Thread Rating:
  • 159 Vote(s) - 3.41 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
WRITER'S SPECIAL গোলকধাঁধায় গোগোল (সমাপ্ত)
[Image: Polish-20220813-192930701.jpg]

(৭)

"আজকে তাড়াতাড়ি চলে এলে মামণি? বললে তোমার বি-শিফ্ট ডিউটি আছে, ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে! আমি তো আজকে ঠিক করেই নিয়েছিলাম, আমি একা একা আর ঘুমাবো না .. না হলে যদি আবার ওইসব .. তুমি চলে এসেছো ভালোই হয়েছে। সাড়ে ন'টা বেজে গিয়েছে আর ভালো লাগছে না পড়তে। আমার না খুব খিদে পেয়েছে, তোমারও নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে দাও না মামনি .." বই থেকে মুখ তুলে সুজাতার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললো গোগোল।

"এই তো সোনা .. একটু দাঁড়া, আমি তাড়াতাড়ি করে গা হাত পা ধুয়ে এসে খেতে দিচ্ছি। আজ তো তোর ফেভারিট আলু-পোস্ত হয়েছে।" এই বলে ঘর সংলগ্ন বাথরুমে ঢুকে গেলো সুজাতা। মিনিট পনেরো পর বেরিয়ে এসে খাবার বেড়ে নিয়ে খেতে বসলো দু'জনে। তার মাতৃদেবীর হাতের অমৃতসম রান্নার স্বাদ সে হয়তো আর কোনোদিন পাবে না, কিন্তু সুজাতার রান্নার হাতটিও বেশ ভালো এবং সর্বোপরি তার মামণির হাতের প্রায় সব রান্নাই ধীরে ধীরে গোগোলের প্রিয় হয়ে উঠেছে।

"কি হয়েছে মামণি? তোমার মুখটা এরকম দেখাচ্ছে .. হসপিটালে কোনো ঝামেলা হয়নি তো?" সুজাতার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো গোগোল।

- "কিছু না সোনা, সারাদিনের পরিশ্রমের পর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, তাই হয়তো .."

- "মোটেও না .. হ্যাঁ মানে টায়ার্ড ফিল তো অবশ্যই হবে .. কিন্তু এটা ছাড়াও কিছু একটা হয়েছে, প্লিজ বলো মামনি আমাকে .."

- "তুই এখনো অনেক ছোটো, অর্ধেক কথাই বুঝিস না। জানিনা তোকে কথাগুলো বলা ঠিক হবে কিনা। কাজের বাইরে আমার তো সেই অর্থে কোনো বন্ধু বা কথা বলার সঙ্গী নেই। তুই আমার বন্ধু, তুই আমার সঙ্গী, তুই আমার সব .. তাই তোকেই বলছি, এতে যদি আমার মনের ভার একটু হলেও কমে। স্বপ্না দাসের কথা মনে আছে তো তোর .. আমাদের হসপিটালের অর্থপেডিক ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র নার্স .. অনিরুদ্ধ দা'র মৃত্যুর তদন্তের জন্য ইন্সপেক্টর গোস্বামী যাকে ইন্টারোগেট করছিল বারবার। এবার বুঝতে পারলি তো কার কথা বলছি? সেই মহিলা আজ বিকেলের দিকে নিজের বাড়িতে রহস্যজনকভাবে খুন হয়েছে। কেউ বা কারা ওই মহিলাকে তার বাড়ির দরজার সামনে মাথায় ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছে। কিন্তু যেটা সবথেকে বেশি আশঙ্কার এবং চিন্তার বিষয় .. আশ্চর্যজনক ভাবে বিকেলের পর থেকে স্বপ্না দি'র মেয়েকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হসপিটালে পুলিশ এসেছিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। কারণ উনি তো হসপিটালেরই স্টাফ এবং আজকেও উনার ডিউটি ছিলো। পুলিশের ধারণা যারা স্বপ্না'দি কে খুন করেছে তারাই হয়তো ওনার মেয়েকে নিয়ে বেপাত্তা হয়ে গেছে অথবা এই খুনের পেছনে হয়তো ওর মেয়ের হাত আছে। আমাদের সুপারিনটেনডেন্ট ডক্টর দাসগুপ্ত ভীষণরকম ভাবে ভেঙে পড়েছে। আমাকে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিলেন, বললেন -  দিনকাল ভালো নয়।"

