07-08-2022, 09:10 PM
গাত্র হরিদ্রা
বড় একটা কমিউনিটি সেন্টারে রাই রুদ্রের গায়ে হলুদের আসর বসেছে। পুরো সেন্টার টা নানা রঙের ফুল, বাহারি রঙের পর্দা আর ঝলমলে আলোতে সাজানো হয়েছে, এক পাশে বড় একটা স্টেজ করা হয়েছে সেখানেই রাজকীয় আসন বসানো হয়েছে পাত্র পাত্রীর জন্য৷ স্টেজের সামনেই সাড়ি সাড়ি চেয়ার পাতা আছে অথিতিদের জন্য। সিলিং জুড়ে বড় বড় ঝাড়বাতি ঝুলছে, দুপাশ জুড়ে রঙ বেরঙের বেলুন ঝুলানো হয়েছে। অতিথিরা যে পথে আসবে তার দুপাশে সাড়ি সাড়ি ফুল গাছের টব বসানো আছে তাতে রঙিন ছোট ছোট এলইডি বাতিতে ঝলমল করছে। সেন্টারের রুম গুলো সব মেয়েদের দখলে সবাই সেখানে শেষ মূহুর্তের সাজে ব্যস্ত, কোন এক রুমে হয়তো রাইও সাজতে বসেছে। মাঝে মাঝে তনু আর ছুটকির দেখা পাওয়া যাচ্ছে সাউন্ড অপারেটর এর কাছে, ওদের নাচার জন্য লম্বা একটা গানের লিস্ট আগেই ধরিয়ে দেয়া হয়েছে এরপরও ওদের চেকিং মাঝে মধ্যেই চলছে। দুজনের গায়েই ভারী চুমকির কাজ করা হলুদ রঙের লেহেঙ্গা, মেহেদীর নকশা আকা হাতে ভর্তি চুরির ঝনঝনানি। দূরে একপাশে যেখানে খাবারের আয়োজন হয়েছে যেখানে সেখানে অবিনাশ বাবু শেষবারের মত ক্যাটারিং এর লোকদের সবটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। সাউন্ড চেকের জন্য যখনি সাউন্ড বক্স গুলো বেজে উঠছে পুরো সেন্টার টাই জন্য কেঁপে উঠছে ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যান্ডপার্টি লোক গুলোও বাজনা বাজিয়ে চলেছে। মাঝখানে বড় আলপনার পাশেই জল ভরার কলসি গুলো যেখানে রাখা সেখানেই দেবীকা চৌধুরী আর অঞ্জলি দেবীর দেখা পাওয়া গেল হাসি মুখে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। মাঝে মাঝে এক রুম থেকে আরেক রুমে কয়েকজন কে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যাচ্ছে, ছোট্ট বাচ্চা গুলোর সাজ সবার আগেই শেষ হয় আর তাই ওদের দলটা একপাশে হুড়োহুড়িতে লেগে পড়েছে, জামাকাপড়ের যে বেহাল দশা করছে তাতে মায়েদের কাছে যে বকুনি খাবে সেটা চিরন্তন সত্য। রুদ্র কয়েকজন পরিচিত বন্ধুর সাথে স্টেজের পাশেই কয়েকটা চেয়ার দখল করে বসে আছে। ওদের সাজসজ্জা নিয়ে এত আয়োজন নেই, সত্যি বলতে বিয়েতে মেয়েদের সাজসজ্জা আর জামাকাপড়, গহনা, পার্লার বা অন্যান্য বিষয়ে যত খেয়াল রাখা হয় এর ফিফটি পার্সেন্টও ছেলেদের দিকে রাখা হয় না। আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দুতেই থাকে করে কনে আর বাকি মেয়েরা আর নারীরা। ছেলেদের আলাদা তেমন কোন আকর্ষণ থাকে না।
