03-07-2022, 09:44 PM
(This post was last modified: 04-07-2022, 12:18 AM by nextpage. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
প্রত্যাবর্তন
বাবান দার উপহার
যখন থেকে ছুটকি জেনেছে তনুও ওদের সাথেই যাবে ওর উৎসাহ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। সেদিন শপিংমলে তেমন কোন পরিচয় হয়নি আর কথাবার্তাও বেশি একটা সামনে আগায় নি৷ আজ পার্টিতে দুজনেই এক রঙের এক রকম জামা পড়ে যাচ্ছে সেটা যেমন রোমাঞ্চের সেই সাথে নতুন বান্ধবী হবে সেটাও বা কম কিসের। রুদ্র সেই কখন থেকে রেডি ছেলেদের আর রেডি হবার কি আছে ঐ তো জিন্সের প্যান্ট আর সাথে সাদা কালারের একটা শার্ট ঐটুকুতে আর কত সময়ই বা লাগে। কিন্তু অন্যদিকে ম্যাডাম ছুটকির তো সাজসজ্জা শেষ হবার নামই নেই। দুই-তিন বার ওর ঘরের সামনে থেকে ঘোরে গেছে প্রতিবারই একই দৃশ্য আয়নার সামনে বসে কত কি যে মেখে যাচ্ছে মুখে। রুদ্র বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেইসবুকে ঘাটাঘাটি করতে থাকে। কতটা সময় পরে ছুটকি এসে হাজির হয় ওর ঘরে
-দেখ তো দাদা আমাকে কেমন লাগছে?
শুয়া অবস্থাতেই আড় চোখে বোনের দিকে তাকায় সে, লাল কালারের পার্টি ফ্রকটা তে দারুন মানিয়েছে ছুটকি কে। দাদার মতই লম্বা হচ্ছে দিন দিন সে কারণেই আরও বেশি ভালো লাগছে হয়তো। মাথায় তাজ এর মত করে কিছু একটা পড়েছে সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে কোন পরী এসে দাড়িয়েছে সামনে।
-(মুখ ভেঙচিয়ে) কিরে তুই এত সাজগোজ করলি কেন? মানুষ দেখে তো চিন্তায় পড়ে যাবে যে জন্মদিনের পার্টি টা কার? আরেকটু কম সাজলেও পারতি।
-(জিভ বের করে ভেংচি কাটে) তোকে বলেছে বুঝি সবাই এসে এসে। তুই শুধু বল কেমন লাগছে আমাকে?
-নাহ বেশি ভালো না। ঐ তো শাঁকচুন্নির আপডেট ভার্সন আর কি। তোকে দেখলে ঐ সিরিয়ালের ডিরেক্টর রা আরেকটা ভূতের নাটক বানিয়ে ফেলবে।
-(কাঁদো স্বরে) মা দেখো দাদা বলছে আমাকে নাকি ভালো লাগছে না। আমি কিন্তু তাহলে যাবই না।
-না গেলে আমি বেঁচে যাই।
-কিরে বাবু তুই এখন আবার ওর পেছনে লাগচ্ছিস কেন?? দেরি না করে ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়। আবার না কোথা থেকে আরেকজন কে নিবি বললি (বসার ঘর থেকেই অঞ্জলি দেবী উঁচু গলায় বলতে থাকে)
মায়ের গলা শুনেই রুদ্র তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে শার্ট টা আরেকটু ঠিকঠাক করে ছুটকি কে নিয়ে বের হবার আগে বাবার সাথে দেখা করে আসে।
-বাবা আমি ছুটকি কে নিয়ে যাচ্ছি।
