24-07-2022, 03:26 PM
পর্ব আঠেরো
উপরে উঠে এলো দুজনাই। দুজনের জামা কাপড় ই জলে ভেজা। শীত করতে লাগল লালির। তাও নিজের ওড়না টা নিংড়ে হীরার মাথা মুছিয়ে দিতে লাগল। জিজ্ঞাসা করল,
- কিরে কিছু উপায় পেলি?
মুখ এর সামনে ওড়না দিয়ে মাথা মুছে দেওয়ায় হীরার মাথা টা নড়ছিল। আর ততই বিরক্ত হচ্ছিল হীরা। বিরক্ত হয়েই বলল,
- আরে ধুর!! কি করছ? ছাড় না এবারে। ছোট ছেলে নাকি আমি?
- তুই? তার ও অধম রে। নিজেকে সামলাতে পারে না উনি আমার মণি সামলাতে পুকুরে ঝাঁপ দিলেন!!
হীরা মরে যায় এমন ভালবাসা পেতে। কিছু বলল না হীরা। লালি কে ইচ্ছে মতন নিজের আশ মিটিয়ে হীরার মাথা মুছতে দিল। যেমন দেয় নিজের মা কে। কিন্তু লালির প্রশ্নের উত্তর টা ও দিল। বলল,
- হুম পেয়েছি একটা উপায়।
লালি উৎসাহিত হয়ে পড়ল। জিজ্ঞাসা করল,
- কি পেলি? বল?
- বুঝবে কি?
- দ্যাখ ভালো হচ্ছে না কিন্তু বল।
- আচ্ছা আচ্ছা শোন, বলতো তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, একটা সেট অফ নাম্বারস, যা খুশী হতে পারে হয়ত বলল এক থেকে একশ, একটা সেট অফ নাম্বার। এর মধ্যে থেকে পাঁচ আছে এমন কি কি নাম্বার আছে সেখানে? রিলেট কর, অনেক গুলো টাইম লকার, চাবি এক ই, তার মধ্যে কোন লকার এ মণি আছে?
- মানে? ভালো করে বোঝা।
- বেশ, দেখ এখানে পাঁচ কত গুলো আছে সেটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়, ইম্পর্ট্যান্ট হলো সময়। তোমার কাছে বেস্ট আর ওয়ার্স্ট দুটোই পসিবিলিটি আছে। ওয়ার্স্ট হলো তোমাকে এক থেকে একশ সব কটা নাম্বার কেই শুরু থেকে সার্চ করে যেতে হবে আর দেখতে হবে ভিতরে পাঁচ আছে কিনা। আর বেস্ট তো বেস্ট। তুমি সেই সেই নাম্বার গুলো কেই ভগবানের আশীর্ব্বাদে তুলে নিলে যেগুলো তে পাঁচ আছে। হিসাব মতন ওয়ার্স্ট এর ক্ষেত্রে তোমাকে একশো টা সার্চ করতে হবে আর বেস্ট এর ক্ষেত্রে সার্চ করতে হবে কুড়ি টা নাম্বার, তাইতো?
লালি হিসাব করে বলল
- হ্যাঁ কুড়ি টা পাঁচ আছে এক থেকে একশোর মধ্যে
- বেশ এখন এই সেট অফ নাম্বার টা তুমি ফ্যাক্টোরিয়াল ১০ কর।
- মানে?
- মানে ফ্যাক্টোরিয়াল ১০। ৩৬২৮৮০০। এই নাম্বার সেটের মধ্যে খুঁজতে বলা হয়, কত সময় লাগবে ভেবেছ?
- ওকে! কিন্তু তাতে কি হবে?
- আছে তো ইনফাইনাইট ইউনিভার্স। কিন্তু ১০ টা ইউঁনিভার্স এর ভিতরে এই টাইম লকারের রেপ্লিকা ছড়িয়ে দিলে, পারমুটেশন এ ৩৬২৮৮০০ পসিবিলিটি তৈরি হবে। আর অশ্বথামা কে এতো গুলো পসিবিলিটি তে সার্চ করতে হবে মণি , যেখানে এক ই চাবি দিয়ে টাইম লকার খুলবে। আর ওদের মধ্যে একটা তে থাকবে মহাশিবের এই অনন্ত শক্তিশালী মণি। আর প্রতিটা নকল টাইম লকার হবে এক একটা সময় ফাঁদ। অর্থাৎ একটা বাক্স র রেপ্লিকা আর ও ৩৬২৮৮০০ টা বানানো হল। না ভুল বললাম, বানানো হবে দশ টাই, কিন্তু ওকে কে খুঁজতে ৩৬২৮৮০০ বার ওকে চেষ্টা করতে হবে। আর প্রতিটা বাক্স একটাই চাবি দিয়ে খোলে। যে বাক্সে মণি নেই সেই বাক্সে বিষধর সাপ বা বিষাক্ত ধোঁয়া বা কোন বিশাল প্রাণঘাতী কীট। প্রতিটা তেই প্রাণের আশঙ্কা। মানে একটা টাইম লকারে ভুল করে ঢুকে গেলে অশ্বথামা কে বের হতে অনেক টা সময় লাগবে। আর বের হয়ে এলেও ওকে ফিরতে হবে সেই পুরোন জায়গায় যেখান থেকে ও শুরু করেছিল। আইডেন্টিক্যাল এই টাইম লকার গুলো চক্রব্যুহের মতন ঘুরতে থাকবে, আসল টা কে ব্যুহের নাভী তে নিয়ে। যেখানে অশ্বথামা পৌঁছতে পৌঁছতে না জানি কত ইউনিভার্স ধ্বংস হবে আর কত তৈরি হবে। হয়ত বা ওর অমরত্ব এই বিশাল ইউনিভার্সের পুনর্বার সিঙ্গুলারিটির সাথে একাত্ম হয়ে যাবে আর ও খুঁজতেই থাকবে সেই মণি কে, সময় চক্রের ফাঁদে ফেঁসে গিয়ে। এটাই ওর জীবন। এই ভাবেই লেখা আছে ওর জীবনের পরিনতি। সেখানে কিছুই পরিনতি পাবে না।
লালি চুপ করে রইল। কোন জবাব তো নেই আর। জিজ্ঞাসা করতে সাহস ও পাচ্ছে না কিছু। এতো প্রশ্নের ভিড়ে হারিয়ে গেল আবার সেই প্রশ্ন, হীরা কি ভাবে এই রেপ্লিকা বানাবে? ভ্যোম হয়ে বসে রইল লালি। আর পারছে না ও। চোখ জড়িয়ে আসছে একেবারে। ভিজে গায়েই, সিক্ত হীরার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল লালি ক্লান্তি তে। কত স্বপ্ন চোখে ওর। হীরা কে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন। হীরা কিছু না করে না করুক। লালি তো চাকরী করেই। হীরা বসে থাকবে আর লালি শুধু ওকে দেখবে। আহা ছেলেটা কত কষ্ট করেছে। পুরো মথুরা নগরী কে তুলে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে দ্বারকা তে। বদমাশ!! মথুরায় থাকলে পাছে দেখা হয়ে যায় ললিতার সাথে! ললিতা খবর রেখেছিল ওর। দুষ্টু টা বিয়ে করেছিল। সন্তান সন্ততি। কিন্তু ও নিজের বুকে হাত রেখে বলুক, ললিতার মতন এতো ভালো আর কেউ বেসেছিল কিনা ওকে? জানে ললিতা এমন দুষ্টু কে বেঁধে রাখতে ললিতা ছাড়া কেউ পারবে না আর।আর ওকে ছাড়বে না লালি কোন দিন। যদি বাঘমুড়োর থেকে লালি বেঁচে যায়, লজ্জার মাথা খেয়ে ও বাবা কে বলে দেবে হীরা কে ঘর বাঁধার কথা। ওর বাবা নিশ্চই মেনে নেবে। দুটো সন্তান হবে ওদের। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ছেলেটা যেন একেবারে হীরার মতন হয়। সন্ধ্যে বেলায় লালি ফিরবে বাড়িতে, আর তিন জন কে নিয়ে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাবে এই বাঘমুড়ো তেই। উফ হীরা!! এতো সুন্দর বাঁশী কেন বাজাস তুই? জানিস না, এই বাঁশী আমাকে ঘুমোতে দেয় না, জাগতে দেয় না। কেমন অস্থির করে তোলে? ঘুমের মধ্যেই লালি যেন জড়িয়ে ধরল হীরা কে। লালির ঠোঁটে অপার্থিব শান্তির হালকা হাসি। মনে মনে বলল হীরা কে, না না তুই বাজা বাঁশী। তোর বাঁশী ই আমার জীবন কাঠি। কিন্তু কেন বার বার লালি চোখ বুজলেই দেখছে কানু কে? কেন বিয়ের স্বপ্নের সময়ে হীরা কে কানুর সাথে মিশিয়ে ফেলছে লালি। কেন বার বার মনে হচ্ছে হীরার পরিশ্রমের কথা দ্বারকা তে নগরী বসানোর সময়ে? কেন সেদিনের কানুর বৃন্দাবণ ছেড়ে চলে আসার সময়ে বার বার মনে হচ্ছে কানু না ওকে হীরা ছেড়ে চলে যাচ্ছে?
