13-07-2022, 09:53 PM
(This post was last modified: 10-01-2023, 12:05 PM by Bumba_1. Edited 7 times in total. Edited 7 times in total.)
(২০)
অনিরুদ্ধর জ্ঞান ফেরার পর তাকে নিয়ে সুজাতা বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় গোগোল যখন তাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলে - ফোনের প্যারালাল লাইন থেকে সে সব কথা শুনে নিয়েছে। তাকে যদি সঙ্গে করে না নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে সে একাই যাবে। যে ছেলে সন্ধ্যে নামলে অন্ধকারের ভয়ে বাড়ি থেকে এক'পা বের হতে চাইতো না, সে আজ বলছে এতো রাতে একা একাই চলে যেতে পারবে .. পরিস্থিতি মানুষকে কতটা বদলে যায়। প্রথমে অনিরুদ্ধর আপত্তি থাকলেও পরবর্তীতে তার সন্তানের করুন অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখের দিকে তাকিয়ে আর বাধা দেয়নি।
রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। পুলিশ-স্টেশন সংলগ্ন হসপিটালের পেছন দিকটায় শবাগার। এতোটুকু বয়সে এইরকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে তা বোধহয় স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি আমাদের ছোট্ট গোগোল। মর্গের চারপাশে কেমন যেন একটি গুমোট ভাব। এ যেন বাইরের বাতাস ভিতরে কিংবা ভিতরের বাতাস বাইরে না যাওয়ার এক অলিখিত চুক্তির ফল। রাত ক্রমশ গভীর হওয়াতে মর্গের চারপাশে দীর্ঘদিন না কাটার ফলে গজিয়ে ওঠা আগাছা থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার সম্মিলিত ডাক যেন একটা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল এই বিষয়ে সন্দেহ নেই।
এখানকার দুর্বাঘাসগুলো মলিন, দেয়ালগুলো রঙচটা, গাছগুলো ধূসর, এখানে কাজ করা জীবিত মানুষগুলো কেমন যেন নিরস, বলা ভালো অভিব্যক্তিহীন - এখানে কেউ হাসে না .. হাসতে পারে না .. হাসতে জানে না .. হয়তো হাসতেই ভুলে গিয়েছে। এখানে আগত দেহগুলো প্রাণহীন .. নিথর। এখানকার স্ট্রেচারগুলো কখনও তাজা লাশ, কখনও অর্ধগলিত, কখনও বা পচেগলে যাওয়া নাম-পরিচয়হীন দেহগুলোকে বয়ে বেড়ায়। কখনও শবদেহের পেছনে আত্মীয়স্বজনের ভিড় থাকে আবার কখনও হয়তো কেউ-ই থাকে না দু'একজন পুলিশের কর্মচারী ছাড়া। অজ্ঞাত পরিচয়ের হতভাগ্য এই নাম-গোত্রহীন শবদেহগুলির অনির্দিষ্টকালের জন্য ঠিকানা হয় এই মর্গ।
সন্তান হারানো হাজারো মায়ের শোকের উন্মত্ততা, শোকের প্রকোপে বাকরুদ্ধ পিতার নীরব কান্না, ভাইবোনদের হৃদয়বিদারক চিৎকার, প্রিয়তমা স্ত্রীর মূর্ছা যাওয়া আর ডুকরে ডুকরে কান্নার নীরব সাক্ষী এখানকার গাছপালা আর নিষ্প্রাণ কনক্রিটগুলো। এখানে সুখের ছিটেফোঁটাও নেই, কেবলই শোকের মাতম।
