20-07-2022, 08:59 PM
মনের খোঁজে
কলেজ শেষে আজ আগের ঠিক করা জায়গায় দেখা করার জন্য যে যার মত কলেজ থেকে বেড়িয়ে গেছে। ছুটকি আগেই এসে গিয়েছিল কফি সপে কিন্তু তনুর আসার নাম নেই। কিছুক্ষণ পরেই ঘেমে নেয়ে একশা অবস্থায় তনু এসে ছুটকির উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসে হাঁফাতে থাকে। প্রচন্ড গরমে শহরের অসহনীয় যানজটে জীবনের কি অবস্থা হয় সেটা যারা লোকাল পরিবহনে যাতায়াত করে তাদের অজানা নয়৷ ক্যাফের এসির বাতাসে শরীরটা একটু জুড়িয়ে নিয়ে গত দুদিন আগে বাসায় কি কি ঘটে গেছে তা ছুটকির কাছে একে একে সব বলতে থাকে। তনুর কাছে ওর বাবার কথা শুনে ছুটকিও রাগে ফুসতে থাকে, জ্ঞান হবার পর বাবার অনেক শাসন সামলাতে হয়েছে তাই বলে এমন আচরণ কখনো কারো সাথে করতে দেখে নি সে। আপাতত সেগুলো পাশে রেখে যে কাজটার জন্য এসেছিল সেটা করার দিকে মনোযোগ দেয়, তনু ব্যাগ থেকে মোবাইল আর দিদির মোবাইল থেকে লুকিয়ে জয় দার নাম্বার টা যে কাগজে লিখেছিল সেটা বের করে৷ কিন্তু এখানেও সমস্যা আছে একটা, জয় নামে তিন চারটে নাম্বার সেভ করা ছিল সেটার মাঝে ওদের দরকারের জয় কোনটা সেটা বুঝা মুশকিল তাই সবগুলো নাম্বারই লিখে নিয়ে এসেছে। একেক করে দুটো নাম্বার ট্রাই করা হয়েছে, সরাসরি পরিচয়ও দিতে পারছে না কারণ কেউ যদি আবার দিদি কে ফোন করে জানিয়ে দেয় তবে খুব বকা খাবে এমনিতেই দিদির মেজাজ কয়েকদিন ধরে চটে আছে। ইনিয়ে বিনিয়ে অন্য কথার ছলে আসল জয় কে খোঁজার চেষ্টা চলছে। আরেকটা নাম্বারে ফোন করে তনু, নাহ... কেউ পিক করছে না আরেকবার ট্রাই করে এবারও সারাক্ষণ রিং হয়ে গেল কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না। আপাতত এটা বাদ দিয়ে আরেকটা নাম্বারে ফোন করবে তখনি আগের নাম্বার টা থেকে কল আসে৷ অনেক আশা নিয়ে দুরুদুরু বুকে কলটা রিসিভ করে তনু, ইয়ারফোন দুটো দুজনের কানে গুজে রাখা
-হ্যালো কে বলছেন? এই নাম্বার থেকে মাত্রই দুটো কল এসেছিল আমি মিটিং এ ছিলাম তাই রিসিভ করতে পারি নি।
-(গলাটা একটু গম্ভীর করে) আপনি কি জয় বলছেন?
-হ্যাঁ আমি জয়, আপনি কে?
-আমাকে চিনবেন না, আচ্ছা আপনি কি গোপালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এস এস সি-২০০৯ ব্যাচের জয় সাহা।
-হ্যাঁ আমিই সেই জয় সাহা, ওটা আমাদের গ্রামের বাড়ি। আপনি কে বলছেন? আমি কি চিনি আপনাকে?
-(ইয়াহু.... পেয়ে গেছি দুজনেই চিৎকার করে উঠে, ওদের প্রথম টার্গেট ফুল হবার আনন্দে হাত পা ছুঁড়তে থাকে) দাদা তুমি আমাদের চিনবে না তবে আমরা তোমাকে চিনি, আচ্ছা তোমার কলেজের বন্ধু রুদ্র আর রাই এর কথা মনে আছে।
-হ্যাঁ মনে আছে, দিন বিশেক আগে রাই এর সাথে কথা হয়েছে। কিন্তু রুদ্রের সাথে তো অনেক বছর ধরে যোগাযোগ নেই, সেই শেষ কলেজে থাকতে যোগাযোগ হয়েছিল এরপর হয় নি ওর নতুন নাম্বাটাও আমার কাছে নেই। কেন, কিছু হয়েছে কি? তোমরা কে, কোন মজা করছো না তো।
-আমরা এখানে দুজন আমি তনু মানে তন্বী চৌধুরী রাই এর ছোট বোন আর ছোটকি, রিতু রায় রুদ্র দার বোন।
-ছোটকি??? বাবুর বোন ওকে তো ছোট্ট থাকতে দেখেছি। তখন তো আমরা গোপালপুরে থাকতাম, তবে ছোটকি ছোট থাকতেই ওরা ওখান থেকে শহরে চলে গিয়েছিল। রাই এর একটা বোন আছে সেটা ও বলেছিল। তোমরা হঠাৎ আমাকে ফোন করলে যে, কি ব্যাপার?
