13-08-2022, 01:10 AM
(This post was last modified: 13-08-2022, 01:12 AM by Nirjon_ahmed. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
অদ্বৈতা সুপারভাইজারের নাম বলে ওর।
ভিসির বাড়ির আকাশে কয়েকটা চিল উড়ছে, ভেজা ফুটপাতেই শুয়ে আছে একটা কুকুর। সারাদিন কিছু পেটে পড়েছে কুকুরটার? কী খেয়ে বাঁচে ওরা? নির্জনের কুকুরটাকে কিছু খাওয়াতে ইচ্ছে করে।
“ফার্স্ট ইয়ারে আমরা কি তুই তুকারি করতাম?”, আচমকা জিজ্ঞেস করে অদ্বৈতা।
“না”, সংক্ষেপে জবাব দেয় নির্জন।
“তুমি নিশ্চিত?”
“হ্যাঁ! তোমার মনে নেই?”
মাথা নাড়ে অদ্বৈতা।
“তুমি বোধহয় প্রথমদিকে তুই করে বলার চেষ্টা করেছিলে। আমি সেটা হতে দেইনি!”
অদ্বৈতা মুখে দূরাগত চেনা গানের কলির মতো ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে। চোখ ফেরাতে পারে না নির্জন। কিন্তু ও চোখের পলক ফেলে ওর দিকে তাকাতেই নির্জন চোখ সরিয়ে নেয়।
অদ্বৈতা বলে, “এখন আর বোধহয় তোমাকে কোনদিন তুই বলতে পারব না!”
নির্জনের মুখেও এবারে হাসি ফোটে। বলে, “সেটাই ভালো। তোমাকে আমি শুধুই বন্ধু হিসেবে কোনদিন দেখিনি।”
নির্জনের সিগারেটটা কখন শেষ হয়ে গেছে, কখন ও ফেলে দিয়েছে হাত থেকে, খেয়ালই করেনি ও। ভিসির বাড়ির সামনে একটা সিগারেটওয়ালাকে দেখে আবার ইচ্ছে করে সিগারেট ধরানোর।
অদ্বৈতা ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “সমাজবিজ্ঞানে একটা নতুন চায়ের দোকান এসেছে। ওখানে চা খাই?”
“তাই নাকি? চলো!”
রাস্তা পেরিয়ে ওরা মলচত্বরের রাস্তায় পা দিলে ওদের অভ্যর্থনা জানায় একরাশ হাওয়া। গ্রীষ্মে ফোঁটা কিছু কৃষ্ণচূড়া এখনো আকাশে লাল আগুন ছড়িয়ে রেখেছে আকাশে।
“কোথায় যাবে তুমি, অদ্বৈতা?”
কলাভবনের সামনের রাস্তায় পা রেখে জিজ্ঞেস করে নির্জন।
“এইতো তোমার সাথে সমাজবিজ্ঞানে যাচ্ছি!”
সামান্য হেসে চড়ুই পাখির দ্রুতিতে জবাব দেয় অদ্বৈতা।
“না না। সেটা বলছি না!”, প্রশ্নটাকে শোধরায় নির্জন। বলে, “কোন দেশে যাওয়ার চিন্তা করছো?”
“ঠিক নেই!”
সংক্ষেপে উত্তর দেয় ও। তারপর বলে, “জিআরই এর প্রস্তুতি নিচ্ছি। নর্থ আমেরিকার কোথাও হলে বেটার হয়!”
“ইউরোপে যাবে না কেন? আমাদের দেশের স্কলাররা তো সবাই ইউরোপের কথাই বলে শুধু!”