-সাবধানে গাড়ি চালাবে আর শোন বোন কিন্তু বড় হচ্ছে, সবদিক খেয়াল রেখে। আর তুমিও লিমিটে সব কিছু থাকে যেন। আর ছুটকি দাদার সাথে সাথে থাকবি, বেশি রাত করিস না।
-আচ্ছা ঠিক আছে তুমি টেনশন করো না।(রুদ্র কথাটা বলে
ঘর থেকে হতে থাকে)
-হাতখরচের টাকা তোর মায়ের কাছে দিয়ে রেখেছি নিয়ে যাস(পেছন থেকে অবিনাশ বাবু রুদ্রের উদ্দেশ্যে কথা গুলো বলে যায়)
রুদ্রের মুখে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠে। ও নিজেই ইনকাম করে নিজের খরচ বোনের খরচ সামলে বাকিটা মায়ের কাছে দিয়ে দেয় তারপরও ওর বাবা নিয়মিতই ওর আর ছুটকির হাত খরচের টাকা অঞ্জলি দেবীর কাছে দিয়ে দেয়। ওরা ঐ টাকা টা খরচ করে যেন অন্যরকম একটা আনন্দ উপভোগ করে। বাসা থেকে বের হবার আগে তনু কে মোবাইল করে জানিয়ে দেয় ওদের রওনা হবার কথা। সন্ধ্যার দিকে রাস্তা আজ অন্যদিনের চেয়ে ফাঁকা আছে। সেন বাড়ি মোড়ে যেতে মিনিট পনেরো লাগলো ওদের। বিল্ডিং এর নিচে গিয়ে ফোন করে রুদ্র। মিনিট সাতেক এর মাঝেই তনু নেমে আসে। ওকেও দারুন মানিয়েছে জামাটা। ফর্সা গায়ের রঙের সাথে যেকোন রঙই মানানসই তবে লাল রঙটা একটু বেশিই ফুটে উঠে।
-দাদাভাই এই জামাটাতে কেমন লাগছে আমাকে?
-সুপারব! দেখতে হবে না চয়েস টা কার।
-(ছুটকি পিছন থেকে পিঠে চিমটি কাটে) আর আমাকে কি বলেছিলি মনে আছে তো।
-উফফ, দজ্জাল মেয়ে! ওটা তো দুষ্টুমি করে বলেছিলাম। দুজনকেই বেশ লাগছে। এখন চল দেরি হয়ে যাচ্ছে৷ কিরে তনু বাসায় বলা হয়েছে তো।
-হুম, দিদি মা বাবা কে ম্যানেজ করে নিয়েছে। ঐতো দেখো ব্যালকনিতে মা দাঁড়িয়ে আছে।
-(নিচ থেকে অন্ধকারে মুখ স্পট বুঝা যায় না, তবে কেউ একজন দাঁড়ানো সেটা দেখা যাচ্ছে) তোর দিদি তো তাহলে বেশ আদর করে তোকে।
-করে তবে শাসন করে বেশি, তুমি দেখলে বলবে ও কোন কলেজের ম্যাডাম হলে ভালো হতো।(খিলখিল করে হাসতে থাকে)
রুদ্রের বাইকে তিন জনে যাওয়া টা একটু মুশকিল তবে সেটা তেমন একটা সমস্যা হলো না। তনু উঠে বসতেই সারিন্দা ক্যাফের দিকে রওনা হয় ওরা।
★★★★
বাবু আর ছুটকি একটু আগেই বেরিয়ে গেছে, অঞ্জলি দেবী মাত্রই সন্ধ্যা পূজো শেষে ঠাকুর শয়ন দিয়ে বের হয়েছে। শাড়িটা পাল্টে আবার আগের টা পড়ে নিয়ে অবিনাশ বাবু কে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এখনি চা দিবে কিনা। রান্না ঘরে চায়ের জল গরম করতে দিয়েছে তখনি কলিং বেলটা বেজে উঠলো, গ্যাসের সুইচটা কমিয়ে দিয়ে দরজা খুলতে যায়। দরজা খুলেই দেখে রাই দাড়িয়ে আছে,
-কিরে তুই? আগে তো ফোন ও করলি না?
-কেন আন্টি ফোন না করে আসছি বলে কি বাসায় ঢুকতে দিবে না?
