22-09-2022, 03:55 PM
একবিংশতি অধ্যায়
রাতে শুয়ে কাকুর কথা ভাবতে থাকে সুখ।একটা ঘরে চারটে চৌকি।চৌকি ভাড়া একশোটাকা।একজন কজের মাসী রান্না করে তার আর বাজার খরচ মিলে প্রায় তিনশো টাকা।মাস গেলে চার সাড়ে-চারশোর টাকার ব্যাপার।শনিবার কাকু আসবেন সোমবার কাকুর সঙ্গে যেতে হবে।আজকের কাগজে দিয়েছে কাল কলেজ থেকে রেজাল্ট দেওয়া হবে।ভাল খারাপ যাইহোক পাস করে যাবে সেটা নিয়ে ভাবছে না।মাকে ছেড়ে আজ পর্যন্ত একদিন বৈচিমাসীর সঙ্গে থাকা ছাড়া বাইরে থাকেনি।মায়ের মুখটা ভেসে উঠল।এতক্ষনে মা হয়তো শুয়ে পড়েছে।
ভোরের আলো তখনও ফোটেনি।রাস্তা ঘাট ফাক।বিজন পাল গুটি গুটি পা-এ লাইনের ধারে বস্তির দিকে এগিয়ে চলেছেন।পায়জামা পরার আগে জাঙ্গিয়া পরতে গিয়েও পরেন নি।ঝুলে থাকতে থাকতে লম্বায় বাড়তে পারে।এতকাল বেশ চলছিল দত্তপুকুর থেকে ফেরার পর নতুন বায়নার কারণটা বিজন পাল আজও খুজে পায়নি।একটু বড় ছোটোয় কি আসে যায়।গিরিবালার তো অসুবিধে হয়নি। কাল থেকে তোকে আসতে হবে না।সব ব্যাপারে মেজাজ দেখালে চলে।এখন বোঝো কত ধানে কত চাল। বস্তির কাছে এসে এদিক ওদিক দেখলেন।ভদ্রলোকদের এই হয়েছে মুষ্কিল ইচ্ছে হলেই যেখানে সেখানে যাওয়া যায় না।রেলের দখল করা জমিতে সারি সারি চালা ঘর।একটা ঘরের কাছে গিয়ে নীচু গলায় ডাকলেন,গিরি-ই-ই----গিরি-ই-ই-ই।
কি ডারে?ভেতর থেকে বিরক্তি ভরা আওয়াজ এল।
গিরিবালা আমি-ই।
দরজা খুলে বিজন পালকে দেখে গিরিবালা বলল,দাদা আপনে?
একটা লোকের জন্য তোর বৌদি তো জ্বালিয়ে খেলো।
আমি আপনের কাজ করতে পারব না।আমার একটা প্রেস্টিক আছে।
তোকে করতে হবে না।তুই একটা লোক দেখে দে।
মাস্টারসাবের বাড়ি গেছিল সব খবর পাই।উনি আমারে খুব পছন্দ করেন।নিজির দ্বারা হয়নি তাই আপনেরে পাঠিয়েছে।
ওর কথা বাদ দে।আমার কথাটা ভাব।
শালা ভেড়ুয়া।যখন আমারে বলল মিনি বেড়ালের মত অন্যদিকে মুখ ফেরায়ে ছেল।এসব কথা মুখের উপর বলা যায় না।গিরিবালা বলল,দেখি কি করা যায়।
দেখি না সোনা তোকে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
ঠিক আছে এখন যান।লোকজন জাগলি সন্দ করতি পারে।
সন্দেহ করলে করুক আমি ওসবে ভয় পাইনে।
হইছে হইছে সেইদিন তো কোনো কথা বলেন নাই।
বলি নি কেন জানিস? তোর বৌদিকে টাইট দেবার জন্য।এখন বুঝতে পারছে।বাদ দে ঐসব কথা,তুই একটা লোক দেখে দে সোনা।
গিরিবালার মনে মজা করার ইচ্ছে হল বলল,বয়স্কা হলে চলবে?
