05-07-2022, 05:31 PM
৩৭
ক্লিয়োপেট্রা – ২
“হ্যাভ ইয়ু ড্রন দিস?... ওয়াও! বিউটিফুল!... বাট… আই থিঙ্ক, ইফ ইয়ু ইয়ুজ আ লিট্টল বিট ভাইব্রেন্ট কালার্স, দেন দ্য ডিজাইন অফ দিজ ড্রেসেস উইল লুক মোর কালারফুল… মোর প্রমিনেন্ট!... ইজন্ট ইট?” কানের ঠিক পাশে ঝরে পড়া কথাগুলো শুনে চমকে উঠে মুখ তুলে তাকিয়ে ছিলাম… কেন জানি না… কথাগুলো কানে যেতেই কেমন অদ্ভুত ভাবে মনের মধ্যে একটা দোলা দিয়ে গিয়েছিল… অনেক… অনেক দিন আগে কিছু শোনা স্মৃতি যেন আবার নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল চোখের সামনে… কথাগুলো এক না হয়েও যেন অনেকটাই সেই একই রকম… “কিন্তু আমার মনে হয় ছবির প্রেক্ষাপটে যে রঙটার ব্যবহার হয়েছে, সেখানে আর একটু সাদার মিশেল থাকলে সামনের অবজেক্টটা আরো বেশি করে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠত!” বহুদিন আগে একটি সপ্রতিভ ভারতীয় যুবক এক অসামান্য বৃটিশ সুন্দরীর আঁকা একটি পেনটিং দেখিয়ে এমনটাই বলে উঠেছিল এক আর্ট গ্যালির এক্সিবিশনে… প্রথমে সেই সুন্দরী যুবকের কথায় ভ্রূ কুঁচকে উঠেছিল… ভেবেছিল একজন ভারতীয় আর্টএর বোঝেটাই বা কি? কিন্তু পরবর্তী কালে কি মনে হতে যুবকের কথা মত চেষ্টা করেছিল নিজের আঁকা ছবিটার উপরে রঙের প্রলেপ তুলে ধরতে, আর যার ফলে সত্যিই যেন আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছিল তার আঁকা ছবিটা… তারপর তো ইতিহাস… দুটো প্রাণ এক হয়ে যাওয়ার…
তাই সেই কথার অনেকটারই পুনারুবৃত্তিতে আমার সারা গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল… আমি অবাক দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকিয়ে রইলাম বক্তার পানে… ওই গভীর সবুজাভ চোখে চোখ রেখে… মনের মধ্যে তখন এক অবোধ ঝড় বয়ে চলেছে… একি শুনলাম আমি!
“হেই! হ্যালো!... আর ইয়ু ওকে?... আই হ্যাভেন্ট টোল্ড দিজ টু হার্ট ইয়ু… অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি, ইফ আই ডান ইট!” আমার অবাক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গভীর স্বরে ফের বলে ওঠে দিমিত্রিভ… ভাবে হয়তো কথাগুলো বলে আমার মনে আঘাত দিয়ে ফেলেছে সে…
সম্বিত ফেরে আমারও… তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিই ওর চোখের উপর থেকে… অকারণেই কি রাঙা হয়ে উঠেছিল আমার গাল দুখানি? ছি ছি… এই ভাবে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা উচিত হয় নি আমার… কি ভাবলো আমায় কে জানে!... কোথায় কত বছর আগের লন্ডনের আর্ট গ্যালারীতে দেখা হওয়া দুটি মানুষের আর কোথায় জার্মানীর ফ্র্যাঙ্কফার্টের হসপিটালএর রিক্রিয়েশন রুম… আমি মাথা নাড়ি তাড়াতাড়ি… “নো নো… আই হ্যাভেন্ট মাইন্ড এনিথিং… আকচুয়ালি আই হ্যাভ গট লস্ট ইন মাই মেমারী…”
