07-09-2022, 09:04 PM
(This post was last modified: 29-11-2022, 09:20 PM by Bumba_1. Edited 3 times in total. Edited 3 times in total.)
(১১)
সময় বড় অদ্ভুত জিনিস .. যা কখনো দৃষ্টিগোচর হয় না, কিন্তু জীবন যুদ্ধে কে অবিচল থেকে সফলতার নিরিখে এগিয়ে আর কে পিছিয়ে তা কিন্তু সময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সঠিক দিক ও সঠিক সময়ের জ্ঞান না থাকলে, উদীয়মান সূর্যকেও অস্ত যাওয়ার মতো মনে হয়। সময় কখনো সাক্ষী বা প্রমাণ চায় না, সরাসরি আঘাত করে। আগে মানুষ শিখিয়েছে সময় বদলে যায়, আর পরবর্তীতে সময় শিখিয়েছে মানুষও বদলে যায়। যে ব্যক্তি জীবনের একটি ঘন্টা নষ্ট করার সাহস করে, সে আসলে জীবনের মূল্য এখনও বোঝেইনি। দ্রুত বয়ে চলে যাওয়া এই সময়ের সঠিক ব্যবহার যারা করতে পারে তারাই সফল ও সার্থক বলে পরিচিত হয়। যারা সময়কে ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারে না, তারাই আসলে সময় নিয়ে অভিযোগ করে।
আমাদের গোগোল সেই প্রথম পর্যায়ের মধ্যে পড়ে যে সর্বদা মনে করে সময় হলো জীবনের সর্বাধিক মূল্যবান মুদ্রা। এই মুদ্রাটি কীভাবে ব্যয় করা হবে এই বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে যদি অপরকে নির্ধারণ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই সময়ের গোলকধাঁধায় চিরজীবনের মতো আটকা পড়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে হয়। তাই নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে ব্যক্তিগত জীবনের ভালোমন্দের ক্ষেত্রেই হোক অথবা জীবনযুদ্ধের জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রেই হোক এখনো পর্যন্ত বিফলতা তাকে গ্রাস করেনি।
ওদিকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অতিক্রম হয়ে বছর ঘুরতে চললো এখনো নিশীথ বটব্যালের খুনের কিনারা করতে পারলো না পুলিশ। বিধায়ক মানিক সামন্ত (তার ব্যক্তিগত ধারণা অনুযায়ী) গঙ্গানগরের অপদার্থ পুলিশ বাহিনী এবং বিশেষ করে ইন্সপেক্টর গোস্বামীর বিরুদ্ধে হায়ার অথরিটির কাছে নালিশ জানিয়েছিলেন। তবে এখনো পর্যন্ত উপরমহল থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
আজ গোগোলের কলেজ জীবনের শেষ দিন। ফিজিওলজি অনার্স ছিলো তার .. রেজাল্ট বেরিয়েছে .. ফার্স্টক্লাস পেয়েছে আমাদের গোগোল। কলেজ থেকে মার্কশিট নিয়ে টোটো চেপে বাড়ি ফিরছে। রেলপাড়ে ঢোকার মুখের রাস্তাটা বেশ খারাপ, স্বভাবতই টোটো কিছুটা স্লো হয়েছে। গোগোল দেখলো একটা বাড়ির সামনে একটি মেয়ে আর দুটি ছেলে দাঁড়িয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে কিছু কথা বলছে। বাড়িটার সামনে অর্থাৎ রাস্তার উল্টোদিকে আর একটা টোটো দাঁড়িয়ে আছে। সেই তিনচাকার যানের ড্রাইভার বলছেন - "তাড়াতাড়ি আপনাদের ঝামেলাটা মেটান .. ভাড়াটা মিটিয়ে আমাকে ছাড়ুন।" মেয়েটি কাঁদছে , পাশে একটা লম্বা ছেলে সিরিয়াস মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে , আর অন্য ছেলেটি হাত-পা নেড়ে কি'সব যেন বোঝাচ্ছে।
