Thread Rating:
  • 41 Vote(s) - 3.34 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance যৌবনের ভাদ্র মাস- নির্জন আহমেদ
#47
অধ্যায় ১৩ঃ শিল্পকলায়
শিল্পকলা একাডেমীতে কীসের একটা প্রদর্শনী হচ্ছে। ফেসবুকে খুব চেকইন দেয়া দেখছি বন্ধুদের। ভাবলাম গিয়েই দেখি একবার। একা যেতে ইচ্ছে করছিল না বলে সুদীপ্তকে ফোন দিলাম। শালা ফোনটাই রিসিভ করল না। সেদিনের কাহিনীর পর নীলার সাথেও কথা হয়নি; ডুব মেরেছে কোথায় কে জানে, ক্লাসেও আসছে না।

অগত্যা একাই রওনা দিলাম।

শাহবাগ পর্যন্ত হেঁটে। ঢাকা শহরে সবসময়ই প্রায় সংস্কারের কাজ চলছে, বিরাম নেই। টিএসসি থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত টানা জ্যাম। মেট্রোরেলের কাজের জন্য রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। দুটা রিক্সা একসাথে যাওয়ার উপায় নেই। চারুকলার সামনে তাই নেমে হাঁটা দিলাম। কচ্ছপ গতিতে রিক্সায় যাওয়ার মানে নেই কোন।

রমনা পার্কের ভিতর দিয়েই গেলাম। বৃষ্টি হয়েছে কিছু আগেই। লেকের পাশের রাস্তাটা সাপের খোলসের মতো শীতল ও ভেজা, চকচক করছে। লাল ইটের পথটার এখানে ওখানে পড়ে আছে ঝরা কিছু পাতা। বৃষ্টি শেষের কুয়াশা জমে আছে লেকের উপরের আকাশে। মৃদু আলোর বিকেলে রমনার লাল ইটের পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে নেই আমি। হয়ত ভুল করে অজান্তেই চলে এসেছি ইউরোপের কোন রাস্তায়। শুধু রাস্তার জ্যামে আটকে থাকা বাস আর ট্রাকের হর্ন সেই কল্পনাকে পূর্ণতা দিতে বাঁধা দিচ্ছিল।

শিল্পকলার দুই নং গেট দিয়ে ঢুকে বারান্দায় দাঁড়াতেই বৃষ্টি এলো ঝুম। মেঘের আর্তনাদ কানে তালা মেরে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে বোধহয়। অনেকেই সামনের চত্ত্বরে আড্ডা দিচ্ছিল, তারাও দৌড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে বারান্দায়।

সিগারেট একটা ধরাব কিনা ভাবছি। এসব আঁতেলমার্কা জায়গায় সিগারেট ধরানো অপরাধ হয়ে যাবে না তো? আমি সিগারেট ধরালাম আর ওমনি একজন চুলপাকা বৃদ্ধ কিংবা উর্দি পরিহিত সান্ত্রী এসে বলল, এখানে সিগারেট খাওয়া নিষেধ! তখন তো ফেলে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না!

আশেপাশে কাউকে সিগারেট ধরাতে দেখছি না। এতগুলো তরুণতরুণী এখানে, কেউ কি খায় না? নাকি তাদের পকেটে সিগারেট নেই।

এসব ভাবছি আর ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ আমার উদ্দেশ্যে কথা বলে উঠল।

"এই যে, ইদানিং শিল্পচর্চা করছ নাকি?"

পিছনে ফিরে দেখি জান্নাত! জান্নাতুল ফেরদৌস! সে একটা কালো শাড়ি পরে আধভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আমার পিছনেই, লক্ষ্য করিনি।

বললাম, "আমি শিল্পের কিছু বুঝি না! আর এসব আমাদের জন্য নয়ও। কে কিনবে ১৫০০০ টাকা দিয়ে একটা পেইন্টিং?"

