26-07-2022, 04:43 PM
আগের পর্বের কিছু অংশ...
আর বাঘমুড়ো কোনরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উর্ধশ্বাসে পালাল নগেনের বাড়ির দেওয়াল টা কে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে। মন্দিরের কোনায় পরে রইল গলিত বোতাম টা কালো হয়ে। নগেনের হাত জ্বালা করছে মারাত্মক। কুকুর টার দিকে তাকিয়ে দেখল, সেটা ধীরে ধীরে লালির রূপ ধারণ করছে। ক্ষমতাধারী বাঘমুড়োর সাথে লড়তে গিয়ে প্রাণ টাই যেতে বসে ছিল মেয়েটার। দেরী করল না নগেন। বারান্দার এক কোনে একটা বিছানার চাদর ছিল। সেটা নিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি উলঙ্গ লালির গায়ে চাপিয়ে দিল। কেঁদে উঠল নগেন হাউ হাউ করে চাদর সমেত লালি কে বুকে করে আঁকড়ে ধরে।
পর্ব উনিশ
লালি শুয়ে ছিল নিজের ঘরে। সর্বাঙ্গে ব্যাথা। বাঘমুড়োর মরণ পাশে যখন লালি আবদ্ধ হয়েছিল, পাঁজরের কিছু হাড়, ভাঙ্গার আওয়াজ লালি পেয়েছিল। সেলফ হিল হচ্ছে দ্রুত। আর তখন ই ব্যাথায় মনে হচ্ছে প্রাণ বের হয়ে যাবে লালির। বুঝতে পারছে মাথায় বসে আছে উমা কাকি। উফ কি সুন্দর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে উমা কাকি মাথায়। এই চরম বেদনা তেও হীরা আর লালির এক ই মা সেটা ভেবে নিল লালি নিজের মতন করে। আহা হীরা নিশ্চই খুব কান্না কাটি করেছে লালির জন্য। উমার হাত টা নিজের গালের নীচে নিয়ে শুয়ে রইল লালি। আর উমা অন্য হাতে লালির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। লালি বুঝতে পারছে বাইরে বাবা, নগেন দাদু জেগে আছে। গলার আওয়াজ পাচ্ছে লালি। হয়ত , না না হয়ত না, রহিম দা , অভি আর হীরা তো থাকবেই। কিন্তু গলার আওয়াজ পাচ্ছে নগেন দাদু আর বাবার। বাকিদের গলার আওয়াজ পাচ্ছে না।
পরেশ বাইরে জেগে। আর মেয়েকে ও বাড়ির বাইরে আর একলা ছাড়বে না, মনে মনে বিড়বিড় করছিল পরেশ। রহিম আর অভি দাঁড়িয়ে উঠোনে ঠায় এই মাঝরাতেও। নগেন ও বসে পরেশের পাশে। পরেশ মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছে আর কাঁদছে। যে মেয়েকে জীবনে কষ্ট পেতে দেয় নি সেই মেয়ের এমন অবস্থায় কোন বাপ নিজেকে স্থির রাখতে পারবে? কিন্তু নগেনের লালির সাথে কথা বলতে হবে। নগেন যা সন্দেহ করছে সেটা যদি সত্যি হয় তবে এটা নিশ্চিত তিনি এই গ্রামেই অধিবাসে আছেন। নগেন পরেশ কে বলল,
- পরেশ বাবা তুই একটু বিশ্রাম নে। তোকে তো সব বলেছি। কোন ভয় নেই আর। আমরা আছি আর উমা ও আছে।
পরেশের চোখ লাল হয়ে আছে কেঁদে কেঁদে। কোন সাড়া দিল না। কিন্তু উঠলো ও না দুয়ার থেকে। তাকিয়ে রইল সামনের অন্ধকারের দিকে। নাহ মেয়েকে ছেড়ে ও উঠবে না। নগেন আবার বলল,
- দ্যাখ, মেয়ে তোর। কষ্ট হয়তো তোর অনেক বেশী পরেশ। কিন্তু বিশ্বাস কর আমিও কম কষ্টে নেই। তার থেকেও রাগে আমার গা হাত পা জ্বলছে। তুই গিয়ে শুয়ে পর। মহাদেব ও শুয়েছে একটু। যা একটু গড়িয়ে নে। আমরা আছি। কথা দিচ্ছি তোকে এই বুড়োর দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে, আমাদের লালি সুরক্ষিত। আর সত্যি করে একটা কথা বল, না আমি না তুই, কেউ তো বাঘমুড়ো কে হারাতে পারব না। পুরো গ্রাম আজকে জেগে। সবাই রাস্তা ঘাটে শাবল গাইতি নিয়ে পাহাড়া দিচ্ছে।
এই বলে হাতের গলে যাওয়া বোতাম টা নেড়ে চেরে দেখতে লাগল নগেন। এক হাতে ভালো বোতাম খানা আর অন্য হাতে গলিত বোতাম টা। কি অসাধ্য সাধন করল এই ছোট্ট জিনিস টা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরেশ শুনছিল নগেনের কথা। এবারে কথা বলল,
- কিন্তু জ্যাঠা, আমার মেয়ের কিছু হবার আগে আমার প্রাণ যাক। জানি সবাই মরব ওই পিশাচের হাতে। শুনেছিলাম বহু আগেও আমাদের গ্রাম শ্মশান হতে হতে বেঁচে গেছিল। কিন্তু আমার মেয়েকে , ও মেরে ফেলার আগে ওই শয়তান কে কষ্ট করতে হবে। আমি দাঁড়াব ওর সামনে জ্যাঠা।
- শুধু তুই না পরেশ, আমিও দাঁড়াব তোর সাথে সবার আগে…
তার আগেই শুনল লালি ডাকছে ভিতর থেকে। আসলে লালি শুনতে পাচ্ছিল ওর বাবা আর নগেন দাদুর কথা।
- দাদু একবার ভিতরে আসবে?
ডাক টা শুনে পরেশ আর নগেন দুজনাই উঠে এলো ঘরে। পিছন পিছন এল রহিম আর অভি। পরেশ এসে দেখল, নাক দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্ত এখনো অল্প অল্প লেগে লালির গায়ে আর গালে। দেখে মনে হচ্ছে অনেক তা আগের থেকে ভাল। বাবা কে দেখে লালি হাসল। পরেশ গিয়ে আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগল। উমা উঠে দাঁড়াল। বলল,
- আপনারা কথা বলুন তো মেয়েটার সাথে। আমি একটু চা করে নিয়ে আসছি।
নগেন বলল,
- সেই ভালো বৌমা। কিন্তু পুকুরের পাড় দিয়ে যেও না আর বাড়ি। এখানেই চা করো।
- আচ্ছা জ্যেঠাবাবা।
নগেন বেড়িয়ে যাওয়া উমা কে জিজ্ঞাসা করল,
- বৌমা, সেই ছোঁড়া কোথায়? ঘুমোচ্ছে?
উমা দাঁড়াল না। কিন্তু বলতে বলতে কেঁদে ফেলল প্রায়। নগেন শুনতে পেল দরজার বাইরে চলে উমার কথা,
- জানিনা জ্যাঠাবাবা, লালি কে এই অবস্থায় দেখে সেই যে গেছে সন্ধ্যে বেলায় আর আমি ওকে দেখিনি।
এটা শুনে লালির বুক কেঁপে উঠলো। কোনো অজানা শক্তির বলে ছিলার মতন উঠে বসে পরল লালি বিছানার উপরে। সবাই মিলে লালি কে ধরতে গেল যাতে পরে না যায়। শুধু নগেন ঠান্ডা মাথায় বলল,
- ওকে নিয়ে চিন্তা করিস না দিদিভাই। এই বিশাল যজ্ঞ ওর ই নির্দেশে হচ্ছে রে দিদি। আজকেও ও না থাকলে তোকে বাঁচাতে পারতাম না।
ততক্ষণে সবাই ধরে লালি কে আবার শুইয়ে দিয়েছে বিছানায়। কিন্তু নগেনের বলা কথা গুলো এমন ই অদ্ভুত যে সবার চোখ নগেনের দিকে চলে গেল। নগেন লালির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
- ভাবিস না মা, আমি একটা বোকা ওকে চিনতে পারিনি। কত বার আমাদের ও বুঝিয়েছে। কিন্তু আমরা বুঝিনি।
রহিম কথা বলল এবারে প্রথম। সেই সন্ধ্যে থেকে গুম হয়ে আছে ও। না পারছে সরাসরি লড়াই এ যেতে, না পারছে ওই শয়তান টার মুন্ডু খানা ছিঁড়ে ফেলতে। তারপরে লালির এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী করছে রহিম। এক ই অবস্থা অভির ও। লালির হাড়গোড় ভাঙ্গা রক্তাক্ত চাদরে ঢাকা অবস্থা টা কারোর ই মন থেকে সরে যাচ্ছে না। রহিম বলল,
- কি বলছ দাদু খোলসা কর।
লালি ছটফট করছিল। হীরা বাড়ি ফেরে নি সেই সন্ধ্যে থেকে ও মানতেই পারছে না। একবার রহিম কে একবার অভি কে বারং বার বলেই চলেছে,
- তোমরা এখানে কেন? যাও না ওকে খুঁজে নিয়ে এস এখনি আমার কাছে। অভি তুই যা ভাই। ওর কোন কান্ডজ্ঞান নেই। যাআআআআ।
শেষ ও করতে পারল না কথা টা। উমার মতই গলা ধরে এলো ওর। বস্তুত দুজনাই ধরে নিয়েছে হীরা আর নেই। নগেন হয়ত বুঝল লালির মনের অবস্থা টা। বুঝল, কত টা ভালোবাসে লালি হীরা কে। পরেশ হাঁ করে তাকিয়ে আছে নগেনের দিকে। নগেনের প্রশান্ত চিন্তা হীন মুখের কারণ বের করতে পারছে না। বস্তুত সবাই যখন নানা কারণে এখানে ভয়গ্রস্ত, আতঙ্কিত। নগেন আবার লালির মাথায় হাত বোলাতে লাগল আর বলল,
- লালি, শান্ত হ দিদি। কোন ভয় নেই ওকে নিয়ে। শান্ত হ। তুই সত্যি করেই ওকে চিনতে পারিস নি?
