09-07-2022, 02:55 AM
(This post was last modified: 10-07-2022, 01:42 AM by Nirjon_ahmed. Edited 4 times in total. Edited 4 times in total.)
অধ্যায় ৯ঃ স্মরণ করো খৈয়ামে
"আবার যখন মিলবে হেথায় শরাব সাকির আঞ্জামে,
হে বন্ধুদল, একটি ফোঁটা অশ্রু ফেলো মোর নামে!
চক্রাকারে পাত্র ঘুরে আসবে যখন, সাকির পাশ,
পেয়ালা একটি উলটে দিয়ো স্মরণ করে খৈয়ামে... "
টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হওয়ায় যে যার রুমের দিকে চলে গেলে নির্জন ফ্লাইওভারের নিচে প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন খামগুলোর আড়ালে বসে। হাওয়া দিচ্ছে খুব, ছাট লাগছে গায়ে, ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে ওর। ও জানে, এখন বিছানায় গেলেই কাঁথার উষ্ণ গহ্বরে আর পাঁচ মিনিটও টিকবে না, ঘুম টেনে নেবে বিস্মৃতিতে। অথচ এই রাতের একটা সেকেন্ডও ঘুমিয়ে কি হাই তুলে নষ্ট করতে চায় না নির্জন। ষষ্ঠেন্দ্রিয় সজাগ রেখে শুষে নিতে চায় ও এই পরিবেশ। থমথমে নিস্তব্ধতা, ছাত্রদের কোলাহল, এই আলো আঁধার, আচমকা আসা ইলশে গুঁড়ি আর মাটিতে বৃষ্টি পড়ার সরসর শব্দ- সব কিছু শুষে নিতে চায় ও।
রিডিং রুমের বারান্দায় অনেকে পড়ছে। অনেকেই চা বানানোর সরঞ্জাম রাখে সাথে, যাতে ঘুম এলেই চায়ের উষ্ণতায় চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে মুহূর্তেই। কেউ বালিশ নিয়ে এসেছে- ঘুমাবে রিডিংরুমেই।
যারা এভাবে পড়ছে, দিনে চৌদ্দ কি পনেরো ঘণ্টা, তাদের সাথে পরীক্ষায় কী করে পারবে নির্জন সারাদিন কাজ করে? জুলফিকারই বা কী উপায় প্রতিযোগিতায় তাদের টেক্কা দেবে ছয়টা টিউশন করিয়ে?
একটা বছর যদি সময় দিত কেউ ওকে! বারোটা মাস! রোজগারের চিন্তা নেই, বাড়িতে টাকা পাঠানোর চাপ নেই, কাজের ক্লান্তি নেই, ঘুপচি ঘরের গরমের তীব্রতায় সামান্য হাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ নেই- শুধু পড়া, পড়া আর পড়া!
সিগারেটের তেষ্টা বোধ করে নির্জন।
এই সামান্য চাহিদাটাও নির্জনের কাছে ইউটোপিয়া মনে হয় এখন!
ঘুমানোর আগে নিম্বাসদার সাথে একবার দেখা করবে ভেবেছিলো, রাত একটার পর। কিন্তু এখন আশেপাশে কেউ নেই বলে আর একা থাকলেই মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘশ্বাস প্রসব করবে, এমন সম্ভাবনা থাকায়, নির্জন নিম্বাসদার রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
নিম্বাসদা এই মাঝরাতে জুতা পরে ফিটফাট হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গোঁফ ছাটছেন। নির্জনকে অবতল আয়নায় দেখেই বলে উঠলেন, “তোর কথাই শালা ভাবছিলাম! বহুত দিন বাঁচবি!”
নিম্বাসদা সিঙ্গেল রুমে থাকেন। একা। এমন সৌভাগ্য খুব কম ছাত্রেরই হয়।
“হঠাত আমার কথা মনে পড়ল? একবারও তো খোঁজ নেননি!”
অভিযোগের সুরে কথাগুলো বলে তার লম্বা ছোট্ট ঘরে ঢুকলো নির্জন।
ঘরের কোণে সারি সারি মদের বোতল, পড়ার টেবিলে পাশেই। টেবিলে বিশাল একটা হুলো- দেশী বিড়াল এতো বড় হতে পারে- প্রায় ৬ মাস বয়সী পাঠার সমান, এই হুলোকে না দেখলে ও জানতো না- তাকিয়ে আছে ঘুম চোখ। বোধহয় বিরক্ত নিম্বাসদার এই অসময়ের রূপচর্চায়। বিছানায় বাকমার্ক করে রাখা একটা বই উল্টো পড়ে আছে।
“আমি তো জানি, তুই খারাপ আছিস। একারণে ফোনটোন দেই না। কেউ ভালো নেই, এটা ফোনে শুনতে আমার ভালো লাগে না!”
“আমার কথা কেন ভাবছিলেন?”
আয়না থেকে সামান্য মুখ তুলে নিম্বাসদা বললেন, “আজ একটা হেব্বি খাওয়াদাওয়া আছে। ফরেন মাল থাকবে। তুই একদিন আমার কাছে ফরেন খাইতে চাইছিলি, খাওয়াইতে পারি নাই। আজ সুযোগ আছে!”
নির্জনের মুখে এবারে হাসি ফুটে ওঠে। বলে, “খাওয়ানোর কথা আপনার। আপনি নিজের বদলে আরেকজনের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গতে চাইছেন?”
“আমার কি তোকে ফরেন খাওয়ানোর সামর্থ হইছে নাকি? দাম জানিস? আমি শালা ভুল দেশে জন্মাইছি!”
“কোন দেশে জন্মানো উচিত ছিল?”
“ইন্ডিয়ায়। ওখানে মাল কতো সস্তা জানিস? আমি ইন্ডিয়ায় থাকলে পানির বদলে শালা মাল খেতাম!”
হুলোটা আড়মোড়া ভাঙ্গছে এখন। মিনিয়েচার বাঘের এই প্রজাতিকে যতই দেখে ততই অবাক হয় ও। অলস, স্বার্থপর ও খুঁতখুঁতে এই প্রাণীটি স্রেফ সৌন্দর্যের জোরে মনুষ্য সমাজে রাজার হালে বাস করছে। কোন শালা বলেছে সৌন্দর্যের চেয়ে গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
“তুই চল আমার সাথে। যত ইচ্ছা মাল টানবি! অনেক মেয়েও থাকবে।”
নির্জন বলে, “ধুর মিয়া, এত রাতে কোথায় যাব? আপনি যাচ্ছিলেন যান। ভাবলাম গল্প করে আসে, সেটা দেখছি হচ্ছে না!”
আয়নাটা রেখে নির্জনের দিকে পুরোপুরো ফিরে নিম্বাসদা বলেন, “গার্মেন্টসে ঢুকে তুই ভেড়া হয়ে গেলি নাকি? তোর এডভেঞ্চার স্প্রিট কৈ গেলো? বারোটা কোন রাত? রাতের ঢাকা এখনো ঘোমটাই তোলে নাই, আর তুই ঘুমাবি!”
নির্জন বাঁকা হেসে বলে, “আপনার মেয়র তো ইলেকট্রিসিটি বাঁচানোর ছলে রাত আটটার মধ্যে দোনাকপাঠ সব বন্ধ করাচ্ছে। আপনার রাতের ঢাকা তো নয়টার মধ্যেই এখন বাচ্চাদের মতো দুদু খেয়ে ঘুমাবে!”