"তাহলে এখানে কী করতে এলে?", হেসে জিজ্ঞেস করল জান্নাত। জান্নাতের চুল থেকে টপ করে একফোঁটা পানি কপালে পড়ল। বৃষ্টির ফোঁটাটাও কি ছুঁতে চাইছিল ওর মুখ?

"আমার কথা পরে হবে। আপনি এমন ভিজে গেলেন কীকরে!"

জান্নাতের মুখ থেকে হাসি গেল মুছে, সাথেসাথেই। হাসির জায়গায় এসে জমা হলো বিশুদ্ধ বিরক্তি। বলল, "আর বলো না, এক বান্ধবীর পাল্লায় পড়ে এখানে এলাম। সেই কিনা পনেরো মিনিট থেকেই চলে গেল। আমি একা একাই ঘুরে দেখলাম। আর চলে যাওয়ার জন্য বের হতেই বৃষ্টি। কেমন লাগে বল!"

আমি স্বান্তনা না দিয়ে বললাম, এ"সে ভালই করেছেন। আমার সাথে দেখা হয়ে গেল! আর বৃষ্টিতে ভিজেছেন বলে, আপনাকে বেশি সুন্দরী লাগছে!"

আমার কথায় হেসে ফেলল জান্নাত। বললাম, "এভ্রি ক্লাউড হ্যাজ আ সিলভার লাইনিং!"

কতদিন জান্নাতের সাথে কথা বলতে চেয়েছি! ফেসবুকে নক করলে তো সে দেখেও উত্তর করে না। আর দেখা হলে কথা বলব কী, সাথে তার সবসময় বডিগার্ডের মত এঁটে থাকে বয়ফ্রেন্ড, কখনো একগাদা বন্ধুবান্ধব। আজ পেয়ে গেছি একা, দৈবক্রমে।

"আপনার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসতেন! আপনার সাথে তো সবসময়ই থাকে ও", একটু খোঁচা দিয়েই করলাম জিজ্ঞেস। আমি যে ওকে লক্ষ্য করি প্রায়ই, সেটাও বুঝিয়ে দেয়া হলো।

জান্নাত বলল, "সব জায়গায় কি বফকে নিয়ে যাওয়া যায়? আর সবসময় তো একসাথে থাকতে ভালোও লাগে না!"

এ যে ভূতের মুখে রাম নাম! কলাভবনে, টিএসসিতে, কার্জন কিংবা নীলক্ষেতে ওর বফ ওর সাথে জমজের মত লেগে থাকে; বাঁ উলটো করে বললে, জান্নাতই লেগে থাকে বফের সাথে। তার মুখে এমন কথা!

বললাম, "ভালই হয়েছে, ও আসেনি। এলে তো আমার সাথে কথাই বলতেন না। কতদিন চেষ্টা করেছি আপনার সাথে কথা বলতে, ও ছিল বলেই পারিনি!"

জান্নাত ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখে লেগে থাকা পানি মুছল। বলল, "তোমার মাথা থেকে ভূত নামেনি তাহলে? আমি তোমার চেয়ে বড় জানো?"

"তাই তো আপনি করে সম্বোধন করছি!"

"আহাহা! সম্মান করে উদ্ধার করলে আমাকে!"

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম আমি। কী বলব খুঁজে পাচ্ছি না। এতদিন আমার সাথে এমন আচরণ করে আজ হঠাত এমন পালটি খেল কেন জান্নাত? আজ একা আছে বলেই কি আমার সাথে কথা বলছে ও?

"আচ্ছা, আমার ম্যাসেজের রিপ্লাই দিতেন না কেন, বলুন তো?"

জান্নাত হয়ত আমার এই প্রশ্নটা আশা করেনি। তাই কিছুক্ষণ জবাব দিতে পারল না। তারপর ভেবে উত্তর দিল, "আসলে আমি জানি, তুমি কী বলবে। তাই রিপ্লাই দেইনি!"

