---ইকলেজ বাড়িটা কি অনেক দূরে হেমেন দা?
---কেন কাছেই তো। হেঁটে দশ মিনিট।
---ওমা! তবে তো হেঁটেই যেতে পারতাম। কাবেরী মাঝপথে বলল।
---আসলে তোদের একবার এলাকাটা চেনাবো বলেই গাড়ি নিয়ে আসা।
কিছুক্ষণের মধ্যে ধারনাটা বদল হল কাবেরীর। এখানে সকলে বাংলা বলে ও বোঝে। মুণ্ডারাও নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলে, সেই বাংলায় একটা গেঁয়ো টান রয়েছে। দুটো মুন্ডা ছেলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। একজনের মাথায় একটা পুঁটলি মত বোঝা। অন্যজনের হাতে একটা গাছের ডাল। হেমেন দা আলমগীরকে গাড়ি থামাতে বললেন। ছেলে দুটোও দাঁড়িয়ে গেল। বয়স বেশি নয়, একুশ-বাইশ হবে। হেমেন দাকে দেখে ডাল হাতের ছেলেটা বলল---মাস্টার মশাই কুথায় যাচ্ছেন?
---শহর থেকে আমার বোন এসেছে। এলাকাটা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি। তোর কি কোনো কাম-কাজ আছে কুছুয়া।
ছেলেটা মাথা নাড়লো। হ্যা কি না বলল বোঝা গেল না। হেমেন দা দরজা খুলে ওকে তুলে নিল।
মুন্ডাদের নিজেদের ভাষা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। হেমেন দা বললেন---বলতো খুকি মুন্ডাদের ভাষার নাম কী?
---ওই তো তুমি কাল বললে, মুন্ডা।
অসীম বলল---অলচিকি।
----না হল না। হাসলেন হেমেন দা।---ওটা সাঁওতালদের ভাষা। কুছুয়াও কি বুঝল, হেসে ফেলল।
কাবেরী মনে মনে ভাবলো অরুণাভ থাকলে নিশ্চিত বলে দিত। ওর জি.কে বা হিউমার সাংঘাতিক। অথচ সারা জীবন মানুষটা ব্যাংক আর টাকা-পয়সার হিসেব নিয়ে রয়ে গেল।
হেমেন দা বলতে লাগলেন---মুন্ডাদের ভাষা হল মুন্ডারী। অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং ভারতীয় আর্যভাষা থেকেও প্রাচীনতর। এ ভাষা উড়িয়া, অসমীয়া ও বাংলা ভাষার প্রাথমিক ভিত রচনা করেছে। খাসিয়া, গারো, সাঁওতাল, কোল ইত্যাদি উপজাতীয় ভাষার সঙ্গে মুন্ডা ভাষার সম্পর্ক লক্ষণীয়।
ইকলেজ বাড়িটার সামনে এসে পৌঁছল ওরা। একতলা কলেজ বাড়ির কাজ এখনো অসমাপ্ত। জায়গাটা খানিকটা সমতল। একটা ছোট জলাশয় আছে। এই জলাশয়টিও কাবেরীদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি। সেই অর্থে বর্তমান হেমেন রায় ও কাবেরী চক্রবর্তীর যৌথ সম্পদ। এখান থেকে দেখা যায় হাঁসড়া গ্রামটা। ছোট গ্রাম। শাল জঙ্গলের মধ্যে ইতিউতি কয়েকটা চালা ঘর হারিয়ে গেছে যেন। ঘরগুলো বেশ ভালো লাগছে কাবেরীর। একে অপরের থেকে কত বিচ্ছিন্ন। কোনটা বেশ উঁচুতে, কোনটা ঢালে। কোনোটা খানিকটা সমান্তরাল জমিতে।
অদূরে আরো ঘন জঙ্গল। পাহাড়ের পর পাহাড়। সেদিকেই আঙ্গুল তুলে হেমেন দা বললেন---ওই পাহাড়েই বোঙ্গা দেবতার মন্দির।
---বোঙ্গা! মানে মুন্ডাদের আরাধ্য দেবতা। অসীম বিস্ময়ে বলল।
----হ্যা। মুন্ডাদের প্রধান আরাধ্য দেবতা বোঙ্গা। অর্থাৎ সূর্য দেবতা। ওদের আরো দেব-দেবী রয়েছে। এ বয়সে আমি আর পাহাড়ে উঠতে পারবো না। তোরা যদি চাস তো গিয়ে দেখ।
কুছুয়ার কাঁধে হাত রেখে হেমেন দা বললেন--ওদের নিয়ে যাস সাবধানে।
কুছুয়া গাছের ডালটা হাতে নিয়ে আগে আগে চলেছে। খানিকটা পিছনে অসীম আর কাবেরী। অসীমের পরনে আকাশনীল শার্ট। কাবেরী একটা মেরুন রঙের তাঁত পরেছে, কমলা রঙা ব্লাউজ। পাহাড় ভেঙে উঠতে সামান্য হলেও তেমন কষ্ট হচ্ছে না কাবেরীর। কতদিন পর এভাবে পাহাড়ে ওঠা। অরুণাভ আর কাবেরী বিয়ের পর বেশ সাবলীল ভাবে পাহাড়ে উঠতে পারতো। ওই তো বছর দুই আগেও যখন ওরা কাশ্মীরে গিয়েছিল, ছেলেদুটোকে নিয়ে কাবেরী তরতর করে এগিয়ে গিয়েছিল। পেছনে পড়েছিল অরুণাভ। চুয়াল্লিশ বছরে এসে কাবেরী বুঝতে পারছে এখনও সে ক্ষমতা তার আছে। অসীম অবশ্য আগে আগেই উঠে যাচ্ছে। অসীমের চেহারাটা গোলগাল, ছোটখাটো। কুছুয়া তাদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। স্যার, দিদিমনিদের পেছনে পড়ে থাকতে দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
একটা ঢিবি মত জায়গায় আটকে পড়ল কাবেরী। অসীম হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল---কষ্ট হচ্ছে। হাতটা ধরে সামলে নিল নিজেকে। ঢিবিটা পেরিয়েই কাবেরী বলল---ওমা! কষ্ট হবে কেন? বেশ তো লাগছে হাঁটতে।
---না না। তুমি তো আমার মত রোগা-পাতলা নও।
---তারমানে তুমি আমাকে মোটা বলছ?
