Thread Rating:
  • 26 Vote(s) - 3.31 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Thriller দ্যা লাস্ট কেস (ছোট গল্প)
#32
পর্ব- তিন




কে. সি চৌধুরী বারবার মিত্রা কে বলে দিয়েছে তিনি বা বিচারক যা বলবেন সেটাতেই হ্যাঁ বলার জন্য, আর কিছু বলার দরকার নেই। খুব তাড়াতাড়ি সবটা মিটিয়ে দিবেন। কয়েকটা কাগজে কি সব সই নিলেন উকিল সাহেব।

মিত্রার ডাক পড়লো,
তা আপনি আপনার স্বামীকে ডিভোর্স দিতে চান, কারণ হিসেবে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, মেন্টালি টর্চার, মলেষ্ট আর পরকীয়া সম্পর্কের অভিযোগ করেছেন এটা কি ঠিক - বিচারক মহিলার মুখের কথা শুনে মিত্রা থ হয়ে গেছে, প্রথমত ও তো ডিভোর্স আপিল করে নি আর যেই অভিযোগ গুলোর কথা বলা হচ্ছে ওগুলো তো বহুদূরের কথা। উনি কি বলছেন আর এখানে কি হচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছে না, এই প্রথম কোর্টে এসেছে সেটার ভীতি টাই তো এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছে না এর মাঝেই এসব। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না৷ এর মাঝেই বিচারক মহিলা আবারও জিজ্ঞেস করে উঠলেন থতমত খেয়ে কে. সি চৌধুরীর দিকে তাকায় মিত্রা। কে. সি চৌধুরী মিত্রা কে মাথা নাড়িয়ে সায় দিতে বলে।

হুম, আমিই অভিযোগ গুলো করেছি - কাঁপা কাঁপা গলায় কোনমতে কথা টা  শেষে করেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো মিত্রা। নিজের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না কথা গুলো ও বলেছে, কেন বললো সেটাই ভাবতে থাকে। সব কিছু কেমন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে কিন্তু কিচ্ছু করতে পারছে না সে, ওর তো না করার কথা ছিল সেটা পারলো না কেন।

তা অভিযোগ করলেই তো হবে না অভিযোগের পক্ষে প্রমানও তো থাকতে হবে নাকি, যদি মিউচুয়াল ডিভোর্স হতো তবে না হয় একভাবে হতো এখন তো এটা অন্য একটা ধারায় চলে গেছে। তা চৌধুরী বাবু সব প্রমাণ নিয়েই এসেছেন নাকি সামনের কোন ডেট নিবেন - খড়খড়ে গলায় মহিলার কথা গুলো শুনে মিত্রার গায়ের লোম গুলো দাড়িয়ে গেল, কিসের ধারা টারা বলছে কিছুই তো বুঝতে পারছে না। আর অভিযোগের প্রমান সেটাই কোথায় পাবে ও, ও তো অভিযোগই করে নি। কি হবে এখন?

ম্যাডাম কেস যখন নিয়েছি তবে তো আটঘাট বেঁধেই নেমেছি, সব প্রমান হাতের মুঠোয় নিয়েই তবে আজ এসেছি৷ এক এক করে সব আপনার সামনে পেশ করবো, প্রথমেই কিছু ছবি দেখাচ্ছি যেগুলো কিংশুক বাবুর পরকীয়া সম্পর্কের প্রমান - কথাটা শুনে মিত্রা যেন আকাশ থেকে পড়লো, কারণ ও তো সেই ছবি গুলো কে সি চৌধুরী কে দেখায় নি তবে উনি কোথা থেকে পেলেন। এ ব্যাপারের তো কোন কথা পর্যন্ত বলে নি।

এছাড়াও কিংশুক বাবু প্রতি রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফিরে, আর বাসায় ফিরে আমার মক্কেলের উপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার নিপীড়ন চালায়, সেটার পক্ষের প্রমান হিসেবে আমি কিছু ছবি আর সাক্ষী এনেছি। ছবি গুলো তে দেখতে পারছেন উনি ক্লাবে মদ্যপ অবস্থায় আছে আর উনি বাসায় আসার পর যা যা করেন সে সবের সাক্ষী হিসেবে তাদের পাশের বাসার একজন কে হাজির করছি - ছবি গুলো দেখে আর সাক্ষীর বয়ান অনুযায়ী অভিযোগ গুলো অনেকাংশেই প্রমাণিত হয়ে যায়, এর পরেও বিচারক অভিযোগ কারীর মুখ থেকে কিছু শুনতে চায়।