ওদের সামনে, কলাভবনের যেখানে কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল একটা, করোনার মাঝে যাকে কেটে ফেলা হয়েছে, সেখানে, জল জমেছে একটু। অদ্বৈতা সেই জায়গাটুকু পেরুতে লাফ দেয়। নির্জনের মনে হয়, এভাবে লাফাতে, এমন পাখির মতো দুদিকে হাত মেলে, ফড়িং এর মতো ল্যান্ড করতে ও কোনদিন দেখেনি কাউকে।
নির্জনকে অবশ্য লাফাতে হয় না।
অদ্বৈতা বলে, “ইউরোপে যাবো না এমন নয়। নর্থ আমেরিকায় না হলে ইউরোপেই যাবো। সমস্যা হলো, ইউরোপের স্কলারশিপ কম। আর কানাডা আর ইউএসে যে স্কলারশিপ দেয় সেটা হিউজ। অনেক টাকা বেচেও যায়। তাই নর্থ আমেরিকাই টার্গেট আপাতত। আর ইউরোপের মধ্যে ইউকে ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আর ইউকের ইউনিতে এডমিশন পাওয়াও টাফ!”
এসবের কিছুই নির্জনের জানা নেই। ও কোনদিন দেশের বাইরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেনি, দেশের বাইরে পড়তে যাওয়া সম্ভব, এটা মনে পর্যন্ত আসেনি ওর।
“তোমার এডমিশন ভালো কোথাও হয়ে যাবে, দেখো।“, নির্জন মন থেকেই বলে, আশীর্বাদের স্বরে।
অদ্বৈতা ওর দিকে তাকায়। ওর চোখ এক মুহূর্ত ওর মুখে অবস্থান করে চলে যায় ডাকসুর সামনের চালতা গাছের চিরসবুজ পাতায়।
বলে, “হোপ সো। সমস্যা হলো, আমি এই মাস্টার্সের থিসিসের জন্য প্রিপারেশন ঠিকমতো নিতে পারছি না। কিছু ইউনি ইন্টারভিউ নেয়। প্রস্তুতি ছাড়া টেকা ইম্পসিবল।“
“তোমার থিসিসের টপিক কী?”
অদ্বৈতা বলে, “সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ইন গার্মেন্ট সেক্টর।”
নির্জনের পা দুটো থেমে যায় যেন। দমে যায় বুকটা। গার্মেন্ট সেক্টর নিয়ে কাজ করছে বলেই কি নির্জনকে মনে পড়েছে অদ্বৈতার? ও কি তবে নির্জনের কাছে কোন সাহায্য চায় বলেই আজ দেখা করল? এই ক্ষমাটমা স্রেফ বাহানা?
ওয়ান টাইম কাঁপে চা নিয়ে ওরা বসে ক্যাফের উপরে। শুক্রবার বলে লোক গিজগিজ করছে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা অনেকেই এসেছে বাল বাচ্চা সহ, এদিকে ওদিকে বাচ্চাদের দৌড়ে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে।
নির্জন চায়ে চুমুক দেয়।
অদ্বৈতা বলে, “তুমি এমন গুম হয়ে আছো কেন? কী হলো?”
একটু হেসে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে নির্জন। যে কারণেই মনে পড়ুক, মনে তো পড়েছে ওর!
নির্জন জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি চোখে কাজল দিয়েছো, অদ্বৈতা?”
হতচকিয়ে যায় ও। চোখদুটো বিস্ময়ে জ্বলে ওঠে সামান্য, “না তো! কাজল দিয়েছি মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ!”
অদ্বৈতা বলে না কিছুই। কয়েকবার নিঃশব্দে চুমুক দেয় শুধু চায়ের কাপে।
অদ্বৈতা সামান্য বদলেছে এই ক’বছরে। কয়েক বছরই তো! সেদিনের পর থেকে কোনদিন তো ওকে এতো কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়নি। মুখটা ফুলেছে একটু, চোখদুটো হয়েছে গভীরতর, আর কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল এখন ছড়িয়ে পড়েছে পিঠময়।
“তোমার চেহারা অনেক পাল্টে গেছে, নির্জন।“, কাঁপে চুমুক দেয়ার ফাঁকে বলে অদ্বৈতা। “ফার্স্ট ইয়ারে কেমন বেবি ফেইস ছিলে। এখন একটু বয়স্ক বয়স্ক লাগছে!”