কাবেরী মোটেই মোটা নয়। আবার যুবতী শরীরের ছিপছিপে তন্বী নয়। মধ্য তিরিশের দিক থেকে তার শরীর আস্তে আস্তে ভারীর দিকে যেতে শুরু করলেও, তা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে রয়েছে। পেটে সামান্য মেদ আছে। তাতে কোমরে সামান্য ভাঁজ পড়ে। তবে সেই অতিরিক্ততা চল্লিশের যে কোনো নারীদেরই থাকে। খারাপ দেখায় না, বরং এতে বেশ পরিণতসুলভ দেখায় তাকে।
কছুয়া হাঁটা শুরু করল। ওরাও পিছু নিল নীরব অনুসরণকারীর মত। আর খানিকটা পথ পেরোনোর পর বড় শাল গাছটার তলায় ছোট্ট মন্দির। মন্দিরের দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকতে দেখা পেল স্বয়ং বোঙ্গা দেবতার। নীল বর্ণ মাটির তৈরি এই মূর্তি আসলে * দের সূর্য দেবতারই প্রতিরূপ।
কাবেরী দু হাত মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করল। পাশে দাঁড়ানো অসীমের হাসিমুখ দেখে কাবেরী জিজ্ঞেস করল হাসছ কেন?
---এই যে তোমার বিশ্বাস দেখে। মাটির দেবতার প্রতি এত আস্থা...
---আঃ অসীম! আদিবাসীদের দেবতারা খুব জাগ্রত হয় শুনেছি।
গলা ছেড়ে অট্টহাসি হাসল অসীম। কাবেরী বিরক্ত হল। মনে মনে ভাবলো নাস্তিকতা বোধ হয় পুরুষ মানুষদের একটি চরিত্র। অরুণাভটাও তাই। ঠাকুর-দেবতাকে তাচ্ছিল্য করা ওর অভ্যেস।
কাবেরীর রাগ ভাঙাতে অসীম বলল--চাইলে পুজোও দিতে পারো।
কুছুয়া বলল---এখুন হবেনি দিদিমণি। সক্কালে আসতে হবে। তখুন পূজা হয়।
মূর্তির পায়ের কাছে তখনও টাটকা ফুল, পূজার সামগ্রী দেখে বোঝা গেল সকালে এখানে পূজা হয়েছে।
বেরোনোর সময় অসীম লক্ষ্য করল মন্দিরের পাশ দিয়ে একটা জলস্রোত চলে গেছে। কুছুয়াকে জিজ্ঞেস করতে বলল---ইতু দেবীর থান হতে আসছে সার। গেলেই দিখতে পাবেন।
---ইতু দেবী? নামটা ইন্টারেস্টিং। এমন নামতো শুনিনি কখনো।
অসীমকে মাঝপথে থামিয়ে কাবেরী বলল--চলো না, গেলেই দেখতে পাবো।
গভীর জঙ্গলের এলোমেলো রাস্তা। হাতের শক্ত ডাল দিয়ে ঝোপঝাড় ছেঁটে রাস্তা বানাতে থাকলো কছুয়া। অসীম ভয় পেয়ে বলল---সাপ-খোপ নেই তো?
কুছুয়া তার কাজে রত থেকেই বলল---আছে নাই আবার! ময়াল, ঢেমনা, শিয়রচাঁদা, তপ সব আছে।
নিজে ভয় পেলেও, অসীম বলল---কাবেরী সাবধানে পা ফেলো।
অনেকটা পথ এই জঙ্গলাকীর্ন রাস্তায়। এসময় কুছুয়া চলে গেলে একা একা পথ খুঁজে ফেরা মুশকিল। অবশেষ এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত ইতু দেবীর থান। দেবী বলতে কালো পাথর খন্ড। দুটো পাহাড়ের ফাটলের মাঝে তার স্থান। পাশ দিয়ে দুধসাদা ছোট ঝর্ণা। বোঙ্গা দেবের মন্দিরের পাশের জলস্রোতের উৎস এই ঝর্ণা।
এধার ওধার মুরগীর পালক দেখে অসীম বলল---এখানে বলি-টলি হয় নাকি?
---সে পরবের সময় হয়। এখুন তো গরম। আরো চারমাইনা পরে পরব। মানত কইরলে তখুন মুরগী দিতে হয়।
কছুয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কাবেরী জিজ্ঞেস করল---এখানে মানত করে কিসের জন্য?