তনু আর ছুটকির দুজনে কেন জয় কে খুঁজে বের করা ওদের কি দরকার জয় কে সবকথা জয়ের কাছে খুলে বলে, ওরা জানতে চায় রাই কেন রুদ্রের উপর রেগে আছে আর রুদ্রেরই বা কিসের আক্ষেপ নিয়ে এমন করে নিজেকে ছোট ভাবে। কেন এত ভালো বন্ধু হয়েও ওদের মাঝে যোগাযোগ নেই, একে একে প্রশ্নের পাহাড় জমতে থাকে জয়ের সামনে। চাইলেও সব কথা ওদের সামনে জয় বলতে পারে, সে-সব কথা বলে ওদের কাছে নিজেদের ছোট করা ছাড়া আর কোন কাজে আসবে না। তাই খেয়াল করে কিছু কিছু কথা বাদ দিয়ে ওদের সেই ছোট থেকে শহরে আশা অব্দি অনেক কথাই তনু আর ছুটকির কাছে শেয়ার করে। ওরা দুজনে যদি রাই আর রুদ্র কে আবার এক করতে পারে তবে জয়ের নিজের মনের উপর থেকেও একটা বোঝা কমবে মনে হয়। সেদিনের ঐ কান্ডের জন্য সে নিজেকেই সবচেয়ে বেশি দোষী মনে করে। রুদ্র যে রাই কে পছন্দ করতো মানে ভালোবাসতো সেটা জয় ছাড়া আর কারও কাছে বলে নি, সেটাও আকারে ইঙ্গিতে তনু আর ছুটকির কাছে বলতে শুরু করে৷ তনু আর ছুটকিও বুঝতে পারে জয় ওদের কি বুঝাতে চাইছে ওদের কে, জয়ের কথা শুনে মনে হলো সবটাই একটা ভুল বুঝাবুঝি থেকে হয়েছে আর সেটাই জমতে জমতে অনেক বড় ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে৷ আর সেটা ঠিক করতে হলে আবার ওদের তিনজনকে একসাথে আনতে হবে আর সেটা ওরা দুজনে মিলেই করবে।
-আচ্ছা জয় দা তুমি কোথায় আছো এখন?
-আমি তো চট্টগ্রামে, একটা স্টীল কোম্পানিতে জব করি। রাই যে কোম্পানিতে আছে সেটার বড় সাপ্লায়ার আমাদের কোম্পানি। কেন বলতো?
-তুমি একবার আমাদের এখানে আসতে পারবে?
-তোদের এখানে? কেন?
-দরকার আছে, একটা গেট টুগেদার হবে। আর তুমি ছাড়া সেটা সম্ভব না তাই তোমাকে আসতে হবে আর রাই দি আর রুদ্র দার মাঝের ভুল বুঝাবুঝি টা দূর করতে হবে।
-এত বড় দায়িত্ব আমার উপরে দিয়ে দিলি, আমাকে আসতে হলে তো ছুটি নিতে হবে। আচ্ছা এদিকে সব গুছিয়ে তোদের জানাবো ঠিক আছে। তোদের প্ল্যানে অনেকদিন পর সবার সাথে দেখা হবে সেটার এক্সাইটেড টা এখনি ফিল করছি আমি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোদের আমি জানাবো কবে আসতে পারবো।(জয়ের খুব আনন্দ হচ্ছে আজ, যদি সত্যিই আবার সবার সাথে দেখা হয় তবে ওর ট্রাই করবে রাই আর রুদ্রের মাঝের দূরত্ব টা যেন ও দূর করে দিতে পারে। জয় জানে রাইও রুদ্রের উপর দূর্বল ছিল কিন্তু এতবছর পর কি সব আগের মতই আছে? যদি থাকে তবে জয়ের চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না কিন্তু ওদের মনে যদি সেই টান টা আর না থাকে তবে? না না যা ভাববো সব ভালো কিছুই ভাবতে হবে)
-আচ্ছা দাদা শুনো তুমি কিন্তু আবার দিদির কাছে এটা নিয়ে কিছু বলে ফেলো না যেন, এটা তোমার আর আমাদের সিক্রেট থাকবে।
-ওকে ঠিক আছে, সেটা আর আমাকে বলে তোদের বলে দিতে হবে না।
-আচ্ছা দাদা রাখি এখন, বাসায় যেতে দেরি হলে আবার টেনশন করবে।
কলটা কেটে যাবার পর ওদের আনন্দ দেখে কে, খুশিতে একজন আরেকজন কে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরে। সম্বিত ফিরতেই বুঝতে পারে বাকিরা সবাই হা করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের আরেকটা মিশন সাকসেসফুলি শেষ হলো এখন লাস্ট স্টেজ সেটা ঠিকঠাক ভাবে কাজ করলেই ওদের টার্গেট ফুল হবে। সেটার জন্যই এখনি ভাবতে হবে, জয় দা না হয় এসে যাবে কিন্তু রাই দি আর রুদ্র দা কে কি বলে এক জায়গায় আনা যায় সেটা বের করতে হবে যাতে করে সারপ্রাইজটাও থাকে আবার ওদের কাজটাও হয়ে যায়। না আর দেরি করা যাবে না, নাইলে বাসা থেকে দাদা দিদির কাছে ফোন চলে যাবে আর সেটা হলে বকাঝকা শুনতেই হবে।
মিটিং শেষেই রুদ্রকে একটা সাইটের কাজে যেতে হতো তারপর তেমন কোন কাজ নেই আজ, সাইটের কাজে রিতাও ওর সাথেই যায় আজও ওরা দুজনেই সাইটের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো। ওখানকার কাজ শেষ হতেই রিতা বারবার শপিং এ যাবার তাগাদা দিতে লাগলো, রুদ্রের শপিং এর মত বোর কাজে তেমন আগ্রহ নেই আবার রিতাকে কথা দিয়েছে অবশেষে তাই ওকে যেতেই হলো। মেয়েদের শপিং পৃথিবীর দশম আশ্চর্যের অন্যতম একটা কয়েকটা দোকান আর এত এত কালার আর ডিজাইনের জামা না দেখা পর্যন্ত ওরা ওদের চয়েস সম্পর্কে ধারনাই পায় না ঠিকমত। একবার বলছে এটা ভালো লাগছে একটু পরেই ডিসিশন চেঞ্জ এবার আরেকটা বেশি ভালো লাগছে তো একটু পরে অন্য আরেকটা। সাথে যে থাকে তার কাছে বিষয়টা কতটা বোরিং সেটা তারাই জানে, রুদ্র শুধু পেছন পেছন হাটছে আর যেটা দেখাচ্ছে সেটাই মাথা নাড়াছে এছাড়া আর কিছু বলার আছে সেটা ওর মনে হচ্ছে না। একঘন্টার বেশি সময়ে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে মাত্র দুটো জামা কেনা হয়েছে, এত ধৈর্য ওরা আর অন্য কিছুতে দেখাতে পারুক আর না পারুক শপিং আর পার্লারে ঠিকই দেখাতে পারে। যাইহোক আপাতত শপিং শেষ রুদ্র ভেবেছিলো বাঁচা গেছে এবার একটু শান্তি পাবো
-রুদ্র দা আজ তো আর অফিসে যাবে না?