“বয়স্ক? বুড়া হয়ে গেলাম নাকি?”
“আরে না। বুড়া না। মানে কমবয়সী লাগছে না আরকি!”
নির্জনের ভালো লাগে। অদ্বৈতা যে প্রথমবর্ষের হেংলা দোহারা চেহারাটা মনে রেখেছে, ভাবতেই ভালো লাগে ওর। কী দিন ছিলো সেসব। অফুরন্ত আনন্দের দিন। চিন্তাহীন ঘোরাঘুরির দিন। ক্লাস শেষে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার দলবেঁধে বিশটাকার ভাত খাওয়ার দিন।
চায়ের পাট শেষ হলে ওরা পাশাপাশি বসে থাকে কিছুক্ষণ চুপচাপ। নির্জন বলার মতো পায় না খুঁজে কিছুই। কয়েক সেন্টিমিটির দূরেই অদ্বৈতা, তাকিয়ে আছে অদূরের কোন কিছুর দিকে। নির্জনের ইচ্ছে করে ওকে ডাকতে। ওর নামটা উচ্চারণ করতেও ভালো লাগে ওর। ইচ্ছে করে, ওর মুখটাকে ফিরিয়ে আনে নিজের দিকে। বলে, “আমার দিকে একটু তাকাও, প্লিজ। কতোদিন তোমায় দেখিনি, কতোদিন তোমার দেখবো না আবার। এখন একটু দেখতে দাও। এখন একটু চোখটা ভরুক, চোখটা ডুবুক, চোখটা তলাক!”
নির্জন আলতো স্বরে ডাকে, “অদ্বৈতা!”
আশেপাশে কোলাহলের কারণেই বুঝি, কিংবা অমনোযোগের জন্যে, অদ্বৈতা কোন সাড়া দেয় না। ওর কানে নির্জনের মুখ থেকে বেরুনো ক্ষীণ স্বর পৌঁছায় না।
নির্জন গলার স্বর আরেক স্কেল তুলে ডাকে।
“অদ্বৈতা!”
এবারে ও ফিরে তাকায়। ওর চোখ হাসছে। ঠোঁটেও হাসির চিলতে রোদ।
বলে, “কী?”
“এভাবে চুপ করে কী ভাবছো?”
“ভাবছি, কীভাবে এতো বড় হয়ে গেলাম! এইতো ক’দিন আগেই ক্যাম্পাসে ছিলাম ফ্রেসার, আর এখন এন্ডগেম শুরু হয়ে গেছে। কিছুদিন পরই ক্যাম্পাসে আমি বহিরাগত, তারপর তো দেশেই থাকবো না আর!”
নির্জনের বুক পদ্মপাতার মতো কাঁপতে থাকে। বলে, “বিদেশেই স্যাটেল করবে?”
“জানি না। হয়তো। আম্মু অবশ্য আমার বিদেশে থেকে যাওয়ার কথা শুনতেই চায় না। বলে, ওখানে স্যাটেল হওয়ার কথা চিন্তা করলে, পড়তেই যেতে দেব না। তোর এতো পড়াশুনা করার দরকার নাই। তুই এমনেই থাক, দেশে থাক!”
অদ্বৈতা এমনভাবে ওর মায়ের নকল করে, হেসে ফেলে নির্জন।
নির্জন বলে, “ঠিকই বলে। দেশের বাইরে কেন থাকবে? চাইলেই দেখতে পারবে না। ছুঁতে পারবে না। কেন দূরে যাবে!”
অদ্বৈতা বলে, “আমার মা হলো রবীন্দ্রনাথের বঙ্গমাতার সাত কোটি সন্তানের জননী। বাঙালি করেই রাখবে, মানুষ করবে না!”
নির্জনের নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। ওর মা কেমন ছিলো? ওর মা ওকে দিতো দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি? দুহাতে আঁকড়ে ধরতো না বঙ্গভূমির মতো?