সুজাতার মুখে কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকলো গোগোল।  "জানো তো মামনি, আমার মা বলতো - অন্যায় যারা করে ভগবান একদিন না একদিন তাদের ঠিক শাস্তি দেয়। হাজার চেষ্টা করেও পুলিশ আঙ্কেল তো কিছু করতে পারছিলো না, তাই হয়তো অন্যভাবেই .." কথা শেষ করার আগেই মাঝপথে কান্নায় গলার স্বর আটকে গেলো তার।

একটা বছর বারোর ছেলে .. যার এখন জীবনটা হেসে খেলে কাটানোর কথা, চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ভবিষ্যতের ভিত্তিস্থাপন করার কথা .. তার ভেতরে কতটা দুঃখ, কতটা কষ্ট এবং তার সঙ্গে কিছুটা হলেও প্রতিহিংসা জমে আছে গোগোলের অসম্পূর্ণ কথায় তা অনুধাবন করতে পারলো সুজাতা। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো "বুঝি সোনা .. আমি তোর সব কষ্ট, সব বেদনা বুঝতে পারি। কিন্তু তোর মা বেঁচে থাকলে আমি জানি এটাও নিশ্চয়ই বলতো - অন্য কেউ অন্যায় করলে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য সেই একই পথ বেছে নিলে ওই ব্যক্তির সঙ্গে নিজের তফাৎ থাকে না। শান্ত হও গোগোল সোনা, শান্ত হও। তোমাকে অনেক বড় হতে হবে, মানুষের মতো মানুষ হতে হবে, বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে তো!"

খেতে খেতে আর বিশেষ কথা হলো না দু'জনের। খেয়ে উঠে বিছানা করে শোওয়ার পর মাথায় অনেক চিন্তা কিলবিল করলেও শারীরিকভাবে অসম্ভব ক্লান্ত থাকার দরুন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো সুজাতা। অন্যান্য দিনের মতো তার মামনিকে জড়িয়ে ধরে তার শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ নিয়েও ঘুম আসছিলো না গোগোলের।