চমকে ঘুম ভাঙল লালির। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল ও হীরার বুকে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছিল। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখল লালি সামান্য ভিজে নেই আর ওর জামাকাপড়। রোদ একেবারে ঝাঁ ঝাঁ করছে। হীরার দিকে তাকাল লালি। দেখল হীরা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে মিটি মিটি। ও কি পুরোটাই স্বপ্ন দেখছিল? তা কি করে হয়? আর ওকে দেখ? যেন কিচ্ছু হয় নি এমন মুখ করে বসে আছে। উফ এমন ঘুম বহুকাল লালি ঘুমোয় নি। নিজেকে কি পরিমাণ হালকা লাগছে লালির বলে বোঝাতে পারা যাবে না। মিষ্টি করে হেসে হীরা ওকে বলল,
- তোমাকে একবার নগেন দাদুর বাড়ি যেতে হবে।
লালি বলল,
- কিন্তু হীরা মণি সেফ তো? অশ্বথামা খুঁজে পাবে না তো আর?
- কি করে বলব? আমি তো নিজেই খুঁজে পাই নি।
লালি আর ও অবাক হয়ে গেল। কি বলছে ছেলেটা। এতোক্ষণ কি তবে স্বপ্নই ছিল সব কিছু? না না তা কি করে হয়? ও বলল,
- আমাকে বোঝালি যে এতো কিছু? টাইম লকার, নাইন্থ ডাইমেনশন ইত্যাদি?
- আমি? কোথায় বোঝালাম? কি বলছ তুমি? স্বপ্ন দেখেছ নাকি? বাবাহ টাইম লকার? কি বস্তু সেটা? তুমি তো এসে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলে। বাবাহ কি নাক ডাক তুমি।
অন্য সময় হলে, এই নাক ডাকার কথায়, লালি ঝগড়া করত হীরার সাথে। কিন্তু আজকে মনটা কেমন একটা হয়ে গেল। অথচ হীরা হাসছে মিটিমিটি। এরকম করছে কেন ছেলেটা। সেদিনের স্বপ্নের কানু আর হীরার মুখ টা অবিকল এক। গায়ে কাঁটা দিল লালির। কেন মনে হচ্ছে সামনে আরাধ্য আর লালি বুঝতে পারছে না সেটা। কেন মনে হচ্ছে হীরা ইচ্ছে করে লালি কে কনফিউজ করছে? হীরা আবার কথা বলল,
- কি গো কি ভাবছ?
- তুই কি কিছু লোকাচ্ছিস আমার থেকে?
হীরা সেই রকম ই মুচকী হেসে জবাব দিল।
- আমি আর কি লোকাবো? লোকানোর কি আছে আমার? সব তো তোমার সামনে আমি খুলে দিয়েছি নিজের সর্বস্ব। এর পরেও এমন কথা বললে কি করে চলবে।
কেমন কথা? লালি আবার কনফিউজ হয়ে গেল। মানে কানু আর হীরা এক ই সেই কথাটা লালি বুঝতে পারছে না নাকি হীরা শুধু একজন যাকে লালি ভালবাসে, সেই কথাটা। এমন দ্বর্থ্যক কথা বলে যে কথার ফাঁদে জড়িয়ে যেতে সময় লাগে না। ঠিক অনন্ত সম্ভাবনার সময়-ফাঁদের মতই এই ছোঁড়া কথার-ফাঁদ বানিয়ে রাখে প্রতি কথায়। লালি কিছু বলতে যাবে এবারে, ঠিক তখন ই উমা কাকি খিড়কী দরজা থেকে হাঁক দিল,
- হীরা!!! কই রে, ভাত দুটো খেয়েই কোথায় গেলি? ঘাটে আছিস নাকি?? ও হীরা। শুতে আয় বাবা!!!!
মায়ের গলা শুনেই হীরা ভয় পেয়ে চলে যাবার সময়ে বলে গেল,
- নগেন দাদু র কাছে যাও।
যে ভাবে পালাল হীরা লালির হাসি পেয়ে গেল। যদিও লালির সন্দেহ ঠিক হলে, এই সব নাটকের জন্যেই ওর নাম নটবর। কিন্তু মন থেকে বোঝা টা নেমে গেল লালির। হীরা কে তেমন ভাবেই পেল এই ক্ষেত্রে যেমন ভাবে ও চায় হীরা কে ওর জীবনে। হীরা দৌড়ে চলে গেল। লালির মনে পড়ল আর সময় নেই, নগেন দাদুর ব্যাপার টা পরিষ্কার করতেই হবে। বা নগেন দাদুর সাথে থাকতে হবে। ও পুকুরের ধার ধরে চলে এল নগেনের বাড়ি।
মনে শতেক দোলাচল নিয়ে নগেনের বাড়ি এল লালি। স্বপ্ন হোক বা যাই হোক, লালি বুঝে গেছে হীরার সাথে কথোপকথন থেকে যে নগেন দাদুদের বাড়িতেই আছে অলায়ুধের বংশধর। হীরা যেমন ভাবে বলল, তেমন ভাবে যদি টাইম লকার কে একটা ভুল্ভুলাইয়া তে ফেলে দিতে পারে কেউ তবে নগেন দাদু লকারের চাবি দিলেও, আসল লকার এ ঢুকতে অনেক সময় ব্যতীত হবে। বা কোন দিন ও কেউ ওই লকারে পৌঁছতে পারবে না। মনের মধ্যে হাজার হাজার প্রশ্ন ভিড় করে এল। অশ্বথামা কে না হয় আটকানো গেল মণি নেওয়ার থেকে। কিন্তু অশ্বথামা ও তো বিশাল বীর। ওর সামর্থ্য কে, কে চ্যালেঞ্জ জানাবে? একলা বাঘমুড়োর সাথেই তিন জনে মিলে লড়াই করে উঠতে পারা যাচ্ছে না। তারপরে অশ্বথামা যোগ দিলে কি হবে? পুলিশ প্রশাসন? না না অনেক লোকের মৃত্যু ঘটবে এতে। লালি এই বিশাল বিপদে আর কোন নিরীহ প্রাণ কে বলি দিতে পারবে না। এদের কে শেষ করার উপায় বের করতেই হবে। কি উপায়? আচ্ছা নগেন দাদু রা তো অলায়ুধের বংশধর।কোন ক্ষমতা নেই কি ওদের? নাহ দাদুর সাথে কথা বলতেই হবে এখন। সময় কমে আসছে অতি দ্রুত।
ধীর পায়ে নগেনের বাড়িতে ঢুকতেই, গন্ধ টা টের পেল লালি। না বিশ্রী দুর্গন্ধ নয়। পূর্নাংগ বাঘের গন্ধ। ম ম করছে বাড়িময়। কি ব্যাপার? লালি খুব ধীর পায়ে এগিয়ে গেল কলপার হয়ে নগেন দের বারান্দার দিকে। ডান পাশে রাধামাধবের মন্দির টা রেখে বারান্দার কোনে পা রাখল লালি। ঠিক উল্টোদিকের কোনে দেখল বাঘমুড়ো কে। উবু হয়ে বসে আছে। আর তার সামনে কেউ শুয়ে আছে। ভাল করে খেয়াল করল লালি, ওটা নগেন দাদু। নগেন দাদুর চেক লুঙ্গি টা চিনতে পারল লালি। বাঘমুড়ো হয়ত নগেন কে মাটিতে ফেলে গলায় কামড় দিয়ে মাথা টা ছিঁড়ে নেবার উপক্রম করছে। নগেন দাদু কে বাঁচতেই হবে যে। লালির মন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল নগেন কে বাঁচাতেই হবে। আর সাথে সাথে লালির মাথাও সায় দিল। আর তার থেকেও কম সময়ে লালির ভিতরের পশু টা না চাইতেই জেগে উঠলো। সময় নেই আর একদম। ভয়ানক গর্জন করে যে লাফ টা দিল বাঘমুড়ো কে লক্ষ্য করে তাতেই বাঘমুড়ো তাকালো পিছন ফিরে। লালি বুঝতে পারল সেকেন্ডের ও কম সময়ে ওর পোশাক ছিঁড়ে কুচি কুচি হয়ে গেল। সুতির পোশাক, বিশাল কুকুরের শরীর কে নিতে পারল না। মাথার ঘন চুল যেন বদলে গিয়ে সাদা হয়ে গেল। হাত বদলে শক্তিশালী দুটো পা বেড়িয়ে এলো হাওয়া তেই। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। নাকের মধ্যে বাঘের গন্ধ টা ঢুকে একেবারে হৃদয় অব্দি পৌঁছে গেল। চারদিকের আওয়াজ মারাত্মক ভাবে কানে প্রবেশ করতে লাগল লালির। বাঘমুড়োর হৃদপিন্ডের আওয়াজ ও শুনতে পাচ্ছে এখন লালি। শুনতে পাচ্ছে বাঘমুড়োর কয়েক লহমার আতঙ্কের শ্বাসের শব্দ। বাঘমুড়োর ঘুরে তাকানোর খুব অল্প পরিমাণ শব্দ ও লালি শুনতে পাচ্ছে এখন। এতে লালির সুবিধা হয় আক্রমনের। লালি দেখল বাঘমুড়ো বসে আছে এমন ভাবে যেন সমতা নেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। একটা চকিত অসামঞ্জস্য। মুহুর্তের অবাক হয়ে যাওয়া অসতর্ক বাঘমুড়োর গলা এখন লক্ষ্য লালির।
ততক্ষণে বাঘমুড়ো দেখে নিয়েছে বিশাল সাদা কুকুর টা কে। আর শুধু সেটাই দেখে নি। লালি র বদলে যাওয়া টা ও দেখল হাওয়াতেই। আর সেটা দেখেই হয়ত বাঘমুড়ো একটু বিহবল হয়ে গেছিল। চকিতের ইম-ব্যালেন্স। চকিতের অসতর্কতা। ব্যস ওই টুকু সময়েই লালি এসে পড়ল বাঘমুড়োর ঘাড়ে। কিন্তু সে তো শুধু বাঘমুড়ো নয়। সে শিশুপাল। মুহুর্তেই নগেন কে ছেড়ে দুটো হাত দিয়েই আটকাতে গেল লালি কে। আটকেও দিল। লালির বাঘমুড়োর গলার নলী টা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও, আক্রমণ একেবারে বিফলে গেল না। লালির বিশাল শরীরের ধাক্কায় আর সাথে বাঘমুড়ো ছিটকে গেল সেখান থেকে বারান্দার পশ্চিম দিকে। রাখা ছিল একটা ছোট তক্তপোষ। অনেক গুলো বড় বড় কাঁসার ঘড়া, বাসন পত্র। বাঘমুড়োর শরীরের ভারে তক্তপোষ টা কাঠির মতন মড়মড় করে ভেঙ্গে গেল। কাঁসার বাসন পত্র ঝন ঝন করে সান বাঁধানো মেঝেতে পড়ল। মনে হলো ভুমিকম্প হলো বাঘমুড়ো ছিটকে পরার সাথে সাথেই।
বাসনপত্রের ঝনঝনানি থামার সাথে সাথেই কিছুক্ষণের নীরবতা। মনে হলো কিছুক্ষণ আগে এই সব কিচ্ছু হয় নি, এমন ই স্তব্ধতা বিরাজ করছিল তখন। অনেক কষ্টে নগেন দাঁড়াল। বিহবল হয়ে গেছিল নগেন একটু আগে। মনে হচ্ছিল মৃত্যুই সত্য। কিন্তু ঘোর কেটে গেছে নগেনের। দেখল বিশাল কুকুর টা নগেন কে আড়াল করে দাঁড়াল বাঘমুড়োর থেকে। বাঘমুড়ো মনে হয় ঘাবড়ে গেছিল। কিন্তু সহসা উঠে দাঁড়িয়ে পরেই যে হুংকার দিল মনে হলো বারান্দায় ঝোলানো সব ছবি গুলো এবারে খসে পরে যাবে। সেই হুংকারে চারিদিক একেবারে আতঙ্কে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। মনে হলো ঝড় উঠেছে বাইরে। ক্রোধে বারান্দার দেওয়ালে লাথি মারতেই নগেনের বারান্দাটা উঠোনের দিকে হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ল। গ্রিল ছিল লোহার, সেটা প্রায় উড়ে গিয়ে কলপারে , টিউবওয়েলের ধাক্কা খেয়ে খিড়কী দরজা টা কে আটকে দিল। একটা ছোট্ট লাফ মেরে বাইরে বেড়িয়ে উঠোনে এলো বাঘমুড়ো। বস্তুত আহ্বান করল লালি কে যুদ্ধে। নগেনের মনে হলো লালি যুদ্ধে যাবে না। কিন্তু ভাবনা টা শেষ ও হলো না, আবার একটা মারাত্মক আতঙ্কিত হুহুঙ্কারে ভরে গেল চারিদিক। নগেন কান চাপা দিল সেই বিশাল আর্ত রব সহ্য করতে না পেরে। দেখল কি মারাত্মক ক্রোধ নিয়ে গলা উঁচিয়ে লালি বারংবার হুঙ্কার দিতে থাকল। - আআআআউউউউ।
লাফ দিলো কুকুর টা বাইরের দিকে। তোয়াক্কা করল না কিছুর। সেই লাফে এদিকের বারান্দা টাও ভেঙ্গে গেল। লালি বাইরে এসে দাঁড়াল দু ফালি চকচকে দাঁত বের করে। মুহুর্মুহু গর্জনে ভরে উঠলো নগেনের বাড়ি। নগেন দেখল কেউ বেড়িয়ে আসে নি ঘর থেকে। তবে কি কেউ বুঝতে পারছে না এই লড়াই এই শব্দ? কেউ আসছে না কেন? ততক্ষণে নগেন বারান্দা দিয়ে ভয়ে ভয়ে বাইরে তাকাল। দেখল কোথা থেকে কালবৈশাখী এসে হাজির হয়েছে, মহামেঘ দের শাগরেদ করে। সাদা কুকুর টার লম্বা সাদা লোম উড়ছে হাওয়ায়। আর বাঘমুড়োর ক্রোধিত, নৃশংস চাউনি নগেন সহ্য করতে পারল না। একে অপর কে গোল করে উঠোনে ঘুরতে লাগল দুজনে। সুযোগ খুঁজছে একে অপর কে শেষ করে দেবার। নগেন সেদিনে দেখেছে বাঘমুড়ো কে জলার মাঠে লড়তে তিনজনের সাথে। আজকে তো একলা লালি। উফ না এ লড়াই হতে দেওয়া যাবে না কোন ভাবেই। কিন্তু কি ভাবে আটকাবে দুজন কে? ততক্ষণে উঠোনের মাঝে ধুন্ধুমার বেঁধে গেছে। নগেন একবার বাইরে বের হবার চেষ্টা করল। কিন্তু বিশাল লোহার গ্রিল টা, বাঘমুড়ো জোরে লাথি মেরেছিল যে ছিটকে এসে একেবারে দেওয়া ঠেসে গেছে। কোন ভাবেই নড়াতে পারল না নগেন।
চিৎকার করে উঠলো নগেন, যখন বাঘমুড়ো লালির আক্রমণে নিজেকে সামলাতে না পেরে ছিটকে এসে পড়ল কলপারে ঠিক নগেনের পায়ের কাছে। কিন্তু সামনে নগেন থাকা স্বত্বেও বাঘমুড়ো নগেন কে দেখলই না। উঠে দ্বিগুন সামর্থ্যে প্রায় ছুটে গেল লালি কে আঘাত করতে। নগেন তাকিয়ে দেখল বাঘমুড়ো মারাত্মক ক্রোধে বিশাল কুকুর টা কে দুই হাতে তুলে আছাড় মারল উঠোনেই। নগেন কেপে উঠল সেটা দেখে। কিন্তু না আছাড় খেয়েও কোন পরিবর্তন নেই কুকুর টার। আছাড় মারার পরে শরীরের যে তূল্যতা খোয়া গেছিল বাঘমুড়োর, সেইটা কে কাজে লাগিয়েই কুকুর টা চকিতে উঠে বিশাল শরীর নিয়ে বাঘমুড়োর গায়ে ঝাঁপ দিল। বাঘমুড়ো টাল সামলাতে পারল না। পড়ে গেল মাটিতে। আর কুকুর টা ওই অবস্থাতেই বাঘমুড়ো কে নিয়ে গড়াতে গড়াতে রাধামাধবের মন্দিরের কোনায় ধাক্কা খেল। ভেঙ্গে গেলো মন্দিরের সান বাঁধানো কোনা টা। কুকুর টা বাঘমুড়োর গলার নলী টা কামড়ে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। ততক্ষণে ঢের বেশী শক্তিশালী বাঘমুড়ো নিজেকে সামলে নিয়েছে। ওই অবস্থা তেই কুকুর টা গলা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বজ্রসম শক্তিতে গলায় প্যাঁচ দিলো একটা।