রুদ্র চুপচাপ বসে বাকিদের কথা শুনছিলো হঠাৎ দুটো হাত ওর চোখ চেপে ধরে, সেই হাতের চুড়ির শব্দ ওর কানে আসছে। কে হতে পারে সবার সামনে আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া বোকামি হবে, এটা রাই না নিশ্চয়ই তবে কে তনয়া কিংবা রিতা হতে পারে। রূপালির হাত একটু খড়খড়ে কিন্তু এই হাতটা তো মসৃণ আর কোমল, খিলখিল করে হাসছে সেই নারী এই হাসির কন্ঠ আগে কখনো শুনেনি সেই। দু হাত তুলে অপারগতা প্রকাশ করতেই হাত দুটো সরে যায় চোখের সামনে থেকে, চোখ মেলে তাকাতে একজন কে দেখতে পায় মুখটা তার একদম অচেনা নয় কিন্তু অনেকদিন পর দেখছে অনেক বছর পর আবার সেই মানুষটার সাথে দেখা হলো
-জয়..... (মুখে নামটা নিতে নিতেই জড়িয়ে ধরে বাল্যকালের বন্ধুকে, কোন অভিমানে কোন ক্ষোভে এতবছর নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর কাছ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিল সেটার উত্তর এই রুদ্রের কাছে নেই, কখনো ছিলও না। এতবছর পর বন্ধুকে কাছে পেয়ে দুজনের চোখই ভিজে উঠেছে) আমি তো তোকে জানায় নি কিছুই তবে কেমন করে জানলি?
-রাই জানিয়েছে ওর সাথে অনেক আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল, তোকে সারপ্রাইজ দিবো বলেই ওকে কিছু বলতে বারণ করেছিলাম।
-(হঠাৎ চোখে ধরা মেয়েটার কথা মনে পড়তেই পেছন ফেরে তাকায়, বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়া কপালে সিঁদুর হালকা লম্বাটে মুখমন্ডল হাসির ঝিলিকে একজন কে দেখতে পায়, জয়ের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে) উনি কে চিনতে পারলাম না তো।
-তোকে পরিচয় করিয়ে দেই, ও আমার স্ত্রী পল্লবী, আর পল্লবী তোকে ভালো করেই চেনে। গতবছরই বিয়ে করেছি হঠাৎ করেই নইলে তোকে ঠিক জানাতাম।
-ইচ্ছে করেই বলিস নি যদি তোর সুন্দরী বউকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম সেই ভয়ে ( পল্লবীর দিকে ইশারা করে)
-আমি কিন্তু এখনো আমার হ্যান্ডসাম দেবরের সাথে পালাতে রাজি আছি, রাই রাজি থাকলেই হলো ( রুদ্রের পেটের কাছে চিমটি কেটে কথাটা বলতেই হাসির রুল পড়ে যায়)
-সুন্দরী তুমি রাজি থাকলে রাই কে বাদ দিয়ে তোমকেই বিয়ে করে নেব বলে দিলাম...