---পোয়াতি হতে গেরামের বউরা আসে। যার ছেনা-পোনা হয় নাই, গাভীর দুধ কমছে, তারা আইসে। গত বসর আমার বউটা আইসছিল, এখন আমার বেটা হইছে দিদিমণি।
--তুমি বিয়ে করেছ?
লজ্জায় সরলমতি বালকের মত কুছুয়া মাথা নীচু করল। একুশ-বাইশ বছরে আদিবাসী এলাকার ছেলেরা বাপ হয়ে যায়! বিস্মিত হত কাবেরী।
সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাৎ জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা লোক। বেশ রুগ্ন লোকটার পরনে লাল কাপড় জড়ানো, হাতে লাঠি। কুছুয়া খুব সম্ভ্রমের চোখে বলল---দিগা বাবা, এই থানের পূজারী।
দিগা বাবা লোকটার বয়স হয়েছে, চোখ তুলে তাকালেন অসীম ও কাবেরী দিকে। বললেন---শহর থেকে আইসছেন বাবুরা?
কুছুয়াই বলল--হাঁ গো, বাবা। কলকাতা থিকে আইসছে।
---ইটা তো মানতের সময় লয়, তবে মা তোরে দেখে বড় ভালো লাইগলো। কাবেরীকে কথাটা বলল লোকটা।
কাবেরীর মাথায় একটা ফুল ছুঁইয়ে বলল---মরদ, ছ্যানা-পোনা লয়ে সুখী হ মা।
কাবেরী ভক্তি ভরে মাথা নুইয়ে থাকলো। দিগা বাবা এবার একটা ছোট্ট নুড়ি দিলেন কাবেরীর হাতে। দিগা বাবার চোখ প্রস্তর খণ্ডের দিকে---ইটা রাখিস নিজের কাছে। আর বেশি দের নাই, তুই মা হবি।
নুড়িটা একদম গোল। এমন নুড়ি এই এলাকায় কোথাও পাওয়া যায় বলে কাবেরীর মনে হল না।
কথাটা শুনে অসীম মুচকী হাসছে। ওখান থেকে বেরোনোর সময় কাবেরী নুড়িটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো একেবারে মসৃণ। ঠিক যেন কারিগর দিয়ে কোনো পাথরকে এভাবে বানানো হয়েছে। কুছুয়া পাথরটার দিকে তাকিয়ে বলল---দিদিমণি, ই পাথর বড় কামের গো, আমার বউটারেও দিগা বাবা দিছিল। যার কাছে রয়, সে ছানা-পোনার মুখ দেখে।
হো হো করে হেসে উঠল অসীম---তাহলে মিস্টার চক্রবর্তীকে শিগগিরি খবরটা দাও কাবেরী। তিনি আবার বাবা হতে চলেছেন।
কাবেরী হেসে উঠে বলল--ধ্যাৎ।
ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস থাকলেও কাবেরী মাদুল, কবজ, টোটকা এসবে একদম বিশ্বাস করে না। দুটো বড় বড় ছেলের মা কাবেরী, এ কথা জানলে দিগা বাবা নিশ্চই আর এই ইতু দেবীর থান মুখো হতেন না। মনে মনে হেসে উঠল কাবেরী।
ওরা যখন নীচে পৌঁছল, হেমেন দা একটা টিলার ওপর বসে রয়েছেন। আলমগীর গাড়ীর টুল বক্স খুলে ঠুং ঠাং করতে ব্যস্ত। কুছুয়া হাত নেড়ে রওনা দিল হাঁসড়া গ্রামের দিকে। গাড়ীতে উঠে ওরা রওনা দিল বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে। উঁচু নীচু পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে ঘন অরণ্যের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি।
প্রায় ঘন্টা দেড়েকের দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে ওরা এসে পৌঁছল একটা ভগ্ন শিব মন্দিরের কাছে। হেমেন দা বললেন---এবার নেমে পড়তে হবে।
অসীম বলল---কাছেপিঠে দেখবার মতো কিছু আছে নাকি?
হেমেন দা একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন---আছে একটা বড় ঝর্ণা। ঠিক মন্দিরটার পেছনে।
কল কল জলের শব্দ কানে এলো কাবেরীর। কিশোরীর মেয়ের মতো বলে উঠল---ওই তো জলের শব্দ।
হেমেন দা বললেন---ঠিক শুনেছিস। তবে এখানে আসবার আরেকটা কারণ আছে। কাছেই ফরেস্ট অফিস। ফরেস্টের রেঞ্জার অফিসার আমার পরিচিত। তোরা যখন এসেছিস, কলেজের বিষয় নিয়ে একটু কথাবার্তাও হয়ে যাবে।
মন্দিরটা বেশ পুরোনো। এখানে যেন সবই কেমন পুরোনো বলে মনে হচ্ছে কাবেরীর। মন্দিরের বারান্দায় দুপাশে দুটো সিমেন্টের বাঘ। আর পাঁচটা * মন্দিরের মতই। হেমেন রায় বললেন---মুন্ডারা কিন্তু * দেবদেবীদদেরও পূজা করে। * রীতি মেনে তাদের বিয়ে হয়। হাঁসড়াতে একটা চার্চও আছে। ইদানিং কিছু মুন্ডা খ্রিস্টানও হয়েছে।
কাবেরী বিস্মিত হয়ে বলল---এতসব আছে। অথচ একটা কলেজ নেই?