-ওমা এটা আবার কেমন কথা। আয় ভেতরে আয়।
-(বাসার ভেতরে আসে অঞ্জলি দেবীর পেছন পেছন) কিগো আন্টি বাসাটা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে।
-লাগবেই তো দুটো বাসায় নেই যে, আমরা বুড়ো বুড়ি আছি কেবল। ওরা একটা অনুষ্ঠানে গেছে।
-(অঞ্জলি দেবীকে জড়িয়ে ধরে) তুমি মোটেও বুড়ি হওনি, একটু সাজগুজ করলে আমার থেকে তোমাকে বেশি ইয়াং লাগবে।
-(রাইয়ের গাল টেনে দিয়ে) বুঝেছি বুঝেছি! তা তুই আজ শাড়ি পড়লি যে, কোন বিশেষ দিন নাকি।
-(নাকি স্বরে) না আন্টি, তোমাদের এখানে আসবো বলেই পড়লাম। কেমন লাগছে বললে না তো?
-অনেক সুন্দর লাগছে। জাম কালার টা তোর সাথে দারুন মানিয়েছে।
-থ্যাংক ইউ আন্টি, আঙ্কেল কই দেখছি না তো?
-ঐতো রিডিং রুমে, তোর আঙ্কেলের জন্য চা বসিয়েছিলাম তখনি তুই আসলি। যা দেখা করে আয়।
-এখন না, আজ আমিই আঙ্কেলের জন্য চা নিয়ে যাবো। আর হ্যাঁ রাতে কিন্তু তোমার হাতে রান্না খাবো।
-ঠিক আছে চল ঐদিকে রান্নাঘরে।
কিছুক্ষণ পরে চা হয়ে গেছে, দুজনে এর মাঝে আর টুকটাক কথা হয়ে চলেছে। ছোট্ট ট্রে তে চা আর কয়েকটা বিস্কুট সাজিয়ে দিয়ে রাইয়ের দিকে এগিয়ে দেয়। রাই দু হাতে ট্রে ধরে এগোতে যাবে কিন্তু আঁচল টা একটু বড় হয়ে যাওয়াতে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। সেটা বুঝতে পেরে অঞ্জলি দেবী আঁচল টা সামনের দিকে এনে কোমরে গুঁজে দেয়।
-নে এখন ঠিক আছে, তোকে পুরো গিন্নি গিন্নি লাগছে। এবার মেয়েকে বিয়ে দেয়াই যায়।
-(অঞ্জলি দেবীর কথায় রাই একটু লজ্জা পেয়ে যায়, চেহারায় সেটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে) তুমিও না আন্টি কি সব বলো। চলো আমার সাথে চা তো ঠান্ডা হয়ে যাবে এর পরে।
অঞ্জলি দেবী আগে আগে চলতে থাকে, পেছনে চায়ের ট্রে হাতে গুটি গুটি পায়ে রাই এগিয়ে যেতে থাকে। রিডিং রুমের কাছে এসে হালকা করে দরজাটা ঠেলে সরিয়ে রাইকে আগে যেতে ইশারা দেয়। রাই সন্তপর্ণে এগিয়ে যায় অবিনাশ বাবুর দিকে, তিনি তখন কোন একটা বইয়ের পাতায় মগ্ন হয়ে আছে।
-আঙ্কেল তোমার চা (চা এর প্লেট টা অবিনাশ বাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে আস্তে করে কথাটা বলে)
-হুম সামনে রেখে দাও( কথাটা বলা শেষ করার আগেই অচেনা কণ্ঠস্বরটা কানে বাজতেই উপরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে) তুমি কে? বাবুর মা কই?(পাশে তাকাতেই দেখে অঞ্জলি দেবী মিটি মিটি হাসছে)
-দেখো তো চিন্তে পারো কিনা?
-(অবিনাশ বাবু দ্বন্দে পড়ে যায়, একবার মেয়েটির দিকে তাকায় আরেকবার অঞ্জলি দেবীর দিকে তাকায়। খুব অসহায় ভাবে ভ্রু কুঁচকে মেয়েটিকে আরেকবার ভালো করে দেখে নেয়) না তো চিনতে পারছি না। আগে কোথাও কি দেখেছি আমার তো মনে পড়ছে না।
-(রাই একটু এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে অবিনাশ বাবুকে প্রনাম করে) আঙ্কেল আমি রাই, বাবুর সাথে কলেজে পড়তাম মনে আছে? আমার বাবা বিজয় চৌধুরী।
-(এবার অবিনাশ বাবুর মনে পড়ে, রাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়) সেই কবে দেখেছিলাম তখন তো ছোট ছিলে, তাই তোমাকে চিনতে পারি নি মা। কিছু মনে করো না। তোমার বাবা মা কেমন আছেন? তোমরা এখন কোথায় থাকো?