গোগোল ভাবলো নেমে একবার জিজ্ঞাসা করে "দাদা কে জিতছে ?..." কিন্তু পরমুহুর্তেই মনে করলো এখন সে বড় হয়েছে। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হলো তার। এইসব খিল্লি করা তার শোভা পায় না। আসলে কলেজপড়ুয়া চ্যাংড়া হলে কেস খায় বা খাওয়ায় আর এক্সপেরিয়েন্সড হলে কেস স্টাডি করে। গোগোলও তাই কেস স্টাডির দিকে মন দিলো। এই ধরনের কেসকে বলা হয় - 'এক রাধা , দুই গাধা' কেস । ধরা যাক , মেয়েটির নাম বর্ষা , যে ছেলেটি হাত পা নেড়ে বোঝাচ্ছিল তার নাম আকাশ, আর যে ছেলেটি সিরিয়াস মুখ করে দাঁড়িয়েছিল তার নাম কাদা।
ভাবছেন তো আমার মস্তিষ্ক থুড়ি আমাদের গোগোলের মাথাটা এবার সত্যি সত্যি গেছে। আসলে তা নয়, এই নামকরণের পেছনে একটা যুক্তি আছে। আকাশ আর বর্ষার মধ্যে কুছ কুছ হোতা হ্যায়। কিন্তু, কাদা বেচারার কুছ নেহি হোতা। কিন্তু , এই কাদারা প্রেমের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বারবার ট্রাই নিতে থাকে। থেমে থাকলে কাদা শুকিয়ে যাবে। তাই কাদাকে সবসময় ডায়নামিক হতে হবে। গোগোল যা বুঝলো - আকাশ আর বর্ষার মধ্যে কোনো কারণে ঝামেলা হয়েছে। এই ঝামেলার কয়েক হাজার কারণ থাকতে পারে। সেই কারণটা অত ইম্পর্ট্যান্ট নয়। প্রেম কা বন্ধন মে ঝগড়া তো হবেই , কারণ থাক বা নাই থাক। কাজেই, কারণ কি সেটা ভাবা অর্থহীন। এই ঝগড়ায় সবচেয়ে লাভবান হয়েছে কাদা এই ব্যাপারটা কিন্তু লক্ষণীয়। কাদা এইসময় বর্ষাকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সাপোর্ট দিয়েছে। আকাশ না থাকুক , কাদা তো আছে। হয়তো , কবিরা আকাশ নিয়ে কবিতা লিখেছেন , কাদা নিয়ে লেখেননি , কিন্তু বর্ষার সঙ্গে কাদা জড়িয়ে আছে, সেই সৃষ্টির আদিম যুগ থেকে ।
বর্ষাও মন খুলে কথা বলছিল। আকাশ কোনোভাবে সিনে নেই .. ফোনে নেই । বর্ষা আর কাদা টোটো চেপে কোথাও একটা যাচ্ছিলো। হয়তো কাদা বর্ষাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে যাচ্ছিলো। এই বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে কত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে গুনে শেষ করা যাবে না .. এসব গভীর ব্যাপার। যাইহোক , কাদা আর বর্ষা যখন টোটো চেপে যাচ্ছিলো সেই রাস্তাতেই আকাশের সঙ্গে দেখা। আকাশ হয়তো বিড়ি কিনতে বেরিয়েছিল। তারপরেই , এই সিন যেটা দেখে গোগোল কেস স্টাডি করছে।
এই সিনে সবচেয়ে দুঃখী হলো কাদা। ভাবছে কপাল সত্যিই খারাপ .. আকাশ রাস্তা কেটে দিলো ! বর্ষা আকাশকে উদুম ঝাড়ছে। বর্ষাকে কাদার সঙ্গে দেখে আকাশ খচে গেলেও কিছু বলতে পারছে না, কারণ সে নিজেই কোনো কুকীর্তির জন্য সিওর খিস্তি খাচ্ছে। এখন মেন প্রশ্ন হলো - কে জিতলো? কে জিতলো সেটা বড় কথা নয় .. বড় কথা হলো কাদা আবার হেরে গেলো। কাদা বর্ষাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে পারলো না .. কাদা বাড়ি ফিরবে একা।