হেমেন রায় হাসলেন। অসীম বলল---এটাই তোমাদের বিশ্বাস বুঝলে কাবেরী।
হেমেন দা বড় ঝর্ণা বলছিলেন, এটাকে ঠিক বড় বলা চলে না। ঝর্ণাটা নীচু। ছোট্ট একটা পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল। নীচে জল জমে একটা স্বচ্ছ জলাশয় তৈরি হয়েছে। তার তলায় নুড়ি-পাথর নজরে আসে।
ফরেস্টের রেঞ্জার অফিসার অর্জুন কুমার হাজারীবাগের মানুষ। বয়স আনুমানিক ষাট ছুঁই ছুঁই। দেখেই বোঝা যায় রিটায়ার্ডের বয়সে এসে পৌছেছেন। বেশ খাতির করে বসালেন সকলকে। হেমেন দাকে যে বেশ সম্ভ্রমের চোখে দেখেন বোঝা যাচ্ছে।
বেতের চেয়ারে ওরা বসে রইল। হেমেন দা পরিচয় করালেন---ইনি হলেন অসীম মজুমদার। আমার ছাত্র। আর ইনি কাবেরী চক্রবর্তী, আমার বোন। এই জমি জায়গার আরেক অংশীদার।
হাতজোড় করে নমস্কার করলেন অর্জুন কুমার। চা এসে গেল। বললেন--- ম্যাডাম, আপনাদের এই হেল্প ইয়াদ রাখবে মুন্ডাদের গাঁও। ওরা এখনো মূর্খ আছে, লেকিন একদিন পড়ালিখাই করলে বুঝতে পারবে, আপনারা এদের জন্য কত উপকার করলেন।
হেমেন রায়ও বললেন---অর্জুন বাবুও খুব আগ্রহী। অনেকদিনের চেষ্টা ছিল ওর। এই জমিদারী ছেড়ে সেই যে দাদুর বাবা উঠে গেছে, তারপর দাদুও খুব একটা আসেনি। যৌবনে দাদুর কাছে গল্প শুনে একবার এসেছিলাম। তারপর দাদু কবে কি উইল করে গেছে জানতাম না। বাবা মারা যাবের আগে বললেন---হিমু, হাঁসড়ায় আমাদের যে জমিদারী আছে, তা তোর দাদু তোর আর মিনুর মেয়ে খুকির নামে আছে। একদিন সময় বার করে চলে এলুম। তারপর জায়গাটা ভালো লেগে গেল। মাঝে মধ্যেই যাতায়াত বাড়তে লাগলো। অর্জুন বাবু জানতেন না, আমি যে মাঝে মধ্যেই আসি। এই জমির দখল কেউ নিতে আসবে না ভেবে একরকম কাগজপত্র রেডি করে জমিটা অধিগ্রহণের চেষ্টা করছিলেন অর্জুন বাবু। তারপর খোঁজ পেলেন আমার। সে অর্থে দেখতে গেলে এই কলেজ বাড়ি হওয়ার মূল কারিগর কিন্তু অর্জুন কুমারই।
অর্জুন কুমার লজ্জা পেলেন। বললেন---সার, আপনি না থাকলে আমি কি সবটা পেরে উঠতাম। ইধার বহুত সমস্যা। মুন্ডারা গোঁয়ার। ফরেস্টের লোকদের দুশমন মনে করে। আপনার কথা শুনল বলেই না।
অসীম বলল---হেমেন দা, কলেজবাড়ীর জমিটা কত?
---তিন কাঠা। সব মিলিয়ে দাদুর উইল অনুযায়ী আমার আর খুকীর দেড়-দেড়। দাদু অবশ্য কার কোনো অংশ লিখে দিয়ে যায়নি। কাজেই খুকি যে কোনো জমি তার দাবী করতে পারে।
অসীম ঠাট্টা করে কাবেরীর দিকে চেয়ে বলল---তাই নাকি?
কাগজপত্র বের করে মাপযোগ সহ কলেজ বাড়ির প্ল্যানিং দেখাতে লাগলো অর্জুন কুমার। হেমেন দা, অসীম তা নিয়ে ব্যস্ত। কাবেরীর নজর পড়ল ফরেস্টের বাংলোর রঙ্গন গাছের ওপর একটা পাখি বসে সুরে সুরে ডেকে চলছে। পাখিটার কাছে চলে গেল কাবেরী, তবু পাখিটা ভয় পেল না। মনে এলো বাড়ীর টিয়াটার কথা, ছেলেদুটো খাবার দিচ্ছে কিনা কে জানে।
+++++++++
facebook share public
--ইটা রাখিস তোর কাছে। আর বেশি দেরী নাই, তুই মা হবি।
কাবেরী মুগ্ধ হয়ে দেখছিল মায়ের দিক থেকে তার পূর্বপুরুষের এই বসত বাড়ি। এককালে বাড়ির চারপাশে পাঁচিল ছিল বোঝা যায়। কোথাও তার এখনো ভগ্নাংশ রয়ে গেছে। ভোরের বাতাস এসে কাবেরীর গায়ে পড়ছে। বাড়ির সামনেও পাহাড়। চারদিক যেন পাহাড় আর পাহাড়।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরোলো ওরা। ভোরের শীতল বাতাসটা আর নেই। এ জঙ্গলের আরেক বৈপরীত্যধর্মী রূপ। এখন তীব্র গরম আর কাঠফাটা রোদ। যদিও গাছ গাছালির ভিড়ে এই ছায়াটাও প্রশান্তির।
আলমগীর রাঁচির ছেলে। ঝরঝরে বাংলা বলে। সদ্য বিয়ে করেছে, শ্বশুরবাড়ি মুর্শিদাবাদে। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারছে বেশ।
অসীম জিজ্ঞেস করল---ইকলেজ বাড়িটা কি অনেক দূরে হেমেন দা?