-ভাই থাক একটাই বউ আমার, সেটাও যদি নিয়ে নিস তবে আমার কি হবে ( পল্লবী কে এক হাতে নিজের কাছে টেনে নেয় জয়)
একে একে নিজের অফিসের কলিগ আর নতুন কিছু বন্ধুদের সাথে জয়ের পরিচয় করিয়ে দেয়, এর মাঝেই তনু ছুটকির সাথে জয় আর পল্লবীর দেখা হয়ে যায় ওরা পল্লবী কে নিয়ে ভেতরের দিকে কোন একটা রুমে চলে যায় সেখানেই হয়তো রাই আছে। জয় আর রুদ্র হাটতে হাটতে কফি স্টলের দিকে এগিয়ে যায়, জয় খুব খুশি আজ রাই আর রুদ্র নিজেদের সব ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে দুজনের ভালোবাসাকে জিতিয়ে দিয়েছে, জয় ও সেটাই চেয়েছিল আজ নিজেকে একটু ভার মুক্ত মনে হচ্ছে। কিন্তু রুদ্রের মুখ তো অন্য কথা বলছে, সবার সামনে হাসিমুখে কথা বলে যাচ্ছে ঠিকি কিন্তু ভেতরে কিছু একটা চেপে রেখেছে নিশ্চয়ই।
সেদিন ঠিকই রুদ্র মনস্থির করে নিয়েছিল রাইয়ের সাথে দেখা হতেই সব কিছু বলে দিবে, যা হবার হবে সেটা পরে দেখা যাবে কিন্তু রাই কে না বলা পর্যন্ত সে কোনমতেই শান্তি পাচ্ছে না, ভেতরের রুদ্র ওকে স্বাভাবিক ভাবে থাকতেই দিচ্ছে না। যদি সব শোনার পর রাই অভিমান করে, দরকার হলে রাই এর পায়ে পড়ে ওকে মানাবার চেষ্টা করবে তবুও সব ওকে বলতেই হবে। নিজেকে তেমন করেই প্রস্তুত করে পরদিন শপিং এ যাবার আগে কিন্তু মানুষ ভাবে এক কিন্তু সেটার বাস্তবে ঘটে আরেক। যাবার পথেই রুদ্রেই সেই মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়, সেই ভয় টা আবার ওকে পেয়ে বসেছে। ভেতরের রুদ্র এবার ওকে ভয় দেখাতে শুরু করেছে, রুদ্রের দুর্বলতায় আঘাত করতে শুরু করেছে, রাইকে হারিয়ে ফেলার ভয় রুদ্রের মাথায় জেকে বসেছে। রুদ্র ভয় পাচ্ছে যদি সব সত্যি জানার পর রাই ওকে ছেড়ে চলে যায় তখন কি হবে? এতবছর পর যাকে কাছে পেয়েছে এখন যদি আবার তাকেই হারিয়ে ফেলে তবে রুদ্র কি করবে! ভেতরের রুদ্র তার খেলা শুরু করে দিয়েছে নিজের বশে নিয়ে এসেছে সব, ভালোবাসা কে ধরে রাখতে হলেও রুদ্রের জীবনের এই অন্ধকার অংশটা লুকিয়েই রাখতে হবে। তেমন যদি হয় তবে কোন বাঁধা আসলে প্রয়োজনে সেই বাঁধা টাকেই উপ্রে দিবে রুদ্র। নিজের মাঝের হিংস্রতা টা জেগে উঠছে, তবে কি কাউকে খুন করতেও মনে দ্বিধা জাগবে না রুদ্রের মনে। না রুদ্র আর নিজের সাথে লড়তে পারে না শেষমেশ নিজের সিদ্ধান্ত বদলে নেয়, রাই কে কিছুই বলবে না এই সম্পর্কে আপাতত না হয় লুকিয়েই রাখলো কিছুদিন, যদি পরে সম্ভব হয় তখন সবকিছু বলে দিবে এছাড়া আর কোন পথ দেখছে না রুদ্র।