মিসেস মিত্রা, আপনার উকিল যে যে প্রমাণ গুলো দাখিল করেছে সেগুলোর সাথে কি আপনি একমত, আপনার স্বামীর কি সত্যিই আরেকটা অবৈধ সম্পর্ক আছে আর উনি কি রাতে মদ্যপ অবস্থায় আপনার উপর নির্যাতন করে? - মিত্রা দাড়িয়ে কি বলবে সেটা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারে না, আবার কে সি চৌধুরীর দিকে তাকায়, চৌধুরী তাকে অভয় দেয়।

হ্যাঁ, ও মদ্যপ হয়ে বাসায় ফিরে, কিছুদিন আগেই ওর আরেকটা সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছি, হয়তো মাতাল অবস্থায় ও এক দুবার হাত তোলার চেষ্টা করেছে কিন্তু তাই বলে আমি ওকে ডিভোর্স দেবার মত.... - কথাটা শেষ করার আগেই কে সি চৌধুরী বাধা দেয়।

দেখুন ম্যাডাম সব সাক্ষ্য প্রমান এ কিন্তু সবটা পরিষ্কার, এমন একটা মানুষের সাথে আমার মক্কেল নিরাপদ না তাই উনার ডিভোর্স আপিল টা গ্রহন করুন - চৌধুরী বাঁধায় মিত্রার আর কিছুই বলা হয় না একবার শুধু কিংশুকের দিকে তাকায় ও, কিংশুক একাই বসে আছে ভাবলেশহীন ভাবে।

তা মিষ্টার কিংশুক আপনার উকিল কোথায়? আপনি কি নিজেই নিজের হয়ে উকালতি করবেন? - বিচারকের কথা শুনে কিংশুক উঠে দাঁড়ায়, এই প্রথম মিত্রার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দেয়।

জ্বী ম্যাডাম আমার কেস আমিই দেখবো। সেটার অনুমতির আবেদন আপনার কাছে জমা দেয়া হয়েছে - কিংশুকের আবেদন টা হাতে নিয়ে পড়ে সেটাতে একটা সাইন করে দেয় তাসলিমা খান।

তা আপনি কি আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ গুলো শুনেছেন? আর সেগুলো কি স্বীকার করেন যে আপনার দ্বারা সেগুলো হয়েছে - মিত্রা কিংশুকের দিকে তাকিয়ে আছে, ওর মুখে হাসি ভাব টা দেখে অবাক হয়।

হুম আমি সব স্বীকার করে নিচ্ছি, আর ডিভোর্সে সম্মতি দিচ্ছি। আমিও বিশ্বাস করি আমার সাথে মিত্রার থাকা নিরাপদ না - মিত্রার চোখ জল ভিজে উঠে। কিংশুক এক কথায সব মেনে নিলো, হয়তো ও এমন করেছে তাই বলে আর কিছুই বললো না, সরাসরি ডিভোর্সে রাজি হয়ে গেল। 

যদি অভিযোগ স্বীকার করেন তবে আপনার নামে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স এর জন্য নারী নির্যাতন মামলা হতে পারে। সেটাও কিন্তু ফেস করতে হবে ডিভোর্স হয়ে গেলেও।

না ম্যাডাম, আমার মক্কেল শুধু ডিভোর্স চাইছে, মি.  কিংশুক কে জেল খাটানোর ইচ্ছে তার নেই - কে সি চৌধুরী বাধা দিয়ে কথা গুলো বলে উঠে, এর পক্ষে মিত্রার সমর্থন ও নিয়ে নেয়।

যদি এমনটাই চায় তবে সেটা ভেবে দেখা যাবে, আপাতত আজকের কোর্ট এখানেই শেষ। আগামী সপ্তাহে কোর্ট তার রায় জানিয়ে দিবে, ডিভোর্স হয়ে যাবে শুধু কিছু ফর্মালিটি আছে।