---কেন কাছেই তো। হেঁটে দশ মিনিট।
---ওমা! তবে তো হেঁটেই যেতে পারতাম। কাবেরী মাঝপথে বলল।
---আসলে তোদের একবার এলাকাটা চেনাবো বলেই গাড়ি নিয়ে আসা।
কিছুক্ষণের মধ্যে ধারনাটা বদল হল কাবেরীর। এখানে সকলে বাংলা বলে ও বোঝে। মুণ্ডারাও নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলে, সেই বাংলায় একটা গেঁয়ো টান রয়েছে। দুটো মুন্ডা ছেলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। একজনের মাথায় একটা পুঁটলি মত বোঝা। অন্যজনের হাতে একটা গাছের ডাল। হেমেন দা আলমগীরকে গাড়ি থামাতে বললেন। ছেলে দুটোও দাঁড়িয়ে গেল। বয়স বেশি নয়, একুশ-বাইশ হবে। হেমেন দাকে দেখে ডাল হাতের ছেলেটা বলল---মাস্টার মশাই কুথায় যাচ্ছেন?
---শহর থেকে আমার বোন এসেছে। এলাকাটা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি। তোর কি কোনো কাম-কাজ আছে কুছুয়া।
ছেলেটা মাথা নাড়লো। হ্যা কি না বলল বোঝা গেল না। হেমেন দা দরজা খুলে ওকে তুলে নিল।
মুন্ডাদের নিজেদের ভাষা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। হেমেন দা বললেন---বলতো খুকি মুন্ডাদের ভাষার নাম কী?
---ওই তো তুমি কাল বললে, মুন্ডা।
অসীম বলল---অলচিকি।
----না হল না। হাসলেন হেমেন দা।---ওটা সাঁওতালদের ভাষা। কুছুয়াও কি বুঝল, হেসে ফেলল।
কাবেরী মনে মনে ভাবলো অরুণাভ থাকলে নিশ্চিত বলে দিত। ওর জি.কে বা হিউমার সাংঘাতিক। অথচ সারা জীবন মানুষটা ব্যাংক আর টাকা-পয়সার হিসেব নিয়ে রয়ে গেল।
হেমেন দা বলতে লাগলেন---মুন্ডাদের ভাষা হল মুন্ডারী। অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং ভারতীয় আর্যভাষা থেকেও প্রাচীনতর। এ ভাষা উড়িয়া, অসমীয়া ও বাংলা ভাষার প্রাথমিক ভিত রচনা করেছে। খাসিয়া, গারো, সাঁওতাল, কোল ইত্যাদি উপজাতীয় ভাষার সঙ্গে মুন্ডা ভাষার সম্পর্ক লক্ষণীয়।
ইকলেজ বাড়িটার সামনে এসে পৌঁছল ওরা। একতলা কলেজ বাড়ির কাজ এখনো অসমাপ্ত। জায়গাটা খানিকটা সমতল। একটা ছোট জলাশয় আছে। এই জলাশয়টিও কাবেরীদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি। সেই অর্থে বর্তমান হেমেন রায় ও কাবেরী চক্রবর্তীর যৌথ সম্পদ। এখান থেকে দেখা যায় হাঁসড়া গ্রামটা। ছোট গ্রাম। শাল জঙ্গলের মধ্যে ইতিউতি কয়েকটা চালা ঘর হারিয়ে গেছে যেন। ঘরগুলো বেশ ভালো লাগছে কাবেরীর। একে অপরের থেকে কত বিচ্ছিন্ন। কোনটা বেশ উঁচুতে, কোনটা ঢালে। কোনোটা খানিকটা সমান্তরাল জমিতে।
অদূরে আরো ঘন জঙ্গল। পাহাড়ের পর পাহাড়। সেদিকেই আঙ্গুল তুলে হেমেন দা বললেন---ওই পাহাড়েই বোঙ্গা দেবতার মন্দির।
---বোঙ্গা! মানে মুন্ডাদের আরাধ্য দেবতা। অসীম বিস্ময়ে বলল।
----হ্যা। মুন্ডাদের প্রধান আরাধ্য দেবতা বোঙ্গা। অর্থাৎ সূর্য দেবতা। ওদের আরো দেব-দেবী রয়েছে। এ বয়সে আমি আর পাহাড়ে উঠতে পারবো না। তোরা যদি চাস তো গিয়ে দেখ।
কুছুয়ার কাঁধে হাত রেখে হেমেন দা বললেন--ওদের নিয়ে যাস সাবধানে।
কুছুয়া গাছের ডালটা হাতে নিয়ে আগে আগে চলেছে। খানিকটা পিছনে অসীম আর কাবেরী। অসীমের পরনে আকাশনীল শার্ট। কাবেরী একটা মেরুন রঙের তাঁত পরেছে, কমলা রঙা ব্লাউজ। পাহাড় ভেঙে উঠতে সামান্য হলেও তেমন কষ্ট হচ্ছে না কাবেরীর। কতদিন পর এভাবে পাহাড়ে ওঠা। অরুণাভ আর কাবেরী বিয়ের পর বেশ সাবলীল ভাবে পাহাড়ে উঠতে পারতো। ওই তো বছর দুই আগেও যখন ওরা কাশ্মীরে গিয়েছিল, ছেলেদুটোকে নিয়ে কাবেরী তরতর করে এগিয়ে গিয়েছিল। পেছনে পড়েছিল অরুণাভ। চুয়াল্লিশ বছরে এসে কাবেরী বুঝতে পারছে এখনও সে ক্ষমতা তার আছে। অসীম অবশ্য আগে আগেই উঠে যাচ্ছে। অসীমের চেহারাটা গোলগাল, ছোটখাটো। কুছুয়া তাদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। স্যার, দিদিমনিদের পেছনে পড়ে থাকতে দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
একটা ঢিবি মত জায়গায় আটকে পড়ল কাবেরী। অসীম হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল---কষ্ট হচ্ছে। হাতটা ধরে সামলে নিল নিজেকে। ঢিবিটা পেরিয়েই কাবেরী বলল---ওমা! কষ্ট হবে কেন? বেশ তো লাগছে হাঁটতে।
---না না। তুমি তো আমার মত রোগা-পাতলা নও।
---তারমানে তুমি আমাকে মোটা বলছ?