“রাতের ঢাকা মেয়রের কথায় চলে না, নির্জন!”, গর্বিত স্বরে জবাব দেন নিম্বাসদা। “তোদের মেয়রের বাপেরা চালায় রাতের ঢাকা!”
তারপর নির্জনের দিকে তাকিয়ে বলেন, “যা রেডি হয়ে আয়। শার্ট পরিস না আবার। টিশার্ট পরিস! আমিও ততোক্ষণে রেডি হয়ে নেই!”
“আরে যাবো কোথায়, সেটা তো বলবেনন অন্তত?”, তাগদা দিয়ে বলে নির্জন।
“কেপ অফ গুড হোপে!”
“কেপ অফ গুড হোপ? এটা তো বাড়া সাউথ আফ্রিকায়!”
মিচমিচে একটা হাসি মুখে ফুটিয়ে তোলেন নিম্বাসদা। বলল, “তোর মতো বিসিএস প্রার্থীর কাছে এইটা সাউথ আফ্রিকাতে। আমার কাছে এটা ধানমন্ডির বার কাম হোটেল! তাড়াতাড়ি যা এখন...”
***
রুমে গিয়ে শরীরটা সামান্য সম্পাদনা করে হলগেটে যখন নির্জন উঠল নিম্বাসদার ইয়ামাহা আরএক্স ১০০ এর পিছনে, তখন বৃষ্টি গেছে থেমে, ঘড়িতে বেজে গেছে বারোটা। অনেকেই রাতের সিগারেট কেনার জন্য ছুটছে পলাশী মোড়ে।
প্রাচীন ইয়ামাহা আরেক্স দেখতে যতোটা সুন্দর, সাউন্ড যতোটা মন্দ্র, পিলিয়ন বসার জন্য ততোটাই বদখৎ। কোনমতে নিম্বাসদাকে ধরে বসে রইল নির্জন।
“তুই আরওয়ান ফাইভ ভিথ্রি বা জিএসএক্স আর নিয়া ক্যাম্পাসে ঘুরবি, কেউ তোর দিকে ফিরেও তাকাবে না। এসব এখন অহরহ। কিন্তু আমার এই বাইক স্টার্ট মারলেই সবাই ফিরে তাকায়। ওল্ড ইজ গোল্ড, যাই বলিস না কেন?”
“আপনার টাকা থাকলে কি ভিথ্রি বা GSX R এর বদলে এইটা কিনতেন?”, খোঁচা মারার লোভটা এবারে সামলাতে পারে না নির্জন।
নিম্বাসদা জবাবে কিছুই বলেন না।
বৃষ্টি ভেজা রাজপথ চকচক করছে সদ্য পুকুর থেকে তোলার রুইয়ের আঁশের মতো। ভেজা গাছগুলো নতমুখ। নীলক্ষেত সিগনালে একটা পুলিশ দাঁড়িয়ে একা, কয়েকটা ভিখারি হার জিরজিরে একটা কুকুরের পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে নিউমার্কেট ফ্লাইওভারের নিচে।
নির্জন জিজ্ঞেস করল, “কেপ টাউনে, না থুড়ি, কেপ অফ গুড হোপে কী আছে এখন? কেউ ট্রিট দিচ্ছে নাকি?”
“না রে, বাড়া। আমাদের এডিটরের জন্মদিন ছিলো আজ, মানে ছিলো গতকাল আরকি। আর সেটার পার্টি। গতকাল উনি বাইরে ছিলেন!”
“আপনার পত্রিকার নাম যে কী? ভুলে গেছি!”
নিম্বাসদা তার পত্রিকার নাম* বলেন।
নির্জন জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা দাদা, এই পত্রিকা কেউ পড়ে? মানে আমি তো কোন হকারকে বিক্রি করতে দেখি নাই! এরা চলে কেমনে?”
হো হো করে হেসে ওঠেন নিম্বাসদা। উল্টো দিকের হাওয়ার সাথে নিম্বাসদার হাসিও এসে যেন নির্জনের মুখে ঝাপটা মারতে থাকে!
“চলে না। কেউ কেনে না। মাগার সরকারী বিজ্ঞাপন পায় মাসে লাখলাখ টাকার!”
“মানে?”
“মানে আমাদের পত্রিকার ছাপানোই হয় অল্প। কিন্তু সরকাররের কাছে হিসাব দেয়া আছে, এই পত্রিকার সার্কুলার মোর দ্যা দু হান্ড্রেস থাউজেন্ড। সরকারী বিজ্ঞাপনের টাকাও আসে সেই অনুপাতে। সেই টাকা দিয়েই চলে! আর পত্রিকার অনলাইন ভার্সন তো আছেই!”
“সরকার জানে না এসব? কেউ জানায় না?”
“তোর কী মনে হয়, এসব দেখার কেউ আছে? যারা দায়িত্বে আছে এসবের, হয়তো তাদের ঘুষটুস দিয়ে চুপ করিয়ে রাখে!”
“লোকে প্রথম সারির নিউজ পোর্টাল বাদ দিয়ে তোমাদের পোর্টালে ঢোকে?”
নিম্বাসদা আবার অট্টহাস্য করে ওঠেন। কিন্তু প্রথমবারের মতো তার হাসি দীর্ঘসময় ধরে নির্জনের কানে বাজে না।
বলেন, “শতকরা একজনও হয়তো এখন সার্চবারে ইউআরএল টাইপ করে কোন পোর্টালে যায় না! সবাই ফেসবুকে এসেই খবর দেখে। সব পত্রিকারই লায়ন্স শেয়ার ভিজিটর এখন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আসে। বাসর রাতে কি করলেন মিথিলা? বা শবনাম ফারিয়ার কত নম্বর স্বামী হতে চলে অমুক- এমন শিরোনামে কোন মূলধারার পোর্টাল, অনন্দবজর ছাড়া, নিউজ করে? আমরা করি। পাবলিক খায়। দেশের ৯৯% মানুষের অর্থনীতির খবরের দরকার নেই। প্রতিদিন আমাদের সাইটে ইউনিক ভিজিটর কতো জানিস? আঠারো লাখ! কোন নিউজ ভাইরাল হলে তো কোটি পাড় হয়ে যায়!”
“এসব করেই চলছে?”
“চলছে মানে? দৌড়াচ্ছে। এই দেশে অন্তত ৫০টা পত্রিকা দাবি করে তাদের সার্কুলার দৈনিক ১ লাখের উপরে। এত পেপার কেনে কে ভাই? পত্রিকাগুলো চলছেই সরকারের টাকা মেরে!”
জবাবে নির্জন এবারে কিছুই বলে না। বাইক সাইন্সল্যাবে মোড় নিয়েছে।
রাস্তার দুধারের ঘুমন্ত উঁচু বাড়িগুলোর কোন কোন ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে এখনো। কয়েকজন পথচারী এখনও হন্তদন্ত হয়ে পথ চলছে।
“তোকে কিন্তু ভেতরে গেলে সময় দিতে পারব না, বলে রাখতেছি এখন। তুই নিজে নিজেই থাকিস। মাল খেয়ে টাল হয়ে পড়ে থাকিস না আবার। লিমিটে টানিস!”, বলেন নিম্বাসদা।
“আমি তো মাল খাবো না!”