★★★★
অনিরুদ্ধ আর তার পরিবারের বরাবরের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং অনিরুদ্ধর ঊর্ধ্বতন সহকর্মী মিস্টার চক্রবর্তী, সর্বোপরি গোগোলের ফেভারিট সমরেশ আঙ্কেলের চেষ্টায় পড়াশোনার মান সেই অর্থে নিম্ন হলেও রেলপাড়ের হাইকলেজে নিজের পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছিল ছোট্ট গোগোল। "শহরের সেরা কলেজে পড়া এত ভালো পরিবারের একটা ছেলের ছাত্রজীবন বোধহয় এবার নষ্ট হয়ে যাবে .." দুঃখ করে বলা সুজাতার এই কথায়, সমরেশ বাবু একটি ছোট্ট কথা বলেছিলেন - "পাঁকের মধ্যেও পদ্মফুল ফোটার সম্ভাবনা থাকে, এ কথা ভুলো না আর ওকেও ভুলতে দিও না।" সমরেশ বাবু আজ আর নেই, বছর খানেক আগে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেছেন। তবে উনি আজ বেঁচে থাকলে গোগোলের এই সাফল্যে সব থেকে বেশি খুশি হতেন।
যদিও সকালেই রেজাল্ট আউট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোগোলের থেকেও বেশি উৎকণ্ঠায় থাকা এবং অতি উৎসাহী হিয়া ফোন করে খবরটা জেনে নিয়েছিল। বিকেল বেলা কাবেরী আন্টির কোয়ার্টারে এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে এসে আন্টির হাতে দিয়ে "আমি কিছু জানি না, আমাকে বকবে না .. মামণি পাঠিয়েছে .." এই বলে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসলো গোগোল।
"মা .. আমরা একটু উপরে যাবো? আমার সাবজেক্টের কয়েকটা বিষয় একটু আটকে গিয়েছে .. গোগোল দা'র কাছে একটু দেখে নিতাম!" হিয়ার এই প্রশ্নে অন্য সময় হলে হয়তো কাবেরী তাকে নিচের বৈঠকখানা ঘরেই বসতে বলতেন। কিন্তু আজ তার মাথাটা ভীষণ ধরেছে, তার উপর হসপিটালে একটা ঝামেলার জন্য মনটাও ভারাক্রান্ত। তাই "হ্যাঁ, ঠিক আছে যাও .. আমি হরিহর কাকাকে দিয়ে চা পাঠিয়ে দিচ্ছি উপরে .." এই বলে এতো ভালো রেজাল্টের জন্য গোগোলকে আন্তরিকভাবে অনেক আশীর্বাদ করে বৈঠকখানা সংলগ্ন রান্নাঘরে হরিহর কাকাকে ডাকতে ঢুকে গেলেন কাবেরী দেবী।
টোটোয় চেপে কলেজ থেকে ফেরার সময় সকালে দেখা 'এক রাধা, দুই গাধা' কেসটার পুনর্নির্মাণ এবং বিশ্লেষণ তার গোগোল দার মুখে শুনতে শুনতে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল হিয়া। হরিহর কাকা এই সময় চা আর মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই হিয়া বললো "এটা গোগোল'দা কে দাও আর আমার জন্য আরেক কাপ নিয়ে এসো।"
কথাটা শুনেই হরিহর ঝাঁঝালো আপত্তি জানিয়ে বললো "একবারে বলতে পারো না? আবার জল গরম করতে হবে! তাছাড়া তুমি আবার কবে থেকে চা খাওয়া ধরলে? তোমার মা শুনলে কিন্তু খুব রাগ করবে?"