“ওহ!... দ্যটস্ ফাইন…” হাত তুলে কাঁধ ঝাঁকায় দিমিত্রিভ… ঠোঁটের কোনে তখন যেন যিশুর হাসি লেগে রয়েছে বলে মনে হয় আমার…
“আসলে… মানে একটু চেষ্টা করছিলাম, নাটকের ক্যারেক্টারগুলোর ড্রেস কেমন হতে পারে সেটাই একটা স্কেচের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে…” অপ্রতিভবে নিজের কাজের কারন দর্শাবার ইচ্ছায়…
“তুমি আঁকা শিখেছো কোথাও?” সরাসরি প্রশ্ন করে দিমিত্রিভ…
মাথা নাড়ি আমি… “নাহ!... ঐ আর কি… নিজের মনেই ইচ্ছা মত তুলির টান দিই সময় সুযোগ পেলে…” বুঝতে পারি, দিমিত্রিভের মত একজন এত বড় প্রফেশনাল আর্টিস্টের সামনে কি ভিষন বালখিল্লের মত কাজ করে ফেলেছি… হয়তো মনে মনে হাসছে সে আমার এ হেন ছেলেমানুষি দেখে… এখন যেন নিজেরই নিজের উপরে রাগ হচ্ছে বেশ… কি দরকার ছিল? নিজের থেকে এই ভাবে ক্যারেক্টারের পোষাক আঁকার? ওটা তো সত্যিই আমার কাজ নয়… যার কাজ তার সাজে, মাঝখান থেকে দিমিত্রিভের কাছে আমার একটা বাজে ইপ্রেশন হয়ে গেলো… ইশশশশশ… একটা বোকার মত কাজ করে বসলাম…
“সত্যিই তুমি আঁকা শেখোনি?” দিমিত্রিভের গলার স্বরে বিস্ময়… একটু ঝুঁকে টেবিলের উপরে থাকা আমার করা স্কেচগুলো তুলে নেয় হাতে… তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে খুব কাছে নিয়ে পর্যবেক্ষন করতে থাকে সেগুলো… আমার বুকের মধ্যে তখন হাপড়ের টান… কি ফ্যাসাদেই না পড়লাম নিজের থেকে উপযাযক হয়ে এই গুলো আঁকতে গিয়ে… কি প্রয়োজন ছিল এ সবের?... এখন এই মানুষটার চোখে আমার সমস্ত ভুলত্রুটি গুলো এক এক করে উঠে আসবে, আর তখন লজ্জার শেষ থাকবে না একদম… ইসসসস… আমার মনে হচ্ছিল লজ্জায় মিশে যেতে…
হাতের থেকে আঁকা কাগজগুলো ফের টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে চুপ করে খানিক তাকিয়ে থাকে দিমিত্রিভ আমার দিকে… এ আবার কি? আমার দিকে এই ভাবে তাকিয়ে কি দেখে আবার? মনের মধ্যে তখন আমার হাজার প্রশ্ন…
“তোমার তো রক্তে শিল্প!” গভীর স্বরে বলে ওঠে দিমিত্রিভ…
“অ্যাঁ!” আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, এটা প্রশংসা নাকি…
আমার চিন্তার মাঝেই ফের বলে ওঠে দিমিত্রিভ… “তোমার পরিবারের কারুর কি শিল্পের সাথে যোগাযোগ আছে?”
সে তো আছেই… হ্যা… কথাটা তো মিথ্যা নয় একেবারেই… সত্যিই তো আমার রক্তে শিল্প… মা, বাবা দুই তরফ থেকেই… “হ্যা… আমার মা আর বাবা, দুজনেই শিল্পী…” ধীরে মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিই দিমিত্রিভের প্রশ্নের…
আমার জবাবে মৃদু হাসি খেলে যায় দিমিত্রিভের ঠোঁটে… “এবার বুঝেছি… কি করে তুমি এত সুন্দর ইলাস্ট্রেশনগুলো আঁকলে আঁকা না শিখেই… হুম…” সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকায় সে আবার আমার আঁকা পৃষ্ঠার গুলোর দিকে… তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “তুমিই এই গুলো এঁকে শেষ করবে… আমি ভেবেছিলাম আমার কলেজের একজন প্রফেশনাল আর্টিস্টকে বলবো আমায় এ্যাসিস্ট করার জন্য, কিন্তু না… তার কোন দরকার হবে না… আমায় এ্যাসিস্ট করবে তুমি… আমি তোমার আঁকা ইলাস্ট্রেশন ধরেই ড্রেস ডিজাইন করতে বলবো ম্যানেজমেন্টকে…”