কাবেরী মোটেই মোটা নয়। আবার যুবতী শরীরের ছিপছিপে তন্বী নয়। মধ্য তিরিশের দিক থেকে তার শরীর আস্তে আস্তে ভারীর দিকে যেতে শুরু করলেও, তা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে রয়েছে। পেটে সামান্য মেদ আছে। তাতে কোমরে সামান্য ভাঁজ পড়ে। তবে সেই অতিরিক্ততা চল্লিশের যে কোনো নারীদেরই থাকে। খারাপ দেখায় না, বরং এতে বেশ পরিণতসুলভ দেখায় তাকে।
কছুয়া হাঁটা শুরু করল। ওরাও পিছু নিল নীরব অনুসরণকারীর মত। আর খানিকটা পথ পেরোনোর পর বড় শাল গাছটার তলায় ছোট্ট মন্দির। মন্দিরের দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকতে দেখা পেল স্বয়ং বোঙ্গা দেবতার। নীল বর্ণ মাটির তৈরি এই মূর্তি আসলে * দের সূর্য দেবতারই প্রতিরূপ।
কাবেরী দু হাত মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করল। পাশে দাঁড়ানো অসীমের হাসিমুখ দেখে কাবেরী জিজ্ঞেস করল হাসছ কেন?
---এই যে তোমার বিশ্বাস দেখে। মাটির দেবতার প্রতি এত আস্থা...
---আঃ অসীম! আদিবাসীদের দেবতারা খুব জাগ্রত হয় শুনেছি।
গলা ছেড়ে অট্টহাসি হাসল অসীম। কাবেরী বিরক্ত হল। মনে মনে ভাবলো নাস্তিকতা বোধ হয় পুরুষ মানুষদের একটি চরিত্র। অরুণাভটাও তাই। ঠাকুর-দেবতাকে তাচ্ছিল্য করা ওর অভ্যেস।
কাবেরীর রাগ ভাঙাতে অসীম বলল--চাইলে পুজোও দিতে পারো।
কুছুয়া বলল---এখুন হবেনি দিদিমণি। সক্কালে আসতে হবে। তখুন পূজা হয়।
মূর্তির পায়ের কাছে তখনও টাটকা ফুল, পূজার সামগ্রী দেখে বোঝা গেল সকালে এখানে পূজা হয়েছে।
বেরোনোর সময় অসীম লক্ষ্য করল মন্দিরের পাশ দিয়ে একটা জলস্রোত চলে গেছে। কুছুয়াকে জিজ্ঞেস করতে বলল---ইতু দেবীর থান হতে আসছে সার। গেলেই দিখতে পাবেন।
---ইতু দেবী? নামটা ইন্টারেস্টিং। এমন নামতো শুনিনি কখনো।
অসীমকে মাঝপথে থামিয়ে কাবেরী বলল--চলো না, গেলেই দেখতে পাবো।
গভীর জঙ্গলের এলোমেলো রাস্তা। হাতের শক্ত ডাল দিয়ে ঝোপঝাড় ছেঁটে রাস্তা বানাতে থাকলো কছুয়া। অসীম ভয় পেয়ে বলল---সাপ-খোপ নেই তো?
কুছুয়া তার কাজে রত থেকেই বলল---আছে নাই আবার! ময়াল, ঢেমনা, শিয়রচাঁদা, তপ সব আছে।
নিজে ভয় পেলেও, অসীম বলল---কাবেরী সাবধানে পা ফেলো।
অনেকটা পথ এই জঙ্গলাকীর্ন রাস্তায়। এসময় কুছুয়া চলে গেলে একা একা পথ খুঁজে ফেরা মুশকিল। অবশেষ এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত ইতু দেবীর থান। দেবী বলতে কালো পাথর খন্ড। দুটো পাহাড়ের ফাটলের মাঝে তার স্থান। পাশ দিয়ে দুধসাদা ছোট ঝর্ণা। বোঙ্গা দেবের মন্দিরের পাশের জলস্রোতের উৎস এই ঝর্ণা।
এধার ওধার মুরগীর পালক দেখে অসীম বলল---এখানে বলি-টলি হয় নাকি?