"ওহ্ .. আবার শুরু করলে তুমি? ও যখন খাচ্ছে, তখন আমিও এক কাপ চা খাবো। গোগোল দা তুমি ওমলেট খাবে?" হুকুমের সুরে কথাগুলো বললো হিয়া।
গোগোল চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বড় বড় চোখ করে বললো "তোদের বাড়ির অমলেট? হরিহর কাকা তাহলে এখন রেলপাড়ের বাজারে গিয়ে মুরগি কিনবে, সেই মুরগি ডিম পারবে, তারপর সেই ডিমের অমলেট ভাজা হবে। এসেই এক কাপ গরম চা পেয়ে গেছি, এই আমার ভাগ্যি।"
হরিহর তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো "বাড়িতে ডিম নেই, মামলেট হবে না এখন।"
গোগোল তাই শুনে মাথায় এলিয়ে মুচকি হেসে হিয়ার উদ্দেশ্যে উক্তি করলো "দেখলি তো? আজব বাড়ি তোদের .. সেদিন এসে দেখি সদর দরজা খোলা, নিচে কেউ নেই। তারপর দোতলায় এসে দেখি সেখানেও কেউ নেই, কত ডাকাডাকি করলাম, তাও কারোর সাড়াশব্দ পেলাম না। চোরেরা এসে তোদের সব কিছু চুরি করে নিয়ে যায় না কেন বুঝিনা!
গোগোলের কথা শুনে দাঁত বার করে করে হেসে উঠলো হরিহর। সেই দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে হিয়া বললো "এইবার সত্যি সত্যিই মা'কে বলে ওকে শিমুলপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।"
"এই জানিস তো আজ না কলেজ থেকে ফেরার সময় আমাদের রেলপাড়ের কলেজের বাংলার দিদিমণি বর্ণালী ম্যাডামের সঙ্গে দেখা হলো। উনি খুব খুশি হয়েছেন আমার রেজাল্টে .. আমাকে আশীর্বাদ করলেন।" এক পেয়ালা ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক গিয়ে বললো গোগোল।
- "বর্ণালী ম্যাডাম? ও আচ্ছা মনে পড়েছে তোমাদের কলেজের সেই লিটারেচার সাবজেক্টের টিচার .. তোমার ফেভারিট ছিলেন তো উনি। উনি উইডো শুনেছিলাম না? আর ওনার তো একটা তোমার বয়সী ছেলেও আছে।"
- "না না আমার বয়সী নয়, আমার থেকে বেশ কিছুটা ছোট। ওর নাম অপূর্ব, এবার কলেজে উঠলো .. ফার্স্ট ইয়ার। যাগ্গে, বাদ দে ওদের কথা .. তুই তখন বলছিলিস না তোর কোন সাবজেক্টের যেন কি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে! তাড়াতাড়ি নিয়ে আয় বইটা, আমাকে একটু পরেই বেরোতে হবে।
- "এসেই সব সময় যাই যাই করো কেন গো আজকাল? তাহলে আসার দরকারটা কি? পড়াশোনা তো চলতেই থাকবে, তাই বলে ভালো মুখে দু'দন্ড কোথাও তো বলতে পারো!"