-বাবা মা ভালোই আছে, আমরা সেন বাড়ী মোড়ের আলিশা টাওয়ারে থাকি।
-ভালো ভালো, তা কি করছো এখন? জব?
-হুম আঙ্কেল একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে ম্যানেজার পদে আছি।
-অনেক ভালো লাগলো শুনে, ঐ দেখ আজ তুমি আসলে ওদিকে বাবু ছুটকি কেউ বাড়িতে নেই। ওরা থাকলে তো তোমার সাথে কথা বলতে পারতো, কতদিন পর তোমার সাথে দেখা হতো৷
-হুম আঙ্কেল আন্টির কাছে শুনেছি। সমস্যা নেই আজ না হয় তোমাদের সাথেই আড্ডা দেব৷ আচ্ছা আঙ্কেল তুমি চা খাও আমরা ও ঘরে গিয়ে বসি। পরে আবার কথা বলবো তোমার সাথে।
-আচ্ছা মা। আর রাতে কিন্তু এখানে খেয়ে যাবে।
-ওটা তুমি না বললেও আজ ও এখানে খেয়েই যেত( কথাটা বলতে বলতে অঞ্জলি দেবী মুচকি হেসে উঠে)
অবিনাশ বাবু কিছুই বুঝতে পারে না, শুধু ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বইয়ে পাতায় মুখ গুজে দেয়। রাই আর অঞ্জলি দেবী দুজনেই বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। বসার ঘরে সোফায় পাশাপাশি বসে চায়ের কাপে চুমুকের সাথে সাথে কথার ফুলঝুরি ফোটতে থাকে। নতুন পুরনো কতশত জমা গল্প একে অন্যের সাথে ভাগাভাগি করতে থাকে। রাই তার কথা তার বোন মা বাবার বিভিন্ন সময়ের নানা অনুভবের, হাসি-খুশির, কষ্টের কথা অঞ্জলি দেবীর সামনে খোলা বইয়েে মত মেলে দিতে থাকে। কখনো হাসির রুল উঠে কখনো আবার দু'জনেরই চোখের পাতা ভিজে ভারি হতে থাকে। অঞ্জলি দেবী রাই এর চলে আসার পর থেকে এখনকার সময়ের অনেক কথাই রাই কে বলতে থাকে। দুজনের কথার ফাকেই হালকা নাস্তাও হয়ে গেছে এর মাঝেই। হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর দিতেই টনক নড়ে, সময় অনেকটাি গড়িয়েছে এখন রান্না না বসালে মাঝরাতে খেতে বসতে হবে।
রাই ও জেদ ধরে সেও অঞ্জলি দেবীর সাথে আজ রান্না করবে। করবে আর কি সে তো তেমন রান্না জানে না তবে ঐ সাথে থেকে খুন্তি নাড়ানো অব্দি। অঞ্জলি দেবী বার বার বারণ করছিলো এই গরমে রান্নাঘরে যাবার কোন দরকার নেই, কিন্তু রাই নাছোড়বান্দা সেই সাথে যুক্তি একা একা সে কি করবে এখানে বসে বসে শেষপর্যন্ত রাই রান্নাঘরের দখলে এগিয়ে গেল। আজ রাই এর পছন্দের দুটো পদ রান্না করবে অঞ্জলি দেবী, এতদিন সে নিজের মায়ের হাতে এই রান্না গুলো খেয়েছিল আজ রুদ্রের মায়ের হাতে রান্না খাবে। উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনার কোন কমতি নেই আজ রাইয়ের মাঝে। এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে অঞ্জলি দেবী কে মাঝে মাঝে আন্টি নির্দেশ মতে কোন মশলা কতটুকু দিতে হবে ততটুকুই দিচ্ছে সে। দুধে আলতা গায়ের রঙের রাই গনগনে আগুনের তাপে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে ইতিমধ্যেই, কপালের পাশ বেয়ে