হ্য হ্যা রান্না করতে পারলেই হবে।
রান্না করলেই হবে?আর কিছু হবে না কিন্তু।
বিজনপাল লালসা জড়ানো চোখে গিরিবালাকে দেখল।তুই যোগাযোগ রাখিস।
বিজন পাল যেতে গিয়ে ফিরে এসে বললেন,আমি যে তোর কাছে এসেছিলাম তোর বৌদি যেন জানতে না পারে।
ঘুম ভেঙ্গেছে তবু চাদরের নীচ থেকে মাথা বের করছে না।কানে আসছে রান্না ঘর থেকে খুটখাট শব্দ।মায়ের কথা ভাবে সুখদা রঞ্জন।চা করেই বেরিয়ে যাবে।চাদর ঢাকা অবস্থায় না দেখেই বুঝতে পারে মা ঢুকেছে।
সুমনা চা নিয়ে ঢুকে শায়িত ছেলের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকেন। বুঝতে পারেন ঘুমোচ্ছে না মটকা মেরে পড়ে আছে।মাথার দিকে টেবিলে চায়ের কাপ রেখে "চা রেখে গেলাম" বলে চলে গেলেন।
আড়মোড়া ভেঙ্গে চাদর সরিয়ে উঠে বসে চায়ের কাপের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে।এই বের হল ঘণ্টা দুয়েক পরে ফিরে রান্না করবে।কোনো ক্লান্তি নেই।তাপস বলছিল ভালবাসার কথা।সবে উচ্চ মাধ্যমিক এখনই এসব করতে হবে।হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিল।দেওয়াল ঘেষা কীটব্যাগ দেখে ভ্রু কুচকে যায়।ব্যাগটার অনেক বয়স।সেই মাহিদিয়া থেকে আসার সময় এনেছিল। ওটা তো আলমারিতে ছিল বের করল কে?চা শেষ করে চৌকি হতে নেমে ব্যাগের জিপার টেনে খুলে অবাক।তার জামা প্যাণ্ট ভাজ করে সাজানো।মা তাকে কলকাতায় পাঠাতে চায় তার আয়োজন।অভিমানে চোখে জল চলে আসে।মনে মনে ভাবে শনি-রোববার তো দেখাই হবে। কলেজে নানা রকম ছুটি থাকে তাছাড়া গ্রীষ্মাবকাশ পূজাবকাশ তো আছেই।কলকাতায় যাবার ব্যাপারটা মেনে নেয় সুখ।
বিজন পাল মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করেন।ঢুকলেই হাজারো প্রশ্ন তীরের মত বিদ্ধ করবে।দরজা খুলে প্রমীলা বললেন,চা খাবে তো?
সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়িয়ে নিজের ঘরে ঢুকে একটা সিগারেট ধরালেন।একরাশ ধোয়া ছেড়ে ভাবছেন মুড ভাল আছে মনে হয়।এক্টু পরেই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঢুকলেন প্রমীলা।চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন,কি হল সিগারেট ধরালে বাথরুম যাবেনা?
বাথরুম যাব বলেই তো সিগারেট ধরালাম।ব্যাকওয়ার্ড খেললেন বিজন পাল।
শোনো এইমাস পর লোক না পেলে হোম সার্ভিস হতে খাবার আনতে হবে।আমি আর পারছি না।
সকালের কথাটা চেপে গেলেন।আগে থেকে কিছু বলা ঠিক হবে না।গিরি কি করে দেখা যাক।অফিস যাবার তাড়া আছে বিজন পাল চা শেষ করে বাথরুমে ঢুকে গেলেন।পায়জামা খুলতে দেখলেন তলপেটের নীচে কুকড়ে আছে।জাঙ্গিয়া না পরলে বিচিও ঝুলবে।বিচি বড় হলে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার।একবার মালিশ পরীক্ষা করে দেখবেন নাকি?এই বয়সে কি কোনো কাজ হবে?