- "আরে তা নয়, আজ সন্ধ্যাটা আমাদের ফেয়ারওয়েল পার্টি কিনা! মানে আমাদের তো একটা গ্রুপ ছিল কলেজে .. তাদের মধ্যে সবকটাই আজ কলেজ জীবনের থেকে মুক্তি পেলো। তাই সবাই মিলে একটা ছোটখাটো গেট-টুগেদার আর কি।"
- "বাবা, এত বন্ধুপ্রীতি তোমার কবে থেকে হলো গো? আমার তো আর তোমার মতো অনেক অনেক বন্ধু নেই। আমার তো একটাই বন্ধু .. আমার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার, গাইড সবকিছুই একজন। আজ আর পড়বো না .. ভালো লাগছে না। ঠিক আছে তুমি যাও .. এনজয় করো, তোমাকে আটকাবো না।"
★★★★
প্রিয় বর্ণালী,
এই কথা তোমাকে সামনাসামনি বলার সাহস আমার কোনোদিনও হবে না তাই লিখে জানাচ্ছি। কাজের চাপে যখন প্রতিদিন বাড়ি ফিরতে দেরি হয় আর তুমি আমার জন্য জেগে বসে থাকো, তখন তোমার ওই রাগী রাগী মুখটা কিন্তু আমি বেশ এনজয় করি। আসলে তোমাকে রাগলে এত সুন্দর লাগে, যা লিখে ব্যক্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ইচ্ছে করে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তুমি তো জানো আমি কতটা আনরোমান্টিক। প্রথমদিকে লেখাপড়া আর পরবর্তীতে নিজের চাকরি নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি চিরকাল।
প্রায় সব নারীকেই হয়তো রাগলে বেশ লাগে। বাকিদের কথা আমার জানা নেই। তবে তোমার সম্পর্কে যেহেতু আমি ওয়াকিবহাল, তাই রাগলে তোমাকে এত সুন্দর লাগে যা বলে বোঝানো যাবেনা। ইচ্ছে করে প্রতিদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু কোথায় যেন একটা সঙ্কোচবোধ কাজ করে। আচ্ছা একই কথা বারবার লিখে ফেলছি তাই না? কি করবো বলো .. বহুদিন লেখার অভ্যাস চলে গিয়েছে। তার উপরে চিঠি .. সেতো সেই ছোটবেলায় বিজয় দশমীতে আত্মীয়দের প্রণাম জানানোর সময় লিখতাম, থাক সে কথা।
এবার একটা সত্যি কথা বলি? আসলে রোজ না হলেও মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছে করে দেরি করে বাড়ি ফিরি, কেন জানো? শুধুমাত্র তোমার গম্ভীর মুখখানা দেখার জন্য। যে গম্ভীর মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে অদেখা অজস্র ভালবাসা। খুব ভালবাসি তোমায়, তাই নিজের মনের মধ্যেই লুকিয়ে রাখি আমার ভালবাসা। আমি তো অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠি, ভোরের সূর্য তোমাকে দেখার আগে, আমি দেখি। আলো আমার ভালো লাগেনা আজকাল .. সারাক্ষণ তোমাকে দেখে। কিন্তু কি করবো বলো .. আলো ছাড়া তোমাকে দেখা যায়না। তাই তো আমি সর্বদা আলোর কাছে মাথা নত করি .. ঠিক যেমন তোমার কাছে।
বাদ দাও এসব কথা। গতকাল তোমার জন্য যে শাড়িটা এনে টেবিলে রেখেছিলাম .. কিন্তু তোমার হাতে আর দেওয়া হয়নি। এখন এই চিঠিটা পড়লে হয়তো শাড়িটা একবার দেখবে আবার নাও দেখতে পারো। শাড়িটা যে তোমার পছন্দ হবে না আমি এও জানি .. না হওয়ারই কথা। আসলে কি জানো, আমি তো কখনো একা শাড়ি কিনিনি। মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে গেলে মা'কে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। কখনো নিজের পছন্দে শাড়ি কিনতে শিখিইনি। হয়তো তোমার পছন্দ মতো শাড়ি কিনতে পারিনি, তাই তোমার কাছে না দিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছি। তবে কথা দিলাম, তোমাকে একদিন সম্পূর্ণরূপে চেনা হয়ে যাবে। তোমার পছন্দ অপছন্দের তালিকাও আমার হবে। সেদিন তোমার পছন্দ আর আমার পছন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে।