আমি সত্যি বলতে এতটা ভাবি নি… দিমিত্রিভের কথায় আপ্লূত… বাচ্ছা মেয়ের মত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই ওর সামনে… চোখে মুখে তখন আমার এক রাশ উত্তেজনা… “সত্যিই বলছো তুমি? সত্যিই আঁকাগুলো এতটাই ভালো হয়েছে?” আমি যেন নিজেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না কথাগুলো কিছুতেই…
মাথা নাড়ে দিমিত্রিভ… ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি… “হ্যা ডক্টর… আমি সত্যিই বলছি… প্রতিটা আঁকাই ভিষন অ্যাকিউরেট হয়েছে…” তারপর একটু থেমে বলে, “কিছু মিসটেক আছে ইলাস্ট্রেশনে ঠিকই… কিন্তু সেগুলো নমিনাল… ওগুলো আমি দেখিয়ে দেবো’খন… সেটায় খুব একটা অসুবিধা হবে না…”
একদম খেয়ালের বশে ওগুলো এঁকেছিলাম… কিন্তু এখন এই ভাবে অ্যাপ্রুভ হয়ে যাবে, ভেবেই একটা ভিষন আনন্দ হচ্ছে আমার… আমি ওর দিকে তাকিয়ে বোকার মতই দুম করে জিজ্ঞাসা করলাম… “কবে দেখাবে?” বলে ফেলেই নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলাম… আমি কি একটু বেশিই উপযাযক হয়ে বলে ফেললাম না? খারাপ ভাবলো না তো আবার আমায়?
ও কিন্তু আমার কথাটাকে এই ভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখলোই না বোধহয়… একটু ভাবলো, তারপর বলল, “আজকে তো হবে না… আমার ক্লাস আছে… আমি কাল দুপুরে আবার আসবো… তখন তোমার সাথে বসবো… তুমি কি ফ্রি থাকবে সেই সময়?”
“থাকবো…” উত্তর দিই আমি সসব্যস্ত হয়ে… কারন দিমিত্রিভের কাছ থেকে এই ভাবে এত সহজে আঁকাটা দেখে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে মন চায় না আমার কোন মতেই…
আমার এই ভাবে উত্তর দেওয়া দেখে ফের মুচকি হাসে দিমিত্রিভ… একটু কি বেশিই আগ্রহী ভাবলো আমায়? মনে মনে ভাবি আমি… পরক্ষনেই সে ভাবনা সরিয়ে দিই ভিতর থেকে… ভাবলে ভাবুক… আমার জেনে নেওয়ার ইচ্ছা, তাতে যদি একটু ভেবেই থাকে, তাতে আমার ভারী বয়ে গেলো…
পরদিন ঠিক দুপুরের দিকে আমি রিক্রিয়েশন রুমে বসে আছি, দেখি দিমিত্রিভ এসে হাজির… সাথে আরো বেশ কয়েকজন… ঘরে ঢুকে আমার দিকে তাকালোই না একবারের জন্যও… যেন ঘরের মধ্যে এই এত বড় একটা মানুষের কোন অস্তিত্বই নেই… সোজা এগিয়ে গেলো ডাইরেক্টরের দিকে… সেখানে চেয়ার টেনে নিয়ে তার সাথে বসে কথা বলতে শুরু করে দিলো… এখানে যে আমি বসে আছি তার যেন কোন গুরুত্বই নেই… অদ্ভুত… ও আসবে বলে সেদিন আমি একটা খুব সুন্দর টপ আর স্ল্যাক্স পরে এসেছিলাম… ভিতরে ততদিনে আমি ব্রা পড়া অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি… এমনিতেও দেখেছি যে এখানে সচারাচর কেউ তেমন ব্রা পড়ে ঘোরে না… আর যারা পড়ে, তাদের বুক খুব বেশী বড় বলেই পড়ে… সেখানে আমার বুক কোন মতেই ঝোলা নয়… সুগঠিত… তাই ভিতরে ব্রা না পড়লেও খারাপ দেখায় না… আর যখন হস্পিটালের ডিউটিতে থাকি, তখন তো আমার পোষাকের উপরে সাদা হাউসকোট চাপানোই থাকে, তাই পেশেন্টদের সামনে যেতে কোন রকম অসুবিধার সন্মুখিন হতে হয় না আমার… সেদিনও তাই ব্রা পড়ার প্রয়োজন বোধ করি নি… আর টপএর কাপড়টা ভিষন নরম হওয়ার দৌলতে একেবারে লেপ্টে বসেছিল আমার বুকের সাথে… আসলে আমি হয়তো মনে মনে চেয়েছিলাম আমার ফিগারটা দেখাতে দিমিত্রিভকে… ভেবেছিলাম পাশে যখন এসে দাঁড়াবে আমার, তখন ওর চোখে নিজেকে বেশ এ্যাট্রাক্টিভ করে তোলা… যতই হোক… আদতে তো আমি মেয়েই… নাকি? আর সেই কারণেই আমি তো ভেবেছিলাম গতকালের ওই ধরণের কথা বার্তার পর আগে এসে আমার কাছেই দাঁড়াবে… কিন্তু তা না… পাত্তাই দিলো না দেখি… মেয়েলি অভিমান-টান আসে না আমার… কিন্তু এই ভাবে অবজ্ঞাও সহ্য হয় না কিছুতেই… তাও বসে থাকলাম খানিক… যদি উঠে আসে আমার কাছে… কিন্তু কোথায় কি? আসা ইস্তক তো ডিরেক্টরের সাথেই বসে আছে… প্রায় আধা ঘন্টা পেরিয়ে গেলো… এক বারের জন্যও মুখ তুলেও তাকালো না এদিক পানে… তাহলে? তবে কি মন বদলালো? কাল যে বললো আমার ইলাস্ট্রেশন গুলোই ব্যবহার করবে নাটকে!... তাহলে কি অন্য কিছু ভেবে এসেছে আজ? তাই যদি হবে, আমি কেন বেকার বেকার নিজের ডিউটি অফ করে বসে রইলাম ওর জন্য? কি দরকার ছিল সেটার? যেমন রোজ নিজের হস্পিটাল রাউন্ড সেরে তবে আসি, তেমনই আসতাম না হয়… ফালতু কিছু সময় নষ্ট করলাম… মনে মনেই গরজরাতে লাগলাম টেবিলে একা বসে বসে… আনমনে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম সামনে টেবিলের উপরে থাকা ইলাস্ট্রেশনগুলো নিয়ে…
নাহ!... আরো প্রায় পনেরো মিনিটের মত সময় পার হয়ে গিয়েছে… আর এই ভাবে তীর্থের কাকের মত বসে থাকতে ভালো লাগে না আমার… যেন আমার দায় সমস্ত কিছুর… আর কারুর কোন দায় নেই এই পুরো নাটকটার ব্যাপারে… না… মানে আর কারুর নেই মানে সেটা বলতে চাইছি না অবস্য… বাকিরা তো যে যার পার্ট নিয়ে রিহের্সালে ব্যস্ত… আমিই হয়েছি এক ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো… না পারছি নিজের কাজে মন দিতে, না গিয়ে নিজের পার্টটা রিহার্সাল করতে… কাল কি একটা স্বপ্নের ফানুস উড়িয়ে দিয়ে গেলো লোকটা, আর সেটা ধরে বেকার বেকার চুপ করে তেনার অপেক্ষায় বসে রয়েছি… কখন উনি এসে আমায় একটু দেখিয়ে দেবেন… আমায় উদ্ধার করবেন… এবার সত্যিই উঠে দাঁড়াই আমি… টেবিলের উপরে ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলোকে এক সাথে জড় করে নিয়ে তুলে নিই হাতে… ঘুরে