17-07-2022, 10:21 AM
আগের পর্বের কিছু অংশ......
লালি অবাক হয়ে দেখল হীরা লালির হাত টা ধরে একটা হ্যাঁচকা টানে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে ঝাঁপ দিলো, অশ্বত্থ গাছের ছোট ফুটোর ভিতরে। আর তার থেকে ও অবাক হয়ে গেল যখন দেখল, লালি কে বুকে জড়িয়ে ধরে লাফ দেবার সময়ে, প্রায় ভাসমান অবস্থাতেই নিজের হাত দিয়ে কেদারের দিকে কিছু একটা ইশারা করতেই, গ্রামের কবচের মতন একটা নীল আলো দিয়ে কেদারের চার পাশ টা ঢেকে গেল নিমেষেই। লালির মনে হল সে জ্ঞান হারাচ্ছে।
অধ্যায় তিন
পর্ব ১৪
বিশাল জলা। মাঝে মাঝে জল আর বেশীর ভাগ টাই বিশাল ঘাসের বন। ধারালো ঘাসের পাতার ধার। বিশ্রী দুর্গন্ধ জলার থেকে উঠে আসছে। কত সহস্র বছরের পুরোন জল আর তার নীচে থাকা পাঁক। কিন্তু ভোলার ওসবে কিছু যায় আসে না। সামান্য নাক ও সিটকে ও নেই ও। এই সব দুর্গন্ধে ও অভ্যস্ত, সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রোগা প্যাংলা ভোলা কিন্তু হাতে এক খানা বিশাল ধনুক। পিঠে অক্ষয় তূনীর। কোমরে বিশাল তলোয়ার। দুইদিকে জলা কে রেখে ভোলা এগিয়ে যাচ্ছিল আর ও গভীর জঙ্গলের দিকে, জঙ্গলের রাস্তা ধরে। সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল ভোলা। খুব সন্তপর্ণে, জলার থেকে আওয়াজ আসছিল, জল কেটে এগিয়ে আসার। শুনল আওয়াজ টা কিছুক্ষণ ও। মরা মানুষের মতন মুখে একটা আলতো হাসি খেলে গেল। আরো কিছু টা এগিয়ে গিয়ে গেল ভোলা। জন্মাষ্টমীর অন্ধকারে ধীরে ধীরে ভোলার রূপ বদলে বিশাল পুরুষের রূপ নিল। নিজের ধনুক পাশে রেখে গম্ভীর গলায় বলল,
- এস এস শিশুপাল, আর লুকিয়ে থেক না। বেরিয়ে এস। ভয় নেই। আমরা এক হলে এই ধরিত্রী আমাদের ভোগ্যা হবে। জাননা এই মেদিনী বীর ভোগ্যা? এস এস বেড়িয়ে এস। লুকিয়ে থাকার সময় আর নেই।
কথা শেষ ও হলো না। জল থেকে লাফ দিয়ে উঠে এল বাঘমুড়ো। দেখেই মনে হচ্ছে মারাত্মক উত্তেজিত। আর আগের থেকে শক্তিশালী। বিশাল ছাতির সাথে পেশী বহুল শরীর। শরীরে সামান্য মেদ ও নেই। সামর্থ্যের সাথে গতির মিশেল বাঘমুড়োর মধ্যে। সাথে আছে সহস্র বছরের জিঘাংসা। অশ্বথামা হেসে উঠল বাঘমুড়োর দিকে তাকিয়ে। দুজনায় সামনা সামনি এসে দাঁড়াল। প্রথম কথা অশ্বথামাই বলল,
- নতুন শক্তি, বেশী সামর্থ্য কেমন লাগছে শিশুপাল?
বাঘমুড়োর মুখে কথা তো এলো না। কিন্তু নিজের গর্জনে বুঝিয়ে দিল সে খুশী। ছড়িয়ে পরল সেই মৃদু গর্জন জলার বাদাবনের ভিতরে। উড়ে গেল কিছু পাখি সামনের বিশাল মাদার গাছ থেকে। নিজের হাত টা তুলে পেশীর সমাহার দেখাল অশ্বথামা কে। অশ্বথামা খুশী হল। কারন ও নিশ্চিত হয়ে গেছিল বাঘমুড়ো নিজের সামর্থ্য বাড়াতে পেরে খুশী হয়ে গেছে। এখন বাঘমুড়োর সামর্থ্য ই প্রয়োজন ওর। ওই মণির কাছে যাবার সাধ্য নেই তার। কিন্তু বাঘমুড়ো ওই গ্রামে ঢুকতে পারবে কিনা সেটা কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। বাঘমুড়োর সাথে কথা শুরু করল ও।
- দেখ শিশুপাল, সেই কবে থেকে তুমি শাপিত হয়ে এই জলায় ঘুরে বেড়াচ্ছ। আর আমিও তাই। আমার দরকার মণি আর তোমার দরকার মুক্তি। চল না দুজনে মিলে এই সমস্যার সমাধান করি। আমি আগেও এসেছিলাম। কিন্তু সেই সময়ে তুমি আমার ক্ষমতা কে গ্রাহ্য কর নি। কিন্তু আজকে বুঝলে তো, আমার ক্ষমতা ও কম নয় কিছু। আমার পিতা কোনদিন মানেন নি আমি অর্জুন সম বীর। সেই আক্ষেপ আমার আজ ও বর্তমান। আমি পরশুরাম শিষ্য, দ্রোণ পুত্র। অথচ চিরকাল ভয় পেয়ে এসেছি অর্জুন কে। আর তারপরে, ভীম কত নৃশংস ভাবে আমার মাথা থেকে খুবলে নিল আমার প্রাণপ্রিয় মণি। ভেবে দেখ শিশুপাল, প্রান ত্যাগ করতে পারব না আমি, কিন্তু বাঁচতে হবে প্রাণ হীন হয়ে। উফ এতো বড় অভিশাপ আমাকে দিল কৃষ্ণ? আর তুমি? তুমিও ও চিরকাল কৃষ্ণ র থেকে পেয়ে এসেছ অপমান। তোমার প্রাণ সে নেবে ঠিক হয়ে গেছিল তোমার শৈশবেই। একশ অপরাধ ক্ষমা করবে নাকি? ভাব তুমি কত অপমান নিয়ে বেঁচে এসেছ তুমি? তোমার বাগদত্তা রুক্মিণী কে বিয়ে করেছিল কৃষ্ণ, অপহরণ করে। একজন পুরুষের কাছে এ যে কত বড় অপমান সে আমাকে বলে দিতে হবে না।
অশ্বথামার কথা শেষ ও হলো না। বাঘের গর্জনে মনে হল ঝড় উঠল চারিদিকে। ভারী হয়ে গেল মুহুর্তে পরিবেশ টা। পেশী বহুল শরীরে পেশী কিলবিল করে উঠলো। আর শুরু হলো মুহুর্মুহু গর্জন। অশ্বথামা বুঝল, সঠিক জায়গায় আঘাত হেনেছে ও শিশুপালের ওরফে বাঘমুড়োর। চুপ রইল শিশুপাল। ও জানে সময়ের অপেক্ষা মাত্র যখন বাঘমুড়ো ওর ইশারায় কাজ করবে। খানিক বাদে বাঘমুড়োর গর্জন থামলে অশ্বথামা বলল,
- চল না শিশুপাল, আমরা এক হয়ে যাই। তুমি আমাকে সহায়তা কর আর আমি তোমাকে। তুমি আমাকে গ্রাম থেকে মণি এনে দাও আর আমি তোমাকে শক্তিশালী করে দি। এই গ্রাম কে কৃষ্ণ রক্ষা করলে , আমার কাছে আছে আমার ধনুকের ক্ষমতা আর মহাকালীর আশির্ব্বাদ।
এই বলে অশ্বথামা হাত বাড়ালো বাঘমুড়োর দিকে। বাঘমুড়ো নিজের হাত বাড়াতেই একটা ব্যাপার হয়ে গেল মুহুর্তেই। একটা অদৃশ্য বন্ধন যেন দুটো হাত কে বেঁধে দিল। হলুদ আলোর একটা আভাস ফুটে উঠল দুই কব্জির মিলনস্থলে। মেঘের দল মহানিনাদে অট্টহাসি করে উঠলো। ভয়ংকর মেঘনাদে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠলো। বৃষ্টির দেরী নেই আর। সব থেথাম হলে অশ্বথামা বলল,
- শোন শিশুপাল, এই গ্রামেই আছে মণি। তোমাকে সেটা এনে দিতে হবে। আমি জানি, তুমি গ্রামে প্রবেশ করতে পারবে এবারে। বাধা কেটে গেছে। সুদর্শণের মহাকবচ ভাঙছে একটু একটু করে। পূব দিক দিয়ে তুমি প্রবেশ কোর। দেখ আমার মণির চরিত্র একটু অন্যরকম। শক্তিশালী আত্মার কাছাকাছি আসলে তার উজ্জ্বলতা বেড়ে যায়। অতএব স্বাভাবিক ভাবেই, তোমার কাছা কাছি আসলে পরে সে আরো বেশী উজ্জ্বল হবে। রাতের বেলায় খুঁজো। এই টুকু গ্রাম সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু আমি পারব না ওকে নিয়ে আসতে। কৃষ্ণের অভিশাপে, আমি নিজে ওর কাছে গেলেই দুর্বল হয়ে পরি। কিন্তু কৃষ্ণ বা কেউ, যে কেউ সেই মণি আমার হাতে তুলে দিলে মণিহারা হয়ে বেঁচে থাকার অভিশাপ থেকে হয়ত মুক্তি পাব আমি। ফিরে পাব আবার নিজের পুরোন শক্তি। আবার বাঁধতে পারব আমার ব্রহ্মাস্ত্র কে নিজের ধনুকে। ছাড়খাড় করে দেব তখন এই পৃথিবী কে আমি। রাজত্ব করব আমরা দুজনে।
মুহুর্মুহু গর্জন শুরু করল বাঘমুড়ো। নতুন খেলায় মেতে ওঠার তাগিদ যেন শরীরের পেশীতে খেলা করতে লাগল। অশ্বথামা তার পরে একটু গলা নীচু করে বলল,