রাত তখন ক'টা খেয়াল নেই। দূর থেকে বেশ কিছু মানুষের কথা শুনতে পেলো গোগোল। সবাই কথা বলছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। কি ব্যাপার? ওহ্ এটাতো স্বপ্ন .. সে মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব! সে তো স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে - সে রাস্তা পার হচ্ছিলো। বলা নেই, কওয়া নেই, কোথা দিয়ে গঙ্গানগর থেকে হাইওয়ে যাওয়ার একটি বাস প্রায় তার উপর উঠে যাচ্ছিল। তার কি অ্যাক্সিডেন্ট হলো! সে কি আর? শরীরটা খুবই দূর্বল লাগছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে .. ওহ্ তাহলে নিশ্চয়ই সে স্বপ্ন দেখছে। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো গোগোলের। এবার কিছু মানুষ তার কাছাকাছি এসে কথা বলছে। অথচ কারো কথাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তাকে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া করছে। ওহ্ তাহলে কি তাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হচ্ছে? কিন্তু বাড়িতে খবর দিতে হবে তো। মামনি .. মামনি চিন্তা করবে যে! আবছা ভাবে চোখ খোলার চেষ্টা করলো গোগোল। অবাক কান্ড, কিছুতেই চোখ খুলতে পারলো না সে। ভীষণ দূর্বল লাগছে .. এটা নির্ঘাত স্বপ্ন। আবার চেতনা ফিরে এলো গোগোলের। তার বর্তমান উপস্থিতি সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। মনে হচ্ছে কোনো হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে। তাকে নিয়ে আবার টানা-হ্যাঁচড়া শুরু হলো। এবার সে বেশ বুঝতে পারলো তাকে স্ট্রেচার সহ ঠেলে দ্রুত কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনেক মানুষের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ধীরে ধীরে শব্দ ক্ষীন হতে শুরু করলো। সে বেশ বুঝতে পারছে কোনো নির্জন একটা ঘরে নিয়ে রাখা হলো তাকে। হঠাৎ কেউ একজন তার খুব কাছে এলো। তার হাতের কব্জি ধরে রাখলো। মনে হয় পালস্ মাপছে। হঠাৎ তার বাঁ চোখের পাতা আঙুল দিয়ে খুলে ধরলো এবং ক্ষণিকের জন্য তীব্র আলোর ঝলকানি অনুভব করল সে। “বেঁচে নেই .. পরিচয় জানা গেছে? মর্গে রাখুন ..” চমকে ওঠে গোগোল। চিৎকার করে উঠে বসতে গেলো সে .. কিন্তু একচুলও নড়তে পারলো না। মনে হচ্ছে যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে .. স্বপ্নই তো? হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো গোগোলের। ওহ্ কি ভয়ঙ্কর, কি দুর্বিষহ, কি মর্মান্তিক .. এই ধরনের স্বপ্ন দেখার বয়স কি আদৌ হয়েছে তার! ক'টা বাজে এখন? কিরকম যেন একটা খিদে খিদে পাচ্ছে। অভ্যাস মতো বালিশ থেকে মাথাটা তুলতে গেলো সে। কিন্তু এ কি .. সে তো বালিশের উপর শুয়ে নেই। একফোঁটা আলো নেই কোথাও। কখনো ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখেছে গভীর রাতেও তো বিছানায় খুব আবছা ভাবে আলো আসে পাশের  রাস্তা থেকে। কিন্তু আজ কোনো আলো নেই কেন? নিজেকে হঠাৎ সম্পূর্ণ নগ্ন মনে হলো গোগোলের। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়ে চারপাশে হাতড়াতে শুরু করলো। মনে হলো তাকে যেন একটা শক্ত বেদীর উপর শোয়ানো হয়েছে। চারপাশ থেকে কিরকম যেন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে আসছে তার। 'ওঠো অনির্বাণ ওঠো .. আর কতোদিন এইভাবে শুয়ে থাকবে ..' পাশ কেউ যেন বলে উঠলো কথাটা। এই মুহূর্তে একটা অবধারিত ভাবনা উঁকি দিচ্ছে মাথায়, কিন্তু আর কিছু ভাবার সাহস হলো না গোগোলের। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেললে সে।

★★★★

গঙ্গানগর মিউনিসিপাল হসপিটালের সিনিয়র নার্স স্বপ্না দাসের মৃত্যুর পর পুলিশ বিভাগ বেশ তৎপরতার সঙ্গে কিছুদিন তদন্ত প্রক্রিয়া চালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কানাঘুষো শোনা যায় শাসকদলের কোনো এক প্রভাবশালী ব্যক্তির হস্তক্ষেপে কয়েকদিনের মধ্যেই সবকিছু ধামাচাপা পরে যায়। নিষ্পাপ, নির্দোষ, নির্লোভ, সতীলক্ষ্মী হয়তো ছিলো না স্বপ্ন দেবী। কিন্তু যে কোনো হত্যার ন্যায্য বিচার পাওয়ার অধিকার তো চিরন্তন সত্য। দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর অতিক্রান্ত হতে লাগলো .. আগের তিনটি অর্থাৎ অরুন্ধতী, অনিরুদ্ধ এবং লতিকা দেবীর মতো এই মৃত্যু রহস্যেরও কোনো কিনারা করতে পারলো না পুলিশ।

সময়ের মূল্য দিতে পারলে এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই করা সম্ভব। সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। যে সময় চলে যায় সেই সময়কে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। তাই সময়ের মূল্যায়ন করে তার প্রকৃত সদ্ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। সময় হলো জীবনের সর্বাধিক মূল্যবান মুদ্রা। এই মুদ্রাটি কীভাবে ব্যয় করা হবে এই বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে যদি অপরকে নির্ধারণ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই সময়ের গোলকধাঁধায় চিরজীবনের মতো আটকা পড়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে হয়।