নগেন দেখল, কুকুর টা সেই প্যাঁচ ছাড়িয়ে নিতে কি মারাত্মক ছটফটানি শুরু করল। বাঘমুড়ো কে তুলে ফেলল একবার। ঝেড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করল বাঘমুড়ো কে। কিন্তু বাঘমুড়ো কুকুর টার পিছন থেকে সেই যে মরণ প্যাঁচ দিয়েছে, কুকুর টা আর ছাড়াতে পারল না। নগেন দেখছে ধীরে ধীরে লালির ক্ষমতা কমে আসছে। ছটফটানি কমে যাচ্ছে। উফ কি হবে এবারে। বাঘমুড়ো মাটিতে শুয়ে পরেছে কিন্তু নিজের বুকের উপরে বিশাল কুকুর টা কে নিয়ে গলার মরন প্যাঁচ দিয়ে রেখে দিয়েছে। হে মধুসুদন রক্ষা কর মেয়ে টা কে। কি হবে এবারে? মেয়েটা এই ভাবে মারা পরবে? নগেন হাতের সামনে যা ছিল তাই দিয়ে বাঘমুড়ো কে আঘাত শুরু করল। কিন্তু তাতে বাঘমুড়োর কিচ্ছু এলো গেল না। নগেন প্রায় কেঁদে ফেলল। নাতনী সম কাউকে এই ভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখলে কার ই বা মাথার ঠিক থাকে। নগেন আর পারল না নিজেকে সামলাতে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলো সেখানেই।
- যে ভগবান, হে হৃষিকেশ , হে প্রভু আমার সর্বস্ব দিয়ে তুমি মেয়ে টা কে বাঁচাও ঠাকুর। হে প্রভু, হে মধুসূদন।
আর সময় নেই, ধীরে ধীরে কুকুর টার চার পা শিথিল হয়ে আসছে। আগের সেই ছটফটানি আর দেখা যাচ্ছে না। মল্লযুদ্ধে পারদর্শী শিশুপাল নিজের থেকে দ্বিগুন শক্তিধর যোদ্ধাকে পরাজিত করার জ্ঞান আর সামর্থ্য রাখত, সেটা আজকে যুদ্ধে পরিষ্কার। কুকুর টার ক্রোধিত চোখ দুটো মায়া ময় হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে শ্বাস না পেয়ে চোখ বুজে আসছে কুকুর টার। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে নাক দিয়ে কুকুর টার। সাদা রেশমের মতন লোক একেবারে রক্তে লাল হয়ে গেছে। অসহায় ভাবে চেয়ে রইল নগেনের দিকে।
ঠিক সেই সময়ে ঝড় উঠল। ঢং ঢং করে বেজে উঠলো রাধামাধবের মন্দিরের ঘন্টা। ঠিক তখন ই নগেনে মনে পরে গেল একটা কথা। সামনে রাধামধব কে প্রণাম করে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল নগেন। খাটের তলায় একটা বেশ পুরোন, কাঠ আর ধাতুর দিয়ে বানানো একটা বাক্স ছিল। বের করে আনল সেই বাক্স টা নগেন। খুলেই একটা ভেল্ভেটের ছোট্ট বাক্স বের করল নগেন। ভিতরে দেখল আছে জিনিস টা। দুটো ছোট্ট খাপে দুটো ছোট্ট হলুদ রঙের বোতাম। সময় নষ্ট করল না নগেন। একটা বোতাম হাতে নিয়ে প্রণাম করে বেড়িয়ে এলো নগেন বাইরে। দৌড়ে গেলো যুযুধান দুই বিশাল কায়ার দিকে।
ততক্ষণে লালির শেষ অবস্থা। চকচকে দাঁতের মাঝ দিয়ে জিভ টা বের হয়ে এসেছে কুকুর টার। লালা বের হচ্ছে মুখ দিয়ে। বাঘমুড়ো নিশ্চিত হতে পারছে না তাই এখনো ছেড়ে দেয় নি। নগেন আর দেরী করল না। ছুটে গেল বাঘমুড়োর কাছে। রাধামাধব কে প্রণাম করে, বোতাম টা বাঘমুড়োর কপালে ঠেকিয়ে চেপে ধরল নগেন আর বলে উঠল,
- হে প্রভু যদি তুমি সত্যি এসেছিলে সেদিনে , দেখা দিয়েছিলে, তখন রক্ষা করেছিলে আমার পরিবার কে তবে তুমি আজকে এখানে প্রকট হও। বিশ্বাসের মর্যাদা দাও আমার। রক্ষা কর মেয়ে টা কে। হে প্রভু দয়া কর। হে প্রভু দয়া কর।
অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যের মরন আর্তনাদ শুরু করল বাঘমুড়ো। যেখানে বোতাম টা ঠেকিয়েছিল নগেন সেখান টা উত্তপ্ত হতে শুরু করল। নগেনের আঙ্গুল মনে হচ্ছে জ্বলে পুড়ে যাবে যাবে এবারে। কিন্তু নগেন ছাড়ল না আঙ্গুল টা। আঙ্গুল যাক। মেয়েটা বাঁচুক। ছটফট করতে শুরু করল বাঘমুড়ো। মরন প্যাঁচ শিথিল হয়ে গেল ধীরে ধীরে। নগেন বুঝল সেটা যখন কুকুর টা খুব হালকা আওয়াজে গরররররররররর করে উঠল আর মনে হলো কেশে উঠলো। আর কাশীর সাথে এক দলা রক্ত উঠোনে পরল। বাঘমুড়ো যেন আর নিতে পারছিল না সেই উত্তাপ। ছটফট করতে করতে হাত পা ছুঁড়তে শুরু করতেই সেই ধাক্কায় কুকুর টা শূন্যে ছিটকে গিয়ে নগেনের দোতলা বাড়ির উপরের ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে উঠোনে আবার আছাড় খেলো ভুতল কাঁপিয়ে।
আর বাঘমুড়ো কোনরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উর্ধশ্বাসে পালাল নগেনের বাড়ির দেওয়াল টা কে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে। মন্দিরের কোনায় পরে রইল গলিত বোতাম টা কালো হয়ে। নগেনের হাত জ্বালা করছে মারাত্মক। কুকুর টার দিকে তাকিয়ে দেখল, সেটা ধীরে ধীরে লালির রূপ ধারণ করছে। ক্ষমতাধারী বাঘমুড়োর সাথে লড়তে গিয়ে প্রাণ টাই যেতে বসে ছিল মেয়েটার। দেরী করল না নগেন। বারান্দার এক কোনে একটা বিছানার চাদর ছিল। সেটা নিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি উলঙ্গ লালির গায়ে চাপিয়ে দিল। কেঁদে উঠল নগেন হাউ হাউ করে চাদর সমেত লালি কে বুকে করে আঁকড়ে ধরে।
উপরে উঠে এলো দুজনাই। দুজনের জামা কাপড় ই জলে ভেজা। শীত করতে লাগল লালির। তাও নিজের ওড়না টা নিংড়ে হীরার মাথা মুছিয়ে দিতে লাগল। জিজ্ঞাসা করল,
- কিরে কিছু উপায় পেলি?