"আচ্ছা? জানতেন?", আমার গলা কি সার্কাস্টিক শোনাল? জান্নাতের মনে হলো না তো আমি টিটকারি মারছি?

বলল ও, "হ্যাঁ, জানতাম। বলতে, আপনি অনেক সুন্দরী। আপনাকে দেখে ক্রাশ খেয়েছি। ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন কত ছেলে করেছে! তাই তোমাকে চান্স দেইনি!"

আমি হা হয়ে গেলাম ওর জবাব শুনে। আসলেই এসবই বলতাম। নিজেকে কেমন ছোট ছোট লাগছিল। অপমানিতও। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বেদনা হঠাত যেন আমাকে গ্রাস করল।

"বুঝতে পেরেছি" বলতে পারলাম শুধু।

এখন আমার দুম করে এখান থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। দাঁড়াতে পারছি না আর ওর সামনে। বৃষ্টিটা শালা এখন থামলেই পারে। অনেক তো ঝরল। কিংবা একটা ফোন এলেও পারে। ফোন কানে লাগিয়ে ওর থেকে বিদায় নেয়া যাবে!

পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে দিলাম। যে যা ইচ্ছে বলুক শালা। সিগারেট খেতে বারণ করলে নির্ঘাত এর চেয়ে বেশি অপমানিত হব না!

"একাই এসেছো?", জিজ্ঞেস করল জান্নাত। কথা বলছি না দেখে হয়ত করল প্রশ্নটা। আমার এমন চুপচাপ থাকাটা দুজনের জন্যই বিব্রতকর।

"হ্যাঁ। আরেকজনের আসার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে শালা এলো না!"

"আমার মতই অবস্থা। আসতে চেয়েও তোমার বন্ধু আসেনি, আর আমার বান্ধবী এসেও দশ মিনিট থেকে চলে গেছে!"

বৃষ্টি কমার নাম নেই। জান্নাতের সামনে এভাবে কতক্ষণ থাকতে হবে জানি না। কথা চালিয়ে যেতে তাই বললাম, "আমি কিন্তু আপনাকে আসলেই ওসব বলতাম! আপনাকে দেখে আসলেই ক্রাশ খেয়েছি আমি! আপনি অনেক সুন্দরী!"

জান্নাত হাসল শুধু। এ হাসি বিজয়ীর আত্মপ্রসাদের। কোন পুরুষকে প্রেমের জালে জড়িয়ে মেয়েরা কি এমনই আনন্দই পায়?

আবার বললাম, "আমার সাথে প্রেম করলে কিন্তু আপনার একটা অভিজ্ঞতা হবে?"

"আচ্ছা? কীসের অভিজ্ঞতা?", কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল জান্নাত।

বললাম, "জুনিয়রের সাথে কজন মেয়ে প্রেম করে বলুন? সবাই তো সমবয়সী বাঁ বয়সে বড়দের সাথেই আটকে যায়। আপনি নতুন কিছুর স্বাধ পেতেন!"

আবার হাসল জান্নাত আমার কথায়। বলল, "বেশ লোভনীয় লাগছে কিন্তু! কিন্তু কী করব বলো! একসাথে দুইটা প্রেম করার স্টামিনা আমার নেই!"

"আমি আপনার ব্রেকাপ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারি!", একদিন কথাটা বলেছিলাম মনে মনে। আজ উচ্চারণই করে ফেললাম!

কথাটা বলেই ভয়ে ভয়ে তাকালাম জান্নাতের দিকে। ওর কি রেগে যাওয়া উচিত আমার কথায়?

কিন্তু জান্নাত রাগল না। বরং হেসেই বলল, "বেস্ট অফ লাক। আচ্ছা, ঠিকাছে, ব্রেকাপ হলে তোমার কথা চিন্তা করে দেখব!"