- তোমাকে সাবধান করে দি শিশুপাল। এই গ্রামে সম্ভবত শেষ নাগের অধিষ্ঠান আছে। হ্যাঁ ঠিক ই শুনতে পেয়েছ। শেষ নাগ। সাবধানে। রহিম বলে একটা ছেলে। অতুল ক্ষমতার অধিকারী কিন্তু শেষ নাগ। অতুল ক্ষমতা। সেই রাজসভাতেই কৃষ্ণ না আটকালে হয়ত বলরাম এর বেশে শেষ নাগ ই তোমাকে হত্যা করত। পারত পক্ষে এড়িয়ে চলবে শেষ নাগ কে। তোমার শরীরে আমার তন্ত্রের মায়া জাল আছে। সেদিনে যুদ্ধের সময়ে শেষ নাগের আঘাত তোমার শরীরে লাগে নি। তারকীণি তোমাকে সুরক্ষা দিচ্ছিল। কিন্তু ভয় অন্য জায়গায়। সেটা হলো, সে কোথায়? শেষ নাগ আছে যখন, তখন সে ও আছে। আমার সব মায়া কাজ করবে, কিন্তু সেটা তাঁর অনুপস্থিতিতে। তাঁর সামনে কোন মায়া কাজ করবে না। অতএব সাবধান। রহিম কে দেখলে সেখান থেকে পালাবে। আমাদের খুব সাবধানে মণি উদ্ধার করতে হবে। একবার মণি পেলে তখন ব্যাপার টা অন্যরকম হবে। আমাদের দুজনাকেই মুক্তি পেতে হবে শিশুপাল। চলো আমরা যাই। আমার শিকার দরকার তোমাকে গ্রামে পাঠানোর আগে। চল।
ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল। এমন তীব্র বৃষ্টি বোধকরি এই গ্রাম কোনদিন ও দেখে নি। কি তোড়জোড় তার। কি মারাত্মক শনশন করে আওয়াজ। আজকে বোধকরি সব ভাসবে। একে অন্ধকার তারপরে এমন তীব্র বৃষ্টি। কিন্তু দুজনের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। ওরা এগিয়ে আসতে শুরু করল গ্রামের দিকে।
মহাদেবের বাড়ির পূব দিকে সরলা ঘোষের বাড়ি। বলতে গেলে গ্রামের মাঝখান বরাবর সব থেকে সামনের বাড়িটা সরলার। জলার মাঠের দিক থেকে ঢুকলে রাস্তার বাম দিকেই প্রথম বাড়ি টা সরলার বাড়ি। আর তার পাশে একটা বিঘে দশেকের পুকুর আর পুকুরের পরেই প্রথম বাড়ি টা মহাদেবের। সরলা বিধবা মহিলা। একমাত্র ছেলে দীনেশ কে নিয়ে থাকে। বছর বাইশের দীনেশ বড় কর্মঠ ছেলে। খান চারেক গরু আছে। দুধ বিক্রী করে শহরে আর দুগ্ধজাত খাবার দাবার নিজেদের গ্রামের হাটে বেঁচে না হলে শহরের বেশ কিছু দোকান আছে ওর বাঁধা খদ্দের। সেই খানেই বিক্রী করে। সেদিনের হিসেব নিকেশ করে ও শুতে যাবে তখন ই আকাশে ঘন মেঘ গর্জন শুনতে পেল সে। বেড়িয়ে এল বাইরে। গরু গুলো সব ঠিক আছে নাকি একবার দেখে নেবে ও। ওর গোয়ালের দরজা দিয়ে উঠোনের জল ঢোকে বৃষ্টি হলে। গোয়াল টা একটু নাবু কিনা। খানিক বালির বস্তা আর চট চাপিয়ে দেবে গোয়ালের দরজায়। জল ঢুকবে না আর তাহলে।
বাইরে বেড়িয়ে এসে বুঝল বাতাসে বুনো জলের গন্ধ। তার মানে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে পরতেই যা দেরী। আকাশে উড়ছে জলকণা। হাওয়ায় উড়ছে এখন। উঠোনে নামতে না নামতেই শুরু হলো ঝমঝম করে বৃষ্টি। কোনরকমে মাথায় হাত দিয়ে ছুটে এলো গোয়ালে দীনেশ। রাখাই থাকে গোয়ালের টিনের দরজার কাছে বালির বস্তা। আর কিছু চট। ভালো করে উঁচু করে দিল দরজার বাইরে টা গোয়ালের। যাক জল ঢুকবে না। সকালে উঠে জল দেখলে গোয়ালের পিছন দিক এর দেওয়াল হালকা কেটে দিলে জল বেরিয়ে যাবে। কাজ হয়ে যাবার পরে একবার গরু গুলো কে গলায় আদর করে দিল দীনেশ। এই অন্ধকারেও ও বলে দিতে পারে গলকম্বল ধরেই কোন গরু টার কি নাম। ও ছাড়া একমাত্র হীরা পারে এই গ্রামের সব গুলো গরু কে চিনতে। বস্তুত এই নাম গুলো হীরার ই দেওয়া। কিন্তু মনে হলো গরু গুলো চঞ্চল। কাছে থাকলে চুপ থাকলে কিছু একটা ছেড়ে অন্য টার কাছে গেলেই , বাকি গুলো ছটফট করছে। কি হলো সাপ খোপ ঢুকল নাকি গোয়ালে? সর্বনাশ। এখনি টর্চ টা আনতে হবে। ও বাইরে যাবার তোরজোড় করতেই পেল গন্ধ টা। একটা অদ্ভুত বাজে পচা গন্ধ। ইশ বমি হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। এমন বিশ্রী গন্ধ কোথা থেকে আসছে? ও হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো গোয়াল থেকে।
কই কিছু তো নেই। কিন্তু বাইরে গন্ধ টা আরো বেশী। এগোতে পারছে না আর দীনেশ। মা কে জাগাবে? হ্যাঁ জাগানোই ভাল। কেমন গা টা ছম ছম করছে দীনেশের। আড়ষ্ট ভাব একটা। আর নিতে পারছে না দীনেশ। ইশ কি ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ!!! মা কে ডাকার জন্য এগোতেই কিছু একটা দেখে থমকে গেল দীনেশ। বিদ্যুতের আলোয় দেখল মাটির পাঁচিল এর মাথায় দুটো ভয়ঙ্কর মুখ। একটা মুখ বাঘের আর একটা মুখে যেন মৃত্যুর ছায়া। পচা গলা একটা মুখ। ভয়ঙ্কর আতঙ্কে মা কে ডাকতে যাবে সেই সময়েই, হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ল মাটির পাঁচিল। সেকেন্ডের ও কম সময়ে বিশাল চেহারা নিয়ে তড়িৎ গতিতে বাঘমুড়ো ছুটে এসে গলা টা টিপে ধরল দীনেশের। পলকে তুলে নিল দীনেশের শরীর টা নিজের এক হাতেই। গলা টা চেপে ধরে বাঘমুড়ো তুলে ধরেছে দীনেশ কে। দীনেশ কোন ভাবেই আওয়াজ বের করতে পারছে না। আর বের করলেও এই বৃষ্টি তে সেই আওয়াজ কেউ শুনতেও পারবে না। দীনেশের প্রাণ বেড়িয়ে যাবার আগে, মনে মধ্যে মরণের ইচ্ছে জেগে উঠল , এই ভয়ানক আতঙ্কের হাত থেকে মুক্তি পেতে।দীনেশ কে জলার মাঠে এনে বাঘমুড়ো অশ্বথামার নির্দেশে ধড় থেকে মাথা টা কে ছিঁড়ে ফেলল। দীনশের ভয়ঙ্কর মরণ চিৎকারে চারিদিকের নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙ্গে গেল। পরে রইল দুই দিকে ধড় আর মাথা। ধড়ের পা দুট খানিক ছট ফট করে স্থির হয়ে গেল। মাঠের এক দিকে গড়িয়ে যাওয়া মাথা খানা পরে রইল নিথর হয়ে, ভয়ঙ্কর আতঙ্কে চোখ দুটো অস্বাভাবিক বের করে।
- তুমি এবারে যাও অশ্বথামা। আজকেই সেই মণি পাবে এমন কোন স্থিরতা নেই। খোঁজা বন্ধ করলে হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই মণি আমাদের খুঁজে পেতেই হবে। আমার একটু কাজ আছে। কাজ টা শেষ করে নি। তুমি বরং লেগে পড় কাজে। আর দাঁড়াও। এই আংটি তুমি পরে যাও। পিছন থেকে রক্ষা পাবার জন্য এই আংটি তোমার কাজে লাগবে। আর যা বলেছি। এর পরেও বিপদ বুঝলে পালিয়ে আসবে। আগের দিনের মতন যুদ্ধে লেগে যেও না।
এই বলে তূনীর থেকে একটা আংটি বের করে অশ্বথামা পরিয়ে দিল বাঘমুড়ো কে। অপেক্ষা করল না বাঘমুড়ো আর। চলে গেল ক্ষিপ্র তার সাথে। আর অশ্বথামা লেগে পড়ল নিজের কাজে। শুনশান বৃস্টিস্নাতা জলার মাঠে একটা গন্ডী কেটে ফেলল অশ্বথামা নিজের তূনীরের একটা তীর দিয়ে। অবাক ভাবে, গন্ডীর ভিতরে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। তীর দিয়ে নিজের আসন নির্দিষ্ট করে বসে পড়ল অশ্বথামা সেখানে। চাদরের মতন একটা ঢাকা তে ঢেকে গেল ওই জায়গা টা। পূর্ব দিনের মতন একটা বিশাল অগ্নী কুণ্ড বানিয়ে ফেলল অশ্বথামা। নিজের তলোয়ার দিয়ে কেটে কুচি কুচি করে ফেলা দীনশের শরীর খন্ড নিক্ষেপ করতে থাকল অগ্নী কুণ্ডে। সহসা এক বিশাল রক্ত বর্ণের শেয়াল উপস্থিত হলো যেন মাটি ফুঁড়ে। গম্ভীর আওয়াজে অশ্বথামা বলল,
- কে তুই?