মিত্রা কোর্ট রুম থেকে বেড়িয়ে বাইরে কিংশুক কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওর দিকে এগিয়ে যায়। কিংশুক মোবাইলে কারও সাথে কথা বলছিলো মিত্রা কে দেখেই মোবাইল টা রেখে দেয়।

তোমার ইচ্ছে মতই সব হচ্ছে, তাই এতো খুশি দেখাচ্ছে তোমাকে - মিত্রার ভারী হয়ে কণ্ঠে আওয়াজে বাতাসটাও ভারী হয়ে আসে, কিংশুক এক মূহুর্তের জন্য অন্যদিকে তাকিয়ে আবার মিত্রা দিকে ফিরে একটা ছোট্ট হাসি দেয়।

আমার মতে সব হলো কই? শুনলে না কি বললো ডিভোর্স তো তুমি ফাইল করেছো আর সাথে কত অভিযোগ, যদিও অভিযোগ গুলো সত্য - কিংশুকের মুখের কথা শেষ হতেই মিত্রা ওর শার্ট টা খামচে ধরে।

ওটা আমিও বুঝিনি, তুমি কিছু করেছো এসবে? আমি তো কখনো এমন অভিযোগ তোমাকে করিনি, কিছু বলার থাকলে তো তোমাকেই বলতাম এভাবে কোর্টে আসতাম না। আর ছবি টা এখনো আমি বিশ্বাস করি না ওসব তুমি ইচ্ছে করে করছো বোধহয় আমার থেকে দূরে যাবার জন্য তাই না। গত কদিন ধরে তো বাসায় পর্যন্ত যাচ্ছো না, আমি না হয় অস্পৃশ্য কিন্তু মেয়েটা? তুমি তো জানো ও বাবা ছাড়া কিছুই বুঝে না, তোমাকে দেখার জন্য প্রতিদিন কান্নাকাটি করে, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত করে না। কি করেছি আমি যে তুমি আমার সাথে এমন করছে, এভাবে আমাকে, মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছো। তুমি তো এমন ছিলে না কখনো তোমার কি হয়েছে কিংশুক বলো আমাকে। আমার কোন ভুল থাকলে কোন দোষ করে থাকলে আমাকে বলো প্লিজ তবুও এই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসো - মিত্রার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, কিংশুক দুহাতে মিত্রার হাত দুটো ওর শার্ট থেকে ছাড়িয়ে নেয়।

কোনটা ভুল ছিল কি দোষ হয়েছে সেটা তুমিই হয়তো ভালো জানো। ভালো করে ভেবে দেখো উত্তর পেয়ে যাবে আর মেয়ের কথা বলে আমার মন গলাতে চেয়ে লাভ নেই, আমি ওকে আমার মেয়ে বলে স্বীকার করি না, ও আমার মেয়ে না- বাজখাঁই গলায় কথাটা শেষ করেই কিংশুক দ্রুত পায়ে ওখান থেকে চলে যায়, নিমিষেই ভীড়ের মাঝে মিশে গেছে। মিত্রা পিছন থেকে বারবার ওকে ডাকলেও একবারও ফিরে তাকায় নি। এখনো শেষে কি বলে গেল সেটা বুঝার চেষ্টা করছে, কিংশুক এই কথা বলতে পারলো?? না ও হয়তো ভুল শুনেছে কিংশুক কখনো এই কথা বলতে পারে না, ও তো ওর নিজের জীবনের থেকেও মেয়েকে বেশি ভালোবাসে সেই মেয়েকে ও অস্বীকার করতে পারে না। নিজের মন কে বুঝ দেয়ার বৃথা চেষ্টায়  মিত্রার ভিজে যাওয়া চোখ নিয়ে অফিসের দিকে বেড়িয়ে যায়।

বাড়ি পৌঁছে মিত্রা মিলির নাম ধরে ডাকতে থাকে কিন্তু কোন সাড়া পায় না। মেয়েটা তো স্কুল থেকে এসে যাবার কথা ওর জুতো গুলো এখানেই আছে তবে মেয়েটা গেল কই, এত ডাকছে কিন্তু কোন কথা বলছে না। এদিক ওদিক খোঁজেও মেয়েকে না পেয়ে ছাদের দিকে এগিয়ে যায় হঠাৎ কান্নার শব্দ পেয়ে বুঝতে পারে মিলি ওখানেই আছে। মিত্রা কে দেখেই মিলি চোখ মুছে নেয়