---সে পরবের সময় হয়। এখুন তো গরম। আরো চারমাইনা পরে পরব। মানত কইরলে তখুন মুরগী দিতে হয়।
কছুয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কাবেরী জিজ্ঞেস করল---এখানে মানত করে কিসের জন্য?
---পোয়াতি হতে গেরামের বউরা আসে। যার ছেনা-পোনা হয় নাই, গাভীর দুধ কমছে, তারা আইসে। গত বসর আমার বউটা আইসছিল, এখন আমার বেটা হইছে দিদিমণি।
--তুমি বিয়ে করেছ?
লজ্জায় সরলমতি বালকের মত কুছুয়া মাথা নীচু করল। একুশ-বাইশ বছরে আদিবাসী এলাকার ছেলেরা বাপ হয়ে যায়! বিস্মিত হত কাবেরী।
সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাৎ জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা লোক। বেশ রুগ্ন লোকটার পরনে লাল কাপড় জড়ানো, হাতে লাঠি। কুছুয়া খুব সম্ভ্রমের চোখে বলল---দিগা বাবা, এই থানের পূজারী।
দিগা বাবা লোকটার বয়স হয়েছে, চোখ তুলে তাকালেন অসীম ও কাবেরী দিকে। বললেন---শহর থেকে আইসছেন বাবুরা?
কুছুয়াই বলল--হাঁ গো, বাবা। কলকাতা থিকে আইসছে।
---ইটা তো মানতের সময় লয়, তবে মা তোরে দেখে বড় ভালো লাইগলো। কাবেরীকে কথাটা বলল লোকটা।
কাবেরীর মাথায় একটা ফুল ছুঁইয়ে বলল---মরদ, ছ্যানা-পোনা লয়ে সুখী হ মা।
কাবেরী ভক্তি ভরে মাথা নুইয়ে থাকলো। দিগা বাবা এবার একটা ছোট্ট নুড়ি দিলেন কাবেরীর হাতে। দিগা বাবার চোখ প্রস্তর খণ্ডের দিকে---ইটা রাখিস নিজের কাছে। আর বেশি দের নাই, তুই মা হবি।
নুড়িটা একদম গোল। এমন নুড়ি এই এলাকায় কোথাও পাওয়া যায় বলে কাবেরীর মনে হল না।
কথাটা শুনে অসীম মুচকী হাসছে। ওখান থেকে বেরোনোর সময় কাবেরী নুড়িটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো একেবারে মসৃণ। ঠিক যেন কারিগর দিয়ে কোনো পাথরকে এভাবে বানানো হয়েছে। কুছুয়া পাথরটার দিকে তাকিয়ে বলল---দিদিমণি, ই পাথর বড় কামের গো, আমার বউটারেও দিগা বাবা দিছিল। যার কাছে রয়, সে ছানা-পোনার মুখ দেখে।
হো হো করে হেসে উঠল অসীম---তাহলে মিস্টার চক্রবর্তীকে শিগগিরি খবরটা দাও কাবেরী। তিনি আবার বাবা হতে চলেছেন।
কাবেরী হেসে উঠে বলল--ধ্যাৎ।
ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস থাকলেও কাবেরী মাদুল, কবজ, টোটকা এসবে একদম বিশ্বাস করে না। দুটো বড় বড় ছেলের মা কাবেরী, এ কথা জানলে দিগা বাবা নিশ্চই আর এই ইতু দেবীর থান মুখো হতেন না। মনে মনে হেসে উঠল কাবেরী।
ওরা যখন নীচে পৌঁছল, হেমেন দা একটা টিলার ওপর বসে রয়েছেন। আলমগীর গাড়ীর টুল বক্স খুলে ঠুং ঠাং করতে ব্যস্ত। কুছুয়া হাত নেড়ে রওনা দিল হাঁসড়া গ্রামের দিকে। গাড়ীতে উঠে ওরা রওনা দিল বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে। উঁচু নীচু পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে ঘন অরণ্যের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি।
প্রায় ঘন্টা দেড়েকের দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে ওরা এসে পৌঁছল একটা ভগ্ন শিব মন্দিরের কাছে। হেমেন দা বললেন---এবার নেমে পড়তে হবে।
অসীম বলল---কাছেপিঠে দেখবার মতো কিছু আছে নাকি?
হেমেন দা একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন---আছে একটা বড় ঝর্ণা। ঠিক মন্দিরটার পেছনে।
কল কল জলের শব্দ কানে এলো কাবেরীর। কিশোরীর মেয়ের মতো বলে উঠল---ওই তো জলের শব্দ।
হেমেন দা বললেন---ঠিক শুনেছিস। তবে এখানে আসবার আরেকটা কারণ আছে। কাছেই ফরেস্ট অফিস। ফরেস্টের রেঞ্জার অফিসার আমার পরিচিত। তোরা যখন এসেছিস, কলেজের বিষয় নিয়ে একটু কথাবার্তাও হয়ে যাবে।
মন্দিরটা বেশ পুরোনো। এখানে যেন সবই কেমন পুরোনো বলে মনে হচ্ছে কাবেরীর। মন্দিরের বারান্দায় দুপাশে দুটো সিমেন্টের বাঘ। আর পাঁচটা * মন্দিরের মতই। হেমেন রায় বললেন---মুন্ডারা কিন্তু * দেবদেবীদদেরও পূজা করে। * রীতি মেনে তাদের বিয়ে হয়। হাঁসড়াতে একটা চার্চও আছে। ইদানিং কিছু মুন্ডা খ্রিস্টানও হয়েছে।
কাবেরী বিস্মিত হয়ে বলল---এতসব আছে। অথচ একটা কলেজ নেই?