এরপরও রুদ্র চেষ্টা করেছে রাই কে বলার কিন্তু রাই এর সামনে গিয়ে সবকিছু কেমন গুলিয়ে যায় ওর, কোথা থেকে শুরু করবে বা কি দিয়ে শুরু করবে সেটা বুঝতে পারে না। আবার যখনি রাই থেকে দূরে থাকে তখন অনুশোচনা ওকে ভেতর থেকে একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছে৷ কিন্তু রুদ্র কি করবে কোথায় যাবে সেটা বুঝতে পারে না কাউকে যদি একটু পাশে পেত তবে হয়তো রুদ্রের এই মানসিক অশান্তি টা একটু হলেও কমতো কিন্তু এমন সময় সবাই বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত রুদ্রের ভিতরে কি হয়ে চলেছে সেটা দেখার মত সময় কারও নেই। রুদ্র কিছু বলতেও পারছে না আবার না বলতে পারার ক্ষতটাও দিন দিন বড় হচ্ছে। কখনো ভাবে এভাবেই সারাজীবন এই কথা গুলো লুকিয়ে রাখবে আবার কখনো এই লুকিয়ে রাখাটা নিজেকে মানসিক ভাবে অপরাধী বানিয়ে দিচ্ছে। একদিন একদিন করে বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে কিন্তু রুদ্রের আর নিজের সেই অন্ধকার সময়ের কথা গুলো বলা হয়ে উঠে না।
মেয়েদের দলটা বেড়িয়ে এসেছে সাথে অঞ্জলি দেবী দেবীকা দেবী আর বাকি আত্মীয় স্বজনরাো আছে, তনু আর ছুটকি সবার সামনে ওদের দুটোর ছবি তুলতে ব্যস্ত ফটোগ্রাফারদের একজন। এখন জল ভরার জন্য বের হবে সবাই, সাথে সাথেই ব্যান্ডপার্টির সানাই ঢোল বেজে উঠলো, বাজনার তালে তালে ছোট বাচ্চা গুলো কোমড় দুলানো শুরু হয়ে গেছে, বড়দের মাঝেও কেউ কেউ হালকা নাচের তালে কোমড় দুলাচ্ছে। এক এক করে সবাই বাহারি নকশা করা কলসি হাতে বেড়িয়ে পড়ছে ঘাটের উদ্দেশ্যে। জলভরা অনুষ্ঠানে ছেলেদের কোন কাজ নেই তাই ছেলেরা সবাই যে যার মত সেন্টারেই আড্ডা দিতে ব্যস্ত। মিনিট ত্রিশেক এর মাঝেই মহিলারা জল ভরা শেষে চলে আসে, সেন্টারের ভেতরে ঢুকতেই ব্যান্ডপার্টির বাজনার তালে সবাই নাচতে শুরু করে, সানাই আর বাশিতে একের পর এক হিট গানের সুর তোলা হচ্ছে আর সেটার তালে ঢোলে বাড়ি পড়তেই এমনিতেই ভিতর থেকে সবার নাচের ভাবটা বের হয়ে আসে। ছোট বড় সব সবাই যে যার মত হাত পা নাচিয়ে কোমর দুলিয়ে নেচে চলেছে। ফটোগ্রাফার আর সিনেমাটোগ্রাফার দের দলটা ভিন্ন ভিন্ন এঙ্গেল থেকে সেই আনন্দের মূহুর্ত গুলো ক্যামেরা বন্দী করে নিচ্ছে। মাথার উপরে ড্রোন উড়ছে, সেখান থেকেও সবার আনন্দ উল্লাস গুলো ক্যামেরার লেন্সে ধরা দিচ্ছে। একটানা নাচের শেষে সবাই যখন হাঁপিয়ে উঠেছে তখন বাজনা বন্ধ হয়, হালকা জিরিয়ে নিয়ে ছুটকি আর তনু মেয়েদের দলটাকে নিয়ে ভেতরে দিকে চলে যায়, ওদের সাথেই শাড়ির আঁচল কোমড়ে পেঁচিয়ে পল্লবীও আছে। একদেখাতেই সবার সাথে সুন্দর মিশে গেছে, এমন মিশুক মানুষ ছাড়া কোন অনুষ্ঠান বাড়ি জমে উঠে না ঠিক মত। ও ভালো নাচতেও জানে এতক্ষণ সবার সাথে বেশ তাল মিলিয়ে নেচে গেছে।