“মানে? মাল খাবি না কেন? এমন সুযোগ আর পাবি?”
নির্জন বলে, “অনেক কষ্টে এসব মদ গাঁজার নেশা ছাড়ছি, দাদা। আর না। কোনদিন নিজের টাকায় মাল খাওয়ার সামর্থ হলে খাবো, না হলে আর না। এই বাড়া খুঁজে খুঁজে চেয়েচিন্তে মাল খাওয়ার মধ্যে আর আনন্দ পাই না!”
“আরে শালা! তোর দেখি আত্মসম্মান জন্মাইছে। আমারই আত্মসম্মান জন্মাইলো না এখনো!”
কিছুক্ষণ পর নিম্বাসদা বাইকটা যেখানে দাঁড় করালো, সে জায়গায় নির্জন আগেও এসেছে। কিছু দূরেই সরকারী দলের অফিস। সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতে এখানেই একটা টিউশনি করাতো ও। নতুন বোধহয়- এই বার চোখে পড়েনি ওর কোনদিন। পড়লে একবার, আরেকজনকে হয়তো আমড়াগাছি করেই, এখানে এসে অন্তত একটা পেগ মেরে যেতো।
হোটেলের সামনে সার সার গাড়ি। কিছু সরকারী গাড়িও চোখে পড়ল নির্জনের।
নির্জন বলল, “ভাই, এ কোথায় নিয়ে এলেন? এ তো সব বড় লোকদের কারবার। একটা এম্পির গাড়িও দেখলাম। এইখানে শালা আমি কী করব?”
নিম্বাসদা হিসহিসিয়ে উঠল এক্কেবারে, “তুই নিজেকে ছোট ভাবছিস কেন? এই নিজেকে ছোট ভাবার প্রবণতাই জাতটাকে ডোবাল। শালা টিপিকাল বাঙ্গালির মতো ম্যাও ম্যাও করলে পাছায় লাত্থি মারবো তোর সবার সামনেই!”
নিম্বাসদার কথা মেনে নিয়েই সিনা টান করে পা বাড়ালো নির্জন কেপ অগ গুড হোপের ভেতরে।
একজন খাকি উর্দি পরিহিত দারোয়ান মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম জানালো ওদের।
“তুই যদি জানতি আমি শালা গার্মেন্টসের শ্রমিক, তাইলে আমার কলার ধরে সালাম ফেরত চাইতি!”
মনে মনে দারোয়ানটাকে বলল নির্জন।
রিসেপশনে নিম্বাসদার ইনভিটেশন কার্ডটা দেখাতে হলো, লিখতে হলো নাম ধাম।
নিম্বাসদার পিছু পিছু নির্জন তিনতলার বিশাল ফ্লোরে এসে পৌঁছল। যে অল্প কয়েকটা বারে নির্জনের আনাগোনা ছিলো একসময় কিছু উদার বড় ভাইয়ের কল্যাণে, সে কয়েকটার থেকে এর চেহারায় সামান্য অমিল রয়েছে। প্রথম অমিলটাই চোখে লাগে বেশি। এটা যেন অতিরিক্ত খোলামেলা- বারের চেয়ে রেস্টুরেন্ট রেস্টুরেন্ট ভাবটারই প্রাধান্য। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টেবিলগুলোতে পানোন্মত্তের চেয়ে ফরমাল পোশাক পরিহিত ভদ্রলোকেরাই বেশি। বেশিরভাগেরই হাতে যদিও গ্লাস শোভা পাচ্ছে! কয়েকটা মেয়ে- কেউ শাড়ি, কেউ ওয়েস্টার্ন পরে এখানে ওখানে বসে জায়গাটার আভিজাত্য, গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য সব একসাথে বাড়িয়ে তুলেছে।
“কীরে ভাই? কৈ ভাবলাম, ঝাকানাকা পার্টি চলতেছে, নাচ হচ্ছে, মাল খাচ্ছে। এ তো দেখি শালা সুশীল- গল্প করছে বসে বসে!”
নিম্বাসদা বললেন, “এজন্যেই তো বললাম, রাত কেবল শুরু। মাল পেটে পড়লেই প্রতেকটা সক্রেটিস একেকটা জানোয়ারে পরিণত হবে! অবশ্য খুব বেচাল কিছু হওয়ার চান্স কম! হাজার হোক একজন পত্রিকা সম্পাদকের জন্মদিনের পার্টি!”
“এইটারে তো বার মনেই হচ্ছে না!”
“বার দুই তলায়। এইটা মেবি কনফারেন্স হল।”
ওরা যখন হল রুমের মাঝামাঝি এলো, তখনই নিম্বাসদা বললেন, “আমি এখন যাই। ঐ যে কাউন্টার দেখছিস, ওখানে গিয়ে যা চাইবি দেবে, যদি মন চায়, খাইস। আমি সময় পাইলে তোর কাছে আসব!”
“আর যদি ভালো না লাগে?”
“ভালো না লাগলে আমাকে ফোন দিস, ব্যবস্থা করব!”
নির্জন নিম্বাসদার কথা মতো হাঁটতে লাগলো কাউন্টারের দিকে। নিজের পোশাকের কথা ভেবে একবার লজ্জা এসে গ্রাস করেছিলো ওকে। এখানকার ওয়েটারেরা পর্যন্ত তার চেয়ে ভালো পোশাক পরিহিত। পরে সে ভাবনা দূরে ঠেলে দিয়েছে ও। ভেবে লাভ কী? কোন দৈব বলে ও তো নিজের পোশাক পাল্টে ফেলতে পারবে না মুহূর্তেই!
ভেবেছিলো, এক ফোঁটা সুরার গন্ধও নেবে না নাকে। এখন চারদিকে, প্রায় সবাইকে হাতে গ্লাস নিয়ে বসে থাকতে দেখে সাধু হওয়ার ইচ্ছেটাকে দমালো নির্জন। এমন সুযোগ হেলায় হারানোর মানে নেই কোন। কোন্ দেবতা বা ঈশ্বর ওকে পুরস্কৃত করার জন্যে বসে আছে যদি না ডোবায় ঠোঁট পানপাত্রে?
ওমর খৈয়ামের রুবাঈয়াত মনে পড়ে গেলো নির্জনের। নজরুলের অনুবাদে। খৈয়াম জিজ্ঞেস করেছে নবিকে, “হে নবি, হে শ্রেষ্ঠ মানব, আঙুরজল কী দোষ করল? কেন করলে মদকে হারাম?“
খৈয়ামের কল্পনায় নবি দিয়েছেন জবাব। তিনি বলেছেন-
তত্ত্ব-গুরু খৈয়ামেরে পৌঁছে দিয়ো মোর আশিস
ওর মতো লোক বুঝল কিনা উল্টো করে মোর হদিস!
কোথায় আমি বলেছি, যে, সবার তরেই মদ হারাম?
জ্ঞানীর তবে অমৃত এ, বোকার তবে উহাই বিষ!