লালি ভয়ানক অবাক হয়ে গেল। হীরা কে কি চিনবে আলাদা করে ও। ও হীরার অনু পরমাণু চেনে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল নগেনের দিকে। নগেন বলল,
- তুই সেদিন আমাকে যে কথাটা বলেছিলি, চন্ডীমন্ডপে বসে। মানে যেখান থেকে তোরা মণি কোথায় আছে সেই সুত্র টা পেয়েছিলি। সেদিনে তুই বলেছিলি, হীরা বলে এসেছিল, সেই ', বাঁচবে। আর তার ছেলেও বেঁচে আছে তাই তো?
- হ্যাঁ। এই রকম ই হয়েছিল। ওই ',ের কথা মতন হীরা আমাকে নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল গাছের পেটের ভিতরে। তার আগেই এই কথা হীরা বলেছিল সেই ', কে।
- আর এদিকে আমাদের বংশে একটা গল্প আছে। গল্প টা হলো এই যে, তিনশো বছর আগে আমার এক পূর্বপুরুষ ছিলেন। নাম কেদার ভট্টাচার্য্য। উনি রাধা কৃষ্ণ কে সাক্ষাত করেছিলেন। এমন এক সময়ে সাক্ষাত পেয়েছিলেন যখন আমাদের গ্রাম শ্মশান হয়ে গেছিল। একা ছিলেন বলতে গেলে আমার পূর্বপুরুষ। গ্রামের সবাই কে হয় মেরে ফেলেছিল এক পিশাচ আর না হয় ভয়ে সবাই গ্রাম ত্যাগ করেছিল। ঠিক সেই সময়ে রাধা কৃষ্ণ ওনাকে দেখা দিয়েছিলেন। এবং পরিবার কে আশীর্ব্বাদ করেছিলেন। আশীর্ব্বাদ স্বরূপ ছোট্ট একটা জিনিস দিয়েছিলেন লালি। এটা হলো সেই জিনিস টা। যেটার কল্যানে আজকে তুই বেঁচে গেলি।
এই বলে হাতের গলে গিয়ে আকার বদলে যাওয়া হলুদ রঙের বোতাম টা দেখল নগেন সকল কে। লালি দেখল ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের বোতাম। সুতো পরানোর দুটো ঘরের একটা গলে গেছে আর একটা রয়েছে। লালি বলে উঠলো,
- এটা কি?
- আচ্ছা বুঝলি না? এবারে এটা দ্যাখ।
এই বলে লালির হাতে ভালো বোতাম টা দিল নগেন। লালি দুটো জিনিস কে পাশাপাশি রাখতেই বুঝল, এই দুটো বোতাম। একটা গলে গেছে আর একটা অক্ষত আছে। লালি অবাক হয়ে গেল এই দুটো কে নগেন এর হাত দেখে। খুব অবাক হয়ে বলল,
- কোথায় পেলে এই দুটো কে। এটা তো!!
লালির কথা শেষ ও হলো না। নগেন হাসি মুখে বলে উঠল,
- হীরার হলুদ পাঞ্জাবীর বোতাম তো!
- হ্যাঁ কিন্তু তুমি কোথা থেকে পেলে?
লালি জানে এটা হীরার পাঞ্জাবীর বোতাম। কারণ পাঞ্জাবী লালি ই কিনে এনেছিল শহর থেকে হীরা কে জন্মদিনে দেবে বলে। বোতাম টা মনে আছে আরো ভালো কারণ পাঞ্জাবী কাঁচা হলুদ রঙের হলেও বোতাম টা একটু ডিপ ছিল। লালির আপত্তি ছিল বোতামের কালার টার জন্য, কিন্তু পাঞ্জাবী টা এতো পছন্দ হয়েছিল যে বোতামের আলাদা রঙ এর আপত্তি টা ধোপে টেকে নি। কিন্তু পরেশের সামনে বলতে পারছিল না লজ্জায়। বাবা জেনে যাবে অনেক কিছুই বা আন্দাজ করবে অনেক কিছুই। ও ভারী অবাক হয়ে বলল,
- এ তুমি কোথা থেকে পেলে?
- সেটাই তো অবাক ব্যাপার লালি। এই বোতাম দুটো আমাদের পরিবারে গত দশ প্রজন্ম ধরে আছে। অথচ প্লাস্টিকের বোতাম। ওই সময়ে এই প্লাস্টিক আবিষ্কার হয় নি, যে সময় থেকে এই বোতাম টা আমাদের বাড়িতে আছে।
লালির গায়ে কাঁটা দিল। লালি কেন উপস্থিত সকলের গায়ে কাঁটা দিল এবারে। অসম্ভব ব্যাপার বলছে নগেন। লালি বলল,
- তার মানে তুমি সেই মহান অলকৃষের বংশধর?
- হ্যাঁ রে দিদি ভাই, আমি অলকজিত।
- কিছু ভুল হচ্ছে না তো দাদু? এটা খুব বেশী হলে মাস খানেক আগের কেনা।
- না ভুল করছি না। অনেক প্রমাণ আছে দিদি। প্রথমত এই বোতাম দুটো বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ দের কাছেই থাকে। মানে আমার দাদার কাছে ছিল তার আগে আমার বাবা, তার ও আগে আমার জেঠুর কাছে। আমার পরে আমার দাদার ছেলের কাছে থাকবে। পরিবারের এই অতি মূল্যবান জিনিস টা আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহন করে চলেছি।
পরেশের মাথায় কিছু ঢুকছে না বললেই চলে। এই গ্রামের ছেলে সেও। কিন্তু এতো গুহ্য কথা লালি কি ভাবে জানল আর এই কথা বার্তার মানেই বা কি পরেশ বুঝতে পারছে না। কিন্তু নগেন বলেই চলে।
- আমরা চৌধুরী, কিন্তু আমরা আচার্য্য। আমাদের উপনয়ন হয়। কিন্তু খুব সন্তপর্ণে। কেউ জানতে পারে না। তিনদিন অসূর্য্যস্পর্শ্যা হয়ে থাকি আমরা শরীর খারাপের আড়ালে। আমরাই আমাদের পরিবারের গুরু আর আমরাই শিষ্য। ছোট বেলায় আমি ই বুঝতাম না জিনিস টা কি। কারণ আমার ছোট বেলাতেও প্লাস্টিকের আবিষ্কার হয় নি। জন্মাষ্টমীর দিনে প্রণামের জন্য বের করেছিলাম এই মহামূল্যবান জিনিস টা কে। প্রায় দীর্ঘ তিরিশ বছর পরে। কারণ এর আগে আমার দাদার হাতে ছিল এই সম্পদ। তখন ই মনে হয়েছিল এ প্লাস্টিক। কিন্তু তিনশো বছরের লেগাসি বহন করে চলেছি আমরা এই বোতাম কে নিয়ে। আগে মনে হতো এ কোন অন্য জিনিস। ট্রান্সপারেন্ট অথচ শক্ত। মনে হতো সত্যি কৃষ্ণ দিয়েছেন এমন মহামূল্যবান জিনিস। এটা কৃষ্ণ দিয়েছেন এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ এর স্পর্শ মাত্রেই বাঘমুড়ো তোকে ছেড়ে দিয়ে উর্ধশ্বাসে পালালো আমার বাড়ির দেওয়াল ভেঙ্গে। আমাদের ছোটবেলাতেই বলা হত, খুব বিপদ মানে মরণ বাঁচনের মতন বিপদ না আসলে এই বোতাম বাইরে বের না করতে। আমরা কোনদিন এই বোতাম ওই ভেলভেটের বাক্স থেকে বের করিনি। এছাড়া আর ও একটা প্রমাণ আছে।
পরেশ এবারে মুখ খুলল। আসলে ও কিছুই বুঝতে পারছে না। অভি আর রহিম বুঝতে পারলেও কিছু টা, পরেশ একেবারে শূন্য। যদিও নগেন, লালি রহিম আর অভির ক্ষমতার ব্যাপারে বলেছে পরেশ কে। পরেশ ও দেখে বুঝেছে, সমান শক্তিশালী দের মধ্যে যুদ্ধ না হলে, যে পরিমাণ ক্ষয় ক্ষতি নগেন জ্যাঠার বাড়িতে হয়েছে, সেটা হতো না। ও বলে উঠলো,
- কি প্রমাণ প্রমাণ করছ তোমরা? চুপ কর, আমরা আর এই গ্রামে থাকব না। আমি আজ ই ভোর হলে চলে যাব এই গ্রাম ছেড়ে মেয়ে কে নিয়ে। প্রাণ নিয়ে এই গ্রামে আর থাকব না। আর এই অলকজিত টা কে আবার?