ঘামের ধারা ছুটছে। শাড়ির আঁচলে মাঝেমধ্যে মুখটা মুছে নিচ্ছে, আর ভাবতে থাকে একদিনের একটু মূহুর্তেই এমন অবস্থা ওর আর মায়েরা বছরের প্রতিটা দিন প্রতি বেলায় কেমন করে এসব সহ্য করেই সবার জন্য খাবার তৈরি করে চলে, এমন আত্মত্যাগ আর কে কোথায় কবে করেছে সেটা ওর জানা নেই। রান্না প্রায় শেষের দিকে, এবার অঞ্জলি দেবী অনেক ধমকে রাই কে বসার ঘরে পাঠিয়ে দেয় ফ্যানের বাতাসে একটু গা জুড়িয়ে নিতে৷ ও বসার ঘর হয়ে রুদ্রের ঘরে চলে যায়, ফ্যান টা ফুল স্পিডে অন করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ঠান্ডা বাতাসে শরীরের জমে থাকা ঘাম যখন শরীরেরই শুকাতে শুরু করে তখন গা জাড়িয়ে উঠে কাটা দেয় একটু শীত অনুভূত হয়। ক্লান্তির আবেশে চোখ বুজে আসে, পাশ ফিরে একটা বালিশ টেনে মাথার নিচে দিয়ে দেয়। ঠান্ডা বাতাসের শীতলতার প্রভাবে চোখ বুজে আসে...
অফিস শেষে রুদ্র নিচে বাইকে অপেক্ষা করছে কারও জন্য, বারবার মোবাইল বের করে কি যেন দেখছে আবার মোবাইল টা পকেটে পুড়ে রাখছে। কিছুটা সময় পরে তনয়া আসে বাইকের কাছে, ও উঠে বসতেই রুদ্র বাইক স্টার্ট দেয়। পার্কিং সাইডের অন্য পাশেই আরেকটা গাড়িতে বসা ম্যানেজার ম্যাডাম রিদ্ধিমা চৌধুরীর চোখে সবটাই পড়েছে, ম্যাডামের গাড়িটাও বাইকটার পেছন পেছন চলতে শুরু করে। অনেকটা দূর ফলো করার পর হঠাৎ সিগনালে গাড়ি আটকে যায়, সামনে এদিক ওদিক তাকিয়েও রুদ্রের বাইকের দেখা পাওয়া যায় না। ইশ, একটু জন্য আজকেও ফসকে গেল। দু মিনিট পর সিগনাল উঠে যায়, কি করবে ভেবে না পেয়ে সামনের দিকেই চলতে শুরু করে। এই রোডে গাড়ির চাপ টা বেশি দেখে অন্য একটা রোডে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়। হঠাৎ নজরে আসে রুদ্রের বাইকটা একটা সাইডে দাড় করানো আর বাইকে তনয়া বসে, কিন্তু রুদ্র কে দেখা যাচ্ছে না। গাড়িটা কিছুটা ব্যাক করে এক সাইডে দাড় করিয়ে নজর রাখে আশে পাশে। ঐতো একটা মেডিসিন শপ থেকে বের হতে দেখা যাচ্ছে রুদ্রকে, হাতে একটা শপিং ব্যাগও আছে ওটা আগে তো ছিল না ওর সাথে অফিস থেকে বের হবার সময়। রুদ্র বাইকের কাছে এসে আবার বাইক স্টার্ট করে চলতে শুরু করে। ম্যানেজার ম্যাডামের গাড়িটাও ফলো করছে পেছন পেছন। একটা বিল্ডিং এর সামনে এসে রুদ্রের বাইকটা থামে, তনয়া এই বিল্ডিং টা চেনে আগেও একদিন এসেছে ও জানে এটাই রুদ্রের ঠিকানা। বাইকটা পার্কিং এ রেখে রুদ্র তনয়া কে নিয়ে বিল্ডিং এর ভেতরে চলে যায়। রুদ্রের অফিসের ম্যানেজার রিদ্ধিমা চৌধুরীর গাড়িটা রাস্তার উল্টো পাশেই দাড়িয়ে।