- ভুলে গেছিস নাকি?
একটা পুরুষের গলায় উত্তর এল শেয়ালের কন্ঠ থেকে। অশথামা বিরক্ত হল। কিন্তু চেঁচিয়ে উঠল
- যা জিজ্ঞাসা করছি উত্তর দে।
- আমি ব্রহ্মপিশাচ। কি চাস এখন তুই?
অশ্বথামা ছুঁড়ে দিল মাংসপিণ্ড শেয়ালের দিকে। বিশাল হাঁ করে খেয়ে নিল কাঁচা মাংস শেয়াল টা। অশ্বথামা বলে উঠল,
- মণি কোথায় আছে?
- কেন বাঘমুড়ো কে তো পাঠালি? ও খুঁজুক।
- যা জিজ্ঞাসা করছি জবাব দে। কোথায় আছে?
- আমিও জানি না। তবে অনুভব করতে পারি সে এই গ্রামেই আছে।
- কোথায়।
- জানিনা, আমরা যারা জীবন মৃত্যুর মাঝের জীব, তারা এমন কোন দৈব মণির সামনেও যেতে পারি না। ঠিক যেমন তুই পারিস না।
- হুম কে পারবে?
- কেউ না। স্বয়ং নারায়ণ ছাড়া সেই মণি কোথায় আছে কেউ বলতে পারে না। আর জানে অলায়ুধের বংশধর।
- হুম আমার কাছে খবর আছে। সে রাক্ষসের বংশধর কি জীবিত এখনো?
- হ্যাঁ
- কে সে? কি নাম তার?
- তার নাম অলায়ুষ। তার ছেলের নাম অলকজিত। আর নাতির নাম অলকৃত্য।
- হুম ঠিক আছে। খুঁজে নেব আমি। তবে তুই বাঘমুড়োর কে সুরক্ষা দিবি।
আবার এক খন্ড মাংসপিণ্ড ছুঁড়ে দিল অশ্বথামা শেয়ালের দিকে। আগের ভঙ্গী তেই শেয়াল টা লুফে নিল সেই মাংস খন্ড। তার পরে বলল,
- পারব। তবে আজকের দিনের জন্যেই। কালকে তোকে আবার ডাকতে হবে। না ডাকলে আমি আসি না।
- দেখা যাবে। তুই এখন যা, বাঘমুড়োর পিছনে। ও পেয়ে গেলে ওই মণি নিয়ে যেন সোজা এখানেই আসে। এর যেন অন্যথা না হয়।
- বুঝেছি।
চলে গেল শেয়াল টা। ঠিক যেমন ভাবেই এসেছিল, তেমন ভাবেই অদৃশ্য হয়ে গেল হুশ করে।
পরের দিন সকালে যখন লালির ঘুম ভাঙল, দেখল নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। নিজের পোশাক বদলানো। একটা সাদা রাত্রিবাস পরে ও শুয়ে। ঘুম ভেঙ্গে গেছিল একেবারে। এমন ভাবেই ভাঙল যেন ও ঘুমের কোন লেশ মাত্র নেই শরীরে আর মনে। মন আর মাথা খালি করে এমন ঘুম মনে হয় না ও কোন দিন ঘুমিয়েছে বলে। আস্তে আস্তে বাইরে বেড়িয়ে এল লালি। দেখল, উঠোনে বড় ঠাম্মু বড়ি দিচ্ছে। আর লালির বাবা একবার গোয়াল থেকে কল পাড়ে যাচ্ছে জল নিতে আর গোয়ালে ঢুকছে আবার। লালি বুঝল ওর বাবা গোয়াল পরিষ্কার করছে। ঝলমলে রোদ। ও এসে বসল দুয়ারে। ঠাম্মু দেখছে লালি কে আর হাসছে। কি হলো ঠাম্মুর? এক এক করে লালির মাথায় ভিড় করে আসতে থাকল কালকের ঘটনা গুলো।
- ওগুলো কি সত্যি ই ছিল নাকি স্বপ্ন? স্বপ্ন হলে সে শুতে গেল কখন? আর যদি স্বপ্ন না হয় তবেই বা কি করে ও এলো এখানে। ও পোশাক বদলে দিল কে? পরিষ্কার মনে আছে হীরার সাথে দুপুরের পরে খেয়ে দেয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। তারপরে যা হলো সেটা কে স্বপ্ন বলা চলে না। তবে কি সত্যি ছিল সেই সব? তার মানে অশ্বথামার মণি এই গ্রামেই আছে? এই গ্রামেই অলায়ুধের বংশধর বাস করছে? কবচ ভাঙছে, মানে এখন গ্রামে নারায়ণের ও অধিবাস চলছে? ওদের মধ্যে শক্তি কি নারায়ণের প্রভাবেই এসেছে? কিন্তু গ্রামে আরো মানুষ থাকতে ওদের মধ্যেই এলো কি করে শক্তি?
এই রোদ ঝলমলে সকালেও গা ছম ছম করে উঠলো লালির এই সব কথা ভেবে। কিন্তু সবার আগে হীরার সাথে দেখা করতে হবে ওকে। এখনি। কালকে ওখান থেকে চলে আসার সময়ে, হীরার কার্যকলাপ ও অদ্ভুত ছিল।
- ও কি ভাবে জানল ওই ',ের ছেলে বেঁচে? আর ওই ফুটোর ভিতরে লাফ দেবার সময়ে ও কি করল যেটা কবচের মতই নীল রঙ হয়ে ', কে ঘিরে ফেলল কবচের মতন করে? আচ্ছা, হীরা কালকে এতো ঘটনা পরম্পরা দেখে একবার ও চমকে গেলো না তো? ও কি জানত এই সব?