হেমেন রায় হাসলেন। অসীম বলল---এটাই তোমাদের বিশ্বাস বুঝলে কাবেরী।
হেমেন দা বড় ঝর্ণা বলছিলেন, এটাকে ঠিক বড় বলা চলে না। ঝর্ণাটা নীচু। ছোট্ট একটা পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল। নীচে জল জমে একটা স্বচ্ছ জলাশয় তৈরি হয়েছে। তার তলায় নুড়ি-পাথর নজরে আসে।
ফরেস্টের রেঞ্জার অফিসার অর্জুন কুমার হাজারীবাগের মানুষ। বয়স আনুমানিক ষাট ছুঁই ছুঁই। দেখেই বোঝা যায় রিটায়ার্ডের বয়সে এসে পৌছেছেন। বেশ খাতির করে বসালেন সকলকে। হেমেন দাকে যে বেশ সম্ভ্রমের চোখে দেখেন বোঝা যাচ্ছে।
বেতের চেয়ারে ওরা বসে রইল। হেমেন দা পরিচয় করালেন---ইনি হলেন অসীম মজুমদার। আমার ছাত্র। আর ইনি কাবেরী চক্রবর্তী, আমার বোন। এই জমি জায়গার আরেক অংশীদার।
হাতজোড় করে নমস্কার করলেন অর্জুন কুমার। চা এসে গেল। বললেন--- ম্যাডাম, আপনাদের এই হেল্প ইয়াদ রাখবে মুন্ডাদের গাঁও। ওরা এখনো মূর্খ আছে, লেকিন একদিন পড়ালিখাই করলে বুঝতে পারবে, আপনারা এদের জন্য কত উপকার করলেন।
হেমেন রায়ও বললেন---অর্জুন বাবুও খুব আগ্রহী। অনেকদিনের চেষ্টা ছিল ওর। এই জমিদারী ছেড়ে সেই যে দাদুর বাবা উঠে গেছে, তারপর দাদুও খুব একটা আসেনি। যৌবনে দাদুর কাছে গল্প শুনে একবার এসেছিলাম। তারপর দাদু কবে কি উইল করে গেছে জানতাম না। বাবা মারা যাবের আগে বললেন---হিমু, হাঁসড়ায় আমাদের যে জমিদারী আছে, তা তোর দাদু তোর আর মিনুর মেয়ে খুকির নামে আছে। একদিন সময় বার করে চলে এলুম। তারপর জায়গাটা ভালো লেগে গেল। মাঝে মধ্যেই যাতায়াত বাড়তে লাগলো। অর্জুন বাবু জানতেন না, আমি যে মাঝে মধ্যেই আসি। এই জমির দখল কেউ নিতে আসবে না ভেবে একরকম কাগজপত্র রেডি করে জমিটা অধিগ্রহণের চেষ্টা করছিলেন অর্জুন বাবু। তারপর খোঁজ পেলেন আমার। সে অর্থে দেখতে গেলে এই কলেজ বাড়ি হওয়ার মূল কারিগর কিন্তু অর্জুন কুমারই।
অর্জুন কুমার লজ্জা পেলেন। বললেন---সার, আপনি না থাকলে আমি কি সবটা পেরে উঠতাম। ইধার বহুত সমস্যা। মুন্ডারা গোঁয়ার। ফরেস্টের লোকদের দুশমন মনে করে। আপনার কথা শুনল বলেই না।
অসীম বলল---হেমেন দা, কলেজবাড়ীর জমিটা কত?
---তিন কাঠা। সব মিলিয়ে দাদুর উইল অনুযায়ী আমার আর খুকীর দেড়-দেড়। দাদু অবশ্য কার কোনো অংশ লিখে দিয়ে যায়নি। কাজেই খুকি যে কোনো জমি তার দাবী করতে পারে।
অসীম ঠাট্টা করে কাবেরীর দিকে চেয়ে বলল---তাই নাকি?
কাগজপত্র বের করে মাপযোগ সহ কলেজ বাড়ির প্ল্যানিং দেখাতে লাগলো অর্জুন কুমার। হেমেন দা, অসীম তা নিয়ে ব্যস্ত। কাবেরীর নজর পড়ল ফরেস্টের বাংলোর রঙ্গন গাছের ওপর একটা পাখি বসে সুরে সুরে ডেকে চলছে। পাখিটার কাছে চলে গেল কাবেরী, তবু পাখিটা ভয় পেল না। মনে এলো বাড়ীর টিয়াটার কথা, ছেলেদুটো খাবার দিচ্ছে কিনা কে জানে।
+++++++++
facebook share public
--ইটা রাখিস তোর কাছে। আর বেশি দেরী নাই, তুই মা হবি।