মা বাবা কবে আসবে? আমার তো বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব - মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে শাড়ি ধরে বায়না করে।

তোমাকে তো বললাম বাবা অফিসের কাজে বাইরে গেছে, যখন আসবে তখন তো প্রথম তোমার সাথেই দেখা করবে- মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো বলতে গিয়ে মিত্রার গলাটা কেঁপে উঠে। 

তুমি মিথ্যে বলছো, আমি তো স্কুল থেকে আসার সময় বাবাকে দেখলাম হেঁটে কোথায় যেন যাচ্ছে। আমি অনেক ডেকেছি কিন্তু একবারও ফিরে তাকায় নি। তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছে তুমি খুব পঁচা। তোমার সাথে কথা বলবো না, বাবা যতক্ষণ না আসবে ততক্ষণ আমি কিচ্ছু খাবো না- কাঁদতে কাঁদতে মিলি দৌড়ে নিচে নেমে গেছে, কিন্তু মিত্রা এক পা নড়ার শক্তি পেল না, মেয়েকে কি বলবে সেটা ওর জানা নেই।

দুপুরে কাঁদতে কাঁদতে মিলি ঘুমিয়ে গিয়েছিল খায় নি পর্যন্ত, রাতেও অন্য রুমে গিয়ে বসে আছে আর কান্না করছে। মিত্রা খাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে মিলি জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, কাছে গিয়ে শরীরে হাত রাখতেই টের পায় জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। ছোট্ট মেয়েটার উপর তো ধকল কম যাচ্ছে না, মিত্রা তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বালতি ভর্তি জল নিয়ে আসে মাথায় ঢালার জন্য। মিলি জ্বরের ঘোরে বারবার বাবা বাবা বরে বিলাপ করে যাচ্ছে। মিত্রা কিংশুকের নাম্বারে ফোন করে কিন্তু ওর মোবাইল বন্ধ, কিংশুকের বন্ধুদের কাছে ফোন করেও কোন খবর পেল না। ঘন্টা খানেকের মত জল ঢালার পর জ্বর কিছুটা কমতির দিকে, মেয়েকে কোন মতে কিছু খাইয়ে জ্বরের ঔষধ খাইয়ে দেয় মিত্রা। নিজের আর খাবার খাওয়ার মত ইচ্ছে জাগে না, একদিকে কিংশুকের এমন বদলে যাওয়া, ডিভোর্স এসব সামলাতে পারছে না অন্যদিকে মেয়েটা দিনদিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কি করবে কোনদিকে যাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না মিত্রা, শুধু মেয়েকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে সে।