মুখ এর সামনে ওড়না দিয়ে মাথা মুছে দেওয়ায় হীরার মাথা টা নড়ছিল। আর ততই বিরক্ত হচ্ছিল হীরা। বিরক্ত হয়েই বলল,
- আরে ধুর!! কি করছ? ছাড় না এবারে। ছোট ছেলে নাকি আমি?
- তুই? তার ও অধম রে। নিজেকে সামলাতে পারে না উনি আমার মণি সামলাতে পুকুরে ঝাঁপ দিলেন!!
হীরা মরে যায় এমন ভালবাসা পেতে। কিছু বলল না হীরা। লালি কে ইচ্ছে মতন নিজের আশ মিটিয়ে হীরার মাথা মুছতে দিল। যেমন দেয় নিজের মা কে। কিন্তু লালির প্রশ্নের উত্তর টা ও দিল। বলল,
- হুম পেয়েছি একটা উপায়।
লালি উৎসাহিত হয়ে পড়ল। জিজ্ঞাসা করল,
- কি পেলি? বল?
- বুঝবে কি?
- দ্যাখ ভালো হচ্ছে না কিন্তু বল।
- আচ্ছা আচ্ছা শোন, বলতো তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, একটা সেট অফ নাম্বারস, যা খুশী হতে পারে হয়ত বলল এক থেকে একশ, একটা সেট অফ নাম্বার। এর মধ্যে থেকে পাঁচ আছে এমন কি কি নাম্বার আছে সেখানে? রিলেট কর, অনেক গুলো টাইম লকার, চাবি এক ই, তার মধ্যে কোন লকার এ মণি আছে?
- মানে? ভালো করে বোঝা।
- বেশ, দেখ এখানে পাঁচ কত গুলো আছে সেটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়, ইম্পর্ট্যান্ট হলো সময়। তোমার কাছে বেস্ট আর ওয়ার্স্ট দুটোই পসিবিলিটি আছে। ওয়ার্স্ট হলো তোমাকে এক থেকে একশ সব কটা নাম্বার কেই শুরু থেকে সার্চ করে যেতে হবে আর দেখতে হবে ভিতরে পাঁচ আছে কিনা। আর বেস্ট তো বেস্ট। তুমি সেই সেই নাম্বার গুলো কেই ভগবানের আশীর্ব্বাদে তুলে নিলে যেগুলো তে পাঁচ আছে। হিসাব মতন ওয়ার্স্ট এর ক্ষেত্রে তোমাকে একশো টা সার্চ করতে হবে আর বেস্ট এর ক্ষেত্রে সার্চ করতে হবে কুড়ি টা নাম্বার, তাইতো?
লালি হিসাব করে বলল
- হ্যাঁ কুড়ি টা পাঁচ আছে এক থেকে একশোর মধ্যে
- বেশ এখন এই সেট অফ নাম্বার টা তুমি ফ্যাক্টোরিয়াল ১০ কর।
- মানে?
- মানে ফ্যাক্টোরিয়াল ১০। ৩৬২৮৮০০। এই নাম্বার সেটের মধ্যে খুঁজতে বলা হয়, কত সময় লাগবে ভেবেছ?
- ওকে! কিন্তু তাতে কি হবে?
- আছে তো ইনফাইনাইট ইউনিভার্স। কিন্তু ১০ টা ইউঁনিভার্স এর ভিতরে এই টাইম লকারের রেপ্লিকা ছড়িয়ে দিলে, পারমুটেশন এ ৩৬২৮৮০০ পসিবিলিটি তৈরি হবে। আর অশ্বথামা কে এতো গুলো পসিবিলিটি তে সার্চ করতে হবে মণি , যেখানে এক ই চাবি দিয়ে টাইম লকার খুলবে। আর ওদের মধ্যে একটা তে থাকবে মহাশিবের এই অনন্ত শক্তিশালী মণি। আর প্রতিটা নকল টাইম লকার হবে এক একটা সময় ফাঁদ। অর্থাৎ একটা বাক্স র রেপ্লিকা আর ও ৩৬২৮৮০০ টা বানানো হল। না ভুল বললাম, বানানো হবে দশ টাই, কিন্তু ওকে কে খুঁজতে ৩৬২৮৮০০ বার ওকে চেষ্টা করতে হবে। আর প্রতিটা বাক্স একটাই চাবি দিয়ে খোলে। যে বাক্সে মণি নেই সেই বাক্সে বিষধর সাপ বা বিষাক্ত ধোঁয়া বা কোন বিশাল প্রাণঘাতী কীট। প্রতিটা তেই প্রাণের আশঙ্কা। মানে একটা টাইম লকারে ভুল করে ঢুকে গেলে অশ্বথামা কে বের হতে অনেক টা সময় লাগবে। আর বের হয়ে এলেও ওকে ফিরতে হবে সেই পুরোন জায়গায় যেখান থেকে ও শুরু করেছিল। আইডেন্টিক্যাল এই টাইম লকার গুলো চক্রব্যুহের মতন ঘুরতে থাকবে, আসল টা কে ব্যুহের নাভী তে নিয়ে। যেখানে অশ্বথামা পৌঁছতে পৌঁছতে না জানি কত ইউনিভার্স ধ্বংস হবে আর কত তৈরি হবে। হয়ত বা ওর অমরত্ব এই বিশাল ইউনিভার্সের পুনর্বার সিঙ্গুলারিটির সাথে একাত্ম হয়ে যাবে আর ও খুঁজতেই থাকবে সেই মণি কে, সময় চক্রের ফাঁদে ফেঁসে গিয়ে। এটাই ওর জীবন। এই ভাবেই লেখা আছে ওর জীবনের পরিনতি। সেখানে কিছুই পরিনতি পাবে না।
লালি চুপ করে রইল। কোন জবাব তো নেই আর। জিজ্ঞাসা করতে সাহস ও পাচ্ছে না কিছু। এতো প্রশ্নের ভিড়ে হারিয়ে গেল আবার সেই প্রশ্ন, হীরা কি ভাবে এই রেপ্লিকা বানাবে? ভ্যোম হয়ে বসে রইল লালি। আর পারছে না ও। চোখ জড়িয়ে আসছে একেবারে। ভিজে গায়েই, সিক্ত হীরার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল লালি ক্লান্তি তে। কত স্বপ্ন চোখে ওর। হীরা কে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন। হীরা কিছু না করে না করুক। লালি তো চাকরী করেই। হীরা বসে থাকবে আর লালি শুধু ওকে দেখবে। আহা ছেলেটা কত কষ্ট করেছে। পুরো মথুরা নগরী কে তুলে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে দ্বারকা তে। বদমাশ!! মথুরায় থাকলে পাছে দেখা হয়ে যায় ললিতার সাথে! ললিতা খবর রেখেছিল ওর। দুষ্টু টা বিয়ে করেছিল। সন্তান সন্ততি। কিন্তু ও নিজের বুকে হাত রেখে বলুক, ললিতার মতন এতো ভালো আর কেউ বেসেছিল কিনা ওকে? জানে ললিতা এমন দুষ্টু কে বেঁধে রাখতে ললিতা ছাড়া কেউ পারবে না আর।আর ওকে ছাড়বে না লালি কোন দিন। যদি বাঘমুড়োর থেকে লালি বেঁচে যায়, লজ্জার মাথা খেয়ে ও বাবা কে বলে দেবে হীরা কে ঘর বাঁধার কথা। ওর বাবা নিশ্চই মেনে নেবে। দুটো সন্তান হবে ওদের। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ছেলেটা যেন একেবারে হীরার মতন হয়। সন্ধ্যে বেলায় লালি ফিরবে বাড়িতে, আর তিন জন কে নিয়ে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাবে এই বাঘমুড়ো তেই। উফ হীরা!! এতো সুন্দর বাঁশী কেন বাজাস তুই? জানিস না, এই বাঁশী আমাকে ঘুমোতে দেয় না, জাগতে দেয় না। কেমন অস্থির করে তোলে? ঘুমের মধ্যেই লালি যেন জড়িয়ে ধরল হীরা কে। লালির ঠোঁটে অপার্থিব শান্তির হালকা হাসি। মনে মনে বলল হীরা কে, না না তুই বাজা বাঁশী। তোর বাঁশী ই আমার জীবন কাঠি। কিন্তু কেন বার বার লালি চোখ বুজলেই দেখছে কানু কে? কেন বিয়ের স্বপ্নের সময়ে হীরা কে কানুর সাথে মিশিয়ে ফেলছে লালি। কেন বার বার মনে হচ্ছে হীরার পরিশ্রমের কথা দ্বারকা তে নগরী বসানোর সময়ে? কেন সেদিনের কানুর বৃন্দাবণ ছেড়ে চলে আসার সময়ে বার বার মনে হচ্ছে কানু না ওকে হীরা ছেড়ে চলে যাচ্ছে?