পরেশের কথায় নগেনের চোখে জল এলো। বলল,
- হুম তুই পারিস পরেশ চলে যেতে। কিন্তু আমি পারব না। কারণ আমার উঠোনে যে মন্দির আছে সেইখানে রাধা মাধব বসে আছে। তারা যে জীবন্ত রে পরেশ। আমি জানি তারা জীবন্ত।
কেঁদে উঠল নগেন এবারে। বলল,
- আমি চলে গেলে ওদের খেতে দেবে কে? ওদের ঘুম পাড়াবে কে?
পরেশ প্রতিবাদ করল,
- আমার বাড়িতে নেই? রঘুনাথ আমার বাড়িতেও আছে। কিন্তু তিনি ই যখন আমার মেয়েকে এই রকম বিপদে ফেললেন আমি কেন থাকব এই গ্রামে?
লালি এবারে পরেশ কে বলল,
- বাবা তুমি চুপ কর। দাদু কে বলতে দাও। মনে হচ্ছে আমিও বুঝতে পারছি আবছা। দাদু তুমি বল।
নগেন কাঁদতে কাঁদতেই বলতে শুরু করল,
- দিদিভাই, তুই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলি একবার, গ্রামের সব মন্দিরের রাধামাধবের পোশাকে হলুদ ধুতি আছে, তোমার মন্দিরে হলুদ পাঞ্জাবী কেন? আর রাধাই বা বাঙালী শাড়ি পরে কেন? উত্তর আমাদের বংশ তিনশো বছর ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে। উত্তর টা হলো সেদিনে রাধা কৃষ্ণ আমাদের পূর্বপুরুষ কে দেখা দিয়েছিলেন, তারা ঠিক ওই রকম পোশাক পরেই ছিলেন।
লালি বলল কথা।
- হ্যাঁ তুমি ওই উত্তর ই দিয়েছিলে।
নগেন কথা সেশ হবার আগেই বলে উঠলো,
- কিন্তু জানিস দিদি ভাই, ভেবে পেতাম না, তিনশো বছর আগে এমন পাঞ্জাবীর চল তো ছিল না। না চল ছিল এমন ভাবে শাড়ি পরার। তাহলে কি ভাবে এমন ডিজাইনের পাঞ্জাবী আমাদের পূর্বপুরুষ ভেবেছিলেন? বা কি ভাবে তারা রাধা কৃষ্ণ কে দেখেছিলেন এই পোশাকে? কিন্তু চণ্ডীমণ্ডপে তোর কাহিনী শোনার পরে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম। দুয়ে দুয়ে চার করতে পেরেছিলাম। চণ্ডীমণ্ডপে বসেই আমি ভয়ভীত হয়েছিলাম। বুঝে গেছিলাম সেদিনে আমার পূর্বপুরুষ কৃষ্ণ রাধা নয়,তোদের দুজনার সাথে মিলিত হয়েছিলেন। আর সেদিনে আর কেউ নয়, আমাদের হীরা বাঁচিয়ে ছিল আমার পূর্বপুরুষ কে।
নগেনের হাত আপনা থেকেই জোড়া হয়ে মাথায় পৌঁছে গেল। লালির ও মনে পরল, সেদিনে যখন লালিকে হ্যাঁচকা টেনে বুকের মধ্যে নিয়ে, হীরা ঝাঁপ দিলো পোর্টালে, তখন লালি, হীরার পাঞ্জাবী টা বুকের কাছে মুঠো করে ধরেছিল। তাতেই টান পরে বোতাম দুটো ছিঁড়ে গেছিল আর হয়ত পরে গেছিল তিনশ বছর আগের সেই অশ্বত্থ গাছের বেদীতে। লালি আনমনা হয়ে গেল যখন মনে পড়ল, সেই পোর্টালে ঝাঁপ দেবার সময়ে, হাওয়ায় ভাসমান অবস্থাতেই হীরার আঙ্গুল থেকে কিছু একটা বের হয়েছিল নীল রঙের। এদিকে নগেন বলে চলে,
- আর হীরা যে সেই বিশাল আর অমিত শক্তির অংশ তার প্রমাণ হলো, এই বোতামের শক্তি। সামান্য এই বোতামের তেজ সহ্য করতে পারল না বাঘমুড়ো।
ঘরে অখণ্ড নীরবতা। পরেশের মাথায় কিছু না ঢুকলেও বুঝে গেছে গত সহস্র বছর ধরে কৃষ্ণ নাম জপ করা এই গ্রামের বিফলে যায় নি। এই রাত শেষ হবে তাড়াতাড়ি। লালি মনে মনে শিহরিত হচ্ছিল। নিজের স্বপ্নের মানে নিজের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো ওর। বুঝে গেলো ও কে। হীরা কে। কত জন্মের তৃষ্ণা নিয়ে ও এই জন্ম পেয়েছে, শুধু কিছু সময় কাটাবে বলে নিজের আরাধ্যের সাথে। এতোক্ষণে কথা বলল নগেন আবার,
- তাই বলছিলাম দিদি ভাই, ওকে নিয়ে ভাবার কোন মানে হয় না। সে ঠিক আছে। আমাদের জন্যেই কোন কাজ করছে হয়ত। যার জামার বোতাম এতো ক্ষমতা ধরে, না জানি সে কতখানি অসীম ক্ষমতার অধিকারী হবে। ওর ভুলও সহস্র বার ঠিক হয়ে আশির্ব্বাদের মতন ঝরে পরে মানুষের উপরে। চিন্তা করিস না দিদি ভাই। ও সামান্য কেউ না।
লালি কথা গুলো শুনছিল আর ওর মনে হতে লাগল, নিজের শরীরে আর কোন ব্যাথা নেই। ভাঙ্গা হাড় গুলো দ্রুত জোড়া লাগছে লালির। ক্ষত গুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে কোন অদৃশ্য শক্তির কৃপায়। একটা আওয়াজে তাকিয়ে দেখল সামনে চা নিয়ে উমা কাকি এসেছে। চোখে জল উমা কাকির। মহাদেব কাকা ও উঠে এসেছে ঘুম থেকে। থম্থমে মুখ। লালি উঠল বিছানা থেকে। নাহ সামান্য দুর্বলতা ও আর নেই। উঠে প্রণাম করল উমা কাকি কে। বলল,
- কাকি তুমি ভেব না। জানবে এই শরীরে যতক্ষণ প্রাণ আছে, হীরা সুরক্ষিত আছে।
লালি জানে, হীরা যদি সে হয়, একমাত্র অসীম ভালোবাসাই হলো ওই ছোঁড়ার অসীম শক্তির উৎস। লালির মনে পরল, কানুর বলা কাহিনী টা। মর্মোদ্ধার করতে পারল কানুর সেই কাহিনীর।বুঝে গেল এই মহাশক্তির উৎস মানুষের মনের ভিতরে। আর সেটা হলো ভালোবাসা। ভালোবাসার বিশাল শক্তি তেই আমাদের রক্ষাকর্তা বলীয়ান। মধু কৈটভ কোন অসুর ছিল না। ছিল দুটো মারাত্মক বদ গুণ। কৈটভ মানে ঘৃণা। আর মধু মানে স্বার্থ জনিত আকর্ষণ। যে পালন করে তার কাছে এই দুটোই মারাত্মক দোষ। সেদিন ভগবান কোন অসুর কে নয়, মহামায়ার কৃপা তে , মোহ মায়া ত্যাগ করে, নিজের ভিতরেই প্রতিপালিত হওয়া দুটো মহা দোষের হত্যা করেছিলেন। মুক্ত করেছিলেন নিজেকে এই দোষ থেকে। এই দোষ এই সংসারে সব পিতা বা মাতার মধ্যে থাকে। আর তারপরে মোহ মায়া মুক্ত স্থিতধী মুনির মতন ভগবান নিজে ভালোবাসার সাগরে নিমজ্জিত হয়েছিলেন। সত্যি তো ভালোবাসা ছাড়া তো জীবন অচল। নাহ আর সময় নেই। সময় উপস্থিত। হয়তো সে নিজে লড়বে না কিন্তু পথ দেখাবে সে ই।
আর কোন বেদনা নেই শরীরে লালির। মনে হচ্ছে শত শত মৃগেন্দ্রর বল লালির শরীরে। নগেন ও দেখছে লালির চোখে মুখে যেন এক আলাদা জ্যোতি। সত্যি তো সে থাকার প্রমাণ যখন পাওয়া গেছে আর কীসের ভয়? এখন মৃত্যু তেও ভয় নেই নগেনের। রহিম এক অন্যরকম তেজে জ্বলছে। আর অভির চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। এই গভীর রাতে এদের গন্তব্য কোথায় এখন? জলার মাঠ? নগেন বুঝতে পারল, এদের দরকার ছিল এই ভাবনা টা, যে ওদের পিছনে সর্বিশক্তিমান আছে। কিন্তু উমার কোন পরিবর্তন হলো না। চোখের জলে ভিজেই সবাই কে চা দিল। মহাদেব ও চুপ করে আছে। ছেলের চিন্তায় বাবা মা কাতর হবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে ছেলে কত বড় মাতব্বর সেটা তো বাবা মা ভাবতে পারে না। লালির মন ও অস্থির। মনে হচ্ছে এক্ষণি চলে যায় হীরা কে খুঁজতে।
ঠিক সেই সময়েই পেল সবাই আওয়াজ টা। লালি দের বাড়ির পাশেই বাড়ি নগেন দের। এমন নয় যে পাশাপাশি। কারণ দুই বাড়ির মাঝে অনেক ফাঁকা জায়গা। কিন্তু আওয়াজ টা এতো টাই ভয়ঙ্কর যে সবাই মিলে বের হয়ে এল বাইরে। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। আওয়াজ টা শক্ত দেওয়াল ভেঙ্গে পরার আওয়াজ। নগেনের বয়েস হয়েছে বটে, কিন্তু আওয়াজ তার বাড়ি থেকে আসতেই, আর কিছু না ভেবেই নগেন দৌড়ল। লালি নগেন কে একলা ছাড়ল না। পিছন পিছন পিছন দৌড়ল। সাথে রহিম আর অভি। পরেশ পিছনে পিছনে ছুটল লালি কে আটকাতে। মেয়েটার কি হাল ছিল সেটা দেখেছে পরেশ সন্ধ্যে বেলাতেই। এখনো হয়ত পরিপূর্ন সুস্থ হয় নি। নাহ মেয়েটা কে আটকাতেই হবে।
লালি যতক্ষণে পৌঁছল ততক্ষণে গিয়ে দেখল, নগেন দাদুর বাড়ি একেবারে তছনছ। নীচের যে ঘরে নগেন দাদু শুতো সেই ঘরের দেওয়াল টা ভাঙ্গা। বাড়ি তে পৌঁছে দেখল বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে আছে স্থানুর মতন। হয়ত কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না কি হয়ে গেল। লালি অবাক হয়ে গেল। নগেন দাদু কোথায়? ও ছুটে গিয়ে নগেন দাদুর বড় ছেলে বউ দাঁড়িয়েছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করল,
- দাদু কোথায়? কি গো কাকি? ও কাকি?