এমন সময়েই কমে গেল বৃষ্টিটা। যখন চাচ্ছিলাম, তখন কমল না। আর এখন কিছুটা জমিয়ে নিয়েছি, এখনই মেঘের স্টক শেষ হয়ে গেল!

"এই বৃষ্টি কমে গেছে। দেখো তুমি ভাল করে। আমি হলের দিকে যাই!"

আমি ওকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ডেকে দিলাম রিক্সাও। যাওয়ার সময় বললাম, "দেখা হবে!"

জান্নাত চলে যেতেই মনটা ফুরফুরা হয়ে গেল। ভালই জমিয়েছি। শেষপর্যন্ত হয়ত কিছুই হবে না আমাদের কিন্তু যেটুকু হলো, তাও কম নয় তো! কদিন এমন সুন্দরী মেয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ মেলে?

আর্ট গ্যালারির চার তলায় প্রদর্শনী। লিফটের সামনে বিশাল লাইন দেখে সিড়িই নিলাম। ৩য় তলায় উঠছি, দেখলাম সিড়িতেই কারা যেন চুম্মাচাটি করছে। সবাই লিফট ব্যবহার করছে আর এরা ফাঁকা সিড়িকেই কাজে লাগিয়েছে। আরেকটু এগিয়ে যেতেই যেন কপোতকপোতিকে চিনে ফেললাম!

রাজু আর আরোহী না?

রাজুও আমাকে দেখে ফেলেছে। ব্যাটার সেকি লজ্জা। লাল হয়ে গেছে গাল মেয়ে মানুষের মত। আরোহী আমাকে দেখেই সরে গেছে রাজুর বাহু থেকে! ভুল সময়ে এসে গেছি!

"কীরে তুই এখানে কী করিস!"

"ছবি দেখতে এসেছি। যা করছিলি চালিয়ে যা! অপরাধ করিসনি যে এভাবে লজ্জা পাবি!"

"আরে বাল! একটু হয়ে গেল আরকি!"

"ব্যাপার না ব্যাটা। এসব হয়ই!"

আমি ওদের পেরিয়ে যাওয়ার সময় আরোহীর দিকে তাকালাম না। মেয়েটা নিশ্চয়ই লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিল।

কী আজব দেশ আর দেশের রেওয়াজ-রীতি! রাস্তায় কাউকে প্রসাব করতে দেখলে কেউ লজ্জিত হয় না, প্রকাশ্যে রাস্তায় ঘুষ খাওয়ার সময় লজ্জিত হয় না পুলিশ, নির্লজ্জ সরকারি কর্মচারীরা সবার চোখে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাড়িয়েই চলেছে ভুঁড়ি। আর প্রেমিক প্রেমিকার চুমু খাওয়া কারো চোখে পড়লেই তারা লজ্জায় যাচ্ছে কুঁকড়ে!

চারতলায় প্রদর্শনী হচ্ছে। সেখানেই সব ভিড়। কয়েকটা মেয়ে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিতে পোজ দিচ্ছে। ভাবছি, চিত্রকর্ম দেখব নাকি দেখব এসব জীবন্ত ক্লাউনদের!

আর্ট গ্যালারিতে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চলে এলাম। দেখার মত বিশেষ কিছু নেই। অর্থহীন কিছু রঙয়ের কোলাজ যেন সব চিত্রই, যার সবটা গেছে আমার মাথার উপর দিয়ে। এসব আল্ট্রামর্ডান আর্ট কারা বোঝে, আর কোন শিল্পপতি এসব শিল্প লাখলাখ টাকার বিনিময়ে কেনে, জানি না। সামনে থাকলে নির্ঘাত তাদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ফেলতাম।
লেখকের Wattpad Profile


আমরা আরেকটু আশাবাদী হতেই পারি!
[+] 6 users Like Nirjon_ahmed's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: যৌবনের ভাদ্র মাস- নির্জন আহমেদ - by Nirjon_ahmed - 17-07-2022, 12:54 AM



Users browsing this thread: 5 Guest(s)