ওর জন্য মদ অমৃত না গরল, তাই ভাবছিলো নির্জন, তখনই চোখ গেলো নিম্বাসদার দিকে। নিম্বাসদা ওকে ইশারায় ডাকছেন। ওর পাশে কয়েকজন মধ্যবয়সী, একজন বৃদ্ধ।
নির্জন সেদিকে দ্রুত পা চালালো।
কাছে যেতেই নির্জন শুনতে পেলো, নিম্বাসদা বলছেন, “এর কথাই বলছিলাম, স্যার। খুব ব্রাইট ছেলে। ডিইউ থেকে ফ্রেশ গ্রাজুয়েট, এর একটা জবের খুব দরকার!”
নির্জন হতচকিয়ে গেলো। মাল খেতে এনে নিম্বাসদা চাকরির তদবির করছেন কেন? ও তো নিম্বাসদাকে এমন করতে বলেনি। তবে?
নির্জন লোকগুলোর সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে দাঁড়ায়।
“জবের কার দরকার নেই বলো? আগে তো দেখতে হবে, ওর ক্যালিবার কতোটা।”
বৃদ্ধ লোকোটার পাশের স্যুটেড ব্যক্তিটি বলল কথাগুলো। এ’ই কি সম্পাদক? তাগড়া গোঁফ, মুখে টকটকে হাসি- তাকিয়ে আছে নির্জনের দিকে একদৃষ্টে। তার হাতটা ধরে আছে তার স্ত্রী। স্ত্রীই হবে- নইলে এভাবে কেউ হাত ধরে না কারো। স্বামী চারপাশের বেগানা নারীদের অমৃত হ্রদে হুট করে ডুব যেন না মারতে পারেন, সেজন্যেই বোধহয় ছাড়ছে না হাত!
নিম্বাসদা তেলতেলে স্বরে জবাব দেন, “এর ক্যালিবার আপনারা টেস্ট করেই নেবেন, স্যার। আমি মিথ্যে বলছি না। আপনারা এক্সামিন করে দেখতে পারেন।”
রাগ হয় প্রচণ্ড নির্জনের নিম্বাসদার উপর। এমন করবেন উনি, জানলে জীবনেও আসতো না এখানে। নির্জন চাকরির জন্য অনেক পরীক্ষা দিয়েছে, লাইনে দাঁড়িয়েছে, ভাইভা দিয়েছে। কিন্তু কোনদিন কারো কাছে তদবির নিয়ে যায়নি, হাত পাতেনি কারো কাছে। অথচ নিম্বাসদা কী অবলীলায় বলছেন কথাগুলো।
স্যুটেড ব্যক্তিটি বলে উঠল, “এডিটর সাহেব, আপনি বরং একদিন সময় করে এই ছেলের পরীক্ষা নিয়ে নিন। নিম্বাস এমন করে যখন ধরছে!”
এই লোক তবে এডিটর নন। লোকটা এডিটর বলে সম্বোধন করল যাকে, সেই চুলপাকা বৃদ্ধটি জবাবে বললেন না কিছুই। হাসলেন শুধু।
কিছুক্ষণ পর, ওরা যখন নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, নিম্বাসদা নির্জনকে নিয়ে চলে এলেন একটু আড়ালে।
“এটা কিন্তু ঠিক করলেন না, নিম্বাসদা। আপনাকে আমি চাকরির কথা বলতে বলেছি?”
নিম্বাসদা একটা শতবতের গেলাস হাতে নিয়েছেন তুলে। সেখান থেকে একটা সিপ নিয়ে বললেন, “জানি তো বলিস নাই। নিজের রেস্পনসিবিলিটি থেকে বললাম। তুই বাড়া গার্মেন্টসে কাজ করিস, আমার ভালো লাগে না। যদি এখানে হয়ে যায়!”
“ঐ মোচওয়ালা লোকটা শালা কীভাবে কথা বলছিল, দেখলেন? চিবিয়ে চিবিয়ে! যেন ও নিজের পকেট থেকে টাকা দেবে আমার বেতনের।”
“আরে ওর কথা বাদ দে। হস্তীমূর্খ আমলা! ও তো নিজে তদবির নিয়া আসছে। ওর পাশে যে মহিলাটাকে দেখলি, সেটা ওর বৌ। ইউটিউবার। ফুড ভ্লগিং করে। আমাদের পত্রিকায় ওনাকে নিয়ে একটা ফিচার ছাপাতে বলে। ভাব! টাকাও নাকি দেবে!”
নির্জন এবারে হেসে একবার মহিলাটার দিকে তাকায়। মাঝবয়সী। স্বাভাবিক ফিগার। তবে মুখটা বেশ ভালো গঠনের। বলে, “এই মহিলার ভ্লগ কোনদিন দেখছি বলে তো মনে পড়ছে না!”
“দেখবি কী করে? দেশে তো এখন ফুড ভ্লগারের সংখ্যা ছাগলের চেয়ে বেশি। তাও ভালো কবির সংখ্যাটা কমেছে ভ্লগার বাড়ায়!”
“সেটা বড় কথা না”, বলে নির্জন; “বড় কথা হলো, কাজটা ভালো করেন নাই আপনি! এইখানে তদবিরের দরকার ছিল না!”
নিম্বাসদা বলেন, “আচ্ছা, রাগ করিস না। তুই গিয়ে মাল খা। আমি দেখি, যদি তোর কিছু করতে পারি! চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? তোকে তো কিছু করতে হচ্ছে না। মনে কর, আমি তোকে ডাকি নাই। ঐ লোকদের সাথে তোর কথাই হয় নাই! তবে আমি তোর ভালোর জন্যেই বলছি। একবার এই লাইনে ঢুকতে পারলে, তোর মতো ছেলে তরতর করে উপরে উঠবে!”
ওয়েটারকে বলে নিম্বাসদা নিজেই ওকে ব্ল্যাক ডগের পেগ বানিয়ে দিয়ে “তুই থাক। আমি ওনার সাথে সাথেই আছি। দরকার হলে ফোন দিস!” বলে গেলেন চলে।
নিম্বাসদা গিয়ে আবার এডিটরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওকে কেমন লোকটার পোষা কুকুরের মতো লাগছে। দুহাত পিছনে, দাঁড়িয়ে আছেন দেহরক্ষীর মতো। এতোটা তেল মারতে কবে থেকে শুরু করেছেন নিম্বাসদা? সামান্য আগেই নির্জনকে বললেন নিজেকে ছোট না ভাবতে। অথচ এখন সমাপদকের সামনে এমন আচরণ করছেন, এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন- এভাবে ও শুধু মোসাহেবদেরই দাঁড়াতে দেখেছে, দেখেছে রাজনৈতিক নেতাদের পাশে চামচাদের দাঁড়াতে।
প্রায় ঘণ্টা খানেক নির্জন এখানে ওখানে বসে, লোকগুলোর মুখ দেখে চরিত্র অনুমান করার চেষ্টা করে, কয়েকটা ওর বয়সী মেয়েকে ভদ্রতার হাসি উপহার দিয়ে, কিছু নাসরিন ভাবির বয়সী মিলফের বুক, পাছা মেপে ও মাঝেমাঝে দুএকবার গ্লাসে চুমুক দিয়ে কাঁটিয়ে দিলো। বেশ বিরক্ত লাগছে ওর। এই জন-অরণ্যে সময় নষ্টের বদলে হলের বারান্দায় বসে মেঘে ঢাকা তারাদের কথা ভাবলেও ওর বেশি ভালো লাগতো!