দাঁড়াই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে… সাথে সাথে মহাপুরুষের মাথা ঘোরে আমার পানে… তাকায় মুখ তুলে… ইসসস… ঠোঁটে দেখো… কি অদ্ভুত নিষ্পাপ হাসি লেগে রয়েছে… হাত তোলে আমার দিকে তাকিয়ে… ডাকছে আমায়? চোখ সরু করে তাকাই আমি… ভেবেছিলাম তাকাবোই না ওই দিকে কিছুতেই… কিন্তু কে জানে কেন!... মুখ ফিরিয়ে নিতে পারলাম না আমি… দূর থেকেই একটা মিষ্টি হাসি হেসে হাত ছানি দিয়ে ডাক দেয় দিমিত্রিভ আমায়… আর আমিও কেমন সুরসুর করে গিয়ে দাঁড়ালাম ওর সামনে…
“হাই…” আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে দিমিত্রিভ… হাসলে ওকে সত্যিই ভিষন মিষ্টি দেখায়… ওর হাসিগুলো যেন শুধু ঠোঁটে নয়, চোখেও খেলে বেড়ায় কেমন অদ্ভুত ভাবে… চোখের দুপাশের চামড়াগুলো কুঁচকে যায় হাসির টানে…
‘হাই…” প্রত্তুতোরে মৃদু হাসি আমিও… এটা একান্ত জোর করে হাসি টেনে আনা, কিন্তু উপর থেকে সেটা যতটা পারি না বোঝাবার… মাথাটা তো এখনও জ্বলছে আমার… কিন্তু এ ছেলেকে সে সব বুঝিয়ে কি লাভ? এ সব বোঝার মত ক্ষমতা আছে নাকি ওর? তা না হলে আমায় এতক্ষন ওই দূরে টেবিলে অপেক্ষা করিয়ে রাখতো? সব চেনা হয়ে গেছে… সব ক’টা পুরুষই সমান… নেহাত ডিরেক্টর রয়েছে উপস্থিত… নয়তো কোন শালা এখানে এই ভাবে দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো!... বয়ে গেছে আমার থাকতে…
“হ্যাভ আ সিট ডক্টর…” পাশের চেয়ারটার দিকে ইশারা করে বলে ওঠে দিমিত্রিভ… “উই হ্যাভ সামথিং টু সে ইয়ু…”
আমি আবার একটা হাসি টেনে এনে ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলে উঠি… “ইটস্ ওকে… টেল মী… অ্যাকচুয়ালি আই হ্যাভ টু মুভ নাও… আই হ্যাভ মাই রাউন্ড টু ডু…”
আমার রাউন্ড আছে শুনে যেন এবার একটু ব্যস্ত হয়ে ওঠে দিমিত্রিভ… তাড়াতাড়ি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ও… না চাইলেও ওকে সামনে থেকে দেখে বেশ ভালো লাগে আমার… আজকে একটা সাদা ফানেলের শার্ট আর ব্লু জিন্স পড়ে এসেছে… লম্বা চেহারায় বেশ মানিয়েছে… গালে হাল্কা দাড়ি… বড় বড় চুলগুলো মাথার উপরে এলোমেলো হয়ে এলিয়ে রয়েছে… দেখে ফের আমার মনের মধ্যে যিশুর ছবিটা যেন ভেসে উঠল একবার…
“উই ওন্ট টেক মাচ টাইম অফ ইয়োর্স…” তারপর হাত তুলে একবার ডাইরেক্টরকে দেখিয়ে বললো… “উই হ্যাভ বিন ডিসকাসিং… ফ্রম নাও অনওয়ার্ডস… ইয়ু উইল অ্যাসিস্ট মী রিগার্ডিং অল ক্রিয়েটিভিটিস দ্যট রিকয়ার্ড ফর দ্য প্লে…” একটু থেমে ফের বলে উঠল সে… “ইয়ু আর আ বর্ন আর্টিস্ট… আর্ট ইজ ইন ইয়োর ব্লাড… আই ওয়ান্ট দ্যট টু মেক ইট কাম আউট ইন দ্য সার্ভিসেস…”
“ইজ ইট সো?” আমি যেন আমার কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না… নাটকের সমস্ত ক্রিয়েটিভিটিতে আমি থাকবো? আমার আঁকা এতটাই ভালো লেগেছে দিমিত্রিভের?