চমকে ঘুম ভাঙল লালির। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল ও হীরার বুকে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছিল। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখল লালি সামান্য ভিজে নেই আর ওর জামাকাপড়। রোদ একেবারে ঝাঁ ঝাঁ করছে। হীরার দিকে তাকাল লালি। দেখল হীরা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে মিটি মিটি। ও কি পুরোটাই স্বপ্ন দেখছিল? তা কি করে হয়? আর ওকে দেখ? যেন কিচ্ছু হয় নি এমন মুখ করে বসে আছে। উফ এমন ঘুম বহুকাল লালি ঘুমোয় নি। নিজেকে কি পরিমাণ হালকা লাগছে লালির বলে বোঝাতে পারা যাবে না। মিষ্টি করে হেসে হীরা ওকে বলল,
- তোমাকে একবার নগেন দাদুর বাড়ি যেতে হবে।
লালি বলল,
- কিন্তু হীরা মণি সেফ তো? অশ্বথামা খুঁজে পাবে না তো আর?
- কি করে বলব? আমি তো নিজেই খুঁজে পাই নি।
লালি আর ও অবাক হয়ে গেল। কি বলছে ছেলেটা। এতোক্ষণ কি তবে স্বপ্নই ছিল সব কিছু? না না তা কি করে হয়? ও বলল,
- আমাকে বোঝালি যে এতো কিছু? টাইম লকার, নাইন্থ ডাইমেনশন ইত্যাদি?
- আমি? কোথায় বোঝালাম? কি বলছ তুমি? স্বপ্ন দেখেছ নাকি? বাবাহ টাইম লকার? কি বস্তু সেটা? তুমি তো এসে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলে। বাবাহ কি নাক ডাক তুমি।
অন্য সময় হলে, এই নাক ডাকার কথায়, লালি ঝগড়া করত হীরার সাথে। কিন্তু আজকে মনটা কেমন একটা হয়ে গেল। অথচ হীরা হাসছে মিটিমিটি। এরকম করছে কেন ছেলেটা। সেদিনের স্বপ্নের কানু আর হীরার মুখ টা অবিকল এক। গায়ে কাঁটা দিল লালির। কেন মনে হচ্ছে সামনে আরাধ্য আর লালি বুঝতে পারছে না সেটা। কেন মনে হচ্ছে হীরা ইচ্ছে করে লালি কে কনফিউজ করছে? হীরা আবার কথা বলল,
- কি গো কি ভাবছ?
- তুই কি কিছু লোকাচ্ছিস আমার থেকে?
হীরা সেই রকম ই মুচকী হেসে জবাব দিল।
- আমি আর কি লোকাবো? লোকানোর কি আছে আমার? সব তো তোমার সামনে আমি খুলে দিয়েছি নিজের সর্বস্ব। এর পরেও এমন কথা বললে কি করে চলবে।
কেমন কথা? লালি আবার কনফিউজ হয়ে গেল। মানে কানু আর হীরা এক ই সেই কথাটা লালি বুঝতে পারছে না নাকি হীরা শুধু একজন যাকে লালি ভালবাসে, সেই কথাটা। এমন দ্বর্থ্যক কথা বলে যে কথার ফাঁদে জড়িয়ে যেতে সময় লাগে না। ঠিক অনন্ত সম্ভাবনার সময়-ফাঁদের মতই এই ছোঁড়া কথার-ফাঁদ বানিয়ে রাখে প্রতি কথায়। লালি কিছু বলতে যাবে এবারে, ঠিক তখন ই উমা কাকি খিড়কী দরজা থেকে হাঁক দিল,
- হীরা!!! কই রে, ভাত দুটো খেয়েই কোথায় গেলি? ঘাটে আছিস নাকি?? ও হীরা। শুতে আয় বাবা!!!!
মায়ের গলা শুনেই হীরা ভয় পেয়ে চলে যাবার সময়ে বলে গেল,
- নগেন দাদু র কাছে যাও।
যে ভাবে পালাল হীরা লালির হাসি পেয়ে গেল। যদিও লালির সন্দেহ ঠিক হলে, এই সব নাটকের জন্যেই ওর নাম নটবর। কিন্তু মন থেকে বোঝা টা নেমে গেল লালির। হীরা কে তেমন ভাবেই পেল এই ক্ষেত্রে যেমন ভাবে ও চায় হীরা কে ওর জীবনে। হীরা দৌড়ে চলে গেল। লালির মনে পড়ল আর সময় নেই, নগেন দাদুর ব্যাপার টা পরিষ্কার করতেই হবে। বা নগেন দাদুর সাথে থাকতে হবে। ও পুকুরের ধার ধরে চলে এল নগেনের বাড়ি।
মনে শতেক দোলাচল নিয়ে নগেনের বাড়ি এল লালি। স্বপ্ন হোক বা যাই হোক, লালি বুঝে গেছে হীরার সাথে কথোপকথন থেকে যে নগেন দাদুদের বাড়িতেই আছে অলায়ুধের বংশধর। হীরা যেমন ভাবে বলল, তেমন ভাবে যদি টাইম লকার কে একটা ভুল্ভুলাইয়া তে ফেলে দিতে পারে কেউ তবে নগেন দাদু লকারের চাবি দিলেও, আসল লকার এ ঢুকতে অনেক সময় ব্যতীত হবে। বা কোন দিন ও কেউ ওই লকারে পৌঁছতে পারবে না। মনের মধ্যে হাজার হাজার প্রশ্ন ভিড় করে এল। অশ্বথামা কে না হয় আটকানো গেল মণি নেওয়ার থেকে। কিন্তু অশ্বথামা ও তো বিশাল বীর। ওর সামর্থ্য কে, কে চ্যালেঞ্জ জানাবে? একলা বাঘমুড়োর সাথেই তিন জনে মিলে লড়াই করে উঠতে পারা যাচ্ছে না। তারপরে অশ্বথামা যোগ দিলে কি হবে? পুলিশ প্রশাসন? না না অনেক লোকের মৃত্যু ঘটবে এতে। লালি এই বিশাল বিপদে আর কোন নিরীহ প্রাণ কে বলি দিতে পারবে না। এদের কে শেষ করার উপায় বের করতেই হবে। কি উপায়? আচ্ছা নগেন দাদু রা তো অলায়ুধের বংশধর।কোন ক্ষমতা নেই কি ওদের? নাহ দাদুর সাথে কথা বলতেই হবে এখন। সময় কমে আসছে অতি দ্রুত।
ধীর পায়ে নগেনের বাড়িতে ঢুকতেই, গন্ধ টা টের পেল লালি। না বিশ্রী দুর্গন্ধ নয়। পূর্নাংগ বাঘের গন্ধ। ম ম করছে বাড়িময়। কি ব্যাপার? লালি খুব ধীর পায়ে এগিয়ে গেল কলপার হয়ে নগেন দের বারান্দার দিকে। ডান পাশে রাধামাধবের মন্দির টা রেখে বারান্দার কোনে পা রাখল লালি। ঠিক উল্টোদিকের কোনে দেখল বাঘমুড়ো কে। উবু হয়ে বসে আছে। আর তার সামনে কেউ শুয়ে আছে। ভাল করে খেয়াল করল লালি, ওটা নগেন দাদু। নগেন দাদুর চেক লুঙ্গি টা চিনতে পারল লালি। বাঘমুড়ো হয়ত নগেন কে মাটিতে ফেলে গলায় কামড় দিয়ে মাথা টা ছিঁড়ে নেবার উপক্রম করছে। নগেন দাদু কে বাঁচতেই হবে যে। লালির মন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল নগেন কে বাঁচাতেই হবে। আর সাথে সাথে লালির মাথাও সায় দিল। আর তার থেকেও কম সময়ে লালির ভিতরের পশু টা না চাইতেই জেগে উঠলো। সময় নেই আর একদম। ভয়ানক গর্জন করে যে লাফ টা দিল বাঘমুড়ো কে লক্ষ্য করে তাতেই বাঘমুড়ো তাকালো পিছন ফিরে। লালি বুঝতে পারল সেকেন্ডের ও কম সময়ে ওর পোশাক ছিঁড়ে কুচি কুচি হয়ে গেল। সুতির পোশাক, বিশাল কুকুরের শরীর কে নিতে পারল না। মাথার ঘন চুল যেন বদলে গিয়ে সাদা হয়ে গেল। হাত বদলে শক্তিশালী দুটো পা বেড়িয়ে এলো হাওয়া তেই। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। নাকের মধ্যে বাঘের গন্ধ টা ঢুকে একেবারে হৃদয় অব্দি পৌঁছে গেল। চারদিকের আওয়াজ মারাত্মক ভাবে কানে প্রবেশ করতে লাগল লালির। বাঘমুড়োর হৃদপিন্ডের আওয়াজ ও শুনতে পাচ্ছে এখন লালি। শুনতে পাচ্ছে বাঘমুড়োর কয়েক লহমার আতঙ্কের শ্বাসের শব্দ। বাঘমুড়োর ঘুরে তাকানোর খুব অল্প পরিমাণ শব্দ ও লালি শুনতে পাচ্ছে এখন। এতে লালির সুবিধা হয় আক্রমনের। লালি দেখল বাঘমুড়ো বসে আছে এমন ভাবে যেন সমতা নেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। একটা চকিত অসামঞ্জস্য। মুহুর্তের অবাক হয়ে যাওয়া অসতর্ক বাঘমুড়োর গলা এখন লক্ষ্য লালির।
ততক্ষণে বাঘমুড়ো দেখে নিয়েছে বিশাল সাদা কুকুর টা কে। আর শুধু সেটাই দেখে নি। লালি র বদলে যাওয়া টা ও দেখল হাওয়াতেই। আর সেটা দেখেই হয়ত বাঘমুড়ো একটু বিহবল হয়ে গেছিল। চকিতের ইম-ব্যালেন্স। চকিতের অসতর্কতা। ব্যস ওই টুকু সময়েই লালি এসে পড়ল বাঘমুড়োর ঘাড়ে। কিন্তু সে তো শুধু বাঘমুড়ো নয়। সে শিশুপাল। মুহুর্তেই নগেন কে ছেড়ে দুটো হাত দিয়েই আটকাতে গেল লালি কে। আটকেও দিল। লালির বাঘমুড়োর গলার নলী টা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও, আক্রমণ একেবারে বিফলে গেল না। লালির বিশাল শরীরের ধাক্কায় আর সাথে বাঘমুড়ো ছিটকে গেল সেখান থেকে বারান্দার পশ্চিম দিকে। রাখা ছিল একটা ছোট তক্তপোষ। অনেক গুলো বড় বড় কাঁসার ঘড়া, বাসন পত্র। বাঘমুড়োর শরীরের ভারে তক্তপোষ টা কাঠির মতন মড়মড় করে ভেঙ্গে গেল। কাঁসার বাসন পত্র ঝন ঝন করে সান বাঁধানো মেঝেতে পড়ল। মনে হলো ভুমিকম্প হলো বাঘমুড়ো ছিটকে পরার সাথে সাথেই।
বাসনপত্রের ঝনঝনানি থামার সাথে সাথেই কিছুক্ষণের নীরবতা। মনে হলো কিছুক্ষণ আগে এই সব কিচ্ছু হয় নি, এমন ই স্তব্ধতা বিরাজ করছিল তখন। অনেক কষ্টে নগেন দাঁড়াল। বিহবল হয়ে গেছিল নগেন একটু আগে। মনে হচ্ছিল মৃত্যুই সত্য। কিন্তু ঘোর কেটে গেছে নগেনের। দেখল বিশাল কুকুর টা নগেন কে আড়াল করে দাঁড়াল বাঘমুড়োর থেকে। বাঘমুড়ো মনে হয় ঘাবড়ে গেছিল। কিন্তু সহসা উঠে দাঁড়িয়ে পরেই যে হুংকার দিল মনে হলো বারান্দায় ঝোলানো সব ছবি গুলো এবারে খসে পরে যাবে। সেই হুংকারে চারিদিক একেবারে আতঙ্কে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। মনে হলো ঝড় উঠেছে বাইরে। ক্রোধে বারান্দার দেওয়ালে লাথি মারতেই নগেনের বারান্দাটা উঠোনের দিকে হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ল। গ্রিল ছিল লোহার, সেটা প্রায় উড়ে গিয়ে কলপারে , টিউবওয়েলের ধাক্কা খেয়ে খিড়কী দরজা টা কে আটকে দিল। একটা ছোট্ট লাফ মেরে বাইরে বেড়িয়ে উঠোনে এলো বাঘমুড়ো। বস্তুত আহ্বান করল লালি কে যুদ্ধে। নগেনের মনে হলো লালি যুদ্ধে যাবে না। কিন্তু ভাবনা টা শেষ ও হলো না, আবার একটা মারাত্মক আতঙ্কিত হুহুঙ্কারে ভরে গেল চারিদিক। নগেন কান চাপা দিল সেই বিশাল আর্ত রব সহ্য করতে না পেরে। দেখল কি মারাত্মক ক্রোধ নিয়ে গলা উঁচিয়ে লালি বারংবার হুঙ্কার দিতে থাকল। - আআআআউউউউ।
লাফ দিলো কুকুর টা বাইরের দিকে। তোয়াক্কা করল না কিছুর। সেই লাফে এদিকের বারান্দা টাও ভেঙ্গে গেল। লালি বাইরে এসে দাঁড়াল দু ফালি চকচকে দাঁত বের করে। মুহুর্মুহু গর্জনে ভরে উঠলো নগেনের বাড়ি। নগেন দেখল কেউ বেড়িয়ে আসে নি ঘর থেকে। তবে কি কেউ বুঝতে পারছে না এই লড়াই এই শব্দ? কেউ আসছে না কেন? ততক্ষণে নগেন বারান্দা দিয়ে ভয়ে ভয়ে বাইরে তাকাল। দেখল কোথা থেকে কালবৈশাখী এসে হাজির হয়েছে, মহামেঘ দের শাগরেদ করে। সাদা কুকুর টার লম্বা সাদা লোম উড়ছে হাওয়ায়। আর বাঘমুড়োর ক্রোধিত, নৃশংস চাউনি নগেন সহ্য করতে পারল না। একে অপর কে গোল করে উঠোনে ঘুরতে লাগল দুজনে। সুযোগ খুঁজছে একে অপর কে শেষ করে দেবার। নগেন সেদিনে দেখেছে বাঘমুড়ো কে জলার মাঠে লড়তে তিনজনের সাথে। আজকে তো একলা লালি। উফ না এ লড়াই হতে দেওয়া যাবে না কোন ভাবেই। কিন্তু কি ভাবে আটকাবে দুজন কে? ততক্ষণে উঠোনের মাঝে ধুন্ধুমার বেঁধে গেছে। নগেন একবার বাইরে বের হবার চেষ্টা করল। কিন্তু বিশাল লোহার গ্রিল টা, বাঘমুড়ো জোরে লাথি মেরেছিল যে ছিটকে এসে একেবারে দেওয়া ঠেসে গেছে। কোন ভাবেই নড়াতে পারল না নগেন।
চিৎকার করে উঠলো নগেন, যখন বাঘমুড়ো লালির আক্রমণে নিজেকে সামলাতে না পেরে ছিটকে এসে পড়ল কলপারে ঠিক নগেনের পায়ের কাছে। কিন্তু সামনে নগেন থাকা স্বত্বেও বাঘমুড়ো নগেন কে দেখলই না। উঠে দ্বিগুন সামর্থ্যে প্রায় ছুটে গেল লালি কে আঘাত করতে। নগেন তাকিয়ে দেখল বাঘমুড়ো মারাত্মক ক্রোধে বিশাল কুকুর টা কে দুই হাতে তুলে আছাড় মারল উঠোনেই। নগেন কেপে উঠল সেটা দেখে। কিন্তু না আছাড় খেয়েও কোন পরিবর্তন নেই কুকুর টার। আছাড় মারার পরে শরীরের যে তূল্যতা খোয়া গেছিল বাঘমুড়োর, সেইটা কে কাজে লাগিয়েই কুকুর টা চকিতে উঠে বিশাল শরীর নিয়ে বাঘমুড়োর গায়ে ঝাঁপ দিল। বাঘমুড়ো টাল সামলাতে পারল না। পড়ে গেল মাটিতে। আর কুকুর টা ওই অবস্থাতেই বাঘমুড়ো কে নিয়ে গড়াতে গড়াতে রাধামাধবের মন্দিরের কোনায় ধাক্কা খেল। ভেঙ্গে গেলো মন্দিরের সান বাঁধানো কোনা টা। কুকুর টা বাঘমুড়োর গলার নলী টা কামড়ে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। ততক্ষণে ঢের বেশী শক্তিশালী বাঘমুড়ো নিজেকে সামলে নিয়েছে। ওই অবস্থা তেই কুকুর টা গলা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বজ্রসম শক্তিতে গলায় প্যাঁচ দিলো একটা।