উফ মনের মধ্যে এতো প্রশ্নের মেলা বসেছে লালি একেবারে পাগল হয়ে গেল। তার পরে মণির ধাঁধা। কে উদ্ধার করবে সেই ধাঁধার উত্তর? হীরা? নাহ লালিকে বলতেই হবে এই সব কথা, নগেন দাদু, রহিম দা আর অভি কে। সামনে তো সমূহ বিপদ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মণি উদ্ধার করতেই হবে। এই মণি অশ্বথামার হাতে পরলে আর রক্ষে নেই। ওই ', তো সেই কথাই বললেন। অনেক কাজ এখন। সবার আগের কাজ মণি উদ্ধার।
লালি তড়িঘড়ি সকালের কাজ কর্ম সেরে তৈরি হয়ে নিয়ে বেড়িয়ে এলো বাড়ি থেকে। সবার আগে গেল হীরা দের বাড়ি। গিয়ে দেখল হীরা নেই যথারীতি। উমা কাকি বলল, পড়তে গেছে। কিন্তু লালির কেন জানিনা মনে হলো, হীরা পড়তে যায় নি। ও হয়ত বুঝতে পারল হীরা কোথায় যেতে পারে। ও আর অপেক্ষা করল না মহাদেব কাকার বাড়িতে। সোজা চলে এল জলার মাঠে। এসেই দেখল হীরা অশ্বত্থ গাছ থেকে শুধুই পা দিয়ে মেপে গ্রামের ভিতরে ঢুকছে। লালি বুঝে গেল যে কালকের ধাঁধা নিয়ে হীরা লেগে পরেছে। লালির মনের অনেক কিছু মিটে গেল সেই মুহুর্তেই হীরা কে দেখে। এর অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, কালকের যা যা ঘটনা ঘটেছে সব সত্যি। সেই ',ের বলা ধাঁধা ও সত্যি। মণি এই গ্রামেই আছে। শুধু একটাই খটকা লাগছে, কালকে রাতে ওর পোশাক বদলে দিল কে? ভেবেই শিউরে উঠলো লালি লজ্জায়।ততক্ষণে হীরা দেখতে পেল লালি কে। ইশারায় ডাকল। লালি সামনে যেতেই বলল,
- নাও কাজ শুরু কর। অনেক টা মানে আমি উদ্ধার করেছি। বাকি টা করতে আমার তোমার সাহায্য লাগবে।
লালি দেখল হীরা একেবারে সাধারণ ভাবেই কথা বলছে। মানে কালকের রাতের ঘটনা ও মনের মধ্যে রাখেই নি। হয়ত পোশাক বদলে দেবার ব্যাপার টা ও মাথায় নেই। অনেক প্রশ্ন লালির কাছে। জানেনা লালি কখন বাড়িতে ফিরেছে। নিশ্চই অচেতন হয়েই ফিরেছিল। বাড়িতে কেউ কোন প্রশ্ন করল না কেন তাহলে? যাক এই সব ভাবার সময় নেই এখন আর। কাজে লেগে যেতে হবে।সময় খুব কম। লালি বলল,
- কি উদ্ধার করলি শুনি?
- দেখ পেট কাটা গাছ ডান দিকে রেখে সোজা হাঁটার কথা বলা ছিল ছড়া তে। তবে সিংহ দুয়ার পাওয়া যাবে। এখন এটা তো পরিষ্কার, তখন কার সিংহ দুয়ার এখন আর নেই। আমরা জায়গা টা পেতে পারি শুধু। এখন প্রশ্ন হলো, ডান দিকে রেখে হাঁটা, ৩৬০ ডিগ্রী তে হতে পারে তাই না? দেখতে গেলে ইনফাইনাইট পসিবিলিটি। তাহলে কোন দিকে? নিশ্চই গ্রামের দিকেই হবে। এটা আমার অনুমান, অলায়ুধের বংশধর , গ্রামে বাস করে মণি কে নিশ্চই নিজের থেকে খুব দূরে রাখবে না। খুব ভালো হত যদি কোন একজন বৃদ্ধ কাউকে পাওয়া যেত, যে গ্রামের পুরোন ব্যাপার স্যাপার জানে। তা না হলে আমাকে চন্ডীপুরের লাইব্রেরী তে যেতে হবে এখন ই। আমি দেখেছিলাম, বাঘমুড়োর আতঙ্ক নামে একটা বই লাইব্রেরী তে আছে। পড়েছিলাম আমি সেটা। কিন্তু সিংদরজার কথা পাই নি।
লালি অবাক হয়ে শুনছিল হীরার কথা। এই ছেলে যে খুব বড় জায়গায় যাবে সেই নিয়ে সন্দেহ নেই। কি অদ্ভুত মেধা হীরার! লালি হাঁ করে হীরা কে দেখছিল। ওর মনে হলো সরাসরি বাঘমুড়ো আর অশ্বথামার সাথে লড়াই না করলেও, এই বুদ্ধির লড়াই এ হীরা কে একসাথে নেওয়াই যায়। লালি সিদ্ধান্ত নিল হীরা কে সব বলবে। ওদের টিমের ব্যাপারে। সেখানে তো নগেন দাদুও আছে। অনেক কথাই নগেন দাদু জানবে, যা হয়ত ওই লাইব্রেরীর বই এ লেখা নেই। ততক্ষণে হীরা এগিয়ে এসে লালির হাঁ মুখ খানা বন্ধ করে দিয়েছে।
- এই যে , কিছু বললে ভাল হয়।
লালির চমক ভাঙল। খুব খুশী হয়ে বলল,
- আমি কি হেল্প করব তোকে? তুই তো নিজেই সব কিছু বের করে ফেলেছিস? তোর কাছে বুদ্ধির দৌড়ে আমি কি আর পাত্তা পাব? তবে তোকে লাইব্রেরী যাওয়ার কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারি।
- কি করে? অনেক প্রশ্ন আছে,তুমি বুঝতে পারছ না। যেমন বলেছে, সাতের পিঠে সাত কে নিয়ে সিং দরজা পাওয়া যাবে। এখন হেঁটে সাতাত্তর পা এগোতে হবে, এটা আমি নিশ্চিত। কিন্তু কোন দিকে? সেই জন্যেই পুরোন কাউকে দরকার। ভেবে দেখ কালকে আমরা যে প্যারাল্যাল টাইম লাইনে গেছিলাম তখন এই অশ্বত্থ গাছের তলা তেই বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। কিন্তু কোন সিং দরজা দেখিনি। মানে হলো, সেই সিং দরজা ভেঙ্গে গিয়েছিল সেই সময়েই। কাজেই এমন কাউকে দরকার যে এই গ্রামের অনেক পুরোন ইতিহাস জানে।
লালি যতই হীরা কে দেখছে, ওর কথা শুনছে ও অবাক হয়ে যাচ্ছে। সেই পুচকে ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে। বিজ্ঞের মতন এক এক করে জট ছাড়াচ্ছে ধাঁধার। লালি বলল,
- নগেন দাদু কে জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়?
হীরা মনে হল একবার মুচকী হাসল, বলল,
- হ্যাঁ ভালই হয়, সাথে অভি আর রহিম দা কেও ডেকে নিয়ে এস। সবাই মিলে আলোচনা করলে ব্যাপার টা আরো সহজ হবে।
লালি চমকে উঠল। এদের কথা হীরা জানল কি ভাবে? লালি কিছু বলতে যাবে তার আগেই হীরা বলল,
- সময় বেশী নেই আমাদের হাতে। যাও। ওদের কে ডেকে নিয়ে এস। তুমি জান না, কাল রাত থেকে সরলা কাকির ছেলে দীনেশ নিখোঁজ।
- অ্যাঁ?
- হুম। দেখ না গিয়ে সরলা কাকি কান্না কাটি করছে।
- সেকী? কই শুনিনি তো?