মর্গের সামনের লম্বা করিডোরে পাতা কাঠের বেঞ্চিগুলোর মধ্যে একটাতে অপেক্ষারত অনিরুদ্ধ, সুজাতা এবং গোগোল। প্রতিটা মুহূর্ত যেন এক যুগের মতো মনে হচ্ছিলো ওদের কাছে। ঘড়ির কাঁটা বারোটা অতিক্রম করতে তখনও মিনিট পাঁচেক বাকি। ভিতর থেকে উচ্চস্বরে একটি বেল বেজে উঠলো, যা এই রাতের নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে অধিক থেকে অধিকতর প্রকট হয়ে উঠে যেন বুকে আঘাত করলো করিডোরে অপেক্ষারত আগন্তুকদের। "নমস্কার আমি মিস্টার গোস্বামী। আমিই ফোন করেছিলাম থানা থেকে। এইমাত্র বডি পোস্টমর্টেম করে আনা হলো, তাই আপনাদের একটু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাতে হলো। রিপোর্ট আসতে আসতে অবশ্য কাল সকাল। আপনারা আসুন আমার সঙ্গে .. কিন্তু আপনাদের সাথে বাচ্চাটাকে আনলেন কেন? এইরকম সিচুয়েশনে ওর শিশুমনে আঘাত লাগতে পারে। যাই হোক চলুন .. লেট'স গো।" অনিরুদ্ধ তাকিয়ে দেখলো তাদের সামনে পুলিশের খাকি পোশাক পরা একজন বেশ লম্বা মাঝবয়সী ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।
মিস্টার গোস্বামীকে অনুসরণ করে তার বাবা আর আন্টির সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করতে করতে গোগোলের মনে হলো সে যেন কোনো অন্ধকূপের মধ্যে প্রবেশ করলো। ভিতরে ঢুকে প্রথমে শবাগারের দরজার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে রইলো গোগোল। বিশালাকার ঘরটির মধ্যে সারি সারি মৃতদেহ রাখা আছে। প্রত্যেকের পায়ের বুড়ো আঙুলে মাথায় ট্যাগ দিয়ে নম্বর লেখা .. মৃতদেহের শনাক্তকরণের নাম্বার। যেহেতু অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম জরুরি হয়ে পরে .. তাই, নারী-পুরুষ প্রত্যেক মৃতদেহের শরীরে সিজর ও অনান্য মেডিকেল যন্ত্রপাতি দিয়ে কাটাছেঁড়া নিয়মমাফিক পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে। যে সকল দেহ পোস্টমর্টেম করার জন্য এখানে আনা হয়েছে আবার যে কয়েকটি মৃতদেহ পোস্টমর্টেম করার পর এখানে এনে রাখা হয়েছে .. পার্টিশন দিয়ে এই দুটির আলাদা বিভাগ তৈরি করা হয়েছে।
শবদেহগুলি থেকে নির্গত পচা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠে বমির উদ্রেক হওয়ার ফলে গোগোলের মুখ দিয়ে "ওয়াক্" শব্দ নির্গত হতেই তার মুখে নিজের শাড়ির আঁচল চেপে ধরলো সুজাতা। কিন্তু তাতেও যে কাজ হচ্ছিলো না। অদ্ভুতরকমের তীব্র গন্ধটা কাপড় ভেদ করে নাক দিয়ে ঢুকে ফুসফুসে গিয়ে আছড়ে পড়ছিল। গোগোলের মনে হচ্ছিলো - নিঃশ্বাস তোলার সময় আস্ত ফুসফুসটাই বোধহয় ভেতর থেকে বের হয়ে যাবে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার।
"এই যে .. এইদিকে আসুন .. এই বডিটার কথা বলেছিলাম .. রবি এর মুখ থেকে কাপড়টা সরাও .." ওখানে অপেক্ষারত এক কর্মচারীকে নির্দেশ দিয়ে তলায় চাকা লাগানো একটি স্ট্রেচারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন মিস্টার গোস্বামী। তাকে অনুসরণ করে পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো বাকি তিনজন।
"না না থাক .. আমি দেখতে চাই না .. এ আমার অরু হোক বা না হোক আমি জানতে চাই না কিছু .. সে যদি ফিরে আসে, নিজে থেকে আসবে আর যদি না আসে তাহলে অপেক্ষা করবো চিরকাল .. কিন্তু এরকম বাস্তবের সম্মুখীন হতে পারবো না .." আর্তনাদ করে ওঠা অনিরুদ্ধর কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই রবি বলে ছেলেটি স্ট্রেচারের উপরে রাখা মৃতদেহের মুখ থেকে কাপড়টা এক টানে প্রায় কোমর পর্যন্ত নামিয়ে দিলো।
কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে স্ট্রেচারের উপর শায়িত নারীটির দিকে অনিরুদ্ধ তাকিয়ে থাকলো। তারপর উপলব্ধি করলো - ভুল সে একবার নয় .. বারবার করেছে। কিন্তু আজ সে বুঝতে পারছে সেই ভুলের মরীচিকার গোলকধাঁধা শান্তভূমি নয়। গোলকধাঁধার গভীরে ফুলে-ফুলে, তরুতে-তরুতে, লতায়-পাতায় ভীষণ চক্রান্ত চলে। চক্ষের নিমেষে খুন রক্তপাত নিঃশব্দে সমাধা হয়। গোলকধাঁধার ভিতরে যত না সৌন্দর্য, তার যে অধিকতর বিভীষিকা। সেখানে কখনও কেউ যেন শান্তির সন্ধানে আর পদার্পণ করে না। তার কারণ সেখানে হয়তো দু'একটি পুষ্প নিতান্ত নিরীহ, কিন্তু বাদবাকি ফুলেরা দুর্বৃত্ত, প্রতিহিংসা পরায়ণ, ততোধিক বলবান এবং হত্যাকারী। সেখানে রূপ যৌবনের অনুপ্রবেশ ক্ষমাহীন। সেখানে রঙের দাঙ্গায় নিহত হয় শত-শত দুর্বল কুসুম। তারই ফলস্বরূপ সেই মরীচিকার গোলকধাঁধায় তার স্ত্রী অরুন্ধতীর মৃতদেহ অবলোকন করছে সে। চক্ষু বিস্ফোরিত, দেহ ছিন্নভিন্ন, বুক তখনও কি উষ্ণ ছিল তার প্রিয়তমার? কার নখরের চিহ্ন তার স্ত্রীর বুকে ছিল, কে হত্যা করেছে তাকে, কিছুই যে জানা নেই তার। কিন্তু গোলাপের লতা অতখানি এগিয়ে তখনও পথের উপরে যেন ঝুঁকে ছিল এবং রঙ্গন যেন তাকে দেখেই অত্যন্ত নীরবে হঠাৎ ফিরিয়ে নিলো মুখ। পুনরায় সংজ্ঞা হারালো অনিরুদ্ধ। তাকে সঙ্গে সঙ্গে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। কে জানে হয়তো ভবিষ্যতে আরো কোনো মৃত্যু সংঘটিত হতে চলেছে এই মরীচিকার গোলকধাঁধায়।
মা হলো শর্তহীন ভালোবাসার এক অফুরন্ত আধার। চির নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার পরম আশ্রয় .. হতাশার অন্ধকারে একবুক ভালোবাসা। মায়ের কাছে সন্তান সব সময়ই অবুঝ, ছোট্টটি। একই সঙ্গে সবার সেরা, সব সময় বিজয়ী। তাইতো তার কাছে কিছু লুকাবার নেই, নেই পরাজয়ের গ্লানি। কিন্তু সেই মমতাময়ী মা যখন তার অনাঘ্রাত শিশু সন্তানকে এই বিভীষিকাময় স্বার্থপর পৃথিবীতে রেখে চলে যেতে বাধ্য হয়!
"মা .. মা গোওওওও .." অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে শুধু এই শব্দটুকুই নির্গত হলো গোগোলের মুখ দিয়ে। কিন্তু নির্গত হলো না অনেক কিছু, যা তার মনের মনিকোঠায় থেকে যাবে চিরকাল। গোগোল আজ চোখের সামনে যা দেখে চলেছে .. তা পৃথিবীর কোনো পুস্তক ধারণ করতে পারবে না। কোনো মুখ তার কথার প্রবাহ দিয়ে তা প্রকাশ করতে পারবে না। কেননা হৃদয় যা ধারণ করে, মুখ তার যৎসামান্যই বাইরে বের করে আনতে পারে আর যতটুকুই বাইরে আসে, ততটুকু পুস্তকে আসে না। আর যদিও কখনও তার কিছু অংশ ধারণ করা সম্ভবপর হয়, তা কেবল আবেগ, জীবনবোধ উপেক্ষিত কিছু বর্ণই হবে, এর বেশি আর কিছুই নয়। চোখদুটো কষ্ট, বেদনা, ক্ষোভ এবং ঘৃণার সম্মিলিত প্রভাবে জ্বলে উঠল তার।
★★★★
"পাখি একবার উড়ে গিয়ে আবার খাঁচায় ফিরে এসেছে। এটাই আমাদের কাছে অন্তিম সুযোগ। এই জলজ্যান্ত প্রমাণটাকে শেষ করে দিতে পারলেই কেল্লাফতে .. আমাদের টিকিটা পর্যন্ত কেউ ছুঁতে পারবে না। খবরটা পাওয়া মাত্রই আমি নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি। ওখানে আমার লোক আছে, আশা করি ভোর রাতের আগেই কাজ হয়ে যাবে।" হীরাবাঈয়ের কোঠার দোতলার একটি সুসজ্জিত ঘরে রূপসার ডান দিকের স্তনবৃন্ত নিজের ধারালো নখ দিয়ে নির্দয়ভাবে খুঁটে দিতে দিতে উক্তি করলেন বিধায়ক মানিক সামন্ত।