-না তেমন কোন কাজ নেই।
-আমারও, তাহলে তুমি কি বাসায় চলে যাবে?
-হুম, তোমাকে না হয় বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাবো।
-না ভাবছিলাম তেমন কোন কাজ নেই যেহেতু তোমার সাথে তোমাদের বাসায় যাবো, একদিনও তুমি নিজ থেকে বললে না। আমিই নিজ থেকে বললাম।
-আমার বাসায় গিয়ে কি করবে, এখন তো কোন অনুষ্ঠানও নেই। থাকলে তোমাকে নিয়ে যেতাম।
-আঙ্কেল আন্টির সাথে কথা বলবো, অনুষ্ঠান বলতে তো তোমার বিয়ে সেটা কি এবছর হবে বলে তো মনে হয় না(মিষ্টি হাসির ফোয়ারা)। অনুষ্ঠানে গিয়ে তো আর মন খুলে কথা বলা হবে না।
এ মেয়ের সাথে কথা বলে পারা যাবে না একটা না একটা যুক্তি ঠিকি কোথা থেকে খুঁজে নিয়ে আসবেই তাই কথা না বাড়িয়ে রুদ্র ওকে ওদের বাসায় নিয়ে যেতে রাজি হয়ে গেল। সারা রাস্তা মুখটা একটুর জন্যও মনে হয় বন্ধ করে নি, যত কথা আছে সব যেন আজই শেষ করে দিবে। তবে ওর কথা বলার মাঝে যে মিষ্টতা আছে সেটার জন্য ও বকবক করলেও সেটা কানে ধরে না। বাসায় ঢুকতেই রিতা বাইক থেকে নেমেই রুদ্রের আগে এগিয়ে যায়, কলিং বেল চাপতে একটু পড়েই একজন এসে দরজা খুলে। পোশাকে আর বয়সে বুঝতে পারে এটাই রুদ্রের মা, ঝট করে ওড়না টা ঘোমটার মত করে মাথায় দিয়ে অঞ্জলি দেবীকে প্রনাম করে রিতা। অঞ্জলি দেবী অবাক হলেও দুহাতে মাথা স্পর্শ করে আশীর্বাদ করে জিজ্ঞেস করে
-তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না, কে তুমি?
-আন্টি আমি রিতা রুদ্রের কলিগ একসাথেই কাজ করি, আজ আমরা হঠাৎ বিয়ে করে ফেলেছি তাই তোমাদের আশীর্বাদ নিতে আসলাম।
-(দূরে বাইকে কভার দিতে থাকা রুদ্রের দিকে তাকিয়ে কি ঘটেছে বুঝার চেষ্টা করে, বাবু হঠাৎ এমন কাজ করার ছেলে নয় তাও আমার মা বাবা কে না জানিয়ে। আবার মেয়েটাও দেখা যায় ওর সাথেই এসেছে তাহলে কি মেয়েটা সত্যি বলছে? রুদ্রের দিকে তাকিয়ে হাঁক দেয়) বাবু এদিকে আয় তো একটু তাড়াতাড়ি
রুদ্র মায়ের ডাক শুনেই কাছে এগিয়ে যায় রুদ্র ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই রিতা রুদ্র কে বারবার অঞ্জলি দেবী কে প্রনাম করার জন্য কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ো বলতে থাকে, রুদ্র কিছু বুঝতে পারছে তবুও মাকে প্রণাম করে। রুদ্রের প্রণাম করা দেখে অঞ্জলি দেবীর মনে সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে তবে কি সত্যিই রুদ্র বিয়ে করে নিয়েছে।
-কিরে বাবু, মেয়েটা কি বলছে এটা কি সত্যি?