“ইয়েস ডক্টর… ইয়ু আর আ জেনিউনলী ট্যালেন্টেড ওয়োম্যান… আই আপ্রিশিয়েট ইয়োর ট্যানেল্ট…” মৃদু হেসে বলে ওঠে দিমিত্রিভ… ওর চোখের ভাষা দেখে বুঝতে ভুল হয় না আমার যে এই কথাগুলোর মধ্যে কোন চাটুকারিতা বা আমায় শুধু মাত্র ইম্প্রেশ করার জন্য বলছেনা সে… সততই আমার আঁকা ওর পছন্দ হয়েছে, তাই এই ভাবে আমার নাম রেকমেন্ড করেছে ডিরেক্টরের কাছে… আমার মনের ভিতরে খানিক আগের সমস্ত অভিমান যেন নিমেশে গলে জল হয়ে গেলো… আমি একটা বাচ্ছা মেয়ের মত আনন্দ জড়িয়ে ধরলাম দিমিত্রিভকে… “থ্যাঙ্ক ইয়ু… থ্যাঙ্ক ইয়ু সো মাচ ফর গিভিং মী আ চান্স… আই’ল ট্রাই মাই বেস্ট টু গীভ…”
এরপর যেন ঝড়ের মত দিন কাটতে লাগলো… সকাল থেকে আমার হস্পিটাল ডিউটি… রাউন্ড দেওয়া ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে… শিডিউল ধরে সার্জারী… আর তারপর বিকেলের পর থেকে নিজের চরিত্রের রিহার্সাল আর সেই সাথে দিমিত্রিভের সাথে বসে একের পর এক সেটএর ডিজাইন, প্রতিটা ক্যারেক্টারের আলাদা আলাদা ডিজাইন করা শুরু করে দিলাম… দিমিত্রিভ বেশির ভাগটাই আমায় দিয়েই করাতো… ও শুধু উপর থেকে ইন্সপেক্ট করে যেত… যেখানটায় যেটা বেমানান মনে হতো বা আমার কল্পনার সাথে কোথাও মিলতো না, তখন আমার সাথে বসে দেখিয়ে দিত, আলোচনা করে একটা কিছুতে ফাইনালাইজ করতো…
এর ফলে প্রায় প্রতিটা দিনই আমার ফিরতে ফিরতে অনেকটাই রাত হয়ে যেত… প্রথম দিকে আমার জন্য ডিউটের পরে জোর্ডি অপেক্ষা করত… কিন্তু আমি ওকে অনেক বুঝিয়ে সেটা বন্ধ করিয়েছি… ওকে প্রায় জোর করেই বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম… যাতে ও বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিতে পারে… কারন হস্পিটালে ওরও তো যথেষ্টই চাপ থাকে… প্রথম দিকটা গাঁইগুই করলেও, শেষে আর না করতো না… যাবার আগে আমার সাথে একবার দেখা করেই চলে যেতো বাড়ি… কত দিন হয়েছে, বাড়ি ফিরে দেখেছি জোর্ডি আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে সোফাতেই… খারাপ লাগতো ওকে ডেকে তুলতে…
দেখতে দেখতে সেই দিনটাও এসে গেলো… আগের দিন আমার স্টেজ রিহার্সাল হলো… সেখানে হস্পিটাল থেকে ম্যানেজমেন্ট এসে দেখে গেলো… কারন ফাইনালের দিন অনেক ডেলিগেটস্রাও আসবে নাটক দেখতে… সকাল থেকেই রীতি মত উত্তেজিত ছিলাম… যতই হোক… লীড রোল আমার… আগে কখনও কোন দিন স্টেজ পার্ফরম করি নি… তাই একাধারে যেমন উত্তেজনা… তেমনি প্রচন্ড ভয়… যদি শেষ মুহুর্তে গুলিয়ে ফেলি? ভুল সংলাপ বলে দিই? আমায় জোর্ডি আর দিম্মি… ও হ্যা… দিমিত্রিভের সাথে কাজ করতে করতে ওকে আজকাল দিম্মি বলেই ডাকি… ছোট করে… তা ওরা দুজনেই আমায় অভয় দিয়ে গিয়েছে বার বার… বলেছে আমি ঠিক পারবো… কোন ভূল হবে না কোথাও…
নাহ!... হয়ও নি কোন ভূল… একেবারে পার্ফেক্ট পার্ফমেন্স… প্রথমে যখন স্টেজে এন্ট্রি নিয়েছিলাম তখন বুকের মধ্যেটায় যেন ঝড় বইছিল… দিম্মি নিজের হাতে আমার বডি পেংটিং করে দিয়েছিল… এই ক’দিন ওর সাথে থাকতে থাকতে আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা ভিষন সহজ হয়ে উঠেছিল… কাজের ফাঁকে আমরা একে অপরের সাথে খুনসুটি করতাম… দুপুরে লাঞ্চটাও সারতাম এক সাথেই প্রায় দিনই… সাথে কখনও জোর্ডি এসে যোগ দিতো, কখনও অন্য কেউ… তাই নাটকের দিন যখন ব্যাক স্টেজের গ্রীনরুমে আমায় কাপড় খুলে দাঁড়াতে বলল, খুব একটা অস্বস্থি হয় নি আমার