তারপর ফোন রেখে উলঙ্গ, মাঝবয়সী, কামুক এমএলএ সাহেব তার বাঁধা রেন্ডি বছর সাতাশের, স্বাস্থ্যবতী, নগ্নিকা রূপসার সঙ্গে উন্মত্ত রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
অনিরুদ্ধর অফিসের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান মিস্টার সমরেশ চক্রবর্তী তার দেশের বাড়ি শিমূলপুরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে দিন দুয়েকের জন্য গিয়েছিলেন। গঙ্গানগর থেকে শিমূলপুরের দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার।
তার অত্যন্ত প্রিয়, স্নেহের অরুন্ধতীর সন্তান গোগোল যখন গতকাল রাতের দিকে সবার অলক্ষে তাকে ফোন করে জানিয়েছিল "আঙ্কেল .. আঙ্কেল আমাদের সবার খুব বিপদ .. আমার মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সকাল থেকে .. আমার খুব ভয় করছে আঙ্কেল .. জানো তো, আমি তোমাকে সকালেই ফোন করতে চেয়েছিলাম কিন্তু মা বারণ করায় করতে পারিনি .. তুমি কোথায় আছো? তাড়াতাড়ি চলে এসো না গো .. মাকে খোঁজে দাও না আঙ্কেল .." তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি মিস্টার সমরেশ চক্রবর্তী। রাতটুকু কোনোরকমে কাটিয়ে একেবারে ভোরের ট্রেনে রওনা দিয়েছিলেন গঙ্গানগরের উদ্দেশ্যে।
সকাল সাতটা নাগাদ গঙ্গানগর স্টেশনে নেমে প্রথমেই লোকাল পুলিশ স্টেশনে গেলেন মিস্টার চক্রবর্তী। সেখানে অনিরুদ্ধর অ্যাক্সিডেন্টের খবর থেকে শুরু করে গতকাল রাতে হাইওয়েতে ঝিলের ধারে পাওয়া ক্ষতবিক্ষত দুমড়ানো-মোছড়ানো অরুন্ধতীর মৃতদেহ পাওয়ার পর থেকে ঘটে চলা সমস্ত বিভীষিকাময় ঘটনা শুনতে শুনতে দুঃখে কষ্টে মুষড়ে পড়ছিলেন তিনি। সঙ্গে নিজের উপর রাগ হচ্ছিলো এই ভেবে, যখন তার সব থেকে বেশি করে থাকা উচিৎ ছিলো অরুন্ধতীর পাশে, সেই সময়েই তাকে বাইরে চলে যেতে হলো .. একেই বোধহয় বলে নিয়তি। তারপর সবশেষে যে খবরটা তিনি শুনলেন ইন্সপেক্টর গোস্বামীর মুখ থেকে, সেটা তার কাছে অনির্দেশ্য এবং দুঃসহ .. স্তম্ভিত হয়ে থপ করে চেয়ারের উপর বসে পড়লেন সমরেশ বাবু।
★★★★
ড্রয়িংরুমে থম মেরে বসেছিল সুজাতা। অনিরুদ্ধ এখন বাড়িতে নেই, তাই সেই সুযোগে আবার বাংলোতে ঢুকতে পেরেছে লতিকা দেবী। রান্নাঘরে চা-জলখাবার বানানোর অছিলায় গিয়ে নিজের ছোট্ট মোবাইলটা থেকে কারোর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল সে। সেই মুহূর্তে রান্নাঘরের দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো গোগোল। তার মাম্মামের সঙ্গে শাড়ির দোকানে গিয়ে তাকে অনেকবার দরদাম করতে দেখেছে সে। ঠিক সেই ভাবেই ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি সঙ্গে টাকা নিয়ে দরদাম করতে থাকা লতিকা দেবীর দিকে কিছুক্ষণ স্থিরচোখে তাকিয়ে থেকে গোগোল স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো "কার্টুন নেটওয়ার্কটা ডিস্টার্ব করছে .. আমি 'মটু পাতলু মিশন' দেখতে পাচ্ছি না .. ছাদে ডিশ টিভির অ্যান্টেনাটা একটু নাড়িয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে .. আমি একা একা যেতে ভয় পাচ্ছি .. তুমি একটু যাবে আমার সঙ্গে?"