সাউন্ড বক্স গুলো বেজে উঠলো ভেতরের ঘর থেকে রাই বেড়িয়ে আসলো সাথে তনু ছুটকি পল্লবী, সবার চোখে কালো চশমা। সাউন্ড বক্সে বাজানো "কালা চশমা" গানের তালে সবাই নাচের স্টেপ মিলিয়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে আসছে, পাশেই রুদ্র জয় আর ওদের গ্রুপ টাও আছে ওদের সবার চোখেও কালো চশমা। ছেলেরা সবাই টিয়ে রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে আর মেয়েরা গোলাপি রঙের শাড়ি। দুটো রঙ পাশাপাশি দারুন মানিয়েছে। নাচতে নাচতে সবাই স্টেজের সামনে জলভরা কলসি গুলোর এখানে গিয়ে দাড়িয়েছে। দুটো পিড়ির উপর রাই আর রুদ্র কে দাড় করিয়ে বাকিরা গোল হয়ে দাড়িয়েছে। সাউন্ড বক্সে একটা গান বেজে উঠে, গানটা সিলেট অঞ্চলের বিয়ের অনুষ্ঠানে ধামাইল গান হিসেবে বিখ্যাত
জলে গিয়াছিলাম সই
কালা কাজলের পাখি দেইখা আইলাম কই।।
সোনার ও পিঞ্জরা সই গো, রুপার ও টানগুনি
আবের চান্দুয়া দিয়া পিঞ্জরা ঢাকুনি।।
পালিতে পালিসলাম পাখি দুধ কলা দিয়া।।
এগো যাইবার কালে বেঈমান পাখি না চাইল ফিরিয়া।।
ভাইবে রাধারমণ বলে পাখি রইলো কই।।
এগো আইনা দে মোর প্রাণ পাখি পিঞ্জরাতে থুই।।
গানের তালে তালে রাই আর রুদ্র কে মাঝে রেখে সবাই গোল হয়ে হাততালি আর কোমড়ে হাত রেখে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে। রাইও মাঝে মাঝে বাকিদের সাথে যখনি কোমর দুলিয়ে উঠে তখনি সবাই তুমুল হর্ষধ্বনিতে পুরো সেন্টার প্রকম্পিত করে তুলে। রাইয়ের মাথায় গাদা ফুলের সাখে রজনী গন্ধার মালা জড়ানো, টুকটুকে লাল রঙের শাড়ি হাতে ফুল দিয়ে বানানো চুড়ি কানের ফুলের দুলে আর ফুলের টিকলি অসম্ভব সুন্দর লাগছে। রাই প্রায়ই রুদ্রের দুই হাত ধরে ওকেও নাচার জন্য বলছে, রুদ্র এক দুবার কোমড় দুলিয়েই ক্ষান্ত দিচ্ছে।
জলের ঘাটে দেইখা আইলাম
কি সুন্দর শাম রাই
শাম রাই, ভোমরায়
ঘুইরা ঘুইরা মধু খায় ।।
নিত্তি নিত্তি ফুল বাগানে
ভ্রমর আইসা মধু খায়
আয় গো ললিতা সখি
আবার দেখি পুনরায়।।
মুখে হাসি হাতে বাশিঁ
বাজায় বা বন্ধুয়ায়
চাদ বদনে প্রেমের রেখা
কি বা শোভা দেখা যায় ।।
ভাইবে রাধারমণ বলে
পাইলাম না রে হায় রে হায়
পাইতাম যদি প্রান বন্ধুরে
রাখতাম রে পিঞ্জিরায়।।