- হুম, দেখ গিয়ে তোমার পুরো টিম সেখানে আছে। তুমি ই লেট করে ফেললে।
লালি আর দেরী করল না। ছুটে গেল সরলা কাকির বাড়ির দিকে। পিছন ফিরে দেখল হীরা আগের মতই ব্যস্ত হয়ে পরেছে ধাঁধার উত্তর খুঁজতে। লালি সোজা চলে এলো সরলা কাকির বাড়িতে। এসেই দেখল, অনেক লোক জন জড়ো হয়ে গেছে বাড়িতে। মাটির দেওয়াল টা ভেঙ্গে গেছে। মনে হচ্ছে কোন বড় ট্রাক্টর বা লরি এসে ধাক্কা মেরেছে। অনেক টা জায়গা জুড়ে ভাঙ্গা মাটির দেওয়াল টা। দেখল, রহিম দা, অভি আর নগেন দাদু তিনজনেই আছে। কিছু বুঝতে পারল না লালি। কিন্তু এটা বুঝল দেওয়াল ভেঙ্গে কিছু ঢুকেছে। যদি বাঘমুড়ো হয়, তাহলে দেওয়ালে এমন ক্ষত হওয়া স্বাভাবিক। তাহলে হিসাবে দাঁড়াল এটাই যে, বাঘমুড়ো দেওয়াল ভেঙ্গে দীনেশ কে তুলে নিয়ে গেছে? লালির বুক টা আঁতকে উঠল। আর পুকুর টা পেরোলেই হীরা দের বাড়ি। দীনেশ না হয়ে হীরা হলে কি হতো সেটা ভেবেই লালি ভয়ে কুঁকড়ে গেল একেবারে। কালকে রাতের বৃষ্টি তে কাদা হয়ে গেছে জায়গা টা। না হলে পায়ের ছাপ দেখে কিছু আন্দাজ করা যেত। কিন্তু কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না এখন আর। ওদিকে দুয়ারে বসে সরলা কাকি কাঁদছে ভীষণ। লালি আর সহ্য করতে পারল না সেই কান্না। বেড়িয়ে এলো ও বড়ি থেকে। মন টা খারাপ হয়ে গেল। ও বেড়িয়ে এসে বসল অশ্বত্থ গাছের তলায়। হীরা সেই পায়ের মাপে মেপেই চলেছে গাছের গোঁড়া থেকে। চারিদিক কেমন ভয়ের পরিবেশ তৈরি হল সহসা। লালি বুঝল, সেটা লালির মনের ভয়ের কারণে।
লালি অবাক হয়ে দেখল হীরা লালির হাত টা ধরে একটা হ্যাঁচকা টানে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে ঝাঁপ দিলো, অশ্বত্থ গাছের ছোট ফুটোর ভিতরে। আর তার থেকে ও অবাক হয়ে গেল যখন দেখল, লালি কে বুকে জড়িয়ে ধরে লাফ দেবার সময়ে, প্রায় ভাসমান অবস্থাতেই নিজের হাত দিয়ে কেদারের দিকে কিছু একটা ইশারা করতেই, গ্রামের কবচের মতন একটা নীল আলো দিয়ে কেদারের চার পাশ টা ঢেকে গেল নিমেষেই। লালির মনে হল সে জ্ঞান হারাচ্ছে।
অধ্যায় তিন
পর্ব ১৪
বিশাল জলা। মাঝে মাঝে জল আর বেশীর ভাগ টাই বিশাল ঘাসের বন। ধারালো ঘাসের পাতার ধার। বিশ্রী দুর্গন্ধ জলার থেকে উঠে আসছে। কত সহস্র বছরের পুরোন জল আর তার নীচে থাকা পাঁক। কিন্তু ভোলার ওসবে কিছু যায় আসে না। সামান্য নাক ও সিটকে ও নেই ও। এই সব দুর্গন্ধে ও অভ্যস্ত, সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রোগা প্যাংলা ভোলা কিন্তু হাতে এক খানা বিশাল ধনুক। পিঠে অক্ষয় তূনীর। কোমরে বিশাল তলোয়ার। দুইদিকে জলা কে রেখে ভোলা এগিয়ে যাচ্ছিল আর ও গভীর জঙ্গলের দিকে, জঙ্গলের রাস্তা ধরে। সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল ভোলা। খুব সন্তপর্ণে, জলার থেকে আওয়াজ আসছিল, জল কেটে এগিয়ে আসার। শুনল আওয়াজ টা কিছুক্ষণ ও। মরা মানুষের মতন মুখে একটা আলতো হাসি খেলে গেল। আরো কিছু টা এগিয়ে গিয়ে গেল ভোলা। জন্মাষ্টমীর অন্ধকারে ধীরে ধীরে ভোলার রূপ বদলে বিশাল পুরুষের রূপ নিল। নিজের ধনুক পাশে রেখে গম্ভীর গলায় বলল,
- এস এস শিশুপাল, আর লুকিয়ে থেক না। বেরিয়ে এস। ভয় নেই। আমরা এক হলে এই ধরিত্রী আমাদের ভোগ্যা হবে। জাননা এই মেদিনী বীর ভোগ্যা? এস এস বেড়িয়ে এস। লুকিয়ে থাকার সময় আর নেই।
কথা শেষ ও হলো না। জল থেকে লাফ দিয়ে উঠে এল বাঘমুড়ো। দেখেই মনে হচ্ছে মারাত্মক উত্তেজিত। আর আগের থেকে শক্তিশালী। বিশাল ছাতির সাথে পেশী বহুল শরীর। শরীরে সামান্য মেদ ও নেই। সামর্থ্যের সাথে গতির মিশেল বাঘমুড়োর মধ্যে। সাথে আছে সহস্র বছরের জিঘাংসা। অশ্বথামা হেসে উঠল বাঘমুড়োর দিকে তাকিয়ে। দুজনায় সামনা সামনি এসে দাঁড়াল। প্রথম কথা অশ্বথামাই বলল,
- নতুন শক্তি, বেশী সামর্থ্য কেমন লাগছে শিশুপাল?
বাঘমুড়োর মুখে কথা তো এলো না। কিন্তু নিজের গর্জনে বুঝিয়ে দিল সে খুশী। ছড়িয়ে পরল সেই মৃদু গর্জন জলার বাদাবনের ভিতরে। উড়ে গেল কিছু পাখি সামনের বিশাল মাদার গাছ থেকে। নিজের হাত টা তুলে পেশীর সমাহার দেখাল অশ্বথামা কে। অশ্বথামা খুশী হল। কারন ও নিশ্চিত হয়ে গেছিল বাঘমুড়ো নিজের সামর্থ্য বাড়াতে পেরে খুশী হয়ে গেছে। এখন বাঘমুড়োর সামর্থ্য ই প্রয়োজন ওর। ওই মণির কাছে যাবার সাধ্য নেই তার। কিন্তু বাঘমুড়ো ওই গ্রামে ঢুকতে পারবে কিনা সেটা কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। বাঘমুড়োর সাথে কথা শুরু করল ও।
- দেখ শিশুপাল, সেই কবে থেকে তুমি শাপিত হয়ে এই জলায় ঘুরে বেড়াচ্ছ। আর আমিও তাই। আমার দরকার মণি আর তোমার দরকার মুক্তি। চল না দুজনে মিলে এই সমস্যার সমাধান করি। আমি আগেও এসেছিলাম। কিন্তু সেই সময়ে তুমি আমার ক্ষমতা কে গ্রাহ্য কর নি। কিন্তু আজকে বুঝলে তো, আমার ক্ষমতা ও কম নয় কিছু। আমার পিতা কোনদিন মানেন নি আমি অর্জুন সম বীর। সেই আক্ষেপ আমার আজ ও বর্তমান। আমি পরশুরাম শিষ্য, দ্রোণ পুত্র। অথচ চিরকাল ভয় পেয়ে এসেছি অর্জুন কে। আর তারপরে, ভীম কত নৃশংস ভাবে আমার মাথা থেকে খুবলে নিল আমার প্রাণপ্রিয় মণি। ভেবে দেখ শিশুপাল, প্রান ত্যাগ করতে পারব না আমি, কিন্তু বাঁচতে হবে প্রাণ হীন হয়ে। উফ এতো বড় অভিশাপ আমাকে দিল কৃষ্ণ? আর তুমি? তুমিও ও চিরকাল কৃষ্ণ র থেকে পেয়ে এসেছ অপমান। তোমার প্রাণ সে নেবে ঠিক হয়ে গেছিল তোমার শৈশবেই। একশ অপরাধ ক্ষমা করবে নাকি? ভাব তুমি কত অপমান নিয়ে বেঁচে এসেছ তুমি? তোমার বাগদত্তা রুক্মিণী কে বিয়ে করেছিল কৃষ্ণ, অপহরণ করে। একজন পুরুষের কাছে এ যে কত বড় অপমান সে আমাকে বলে দিতে হবে না।
অশ্বথামার কথা শেষ ও হলো না। বাঘের গর্জনে মনে হল ঝড় উঠল চারিদিকে। ভারী হয়ে গেল মুহুর্তে পরিবেশ টা। পেশী বহুল শরীরে পেশী কিলবিল করে উঠলো। আর শুরু হলো মুহুর্মুহু গর্জন। অশ্বথামা বুঝল, সঠিক জায়গায় আঘাত হেনেছে ও শিশুপালের ওরফে বাঘমুড়োর। চুপ রইল শিশুপাল। ও জানে সময়ের অপেক্ষা মাত্র যখন বাঘমুড়ো ওর ইশারায় কাজ করবে। খানিক বাদে বাঘমুড়োর গর্জন থামলে অশ্বথামা বলল,
- চল না শিশুপাল, আমরা এক হয়ে যাই। তুমি আমাকে সহায়তা কর আর আমি তোমাকে। তুমি আমাকে গ্রাম থেকে মণি এনে দাও আর আমি তোমাকে শক্তিশালী করে দি। এই গ্রাম কে কৃষ্ণ রক্ষা করলে , আমার কাছে আছে আমার ধনুকের ক্ষমতা আর মহাকালীর আশির্ব্বাদ।
এই বলে অশ্বথামা হাত বাড়ালো বাঘমুড়োর দিকে। বাঘমুড়ো নিজের হাত বাড়াতেই একটা ব্যাপার হয়ে গেল মুহুর্তেই। একটা অদৃশ্য বন্ধন যেন দুটো হাত কে বেঁধে দিল। হলুদ আলোর একটা আভাস ফুটে উঠল দুই কব্জির মিলনস্থলে। মেঘের দল মহানিনাদে অট্টহাসি করে উঠলো। ভয়ংকর মেঘনাদে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠলো। বৃষ্টির দেরী নেই আর। সব থেথাম হলে অশ্বথামা বলল,
- শোন শিশুপাল, এই গ্রামেই আছে মণি। তোমাকে সেটা এনে দিতে হবে। আমি জানি, তুমি গ্রামে প্রবেশ করতে পারবে এবারে। বাধা কেটে গেছে। সুদর্শণের মহাকবচ ভাঙছে একটু একটু করে। পূব দিক দিয়ে তুমি প্রবেশ কোর। দেখ আমার মণির চরিত্র একটু অন্যরকম। শক্তিশালী আত্মার কাছাকাছি আসলে তার উজ্জ্বলতা বেড়ে যায়। অতএব স্বাভাবিক ভাবেই, তোমার কাছা কাছি আসলে পরে সে আরো বেশী উজ্জ্বল হবে। রাতের বেলায় খুঁজো। এই টুকু গ্রাম সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু আমি পারব না ওকে নিয়ে আসতে। কৃষ্ণের অভিশাপে, আমি নিজে ওর কাছে গেলেই দুর্বল হয়ে পরি। কিন্তু কৃষ্ণ বা কেউ, যে কেউ সেই মণি আমার হাতে তুলে দিলে মণিহারা হয়ে বেঁচে থাকার অভিশাপ থেকে হয়ত মুক্তি পাব আমি। ফিরে পাব আবার নিজের পুরোন শক্তি। আবার বাঁধতে পারব আমার ব্রহ্মাস্ত্র কে নিজের ধনুকে। ছাড়খাড় করে দেব তখন এই পৃথিবী কে আমি। রাজত্ব করব আমরা দুজনে।