-(রুদ্র ঘটনার আদ্যোপান্ত কিছুই জানে না তাই সে অবাক হয় মা কিসের কথা জিজ্ঞেস করছে। রিতা কি মাকে কিছু বলেছে নাকি, কি না কি বলেছে কে জানে ওলটা পাল্টা কিছু বললে তো কেলো করেছে। রিতার দিকে তাকাতেই দেখে ও মিটিমিটি হাসছে) মা কিসের কথা বলছো আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি কি কিছু ভুল করেছি তুমি ওমন করে তাকিয়ে আছো কেন (মায়ের রাগী ভাবটা দেখে ভয় পেয়ে একটু জড়সড় অবস্থা)
-(হঠাৎ করে খিলখিল করে হাসতে থাকে রিতা, ওকে হাসতে দেখে অঞ্জলি দেবী রুদ্র দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে) রুদ্র দা তুমি তো দেখি আন্টি কে খুব ভয় পাও সেটা তো জানা ছিল না।(অঞ্জলি দেবীর দিকে এগিয়ে গিয়ে) তোমার ছেলের তোমাকে না জানিয়ে বিয়ে করার সাহস নেই। এখন তুমি যদি অনুমতি দাও তবে, (দুই হাত দুই গালে কাছের নিয়ে) দেখো আমি কিন্তু দেখতে খারাপ না কি সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়ে।
-মা ওর কথায় কান দিও না ও সবসময় মজা করতে থাকে, আরেকটু হলে তো আমার জান বেড়িয়ে গেছিলো। ভাবছি ও কি না কি বলেছে তোমাকে।(যেন হাঁপ ছেড়ে বাচলো রুদ্র)
-হুম সেতো দেখছিই,(রিতার দিকে তাকিয়ে) তবে মেয়েটা আসলেই মিষ্টি সেই সাথে দুষ্টুও একটু বেশি। একটুর জন্য হলেও আমি ওর কথা বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম। আয় তোরা ভিতরে গিয়ে বস।
রিতা কিছুক্ষণ থাকার পর ওদিনের মত চলে গিয়েছিল। যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ মনে হচ্ছিলো ও বুঝি নিজের বাড়িতেই আছে এই এদিকে ছুটছে ওদিক ছুটছে, অঞ্জলি দেবীর সাথে কি নিয়ে কথা বলতে বলতে হাসি শুরু করেছে। যেমন তেমন হাসি না মনে হয় এই বুঝি হাসতে হাসতে মাটিয়ে গড়িয়ে পড়বে, খানিকটা সময়ের মাঝেই হুলস্থুল করে হাঁপিয়ে উঠে। এর মাঝেই বলে উঠে আজ তো বাসাটা চিনে গেলাম এখন কিন্তু মাঝে মাঝে এসে এমন অত্যাচার করবো কিছু বলতে পারবে না। অঞ্জলি দেবীর সাথে এর মাঝেই যেন বন্ধুত্ব হয়ে গেছে রিতার, তাই তো তিনি নিজেও বললেন সময় পেলেই যেন চলে আসে কিচ্ছুটি মনে করবে না।
★★★★
কলেজের জন্য বের হবার আগেই আগের দিনের করা প্ল্যান মত তনু আর ছুটকি দুজনেই যে যার মত করে রাই রুদ্র কে বলে দেয় যে আজ কলেজ শেষে একটা নতুন রেস্টুরেন্ট খুলেছে সেটাতে যাবে। ওরা যেন ওখানে আসে, ওখানে কিছু নতুন খাবার টেস্ট করবে ছুটকির তেমন কোন জোর করতে হয় নি রুদ্র কে, খাবারের ব্যাপারে ওর দুর্বলতা আগে থেকেই। আর নতুন রেস্টুরেন্টের কথা শুনে ও নিজে থেকেই ট্রিট দেবে জানিয়ে দেয়, ছুটকি কে বলে দেয় যেন তনু কে জানিয়ে দেয় দরকার হলে ও অফিস থেকে বেরিয়ে তনু কে পিক করে নিবে। ছুটকি জানিয়ে দেয় তার কোন দরকার নেই ওরা নিজেরাই চলে যেতে পারবে শুধু রুদ্র যেন ঠিক টাইমে চলে যায়।
তনুও ফাঁক পেতেই রাই কে জানায় বান্ধবীকে নিয়ে নতুন রেস্টুরেন্টে যাবে রাইও যেন সেখানে যায়। রাই প্রথমে রাজি হয় না, বাসায় কদিন ধরেই পরিস্থিতি তেমন একটা ভালো না, এখনো বাবার সাথে রুদ্রের ব্যাপার টা নিয়ে আলোচনা করা হয় নি। কথা হবে কি করে ঐদিনের পর থেকে তো বাবা অনেকটা এড়িয়ে চলছে রাই কে। তবে বোনের আবদার ফেলতে পারে না, তাই শেষমেশ রাজি হয়। তনু কে বলে দেয় পৌঁছে যেন রাই কে জানিয়ে দেয় ও ওখানে পৌঁছে যাবে।
কলেজ শেষে দুজনেই রেস্টুরেন্টে পৌঁছে যায় তনু আর রাই। আবহাওয়া সকাল থেকেই ভালো না, আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে আছে, যখন তখন ঝড় নামবে হয়তো, আর এমনিতেও ঝড়ো বাতাই বইছে মাঝে মাঝে, দুদিন ধরেই নিউজে দেখাচ্ছে নিম্নচাপে সমুদ্র উত্তাল হয়ে আছে ৩ নাম্বার সর্তক সংকেত ও দিয়েছে। প্ল্যান মতো জয় সকালের ফ্লাইট ধরে এখানে চলে আসবে, আর রেস্টুরেন্টের লোকেশান টা পাঠিয়ে দিয়েছে তাই তেমন কোন সমস্যা হবার কথা না। ছুটকি আর তনু খবর নিয়েছে রাই আর রুদ্র দুজনেই অফিস থেকে বেড়িয়ে গেছে আর মিনিট চল্লিশ লাগবে পৌঁছাতে। এদিকে জয় কে ফোন করছে কিন্তু ফোনটা আনরিচেবল দেখাচ্ছে এর মানে কি এখনো ফ্লাইটে আছে নাকি, কিন্তু এতক্ষণ লাগার কথা না। জয় দা ঠিক টাইমে না আসলে তো সব প্ল্যান মাটি হয়ে যাবে। মনটা খুব উশখুশ করছে তনু আর ছুটকির শেষ পর্যন্ত যেন সব ঠিকঠাক ভাবেই হয় সেটাই প্রার্থনা করছে, তনুর ফোনটা বেজে উঠে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে, কল টা রিসিভ করতে গলা শুনে বুঝতে পারে এটা জয়ের গলা।