উত্তর না পেয়ে সামনে যে দাঁড়িয়েছিল তাকেই জিজ্ঞাসা করল লালি পাগলের মতন, ততক্ষণে এসে গেছে পরেশ মহাদেব উমা সবাই পিছন পিছন। লালি পাগলের মতন জিজ্ঞাসা করছে তার একটাই কারণ সেটা হলো, দাদুর কাছে মণির চাবি আছে। একবার দাদু কে ওরা নিয়ে গেলে না জানি কি হবে? লালির পাগলামো দেখে রহিম লালি কে ডাক দিল,
- লালি এই দিকে আয় একবার।
লালি ছুটে গেল রহিমের কাছে। সাথে অভি আর বাকি সবাই। লালি কাছে আসতেই রহিম আঙ্গুল তুলে যেটা দেখালো সেটা দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। দেখলো, পূব দিকে পুকুরের ধারে, নগেন দের বাড়ির পাশেই যে বিশাল জায়গায় ঝোপ ঝাড় আর কলা বনের জঙ্গল ছিল সেখান টা মনে হচ্ছে কিছুটা জায়গা জুড়ে কোন বড় বুলডোজার চলে গেছে। গোল হয়ে দেখা দিচ্ছে বাগান টার শেষ অব্দি। আর কলা গাছ আর ঝোপঝাড়ের জঙ্গল হয়ত দুই পাশে পরে আছে সেই বিশালদেহী বাঘমুড়োর শরীরের চাপে। একলা লালি নয় উপস্থিত সকলেই বুঝে গেল নগেন কে নিয়ে বাঘমুড়ো ওই পথেই গেছে। লালি কোন সময় নস্ট করল না। ওর কুকুরের ইন্সটিঙ্কট বলছে সামনে বিশাল বিপদ। ও দৌড়তে থাকা বাঘমুড়োর শরীরের চাপে ভগ্নপ্রায় গাছপালা, বাড়ি, রাস্তা অনুসরণ করে পিছু নিল। ও যে শুনতে পাচ্ছে বাঘমুড়োর পায়ের আওয়াজ। ও জানে বাঘমুড়ো ওকে অন্য কোন কম্পাঙ্কে নিয়ে যাবে। কিন্তু পোর্টাল বন্ধ হয়ে যাবার আগেই লালি কে সেই পোর্টালের দরজায় পৌঁছতে হবে। না হলে সমূহ বিপদ।
লালি কে অনুসরণ করে দৌড়তে লাগল রহিম আর অভি। রাতেও লালি দৌড়চ্ছে যেন ও পুরোটাই দেখতে পাচ্ছে। কোন গাছের ছোট্ট ডাল কেও নিপুন ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে লালি। ওকে পৌঁছতেই হবে যে পোর্টালে, না হলে কোন জায়গায় নিয়ে যাবে নগেন দাদু কে কেউ জানতেও পারবে না। দ্রুততার সাথেই লালি বুঝতে পারল বাঘমুড়ো বেশী দূরে নেই। খানিক পা গিয়েই কচুবনে প্রবেশের আগে দেখতে পেল বাঘমুড়ো কে। নগেন দাদু কে প্রায় বগলদাবা করে, অতুল বলের অধিকারী বাঘমুড়ো একটা পোর্টাল কী এর দিকে ছুটে যাচ্ছে। লালি জানে ওই পোর্টাল কী বন্ধ হবে পাঁচ সেকেন্ডে। বাঘমুড়ো প্রবেশ করল পোর্টাল এ আর সাথে সাথেই লালি, লালির পিছনে রহিম আর অভি।
কিন্তু তিনজনে দিশাহারা হয়ে গেল তারপরে। এখানে অন্ধকার অনেক বেশী। লালির দৃষ্টি শক্তি কম, কিন্তু লালি কান দিয়ে শুনে আর ঘ্রাণে দিক নির্ণয় করত। কিন্তু এখানে এসে থেকেই লালির কানে যেন দামামা বাজছে। সামনে জলা সেই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ জলা থেকে ভেসে আসা আত্মা দের কান্না লালি কে আর অন্য কিছু শুনতে দিচ্ছে না। কিছু আগে বাঘমুড়োর হৃদয়ের ধুকপুকুনিও শুনতে পাচ্ছিল লালি। এখন কান্না ছাড়া আর কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না। রহিম ও সাধারণত মাটির কাঁপুনিতেই শত্রু কে শনাক্ত করে। কিন্তু বাতাসে এতো বেশী কম্পন জলার পেত্নী দের আওয়াজে যে মাটির কাঁপুনির কোন হদিশ পাচ্ছে না রহিম। আর ততোধিক অন্ধকার। একমাত্র অভি নিজের ধনুকে একটা তীর জুড়ে ধীর পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
- লালি দি, রহিম দা আমার পিছনে এস। এই কচুবন আলাদা। তবে সামনেই জলার মাঠ এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ধীরে ধীরে এস। সাবধান!! সামনেই একটা ছোট গর্ত আছে।
লালি দেখতে পাচ্ছে না কিছুই, কিন্তু কান খাড়া করে আছে, অভি কোথায় পা ফেলছে সেটা শোনার জন্য। সেই ভাবে আন্দাজে এগিয়ে যাচ্ছে। জলার আত্মাদের কান্নার আওয়াজ কে অবদমিত করে শোনার চেষ্টা করছে অভির পায়ের আওয়াজ। আর লালি কে অনুসরণ করছে রহিম। কিছু পরেই অভি অভিজ্ঞ গাইডের মতন , বাকি দুজন কে সেই বিশাল পাতার কচু বন পেরিয়ে জলার মাঠে এনে ফেলল। লালি দেখল নিকষ কালো আঁধারে নিমজ্জিত জলার মাঠ। কিন্তু ধীরে ধীরে এবারে সয়ে আসছে এই আঁধার। সামনের মাঠ আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে সবার কাছেই। লালি বুঝতে পারল সামনে কিছু আছে, যখন দেখল , এগিয়ে যেতে যেতে অভি চকিত হয়ে নিজের ধনুকের ছিলা টেনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
লালি অর ধনুকের লক্ষ্য বরার ভালো করে তাকিয়ে দেখল, আঁধারে দাঁড়িয়ে বিশাল দেহী বাঘমুড়ো আর নীচে পরে আছে নগেন দাদু। ধীরে ধীরে জলার আত্মা দের কান্নার দামামা কে জয় করল লালি। কন্সেন্ট্রেট করল আর ও। জলার কান্না উপেক্ষা করে শোনার চেষ্টা করল নগেন দাদুর হার্টবিট। চলছে দাদুর হৃদপিণ্ড। জলার কান্নার দামামার পাশে, অভি আর রহিম দা র হৃদপিন্ডের শব্দ পেল আর পেল হালকা বাঘমুড়োর ধুকপুকুনি আর খুব ভাল করে শুনলে আর ও কম নগেন দাদুর ধুকপুকুনি। লালি নিশ্চিত হলো, নাহ ঠিক আছে দাদু। একটু দ্রুত চলছে হৃদপিণ্ড, কিন্তু সেটা ভয়ের কারণে। কিন্তু লালি ওদের পিছনে আরো একজনের পায়ের আওয়াজ পেল। সাথে তার ও বুকের ধুকপুকুনি। সাথে তীব্র দুর্গন্ধ। অশ্বথামা!!!!!