“হে, তুমি সেই মালটা না?”
"আবার যখন মিলবে হেথায় শরাব সাকির আঞ্জামে,
হে বন্ধুদল, একটি ফোঁটা অশ্রু ফেলো মোর নামে!
চক্রাকারে পাত্র ঘুরে আসবে যখন, সাকির পাশ,
পেয়ালা একটি উলটে দিয়ো স্মরণ করে খৈয়ামে... "
টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হওয়ায় যে যার রুমের দিকে চলে গেলে নির্জন ফ্লাইওভারের নিচে প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন খামগুলোর আড়ালে বসে। হাওয়া দিচ্ছে খুব, ছাট লাগছে গায়ে, ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে ওর। ও জানে, এখন বিছানায় গেলেই কাঁথার উষ্ণ গহ্বরে আর পাঁচ মিনিটও টিকবে না, ঘুম টেনে নেবে বিস্মৃতিতে। অথচ এই রাতের একটা সেকেন্ডও ঘুমিয়ে কি হাই তুলে নষ্ট করতে চায় না নির্জন। ষষ্ঠেন্দ্রিয় সজাগ রেখে শুষে নিতে চায় ও এই পরিবেশ। থমথমে নিস্তব্ধতা, ছাত্রদের কোলাহল, এই আলো আঁধার, আচমকা আসা ইলশে গুঁড়ি আর মাটিতে বৃষ্টি পড়ার সরসর শব্দ- সব কিছু শুষে নিতে চায় ও।
রিডিং রুমের বারান্দায় অনেকে পড়ছে। অনেকেই চা বানানোর সরঞ্জাম রাখে সাথে, যাতে ঘুম এলেই চায়ের উষ্ণতায় চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে মুহূর্তেই। কেউ বালিশ নিয়ে এসেছে- ঘুমাবে রিডিংরুমেই।
যারা এভাবে পড়ছে, দিনে চৌদ্দ কি পনেরো ঘণ্টা, তাদের সাথে পরীক্ষায় কী করে পারবে নির্জন সারাদিন কাজ করে? জুলফিকারই বা কী উপায় প্রতিযোগিতায় তাদের টেক্কা দেবে ছয়টা টিউশন করিয়ে?
একটা বছর যদি সময় দিত কেউ ওকে! বারোটা মাস! রোজগারের চিন্তা নেই, বাড়িতে টাকা পাঠানোর চাপ নেই, কাজের ক্লান্তি নেই, ঘুপচি ঘরের গরমের তীব্রতায় সামান্য হাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ নেই- শুধু পড়া, পড়া আর পড়া!
সিগারেটের তেষ্টা বোধ করে নির্জন।
এই সামান্য চাহিদাটাও নির্জনের কাছে ইউটোপিয়া মনে হয় এখন!
ঘুমানোর আগে নিম্বাসদার সাথে একবার দেখা করবে ভেবেছিলো, রাত একটার পর। কিন্তু এখন আশেপাশে কেউ নেই বলে আর একা থাকলেই মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘশ্বাস প্রসব করবে, এমন সম্ভাবনা থাকায়, নির্জন নিম্বাসদার রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
নিম্বাসদা এই মাঝরাতে জুতা পরে ফিটফাট হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গোঁফ ছাটছেন। নির্জনকে অবতল আয়নায় দেখেই বলে উঠলেন, “তোর কথাই শালা ভাবছিলাম! বহুত দিন বাঁচবি!”
নিম্বাসদা সিঙ্গেল রুমে থাকেন। একা। এমন সৌভাগ্য খুব কম ছাত্রেরই হয়।
“হঠাত আমার কথা মনে পড়ল? একবারও তো খোঁজ নেননি!”
অভিযোগের সুরে কথাগুলো বলে তার লম্বা ছোট্ট ঘরে ঢুকলো নির্জন।
ঘরের কোণে সারি সারি মদের বোতল, পড়ার টেবিলে পাশেই। টেবিলে বিশাল একটা হুলো- দেশী বিড়াল এতো বড় হতে পারে- প্রায় ৬ মাস বয়সী পাঠার সমান, এই হুলোকে না দেখলে ও জানতো না- তাকিয়ে আছে ঘুম চোখ। বোধহয় বিরক্ত নিম্বাসদার এই অসময়ের রূপচর্চায়। বিছানায় বাকমার্ক করে রাখা একটা বই উল্টো পড়ে আছে।
“আমি তো জানি, তুই খারাপ আছিস। একারণে ফোনটোন দেই না। কেউ ভালো নেই, এটা ফোনে শুনতে আমার ভালো লাগে না!”
“আমার কথা কেন ভাবছিলেন?”
আয়না থেকে সামান্য মুখ তুলে নিম্বাসদা বললেন, “আজ একটা হেব্বি খাওয়াদাওয়া আছে। ফরেন মাল থাকবে। তুই একদিন আমার কাছে ফরেন খাইতে চাইছিলি, খাওয়াইতে পারি নাই। আজ সুযোগ আছে!”
নির্জনের মুখে এবারে হাসি ফুটে ওঠে। বলে, “খাওয়ানোর কথা আপনার। আপনি নিজের বদলে আরেকজনের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গতে চাইছেন?”
“আমার কি তোকে ফরেন খাওয়ানোর সামর্থ হইছে নাকি? দাম জানিস? আমি শালা ভুল দেশে জন্মাইছি!”
“কোন দেশে জন্মানো উচিত ছিল?”
“ইন্ডিয়ায়। ওখানে মাল কতো সস্তা জানিস? আমি ইন্ডিয়ায় থাকলে পানির বদলে শালা মাল খেতাম!”
হুলোটা আড়মোড়া ভাঙ্গছে এখন। মিনিয়েচার বাঘের এই প্রজাতিকে যতই দেখে ততই অবাক হয় ও। অলস, স্বার্থপর ও খুঁতখুঁতে এই প্রাণীটি স্রেফ সৌন্দর্যের জোরে মনুষ্য সমাজে রাজার হালে বাস করছে। কোন শালা বলেছে সৌন্দর্যের চেয়ে গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
“তুই চল আমার সাথে। যত ইচ্ছা মাল টানবি! অনেক মেয়েও থাকবে।”
নির্জন বলে, “ধুর মিয়া, এত রাতে কোথায় যাব? আপনি যাচ্ছিলেন যান। ভাবলাম গল্প করে আসে, সেটা দেখছি হচ্ছে না!”
আয়নাটা রেখে নির্জনের দিকে পুরোপুরো ফিরে নিম্বাসদা বলেন, “গার্মেন্টসে ঢুকে তুই ভেড়া হয়ে গেলি নাকি? তোর এডভেঞ্চার স্প্রিট কৈ গেলো? বারোটা কোন রাত? রাতের ঢাকা এখনো ঘোমটাই তোলে নাই, আর তুই ঘুমাবি!”
নির্জন বাঁকা হেসে বলে, “আপনার মেয়র তো ইলেকট্রিসিটি বাঁচানোর ছলে রাত আটটার মধ্যে দোনাকপাঠ সব বন্ধ করাচ্ছে। আপনার রাতের ঢাকা তো নয়টার মধ্যেই এখন বাচ্চাদের মতো দুদু খেয়ে ঘুমাবে!”