-দাদা কোথায় তুমি, আমরা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, রুদ্র দা দিদি বেড়িয়ে পড়েছে।
-আমি তো এখনো চট্টগ্রামেই বিমানবন্দরে বসে আছি।
-মানে কি দাদা, তুমি মজা করছো তাই না? এসে গেছো কি, কোথায় তুমি আমরা রেস্টুরেন্টে বসে আছি তোমায় তো দেখতে পারছি না।
-নারে মজা করছি না, এদিকে নিম্নচাপের কারণে ঝড় আর প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে তাই আমার ফ্লাইট ক্যানসেল হয়ে গেছে। আমি এখনো বিমানবন্দরেই বসে আছি পরের ফ্লাইটের জন্য, কিন্তু কখন ছাড়বে ঠিক নেই। বিশ্বাস না হলে তোদের বৌদির সাথে কথা বলে দেখ(পাশ থেকেই একটা নারী কন্ঠ শোনতে পাচ্ছে তনু)
-হ্যালো তনু আমি পল্লবী বলছি, তোমার দাদা সত্যি বলছে আমরা এখনো বিমানবন্দরে বসে আছি। তোমার দাদার আর আমারও তো খুব ইচ্ছে তোমাদের সবাইকে দেখতে, দেখি কখন আসতে পারি।
-ঠিক আছে বৌদি ভাই, দেখো কখন ফ্লাইট আবার চালু হয়।
-শোন তনু ছুটকি তোরা আজ কোন ভাবে সামাল দে। আমি দেখি কি করা যায়।
-ওকে দাদা।
জয় আসতে পারছে না তাতে করে ওদের আজকের প্ল্যান টা আর ওয়ার্কআউট করা হবে না। তবুও চেষ্টা করে দেখতে হবে আকারে ইঙ্গিতে যদি কিছু করা যায় তবে একটু হলেও ওদের কষ্টটা সফল হবে। একটু পরেই দেখে রুদ্র এসে গেছে ও বাইরে বাইক টা পার্ক করছে, ও ভিতরে এসেই ছুটকি আর তনু কে জড়িয়ে ধরে
-কিরে বেশি লেট করে ফেললাম নাকি?
-না দাদা ঐ একটু আরকি।
-খাবারের অর্ডার দিয়ে ছিস নাকি?
-না দাদা এইতো তুমি এসেছো এখন দিবো।
-ওকে, তোরা একটু ওয়েট কর আমি একটু টয়লেট থেকে আসছি।
রুদ্র টয়লেটের দিকে যেতেই তনু রাই কে ফোন করে, রিং হতেই কলটা কেটে যায় হয়তো কাছাকাছি এসে গেছে তাই কেটে দিয়েছে। হঠাৎই পেছন থেকে কেউ তনুর দুচোখ চেপে ধরে
-দিদি এটা তুই আমি জানি।
-ধুর, তোকে আর সারপ্রাইজ দেয়া গেল না।(ছুটকি কে দেখে চিনতে পেরেও) ওকে তোর বান্ধবী?
-হুম, তুই কোন সেন্ট ব্যবহার করিস সেটা তো আমার জানা তাই চিনে ফেলেছি। তোকে বলেছিলাম না রুদ্র দার কথা ও রুদ্র দার বোন। নাম রিতু রায়।
-(একটা চেয়ার টেনে বসে) তুমি কোন কলেজে পড়ো?
-ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ এন্ড কলেজে। তোমার কথা তনুর কাছে অনেক শুনেছি, ও যা বলেছে তার থেকেও তুমি অনেক বেশি সুন্দর দিদি।
-হয়েছে হয়েছে আর প্রশংসায় ভাসাতে হবে না। তা খাবারের অর্ডার দেয়া হয় নাই তো।
-না এখনি দিবো।
রুদ্র এদিকেই আসছে, ওদের টেবিলে আরেকজন কেউ বসে আছে ওর দিক থেকে উল্টো করে বসা আছে তাই মুখ দেখতে পারছে না। আর কারও তো আসার কথা ছিলো না তবে কে আসলো, ওদের পরিচিত কেউ নাকি, পরিচিত কেউ তাই তো এতো কথা বলছে। ধীরে ধীরো এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওদিকে চেয়ারে গিয়ে বসে যাবে ওমনি আগে থেকেই বসা মেয়েটিকে দেখে পিলে চমকে যায়...
-ম্যাডাম আপনি? এখানে, কখন এলেন? ওদের সাথে আপনার পরিচয় আছে?
-এত প্রশ্ন এক সাথে! মাত্রই এসে বসলাম, আমার পরিচয় না থাকলে কার থাকবে? তনু আমার বোন।
ছুটকি তনু দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে কি ঘটলো সেটা এখনো বুঝতে পারছে না, রুদ্র দা কেন রাই দি কি ম্যাডাম ডাকছে। তাহলে তারা কি দুজন একে অন্যকে আগে থেকেই....
-কিরে দিদি তুই কি রুদ্র দা কে চিনিস নাকি?
-হুম চিনি তো, মি.রুদ্র আর আমি তো একই কোম্পানিতে আছি।
-তাহলে ঐদিন কার্ড দেখানোর পর বললি নাতো?
-তোকে সব বলতে হবে নাকি?
-ম্যাডাম আমি কিন্তু জানতাম না তনু আপনার বোন হয়, ও আমাকে বলেনি আপনি যে জব করেন আমাদের কোম্পানিতে। ওর কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি, আর ওটা ছুটকি আমার বোন।
-ওর সাথে পরিচয় তনু করিয়ে দিয়েছে। খুব মিষ্টি মেয়ে, তনু হয়তো খুব জ্বালায় আপনাকে তাই না?