যখন মিলি ওর গর্ভে আসলো তখন এই কিংশুক ওর কত কেয়ার করতো, টাইমে টাইমে খাওয়া দাওয়া করানো, ডাক্তারের কাছে নিয়মিত চেকআপে নিয়ে যাওয়া, হাটতে নিয়ে যাওয়া, কখন কোন ঔষধ খেতে হবে সেটার খেয়াল রাখা সব দিকের নজর রাখতো। কোন কাজ করতে দিতো না মিত্রা কে, সারাদিন অফিস করে এসে সব একা হাতে করতো, সকালে নাস্তা করা দুপুরে মিত্রা কি কি খাবে সেটা রেডি করে রাখা আবার অফিস থেকে এসে রাতে রান্না করা, মিত্রা সাথে গল্প করা, বাইরের খোলা জায়গায় হাটতে নিয়ে যাওয়া সব কিংশুক হাসি মুখে করে যেতো। মোড সুইং এর কারণে মিত্রা মাঝে মাঝে রাগারাগি করতো, এটা ওটা বায়না করতো কিন্তু কিংশুক কখনো একটুও রাগ দেখাতো না বরং উল্টো মিত্রার রাগ ভাঙানোর জন্য উদ্ভট সব দাবি গুলোও মেনে নিতো৷ মিলির জন্মের পর সেই কিংশুক একা হাতেই মিত্রাকেও সামলিয়েছে আবার মিলিকেও সামলিয়েছে। আর মেয়েটাও জন্মের পর থেকে বাবা ছাড়া কিছুই বুঝে না। সারাদিন ঠিক বিছানায় হাত পা ছুড়ে খেলে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে কিন্তু যেই কিংশুক অফিস থেকে ফিরেছে তখনি ওর কোলে যে পর্যন্ত না উঠেছে ততক্ষণ আর রক্ষে নেই চিৎকার করে কান্না শুরু করেছে। আর কিংশুক ও মেয়ের কান্না সহ্য করতে পারে না, মেয়েকে কোলে নিয়েই বাড়ির কাজ করেছে, রান্না করেছে, জিনিসপত্র ধোয়ে ঠিক জায়গায় রাখা, ঘর পরিষ্কার করা সব করেছে একটু ক্লান্তি যেন ওর নাগাল পেত না। রাতে আবার মেয়েকে নিজের বুকের উপর নিয়ে ঘুমিয়েছে, আগে যে কিংশুক কাত না হয়ে ঘুমাতে পারতো না সেই কিংশুক চিত হয়ে ঘুমাতে শুরু করেছে মেয়ের জন্য।

সেই সময়ের কথা গুলো ভাবতে ভাবতে মিত্রার চোখ গুলো ভারী হয়ে আসে, মিলির দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা ঘুমোচ্ছে ঠিকি কিন্তু আগে কিংশুকের কাছে যে নিশ্চিন্তে ঘুমাতো সেই নিশ্চিন্ত ভাবটা মুখে নেই৷ মেয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে না এমন করে সব হতে দেয়া যায় না, যে করেই হোক কিংশুক কে বুঝাতে হবে। মিত্রা কে পারতেই হবে, নিজের জন্য না হলেও মেয়ের জন্য হলেও কিন্তু ও নিজেও তো পারছে না কিংশুক কে ছাড়া থাকতে। মিত্রা ঠিক করে কাল সকালেই কিংশুকের অফিসে যাবে, মেয়েটার এমন অবস্থার কথা শুনলে কিংশুক ঠিক চলে আসবে বাড়িতে মেয়েকে খুব ভালোবাসে ও। একবার বাড়ি আসুক তখন যেভাবেই হোক ওকে রাজি করিয়ে নিবে তবু এই ডিভোর্স হতে দিবে না, কিংশুক কে ছাড়া ওরা থাকতে পারবে না। 

পরদিন অফিসে গিয়ে জানতে পারে কিংশুক নাকি চাকরি টা ছেড়ে দিয়েছে দুদিন আগেই, অন্য কোথাও চাকরি নিয়েছে কিনা, কোথায় আছে কারও কাছে কোন খবর নেই। ওর বন্ধুরা পর্যন্ত ওর কোন খবর জানে না, সবার একটাই কথা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে। ওর তেমন কোন আত্মীয় নেই মিত্রার জানা মতে যারা আছে তারাও কেউ কিংশুকের কোন খবর দিতে পারলো না, মিত্রাও পারেনি মিলি কে তার বাবার কোন খবর এনে দিতে৷ মেয়েটাও কেমন পাথরের মত হয়ে গেছে এখন আর কান্না করে না, স্কুলে যায় আসে খাওয়া দাওয়া করে নিজের মত একা একা পড়তে বসে যায় কিন্তু ওর ভেতরে আগের মিলি আর নেই ঠিক বাবার মত হয়েছে ভিতরের সব তছনছ হয়ে গেছে কিন্তু বাইরে কাউকে বুঝতে দেয় না এখন আর মিত্রার সামনে কিংশুকের কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করে না, মিত্রা কিছু বলতে চাইলেও এড়িয়ে যায় বছর চারেকের মিলি যেন বড়দের মত আচরন করতে শিখে গেছে। কোর্টে পরের ডেট এ মিত্রা গেলেও কিংশুকের দেখা পায় নি ও আসেনি, বিচারক আবার নতুন ডেট দিয়ে দেয়। মিত্রা ভেবে পায় না এমন হঠাৎ করে কোথায় উধাও হয়ে গেল কিংশুক, ফোনে পাওয়া যায় না, কারও কাছে কোন খবর নেই ওর। কোন বিপদ হয় নি তো ওর, অজানা আশংকায় মিত্রার মন কেঁপে উঠে। কোন কাজে মন বসাতে পারছে না, চিন্তায় আর অঘুমে চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে।