সূর্যের আলো নিভে যাওয়ায় সন্ধ্যা নামতে শুরু করলে সমাজবিজ্ঞান চত্বরের লাইটগুলো জ্বলে ওঠে। আচমকা লাইট জ্বলে ওঠায় বিরক্ত হয় নির্জন। সন্ধ্যার নদীর জলের মতো কোমল আঁধারে অদ্বৈতাকে দেখছিল ও আড়চোখ, এখন আলো জ্বলে ওঠায় আর পারছে না।
অদ্বৈতা বলে, “আমি এবারে উঠি। তুমি তো হলেই যাবে না?”
“এত তাড়াতাড়ি? তোমার তো গাড়ি আছে। আরেকটু পরে যাও!”
কথাগুলো বলেই ওর মনে হয়, ঠিক করেনি ও কাজটা। ওর কি অদ্বৈতাকে এভাবে অনুরোধ করার অধিকার আছে? কেনই বা থাকবে অদ্বৈতা? ওর সাথে এভাবে বসে থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নিশ্চয়ই ওর আছে। জিআরই এর প্রিপারেশন নিতে হয়, মাস্টার্সের পড়া পড়তে হয়, থিসিস নিয়ে ভাবতে হয়, এদিকে আবার বিদেশী ইউনির ভাইভার প্রস্তুতিও আছে। ওর সময় আছে নির্জনের সাথে বসে থাকার? নির্জনের আফসোস হয় অদ্বৈতাকে মূল্যবান সময় নষ্ট করতে অনুরোধ করেছে বলে।
নিজের অনুরোধ ফিরিয়ে নিয়ে, ওর জবাব দেয়ার আগেই ও বলে, “আচ্ছা থাক। তুমি ব্যস্ত থাকলে যাও। আমাকে তো আবার সাভারের বাসে চড়তেই হবে একটু পর। তাড়াতাড়ি যাওয়াই ভালো!”
অদ্বৈতা শুধু হাসে। বলে, “আরেকদিন না হয় বসবো তোমার সাথে। তাছাড়া তোমার সাথে তো আমার দেখা হবেই!”
“দেখা হবেই?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে নির্জন।
“তোমাকে বললাম না, আমি রিসার্স করছি গার্মেন্ট সেক্টরে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট নিয়ে। আমাকে তো অনেক জায়গায় সার্ভে করতে হবে। সাভারে গেলে তুমি আমার সাথে থাকবে না? তোমার তো ওদিকের গার্মেন্টস নিয়ে অনেক জানাশোনা থাকার কথা!”
নির্জনের অনুমান সত্যিই হয়। অদ্বৈতা শুধুমাত্র সেদিনের রাগারাগির জন্য ক্ষমা চাইতে আজ দেখা করেনি ওর সাথে। নির্জনকে ওর প্রয়োজন বলেই এসেছে।
নির্জন হেসে বলে, “আছে। জানাশোনা আছে। তোমার প্রয়োজন হলে আমাকে জানিও।“
একটু মুচকি হেসে, ডান হাত দিয়ে বিদায় জানানোর ভঙ্গি করে, মুখ ফেরায় অদ্বৈতা। হাঁটতে থাকে মন্থর গতিতে।
হয়তো সামান্য দূরেই কোথাও গাড়ি নিয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে ড্রাইভার। নির্জন অন্তত ওকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারতো! কথাটা আগে মনে হয়নি বলে, মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে নির্জনের।
কয়েক সেকেন্ড মাত্র চোখ সরিয়েছিলো নির্জন, অদ্বৈতা হারিয়ে গেলো হাজার লোকের ভিড়ে। এখন চারিদিকে শুধুই মানুষ। কয়েক লাখ মানুষ। কয়েক কোটি, কয়েকশো কোটি মানুষ। এই কয়েক কোটি কিংবা কয়েকশো কোটি মানুষের মধ্যে অদ্বৈতা আছে। সেও আছে।
এক পৃথিবীতে রয়েছে ওরা! নির্জন ও অদ্বৈতা, এটাই বা কম কীসে? আঃ!