গোগোলের কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে ফোনটা কেটে দিলো লতিকা দেবী। তারপর অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো - যে ছেলে তার এত আদরের, এত প্রিয় মা'কে কাল হারিয়েছে সে আজ সবকিছু ভুলে কার্টুন দেখার কথা বলছে? ছেলেটার কি শোকে মাথা খারাপ হয়ে গেলো, নাকি ব্যাপারটা এখনো বুঝেই উঠতে পারেনি! এরপর এদিক ওদিক দেখে গোগোলের দিকে তাকিয়ে বললো "এই তোর আন্টি কোথায় রে? তোর মা কালকেই মরেছে আর তুই আজ সকালে উঠেই টিভিতে কার্টুন দেখতে চাইছিস? তোর ভেতরে কি মায়া মমতা কিছুই নেই? তাছাড়া এখন তো শুনেছি সবার বাড়িতে কেবিল টিভি, কেবিলের লোকেরা ওখান থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। নিজেরা অ্যান্টেনা ঠিক করার তো কোনো ব্যাপার নেই! এগুলো আমাদের ছোটবেলায় হতো।"
"না গো, আমাদের নিজস্ব ডিশ অ্যান্টেনা আছে .. আন্টি ড্রয়িংরুমে বসে আছে রাগী রাগী মুখ করে .. আমি বাবা আন্টিকে খুব ভয় পাই, তাই ওকে কিছু বলিনি .. তুমি তো আমার মিষ্টি দিদা .. চলো না গো একবার ছাদে, অ্যান্টেনাটা একটু নাড়িয়ে ঠিক করে দেবে .. প্লিজ চলো .. আমি কলেজে চলে গেলে মাও অনেক সময় এই ভাবেই তো ঠিক করতো আমি শুনেছি .. তুমি তাড়াতাড়ি ঠিক করে দাও, তাহলে বাবার স্টাডিরুমের আলমারি থেকে তোমাকে অনেক টাকা দেবো .. ওখানেই তো বাবা সমস্ত টাকা রাখে .. ওই আলমারির চাবি কোথায় আছে আমি জানি .." পুনরায় গোগোলের সরল সাদাসিধে মুখভঙ্গিতে এইরূপ শিশুসুলভ উক্তি শুনে হেসে ফেললো লতিকা দেবী। সে মনে মনে ভাবলো - এ যে দেখছি মেঘ না চাইতেই জল। কোনরকম ছলচাতুরি ছাড়াই একেবারে খাজানার হদিস পেয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম মাতৃশোকে কাতর হয়ে থাকা ছেলেটাকে সেবা করতে করতে জান কাহিল হয়ে যাবে আমার। এখন দেখছি এর কোনো বোধগম্য হয়নি। এইরকম একটা হাবাগোবা ছেলেকেই তো চাইছিলাম। সুজাতাকে আজকেই বাড়ি থেকে তাড়াবো। তারপর ওই ল্যাংড়া জামাই ফিরে এলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে এই সংসারের উপর রাজত্ব করবো। তার বদলে যদি এই বাচ্চাটার আব্দারে কিছুক্ষণের জন্য ছাদে যেতে হয় তাহলে ক্ষতি কি! "চলো বাছাধন .. কোথায় যেতে হবে চলো .. তারপর ফিরে এসে একে একে তোমাদের সবার ব্যবস্থা করছি .." এই বলে গোগোলের পিছন পিছন এসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো লতিকা দেবী। নিজের খেয়ালে এতটাই মগ্ন ছিলো সুজাতা, ব্যাপারটা লক্ষ্যই করল না সে।
লতিকা দেবী ভেবেছিল একতলা বাংলোর মাথার ছাদে উঠতে হবে, এ আর এমন কি কঠিন ব্যাপার! কিন্তু বাইরে বেরিয়ে সে দেখলো তাদের বাংলোর ডানপাশে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে একটি গম্বুজের মতো উঁচু স্তম্ভ .. যেটি প্রায় ৪ থেকে ৫ তলা বাড়ির সমান হবে। তার গা বেয়ে লোহার পেঁচানো সিঁড়ি উঠে গিয়েছে একদম গম্বুজের মাথায় সেখানে বেশ কয়েকটা অ্যান্টেনা দেখা যাচ্ছে। তবে সেগুলো মোটেই হাল ফেশানের ডিশ অ্যান্টেনা নয়, বরং সেই পুরনো