নাচের পর্ব শেষে বর কনের গায়ে হলুদের পর্ব শুরু হলো, পাঁচ জন এয়ো স্ত্রী একত্রে হলুদ সরিষা আর গিলা বাটতে লাগলো, প্রথমে ছেলের গায়ে হলুদ দিয়ে তারপর মেয়েকে দেয়া হবে। রাই আর রুদ্র পাশাপাশি দুটো পিড়িতে বসে আছে, মাঝে মাঝে সবার অলক্ষ্যে টুকটাক খুনসুটিও করছে তবে বেশির ভাগটাই রাই এর তরফ থেকে। ওদের পাশেই থালা ভর্তি নানা রঙের আবির রাখা, হলুদ পর্ব শেষেই আবির রঙের খেলা হবে সবটাই ছুটকি আর তনুর প্ল্যান অনুসারে করা হচ্ছে৷ দুই বাড়ির দুই ছোট সদস্যের আবদারের কমতি নেই। প্রথমেই বড় রা রুদ্রের গায়ে হলুদ ছোয়ালো, একে একে অঞ্জলি দেবী, দেবীকা দেবী, অবিনাশ বাবু, বিজয় চৌধুরী হলুদ ছোঁয়ার পর বাড়ির অন্যান্য আত্মীয় স্বজনরাও হলুদ ছোঁয়ানো চলছে। হঠাৎ পল্লবী দু হাত ভর্তি হলুদ নিয়ে রুদ্রের পুরো মুখ মাখিয়ে দিলো অতর্কিত আক্রমণ টা সামলেই রুদ্রও পল্লবীর হাত ধরে নিয়ে ওকেও হলুদ মাখিয়ে দেয়৷ এর মাঝেই তনয়া, রিতা ওরাও এসে গেছে সবাই হৈ-হুল্লোড় করে একে অন্যকে হলুদ মাখানো শুরু করলো। অন্যদিকে বড় রা রাই কে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে, রুদ্রের পল্লবীর সাথে হলুদ মাখামাখির দৃশ্য রাইয়ের মনে জেলাস ফিল করায় সবার আড়ালে রুদ্রের উরুতে চিমটি কাটে রাই। ব্যাথা সহ্য করে পাশে তাকাতেই দেখে বড় বড় চোখ করে রাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট বড় সবাই একে অন্যকে হলুদ মাখানো নিয়ে হট্টগোল শুরু করে দিয়েছে। রিতা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠে রুদ্র যেন রাই কে হলুদ মাখিয়ে দেয় কিন্তু হাত দিয়ে না৷ রুদ্র বুঝতে পারে রিতা কিসের ইঙ্গিতে কথাটা বলেছে কিন্তু সবার সামনে একটু ইতস্তত বোধ করছে, এদিকে রাই ও রুদ্রকে না করছে ওর ইচ্ছে থাকলেও সবার সামনে লজ্জা লাগছে। কিন্তু বাকিরা নাছোড়বান্দা হলুদ ছোঁয়াতেই হবে, শেষমেশ রুদ্র রাইয়ের দিকে ঘুরে বসে ওর গালে লেগে থাকা হলুদ রাইয়ের গালে লাগিয়ে দেয়। সাথে সাথে সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠে, রুদ্রও রাইকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে পড়ে।
হলুদ পর্ব শেষে তনু ছুটকি আবির নিয়ে হাজির, একে অন্যের দিকে আবির ছুড়ে দিচ্ছে, আবির রঙে সবাই রঙিন হয়ে উঠেছে বাতাসে উড়তে থাকা আবির রঙে বাতাস টাও রঙিন লাগছে। সাথে সাথেই সাউন্ড বক্সে বেজে উঠে
নাসেক নাসেক হাপাল গিলা
খিলাবো আজি আমরা
তবে মকে ধুরিব, গাওনি মাখাবো
হুবাল গাওনি আজি
প্যাক থাকিবো লাগিবো
নাসেক নাসেক হাপাল গিলা
খিলাবো আজি আমরা
তবে মকে ধুরিব, গাওনি মাখাবো
হুবাল গাওনি আজি
প্যাক থাকিবো লাগিবো
নাসেক নাসেক হাপাল গিলা
চিংরা গাবুর বুরাবুরি
হুবাকো দাকাও শ্রিগ্রী
খিলাবো লাগিবো, হুবাকো আজি
চিংরা গাবুর বুরাবুরি
হুবাকো দাকাও শ্রিগ্রী
খিলাবো লাগিবো, হুবাকো আজি
হে! মরল গুলা!!