ভিসির বাড়ির আকাশে কয়েকটা চিল উড়ছে, ভেজা ফুটপাতেই শুয়ে আছে একটা কুকুর। সারাদিন কিছু পেটে পড়েছে কুকুরটার? কী খেয়ে বাঁচে ওরা? নির্জনের কুকুরটাকে কিছু খাওয়াতে ইচ্ছে করে।
“ফার্স্ট ইয়ারে আমরা কি তুই তুকারি করতাম?”, আচমকা জিজ্ঞেস করে অদ্বৈতা।
“না”, সংক্ষেপে জবাব দেয় নির্জন।
“তুমি নিশ্চিত?”
“হ্যাঁ! তোমার মনে নেই?”
মাথা নাড়ে অদ্বৈতা।
“তুমি বোধহয় প্রথমদিকে তুই করে বলার চেষ্টা করেছিলে। আমি সেটা হতে দেইনি!”
অদ্বৈতা মুখে দূরাগত চেনা গানের কলির মতো ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে। চোখ ফেরাতে পারে না নির্জন। কিন্তু ও চোখের পলক ফেলে ওর দিকে তাকাতেই নির্জন চোখ সরিয়ে নেয়।
অদ্বৈতা বলে, “এখন আর বোধহয় তোমাকে কোনদিন তুই বলতে পারব না!”
নির্জনের মুখেও এবারে হাসি ফোটে। বলে, “সেটাই ভালো। তোমাকে আমি শুধুই বন্ধু হিসেবে কোনদিন দেখিনি।”
নির্জনের সিগারেটটা কখন শেষ হয়ে গেছে, কখন ও ফেলে দিয়েছে হাত থেকে, খেয়ালই করেনি ও। ভিসির বাড়ির সামনে একটা সিগারেটওয়ালাকে দেখে আবার ইচ্ছে করে সিগারেট ধরানোর।
অদ্বৈতা ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “সমাজবিজ্ঞানে একটা নতুন চায়ের দোকান এসেছে। ওখানে চা খাই?”
“তাই নাকি? চলো!”
রাস্তা পেরিয়ে ওরা মলচত্বরের রাস্তায় পা দিলে ওদের অভ্যর্থনা জানায় একরাশ হাওয়া। গ্রীষ্মে ফোঁটা কিছু কৃষ্ণচূড়া এখনো আকাশে লাল আগুন ছড়িয়ে রেখেছে আকাশে।
“কোথায় যাবে তুমি, অদ্বৈতা?”
কলাভবনের সামনের রাস্তায় পা রেখে জিজ্ঞেস করে নির্জন।
“এইতো তোমার সাথে সমাজবিজ্ঞানে যাচ্ছি!”
সামান্য হেসে চড়ুই পাখির দ্রুতিতে জবাব দেয় অদ্বৈতা।
“না না। সেটা বলছি না!”, প্রশ্নটাকে শোধরায় নির্জন। বলে, “কোন দেশে যাওয়ার চিন্তা করছো?”
“ঠিক নেই!”
সংক্ষেপে উত্তর দেয় ও। তারপর বলে, “জিআরই এর প্রস্তুতি নিচ্ছি। নর্থ আমেরিকার কোথাও হলে বেটার হয়!”
“ইউরোপে যাবে না কেন? আমাদের দেশের স্কলাররা তো সবাই ইউরোপের কথাই বলে শুধু!”