মুহুর্মুহু গর্জন শুরু করল বাঘমুড়ো। নতুন খেলায় মেতে ওঠার তাগিদ যেন শরীরের পেশীতে খেলা করতে লাগল। অশ্বথামা তার পরে একটু গলা নীচু করে বলল,
- তোমাকে সাবধান করে দি শিশুপাল। এই গ্রামে সম্ভবত শেষ নাগের অধিষ্ঠান আছে। হ্যাঁ ঠিক ই শুনতে পেয়েছ। শেষ নাগ। সাবধানে। রহিম বলে একটা ছেলে। অতুল ক্ষমতার অধিকারী কিন্তু শেষ নাগ। অতুল ক্ষমতা। সেই রাজসভাতেই কৃষ্ণ না আটকালে হয়ত বলরাম এর বেশে শেষ নাগ ই তোমাকে হত্যা করত। পারত পক্ষে এড়িয়ে চলবে শেষ নাগ কে। তোমার শরীরে আমার তন্ত্রের মায়া জাল আছে। সেদিনে যুদ্ধের সময়ে শেষ নাগের আঘাত তোমার শরীরে লাগে নি। তারকীণি তোমাকে সুরক্ষা দিচ্ছিল। কিন্তু ভয় অন্য জায়গায়। সেটা হলো, সে কোথায়? শেষ নাগ আছে যখন, তখন সে ও আছে। আমার সব মায়া কাজ করবে, কিন্তু সেটা তাঁর অনুপস্থিতিতে। তাঁর সামনে কোন মায়া কাজ করবে না। অতএব সাবধান। রহিম কে দেখলে সেখান থেকে পালাবে। আমাদের খুব সাবধানে মণি উদ্ধার করতে হবে। একবার মণি পেলে তখন ব্যাপার টা অন্যরকম হবে। আমাদের দুজনাকেই মুক্তি পেতে হবে শিশুপাল। চলো আমরা যাই। আমার শিকার দরকার তোমাকে গ্রামে পাঠানোর আগে। চল।
ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল। এমন তীব্র বৃষ্টি বোধকরি এই গ্রাম কোনদিন ও দেখে নি। কি তোড়জোড় তার। কি মারাত্মক শনশন করে আওয়াজ। আজকে বোধকরি সব ভাসবে। একে অন্ধকার তারপরে এমন তীব্র বৃষ্টি। কিন্তু দুজনের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। ওরা এগিয়ে আসতে শুরু করল গ্রামের দিকে।
মহাদেবের বাড়ির পূব দিকে সরলা ঘোষের বাড়ি। বলতে গেলে গ্রামের মাঝখান বরাবর সব থেকে সামনের বাড়িটা সরলার। জলার মাঠের দিক থেকে ঢুকলে রাস্তার বাম দিকেই প্রথম বাড়ি টা সরলার বাড়ি। আর তার পাশে একটা বিঘে দশেকের পুকুর আর পুকুরের পরেই প্রথম বাড়ি টা মহাদেবের। সরলা বিধবা মহিলা। একমাত্র ছেলে দীনেশ কে নিয়ে থাকে। বছর বাইশের দীনেশ বড় কর্মঠ ছেলে। খান চারেক গরু আছে। দুধ বিক্রী করে শহরে আর দুগ্ধজাত খাবার দাবার নিজেদের গ্রামের হাটে বেঁচে না হলে শহরের বেশ কিছু দোকান আছে ওর বাঁধা খদ্দের। সেই খানেই বিক্রী করে। সেদিনের হিসেব নিকেশ করে ও শুতে যাবে তখন ই আকাশে ঘন মেঘ গর্জন শুনতে পেল সে। বেড়িয়ে এল বাইরে। গরু গুলো সব ঠিক আছে নাকি একবার দেখে নেবে ও। ওর গোয়ালের দরজা দিয়ে উঠোনের জল ঢোকে বৃষ্টি হলে। গোয়াল টা একটু নাবু কিনা। খানিক বালির বস্তা আর চট চাপিয়ে দেবে গোয়ালের দরজায়। জল ঢুকবে না আর তাহলে।
বাইরে বেড়িয়ে এসে বুঝল বাতাসে বুনো জলের গন্ধ। তার মানে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে পরতেই যা দেরী। আকাশে উড়ছে জলকণা। হাওয়ায় উড়ছে এখন। উঠোনে নামতে না নামতেই শুরু হলো ঝমঝম করে বৃষ্টি। কোনরকমে মাথায় হাত দিয়ে ছুটে এলো গোয়ালে দীনেশ। রাখাই থাকে গোয়ালের টিনের দরজার কাছে বালির বস্তা। আর কিছু চট। ভালো করে উঁচু করে দিল দরজার বাইরে টা গোয়ালের। যাক জল ঢুকবে না। সকালে উঠে জল দেখলে গোয়ালের পিছন দিক এর দেওয়াল হালকা কেটে দিলে জল বেরিয়ে যাবে। কাজ হয়ে যাবার পরে একবার গরু গুলো কে গলায় আদর করে দিল দীনেশ। এই অন্ধকারেও ও বলে দিতে পারে গলকম্বল ধরেই কোন গরু টার কি নাম। ও ছাড়া একমাত্র হীরা পারে এই গ্রামের সব গুলো গরু কে চিনতে। বস্তুত এই নাম গুলো হীরার ই দেওয়া। কিন্তু মনে হলো গরু গুলো চঞ্চল। কাছে থাকলে চুপ থাকলে কিছু একটা ছেড়ে অন্য টার কাছে গেলেই , বাকি গুলো ছটফট করছে। কি হলো সাপ খোপ ঢুকল নাকি গোয়ালে? সর্বনাশ। এখনি টর্চ টা আনতে হবে। ও বাইরে যাবার তোরজোড় করতেই পেল গন্ধ টা। একটা অদ্ভুত বাজে পচা গন্ধ। ইশ বমি হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। এমন বিশ্রী গন্ধ কোথা থেকে আসছে? ও হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো গোয়াল থেকে।
কই কিছু তো নেই। কিন্তু বাইরে গন্ধ টা আরো বেশী। এগোতে পারছে না আর দীনেশ। মা কে জাগাবে? হ্যাঁ জাগানোই ভাল। কেমন গা টা ছম ছম করছে দীনেশের। আড়ষ্ট ভাব একটা। আর নিতে পারছে না দীনেশ। ইশ কি ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ!!! মা কে ডাকার জন্য এগোতেই কিছু একটা দেখে থমকে গেল দীনেশ। বিদ্যুতের আলোয় দেখল মাটির পাঁচিল এর মাথায় দুটো ভয়ঙ্কর মুখ। একটা মুখ বাঘের আর একটা মুখে যেন মৃত্যুর ছায়া। পচা গলা একটা মুখ। ভয়ঙ্কর আতঙ্কে মা কে ডাকতে যাবে সেই সময়েই, হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ল মাটির পাঁচিল। সেকেন্ডের ও কম সময়ে বিশাল চেহারা নিয়ে তড়িৎ গতিতে বাঘমুড়ো ছুটে এসে গলা টা টিপে ধরল দীনেশের। পলকে তুলে নিল দীনেশের শরীর টা নিজের এক হাতেই। গলা টা চেপে ধরে বাঘমুড়ো তুলে ধরেছে দীনেশ কে। দীনেশ কোন ভাবেই আওয়াজ বের করতে পারছে না। আর বের করলেও এই বৃষ্টি তে সেই আওয়াজ কেউ শুনতেও পারবে না। দীনেশের প্রাণ বেড়িয়ে যাবার আগে, মনে মধ্যে মরণের ইচ্ছে জেগে উঠল , এই ভয়ানক আতঙ্কের হাত থেকে মুক্তি পেতে।দীনেশ কে জলার মাঠে এনে বাঘমুড়ো অশ্বথামার নির্দেশে ধড় থেকে মাথা টা কে ছিঁড়ে ফেলল। দীনশের ভয়ঙ্কর মরণ চিৎকারে চারিদিকের নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙ্গে গেল। পরে রইল দুই দিকে ধড় আর মাথা। ধড়ের পা দুট খানিক ছট ফট করে স্থির হয়ে গেল। মাঠের এক দিকে গড়িয়ে যাওয়া মাথা খানা পরে রইল নিথর হয়ে, ভয়ঙ্কর আতঙ্কে চোখ দুটো অস্বাভাবিক বের করে।
- তুমি এবারে যাও অশ্বথামা। আজকেই সেই মণি পাবে এমন কোন স্থিরতা নেই। খোঁজা বন্ধ করলে হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই মণি আমাদের খুঁজে পেতেই হবে। আমার একটু কাজ আছে। কাজ টা শেষ করে নি। তুমি বরং লেগে পড় কাজে। আর দাঁড়াও। এই আংটি তুমি পরে যাও। পিছন থেকে রক্ষা পাবার জন্য এই আংটি তোমার কাজে লাগবে। আর যা বলেছি। এর পরেও বিপদ বুঝলে পালিয়ে আসবে। আগের দিনের মতন যুদ্ধে লেগে যেও না।
এই বলে তূনীর থেকে একটা আংটি বের করে অশ্বথামা পরিয়ে দিল বাঘমুড়ো কে। অপেক্ষা করল না বাঘমুড়ো আর। চলে গেল ক্ষিপ্র তার সাথে। আর অশ্বথামা লেগে পড়ল নিজের কাজে। শুনশান বৃস্টিস্নাতা জলার মাঠে একটা গন্ডী কেটে ফেলল অশ্বথামা নিজের তূনীরের একটা তীর দিয়ে। অবাক ভাবে, গন্ডীর ভিতরে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। তীর দিয়ে নিজের আসন নির্দিষ্ট করে বসে পড়ল অশ্বথামা সেখানে। চাদরের মতন একটা ঢাকা তে ঢেকে গেল ওই জায়গা টা। পূর্ব দিনের মতন একটা বিশাল অগ্নী কুণ্ড বানিয়ে ফেলল অশ্বথামা। নিজের তলোয়ার দিয়ে কেটে কুচি কুচি করে ফেলা দীনশের শরীর খন্ড নিক্ষেপ করতে থাকল অগ্নী কুণ্ডে। সহসা এক বিশাল রক্ত বর্ণের শেয়াল উপস্থিত হলো যেন মাটি ফুঁড়ে। গম্ভীর আওয়াজে অশ্বথামা বলল,
- কে তুই?