প্রথম উক্তিটি যদি গঙ্গানগরের পুলিশ বিভাগ তথা প্রশাসনের জন্য হয়, তাহলে দ্বিতীয়টি অবশ্যই হতভাগিনী মৌমিতার জন্য যথাযথ। গুরুকুলের প্রধান শিক্ষক বলা ভালো নিশীথ এন্ড কোং তার জীবনে আসার পর থেকে সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে মৌমিতার জীবন। অভিভাবকের ছত্রছায়ায় বাড়িতে বসে লুকিয়ে চুরিয়ে মোবাইলে অথবা ল্যাপটপে উত্তেজক নীল ছবি দেখে নিজের মনকে অপবিত্র করে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য স্নানঘরে গিয়ে নিজেকে শান্ত করা এক জিনিস। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বাসস্থান হীন, অভিভাবক শূন্য কোনো তরুণী যদি ওই নীল ছবিগুলোতে অভিনয় করা সেই দুর্বৃত্তদের মতো কোনো ব্যক্তির কবলে পড়ে, তাহলে মনের সাথে সাথে তার শরীরটাও সম্পূর্ণরূপে অপবিত্র হতে বেশি সময় লাগে না এবং জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ।

সেই মর্মান্তিক ঘটনার দিন বাকিদের উপস্থিতির যেহেতু কোনো সাক্ষী ছিলো না, তাই তার মায়ের মৃত্যুর জন্য পুলিশের সন্দেহের তালিকায় একদম প্রথম নামটা তার মেয়ে মৌমিতার - এই কথা খবর মারফত বারংবার জানার পর ক্রমশ ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল মৌমিতা। অল্প বয়সী, ভীতু এবং মস্তিষ্কের সেভাবে বিকাশ না ঘটা তরুণীটির পুলিশের কাছে গিয়ে সেই দিনকার সব সত্যি ঘটনা ব্যক্ত করা এবং নিজের মাতৃদেবীর জন্য শোকাহত হওয়ার চেয়ে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদটাই তার মধ্যে সবথেকে বেশি প্রকাশ পেয়েছিল। ফলস্বরূপ মা'কে কেড়ে নিয়ে তার জীবনের এত বড় ক্ষতি যারা করলো, সাময়িকভাবে বাঁচার জন্য তাদেরকেই আঁকড়ে ধরতে বাধ্য হলো মৌমিতা। দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে .. কিছু পেতে গেলে তো কিছু দিতেই হয় .. এ কথা তো ধ্রুব সত্য‌। তাই এই ক'টা বছরে কখনো বিধায়ক মশাইয়ের বাগানবাড়িতে, কখনো বা কামরাজের আউট হাউসে, আবার কখনো নিশীথ বাবুর ফাঁকা ফ্ল্যাটে মৌমিতার মাখনের মতো তরুণী শরীরটাকে চেটে চুষে কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে ওই তিন দুর্বৃত্ত।

শুধু এখানেই থেমে থাকেনি মৌমিতার জীবন। সময় এবং পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে মনের পরিবর্তন ঘটে মানুষের। আগের থেকে মৌমিতা এখন অনেক বেপরোয়া। একদা ভীতু, গো-বেচারা, শান্তশিষ্ট, সরল মনের মেয়েটা আজ শরীরবিলাসিনী .. যে নিজের ইচ্ছেতেই হয়তো অচেনা আগন্তুকদের নিজের দেহসুধা ভোগ করতে দেয় যত্রতত্র। সেই আগন্তুকের পাপিষ্ঠ হাত কখনো টিপে, কচলে, দুইয়ে দেয় তার ভারী অথচ নরম স্তনযুগল। নিজের কর্তব্যে অবিচল থেকে বাজারের সস্তা মেয়েমানুষের মতো মৌমিতাও পালা করে তাদের পুরুষাঙ্গ অবলীলায় নিজের যৌনাঙ্গের ভেতরে নিয়ে শান্ত করে ক্ষুধার্ত হায়নাগুলোকে। বর্তমান এবং আগামীদিনের সকাল চিরতরে পরিবর্তন এনেছে মৌমিতার জীবনে। ওর জীবন এখন আবর্তিত হয়ে চলেছে বহুবিধ চাহিদার চক্রে। এরই মাঝে একবার নয় বেশ কয়েকবার মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছে মৌমিতা। কিন্তু সেই বিষয়টার উপর নির্ভর করেই বিধায়ক মানিক সামন্ত এক ভয়ানক এবং বেআইনি ব্যবসা শুরু করেছে .. যা ক্রমশ প্রকাশ্য।