ইতি উৎপল।
চিঠিটা পড়তে পড়তে মুখের কোণায় হাসি ফুটে উঠেছিল বর্ণালীর। তার সঙ্গে বেশ অবাকও হয়েছে উৎপলের এই চিঠিটা পড়ে। যে মানুষটা তার সামনে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে ভালোভাবে দু'দণ্ড কথা বলতে পারে না। সেও মনের কোণে বউয়ের জন্য ভালবাসা লুকিয়ে রাখে। বর্ণালীর স্বপ্ন ছিলো তার একজন সুদর্শন এবং রোমান্টিক বর হবে। আর উৎপল! যার ভিতরে মন বলতে আদৌ কোনো বস্তু আছে, তা এতদিন জানা ছিল না বর্ণালীর। কিন্তু এখন উপলব্ধি করতে পারছে রোমান্টিকতার সমুদ্র আছে উৎপলের ভিতরে। বর্ণালীও অবশ্য উৎপলকে খুব ভালোবাসে, কিন্তু প্রকাশ করেনা। চিঠিটা পড়ে তার স্বামীর দেওয়া শাড়িটা দেখার খুব ইচ্ছে হলো বর্ণালীর।
সেদিন দেরি করেনি উৎপল, সন্ধের কিছু আগেই বাড়ি ফিরেছিল। বর্ণালী তাড়াতাড়ি করে গিয়ে দরজা খুললো। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে উৎপল একপ্রকার মুগ্ধ হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও একবার ভাবলো, তাহলে কি সে ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছে! পরমুহূর্তেই অনুধাবন করলো তার সামনে তারই দেওয়া উপহারের শাড়িটা পড়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্ণালী। তারপর কিছু একটা ভেবে 'যেন কিছুই হয়নি' এরকম একটা ভাব দেখিয়ে তার স্ত্রীকে উপেক্ষা করে ভিতরে ঢুকে গেলো উৎপল।
রাতের খাবারের পর বিছানায় শুয়ে ছিলো উৎপল। বেডরুমের দরজা বন্ধের শব্দ পেলো। তার মানে তার স্ত্রী এসেছে। বর্ণালী ভিতর এসে আয়নার সামনে বসে আছে চুপটি করে। আর বারবার আয়নায় নিজেকে দেখছে .. কোথাও কোনো কমতি হলো নাকি!
বিকাল থেকে কাজ শেষ করে নিজের মনের মতো সেজেছে বর্ণালী। উৎপলের উপহারের শাড়িটাও সে পরেছে .. শুধু মাত্র তার স্বামীর জন্য। আর সেই উৎপল একবার ফিরেও তাকালো না তার দিকে! বর্ণালীর বড্ড রাগ হলো, বলা ভালো অভিমান হলো। মাথা নিচু করে বসে রইলো সে .. দু চোখের কোণা ভিজে চিকচিক করতে লাগলো।
এদিকে আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারছিলো না উৎপল। বর্ণালী যেন তাকে চুম্বকের মতো টানছে। ধীর পায়ে উৎপল তার স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বর্ণালী বুঝতেই পারেনি তার পিছনে কেউ আছে। উৎপলের খুব ইচ্ছে করছিল তার প্রিয়তমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু আবার সেই একটা অজানা সঙ্কোচ .. যার কারণ কোনদিনও উপলব্ধি করতে পারেনি সে। তবুও সেই মুহূর্তে সকল বাধা অতিক্রম করে বর্ণালীকে জড়িয়ে ধরলো উৎপল।
চমকে উঠলো বর্ণালী, তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দেখে উৎপল তাকে জড়িয়ে আছে। বেশ অবাক হলো বর্ণালী .. আর সেই মুহূর্তে তার মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা ভালবাসাটা বিকশিত হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। আসলে রাগ, অভিমান লুকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু ভালবাসা লুকিয়ে রাখা যায় না। ভালবাসা প্রতিনিয়ত নতুন করে, নতুন রূপে প্রকাশ পায়। উৎপল বর্ণালীকে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে তার সমস্ত শরীরে ক্রমাগত চুম্বন করতে শুরু করলো। বর্ণালীও তার স্বামীর আদরের প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করলো। অতঃপর ঘরের আলো নিভলো এবং উভয়ে ভালোবাসার চরম ক্রিয়ায় লিপ্ত হলো।