সুখ কলেজে পৌছে দেখল ক্লাস চলছে।খোজ নিয়ে জানা গেল বেলা একটায় রেজাল্ট দেওয়া হবে।তাহলে কি বাড়ীর থেকে একবার ঘুরে আসবে সুখ ভাবে।নজরে পড়ল তিন তলার বারান্দায় কিছু ছেলের জটলা।ওরা ক্লাসে বসে অপেক্ষা করছে।সুখ সিড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠে এল।প্রথমেই কলা বিভাগ তারপর বাণিজ্য একেবারে শেষে বিজ্ঞান।বিজ্ঞান বিভাগের বারান্দায় কয়কজন ছেলে মেয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে।আলাপ নেই মুখ চেনা,একটি ছেলে সিধু মানে সিদ্ধেশ্বরের সঙ্গে দু-একটা কথা হয়েছে আগে।কলা বিভাগের তাপস সীমা এরকম চেনাশুনা কাউকে না দেখে ক্লাসে না ঢূকে বারান্দায় প্রাচীরে হেলান দিয়ে দাড়াল।কটা বাজে হাতে ঘড়ি নেই যে দেখবে।এখন মনে হচ্ছে বাড়ী থেকে একবার ঘুরে এলেই হতো।সিধুর দলকে খুব সচকিত মনে হল।ওদের দৃষ্টি একদিকে নিবদ্ধ।দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল বারান্দার অন্য প্রান্ত হতে পাঞ্চালী দৃপ্তভঙ্গীতে এদিকে আসছে।শ্যমালা রঙ দীর্ঘ দেহ ভীড়ের মধ্যেও ওর দিকে নজর পড়বে সবার।পাচীলে কনুইয়ের ভর দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে সুখদা।ওদের কি কোনো মতলব আছে?যাকগে তার দরকার কি?
পাঞ্চালী ওদের অতিক্রম করে এগোতে যাবে একটি ছেলে বলল,বলতো পঞ্চ স্বামী যার এক কথায় প্রকাশ কি হবে?
এতো সোজা পাঞ্চালী।
সবাই হো-হো করে হেসে উঠল।সুখর রাগ চড়ে যায়।পাঞ্চালী দাঁড়িয়ে পড়ল ঘুরে এসে জিজ্ঞেস করল,আমাকে কিছু বললি?
সিধু মিট্মিট হাসছে।একটি ছেলে বলল,একীরে আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছি।
সুখ এগিয়ে গিয়ে বলে,পঞ্চস্বামী যার তাকে বলে পঞ্চ ভর্তকা। আর পাঞ্চাল রাজকন্যাকে বলে পাঞ্চালী।বুঝেছিস?
পাঞ্চালী আড়চোখে সুখকে দেখে।সিধু বলল,তোর কাছে কেউ শিখতে চেয়েছে?আমাদের সায়েন্সের মধ্যে কথা হচ্ছে তুই কেন নাক গলাচ্ছিস?তোকে কিছু বলেছে?
কাকে বলেছে তুই জানিস না?
ধরলাম পাঞ্চালীকে বলেছে তাতে তোর গায়ে এত জ্বালা কেন?
জ্বালা কেন দেখবি?
কি করবি মারবি?
সুখ হাত তুলে আঙুল গুলো মেলে দিয়ে বলল,এইযে বুড়ো আঙুল হল ভীম তর্জনী অর্জুন মধ্যমা যুধিষ্টির অনামিকা নকুল কনিষ্ঠা সহদেব।
সুখর কাণ্ড দেখে পাঞ্চালী হাসি দমন করে।সুখ বলল,একটি ঝাপড় দেব পঞ্চ পাণ্ডবের ছাপ পড়ে যাবে।
একজন বলল একটা বাজতে চলল ,চল নীচে যাই।
সিধু বলল,হ্যা-হ্যা চলতো।সব জায়গায় মস্তানী।ওরা গুটি গুটি সরে পড়ল।একটা বাজতে চলল শুনে সুখও চলে যাচ্ছিল।পাঞ্চালী বলল,এই শোনো।
সুখদা দাঁড়িয়ে পড়ল।পাঞ্চালী মনে হয় তাকে থ্যাঙ্কস জানাবে।ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,আমাকে বললে?
তুমি ছাড়া এখানে আর কে আছে?
তা ঠিক।
তোমাকে কেঊ ডেকেছে তুমি এসেছিলে কেন?
হকচকিয়ে যায় সুখ আমতা আমতা করে বলল,ওরা অসভ্যতা করছিল তাই--
সব জায়গায় সিভালরি দেখাও?আমি তোমার সাহায্য চেয়েছি?
না মানে বুঝতে পারিনি--।
সিধু যখন জিজ্ঞেস করল ওকে বললে তোমার এত জ্বালা কেন মুখের মত জবাব দিতে পারলে না?