★★★★

অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং সত্যি কথা বলতে গেলে সম্পূর্ণ একটি অন্য পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে  সিটি হসপিটালের মেডিসিন বিভাগের সম্মানের পার্মানেন্ট চাকরি খুইয়ে এখন সুজাতা একজন কন্ট্রাক্চুয়াল অ্যাটেনডেন্টের চাকরি করছিলো এতদিন। তবে তার কাজের প্রতি নিষ্ঠা, তৎপরতা এবং অবশ্যই কিছু অবাক করে দেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত তাকে অল্পদিনের মধ্যেই হসপিটালে সুপারেনটেনডেন্ট ডক্টর দাশগুপ্তের নেক নজরে এনে ফেলেছিল। কিন্তু এখানে মানিক সামন্তর প্রবল হস্তক্ষেপ এবং বিরোধিতা থাকার জন্য হসপিটাল কর্তৃপক্ষ কিছুই করে উঠতে পারেনি সুজাতার জন্য এই ক'বছরে। কিন্তু স্বপ্না দাসের কেসটার পরেই কয়েকদিনের জন্য হলেও কিছুটা নিভৃতে চলে যায় থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। তাই এই কয়েক বছরের ব্যবধানে শত খারাপের মধ্যেও সুজাতার জন্য সামান্য হলেও ভালো কিছু হয়েছে। পার্মানেন্ট করা হয়েছে তাকে এবং সর্বোপরি মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র নার্স হয়েছে সে।

শূন্যস্থান পূরণ হতে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয় মিউনিসিপাল হসপিটালের কর্তৃপক্ষকে। তদন্ত চলাকালীন মাঝে বছর তিনেক কন্ট্রাকচুয়াল বিভাগের কর্মীদের দিয়ে কাজ চালাতে হয়েছিল। অতঃপর তিন বছরের মাথায় পাকাপাকিভাবে অর্থপেডিক ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র নার্স স্বপ্না দাসের জায়গায় কাবেরী বলে একজন অ্যাপয়েন্টেড হলো। ওর সঙ্গে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সুজাতার। যদিও এর পেছনে অবশ্য একটা কারণ আছে। দু'জনে একসঙ্গে সিটি হসপিটালে নার্সিং ট্রেনিং নিয়েছিলো। দুই সহকর্মীর অনেকদিন পর দেখা হওয়াতে একটা গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। পরিবার বলতে একমাত্র মেয়ে হিয়া ছাড়া বিবাহবিচ্ছিন্না কাবেরীর বর্তমানে আর কেউ নেই। মিউনিসিপাল হসপিটালের কোয়ার্টারেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ওদের।

গোগোল সেবার মাধ্যমিক দেবে .. গঙ্গানগর মিউনিসিপাল হসপিটাল কোয়ার্টারের পাশেই গোগোলদের কলেজ। সেখানেই হিয়ার সাথে প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল গোগোলের, হাজারও চোখ এড়িয়ে, পরস্পরের চোখেতে চোখ রেখেছিল তারা। ভিড়ের মাঝে আড়াল খুঁজে কল্পনার রঙিন স্রোতে যেন ভেসে গিয়েছিল দু'জনে। গোগোলের কাছে সকাল তখন শুধুই সুনীল, বিকেল পলাশ রাঙা, সন্ধ্যে গগন তারায় ভরা, আর রাত্রি? সে তো পরীদের দেশ .. ঠিক যেন হিয়ার মতো পরী। আজও মনে পড়ে তার চোখে হিয়ার ভেসে যাওয়া। মুগ্ধ তার নয়নজোড়া স্তব্ধ, যেন বাক্যহারা। তারপর তিন তিনটে বছর কেটে গিয়েছে।