দশদিন হয়ে গেল কিংশুকের কোন খোঁজ নেই, মিত্রা পাগলের মত খোঁজে চলেছে ওকে পরিচিত যারা আছে সবার কাছেই ওর খোঁজ করেছে কিন্তু কোন পাত্তা নেই ওর। দুদিন আগে পুলিশে একটা জিডি করেছে, সেখান থেকেও তেমন কোন রেসপন্স নেই। আজকাল মিত্রা অফিস শেষে পুরনো জায়গা গুলোতে একটু ঘুরতে আসে আগে কিংশুক ওকে এই জায়গা গুলোতে নিয়ে যেত। আজ মিত্রা পুরাতন ফেরী ঘাটে এসেছে, আগে ফেরী চলতো এখন এটা পার্কের মত করা হয়েছে। মিত্রা বড় বট গাছের নিচে বেঞ্চে বসে আগেও এখানে এসে বসতো এখন আরও সুন্দর করে বাঁধানো হয়েছে বেঞ্চ গুলো। খানিক পড়েই একজন লোক চা নিয়ে হাজির
ম্যাডাম আপনার চা - হঠাৎ করে ডাক টা কানে আসতেই চমকে গিয়ে মিত্রা ভ্রু কুঁচকে উপরের দিতে তাকায়।

আমি তো চায়ের কথা বলি নি - মিত্রার কথা শুনে চা-ওয়ালা হাসতে থাকে।

ম্যাডাম আমাকে চিনতে পারেন নি মনে হয়, আমি বিজু আগে এখানে ফ্লাক্সে করে ঘুরে ঘুরে চা বেচতাম। স্যার আর আপনে এখানে আসলে আমার কাছেই চা খেতেন, এখন টং দোকান দিসি ঐখানে - আরেকটু ভালো করে তাকিয়ে মিত্রা বিজু কে চিনতে পারে, হাসি মুখে চা টা ওর হাত থেকে নেয়।

ভালোই হলো দোকান দিয়েছো, তা কত খরচ হয়েছে - চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মিত্রা জিজ্ঞেস করে।

কেন স্যার আপনাকে কিছু বলে নি স্যারই তো দোকানের সব টাকা দিসে, স্যার কইসে আপনে যখন এখানে আইবেন তখন যেন  টাকা না রাখি আর আপনার চায়ে চিনি কম আদা বেশি লেবু দিয়ে যেন চা দেই - মিত্রা অবাক দৃষ্টিতে বিজুর দিকে তাকিয়ে ওর কথা শুনতে থাকে, টং দোকান টা দেখে মনে হয় সদ্য দেয়া হয়েছে।

তোমার স্যার শেষ কবে এসেছিল - কিংশুকের কোন খবর কি বিজুর কাছে আছে নাকি জানার জন্য কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে।

স্যার দশ-বারো দিন আগে আইসিলো যেদিন দোকান টা নিলাম এরপরে আর আসে নাই, কিন্তু স্যার কইসে তোর ম্যাডাম ঠিক আইবো - বিজুর কথা শুনে বুঝতে পারে প্রথম কোর্টের তারিখে কিংশুক এখানে এসেছিল এর পর আর আসে নি। বিজু দোকানের দিকে চলে যায়, মিত্রা বিজুর কথা গুলো আরেকবার নিজের মাঝে আওরাতে থাকে।