আমার অন্যায় হয়ে গেছে।
সুখদা চলে যাবার সময় শুনতে পেল,হাদারাম কারো গায়ে লেখা থাকে না। বাহাদুর বলে কিনা অন্যায় হয়ে গেছে।
সুখদা কথা বাড়ায় না হন হন করে নীচে নামতে থাকে।মা বলে দেখ বাবা কেউ কিছু জিজ্ঞেস না করলে কিছু বলতে যাবি না কেউ কিছু করতে না বললে আগ বাড়িয়ে করতে যাবি না।মা ঠিকই বলে।
অফিসে সামনে লাইন পড়ে গেছে।সুখদা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।এখুনি মার্কশিট দেওয়া শুরু হবে।এখানে আর নয় কলকাতায় চলে যাবে সুখ মনে মনে ভাবে।কোথা থেকে ছুটে এসে সিমাও পিছনে এসে দাঁড়ায়।
তোর সঙ্গে কি হয়েছে রে?সীমা জিজ্ঞেস করল।
ফালতু ঝামেলা।পরে বলছি।
লাইন ধীরে ধীরে এগোতে থাকে।হেডস্যার স্বয়ং মার্কশীট বিলি করছেন।পাঞ্চালী মেয়েটা এমনি ভদ্র কিন্তু তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করল কেন বুঝতে পারে না।ওরা তো ওকেই টিটকিরি দিয়েছে।সুখ একসময় টেবিলের কাছে চলে এল।হেডস্যার তার মার্কশীট বের করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মার্কশীটটাইয় চোখ বোলাতে থাকেন।একসময় বললেন,তোমার রেজাল্ট আরো ভাল আশা করেছিলাম।অবশ্য ইংরেজীতে লেটার মার্ক্স। ল্যাংগুয়েজে লেটার মার্ক্স পাওয়া বেশ কঠিণ।সুখ মাথা নীচু করে শুনতে থাকে।হেডস্যার বললেন,সই করো।
সুখ সই করে মার্ক্সশীট নিয়ে লাইন থেকে বেরিয়ে যায়।সীমা বলল,দাড়াবি।
পাঞ্চালীও লাইনে দাঁড়িয়েছে।তার দিকে একবার আগুণচোখে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
রেজাল্ট নিয়ে সীমা আর সুখ বাড়ীর দিকে চলতে শুরু করে।সীমা বলল,তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি আপত্তি থাকলে বলতে হবে না।
কি কথা?
তাপস আমার সম্পর্কে তোকে কি বলছিল?
শোন সীমা একজনের কথা আরেকজনকে বলা কি ভাল?তাপস যখ জিজ্ঞেস করে তুই কি বলছিলি ওকে আমি কিছুই বলি না।
আচ্ছা তাপস কি চায় তুই বুঝতে পারিস না?
কি জানি?দেখা হলেই খালি সীমার সঙ্গে তোর কি কথা হচ্ছিল?
থাক তোর বুঝে দরকার নেই।এবার বল আজ কি হয়েছিল?
আর বলিস না।সিধু--।
সিধুর কথা থাকে আমি মনীষার কাছে শুনেছি।পাঞ্চালী তোকে কি বলছিল?
ওর সঙ্গে কিছুই হয়নি।বলে কিনা সিভালরি দেখাও--আমাকে বললে তোমার জ্বালা কেন এইসব।
তুই কিছুই বুঝিস না?
কি বুঝব বল।এমনি ও খুব ভদ্র বাবা বলতো মেয়েটা অত্যন্ত ভদ্র অতবড় ডাক্তারের মেয়ে কোনো অহঙ্কার নেই একবার বললেই বুঝতে পারে--।
তুই বুঝিস না?