মিনিট পনেরো র মত অপেক্ষা করে রিদ্ধিমা চৌধুরী চিন্তা করে ফিরে যাবার আবার আরেকবার চিন্তা করে আর মিনিট দশেক অপেক্ষা করবে। একবার গাড়ি থেকে নেমে পাশের দোকান থেকে কয়েকটা লজেন্স কিনে আবার গাড়িতে উঠে বসতেই খেয়াল করে ওরা বিল্ডিং এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। রুদ্র বাইকে করে তনয়াকে ওদের বাড়িতে পৌঁছে দিতে রওনা হয়, আগের মতই আরেকটা গাড়ি পেছন পেছন আসছে। তনয়াকে ওদের বাসার কাছে নামিয়ে দিয়ে রুদ্র চলে যায়৷ রিদ্ধিমা চৌধুরী প্রথমে ভেবেছিল আগের বিল্ডিং টাই হয়তো তনয়াদের ঠিকানা তাই নিচে রুদ্রের জন্য অপেক্ষা করছিলো কিন্তু যখন ওরা দুজনেই বের হয়ে আসলো তখন মনে প্রশ্ন জাগলো। এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে ওটা তনয়াদের বাসা ছিল না এখনকার টা তনয়াদের বাসা। মনে অনেক সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করেছে, আগে মনে হতো সব হয়তো ভুল চিন্তা ভাবনা কিন্তু আজকের পর সেটা তো সত্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে সে যেটা ভেবেছিল সেটাই সত্যি হতে চলেছে। নিজের উপরই রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা জন্ম নিচ্ছে। না এটার শেষ টা জানতে হবে।
পরদিন অফিস শেষে রিদ্ধিমা গাড়িতে অপেক্ষা করছিলো, তনয়া কে আসতে দেখে গাড়িতে ডেকে নেয়। রিদ্ধিমা আজ তনয়াকে পৌঁছে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে, ম্যাডামের মুখের উপর কিছু বলার সাহস হয় না আবার মন থেকে একটু খুশিই হয় ওকে পৌঁছে দিচ্ছে দেখে। কথা বার্তা চলতে চলতে রিদ্ধিমা আগের দিনের বিল্ডিং এর রোড ধরতেই
-ম্যাডাম এদিকে তো আমার বাসা না।
-এদিকে না? আমি তো আরও ভাবলাম সামনে বিল্ডিং এ তোমার বাসা। ঐদিন একটু কাজে এদিকে এসেছিলাম তখন যে দেখলাম তোমাকে ঐ বিল্ডিং এ যেতে। তাই ভাবলাম
-(ম্যাডাম ওদের একসাথে দেখে নিয়েছে শুনে একটু বিব্রতবোধ করে) ন..না..আআ মানে ম্যাডাম ওটা তো রুদ্র স্যারের বাসা। ওদিন একটু প্রবলেম হয়েছিল তাই ওনার বাসায় যেতে হয়েছিল।
-ওহহ, তা কোন গুরুতর সমস্যা নাকি? এখন সব ঠিক আছে? কোন হেল্প লাগলে বলতে পারো, আমি যদি কিছু করতে পারি।
-না ম্যাডাম তেমন কিছু না, এখন সব ঠিক আছে। আসলে ম্যাডাম ঐদিন বাসায় যাবার পথে হঠাৎ করেই পিরিয়ড হবার ব্যাথা হতে থাকে। আমার ব্যাগে প্যাড ও ছিল না। তখন রুদ্র স্যারকে জানাতেই স্যার প্যাড কিনে নিয়ে আসে আর স্যারের বাসায় নিয়ে যায় ফ্রেশ হবার জন্য।
-ওহহ, এই ঘটনা। তবে তো তোমাদের স্যার বেশ কেয়ার করে সবার।
-(একটু লাজুক স্বরে) ইয়েস ম্যাডাম স্যার ভীষন কেয়ার ফুল।
-তা তোমাদের বাসার রাস্তাটা কোন দিকে দেখিয়ে দাও। আর শোন আজকের এই ব্যাপার এখানেই যেন থাকে।
-ওকে ম্যাডাম, আই আন্ডারস্ট্যান্ড।
গাড়ি তনয়ার দেখানো পথে চলতে শুরু করে।