কলিংবেলের শব্দে ঘোর কাটলো বর্ণালীর। অপূর্ব ফিরলো বোধহয় কলেজ থেকে। স্মৃতির অতল থেকে বর্তমানে ফিরে এসে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলতে গেলো।
অপূর্ব সবে আঠারো পেরোলো গত এপ্রিলে, কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। তার শরীরে পুরুষালী রাফ এন্ড টাফ ব্যাপারটা একেবারেই নেই, সেটা যদিও সবার ক্ষেত্রে হয় না। কিন্তু যেটা সবথেকে লক্ষণীয় তার শরীরটা যেন অনেকটা মেয়েলী ছাঁচে গড়া। উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির কাছাকাছি। গায়ের রঙ বেশ ফর্সা বলা চলে। ছিপছিপে শরীর, এই বয়সেও অন্যান্য ছেলেদের মত গায়ে কোনোরকম লোম এমন কি মুখে দাড়ি-গোঁফের লেশমাত্র নেই।
যেটা অন্য পুরুষের ক্ষেত্রে স্বভাবতই ভীষণ লজ্জাকর ব্যাপার, জামা খুললে অপূর্বর ফর্সা, ছিপছিপে শরীরে যেটা সবার আগে চোখে পরতো, তা হলো ওর কিছুটা অস্বাভাবিক আকারের দুটো বুক। যা ছেলেদের মতো একেবারেই চ্যাপ্টা এবং পেশীবহুল ছিলো না। বরং, মেয়েদের মতো দুটো বুকই বেশ খানিকটা খাড়া। আর বাদামী রঙের বোঁটা দুটোও ছেলেদের তুলনায় বেশ বড় আকারের। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে যখন অপূর্ব পাশ ফিরে তাকাতো তখন কতকটা সদ্য মাই গজানো কিশোরীদের মতো খাড়া, ছুঁচলো দেখাতো তার বুক দুটোকে। তাই যখন ধীরে ধীরে সে বড় হলো, তখন জনসমক্ষে লজ্জায় গায়ের জামা খুলতো না অপূর্ব। এই বয়সে যেটা স্বাভাবিক, অর্থাৎ পুরুষাঙ্গের আকার বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু আঠারো বছরের অপূর্বের পুরুষাঙ্গ আদৌ সেই অনুপাতে বাড়েনি .. লম্বায় বড়জোর তিন থেকে সাড়ে তিন ইঞ্চি হবে, তার সঙ্গে অসম্ভব সরু।
জ্যাকি দা'র সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে তার বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ শারীরিক গঠন নিয়ে সর্বদা হীনমন্যতায় ভুগতো অপূর্ব। সব সময় কুঁকড়ে থাকতো ঠাট্টা তামাশা শিকার হওয়ার ভয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে। জ্যাকির সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয় গঙ্গানগরের একটি খাদ্যমেলায়। ওকে দেখে জ্যাকিই প্রথম আলাপ করতে আসে তার সঙ্গে। ছেলেটা নেপালি হলেও খুব সুন্দর বাংলা বলতে পারে। আলাপ থেকে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। ওর কাছ থেকেই অপূর্ব শিখেছে মানুষের শরীর ঈশ্বরের দান .. তা নিয়ে কখনো হীনমন্যতায় ভুগতে নেই। জ্যাকিই এখন তার একমাত্র বন্ধু .. সুখে দুঃখে ওর পাশে থেকেছে, তাই তার কথা ফেলতে পারে না অপূর্ব। জ্যাকি দা বলেছে আজ তাকে একজন নতুন লোকের সঙ্গে আলাপ করাবে, তার জন্য তাকে একটা জায়গায় যেতে হবে। আজ জীবনে প্রথমবার তার মা'কে টিউশনির নামে মিথ্যে বলে অন্য জায়গায় যাবে সে। সাজগোজ করতে বরাবরই ভালবাসে অপূর্ব .. কলেজ থেকে ফিরে মায়ের হাতের বানানো টিফিন খেয়ে তাড়াতাড়ি করে রেডি হতে বাথরুমে ঢুকলো সে।
(ক্রমশ)
ভালো লাগলে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন
লাইক এবং রেপু দিয়ে উৎসাহিত করবেন