কি বুঝব বল।আমি কখনো ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি।
সীমা মুখ টিপে হাসে।
তুই হাসছিস?দেখ সীমা এই গোপালনগর আমার স্যুট করছে না।আমি কলকাতায় চলে যাবো।শনি-রোব্বার আসব।আমাদের আর বেশী দেখা হবে না।
সুখ মেধাবী ছাত্র বোকা বলা যায় না।এক মেধা দিয়ে সব কিছু বিচার করা যায় না।
রাতে শুয়ে কাকুর কথা ভাবতে থাকে সুখ।একটা ঘরে চারটে চৌকি।চৌকি ভাড়া একশোটাকা।একজন কজের মাসী রান্না করে তার আর বাজার খরচ মিলে প্রায় তিনশো টাকা।মাস গেলে চার সাড়ে-চারশোর টাকার ব্যাপার।শনিবার কাকু আসবেন সোমবার কাকুর সঙ্গে যেতে হবে।আজকের কাগজে দিয়েছে কাল কলেজ থেকে রেজাল্ট দেওয়া হবে।ভাল খারাপ যাইহোক পাস করে যাবে সেটা নিয়ে ভাবছে না।মাকে ছেড়ে আজ পর্যন্ত একদিন বৈচিমাসীর সঙ্গে থাকা ছাড়া বাইরে থাকেনি।মায়ের মুখটা ভেসে উঠল।এতক্ষনে মা হয়তো শুয়ে পড়েছে।
ভোরের আলো তখনও ফোটেনি।রাস্তা ঘাট ফাক।বিজন পাল গুটি গুটি পা-এ লাইনের ধারে বস্তির দিকে এগিয়ে চলেছেন।পায়জামা পরার আগে জাঙ্গিয়া পরতে গিয়েও পরেন নি।ঝুলে থাকতে থাকতে লম্বায় বাড়তে পারে।এতকাল বেশ চলছিল দত্তপুকুর থেকে ফেরার পর নতুন বায়নার কারণটা বিজন পাল আজও খুজে পায়নি।একটু বড় ছোটোয় কি আসে যায়।গিরিবালার তো অসুবিধে হয়নি। কাল থেকে তোকে আসতে হবে না।সব ব্যাপারে মেজাজ দেখালে চলে।এখন বোঝো কত ধানে কত চাল। বস্তির কাছে এসে এদিক ওদিক দেখলেন।ভদ্রলোকদের এই হয়েছে মুষ্কিল ইচ্ছে হলেই যেখানে সেখানে যাওয়া যায় না।রেলের দখল করা জমিতে সারি সারি চালা ঘর।একটা ঘরের কাছে গিয়ে নীচু গলায় ডাকলেন,গিরি-ই-ই----গিরি-ই-ই-ই।
কি ডারে?ভেতর থেকে বিরক্তি ভরা আওয়াজ এল।
গিরিবালা আমি-ই।
দরজা খুলে বিজন পালকে দেখে গিরিবালা বলল,দাদা আপনে?
একটা লোকের জন্য তোর বৌদি তো জ্বালিয়ে খেলো।
আমি আপনের কাজ করতে পারব না।আমার একটা প্রেস্টিক আছে।
তোকে করতে হবে না।তুই একটা লোক দেখে দে।
মাস্টারসাবের বাড়ি গেছিল সব খবর পাই।উনি আমারে খুব পছন্দ করেন।নিজির দ্বারা হয়নি তাই আপনেরে পাঠিয়েছে।
ওর কথা বাদ দে।আমার কথাটা ভাব।
শালা ভেড়ুয়া।যখন আমারে বলল মিনি বেড়ালের মত অন্যদিকে মুখ ফেরায়ে ছেল।এসব কথা মুখের উপর বলা যায় না।গিরিবালা বলল,দেখি কি করা যায়।
দেখি না সোনা তোকে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
ঠিক আছে এখন যান।লোকজন জাগলি সন্দ করতি পারে।
সন্দেহ করলে করুক আমি ওসবে ভয় পাইনে।
হইছে হইছে সেইদিন তো কোনো কথা বলেন নাই।
বলি নি কেন জানিস? তোর বৌদিকে টাইট দেবার জন্য।এখন বুঝতে পারছে।বাদ দে ঐসব কথা,তুই একটা লোক দেখে দে সোনা।
গিরিবালার মনে মজা করার ইচ্ছে হল বলল,বয়স্কা হলে চলবে?