- ভুলে গেছিস নাকি?
একটা পুরুষের গলায় উত্তর এল শেয়ালের কন্ঠ থেকে। অশথামা বিরক্ত হল। কিন্তু চেঁচিয়ে উঠল
- যা জিজ্ঞাসা করছি উত্তর দে।
- আমি ব্রহ্মপিশাচ। কি চাস এখন তুই?
অশ্বথামা ছুঁড়ে দিল মাংসপিণ্ড শেয়ালের দিকে। বিশাল হাঁ করে খেয়ে নিল কাঁচা মাংস শেয়াল টা। অশ্বথামা বলে উঠল,
- মণি কোথায় আছে?
- কেন বাঘমুড়ো কে তো পাঠালি? ও খুঁজুক।
- যা জিজ্ঞাসা করছি জবাব দে। কোথায় আছে?
- আমিও জানি না। তবে অনুভব করতে পারি সে এই গ্রামেই আছে।
- কোথায়।
- জানিনা, আমরা যারা জীবন মৃত্যুর মাঝের জীব, তারা এমন কোন দৈব মণির সামনেও যেতে পারি না। ঠিক যেমন তুই পারিস না।
- হুম কে পারবে?
- কেউ না। স্বয়ং নারায়ণ ছাড়া সেই মণি কোথায় আছে কেউ বলতে পারে না। আর জানে অলায়ুধের বংশধর।
- হুম আমার কাছে খবর আছে। সে রাক্ষসের বংশধর কি জীবিত এখনো?
- হ্যাঁ
- কে সে? কি নাম তার?
- তার নাম অলায়ুষ। তার ছেলের নাম অলকজিত। আর নাতির নাম অলকৃত্য।
- হুম ঠিক আছে। খুঁজে নেব আমি। তবে তুই বাঘমুড়োর কে সুরক্ষা দিবি।
আবার এক খন্ড মাংসপিণ্ড ছুঁড়ে দিল অশ্বথামা শেয়ালের দিকে। আগের ভঙ্গী তেই শেয়াল টা লুফে নিল সেই মাংস খন্ড। তার পরে বলল,
- পারব। তবে আজকের দিনের জন্যেই। কালকে তোকে আবার ডাকতে হবে। না ডাকলে আমি আসি না।
- দেখা যাবে। তুই এখন যা, বাঘমুড়োর পিছনে। ও পেয়ে গেলে ওই মণি নিয়ে যেন সোজা এখানেই আসে। এর যেন অন্যথা না হয়।
- বুঝেছি।
চলে গেল শেয়াল টা। ঠিক যেমন ভাবেই এসেছিল, তেমন ভাবেই অদৃশ্য হয়ে গেল হুশ করে।
পরের দিন সকালে যখন লালির ঘুম ভাঙল, দেখল নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। নিজের পোশাক বদলানো। একটা সাদা রাত্রিবাস পরে ও শুয়ে। ঘুম ভেঙ্গে গেছিল একেবারে। এমন ভাবেই ভাঙল যেন ও ঘুমের কোন লেশ মাত্র নেই শরীরে আর মনে। মন আর মাথা খালি করে এমন ঘুম মনে হয় না ও কোন দিন ঘুমিয়েছে বলে। আস্তে আস্তে বাইরে বেড়িয়ে এল লালি। দেখল, উঠোনে বড় ঠাম্মু বড়ি দিচ্ছে। আর লালির বাবা একবার গোয়াল থেকে কল পাড়ে যাচ্ছে জল নিতে আর গোয়ালে ঢুকছে আবার। লালি বুঝল ওর বাবা গোয়াল পরিষ্কার করছে। ঝলমলে রোদ। ও এসে বসল দুয়ারে। ঠাম্মু দেখছে লালি কে আর হাসছে। কি হলো ঠাম্মুর? এক এক করে লালির মাথায় ভিড় করে আসতে থাকল কালকের ঘটনা গুলো।
- ওগুলো কি সত্যি ই ছিল নাকি স্বপ্ন? স্বপ্ন হলে সে শুতে গেল কখন? আর যদি স্বপ্ন না হয় তবেই বা কি করে ও এলো এখানে। ও পোশাক বদলে দিল কে? পরিষ্কার মনে আছে হীরার সাথে দুপুরের পরে খেয়ে দেয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। তারপরে যা হলো সেটা কে স্বপ্ন বলা চলে না। তবে কি সত্যি ছিল সেই সব? তার মানে অশ্বথামার মণি এই গ্রামেই আছে? এই গ্রামেই অলায়ুধের বংশধর বাস করছে? কবচ ভাঙছে, মানে এখন গ্রামে নারায়ণের ও অধিবাস চলছে? ওদের মধ্যে শক্তি কি নারায়ণের প্রভাবেই এসেছে? কিন্তু গ্রামে আরো মানুষ থাকতে ওদের মধ্যেই এলো কি করে শক্তি?
এই রোদ ঝলমলে সকালেও গা ছম ছম করে উঠলো লালির এই সব কথা ভেবে। কিন্তু সবার আগে হীরার সাথে দেখা করতে হবে ওকে। এখনি। কালকে ওখান থেকে চলে আসার সময়ে, হীরার কার্যকলাপ ও অদ্ভুত ছিল।
- ও কি ভাবে জানল ওই ',ের ছেলে বেঁচে? আর ওই ফুটোর ভিতরে লাফ দেবার সময়ে ও কি করল যেটা কবচের মতই নীল রঙ হয়ে ', কে ঘিরে ফেলল কবচের মতন করে? আচ্ছা, হীরা কালকে এতো ঘটনা পরম্পরা দেখে একবার ও চমকে গেলো না তো? ও কি জানত এই সব?