মরল গুলা পুইলা রুয়া
লাগাবো আজি ভাই
নাসেক নাসেক
নাসেক নাসেক
দোল দোল দুলুনি রাঙা মাথার চিরুনি
এনে দেবো হাট থেকে
মান তুমি কর না
নোটন নোটন খোপাটি হাতে তুলে দোপাটি
রাঙা ফিতায় বেধে দেবো
মান তুমি করো না
চেয়ে দেখ ডালিম ফুলে ঐ জমেছে মৌ
বউ কথা কও ডাকছে পাখি
কয় না কথা বউ
হে! মরল গুলা!!
মরল গুলা পুইলা রুয়া
লাগাবো আজি ভাই
নাসেক নাসেক
নাসেক নাসেক
গানের তালে সবাই নাচাতে শুরু করলো, উড়তে থাকা আবিরে আশপাশটা ঝাপসা হয়ে গেছে এই ফাঁকে রাই রুদ্রের হাত ধরে খানিকটা নাচতে শুরু করে। যে যার মত করে নেচে চলেছে গানের বিট গুলোই এমন যে মন থেকেই নাচের উদ্রেক বেড়িয়ে আসে। রিতা তনয়া জয় পল্লবী ছুটকি তনু ওদের বন্ধু বান্ধবী রা সবাই নাচছে। বড়রাও কম যায় না তারাও তাদের পুরনো দিনের স্টেপেই নাচছে। একের পর এক হিট গান গুলো বেজে চলেছে।
নাচতে নাচতে সবাই একটু ক্লান্ত এবার ফটোসেশানের পালা, রাই আর রুদ্রকে স্টেজে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওদের সামনেই টেবিলে একটা কেক রাখা তার পাশেই দুধের নাড়ু, সন্দেশ, নানা পদের মিষ্টি। তার সামনেই আপেল-কমলা- আনারস-আনার বিভিন্ন নকশা করে সাজানো হয়েছে। প্রথমে রুদ্রের মা আর রাই এর মা ধান দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করিয়ে মিষ্টি মুখ করায় এরপর ওদের বাবারা আসে, সবার সাথেই ছবি তোলার পর্বও চলতে থাকে। একে একে অন্য আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবরাও স্টেজে উঠে মিষ্টি মুখ করানো ছবি তোলা খুনসুটি এসব চলতে থাকে। রিতা সবার চেয়ে আলাদা ও রাই রুদ্রের মাঝখানে গিয়ে বসে পড়ে আর নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে শুরু করে ওর শিশুসুলভ আচরণে সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে দেয়। জয় আর পল্লবীর খুনসুটিতে পুরো আসর জমজমাট, রুদ্র তো জয় কে সরিয়ে দিয়ে পল্লবী কে ওর পাশে এনে বসায়, পাশে বসা রাই মেকি অভিমানে গাল ফুলানোর অভিনয় করে। এর মাঝেই তনু ছুটকিদের গ্রুপ তাদের পরিবেশনা শুরু করে, অতিথিরা সবাই তাদের আসনে বসে পড়ে। সাউন্ড বক্সে এক এক করে কাঙ্ক্ষিত গান গুলো বেজে উঠছে আর তার সাথেই ছুটকি তনু পল্লবী আর ওদের বান্ধবীরা নাচ পরিবেশন করছে, রিতা তনয়া ওরাও একটা গানে দারুণ কোমড় দুলিয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে ছোট বাচ্চাদের আবদারে ওদের নাচার জন্যও গান বাজাতে হচ্ছে। ওদের কোন রেগুলার স্টেপ নেই মনের ইচ্ছে মত হাত পা ছুড়ছে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, কয়েকজন তো ঘেমে নেয়ে একাকার মায়েরা টেনেও