হ্য হ্যা রান্না করতে পারলেই হবে।
রান্না করলেই হবে?আর কিছু হবে না কিন্তু।
বিজনপাল লালসা জড়ানো চোখে গিরিবালাকে দেখল।তুই যোগাযোগ রাখিস।
বিজন পাল যেতে গিয়ে ফিরে এসে বললেন,আমি যে তোর কাছে এসেছিলাম তোর বৌদি যেন জানতে না পারে।
ঘুম ভেঙ্গেছে তবু চাদরের নীচ থেকে মাথা বের করছে না।কানে আসছে রান্না ঘর থেকে খুটখাট শব্দ।মায়ের কথা ভাবে সুখদা রঞ্জন।চা করেই বেরিয়ে যাবে।চাদর ঢাকা অবস্থায় না দেখেই বুঝতে পারে মা ঢুকেছে।
সুমনা চা নিয়ে ঢুকে শায়িত ছেলের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকেন। বুঝতে পারেন ঘুমোচ্ছে না মটকা মেরে পড়ে আছে।মাথার দিকে টেবিলে চায়ের কাপ রেখে "চা রেখে গেলাম" বলে চলে গেলেন।
আড়মোড়া ভেঙ্গে চাদর সরিয়ে উঠে বসে চায়ের কাপের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে।এই বের হল ঘণ্টা দুয়েক পরে ফিরে রান্না করবে।কোনো ক্লান্তি নেই।তাপস বলছিল ভালবাসার কথা।সবে উচ্চ মাধ্যমিক এখনই এসব করতে হবে।হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিল।দেওয়াল ঘেষা কীটব্যাগ দেখে ভ্রু কুচকে যায়।ব্যাগটার অনেক বয়স।সেই মাহিদিয়া থেকে আসার সময় এনেছিল। ওটা তো আলমারিতে ছিল বের করল কে?চা শেষ করে চৌকি হতে নেমে ব্যাগের জিপার টেনে খুলে অবাক।তার জামা প্যাণ্ট ভাজ করে সাজানো।মা তাকে কলকাতায় পাঠাতে চায় তার আয়োজন।অভিমানে চোখে জল চলে আসে।মনে মনে ভাবে শনি-রোববার তো দেখাই হবে। কলেজে নানা রকম ছুটি থাকে তাছাড়া গ্রীষ্মাবকাশ পূজাবকাশ তো আছেই।কলকাতায় যাবার ব্যাপারটা মেনে নেয় সুখ।
বিজন পাল মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করেন।ঢুকলেই হাজারো প্রশ্ন তীরের মত বিদ্ধ করবে।দরজা খুলে প্রমীলা বললেন,চা খাবে তো?
সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়িয়ে নিজের ঘরে ঢুকে একটা সিগারেট ধরালেন।একরাশ ধোয়া ছেড়ে ভাবছেন মুড ভাল আছে মনে হয়।এক্টু পরেই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঢুকলেন প্রমীলা।চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন,কি হল সিগারেট ধরালে বাথরুম যাবেনা?
বাথরুম যাব বলেই তো সিগারেট ধরালাম।ব্যাকওয়ার্ড খেললেন বিজন পাল।
শোনো এইমাস পর লোক না পেলে হোম সার্ভিস হতে খাবার আনতে হবে।আমি আর পারছি না।
সকালের কথাটা চেপে গেলেন।আগে থেকে কিছু বলা ঠিক হবে না।গিরি কি করে দেখা যাক।অফিস যাবার তাড়া আছে বিজন পাল চা শেষ করে বাথরুমে ঢুকে গেলেন।পায়জামা খুলতে দেখলেন তলপেটের নীচে কুকড়ে আছে।জাঙ্গিয়া না পরলে বিচিও ঝুলবে।বিচি বড় হলে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার।একবার মালিশ পরীক্ষা করে দেখবেন নাকি?এই বয়সে কি কোনো কাজ হবে?