ওদের সামনে, কলাভবনের যেখানে কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল একটা, করোনার মাঝে যাকে কেটে ফেলা হয়েছে, সেখানে, জল জমেছে একটু। অদ্বৈতা সেই জায়গাটুকু পেরুতে লাফ দেয়। নির্জনের মনে হয়, এভাবে লাফাতে, এমন পাখির মতো দুদিকে হাত মেলে, ফড়িং এর মতো ল্যান্ড করতে ও কোনদিন দেখেনি কাউকে।
নির্জনকে অবশ্য লাফাতে হয় না।
অদ্বৈতা বলে, “ইউরোপে যাবো না এমন নয়। নর্থ আমেরিকায় না হলে ইউরোপেই যাবো। সমস্যা হলো, ইউরোপের স্কলারশিপ কম। আর কানাডা আর ইউএসে যে স্কলারশিপ দেয় সেটা হিউজ। অনেক টাকা বেচেও যায়। তাই নর্থ আমেরিকাই টার্গেট আপাতত। আর ইউরোপের মধ্যে ইউকে ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আর ইউকের ইউনিতে এডমিশন পাওয়াও টাফ!”
এসবের কিছুই নির্জনের জানা নেই। ও কোনদিন দেশের বাইরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেনি, দেশের বাইরে পড়তে যাওয়া সম্ভব, এটা মনে পর্যন্ত আসেনি ওর।
“তোমার এডমিশন ভালো কোথাও হয়ে যাবে, দেখো।“, নির্জন মন থেকেই বলে, আশীর্বাদের স্বরে।
অদ্বৈতা ওর দিকে তাকায়। ওর চোখ এক মুহূর্ত ওর মুখে অবস্থান করে চলে যায় ডাকসুর সামনের চালতা গাছের চিরসবুজ পাতায়।
বলে, “হোপ সো। সমস্যা হলো, আমি এই মাস্টার্সের থিসিসের জন্য প্রিপারেশন ঠিকমতো নিতে পারছি না। কিছু ইউনি ইন্টারভিউ নেয়। প্রস্তুতি ছাড়া টেকা ইম্পসিবল।“
“তোমার থিসিসের টপিক কী?”
অদ্বৈতা বলে, “সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ইন গার্মেন্ট সেক্টর।”
নির্জনের পা দুটো থেমে যায় যেন। দমে যায় বুকটা। গার্মেন্ট সেক্টর নিয়ে কাজ করছে বলেই কি নির্জনকে মনে পড়েছে অদ্বৈতার? ও কি তবে নির্জনের কাছে কোন সাহায্য চায় বলেই আজ দেখা করল? এই ক্ষমাটমা স্রেফ বাহানা?
ওয়ান টাইম কাঁপে চা নিয়ে ওরা বসে ক্যাফের উপরে। শুক্রবার বলে লোক গিজগিজ করছে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা অনেকেই এসেছে বাল বাচ্চা সহ, এদিকে ওদিকে বাচ্চাদের দৌড়ে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে।
নির্জন চায়ে চুমুক দেয়।
অদ্বৈতা বলে, “তুমি এমন গুম হয়ে আছো কেন? কী হলো?”
একটু হেসে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে নির্জন। যে কারণেই মনে পড়ুক, মনে তো পড়েছে ওর!
নির্জন জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি চোখে কাজল দিয়েছো, অদ্বৈতা?”
হতচকিয়ে যায় ও। চোখদুটো বিস্ময়ে জ্বলে ওঠে সামান্য, “না তো! কাজল দিয়েছি মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ!”
অদ্বৈতা বলে না কিছুই। কয়েকবার নিঃশব্দে চুমুক দেয় শুধু চায়ের কাপে।
অদ্বৈতা সামান্য বদলেছে এই ক’বছরে। কয়েক বছরই তো! সেদিনের পর থেকে কোনদিন তো ওকে এতো কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়নি। মুখটা ফুলেছে একটু, চোখদুটো হয়েছে গভীরতর, আর কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল এখন ছড়িয়ে পড়েছে পিঠময়।
“তোমার চেহারা অনেক পাল্টে গেছে, নির্জন।“, কাঁপে চুমুক দেয়ার ফাঁকে বলে অদ্বৈতা। “ফার্স্ট ইয়ারে কেমন বেবি ফেইস ছিলে। এখন একটু বয়স্ক বয়স্ক লাগছে!”
“বয়স্ক? বুড়া হয়ে গেলাম নাকি?”