নিয়ে যেতে পারছে না, এই আনন্দটাই অনুষ্ঠান জমিয়ে তুলে। একপাশে খাওয়াদাওয়া শুরু হয়ে গেছে বিজয় চৌধুরী আর অবিনাশ রায় দুজনে অতিথিদের দেখভাল করছে। স্টেজে বসা রুদ্র আর রাই সবটা উপভোগ করে চলেছে, সবার জীবনেই এমন একটা আনন্দ উৎসবের স্বপ্ন থাকে ওদের সেটা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। সামনে রাখা আপেল কমলা অনারসের টুকরো রুদ্র রাইয়ের মুখে তুলে দিচ্ছে, লজ্জা ভরা দৃষ্টিতে রাই সেটা টুক করে মুখে নিয়ে নিচ্ছে।
ছোটদের নাচার পর্ব শেষেই ছুটকি তনু চেয়ার থেকে রুদ্রের আর রাই এর বাবা মা কে টেনে নাচের জায়গায় নিয়ে আসে। অনেক জোড়াজুড়ি করার পর পুরনো দিনের কিছু গানে অবিনাশ- অঞ্জলি, বিজয়-দেবীকা জুটির নাচ পরিবেশন হয়। নাচ শেষে সবাই তুমুল কড়তালিতে তাদের অনেক উৎসাহ জানায়। হালকা নাচের স্টেপে দুই জুটির নাচে পুরো অনুষ্ঠান রোমান্টিক আবহে মেতে উঠে। শেষ আকর্ষণ হিসেবে রাই আর রুদ্র কে নাচার জন্য বলা হয়, রাই এর আগ্রহ দেখে রুদ্র বুঝতে পারে এটা রাই এর প্ল্যান। দুজনের হাত ধরাধরি করে স্টেজ থেকে নেমে আসে, সাউন্ড বক্সে গান বেজে উঠে
কন্যা রে, কন্যা রে,
তোর রূপের মধু মন ভোলায়
আঁকে বাঁকে রোদ ডাকে তোর গালে রাঙা রং মাখায়।
মিছে বায়না করে আয় না তোর চোখেরই ভাষায়,
চাঁদ লাজে এসে কাছে তোর কাজলে লুকায়।
উড়ে যাই ডানা মেলে আজ রে কন্যা,
দক্ষিণে উতলা বাতাস।
তোর আশায় পথ চেয়ে একতারাটা গাইছে গান,
তোর পথে রোজ ফোঁটে ফুলেদেরই অভিমান।
মিছে বায়না করে আয় না তোর চোখেরই ভাষায়,
চাঁদ লাজে এসে কাছে তোর কাজলে লুকায়।
উড়ে যাই ডানা মেলে আজ রে কন্যা,
দক্ষিণে উতলা বাতাস।
তোর কাঁধে ঢেউ দিলে মোর গাঙে ওঠে বান,
তোর চুলে মন ভুলে বাতাস ও গেয়েছে গান।
মিছে বায়না করে আয় না তোর চোখেরই ভাষায়,
চাঁদ লাজে এসে কাছে তোর কাজলে লুকায়।
উড়ে যাই ডানা মেলে আজ রে কন্যা,
দক্ষিণে উতলা বাতাস।
নাচ শেষে রাই এর হালকা লাজের আভায় হাসিমাখা মুখটার দিকে রুদ্র মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। পাশ থেকে পল্লবী এসে চিমটি কাটে
-এখনি এতো তাকিয়ে থাকলে পরে যখন একা পাবে তখন না জানি কি করো।
-(পল্লবীর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে) কি করবো সেটা কি দেখতে চাও নাকি, চাইলে তোমার সাথে প্র্যাকটিক্যাল করে দেখিয়ে দেব।
-ইশশ সখ কতো।
রুদ্র আর রাই কে আবার জলভরা কলসি গুলোর সামনে পিড়িতে বসানো হয়, দুজনের গায়ে দুটো গামছা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। পাঁচ জন এয়ো স্ত্রী উলুধ্বনির সাথে প্রথমে রুদ্রের পরে রাইয়ের মাথায় জল ঢালতে শুরু করে।