সুখ কলেজে পৌছে দেখল ক্লাস চলছে।খোজ নিয়ে জানা গেল বেলা একটায় রেজাল্ট দেওয়া হবে।তাহলে কি বাড়ীর থেকে একবার ঘুরে আসবে সুখ ভাবে।নজরে পড়ল তিন তলার বারান্দায় কিছু ছেলের জটলা।ওরা ক্লাসে বসে অপেক্ষা করছে।সুখ সিড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠে এল।প্রথমেই কলা বিভাগ তারপর বাণিজ্য একেবারে শেষে বিজ্ঞান।বিজ্ঞান বিভাগের বারান্দায় কয়কজন ছেলে মেয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে।আলাপ নেই মুখ চেনা,একটি ছেলে সিধু মানে সিদ্ধেশ্বরের সঙ্গে দু-একটা কথা হয়েছে আগে।কলা বিভাগের তাপস সীমা এরকম চেনাশুনা কাউকে না দেখে ক্লাসে না ঢূকে বারান্দায় প্রাচীরে হেলান দিয়ে দাড়াল।কটা বাজে হাতে ঘড়ি নেই যে দেখবে।এখন মনে হচ্ছে বাড়ী থেকে একবার ঘুরে এলেই হতো।সিধুর দলকে খুব সচকিত মনে হল।ওদের দৃষ্টি একদিকে নিবদ্ধ।দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল বারান্দার অন্য প্রান্ত হতে পাঞ্চালী দৃপ্তভঙ্গীতে এদিকে আসছে।শ্যমালা রঙ দীর্ঘ দেহ ভীড়ের মধ্যেও ওর দিকে নজর পড়বে সবার।পাচীলে কনুইয়ের ভর দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে সুখদা।ওদের কি কোনো মতলব আছে?যাকগে তার দরকার কি?
পাঞ্চালী ওদের অতিক্রম করে এগোতে যাবে একটি ছেলে বলল,বলতো পঞ্চ স্বামী যার এক কথায় প্রকাশ কি হবে?
এতো সোজা পাঞ্চালী।
সবাই হো-হো করে হেসে উঠল।সুখর রাগ চড়ে যায়।পাঞ্চালী দাঁড়িয়ে পড়ল ঘুরে এসে জিজ্ঞেস করল,আমাকে কিছু বললি?
সিধু মিট্মিট হাসছে।একটি ছেলে বলল,একীরে আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছি।
সুখ এগিয়ে গিয়ে বলে,পঞ্চস্বামী যার তাকে বলে পঞ্চ ভর্তকা। আর পাঞ্চাল রাজকন্যাকে বলে পাঞ্চালী।বুঝেছিস?
পাঞ্চালী আড়চোখে সুখকে দেখে।সিধু বলল,তোর কাছে কেউ শিখতে চেয়েছে?আমাদের সায়েন্সের মধ্যে কথা হচ্ছে তুই কেন নাক গলাচ্ছিস?তোকে কিছু বলেছে?
কাকে বলেছে তুই জানিস না?
ধরলাম পাঞ্চালীকে বলেছে তাতে তোর গায়ে এত জ্বালা কেন?
জ্বালা কেন দেখবি?
কি করবি মারবি?
সুখ হাত তুলে আঙুল গুলো মেলে দিয়ে বলল,এইযে বুড়ো আঙুল হল ভীম তর্জনী অর্জুন মধ্যমা যুধিষ্টির অনামিকা নকুল কনিষ্ঠা সহদেব।
সুখর কাণ্ড দেখে পাঞ্চালী হাসি দমন করে।সুখ বলল,একটি ঝাপড় দেব পঞ্চ পাণ্ডবের ছাপ পড়ে যাবে।
একজন বলল একটা বাজতে চলল ,চল নীচে যাই।
সিধু বলল,হ্যা-হ্যা চলতো।সব জায়গায় মস্তানী।ওরা গুটি গুটি সরে পড়ল।একটা বাজতে চলল শুনে সুখও চলে যাচ্ছিল।পাঞ্চালী বলল,এই শোনো।
সুখদা দাঁড়িয়ে পড়ল।পাঞ্চালী মনে হয় তাকে থ্যাঙ্কস জানাবে।ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,আমাকে বললে?
তুমি ছাড়া এখানে আর কে আছে?
তা ঠিক।
তোমাকে কেঊ ডেকেছে তুমি এসেছিলে কেন?
হকচকিয়ে যায় সুখ আমতা আমতা করে বলল,ওরা অসভ্যতা করছিল তাই--
সব জায়গায় সিভালরি দেখাও?আমি তোমার সাহায্য চেয়েছি?
না মানে বুঝতে পারিনি--।
সিধু যখন জিজ্ঞেস করল ওকে বললে তোমার এত জ্বালা কেন মুখের মত জবাব দিতে পারলে না?