“রাতের ঢাকা মেয়রের কথায় চলে না, নির্জন!”, গর্বিত স্বরে জবাব দেন নিম্বাসদা। “তোদের মেয়রের বাপেরা চালায় রাতের ঢাকা!”
তারপর নির্জনের দিকে তাকিয়ে বলেন, “যা রেডি হয়ে আয়। শার্ট পরিস না আবার। টিশার্ট পরিস! আমিও ততোক্ষণে রেডি হয়ে নেই!”
“আরে যাবো কোথায়, সেটা তো বলবেনন অন্তত?”, তাগদা দিয়ে বলে নির্জন।
“কেপ অফ গুড হোপে!”
“কেপ অফ গুড হোপ? এটা তো বাড়া সাউথ আফ্রিকায়!”
মিচমিচে একটা হাসি মুখে ফুটিয়ে তোলেন নিম্বাসদা। বলল, “তোর মতো বিসিএস প্রার্থীর কাছে এইটা সাউথ আফ্রিকাতে। আমার কাছে এটা ধানমন্ডির বার কাম হোটেল! তাড়াতাড়ি যা এখন...”
***
রুমে গিয়ে শরীরটা সামান্য সম্পাদনা করে হলগেটে যখন নির্জন উঠল নিম্বাসদার ইয়ামাহা আরএক্স ১০০ এর পিছনে, তখন বৃষ্টি গেছে থেমে, ঘড়িতে বেজে গেছে বারোটা। অনেকেই রাতের সিগারেট কেনার জন্য ছুটছে পলাশী মোড়ে।
প্রাচীন ইয়ামাহা আরেক্স দেখতে যতোটা সুন্দর, সাউন্ড যতোটা মন্দ্র, পিলিয়ন বসার জন্য ততোটাই বদখৎ। কোনমতে নিম্বাসদাকে ধরে বসে রইল নির্জন।
“তুই আরওয়ান ফাইভ ভিথ্রি বা জিএসএক্স আর নিয়া ক্যাম্পাসে ঘুরবি, কেউ তোর দিকে ফিরেও তাকাবে না। এসব এখন অহরহ। কিন্তু আমার এই বাইক স্টার্ট মারলেই সবাই ফিরে তাকায়। ওল্ড ইজ গোল্ড, যাই বলিস না কেন?”
“আপনার টাকা থাকলে কি ভিথ্রি বা GSX R এর বদলে এইটা কিনতেন?”, খোঁচা মারার লোভটা এবারে সামলাতে পারে না নির্জন।
নিম্বাসদা জবাবে কিছুই বলেন না।
বৃষ্টি ভেজা রাজপথ চকচক করছে সদ্য পুকুর থেকে তোলার রুইয়ের আঁশের মতো। ভেজা গাছগুলো নতমুখ। নীলক্ষেত সিগনালে একটা পুলিশ দাঁড়িয়ে একা, কয়েকটা ভিখারি হার জিরজিরে একটা কুকুরের পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে নিউমার্কেট ফ্লাইওভারের নিচে।
নির্জন জিজ্ঞেস করল, “কেপ টাউনে, না থুড়ি, কেপ অফ গুড হোপে কী আছে এখন? কেউ ট্রিট দিচ্ছে নাকি?”
“না রে, বাড়া। আমাদের এডিটরের জন্মদিন ছিলো আজ, মানে ছিলো গতকাল আরকি। আর সেটার পার্টি। গতকাল উনি বাইরে ছিলেন!”
“আপনার পত্রিকার নাম যে কী? ভুলে গেছি!”
নিম্বাসদা তার পত্রিকার নাম* বলেন।
নির্জন জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা দাদা, এই পত্রিকা কেউ পড়ে? মানে আমি তো কোন হকারকে বিক্রি করতে দেখি নাই! এরা চলে কেমনে?”
হো হো করে হেসে ওঠেন নিম্বাসদা। উল্টো দিকের হাওয়ার সাথে নিম্বাসদার হাসিও এসে যেন নির্জনের মুখে ঝাপটা মারতে থাকে!
“চলে না। কেউ কেনে না। মাগার সরকারী বিজ্ঞাপন পায় মাসে লাখলাখ টাকার!”
“মানে?”
“মানে আমাদের পত্রিকার ছাপানোই হয় অল্প। কিন্তু সরকাররের কাছে হিসাব দেয়া আছে, এই পত্রিকার সার্কুলার মোর দ্যা দু হান্ড্রেস থাউজেন্ড। সরকারী বিজ্ঞাপনের টাকাও আসে সেই অনুপাতে। সেই টাকা দিয়েই চলে! আর পত্রিকার অনলাইন ভার্সন তো আছেই!”
“সরকার জানে না এসব? কেউ জানায় না?”
“তোর কী মনে হয়, এসব দেখার কেউ আছে? যারা দায়িত্বে আছে এসবের, হয়তো তাদের ঘুষটুস দিয়ে চুপ করিয়ে রাখে!”
“লোকে প্রথম সারির নিউজ পোর্টাল বাদ দিয়ে তোমাদের পোর্টালে ঢোকে?”
নিম্বাসদা আবার অট্টহাস্য করে ওঠেন। কিন্তু প্রথমবারের মতো তার হাসি দীর্ঘসময় ধরে নির্জনের কানে বাজে না।
বলেন, “শতকরা একজনও হয়তো এখন সার্চবারে ইউআরএল টাইপ করে কোন পোর্টালে যায় না! সবাই ফেসবুকে এসেই খবর দেখে। সব পত্রিকারই লায়ন্স শেয়ার ভিজিটর এখন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আসে। বাসর রাতে কি করলেন মিথিলা? বা শবনাম ফারিয়ার কত নম্বর স্বামী হতে চলে অমুক- এমন শিরোনামে কোন মূলধারার পোর্টাল, অনন্দবজর ছাড়া, নিউজ করে? আমরা করি। পাবলিক খায়। দেশের ৯৯% মানুষের অর্থনীতির খবরের দরকার নেই। প্রতিদিন আমাদের সাইটে ইউনিক ভিজিটর কতো জানিস? আঠারো লাখ! কোন নিউজ ভাইরাল হলে তো কোটি পাড় হয়ে যায়!”
“এসব করেই চলছে?”
“চলছে মানে? দৌড়াচ্ছে। এই দেশে অন্তত ৫০টা পত্রিকা দাবি করে তাদের সার্কুলার দৈনিক ১ লাখের উপরে। এত পেপার কেনে কে ভাই? পত্রিকাগুলো চলছেই সরকারের টাকা মেরে!”
জবাবে নির্জন এবারে কিছুই বলে না। বাইক সাইন্সল্যাবে মোড় নিয়েছে।
রাস্তার দুধারের ঘুমন্ত উঁচু বাড়িগুলোর কোন কোন ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে এখনো। কয়েকজন পথচারী এখনও হন্তদন্ত হয়ে পথ চলছে।
“তোকে কিন্তু ভেতরে গেলে সময় দিতে পারব না, বলে রাখতেছি এখন। তুই নিজে নিজেই থাকিস। মাল খেয়ে টাল হয়ে পড়ে থাকিস না আবার। লিমিটে টানিস!”, বলেন নিম্বাসদা।
“আমি তো মাল খাবো না!”