আর বাঘমুড়ো কোনরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উর্ধশ্বাসে পালাল নগেনের বাড়ির দেওয়াল টা কে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে। মন্দিরের কোনায় পরে রইল গলিত বোতাম টা কালো হয়ে। নগেনের হাত জ্বালা করছে মারাত্মক। কুকুর টার দিকে তাকিয়ে দেখল, সেটা ধীরে ধীরে লালির রূপ ধারণ করছে। ক্ষমতাধারী বাঘমুড়োর সাথে লড়তে গিয়ে প্রাণ টাই যেতে বসে ছিল মেয়েটার। দেরী করল না নগেন। বারান্দার এক কোনে একটা বিছানার চাদর ছিল। সেটা নিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি উলঙ্গ লালির গায়ে চাপিয়ে দিল। কেঁদে উঠল নগেন হাউ হাউ করে চাদর সমেত লালি কে বুকে করে আঁকড়ে ধরে।
পর্ব উনিশ
লালি শুয়ে ছিল নিজের ঘরে। সর্বাঙ্গে ব্যাথা। বাঘমুড়োর মরণ পাশে যখন লালি আবদ্ধ হয়েছিল, পাঁজরের কিছু হাড়, ভাঙ্গার আওয়াজ লালি পেয়েছিল। সেলফ হিল হচ্ছে দ্রুত। আর তখন ই ব্যাথায় মনে হচ্ছে প্রাণ বের হয়ে যাবে লালির। বুঝতে পারছে মাথায় বসে আছে উমা কাকি। উফ কি সুন্দর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে উমা কাকি মাথায়। এই চরম বেদনা তেও হীরা আর লালির এক ই মা সেটা ভেবে নিল লালি নিজের মতন করে। আহা হীরা নিশ্চই খুব কান্না কাটি করেছে লালির জন্য। উমার হাত টা নিজের গালের নীচে নিয়ে শুয়ে রইল লালি। আর উমা অন্য হাতে লালির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। লালি বুঝতে পারছে বাইরে বাবা, নগেন দাদু জেগে আছে। গলার আওয়াজ পাচ্ছে লালি। হয়ত , না না হয়ত না, রহিম দা , অভি আর হীরা তো থাকবেই। কিন্তু গলার আওয়াজ পাচ্ছে নগেন দাদু আর বাবার। বাকিদের গলার আওয়াজ পাচ্ছে না।
পরেশ বাইরে জেগে। আর মেয়েকে ও বাড়ির বাইরে আর একলা ছাড়বে না, মনে মনে বিড়বিড় করছিল পরেশ। রহিম আর অভি দাঁড়িয়ে উঠোনে ঠায় এই মাঝরাতেও। নগেন ও বসে পরেশের পাশে। পরেশ মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছে আর কাঁদছে। যে মেয়েকে জীবনে কষ্ট পেতে দেয় নি সেই মেয়ের এমন অবস্থায় কোন বাপ নিজেকে স্থির রাখতে পারবে? কিন্তু নগেনের লালির সাথে কথা বলতে হবে। নগেন যা সন্দেহ করছে সেটা যদি সত্যি হয় তবে এটা নিশ্চিত তিনি এই গ্রামেই অধিবাসে আছেন। নগেন পরেশ কে বলল,
- পরেশ বাবা তুই একটু বিশ্রাম নে। তোকে তো সব বলেছি। কোন ভয় নেই আর। আমরা আছি আর উমা ও আছে।
পরেশের চোখ লাল হয়ে আছে কেঁদে কেঁদে। কোন সাড়া দিল না। কিন্তু উঠলো ও না দুয়ার থেকে। তাকিয়ে রইল সামনের অন্ধকারের দিকে। নাহ মেয়েকে ছেড়ে ও উঠবে না। নগেন আবার বলল,
- দ্যাখ, মেয়ে তোর। কষ্ট হয়তো তোর অনেক বেশী পরেশ। কিন্তু বিশ্বাস কর আমিও কম কষ্টে নেই। তার থেকেও রাগে আমার গা হাত পা জ্বলছে। তুই গিয়ে শুয়ে পর। মহাদেব ও শুয়েছে একটু। যা একটু গড়িয়ে নে। আমরা আছি। কথা দিচ্ছি তোকে এই বুড়োর দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে, আমাদের লালি সুরক্ষিত। আর সত্যি করে একটা কথা বল, না আমি না তুই, কেউ তো বাঘমুড়ো কে হারাতে পারব না। পুরো গ্রাম আজকে জেগে। সবাই রাস্তা ঘাটে শাবল গাইতি নিয়ে পাহাড়া দিচ্ছে।
এই বলে হাতের গলে যাওয়া বোতাম টা নেড়ে চেরে দেখতে লাগল নগেন। এক হাতে ভালো বোতাম খানা আর অন্য হাতে গলিত বোতাম টা। কি অসাধ্য সাধন করল এই ছোট্ট জিনিস টা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরেশ শুনছিল নগেনের কথা। এবারে কথা বলল,
- কিন্তু জ্যাঠা, আমার মেয়ের কিছু হবার আগে আমার প্রাণ যাক। জানি সবাই মরব ওই পিশাচের হাতে। শুনেছিলাম বহু আগেও আমাদের গ্রাম শ্মশান হতে হতে বেঁচে গেছিল। কিন্তু আমার মেয়েকে , ও মেরে ফেলার আগে ওই শয়তান কে কষ্ট করতে হবে। আমি দাঁড়াব ওর সামনে জ্যাঠা।
- শুধু তুই না পরেশ, আমিও দাঁড়াব তোর সাথে সবার আগে…
তার আগেই শুনল লালি ডাকছে ভিতর থেকে। আসলে লালি শুনতে পাচ্ছিল ওর বাবা আর নগেন দাদুর কথা।
- দাদু একবার ভিতরে আসবে?
ডাক টা শুনে পরেশ আর নগেন দুজনাই উঠে এলো ঘরে। পিছন পিছন এল রহিম আর অভি। পরেশ এসে দেখল, নাক দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্ত এখনো অল্প অল্প লেগে লালির গায়ে আর গালে। দেখে মনে হচ্ছে অনেক তা আগের থেকে ভাল। বাবা কে দেখে লালি হাসল। পরেশ গিয়ে আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগল। উমা উঠে দাঁড়াল। বলল,
- আপনারা কথা বলুন তো মেয়েটার সাথে। আমি একটু চা করে নিয়ে আসছি।
নগেন বলল,
- সেই ভালো বৌমা। কিন্তু পুকুরের পাড় দিয়ে যেও না আর বাড়ি। এখানেই চা করো।
- আচ্ছা জ্যেঠাবাবা।
নগেন বেড়িয়ে যাওয়া উমা কে জিজ্ঞাসা করল,
- বৌমা, সেই ছোঁড়া কোথায়? ঘুমোচ্ছে?
উমা দাঁড়াল না। কিন্তু বলতে বলতে কেঁদে ফেলল প্রায়। নগেন শুনতে পেল দরজার বাইরে চলে উমার কথা,
- জানিনা জ্যাঠাবাবা, লালি কে এই অবস্থায় দেখে সেই যে গেছে সন্ধ্যে বেলায় আর আমি ওকে দেখিনি।
এটা শুনে লালির বুক কেঁপে উঠলো। কোনো অজানা শক্তির বলে ছিলার মতন উঠে বসে পরল লালি বিছানার উপরে। সবাই মিলে লালি কে ধরতে গেল যাতে পরে না যায়। শুধু নগেন ঠান্ডা মাথায় বলল,
- ওকে নিয়ে চিন্তা করিস না দিদিভাই। এই বিশাল যজ্ঞ ওর ই নির্দেশে হচ্ছে রে দিদি। আজকেও ও না থাকলে তোকে বাঁচাতে পারতাম না।
ততক্ষণে সবাই ধরে লালি কে আবার শুইয়ে দিয়েছে বিছানায়। কিন্তু নগেনের বলা কথা গুলো এমন ই অদ্ভুত যে সবার চোখ নগেনের দিকে চলে গেল। নগেন লালির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
- ভাবিস না মা, আমি একটা বোকা ওকে চিনতে পারিনি। কত বার আমাদের ও বুঝিয়েছে। কিন্তু আমরা বুঝিনি।
রহিম কথা বলল এবারে প্রথম। সেই সন্ধ্যে থেকে গুম হয়ে আছে ও। না পারছে সরাসরি লড়াই এ যেতে, না পারছে ওই শয়তান টার মুন্ডু খানা ছিঁড়ে ফেলতে। তারপরে লালির এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী করছে রহিম। এক ই অবস্থা অভির ও। লালির হাড়গোড় ভাঙ্গা রক্তাক্ত চাদরে ঢাকা অবস্থা টা কারোর ই মন থেকে সরে যাচ্ছে না। রহিম বলল,
- কি বলছ দাদু খোলসা কর।
লালি ছটফট করছিল। হীরা বাড়ি ফেরে নি সেই সন্ধ্যে থেকে ও মানতেই পারছে না। একবার রহিম কে একবার অভি কে বারং বার বলেই চলেছে,
- তোমরা এখানে কেন? যাও না ওকে খুঁজে নিয়ে এস এখনি আমার কাছে। অভি তুই যা ভাই। ওর কোন কান্ডজ্ঞান নেই। যাআআআআ।
শেষ ও করতে পারল না কথা টা। উমার মতই গলা ধরে এলো ওর। বস্তুত দুজনাই ধরে নিয়েছে হীরা আর নেই। নগেন হয়ত বুঝল লালির মনের অবস্থা টা। বুঝল, কত টা ভালোবাসে লালি হীরা কে। পরেশ হাঁ করে তাকিয়ে আছে নগেনের দিকে। নগেনের প্রশান্ত চিন্তা হীন মুখের কারণ বের করতে পারছে না। বস্তুত সবাই যখন নানা কারণে এখানে ভয়গ্রস্ত, আতঙ্কিত। নগেন আবার লালির মাথায় হাত বোলাতে লাগল আর বলল,
- লালি, শান্ত হ দিদি। কোন ভয় নেই ওকে নিয়ে। শান্ত হ। তুই সত্যি করেই ওকে চিনতে পারিস নি?