-না না, ও ছুটকির চেয়ে অনেক কম.... আপনি খুব শাসন করেন তো তাই।(যথারীতি পাশে বসা ছুটকির গাল ফুলানো শুরু হয়ে গেছে, তনু আর রাই মিটিমিটি হেসেই চলেছে)
-ওহহ ওসবও বলা হয়ে গেছে( তনুর দিকে তাকিয়ে) কিরে আমি কি তোকে সবসময়ই বকাবকি করি শাসন করি নাকি?? ভালো কিছু আর বলতে পারলি না, এমনিতেই তো ওনি ভাবে আমি নাকি অনেক রাগী মানুষ।
-না না ম্যাডাম, ওটা তো জাস্ট মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল মাত্র। তনু তো বলেছে আপনি ওকে অনেক আদর করেন ভালোবাসেন, ওর সব আবদার তো আপনার কাছেই করে।
-যাক ভালো কিছু বলেছে তাহলে। তা অর্ডার টা দেয়া হোক এখন। তোরা অর্ডার টা দে আমার একটা কল আসছে আমি কথা বলে আসছি।
তনু আর ছুটকি কে কি অর্ডার করবে সেটা নিয়ে হুল্লোড় শুরু করে দিয়েছে আর রুদ্র ওরা দুটোকে সামলাবার চেষ্টা করছে। রুদ্র বুঝতে পারলো এইভাবে বললে কাজ হবে না তাই হালকা একটা ধমক দিতেই সব ঠান্ডা, আস্তে ধীরে অর্ডার করতে শুরু করলো। পারলে ওরা সব আইটেমই আজকে খেয়ে নেবার পায়তারা করছে একের পর এক অর্ডার করে চলেছে শেষে আবার আইসক্রিম ও অর্ডার করেছে এত খাবার খাবে কি করে কে জানে। হঠাৎ করে রুদ্রের মোবাইলটা বেজে উঠলো পকেট থেকে বের করতেই সেই নাম্বার থেকে মেসেজ
ভালোই জমিয়েছো দেখছি, একেবারে অফিসেরর ম্যাডামের সাথে লাঞ্চ করছো আজ। সাবধান, ঐ ম্যাডামের দিকে যেন আবার মন গলে না যায়। যদি যায় তবে আরেকটা কাঁধ কিন্তু বাকি আছে ওটাতেও কামড়ে দেবো বলে দিলাম।
ঐ কামড়ের দাগটা এখনো আছে তে মনে হয়? আর থাকতেই হবে আমি যতদিন আছি ওটাও থাকবে আমার ভালবাসার চিহ্ন হিসেবে।
মেসেজ টা পড়া শেষ করেই রুদ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে পাগলের মত আশেপাশে দেখতে থাকে, ও হয়তো আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে বসে আছে নইলে জানলো কি করে ও এখানে আছে আর কার সাথে আছে। বারবার নাম্বার টাতে কল করার ট্রাই করে কিন্তু যেটা হবার ততক্ষণে হয়ে গেছে। রুদ্র টেবিল ছেড়ে ডানে বামে ঘুরেফিরে খোঁজার চেষ্টা করে সেই মানুষটাকে, কিন্তু দেখলেই কি চিনতে পারবে? এখনো কি সেই আগের চেহারা আছে এত বছরে কত কি বদলে গেছে। হয়তো চিনতে পারবে না আবার চিনতেও তো পারে, যেভাবে ও রুদ্র কে চিনে নিয়েছে। না আশেপাশের সব-কয়টা টেবিল দেখা হয়ে গেছে কিন্তু কোথাও মনে হলো না ও আছে। তেমন করে কারও দিকেই তো নজর টা টানলো না। রুদ্র কে এমন করে ছোটাছুটি করতে দেখে ছুটকি তনু হতবাক হয়ে যায়, হঠাৎ করে দাদার কি হলো বুঝতে পারে না৷ না আর হয়তো দেখা পাওয়া গেল না, আশাহত হয়ে যুদ্ধ বিধস্ত এক সৈনিকের ন্যায় ক্লান্ত পায়ে জরাজীর্ণ শরীরটা নিয়ে কোন মতে চেয়ারটার কাছে এসে ধপ করে বসে পরে।
-কিরে দাদা কি হয়েছে, এমন করে ছোটাছুটি করছিলি কেন?
-(গলা থেকে আওয়াজ বের হয় না, কেমন যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। হার্টবিট বেড়ে গেছে সেটার কারণেই হয়তো কপালের পাশ জড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে এই এসির মাঝেও৷ মনের ভিতর কি চলছে সেটা বলে কাউকে বুঝাতে পারবে না, এত বছর পর এমন একটা মানুষের কথা মনে পড়ে গেছে নাকি মনে করিয়ে দিয়েছে যেটা সে কখনোই ভুলতে পারেনি আর পারবেও না। ওটা ও ছাড়া আর কেউ হতে পারে না নইলে কাঁধে যে কামড়ের দাগ আছে সেটা তো আর কারও জানার কথা না, ঘুরের মাঝেই অস্পষ্ট স্বরে মুখ দিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে আসে একটা শব্দ) রাইইইই।
-কিরে দাদা কি হলো বললি না তো, কি বিড়বিড় করে বলছিস তখন থেকে?