আজ যেই কিংশুকের জন্য এত ছটফট করছে মিত্রা পাঁচ বছর আগেও কি এমন ছটফটানি ছিল মিত্রা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে। এ্যারেঞ্জ ম্যারেঞ্জ ছিল ওদের, কিন্তু কিংশুক প্রথম থেকেই বন্ধুর মত মিশে গিয়েছিল মিত্রার সাথে, ও মিত্রার খুব খেয়াল রাখতো নিয়ম করে কিছুক্ষণ পরপর খবর নিতো। কিন্তু মিত্রার নিজের কাছে নিজেকে কেমন বন্দী লাগতো, মনে হতো কিংশুক ওর সবকিছুতেই নজর রাখে তাতে করে ওর নিজের স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই। কিংশুক হয়তো মিত্রার মনের কথা বুঝতো তাই ও মাঝে মাঝে মিত্রা কে বলতো "এখন তোমার নিজেকে খাঁচায় বন্ধ পাখির মত মনে হয়, কিন্তু যেদিন মুক্ত হবে সেদিন হয়তো আবার বন্দী জীবনটাই আবার খুঁজে বেরাবে"। কিংশুক যে এভাবে মিত্রাকে মুক্ত করে দিবে সেটা কল্পনাও করতে পারে নি। প্রথমে যেই কিংশুক কে ওর সহ্য হতো না এখন সেই কিংশুক ওর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, ওকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারতো না, ইচ্ছে করতো সবসময় ওর কাছাকাছি থাকতে, নিজের স্বামী সন্তানের বাবাকেো লুকিয়ে দেখার মাঝেও যেন অন্যরকম একটা শান্তি পেত। কিন্তু আজ সেই কিংশুক ওর থেকে দূরে চলে গেল, এমন করে একলা করে দিল যে আজকাল আর এই মুক্ত স্বাধীনতা টা আর মিত্রার কাছে উপভোগের যে বেশি কষ্টদায়ক মনে হয়। মিত্রা এখনো আশায় আছে কিংশুক হয়তো কোন গেম খেলছে ঠিক আবার হয়তো কখনো ফিরে আসবে, এবার কিংশুক কে আর নিজের কাছছাড়া হতে দিবে না মিত্রা। সন্ধ্যা হয়ে আসছে শাড়ির আঁচলে মুখ টা মুছে মিত্রা বাড়ির পথ ধরে।

মেয়েকে খাইয়ে স্কুল বাসে উঠিয়ে মিত্রাও নিজে অফিসের জন্য ট্যাক্সি ধরে। ট্যাক্সি টা সিগনালে পড়েছে অনেক লম্বা জ্যাম, ছোট ছোট কয়েকটা মেয়ে ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করছে। মিত্রা ওদের দিকে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ ওর দৃষ্টিটা একটা বাইকে আটকে যায়। বাইকের ব্যাক সীটে সেই মেয়েটা বসা যার সাথে কিংশুকের ছবি দেখেছিল আর কোর্টে কথা বলতে দেখেছিল, কিন্তু মেয়েটা যাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে সেই ছেলেটা তো কিংশুক নয়। তাহলে কিংশুক কোথায়, ঐ মেয়েটার কাছ কোন খবর আছে কি মিত্রা ট্যাক্সি থেকে নেমে মেয়েটার কাছে যেতে চায় কিন্তু এর মাঝেই সিগনাল উঠে গেছে গাড়ি চলতে শুরু করেছে, বাইকটাও দ্রুত গতিতে চলে গেল মিত্রা আবার ট্যাক্সি তে উঠে বসে।
অফিস থেকে বাসায় ফিরে দরজা খুলতেই দেখলো মিলি এখানে বসার ঘরেই বসে আছে, মিত্রা কে দেখেই দৌড়ে ওর কাছে জাপ্টে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে
মামনি কি হয়েছে তুমি এমন করে কাঁদছো কেন - কতদিন পর মেয়েকে আবার এমন করে কাঁদতে দেখে মিত্রা ঘাবড়ে যায়। হাঁটু গেড়ে মেয়ের সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দেখার চেষ্টা করে কোন আঘাত পেয়েছে নাকি।

মা, আমি আজ স্কুল থেকে ফেরার সময় বাবাকে দেখেছি। বাবার যেন কি হয়েছে, হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ করা আর হুইল চেয়ারে বসা। মা বাবার কি হয়েছে? আমি বাবা কে দেখতে যাবো।

[+] 5 users Like nextpage's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: দ্যা লাস্ট কেস (ছোট গল্প) - by nextpage - 10-08-2022, 08:59 PM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)