উফ মনের মধ্যে এতো প্রশ্নের মেলা বসেছে লালি একেবারে পাগল হয়ে গেল। তার পরে মণির ধাঁধা। কে উদ্ধার করবে সেই ধাঁধার উত্তর? হীরা? নাহ লালিকে বলতেই হবে এই সব কথা, নগেন দাদু, রহিম দা আর অভি কে। সামনে তো সমূহ বিপদ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মণি উদ্ধার করতেই হবে। এই মণি অশ্বথামার হাতে পরলে আর রক্ষে নেই। ওই ', তো সেই কথাই বললেন। অনেক কাজ এখন। সবার আগের কাজ মণি উদ্ধার।
লালি তড়িঘড়ি সকালের কাজ কর্ম সেরে তৈরি হয়ে নিয়ে বেড়িয়ে এলো বাড়ি থেকে। সবার আগে গেল হীরা দের বাড়ি। গিয়ে দেখল হীরা নেই যথারীতি। উমা কাকি বলল, পড়তে গেছে। কিন্তু লালির কেন জানিনা মনে হলো, হীরা পড়তে যায় নি। ও হয়ত বুঝতে পারল হীরা কোথায় যেতে পারে। ও আর অপেক্ষা করল না মহাদেব কাকার বাড়িতে। সোজা চলে এল জলার মাঠে। এসেই দেখল হীরা অশ্বত্থ গাছ থেকে শুধুই পা দিয়ে মেপে গ্রামের ভিতরে ঢুকছে। লালি বুঝে গেল যে কালকের ধাঁধা নিয়ে হীরা লেগে পরেছে। লালির মনের অনেক কিছু মিটে গেল সেই মুহুর্তেই হীরা কে দেখে। এর অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, কালকের যা যা ঘটনা ঘটেছে সব সত্যি। সেই ',ের বলা ধাঁধা ও সত্যি। মণি এই গ্রামেই আছে। শুধু একটাই খটকা লাগছে, কালকে রাতে ওর পোশাক বদলে দিল কে? ভেবেই শিউরে উঠলো লালি লজ্জায়।ততক্ষণে হীরা দেখতে পেল লালি কে। ইশারায় ডাকল। লালি সামনে যেতেই বলল,
- নাও কাজ শুরু কর। অনেক টা মানে আমি উদ্ধার করেছি। বাকি টা করতে আমার তোমার সাহায্য লাগবে।
লালি দেখল হীরা একেবারে সাধারণ ভাবেই কথা বলছে। মানে কালকের রাতের ঘটনা ও মনের মধ্যে রাখেই নি। হয়ত পোশাক বদলে দেবার ব্যাপার টা ও মাথায় নেই। অনেক প্রশ্ন লালির কাছে। জানেনা লালি কখন বাড়িতে ফিরেছে। নিশ্চই অচেতন হয়েই ফিরেছিল। বাড়িতে কেউ কোন প্রশ্ন করল না কেন তাহলে? যাক এই সব ভাবার সময় নেই এখন আর। কাজে লেগে যেতে হবে।সময় খুব কম। লালি বলল,
- কি উদ্ধার করলি শুনি?
- দেখ পেট কাটা গাছ ডান দিকে রেখে সোজা হাঁটার কথা বলা ছিল ছড়া তে। তবে সিংহ দুয়ার পাওয়া যাবে। এখন এটা তো পরিষ্কার, তখন কার সিংহ দুয়ার এখন আর নেই। আমরা জায়গা টা পেতে পারি শুধু। এখন প্রশ্ন হলো, ডান দিকে রেখে হাঁটা, ৩৬০ ডিগ্রী তে হতে পারে তাই না? দেখতে গেলে ইনফাইনাইট পসিবিলিটি। তাহলে কোন দিকে? নিশ্চই গ্রামের দিকেই হবে। এটা আমার অনুমান, অলায়ুধের বংশধর , গ্রামে বাস করে মণি কে নিশ্চই নিজের থেকে খুব দূরে রাখবে না। খুব ভালো হত যদি কোন একজন বৃদ্ধ কাউকে পাওয়া যেত, যে গ্রামের পুরোন ব্যাপার স্যাপার জানে। তা না হলে আমাকে চন্ডীপুরের লাইব্রেরী তে যেতে হবে এখন ই। আমি দেখেছিলাম, বাঘমুড়োর আতঙ্ক নামে একটা বই লাইব্রেরী তে আছে। পড়েছিলাম আমি সেটা। কিন্তু সিংদরজার কথা পাই নি।
লালি অবাক হয়ে শুনছিল হীরার কথা। এই ছেলে যে খুব বড় জায়গায় যাবে সেই নিয়ে সন্দেহ নেই। কি অদ্ভুত মেধা হীরার! লালি হাঁ করে হীরা কে দেখছিল। ওর মনে হলো সরাসরি বাঘমুড়ো আর অশ্বথামার সাথে লড়াই না করলেও, এই বুদ্ধির লড়াই এ হীরা কে একসাথে নেওয়াই যায়। লালি সিদ্ধান্ত নিল হীরা কে সব বলবে। ওদের টিমের ব্যাপারে। সেখানে তো নগেন দাদুও আছে। অনেক কথাই নগেন দাদু জানবে, যা হয়ত ওই লাইব্রেরীর বই এ লেখা নেই। ততক্ষণে হীরা এগিয়ে এসে লালির হাঁ মুখ খানা বন্ধ করে দিয়েছে।
- এই যে , কিছু বললে ভাল হয়।
লালির চমক ভাঙল। খুব খুশী হয়ে বলল,
- আমি কি হেল্প করব তোকে? তুই তো নিজেই সব কিছু বের করে ফেলেছিস? তোর কাছে বুদ্ধির দৌড়ে আমি কি আর পাত্তা পাব? তবে তোকে লাইব্রেরী যাওয়ার কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারি।
- কি করে? অনেক প্রশ্ন আছে,তুমি বুঝতে পারছ না। যেমন বলেছে, সাতের পিঠে সাত কে নিয়ে সিং দরজা পাওয়া যাবে। এখন হেঁটে সাতাত্তর পা এগোতে হবে, এটা আমি নিশ্চিত। কিন্তু কোন দিকে? সেই জন্যেই পুরোন কাউকে দরকার। ভেবে দেখ কালকে আমরা যে প্যারাল্যাল টাইম লাইনে গেছিলাম তখন এই অশ্বত্থ গাছের তলা তেই বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। কিন্তু কোন সিং দরজা দেখিনি। মানে হলো, সেই সিং দরজা ভেঙ্গে গিয়েছিল সেই সময়েই। কাজেই এমন কাউকে দরকার যে এই গ্রামের অনেক পুরোন ইতিহাস জানে।
লালি যতই হীরা কে দেখছে, ওর কথা শুনছে ও অবাক হয়ে যাচ্ছে। সেই পুচকে ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে। বিজ্ঞের মতন এক এক করে জট ছাড়াচ্ছে ধাঁধার। লালি বলল,
- নগেন দাদু কে জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়?
হীরা মনে হল একবার মুচকী হাসল, বলল,
- হ্যাঁ ভালই হয়, সাথে অভি আর রহিম দা কেও ডেকে নিয়ে এস। সবাই মিলে আলোচনা করলে ব্যাপার টা আরো সহজ হবে।
লালি চমকে উঠল। এদের কথা হীরা জানল কি ভাবে? লালি কিছু বলতে যাবে তার আগেই হীরা বলল,
- সময় বেশী নেই আমাদের হাতে। যাও। ওদের কে ডেকে নিয়ে এস। তুমি জান না, কাল রাত থেকে সরলা কাকির ছেলে দীনেশ নিখোঁজ।
- অ্যাঁ?
- হুম। দেখ না গিয়ে সরলা কাকি কান্না কাটি করছে।
- সেকী? কই শুনিনি তো?
- হুম, দেখ গিয়ে তোমার পুরো টিম সেখানে আছে। তুমি ই লেট করে ফেললে।
লালি আর দেরী করল না। ছুটে গেল সরলা কাকির বাড়ির দিকে। পিছন ফিরে দেখল হীরা আগের মতই ব্যস্ত হয়ে পরেছে ধাঁধার উত্তর খুঁজতে। লালি সোজা চলে এলো সরলা কাকির বাড়িতে। এসেই দেখল, অনেক লোক জন জড়ো হয়ে গেছে বাড়িতে। মাটির দেওয়াল টা ভেঙ্গে গেছে। মনে হচ্ছে কোন বড় ট্রাক্টর বা লরি এসে ধাক্কা মেরেছে। অনেক টা জায়গা জুড়ে ভাঙ্গা মাটির দেওয়াল টা। দেখল, রহিম দা, অভি আর নগেন দাদু তিনজনেই আছে। কিছু বুঝতে পারল না লালি। কিন্তু এটা বুঝল দেওয়াল ভেঙ্গে কিছু ঢুকেছে। যদি বাঘমুড়ো হয়, তাহলে দেওয়ালে এমন ক্ষত হওয়া স্বাভাবিক। তাহলে হিসাবে দাঁড়াল এটাই যে, বাঘমুড়ো দেওয়াল ভেঙ্গে দীনেশ কে তুলে নিয়ে গেছে? লালির বুক টা আঁতকে উঠল। আর পুকুর টা পেরোলেই হীরা দের বাড়ি। দীনেশ না হয়ে হীরা হলে কি হতো সেটা ভেবেই লালি ভয়ে কুঁকড়ে গেল একেবারে। কালকে রাতের বৃষ্টি তে কাদা হয়ে গেছে জায়গা টা। না হলে পায়ের ছাপ দেখে কিছু আন্দাজ করা যেত। কিন্তু কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না এখন আর। ওদিকে দুয়ারে বসে সরলা কাকি কাঁদছে ভীষণ। লালি আর সহ্য করতে পারল না সেই কান্না। বেড়িয়ে এলো ও বড়ি থেকে। মন টা খারাপ হয়ে গেল। ও বেড়িয়ে এসে বসল অশ্বত্থ গাছের তলায়। হীরা সেই পায়ের মাপে মেপেই চলেছে গাছের গোঁড়া থেকে। চারিদিক কেমন ভয়ের পরিবেশ তৈরি হল সহসা। লালি বুঝল, সেটা লালির মনের ভয়ের কারণে।