-(ছুটকির ধাক্কায় সম্বিত ফেরে, এর মাঝেই ম্যাডাম ও চলে এসেছে টেবিলের কাছে, খাবার গুলোও একেক করে চলে আসছে টেবিলে) না মানে তেমন কিছু না। ঐ আর কি ওটা তোরা বুঝবি না। নে খাওয়া শুরু কর। ম্যাডাম আপনিও বসে পড়ুন।
তনু আর ছুটকির মনটা খ্যাচ খ্যাচ করলেও সেটা নিয়ে আর কথা বাড়ায় না, কিন্তু পাশে বসা রিদ্ধিমা চৌধুরী মুখ টিপে টিপে হাসছে তখন থেকেই। দূরে দাড়িয়ে এতক্ষণ সবটাই দেখা হয়েছে তার, রুদ্র কেমন করে পাগলের মত এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিলো ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা কোন মূল্যবান বস্তুর খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে। একবার মনে হয়েছিল ছোটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরবে রুদ্রকে ওর বুকে মাথা রেখে বলে দিবে যেই মানুষটাকে হন্যে হয়ে সে খুঁজে চলেছে আমিই সেই। কিন্তু আবার ভাবলো একটু ছোটাছুটি করুক না দেখি নিজ থেকে খুঁজে নিতে পারে কিনা, এতটুকু তো পরিষ্কার হয়েই গেল বাইরে বাইরে যতই রাগ দেখাক না কেন ভিতরে এখনো সেই আগের বাবু এখনো বেঁচে আছে আর সেখানে রাই আগেও ছিল আর পরেও থাকবে। ওদিকে আনমনে হয়ে বসে থাকা রুদ্র ঠিকমত খেতেও পারছে না, ওর মনটা আর খাবারের দিকে নেই যেন মনটা এক ছোটে সেই গ্রামে সেই কলেজ সেই খেলার মাঠ বাজার ভাঙা ব্রীজটার কাছে চলে গেছে, সেই মানুষ গুলোর কাছে বিশেষ করে ঐ একজনের কাছে। চোখ বন্ধ করে সেই চেহারা আরেকটা বার ভালো করে মনে করার চেষ্টা করে চলেছে, আবছা আবছা একটা চেহারা ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে যায়। কতবছর হয়ে গেল সবকিছুর উপর জমে থাকা সেই টান টা কেমন করেই যেন ছিন্ন করে চলে এসেছিল একটাবারও তাকাতে ইচ্ছে হয় নি ফিরে কিন্তু আজ যেন এক ঝটকায় আবার সব স্মৃতি গুলো ঘিরে ধরেছে তাকে, না টান টা কোন কালেই ছিন্ন হয় নি আর হবেও না তখন যেটা ছিল সেটা হলো নিজের উপর তৈরী হওয়া ঘৃণা রাগ, ক্ষোভ আর রাই এর উপর জমতে থাকা অভিমান। কিন্তু বিধাতার কি আশ্চর্য খেলা এতদিনের ক্ষোভ রাগ অভিমান যেন এক তুড়িতেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল আর ভিতর থেকে সেই পুরনো আকাঙ্খা টা জেগে উঠলো সেই মানুষটাকে একটিবার চোখ ভরে দেখবার। ভিতরটা যেন শুষ্ক মরুভূমি হয়ে আছে সেই মানুষটায় হইতো পারবে আবার সেখানে সবুজের সমারোহ ঘটাতে, এই আশায় আবারও জেগেছে মনের কোনে।
খাবার শেষে কে বিল দিবে সেটা নিয়ে আবার একটা হট্টগোল ছুটকির ইচ্ছে রুদ্র দিবে আর ওদিকে তনু ইচ্ছে রিদ্ধিমা দেবে। রুদ্রের আগেই বলা ছিল ও ট্রিট দিবে তাই ও আগ বাড়িয়ে বিল দিতে যাবে তখনি রিদ্ধিমা রেগে উঠলো, ম্যাডামের রাগান্বিত মুখ দেখে রুদ্রের আর আর্গুমেন্ট করার সাহস হলো না তাই বিল রিদ্ধিমাই পে করলো তবে রুদ্রের মন রাখতে আইসক্রিম বিলটা ওকে দিতে দিলো। রুদ্রের দাপট কেন জানি রিদ্ধিমার সামনে কাজ করে না, ম্যাডামের চোখের দিকে তাকাতেই ওর কেমন জানি অনুভূতি হয় উল্টো করে জবাব দেবার মত কিছুই যেন খুঁজে পায় না, এমনটা আরও কারো সাথেই তো হয় না হয়তো ওর মনে ম্যাডাম কে নিয়ে ভীতি টা কাজ করে বলেই। ম্যাডামের রাগান্বিত চোখে যেন ও নিজেকে ভস্মীভূত হতে উপলব্ধি করে সবকিছু শেষ করে পার্কিং এ এসে ওরা বিদায় নিলো একে অন্যের কাছ থেকে। কিন্তু তনু আর ছুটকির মন খুশি না তেমন কারণ যেটার জন্য আসলো সেটাই তো হলো না, তবুও ওরা যে পরিচিত সেটা তো জানা গেল তাতে করে সামনে নতুন কোন প্ল্যান করতে সুবিধা হবে ওদের। আবার নতুন করে ভাবতে হবে, একবার ভেবেছিল জয় দা আসতে পারে নি তাতে কি হয়েছে ওরাই সব বলে দিবে কিন্তু পরে আবার ভাবলো ওদের বলার চেয়ে জয় দা কে বলালেই সবচেয়ে ভালো হবে কারণ জয় দার তো সবটাই জানা আর বড় কেউ হলে পরের ব্যাপারটাও সামাল দিতে সহজ হবে। তবে আজ কি কি হলো সেটা জয় দার কাছে শেয়ার করতে হবে তবেই পরবর্তী তে কি প্ল্যান হবে সেটা ঠিক করা যাবে।