লালি ভয়ানক অবাক হয়ে গেল। হীরা কে কি চিনবে আলাদা করে ও। ও হীরার অনু পরমাণু চেনে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল নগেনের দিকে। নগেন বলল,
- তুই সেদিন আমাকে যে কথাটা বলেছিলি, চন্ডীমন্ডপে বসে। মানে যেখান থেকে তোরা মণি কোথায় আছে সেই সুত্র টা পেয়েছিলি। সেদিনে তুই বলেছিলি, হীরা বলে এসেছিল, সেই ', বাঁচবে। আর তার ছেলেও বেঁচে আছে তাই তো?
- হ্যাঁ। এই রকম ই হয়েছিল। ওই ',ের কথা মতন হীরা আমাকে নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল গাছের পেটের ভিতরে। তার আগেই এই কথা হীরা বলেছিল সেই ', কে।
- আর এদিকে আমাদের বংশে একটা গল্প আছে। গল্প টা হলো এই যে, তিনশো বছর আগে আমার এক পূর্বপুরুষ ছিলেন। নাম কেদার ভট্টাচার্য্য। উনি রাধা কৃষ্ণ কে সাক্ষাত করেছিলেন। এমন এক সময়ে সাক্ষাত পেয়েছিলেন যখন আমাদের গ্রাম শ্মশান হয়ে গেছিল। একা ছিলেন বলতে গেলে আমার পূর্বপুরুষ। গ্রামের সবাই কে হয় মেরে ফেলেছিল এক পিশাচ আর না হয় ভয়ে সবাই গ্রাম ত্যাগ করেছিল। ঠিক সেই সময়ে রাধা কৃষ্ণ ওনাকে দেখা দিয়েছিলেন। এবং পরিবার কে আশীর্ব্বাদ করেছিলেন। আশীর্ব্বাদ স্বরূপ ছোট্ট একটা জিনিস দিয়েছিলেন লালি। এটা হলো সেই জিনিস টা। যেটার কল্যানে আজকে তুই বেঁচে গেলি।
এই বলে হাতের গলে গিয়ে আকার বদলে যাওয়া হলুদ রঙের বোতাম টা দেখল নগেন সকল কে। লালি দেখল ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের বোতাম। সুতো পরানোর দুটো ঘরের একটা গলে গেছে আর একটা রয়েছে। লালি বলে উঠলো,
- এটা কি?
- আচ্ছা বুঝলি না? এবারে এটা দ্যাখ।
এই বলে লালির হাতে ভালো বোতাম টা দিল নগেন। লালি দুটো জিনিস কে পাশাপাশি রাখতেই বুঝল, এই দুটো বোতাম। একটা গলে গেছে আর একটা অক্ষত আছে। লালি অবাক হয়ে গেল এই দুটো কে নগেন এর হাত দেখে। খুব অবাক হয়ে বলল,
- কোথায় পেলে এই দুটো কে। এটা তো!!
লালির কথা শেষ ও হলো না। নগেন হাসি মুখে বলে উঠল,
- হীরার হলুদ পাঞ্জাবীর বোতাম তো!
- হ্যাঁ কিন্তু তুমি কোথা থেকে পেলে?
লালি জানে এটা হীরার পাঞ্জাবীর বোতাম। কারণ পাঞ্জাবী লালি ই কিনে এনেছিল শহর থেকে হীরা কে জন্মদিনে দেবে বলে। বোতাম টা মনে আছে আরো ভালো কারণ পাঞ্জাবী কাঁচা হলুদ রঙের হলেও বোতাম টা একটু ডিপ ছিল। লালির আপত্তি ছিল বোতামের কালার টার জন্য, কিন্তু পাঞ্জাবী টা এতো পছন্দ হয়েছিল যে বোতামের আলাদা রঙ এর আপত্তি টা ধোপে টেকে নি। কিন্তু পরেশের সামনে বলতে পারছিল না লজ্জায়। বাবা জেনে যাবে অনেক কিছুই বা আন্দাজ করবে অনেক কিছুই। ও ভারী অবাক হয়ে বলল,
- এ তুমি কোথা থেকে পেলে?
- সেটাই তো অবাক ব্যাপার লালি। এই বোতাম দুটো আমাদের পরিবারে গত দশ প্রজন্ম ধরে আছে। অথচ প্লাস্টিকের বোতাম। ওই সময়ে এই প্লাস্টিক আবিষ্কার হয় নি, যে সময় থেকে এই বোতাম টা আমাদের বাড়িতে আছে।
লালির গায়ে কাঁটা দিল। লালি কেন উপস্থিত সকলের গায়ে কাঁটা দিল এবারে। অসম্ভব ব্যাপার বলছে নগেন। লালি বলল,
- তার মানে তুমি সেই মহান অলকৃষের বংশধর?
- হ্যাঁ রে দিদি ভাই, আমি অলকজিত।
- কিছু ভুল হচ্ছে না তো দাদু? এটা খুব বেশী হলে মাস খানেক আগের কেনা।
- না ভুল করছি না। অনেক প্রমাণ আছে দিদি। প্রথমত এই বোতাম দুটো বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ দের কাছেই থাকে। মানে আমার দাদার কাছে ছিল তার আগে আমার বাবা, তার ও আগে আমার জেঠুর কাছে। আমার পরে আমার দাদার ছেলের কাছে থাকবে। পরিবারের এই অতি মূল্যবান জিনিস টা আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহন করে চলেছি।
পরেশের মাথায় কিছু ঢুকছে না বললেই চলে। এই গ্রামের ছেলে সেও। কিন্তু এতো গুহ্য কথা লালি কি ভাবে জানল আর এই কথা বার্তার মানেই বা কি পরেশ বুঝতে পারছে না। কিন্তু নগেন বলেই চলে।
- আমরা চৌধুরী, কিন্তু আমরা আচার্য্য। আমাদের উপনয়ন হয়। কিন্তু খুব সন্তপর্ণে। কেউ জানতে পারে না। তিনদিন অসূর্য্যস্পর্শ্যা হয়ে থাকি আমরা শরীর খারাপের আড়ালে। আমরাই আমাদের পরিবারের গুরু আর আমরাই শিষ্য। ছোট বেলায় আমি ই বুঝতাম না জিনিস টা কি। কারণ আমার ছোট বেলাতেও প্লাস্টিকের আবিষ্কার হয় নি। জন্মাষ্টমীর দিনে প্রণামের জন্য বের করেছিলাম এই মহামূল্যবান জিনিস টা কে। প্রায় দীর্ঘ তিরিশ বছর পরে। কারণ এর আগে আমার দাদার হাতে ছিল এই সম্পদ। তখন ই মনে হয়েছিল এ প্লাস্টিক। কিন্তু তিনশো বছরের লেগাসি বহন করে চলেছি আমরা এই বোতাম কে নিয়ে। আগে মনে হতো এ কোন অন্য জিনিস। ট্রান্সপারেন্ট অথচ শক্ত। মনে হতো সত্যি কৃষ্ণ দিয়েছেন এমন মহামূল্যবান জিনিস। এটা কৃষ্ণ দিয়েছেন এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ এর স্পর্শ মাত্রেই বাঘমুড়ো তোকে ছেড়ে দিয়ে উর্ধশ্বাসে পালালো আমার বাড়ির দেওয়াল ভেঙ্গে। আমাদের ছোটবেলাতেই বলা হত, খুব বিপদ মানে মরণ বাঁচনের মতন বিপদ না আসলে এই বোতাম বাইরে বের না করতে। আমরা কোনদিন এই বোতাম ওই ভেলভেটের বাক্স থেকে বের করিনি। এছাড়া আর ও একটা প্রমাণ আছে।
পরেশ এবারে মুখ খুলল। আসলে ও কিছুই বুঝতে পারছে না। অভি আর রহিম বুঝতে পারলেও কিছু টা, পরেশ একেবারে শূন্য। যদিও নগেন, লালি রহিম আর অভির ক্ষমতার ব্যাপারে বলেছে পরেশ কে। পরেশ ও দেখে বুঝেছে, সমান শক্তিশালী দের মধ্যে যুদ্ধ না হলে, যে পরিমাণ ক্ষয় ক্ষতি নগেন জ্যাঠার বাড়িতে হয়েছে, সেটা হতো না। ও বলে উঠলো,
- কি প্রমাণ প্রমাণ করছ তোমরা? চুপ কর, আমরা আর এই গ্রামে থাকব না। আমি আজ ই ভোর হলে চলে যাব এই গ্রাম ছেড়ে মেয়ে কে নিয়ে। প্রাণ নিয়ে এই গ্রামে আর থাকব না। আর এই অলকজিত টা কে আবার?