আমার অন্যায় হয়ে গেছে।
সুখদা চলে যাবার সময় শুনতে পেল,হাদারাম কারো গায়ে লেখা থাকে না। বাহাদুর বলে কিনা অন্যায় হয়ে গেছে।
সুখদা কথা বাড়ায় না হন হন করে নীচে নামতে থাকে।মা বলে দেখ বাবা কেউ কিছু জিজ্ঞেস না করলে কিছু বলতে যাবি না কেউ কিছু করতে না বললে আগ বাড়িয়ে করতে যাবি না।মা ঠিকই বলে।
অফিসে সামনে লাইন পড়ে গেছে।সুখদা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।এখুনি মার্কশিট দেওয়া শুরু হবে।এখানে আর নয় কলকাতায় চলে যাবে সুখ মনে মনে ভাবে।কোথা থেকে ছুটে এসে সিমাও পিছনে এসে দাঁড়ায়।
তোর সঙ্গে কি হয়েছে রে?সীমা জিজ্ঞেস করল।
ফালতু ঝামেলা।পরে বলছি।
লাইন ধীরে ধীরে এগোতে থাকে।হেডস্যার স্বয়ং মার্কশীট বিলি করছেন।পাঞ্চালী মেয়েটা এমনি ভদ্র কিন্তু তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করল কেন বুঝতে পারে না।ওরা তো ওকেই টিটকিরি দিয়েছে।সুখ একসময় টেবিলের কাছে চলে এল।হেডস্যার তার মার্কশীট বের করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মার্কশীটটাইয় চোখ বোলাতে থাকেন।একসময় বললেন,তোমার রেজাল্ট আরো ভাল আশা করেছিলাম।অবশ্য ইংরেজীতে লেটার মার্ক্স। ল্যাংগুয়েজে লেটার মার্ক্স পাওয়া বেশ কঠিণ।সুখ মাথা নীচু করে শুনতে থাকে।হেডস্যার বললেন,সই করো।
সুখ সই করে মার্ক্সশীট নিয়ে লাইন থেকে বেরিয়ে যায়।সীমা বলল,দাড়াবি।
পাঞ্চালীও লাইনে দাঁড়িয়েছে।তার দিকে একবার আগুণচোখে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
রেজাল্ট নিয়ে সীমা আর সুখ বাড়ীর দিকে চলতে শুরু করে।সীমা বলল,তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি আপত্তি থাকলে বলতে হবে না।
কি কথা?
তাপস আমার সম্পর্কে তোকে কি বলছিল?
শোন সীমা একজনের কথা আরেকজনকে বলা কি ভাল?তাপস যখ জিজ্ঞেস করে তুই কি বলছিলি ওকে আমি কিছুই বলি না।
আচ্ছা তাপস কি চায় তুই বুঝতে পারিস না?
কি জানি?দেখা হলেই খালি সীমার সঙ্গে তোর কি কথা হচ্ছিল?
থাক তোর বুঝে দরকার নেই।এবার বল আজ কি হয়েছিল?
আর বলিস না।সিধু--।
সিধুর কথা থাকে আমি মনীষার কাছে শুনেছি।পাঞ্চালী তোকে কি বলছিল?
ওর সঙ্গে কিছুই হয়নি।বলে কিনা সিভালরি দেখাও--আমাকে বললে তোমার জ্বালা কেন এইসব।
তুই কিছুই বুঝিস না?
কি বুঝব বল।এমনি ও খুব ভদ্র বাবা বলতো মেয়েটা অত্যন্ত ভদ্র অতবড় ডাক্তারের মেয়ে কোনো অহঙ্কার নেই একবার বললেই বুঝতে পারে--।
তুই বুঝিস না?
কি বুঝব বল।আমি কখনো ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি।
সীমা মুখ টিপে হাসে।
তুই হাসছিস?দেখ সীমা এই গোপালনগর আমার স্যুট করছে না।আমি কলকাতায় চলে যাবো।শনি-রোব্বার আসব।আমাদের আর বেশী দেখা হবে না।
সুখ মেধাবী ছাত্র বোকা বলা যায় না।এক মেধা দিয়ে সব কিছু বিচার করা যায় না।