তনু ওর দিদি সাথে গাড়িতে উঠে বসে আর ছুটকি ওর দাদার বাইকে, আরেকবার হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে যে যার গন্তব্যের দিকে চলতে শুরু করে।
★★★★
আজ বাসা থেকে অফিসের জন্য বের হতে গিয়েই দেখে বাইকটা স্টার্ট নিচ্ছে না, এখন আবার কি হলো কে জানে কয়েকদিন আগেই তো নতুন করে মবিল ভরার সময় সব চেক করা হয়েছিল। সকার সকাল মেজাজটাই গরম হয়ে গেল, এতদিনে অভ্যাস হয়ে গেছে আজ আবার লোকাল বাসে কিংবা উবারে যেতে হবে। যাই হোক বিষন্ন মনটা নিয়েই অফিসের জন্য বেরিয়ে পরে, মোবাইল বের করে কাছাকাছি কোথায় উবারের গাড়ি আছে সেটার লোকেশান দেখতে থাকে কিন্তু রাস্তায় প্রচুর জ্যাম আর আশেপাশে গাড়ির লোকেশানো দেখাচ্ছে না। যে জ্যাম তাতে করে ভেঙে ভেঙে যেতে হবে। দেরি না করে মেইন রাস্তায় দিকে হাটতে শুরু করে, দু তিনবার গাড়ি চেঞ্জ করে অফিসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রুদ্রের অবস্থা একেবারে কাহিল। অফিসে ঢুকতে যাবে তখনি ম্যানেজার ম্যাডামের সাথে দেখা হাই হ্যালো করে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। রুমে ঢুকেই এয়ার কুলার টা ফুল স্পিডে দিয়ে চেয়ারে এলিয়ে পরে, একটু পরেই পিয়ন এসে লেমন সোডা দিয়ে যায়। রুদ্র অবাক হয় কারণ সে তো কিছু অর্ডার করে নি
-আমি তো কিছু আনতে বলি নি, অন্য কারোর টা নিয়ে এসেছো নাকি ভুলে?
-না ম্যাডাম পাঠিয়েছে।
-ম্যাডাম? কোন ম্যাডাম?
-ম্যানেজার ম্যাডাম।
রুদ্র ভাবে আসার পথে হয়তো বেহাল অবস্থা দেখেছে তাই পাঠিয়ে দিয়েছে, সত্যিই যত দেখছে অবাক হচ্ছে এই মনে হয় খুব রাগী মানুষ এই আবার খুব সাধারন। লেমন সোডা টা খাওয়ার পর শরীরটা চনমনে লাগছে।
অফিসে রুপালির সাথে দেখা হয়েছিল, তখন জানতে পারে রুদ্র বাইক ছাড়া এসেছে তখনি রুপালি বলে আজ ও রুদ্র কে নিয়ে লং ড্রাইভে যাবে অফিস শেষে যেন অপেক্ষা করে। রুদ্রেরও মনে হলো একটু ঘুরে আসলে মনটা ভালো লাগবে তাই আর না করে না। রুদ্র একটু আগেই অফিস থেকে বের হয়ে নিচে অপেক্ষা করতে থাকে। রিদ্ধিমা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো লুকিং গ্লাসে রুদ্র কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তাও আবার বাইক ছাড়া, মোবাইল বের করে আন্টি কে ফোন দিয়ে বাইক না আনার কারন টা জেনে নেয়। জানালার গ্লাস নামিয়ে মাথা টা হালকা বের করে রুদ্র কে ডাক দেয়
-কি ব্যাপার মি. রুদ্র, আজ বাইক দেখছি না।
-ম্যাডাম বাইকটা স্টার্ট নিচ্ছিলো না তাই আজ আনি নি।
-ওহ, তাই তখন ওমন দেখাচ্ছিলো, চলুন আজ না হয় আমি ড্রপ করে দিই।
-না না ম্যাডাম আপনাকে কষ্ট করতে হবে না আমি এমনিই চলে যাবো।
-এতে আবার কষ্ট কিসের? নাকি অন্য কোন প্ল্যান আছে তাহলে থাক, আমি আপনার প্ল্যান নষ্ট করতে চাই না।
-(কি করবে ভেবে পায় না, ওদিকে রুপালি অপেক্ষা করবে আবার এদিকে যদি ম্যাডাম না সরাসরি না করে তবে ম্যাডাম রাগ করতে পারে আবার সেটা তনুর কাছেও বলতে পারে, ইশশ তনু কি ভাববে যে আমি আ্যাটিটিউড দেখিয়েছি। না রুপালির সাথে না হয় আরেকদিন যাওয়া যাবে, কেন জানি ম্যাডামের কথা ফেলতে পারছে না সে) না ম্যাডাম তেমন কোন প্ল্যান নেই, আমি ভাবলাম শুধু শুধু আপনাকে কষ্ট দেব কেন।
-কিসের কষ্ট সেটাই বুঝলাম না আমি কি আপনাকে কোলে করে নিয়ে যাবো নাকি, নিন উঠে বসুন।
রুদ্র সামনে সিটেই উঠে বসতে বসতে রুপালি কে মেসেজ করে প্ল্যান ক্যানসেল সেটা জানিয়ে দেয়। গাড়ি চলতে শুরু করে, টুকটাক অফিসিয়াল বিষয়ে কথা হতে থাকে কিন্তু রুদ্র রিদ্ধিমার দিকে একবারও ফিরে তাকায় নি, যতটুকু কথা হয়েছে সবটাই বাইরের দিকে তাকিয়ে। বেশিক্ষণ লাগলো না রুদ্রের বাসায় পৌঁছাতে। বাসার সামনে গাড়ি থামতেই রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে বোকার মত হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে গেট খুলে বাসায় ঢুকতে যাবে তখনি রিদ্ধিমা পেছন থেকে ডেকে উঠে
-আপনাকে এতদূর এসে ড্রপ করলাম, আমাকে বাসায় আসতে বলবেন না??