যদি লক্ষ্য স্থির থাকে, তবে সময়ের সাথে সাথে মানুষ অনেক পরিণত হয়ে ওঠে। তার মনের চঞ্চলতা হ্রাস পেয়ে সেখানে স্থান করে নেয় ধৈর্য আর উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা। ঊনিশ বছরের গোগোল আজ অনেক ধৈর্যশীল এবং পরিণত। মাঝের এই সাতটা বছরে অনেক কিছুর অভিজ্ঞতা হয়েছে তার।
বৈশাখী ঝড়ের রাক্ষুসে দাপট দেখেছে সে, গনগনে আলোয় তেজদীপ্ত সূর্য দেখেছে। আবার বসন্তে - ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় সবুজ ফসলে বিস্তীর্ন মাঠের অপরূপ শোভা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তার। কালো মেঘহীন অসীম নীলাকাশ দেখেছে, সাদা পাখনায় ভর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে বলাকাদের উড়তে দেখেছে। দুর্বৃত্ত শিকারীর গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে মুখ থুবরে ওদের ডানা ঝাপটাতে দেখেছে .. ফোঁটা ফোঁটা রক্তে সবুজ ঘাস রঞ্জিত হতে দেখেছে। পিতৃমাতৃহীন সন্তানের বেদনা যেমন আত্মস্থ করেছে ঠিক সেই ভাবেই  অনেক মাকে তাদের সন্তানদের যুদ্ধের সাজে সাজিয়ে দিতে দেখেছে। আবার যুদ্ধ শেষে অনেক মায়ের চোখে অশ্রুর বন্যা বইতে দেখেছে। তার মাতৃদেবীর কাজলকালো যে চোখে অন্তহীন ভালবাসার, মমতার আর মাতৃত্বের ছাপ দেখেছে, সে চোখেই আবার দেখেছে প্রচন্ড ঘৃনা, ক্রোধ আর ভয়। তার মনে পড়ে এখনো মায়ের বুকে হিংস্র পশুর ধারালো নখের দাগ। দৃশ্যটা মনে পড়লেই এখনও সে আয়নার সামনে নিজের চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারে না। তাকালেই নাকে বারুদের গন্ধ আসে, বুকে প্রবল ঝড় ওঠে, চোখে গনগনে আগুন জ্বলে ঘৃনার, ক্রোধের, প্রতিশোধের।

সাত বছর পর‌ গুরুকুল বিদ্যামন্দিরে পদার্পণ ঘটলো গোগোলের। প্রধান ফটক পেরিয়ে যখন কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর প্রবেশ করলো, তখন স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেল সে। শিক্ষা জীবনের অল্প কিছু সময় মাত্র ছয় বছর গুরুকুলে কাটালেও এখনো মন পরে আছে এই কলেজের আঙিনায়। ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে আসা ধূসর স্মৃতিগুলো বারবার কড়া নাড়ে মনের দুয়ারে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই সোনালি দিনগুলোতে। ফিকে হয়ে আসা স্মৃতিগুলো উদ্ভাসিত হয় স্বর্ণদীপ্তিতে।

অট্টালিকা সমান ভবনে শুরু হওয়া কলেজ প্রাণ ফিরে পায় একঝাঁক কিশোরের দৃপ্ত পদচারণায়। সেই হলুদ রঙ করা দেয়াল, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ক্লাসরুম, সবুজ ঘাসের মাঠ আজও বুকে জাগায় শিহরণ। কলেজ শুরুর ঠিক আগে আগে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই প্রিয়মুখ একঝলক দেখবে বলে .. প্রিয় বন্ধু সন্দীপের  অনেকদিন কোন খবর পায়নি গোগোল। যার সাথে বসবে বলে বই দিয়ে জায়গা দখল, ক্লাসের ফাঁকে কাটাকুটি খেলা কিংবা নড়বড়ে করিডোরে দাঁড়িয়ে গল্প করা, স্যারের বকুনি এড়াতে ছোট করে চুল কাটা, টিফিন পিরিয়ডে সারা মাঠ ছুটোছুটি করে হাঁপিয়ে গিয়ে বাড়ি থেকে হাজারবার বারণ করে দেওয়া সত্ত্বেও দেয়ালে লাগানো জলের কলে মুখ লাগিয়ে পিপাসা মেটানো .. আরো কত কি।

পুরনো স্মৃতির সরণীতে বিচরণ করতে করতে মনটা প্রশান্ত হয়ে গিয়েছিলো গোগোলের। তারপর যখন কোকেন পাচারের বদনাম মাথায় নিয়ে এই কলেজে তার শেষ দিনের কথা মনে পড়লো, তখন বুকে আবার তার প্রবল ঝড় উঠলো, দপ করে জ্বলে উঠলো চোখ দুটো। কলেজ ছুটি হয়ে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। বিদ্যার্থীরা সবাই ততক্ষণে চলে গিয়েছে। শিক্ষকরাও আস্তে আস্তে যেতে শুরু করেছে। দোতালায় হেডস্যারের কেবিনে তখনো আলো জ্বলছে।