নগেন দেখল, কুকুর টা সেই প্যাঁচ ছাড়িয়ে নিতে কি মারাত্মক ছটফটানি শুরু করল। বাঘমুড়ো কে তুলে ফেলল একবার। ঝেড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করল বাঘমুড়ো কে। কিন্তু বাঘমুড়ো কুকুর টার পিছন থেকে সেই যে মরণ প্যাঁচ দিয়েছে, কুকুর টা আর ছাড়াতে পারল না। নগেন দেখছে ধীরে ধীরে লালির ক্ষমতা কমে আসছে। ছটফটানি কমে যাচ্ছে। উফ কি হবে এবারে। বাঘমুড়ো মাটিতে শুয়ে পরেছে কিন্তু নিজের বুকের উপরে বিশাল কুকুর টা কে নিয়ে গলার মরন প্যাঁচ দিয়ে রেখে দিয়েছে। হে মধুসুদন রক্ষা কর মেয়ে টা কে। কি হবে এবারে? মেয়েটা এই ভাবে মারা পরবে? নগেন হাতের সামনে যা ছিল তাই দিয়ে বাঘমুড়ো কে আঘাত শুরু করল। কিন্তু তাতে বাঘমুড়োর কিচ্ছু এলো গেল না। নগেন প্রায় কেঁদে ফেলল। নাতনী সম কাউকে এই ভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখলে কার ই বা মাথার ঠিক থাকে। নগেন আর পারল না নিজেকে সামলাতে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলো সেখানেই।
- যে ভগবান, হে হৃষিকেশ , হে প্রভু আমার সর্বস্ব দিয়ে তুমি মেয়ে টা কে বাঁচাও ঠাকুর। হে প্রভু, হে মধুসূদন।
আর সময় নেই, ধীরে ধীরে কুকুর টার চার পা শিথিল হয়ে আসছে। আগের সেই ছটফটানি আর দেখা যাচ্ছে না। মল্লযুদ্ধে পারদর্শী শিশুপাল নিজের থেকে দ্বিগুন শক্তিধর যোদ্ধাকে পরাজিত করার জ্ঞান আর সামর্থ্য রাখত, সেটা আজকে যুদ্ধে পরিষ্কার। কুকুর টার ক্রোধিত চোখ দুটো মায়া ময় হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে শ্বাস না পেয়ে চোখ বুজে আসছে কুকুর টার। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে নাক দিয়ে কুকুর টার। সাদা রেশমের মতন লোক একেবারে রক্তে লাল হয়ে গেছে। অসহায় ভাবে চেয়ে রইল নগেনের দিকে।
ঠিক সেই সময়ে ঝড় উঠল। ঢং ঢং করে বেজে উঠলো রাধামাধবের মন্দিরের ঘন্টা। ঠিক তখন ই নগেনে মনে পরে গেল একটা কথা। সামনে রাধামধব কে প্রণাম করে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল নগেন। খাটের তলায় একটা বেশ পুরোন, কাঠ আর ধাতুর দিয়ে বানানো একটা বাক্স ছিল। বের করে আনল সেই বাক্স টা নগেন। খুলেই একটা ভেল্ভেটের ছোট্ট বাক্স বের করল নগেন। ভিতরে দেখল আছে জিনিস টা। দুটো ছোট্ট খাপে দুটো ছোট্ট হলুদ রঙের বোতাম। সময় নষ্ট করল না নগেন। একটা বোতাম হাতে নিয়ে প্রণাম করে বেড়িয়ে এলো নগেন বাইরে। দৌড়ে গেলো যুযুধান দুই বিশাল কায়ার দিকে।
ততক্ষণে লালির শেষ অবস্থা। চকচকে দাঁতের মাঝ দিয়ে জিভ টা বের হয়ে এসেছে কুকুর টার। লালা বের হচ্ছে মুখ দিয়ে। বাঘমুড়ো নিশ্চিত হতে পারছে না তাই এখনো ছেড়ে দেয় নি। নগেন আর দেরী করল না। ছুটে গেল বাঘমুড়োর কাছে। রাধামাধব কে প্রণাম করে, বোতাম টা বাঘমুড়োর কপালে ঠেকিয়ে চেপে ধরল নগেন আর বলে উঠল,
- হে প্রভু যদি তুমি সত্যি এসেছিলে সেদিনে , দেখা দিয়েছিলে, তখন রক্ষা করেছিলে আমার পরিবার কে তবে তুমি আজকে এখানে প্রকট হও। বিশ্বাসের মর্যাদা দাও আমার। রক্ষা কর মেয়ে টা কে। হে প্রভু দয়া কর। হে প্রভু দয়া কর।
অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যের মরন আর্তনাদ শুরু করল বাঘমুড়ো। যেখানে বোতাম টা ঠেকিয়েছিল নগেন সেখান টা উত্তপ্ত হতে শুরু করল। নগেনের আঙ্গুল মনে হচ্ছে জ্বলে পুড়ে যাবে যাবে এবারে। কিন্তু নগেন ছাড়ল না আঙ্গুল টা। আঙ্গুল যাক। মেয়েটা বাঁচুক। ছটফট করতে শুরু করল বাঘমুড়ো। মরন প্যাঁচ শিথিল হয়ে গেল ধীরে ধীরে। নগেন বুঝল সেটা যখন কুকুর টা খুব হালকা আওয়াজে গরররররররররর করে উঠল আর মনে হলো কেশে উঠলো। আর কাশীর সাথে এক দলা রক্ত উঠোনে পরল। বাঘমুড়ো যেন আর নিতে পারছিল না সেই উত্তাপ। ছটফট করতে করতে হাত পা ছুঁড়তে শুরু করতেই সেই ধাক্কায় কুকুর টা শূন্যে ছিটকে গিয়ে নগেনের দোতলা বাড়ির উপরের ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে উঠোনে আবার আছাড় খেলো ভুতল কাঁপিয়ে।
আর বাঘমুড়ো কোনরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উর্ধশ্বাসে পালাল নগেনের বাড়ির দেওয়াল টা কে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে। মন্দিরের কোনায় পরে রইল গলিত বোতাম টা কালো হয়ে। নগেনের হাত জ্বালা করছে মারাত্মক। কুকুর টার দিকে তাকিয়ে দেখল, সেটা ধীরে ধীরে লালির রূপ ধারণ করছে। ক্ষমতাধারী বাঘমুড়োর সাথে লড়তে গিয়ে প্রাণ টাই যেতে বসে ছিল মেয়েটার। দেরী করল না নগেন। বারান্দার এক কোনে একটা বিছানার চাদর ছিল। সেটা নিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি উলঙ্গ লালির গায়ে চাপিয়ে দিল। কেঁদে উঠল নগেন হাউ হাউ করে চাদর সমেত লালি কে বুকে করে আঁকড়ে ধরে।