সেদিন… একটা সেদিন ব্রা আর প্যান্টি পড়ে ওর সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম… আর ও রঙ দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছিল আমার সারা দেহ… দেহের অনেক জায়গায় তুলে ধরেছিল তুলির টানে প্রচুর উল্কি… শেষ হলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম আর্শির সামনে… এ যেন আমি না… সত্যিই ইতিহাসের পাতা থেকে ক্লিয়পেট্রা এসে দাঁড়িয়েছে আর্শির সামনে… আমি নিজেই নিজেতে মহিত হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন… আমার পেছনে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসছিল দিম্মি… হয়তো নিজের সৃষ্টির সন্তুষ্টিতে…
সত্যি বলতে প্রথম যখন ওর সামনে নিরালা নির্জন গ্রীণরুমে গায়ের সমস্ত জামা কাপড় খুলে একেবারে নগ্ন হয়ে দাঁড়ালাম… তখন মনের মধ্যে একবার একটা কথা মনে এসেছিল… আমায় এই ভাবে দেখে দেখি কোন রকম সুযোগ নেয় কিনা দিম্মি!... দেহে রঙের প্রলেপ দেবার নাম করে আমার গোপনাঙ্গে কি ভাবে ছোঁয়া দিয়ে যায় ও… একটা মেয়েলি কৌতুহল যে মনের ভিতর ছিল না সেটা অস্বীকার করবো না… কারুর সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়ানো আমার কাছে কোন বড় কথা নয় কিন্তু দিম্মি কি ভাবে আমার নগ্নতাটা গ্রহন করে সেটাই দেখার ইচ্ছা ছিল মনে মনে…
নাহ!... আমি সত্যিই আপ্লূত দিম্মির প্রফেশনালিজম্ দেখে… আমার সারা শরীরে নানা উল্কির টান দিয়ে গেলো তুলি দিয়ে কিন্তু এতটুকু সুযোগ সে নেয়নি কোন সময়েই… চাইলেই পারতো সেটা… আমারও বলার কিছু ছিল না কারন আঁকার সময় ছোঁয়া লাগার কোন ঠিক ঠিকানা থাকে না… কিন্তু অদ্ভুত নির্লিপ্ততায় নিজের কাজ শেষ করে ফেললো সে… আমার মনের মধ্যে এতটুকু কোন অস্বস্থি সৃষ্টির সুযোগ না দিয়ে…
স্টেজের সেন্টার সার্কেলে গিয়ে দাঁড়াতেই আমি আমার মধ্যে যেন অদ্ভুত ভাবে আর থাকলাম না… আমি সম্পূর্ণ ভাবে তখন ক্লিয়পেট্রা হয়ে গিয়েছি… স্টেজের ওপারে যে ওই বিশাল অডিয়েন্স আমারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে… তাও যেন সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম…
সম্বিত ফিরলো একেবারে নাটকের শেষে… ওই বিশাল অডিটরিয়ামে যখন প্রতিটা শ্রোতা উঠে দাঁড়িয়ে এক সাথে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিল… সত্যিই বলছি… আমি ওই মুহুর্তটা কিছুতেই যেন ভুলে যেতে চাইছিলাম না… আমি আপ্লূত… বিমুগ্ধ… নিজেই নিজেতে… আমি সত্যিই পারলাম? এটা আমায় দিয়ে হলো?... কি করে জানি না সেদিন আমার চোখেও কোথা থেকে জল এসে গিয়েছিল…
.
.
.
মনটা ভারী হয়ে উঠেছে পর্ণারও… চন্দ্রকান্তার খুশিতে… এই ভাবে খুশিতেও কি মন ভারী হয়ে ওঠে? আসলে চন্দ্রকান্তার ডায়রি পড়তে পড়তে কি ভাবে যেন নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছে সে… চন্দ্রকান্তার সাথে… চন্দ্রকান্তার দুঃখে তার চোখ ভিজে ওঠে আবার খুশিতে বুকের ভিতরটা উছলে ওঠে এক অনাবিল আনন্দে… এটাই বোধহয় মানুষের ধর্ম… অপরের মানসিকতার সাথে নিজেকে মিলিয়ে ফেলা… ডায়রিটা বন্ধ করে চুপ করে খানিক বসে থাকে সে… তারপর উঠে দাঁড়ায় বিছানা ছেড়ে… নাহ!... তাকে চুপ করে বসে থাকলে হবে না… নিজের প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞে কাজ করে যেতে হবে… চন্দ্রকান্তা চন্দ্রকান্তার জায়গায়, আর সে তার…
ক্রমশ…