“মানে? মাল খাবি না কেন? এমন সুযোগ আর পাবি?”
নির্জন বলে, “অনেক কষ্টে এসব মদ গাঁজার নেশা ছাড়ছি, দাদা। আর না। কোনদিন নিজের টাকায় মাল খাওয়ার সামর্থ হলে খাবো, না হলে আর না। এই বাড়া খুঁজে খুঁজে চেয়েচিন্তে মাল খাওয়ার মধ্যে আর আনন্দ পাই না!”
“আরে শালা! তোর দেখি আত্মসম্মান জন্মাইছে। আমারই আত্মসম্মান জন্মাইলো না এখনো!”
কিছুক্ষণ পর নিম্বাসদা বাইকটা যেখানে দাঁড় করালো, সে জায়গায় নির্জন আগেও এসেছে। কিছু দূরেই সরকারী দলের অফিস। সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতে এখানেই একটা টিউশনি করাতো ও। নতুন বোধহয়- এই বার চোখে পড়েনি ওর কোনদিন। পড়লে একবার, আরেকজনকে হয়তো আমড়াগাছি করেই, এখানে এসে অন্তত একটা পেগ মেরে যেতো।
হোটেলের সামনে সার সার গাড়ি। কিছু সরকারী গাড়িও চোখে পড়ল নির্জনের।
নির্জন বলল, “ভাই, এ কোথায় নিয়ে এলেন? এ তো সব বড় লোকদের কারবার। একটা এম্পির গাড়িও দেখলাম। এইখানে শালা আমি কী করব?”
নিম্বাসদা হিসহিসিয়ে উঠল এক্কেবারে, “তুই নিজেকে ছোট ভাবছিস কেন? এই নিজেকে ছোট ভাবার প্রবণতাই জাতটাকে ডোবাল। শালা টিপিকাল বাঙ্গালির মতো ম্যাও ম্যাও করলে পাছায় লাত্থি মারবো তোর সবার সামনেই!”
নিম্বাসদার কথা মেনে নিয়েই সিনা টান করে পা বাড়ালো নির্জন কেপ অগ গুড হোপের ভেতরে।
একজন খাকি উর্দি পরিহিত দারোয়ান মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম জানালো ওদের।
“তুই যদি জানতি আমি শালা গার্মেন্টসের শ্রমিক, তাইলে আমার কলার ধরে সালাম ফেরত চাইতি!”
মনে মনে দারোয়ানটাকে বলল নির্জন।
রিসেপশনে নিম্বাসদার ইনভিটেশন কার্ডটা দেখাতে হলো, লিখতে হলো নাম ধাম।
নিম্বাসদার পিছু পিছু নির্জন তিনতলার বিশাল ফ্লোরে এসে পৌঁছল। যে অল্প কয়েকটা বারে নির্জনের আনাগোনা ছিলো একসময় কিছু উদার বড় ভাইয়ের কল্যাণে, সে কয়েকটার থেকে এর চেহারায় সামান্য অমিল রয়েছে। প্রথম অমিলটাই চোখে লাগে বেশি। এটা যেন অতিরিক্ত খোলামেলা- বারের চেয়ে রেস্টুরেন্ট রেস্টুরেন্ট ভাবটারই প্রাধান্য। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টেবিলগুলোতে পানোন্মত্তের চেয়ে ফরমাল পোশাক পরিহিত ভদ্রলোকেরাই বেশি। বেশিরভাগেরই হাতে যদিও গ্লাস শোভা পাচ্ছে! কয়েকটা মেয়ে- কেউ শাড়ি, কেউ ওয়েস্টার্ন পরে এখানে ওখানে বসে জায়গাটার আভিজাত্য, গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য সব একসাথে বাড়িয়ে তুলেছে।
“কীরে ভাই? কৈ ভাবলাম, ঝাকানাকা পার্টি চলতেছে, নাচ হচ্ছে, মাল খাচ্ছে। এ তো দেখি শালা সুশীল- গল্প করছে বসে বসে!”
নিম্বাসদা বললেন, “এজন্যেই তো বললাম, রাত কেবল শুরু। মাল পেটে পড়লেই প্রতেকটা সক্রেটিস একেকটা জানোয়ারে পরিণত হবে! অবশ্য খুব বেচাল কিছু হওয়ার চান্স কম! হাজার হোক একজন পত্রিকা সম্পাদকের জন্মদিনের পার্টি!”
“এইটারে তো বার মনেই হচ্ছে না!”
“বার দুই তলায়। এইটা মেবি কনফারেন্স হল।”
ওরা যখন হল রুমের মাঝামাঝি এলো, তখনই নিম্বাসদা বললেন, “আমি এখন যাই। ঐ যে কাউন্টার দেখছিস, ওখানে গিয়ে যা চাইবি দেবে, যদি মন চায়, খাইস। আমি সময় পাইলে তোর কাছে আসব!”
“আর যদি ভালো না লাগে?”
“ভালো না লাগলে আমাকে ফোন দিস, ব্যবস্থা করব!”
নির্জন নিম্বাসদার কথা মতো হাঁটতে লাগলো কাউন্টারের দিকে। নিজের পোশাকের কথা ভেবে একবার লজ্জা এসে গ্রাস করেছিলো ওকে। এখানকার ওয়েটারেরা পর্যন্ত তার চেয়ে ভালো পোশাক পরিহিত। পরে সে ভাবনা দূরে ঠেলে দিয়েছে ও। ভেবে লাভ কী? কোন দৈব বলে ও তো নিজের পোশাক পাল্টে ফেলতে পারবে না মুহূর্তেই!
ভেবেছিলো, এক ফোঁটা সুরার গন্ধও নেবে না নাকে। এখন চারদিকে, প্রায় সবাইকে হাতে গ্লাস নিয়ে বসে থাকতে দেখে সাধু হওয়ার ইচ্ছেটাকে দমালো নির্জন। এমন সুযোগ হেলায় হারানোর মানে নেই কোন। কোন্ দেবতা বা ঈশ্বর ওকে পুরস্কৃত করার জন্যে বসে আছে যদি না ডোবায় ঠোঁট পানপাত্রে?
ওমর খৈয়ামের রুবাঈয়াত মনে পড়ে গেলো নির্জনের। নজরুলের অনুবাদে। খৈয়াম জিজ্ঞেস করেছে নবিকে, “হে নবি, হে শ্রেষ্ঠ মানব, আঙুরজল কী দোষ করল? কেন করলে মদকে হারাম?“
খৈয়ামের কল্পনায় নবি দিয়েছেন জবাব। তিনি বলেছেন-
তত্ত্ব-গুরু খৈয়ামেরে পৌঁছে দিয়ো মোর আশিস
ওর মতো লোক বুঝল কিনা উল্টো করে মোর হদিস!
কোথায় আমি বলেছি, যে, সবার তরেই মদ হারাম?
জ্ঞানীর তবে অমৃত এ, বোকার তবে উহাই বিষ!