মডেলের টিভিগুলোর অ্যান্টেনার মতো দেখতে। লতিকাদেবী ভালোভাবেই বুঝতে পারলো এটা শিশুমনের একটা খেয়াল। ওই অ্যান্টেনাগুলোর এই বাড়ির টিভির কোনো সম্পর্ক নেই। তার ভাগ্নিও নিশ্চয়ই বাচ্চাটাকে ভোলানোর জন্য মিথ্যে কথাই বলতো। এরপর শিশুমন বিগড়ে গেলে যদি গুপ্তধনের চাবি হাতছাড়া হয়ে যায়, সেই লোভে ওই গম্বুজের মতো স্তম্ভটার দিকে অগ্রসর হতে লাগলো লতিকা দেবী .. তার পেছন পেছন গোগোল। এত সকালে এদিকটা সচরাচর কেউ আসে না .. প্রায় জনশূন্য থাকে।
★★★★
সেই মুহূর্তে ড্রয়িংরুমে রাখা ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো। ভাবনার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া সুজাতার ঘোর কাটলো ফোনের আওয়াজে।
- "হ্যালো কে বলছেন? হসপিটাল থেকে নিশ্চয়ই .. মিস্টার মুখার্জি এখন কেমন আছেন?
- "আজ্ঞে না .. আমি সমরেশ চক্রবর্তী কথা বলছি। আমাকে আপনি চিনবেন না, আমি অনিরুদ্ধর অফিসের সহকর্মী। তবে আপনি সম্ভবত সুজাতা - সিটি হসপিটালের মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র নার্স .. থানা থেকে আপনার ব্যাপারে শুনলাম। কাল থেকে আপনি অনেক করে আসছেন ওদের জন্য, এই পরিবারটার পাশে আছেন। আমি দু'দিন এখানে ছিলাম না। আজ কিছুক্ষণ আগে গঙ্গানগর এসে পৌঁছালাম।
- "আমি আপনাকে না চিনলেও গতকাল থেকে অনিরুদ্ধ দা এবং গোগোলের মুখে সারাক্ষণ আপনার কথা শুনেছি। তার সঙ্গে এটাও বুঝতে পেরেছি এই শত্রুপুরীতে আপনিই ওদের একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী। তবে আপনি আমার চাকরি এবং আমার ডেজিগনেশন সম্পর্কে যে কথাগুলো বললেন .. সেগুলো এখন অতীত। একটু আগেই হসপিটাল থেকে ফোন করে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আমার চাকরিটা আর নেই .. যেটুকু টাকা পয়সা পাবো তা ওরা আমার ব্যাঙ্ক একাউন্টে পাঠিয়ে দেবে। এইরকম ঘটনা আমার সঙ্গে কেন ঘটলো সেটা বোধহয় বুঝতে পারছি। যাই হোক এখন এইসব কথা বলে লাভ নেই। আপনি শুনেছেন কিনা জানিনা অনিরুদ্ধ দা কে কাল রাতে আবার হসপিটালে ভর্তি করতে হয়েছে। আসলে এত দুর্বল শরীর, তার উপর এত বড় ধাক্কাটা নিতে পারেনি, আবার সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল। হসপিটাল থেকে এতক্ষণে ফোন আসার কথা .. যাগ্গে আমাকেই একবার যেতে হবে এখন ওখানে।"
- "আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন .. আর শান্ত মনে আমার কথাগুলো শুনুন .. আপনাকে এখন শক্ত হতে হবে, অনেক দায়িত্ব নিতে হবে আপনাকে। তবে চিন্তা করবেন না আমি সঙ্গে আছি এবং থাকবো। মানুষের বিপদ যখন আসে তখন এই ভাবেই বোধহয় আসে .. ওদের অবর্তমানে আমিই এখন গোগোলের লোকাল গার্জেন। তাই আমাকে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ, আসলে ঠিক হসপিটাল থেকে নয় থানা থেকে খবরটা শুনেই আপনাকে ফোন করলাম। আজ ভোরের দিকে পাঁচটা নাগাদ অনিরুদ্ধ মারা গেছে। সেই সময় ওর কেবিনে কেউ ছিলো না, সিস্টার একটু টয়লেটে গিয়েছিলেন। মিনিট পনেরো পরে যখন উনি কেবিনে ফিরে আসেন .. তখন দেখা যায় অনিরুদ্ধর মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটা সরানো .. তারপর ওকে পরীক্ষা করে দেখা যায় ও আর বেঁচে নেই। তবে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করছে এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয় .. কারোর দ্বারা এটি ঘটানো হয়েছে। থানাতেও সেই মর্মেই ডায়েরি করা হয়েছে। ওরাই আপনাকে জানাতো, কিন্তু যেহেতু খবরটা আমি আগে জেনেছি এবং এরপর থেকে সবকিছু আমিই দেখবো, তাই আমি জানালাম।"
ফোনের রিসিভারটা হাত থেকে পড়ে গেলো সুজাতার। তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকলো কনকপুরের মেলার সেই সন্ধ্যের এক টুকরো স্মৃতি। কালকে তার প্রিয় বান্ধবী অরুন্ধতীর মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল সুজাতা, আজ তার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র প্রেম যার সম্বন্ধে কেউ কোনোদিন জানতে পারলো না আর ভবিষ্যতেও হয়তো জানতে পারবে না সেই মানুষটিকে হারিয়ে সেই শোকের পাথরও বোধায় গলতে শুরু করছিলো .. চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সুজাতা।
সেই মুহূর্তে বাড়ির খুব কাছ থেকে একটি মহিলা কন্ঠের আর্তনাদ এবং একটা ভারী বস্তু অনেক উপর থেকে পড়লে যেরকম আওয়াজ হয়, ঠিক সেইরকম একটা শব্দ হলো। অন্য সময় হলে সে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে অবশ্যই দেখতো। তবে এমত অবস্থায় বাহ্যিক ব্যাপার সম্পর্কে তার কৌতূহল এবং ওঠার মতো শারীরিক ক্ষমতা কোনোটাই ছিলো না। গোগোলটা কি করছে কে জানে! সকাল থেকে ওর দিকে তাকানোর সময়টুকু পর্যন্ত পায়নি সে .. ওকে তো জানাতে হবে খবরটা .. কিন্তু ও কি নিতে পারবে এইটুকু বয়সে এতো বড় বড় আঘাতগুলো?
গোগোলকে ডাকতে যাবে .. এমন সময় বাইরে থেকে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে ভয়ার্ত কণ্ঠে হাঁপাতে হাঁপাতে গোগোল বলে উঠলো "আন্টি জানো তো .. আমাদের বাড়ির পাশে যে সিমেন্টের টাওয়ারটা আছে, ওখান থেকে দিদা পড়ে গেছে .. কিন্তু ওখানে দিদা কেন উঠলো বলো তো? ওখানে তো কিছুই নেই .. আমি বিকেলবেলা খেলতে খেলতে ওদিকটা গেলে মা ভীষণ রাগ করতো .. আমি কখনো ওখানে যাই না .. দরজা হাট করে খোলা ছিলো .. তাই আমি বেরিয়ে একটু সামনেটা দাঁড়িয়েছিলাম বাবা কখন ফিরবে সেটা দেখার জন্য। তখন দেখলাম দিদা উপর থেকে ঝপ করে পড়ে গেলো .. না না আমি দেখিনি .. মানে পড়ে যাওয়ার পর আওয়াজ শুনে ওদিকে তাকিয়ে দেখে বুঝলাম ওটা দিদা .. তুমি শিগগিরি চলো .."
শত চেষ্টা করেও সোফা থেকে উঠতে পারলো না সুজাতা। তার শরীরটা ঠকঠক করে কাঁপছিলো।
•• আদি খন্ডের সমাপ্তি ••
|| পাঠক বন্ধুদের উদ্দেশ্যে ||
আমার এই উপন্যাসের প্রথম অধ্যায় আদি খন্ড সমাপ্ত হলো। আর কয়েকদিনের মধ্যেই মূল উপন্যাসে প্রবেশ করে শুরু হবে উত্তর খন্ড। উপন্যাসের প্রথম ভাগের মতোই আশাকরি দ্বিতীয় ভাগে আপনাদের সহযোগিতা এবং ভালোবাসা পাবো।
ভালো লাগলে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন
লাইক এবং রেপু দিয়ে উৎসাহিত করবেন