"কে ভাই তুমি?" তার কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়ানো একজন প্রায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির কাছাকাছি লম্বা, গায়ের রঙ অত্যধিক ফর্সা, মাথায় কোঁকড়ানো ঘন কেশ বিশিষ্ট, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি যুক্ত, কটা চোখের অধিকারী, একহারা চেহারার, সুদর্শন এক তরুণের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো গুরুকুলের প্রধানশিক্ষক নিশীথ বটব্যাল।

"এ কি স্যার .. চিনতে পারছেন না আমাকে? আমি আপনার কলেজের ছাত্র, সরি প্রাক্তন ছাত্র অনির্বাণ। ওই যে একদিন আপনার নিজের গাড়ি করে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন .. মনে পড়েছে? ভিতরে আসতে পারি?" দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে প্রশ্ন করলো গোগোল।

কয়েক মুহূর্ত ক্রূর দৃষ্টিতে তার দরজার সামনে দাঁড়ানো তরুণটিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক সুরে নিশীধ বাবু বলতে শুরু করলো "তুমি দেশের কোন মুখটা উজ্জ্বল করেছ শুনি, যে তোমাকে দেখলেই চিনে ফেলতে হবে? তবে তোমার কথাগুলো শুনে এইবার মনে পড়েছে। তুমিই তো সেই দুশ্চরিত্র অনিরুদ্ধ মুখার্জির ছেলে, যার সঙ্গে ওদের অফিসের এক মহিলার অবৈধ সম্পর্ক ছিলো। তোমার মাও তো খুব একটা সুবিধার মহিলা ছিলেন না বলে শুনেছি। কি আর করবে বলো .. নিজের স্বামীকে যখন দেখছে বাইরে অন্য মহিলা নিয়ে ফুর্তি করছে, তখন সেও হয়তো বেশ কয়েকটা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। তারই ফলস্বরূপ মরতে হয়েছে তাকে। তবে জানো তো আমাদের সবার মধ্যেই একটা জিনঘটিত ব্যাপার থাকে। সেই হিসেবেই তোমার গুণধর বাবা-মায়ের একেবারে যোগ্য সন্তান তুমি। কোকেন পাচারের কেসে তোমাকে কলেজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল না? এখানে কি চাই?"

নিশীথ বাবুর মুখে কথাগুলো শুনতে শুনতে গোগোলের সারা শরীর ক্ষোভ এবং আক্রোশের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে দিলো। তার মনে হলো এই মুহূর্তে  উল্টোদিকে কেবিনের ভেতর বসা লোকটিকে চেয়ার থেকে তুলে নিয়ে এসে দোতলার বারান্দার উপর থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু সময় তাকে অনেক পরিণত এবং ধৈর্যশীল বানিয়েছে। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে এনে করজোড়ে বিনীতভাবে বললো "ঠিকই তো .. আপনি হয়তো ঠিক কথাই বলছেন স্যার। তবে ঐসব পুরনো কথা তুলে কি লাভ বলুন! যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে। আমি একটা অন্য কারণে এসেছি .. তাও দরকারটা আমার নয়। আমার কথাগুলো যদি দয়া করে শুনতেন তাহলে আপনারই হয়তো উপকার হতো।"

"বটে? আমার উপকার? তাও আবার তুমি উপযাজক হয়ে করতে এসেছো? ঠিক আছে ভেতরে এসো।" ইশারা করে গোগোলকে ভেতরে ডাকলো নিশীথ বটব্যাল।

(ক্রমশ)

ভালো লাগলে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন
লাইক এবং রেপু দিয়ে উৎসাহিত করবেন

[Image: Animation-resize-gif-f3b601eb23d95beeb4e...911ac0.gif]


Like Reply


Messages In This Thread
RE: গোলকধাঁধায় গোগোল (চলছে) - by Bumba_1 - 14-08-2022, 09:31 PM



Users browsing this thread: 62 Guest(s)