পরেশের কথায় নগেনের চোখে জল এলো। বলল,
- হুম তুই পারিস পরেশ চলে যেতে। কিন্তু আমি পারব না। কারণ আমার উঠোনে যে মন্দির আছে সেইখানে রাধা মাধব বসে আছে। তারা যে জীবন্ত রে পরেশ। আমি জানি তারা জীবন্ত।
কেঁদে উঠল নগেন এবারে। বলল,
- আমি চলে গেলে ওদের খেতে দেবে কে? ওদের ঘুম পাড়াবে কে?
পরেশ প্রতিবাদ করল,
- আমার বাড়িতে নেই? রঘুনাথ আমার বাড়িতেও আছে। কিন্তু তিনি ই যখন আমার মেয়েকে এই রকম বিপদে ফেললেন আমি কেন থাকব এই গ্রামে?
লালি এবারে পরেশ কে বলল,
- বাবা তুমি চুপ কর। দাদু কে বলতে দাও। মনে হচ্ছে আমিও বুঝতে পারছি আবছা। দাদু তুমি বল।
নগেন কাঁদতে কাঁদতেই বলতে শুরু করল,
- দিদিভাই, তুই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলি একবার, গ্রামের সব মন্দিরের রাধামাধবের পোশাকে হলুদ ধুতি আছে, তোমার মন্দিরে হলুদ পাঞ্জাবী কেন? আর রাধাই বা বাঙালী শাড়ি পরে কেন? উত্তর আমাদের বংশ তিনশো বছর ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে। উত্তর টা হলো সেদিনে রাধা কৃষ্ণ আমাদের পূর্বপুরুষ কে দেখা দিয়েছিলেন, তারা ঠিক ওই রকম পোশাক পরেই ছিলেন।
লালি বলল কথা।
- হ্যাঁ তুমি ওই উত্তর ই দিয়েছিলে।
নগেন কথা সেশ হবার আগেই বলে উঠলো,
- কিন্তু জানিস দিদি ভাই, ভেবে পেতাম না, তিনশো বছর আগে এমন পাঞ্জাবীর চল তো ছিল না। না চল ছিল এমন ভাবে শাড়ি পরার। তাহলে কি ভাবে এমন ডিজাইনের পাঞ্জাবী আমাদের পূর্বপুরুষ ভেবেছিলেন? বা কি ভাবে তারা রাধা কৃষ্ণ কে দেখেছিলেন এই পোশাকে? কিন্তু চণ্ডীমণ্ডপে তোর কাহিনী শোনার পরে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম। দুয়ে দুয়ে চার করতে পেরেছিলাম। চণ্ডীমণ্ডপে বসেই আমি ভয়ভীত হয়েছিলাম। বুঝে গেছিলাম সেদিনে আমার পূর্বপুরুষ কৃষ্ণ রাধা নয়,তোদের দুজনার সাথে মিলিত হয়েছিলেন। আর সেদিনে আর কেউ নয়, আমাদের হীরা বাঁচিয়ে ছিল আমার পূর্বপুরুষ কে।
নগেনের হাত আপনা থেকেই জোড়া হয়ে মাথায় পৌঁছে গেল। লালির ও মনে পরল, সেদিনে যখন লালিকে হ্যাঁচকা টেনে বুকের মধ্যে নিয়ে, হীরা ঝাঁপ দিলো পোর্টালে, তখন লালি, হীরার পাঞ্জাবী টা বুকের কাছে মুঠো করে ধরেছিল। তাতেই টান পরে বোতাম দুটো ছিঁড়ে গেছিল আর হয়ত পরে গেছিল তিনশ বছর আগের সেই অশ্বত্থ গাছের বেদীতে। লালি আনমনা হয়ে গেল যখন মনে পড়ল, সেই পোর্টালে ঝাঁপ দেবার সময়ে, হাওয়ায় ভাসমান অবস্থাতেই হীরার আঙ্গুল থেকে কিছু একটা বের হয়েছিল নীল রঙের। এদিকে নগেন বলে চলে,
- আর হীরা যে সেই বিশাল আর অমিত শক্তির অংশ তার প্রমাণ হলো, এই বোতামের শক্তি। সামান্য এই বোতামের তেজ সহ্য করতে পারল না বাঘমুড়ো।
ঘরে অখণ্ড নীরবতা। পরেশের মাথায় কিছু না ঢুকলেও বুঝে গেছে গত সহস্র বছর ধরে কৃষ্ণ নাম জপ করা এই গ্রামের বিফলে যায় নি। এই রাত শেষ হবে তাড়াতাড়ি। লালি মনে মনে শিহরিত হচ্ছিল। নিজের স্বপ্নের মানে নিজের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো ওর। বুঝে গেলো ও কে। হীরা কে। কত জন্মের তৃষ্ণা নিয়ে ও এই জন্ম পেয়েছে, শুধু কিছু সময় কাটাবে বলে নিজের আরাধ্যের সাথে। এতোক্ষণে কথা বলল নগেন আবার,
- তাই বলছিলাম দিদি ভাই, ওকে নিয়ে ভাবার কোন মানে হয় না। সে ঠিক আছে। আমাদের জন্যেই কোন কাজ করছে হয়ত। যার জামার বোতাম এতো ক্ষমতা ধরে, না জানি সে কতখানি অসীম ক্ষমতার অধিকারী হবে। ওর ভুলও সহস্র বার ঠিক হয়ে আশির্ব্বাদের মতন ঝরে পরে মানুষের উপরে। চিন্তা করিস না দিদি ভাই। ও সামান্য কেউ না।
লালি কথা গুলো শুনছিল আর ওর মনে হতে লাগল, নিজের শরীরে আর কোন ব্যাথা নেই। ভাঙ্গা হাড় গুলো দ্রুত জোড়া লাগছে লালির। ক্ষত গুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে কোন অদৃশ্য শক্তির কৃপায়। একটা আওয়াজে তাকিয়ে দেখল সামনে চা নিয়ে উমা কাকি এসেছে। চোখে জল উমা কাকির। মহাদেব কাকা ও উঠে এসেছে ঘুম থেকে। থম্থমে মুখ। লালি উঠল বিছানা থেকে। নাহ সামান্য দুর্বলতা ও আর নেই। উঠে প্রণাম করল উমা কাকি কে। বলল,
- কাকি তুমি ভেব না। জানবে এই শরীরে যতক্ষণ প্রাণ আছে, হীরা সুরক্ষিত আছে।
লালি জানে, হীরা যদি সে হয়, একমাত্র অসীম ভালোবাসাই হলো ওই ছোঁড়ার অসীম শক্তির উৎস। লালির মনে পরল, কানুর বলা কাহিনী টা। মর্মোদ্ধার করতে পারল কানুর সেই কাহিনীর।বুঝে গেল এই মহাশক্তির উৎস মানুষের মনের ভিতরে। আর সেটা হলো ভালোবাসা। ভালোবাসার বিশাল শক্তি তেই আমাদের রক্ষাকর্তা বলীয়ান। মধু কৈটভ কোন অসুর ছিল না। ছিল দুটো মারাত্মক বদ গুণ। কৈটভ মানে ঘৃণা। আর মধু মানে স্বার্থ জনিত আকর্ষণ। যে পালন করে তার কাছে এই দুটোই মারাত্মক দোষ। সেদিন ভগবান কোন অসুর কে নয়, মহামায়ার কৃপা তে , মোহ মায়া ত্যাগ করে, নিজের ভিতরেই প্রতিপালিত হওয়া দুটো মহা দোষের হত্যা করেছিলেন। মুক্ত করেছিলেন নিজেকে এই দোষ থেকে। এই দোষ এই সংসারে সব পিতা বা মাতার মধ্যে থাকে। আর তারপরে মোহ মায়া মুক্ত স্থিতধী মুনির মতন ভগবান নিজে ভালোবাসার সাগরে নিমজ্জিত হয়েছিলেন। সত্যি তো ভালোবাসা ছাড়া তো জীবন অচল। নাহ আর সময় নেই। সময় উপস্থিত। হয়তো সে নিজে লড়বে না কিন্তু পথ দেখাবে সে ই।
আর কোন বেদনা নেই শরীরে লালির। মনে হচ্ছে শত শত মৃগেন্দ্রর বল লালির শরীরে। নগেন ও দেখছে লালির চোখে মুখে যেন এক আলাদা জ্যোতি। সত্যি তো সে থাকার প্রমাণ যখন পাওয়া গেছে আর কীসের ভয়? এখন মৃত্যু তেও ভয় নেই নগেনের। রহিম এক অন্যরকম তেজে জ্বলছে। আর অভির চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। এই গভীর রাতে এদের গন্তব্য কোথায় এখন? জলার মাঠ? নগেন বুঝতে পারল, এদের দরকার ছিল এই ভাবনা টা, যে ওদের পিছনে সর্বিশক্তিমান আছে। কিন্তু উমার কোন পরিবর্তন হলো না। চোখের জলে ভিজেই সবাই কে চা দিল। মহাদেব ও চুপ করে আছে। ছেলের চিন্তায় বাবা মা কাতর হবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে ছেলে কত বড় মাতব্বর সেটা তো বাবা মা ভাবতে পারে না। লালির মন ও অস্থির। মনে হচ্ছে এক্ষণি চলে যায় হীরা কে খুঁজতে।
ঠিক সেই সময়েই পেল সবাই আওয়াজ টা। লালি দের বাড়ির পাশেই বাড়ি নগেন দের। এমন নয় যে পাশাপাশি। কারণ দুই বাড়ির মাঝে অনেক ফাঁকা জায়গা। কিন্তু আওয়াজ টা এতো টাই ভয়ঙ্কর যে সবাই মিলে বের হয়ে এল বাইরে। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। আওয়াজ টা শক্ত দেওয়াল ভেঙ্গে পরার আওয়াজ। নগেনের বয়েস হয়েছে বটে, কিন্তু আওয়াজ তার বাড়ি থেকে আসতেই, আর কিছু না ভেবেই নগেন দৌড়ল। লালি নগেন কে একলা ছাড়ল না। পিছন পিছন পিছন দৌড়ল। সাথে রহিম আর অভি। পরেশ পিছনে পিছনে ছুটল লালি কে আটকাতে। মেয়েটার কি হাল ছিল সেটা দেখেছে পরেশ সন্ধ্যে বেলাতেই। এখনো হয়ত পরিপূর্ন সুস্থ হয় নি। নাহ মেয়েটা কে আটকাতেই হবে।
লালি যতক্ষণে পৌঁছল ততক্ষণে গিয়ে দেখল, নগেন দাদুর বাড়ি একেবারে তছনছ। নীচের যে ঘরে নগেন দাদু শুতো সেই ঘরের দেওয়াল টা ভাঙ্গা। বাড়ি তে পৌঁছে দেখল বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে আছে স্থানুর মতন। হয়ত কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না কি হয়ে গেল। লালি অবাক হয়ে গেল। নগেন দাদু কোথায়? ও ছুটে গিয়ে নগেন দাদুর বড় ছেলে বউ দাঁড়িয়েছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করল,
- দাদু কোথায়? কি গো কাকি? ও কাকি?