ওর জন্য মদ অমৃত না গরল, তাই ভাবছিলো নির্জন, তখনই চোখ গেলো নিম্বাসদার দিকে। নিম্বাসদা ওকে ইশারায় ডাকছেন। ওর পাশে কয়েকজন মধ্যবয়সী, একজন বৃদ্ধ।
নির্জন সেদিকে দ্রুত পা চালালো।
কাছে যেতেই নির্জন শুনতে পেলো, নিম্বাসদা বলছেন, “এর কথাই বলছিলাম, স্যার। খুব ব্রাইট ছেলে। ডিইউ থেকে ফ্রেশ গ্রাজুয়েট, এর একটা জবের খুব দরকার!”
নির্জন হতচকিয়ে গেলো। মাল খেতে এনে নিম্বাসদা চাকরির তদবির করছেন কেন? ও তো নিম্বাসদাকে এমন করতে বলেনি। তবে?
নির্জন লোকগুলোর সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে দাঁড়ায়।
“জবের কার দরকার নেই বলো? আগে তো দেখতে হবে, ওর ক্যালিবার কতোটা।”
বৃদ্ধ লোকোটার পাশের স্যুটেড ব্যক্তিটি বলল কথাগুলো। এ’ই কি সম্পাদক? তাগড়া গোঁফ, মুখে টকটকে হাসি- তাকিয়ে আছে নির্জনের দিকে একদৃষ্টে। তার হাতটা ধরে আছে তার স্ত্রী। স্ত্রীই হবে- নইলে এভাবে কেউ হাত ধরে না কারো। স্বামী চারপাশের বেগানা নারীদের অমৃত হ্রদে হুট করে ডুব যেন না মারতে পারেন, সেজন্যেই বোধহয় ছাড়ছে না হাত!
নিম্বাসদা তেলতেলে স্বরে জবাব দেন, “এর ক্যালিবার আপনারা টেস্ট করেই নেবেন, স্যার। আমি মিথ্যে বলছি না। আপনারা এক্সামিন করে দেখতে পারেন।”
রাগ হয় প্রচণ্ড নির্জনের নিম্বাসদার উপর। এমন করবেন উনি, জানলে জীবনেও আসতো না এখানে। নির্জন চাকরির জন্য অনেক পরীক্ষা দিয়েছে, লাইনে দাঁড়িয়েছে, ভাইভা দিয়েছে। কিন্তু কোনদিন কারো কাছে তদবির নিয়ে যায়নি, হাত পাতেনি কারো কাছে। অথচ নিম্বাসদা কী অবলীলায় বলছেন কথাগুলো।
স্যুটেড ব্যক্তিটি বলে উঠল, “এডিটর সাহেব, আপনি বরং একদিন সময় করে এই ছেলের পরীক্ষা নিয়ে নিন। নিম্বাস এমন করে যখন ধরছে!”
এই লোক তবে এডিটর নন। লোকটা এডিটর বলে সম্বোধন করল যাকে, সেই চুলপাকা বৃদ্ধটি জবাবে বললেন না কিছুই। হাসলেন শুধু।
কিছুক্ষণ পর, ওরা যখন নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, নিম্বাসদা নির্জনকে নিয়ে চলে এলেন একটু আড়ালে।
“এটা কিন্তু ঠিক করলেন না, নিম্বাসদা। আপনাকে আমি চাকরির কথা বলতে বলেছি?”
নিম্বাসদা একটা শতবতের গেলাস হাতে নিয়েছেন তুলে। সেখান থেকে একটা সিপ নিয়ে বললেন, “জানি তো বলিস নাই। নিজের রেস্পনসিবিলিটি থেকে বললাম। তুই বাড়া গার্মেন্টসে কাজ করিস, আমার ভালো লাগে না। যদি এখানে হয়ে যায়!”
“ঐ মোচওয়ালা লোকটা শালা কীভাবে কথা বলছিল, দেখলেন? চিবিয়ে চিবিয়ে! যেন ও নিজের পকেট থেকে টাকা দেবে আমার বেতনের।”
“আরে ওর কথা বাদ দে। হস্তীমূর্খ আমলা! ও তো নিজে তদবির নিয়া আসছে। ওর পাশে যে মহিলাটাকে দেখলি, সেটা ওর বৌ। ইউটিউবার। ফুড ভ্লগিং করে। আমাদের পত্রিকায় ওনাকে নিয়ে একটা ফিচার ছাপাতে বলে। ভাব! টাকাও নাকি দেবে!”
নির্জন এবারে হেসে একবার মহিলাটার দিকে তাকায়। মাঝবয়সী। স্বাভাবিক ফিগার। তবে মুখটা বেশ ভালো গঠনের। বলে, “এই মহিলার ভ্লগ কোনদিন দেখছি বলে তো মনে পড়ছে না!”
“দেখবি কী করে? দেশে তো এখন ফুড ভ্লগারের সংখ্যা ছাগলের চেয়ে বেশি। তাও ভালো কবির সংখ্যাটা কমেছে ভ্লগার বাড়ায়!”
“সেটা বড় কথা না”, বলে নির্জন; “বড় কথা হলো, কাজটা ভালো করেন নাই আপনি! এইখানে তদবিরের দরকার ছিল না!”
নিম্বাসদা বলেন, “আচ্ছা, রাগ করিস না। তুই গিয়ে মাল খা। আমি দেখি, যদি তোর কিছু করতে পারি! চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? তোকে তো কিছু করতে হচ্ছে না। মনে কর, আমি তোকে ডাকি নাই। ঐ লোকদের সাথে তোর কথাই হয় নাই! তবে আমি তোর ভালোর জন্যেই বলছি। একবার এই লাইনে ঢুকতে পারলে, তোর মতো ছেলে তরতর করে উপরে উঠবে!”
ওয়েটারকে বলে নিম্বাসদা নিজেই ওকে ব্ল্যাক ডগের পেগ বানিয়ে দিয়ে “তুই থাক। আমি ওনার সাথে সাথেই আছি। দরকার হলে ফোন দিস!” বলে গেলেন চলে।
নিম্বাসদা গিয়ে আবার এডিটরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওকে কেমন লোকটার পোষা কুকুরের মতো লাগছে। দুহাত পিছনে, দাঁড়িয়ে আছেন দেহরক্ষীর মতো। এতোটা তেল মারতে কবে থেকে শুরু করেছেন নিম্বাসদা? সামান্য আগেই নির্জনকে বললেন নিজেকে ছোট না ভাবতে। অথচ এখন সমাপদকের সামনে এমন আচরণ করছেন, এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন- এভাবে ও শুধু মোসাহেবদেরই দাঁড়াতে দেখেছে, দেখেছে রাজনৈতিক নেতাদের পাশে চামচাদের দাঁড়াতে।
প্রায় ঘণ্টা খানেক নির্জন এখানে ওখানে বসে, লোকগুলোর মুখ দেখে চরিত্র অনুমান করার চেষ্টা করে, কয়েকটা ওর বয়সী মেয়েকে ভদ্রতার হাসি উপহার দিয়ে, কিছু নাসরিন ভাবির বয়সী মিলফের বুক, পাছা মেপে ও মাঝেমাঝে দুএকবার গ্লাসে চুমুক দিয়ে কাঁটিয়ে দিলো। বেশ বিরক্ত লাগছে ওর। এই জন-অরণ্যে সময় নষ্টের বদলে হলের বারান্দায় বসে মেঘে ঢাকা তারাদের কথা ভাবলেও ওর বেশি ভালো লাগতো!
“হে, তুমি সেই মালটা না?”