“আরে না। বুড়া না। মানে কমবয়সী লাগছে না আরকি!”
নির্জনের ভালো লাগে। অদ্বৈতা যে প্রথমবর্ষের হেংলা দোহারা চেহারাটা মনে রেখেছে, ভাবতেই ভালো লাগে ওর। কী দিন ছিলো সেসব। অফুরন্ত আনন্দের দিন। চিন্তাহীন ঘোরাঘুরির দিন। ক্লাস শেষে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার দলবেঁধে বিশটাকার ভাত খাওয়ার দিন।
চায়ের পাট শেষ হলে ওরা পাশাপাশি বসে থাকে কিছুক্ষণ চুপচাপ। নির্জন বলার মতো পায় না খুঁজে কিছুই। কয়েক সেন্টিমিটির দূরেই অদ্বৈতা, তাকিয়ে আছে অদূরের কোন কিছুর দিকে। নির্জনের ইচ্ছে করে ওকে ডাকতে। ওর নামটা উচ্চারণ করতেও ভালো লাগে ওর। ইচ্ছে করে, ওর মুখটাকে ফিরিয়ে আনে নিজের দিকে। বলে, “আমার দিকে একটু তাকাও, প্লিজ। কতোদিন তোমায় দেখিনি, কতোদিন তোমার দেখবো না আবার। এখন একটু দেখতে দাও। এখন একটু চোখটা ভরুক, চোখটা ডুবুক, চোখটা তলাক!”
নির্জন আলতো স্বরে ডাকে, “অদ্বৈতা!”
আশেপাশে কোলাহলের কারণেই বুঝি, কিংবা অমনোযোগের জন্যে, অদ্বৈতা কোন সাড়া দেয় না। ওর কানে নির্জনের মুখ থেকে বেরুনো ক্ষীণ স্বর পৌঁছায় না।
নির্জন গলার স্বর আরেক স্কেল তুলে ডাকে।
“অদ্বৈতা!”
এবারে ও ফিরে তাকায়। ওর চোখ হাসছে। ঠোঁটেও হাসির চিলতে রোদ।
বলে, “কী?”
“এভাবে চুপ করে কী ভাবছো?”
“ভাবছি, কীভাবে এতো বড় হয়ে গেলাম! এইতো ক’দিন আগেই ক্যাম্পাসে ছিলাম ফ্রেসার, আর এখন এন্ডগেম শুরু হয়ে গেছে। কিছুদিন পরই ক্যাম্পাসে আমি বহিরাগত, তারপর তো দেশেই থাকবো না আর!”
নির্জনের বুক পদ্মপাতার মতো কাঁপতে থাকে। বলে, “বিদেশেই স্যাটেল করবে?”
“জানি না। হয়তো। আম্মু অবশ্য আমার বিদেশে থেকে যাওয়ার কথা শুনতেই চায় না। বলে, ওখানে স্যাটেল হওয়ার কথা চিন্তা করলে, পড়তেই যেতে দেব না। তোর এতো পড়াশুনা করার দরকার নাই। তুই এমনেই থাক, দেশে থাক!”
অদ্বৈতা এমনভাবে ওর মায়ের নকল করে, হেসে ফেলে নির্জন।
নির্জন বলে, “ঠিকই বলে। দেশের বাইরে কেন থাকবে? চাইলেই দেখতে পারবে না। ছুঁতে পারবে না। কেন দূরে যাবে!”
অদ্বৈতা বলে, “আমার মা হলো রবীন্দ্রনাথের বঙ্গমাতার সাত কোটি সন্তানের জননী। বাঙালি করেই রাখবে, মানুষ করবে না!”
নির্জনের নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। ওর মা কেমন ছিলো? ওর মা ওকে দিতো দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি? দুহাতে আঁকড়ে ধরতো না বঙ্গভূমির মতো?