উত্তর না পেয়ে সামনে যে দাঁড়িয়েছিল তাকেই জিজ্ঞাসা করল লালি পাগলের মতন, ততক্ষণে এসে গেছে পরেশ মহাদেব উমা সবাই পিছন পিছন। লালি পাগলের মতন জিজ্ঞাসা করছে তার একটাই কারণ সেটা হলো, দাদুর কাছে মণির চাবি আছে। একবার দাদু কে ওরা নিয়ে গেলে না জানি কি হবে? লালির পাগলামো দেখে রহিম লালি কে ডাক দিল,
- লালি এই দিকে আয় একবার।
লালি ছুটে গেল রহিমের কাছে। সাথে অভি আর বাকি সবাই। লালি কাছে আসতেই রহিম আঙ্গুল তুলে যেটা দেখালো সেটা দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। দেখলো, পূব দিকে পুকুরের ধারে, নগেন দের বাড়ির পাশেই যে বিশাল জায়গায় ঝোপ ঝাড় আর কলা বনের জঙ্গল ছিল সেখান টা মনে হচ্ছে কিছুটা জায়গা জুড়ে কোন বড় বুলডোজার চলে গেছে। গোল হয়ে দেখা দিচ্ছে বাগান টার শেষ অব্দি। আর কলা গাছ আর ঝোপঝাড়ের জঙ্গল হয়ত দুই পাশে পরে আছে সেই বিশালদেহী বাঘমুড়োর শরীরের চাপে। একলা লালি নয় উপস্থিত সকলেই বুঝে গেল নগেন কে নিয়ে বাঘমুড়ো ওই পথেই গেছে। লালি কোন সময় নস্ট করল না। ওর কুকুরের ইন্সটিঙ্কট বলছে সামনে বিশাল বিপদ। ও দৌড়তে থাকা বাঘমুড়োর শরীরের চাপে ভগ্নপ্রায় গাছপালা, বাড়ি, রাস্তা অনুসরণ করে পিছু নিল। ও যে শুনতে পাচ্ছে বাঘমুড়োর পায়ের আওয়াজ। ও জানে বাঘমুড়ো ওকে অন্য কোন কম্পাঙ্কে নিয়ে যাবে। কিন্তু পোর্টাল বন্ধ হয়ে যাবার আগেই লালি কে সেই পোর্টালের দরজায় পৌঁছতে হবে। না হলে সমূহ বিপদ।
লালি কে অনুসরণ করে দৌড়তে লাগল রহিম আর অভি। রাতেও লালি দৌড়চ্ছে যেন ও পুরোটাই দেখতে পাচ্ছে। কোন গাছের ছোট্ট ডাল কেও নিপুন ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে লালি। ওকে পৌঁছতেই হবে যে পোর্টালে, না হলে কোন জায়গায় নিয়ে যাবে নগেন দাদু কে কেউ জানতেও পারবে না। দ্রুততার সাথেই লালি বুঝতে পারল বাঘমুড়ো বেশী দূরে নেই। খানিক পা গিয়েই কচুবনে প্রবেশের আগে দেখতে পেল বাঘমুড়ো কে। নগেন দাদু কে প্রায় বগলদাবা করে, অতুল বলের অধিকারী বাঘমুড়ো একটা পোর্টাল কী এর দিকে ছুটে যাচ্ছে। লালি জানে ওই পোর্টাল কী বন্ধ হবে পাঁচ সেকেন্ডে। বাঘমুড়ো প্রবেশ করল পোর্টাল এ আর সাথে সাথেই লালি, লালির পিছনে রহিম আর অভি।
কিন্তু তিনজনে দিশাহারা হয়ে গেল তারপরে। এখানে অন্ধকার অনেক বেশী। লালির দৃষ্টি শক্তি কম, কিন্তু লালি কান দিয়ে শুনে আর ঘ্রাণে দিক নির্ণয় করত। কিন্তু এখানে এসে থেকেই লালির কানে যেন দামামা বাজছে। সামনে জলা সেই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ জলা থেকে ভেসে আসা আত্মা দের কান্না লালি কে আর অন্য কিছু শুনতে দিচ্ছে না। কিছু আগে বাঘমুড়োর হৃদয়ের ধুকপুকুনিও শুনতে পাচ্ছিল লালি। এখন কান্না ছাড়া আর কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না। রহিম ও সাধারণত মাটির কাঁপুনিতেই শত্রু কে শনাক্ত করে। কিন্তু বাতাসে এতো বেশী কম্পন জলার পেত্নী দের আওয়াজে যে মাটির কাঁপুনির কোন হদিশ পাচ্ছে না রহিম। আর ততোধিক অন্ধকার। একমাত্র অভি নিজের ধনুকে একটা তীর জুড়ে ধীর পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
- লালি দি, রহিম দা আমার পিছনে এস। এই কচুবন আলাদা। তবে সামনেই জলার মাঠ এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ধীরে ধীরে এস। সাবধান!! সামনেই একটা ছোট গর্ত আছে।
লালি দেখতে পাচ্ছে না কিছুই, কিন্তু কান খাড়া করে আছে, অভি কোথায় পা ফেলছে সেটা শোনার জন্য। সেই ভাবে আন্দাজে এগিয়ে যাচ্ছে। জলার আত্মাদের কান্নার আওয়াজ কে অবদমিত করে শোনার চেষ্টা করছে অভির পায়ের আওয়াজ। আর লালি কে অনুসরণ করছে রহিম। কিছু পরেই অভি অভিজ্ঞ গাইডের মতন , বাকি দুজন কে সেই বিশাল পাতার কচু বন পেরিয়ে জলার মাঠে এনে ফেলল। লালি দেখল নিকষ কালো আঁধারে নিমজ্জিত জলার মাঠ। কিন্তু ধীরে ধীরে এবারে সয়ে আসছে এই আঁধার। সামনের মাঠ আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে সবার কাছেই। লালি বুঝতে পারল সামনে কিছু আছে, যখন দেখল , এগিয়ে যেতে যেতে অভি চকিত হয়ে নিজের ধনুকের ছিলা টেনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
লালি অর ধনুকের লক্ষ্য বরার ভালো করে তাকিয়ে দেখল, আঁধারে দাঁড়িয়ে বিশাল দেহী বাঘমুড়ো আর নীচে পরে আছে নগেন দাদু। ধীরে ধীরে জলার আত্মা দের কান্নার দামামা কে জয় করল লালি। কন্সেন্ট্রেট করল আর ও। জলার কান্না উপেক্ষা করে শোনার চেষ্টা করল নগেন দাদুর হার্টবিট। চলছে দাদুর হৃদপিণ্ড। জলার কান্নার দামামার পাশে, অভি আর রহিম দা র হৃদপিন্ডের শব্দ পেল আর পেল হালকা বাঘমুড়োর ধুকপুকুনি আর খুব ভাল করে শুনলে আর ও কম নগেন দাদুর ধুকপুকুনি। লালি নিশ্চিত হলো, নাহ ঠিক আছে দাদু। একটু দ্রুত চলছে হৃদপিণ্ড, কিন্তু সেটা ভয়ের কারণে। কিন্তু লালি ওদের পিছনে আরো একজনের পায়ের আওয়াজ পেল। সাথে তার ও বুকের ধুকপুকুনি। সাথে তীব্র দুর্গন্ধ। অশ্বথামা!!!!!