সূর্যের আলো নিভে যাওয়ায় সন্ধ্যা নামতে শুরু করলে সমাজবিজ্ঞান চত্বরের লাইটগুলো জ্বলে ওঠে। আচমকা লাইট জ্বলে ওঠায় বিরক্ত হয় নির্জন। সন্ধ্যার নদীর জলের মতো কোমল আঁধারে অদ্বৈতাকে দেখছিল ও আড়চোখ, এখন আলো জ্বলে ওঠায় আর পারছে না।
অদ্বৈতা বলে, “আমি এবারে উঠি। তুমি তো হলেই যাবে না?”
“এত তাড়াতাড়ি? তোমার তো গাড়ি আছে। আরেকটু পরে যাও!”
কথাগুলো বলেই ওর মনে হয়, ঠিক করেনি ও কাজটা। ওর কি অদ্বৈতাকে এভাবে অনুরোধ করার অধিকার আছে? কেনই বা থাকবে অদ্বৈতা? ওর সাথে এভাবে বসে থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নিশ্চয়ই ওর আছে। জিআরই এর প্রিপারেশন নিতে হয়, মাস্টার্সের পড়া পড়তে হয়, থিসিস নিয়ে ভাবতে হয়, এদিকে আবার বিদেশী ইউনির ভাইভার প্রস্তুতিও আছে। ওর সময় আছে নির্জনের সাথে বসে থাকার? নির্জনের আফসোস হয় অদ্বৈতাকে মূল্যবান সময় নষ্ট করতে অনুরোধ করেছে বলে।
নিজের অনুরোধ ফিরিয়ে নিয়ে, ওর জবাব দেয়ার আগেই ও বলে, “আচ্ছা থাক। তুমি ব্যস্ত থাকলে যাও। আমাকে তো আবার সাভারের বাসে চড়তেই হবে একটু পর। তাড়াতাড়ি যাওয়াই ভালো!”
অদ্বৈতা শুধু হাসে। বলে, “আরেকদিন না হয় বসবো তোমার সাথে। তাছাড়া তোমার সাথে তো আমার দেখা হবেই!”
“দেখা হবেই?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে নির্জন।
“তোমাকে বললাম না, আমি রিসার্স করছি গার্মেন্ট সেক্টরে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট নিয়ে। আমাকে তো অনেক জায়গায় সার্ভে করতে হবে। সাভারে গেলে তুমি আমার সাথে থাকবে না? তোমার তো ওদিকের গার্মেন্টস নিয়ে অনেক জানাশোনা থাকার কথা!”
নির্জনের অনুমান সত্যিই হয়। অদ্বৈতা শুধুমাত্র সেদিনের রাগারাগির জন্য ক্ষমা চাইতে আজ দেখা করেনি ওর সাথে। নির্জনকে ওর প্রয়োজন বলেই এসেছে।
নির্জন হেসে বলে, “আছে। জানাশোনা আছে। তোমার প্রয়োজন হলে আমাকে জানিও।“
একটু মুচকি হেসে, ডান হাত দিয়ে বিদায় জানানোর ভঙ্গি করে, মুখ ফেরায় অদ্বৈতা। হাঁটতে থাকে মন্থর গতিতে।
হয়তো সামান্য দূরেই কোথাও গাড়ি নিয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে ড্রাইভার। নির্জন অন্তত ওকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারতো! কথাটা আগে মনে হয়নি বলে, মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে নির্জনের।
কয়েক সেকেন্ড মাত্র চোখ সরিয়েছিলো নির্জন, অদ্বৈতা হারিয়ে গেলো হাজার লোকের ভিড়ে। এখন চারিদিকে শুধুই মানুষ। কয়েক লাখ মানুষ। কয়েক কোটি, কয়েকশো কোটি মানুষ। এই কয়েক কোটি কিংবা কয়েকশো কোটি মানুষের মধ্যে অদ্বৈতা আছে। সেও আছে।
এক পৃথিবীতে রয়েছে ওরা! নির্জন ও অদ্বৈতা, এটাই বা কম কীসে? আঃ!