অঞ্জলি দেবীর ডাকে রাইয়ের তন্দ্রা ভাবটা কেটে যায়। মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখে দশটা বাজতে চললো, আন্টি ওকে খাবারের জন্য ডাকতে এসেছিল। আলসে ভাবটা কাটানোর জন্য বাথরুমে যায় চোখে মুখে জল দেবার জন্য। চোখে মুখে জল দিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে, মনে মনে কিছু একটা ঘটে চলেছে
এই ঠুনকো জীবনে তুমি কাচের দেয়াল
এক আধটু কারনে যদি হও বেসামাল
মনে তাই তোমার খেয়াল
মনে তাই তোমার খেয়াল।
লাইন কটা রাইয়ের কানে ঘুরেফিরে আসতে থাকে বারবার। আবার একটু মুখে জল ছিটিয়ে রুদ্রের রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমের দিকে চলে যায়। খাবারের টেবিলে অবিনাশ বাবু আগে থেকেই বসে আছে অন্যদিকে অঞ্জলি দেবী খাবার গুলো গুছিয়ে রাখছে। রাই কে আসতে দেখেই অবিনাশ বাবু ইশারায় ওদিকের একটা চেয়ার দেখিয়ে দেয়
-আসো আসো, চোখ লেগে গিয়েছিল নাকি? অঞ্জলি তুমি ওকে রান্না ঘরে ঢুকতে দিলে কেন, গরমে হয়তো ওর কষ্ট হচ্ছিলো।
-না না আঙ্কেল, আন্টি বারণ করেছিল আমিই জোর করে রান্নাঘরে গিয়েছিলাম। আমার কোন কষ্ট হয় নি তো। দাও আন্টি তাড়াতাড়ি খেতে দাও, তোমার হাতের জাদুতে যে সুঘ্রাণ বেরিয়েছে তাতে খিদে টা আরও বেড়ে গেল।
-তা ঠিক বলেছো মা, তোমার আন্টির হাতে জাদু আছে। কিন্তু আমাদের কি সেই কপাল আছে যা দেয় তাই খেতে হয়। আজ তবু তুমি আছো বলে ভালো কিছু কপালে জুটছে।
-কি বললে তুমি?? এর মানে কি আমি প্রতিদিন যা তা রান্না করি আর সেগুলোই তোমাদের খেতে হয়। তা যাও না বাইরে থেকেই খেয়ে এসো আমার রান্না যখন ভালো লাগে না।
-(মিটি মিটি হেসে চলেছে রাই) আন্টি তুমি রাগ করো কেন? আঙ্কেল এটা কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছে না। আন্টি কে শুধু বদনাম করবে না। আমার আন্টি অনেক ভালো।
-ও মা এখনি দেখা যায় দল ভারী, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকতে থাকতেই আমি মুখে কুলুপ এটে দিলাম( হু হু করে হাসতে থাকে)
-মেয়েটার সামনে কিছু বললাম না আর তোমাকে। কাউকে দেখলেই তুমি ভীমরতিগ্রস্ত হয়ে পড়ো। এখন চুপচাপ খেয়ে নাও।
-দেখলে তো মা, তোমার আন্টি আমাকে কিভাবে শাসনে রাখে। একটু পান থেকে চুন খসলো তো একেবারে শাসিয়ে উঠবে।
-বুঝেছি বুঝেছি যাও আমি আজ আন্টিকে বলে যাবো যেন তোমার সাথে এমন না করে।
খাওয়া চলছে এর মাঝেই টুকটাক এদিক সেদিকের আলাপ চলছে, টিপ্পনী কাটা হচ্ছে আর তার পর হাসির রুল পড়ছে। হাসতে গিয়ে বারকয়েক ভীষম ও খেয়েছে সবাই। খাবারের শেষ দিকে অঞ্জলি দেবীর সবাইকে দই দিতে থাকে। তখনি রাই বলে উঠে
-আন্টি একটা কথা বলার ছিল, কিছু মনে করবো না তো?
-কিছু মনে করবো কেন? কি বলবি বল না।
-তবুও আন্টি একটু সেনসেটিভ বিষয় তো তাই।
-বাপরে, তুই এত সিরিয়াস হয়ে গেলি কেন হঠাৎ, যা বলার বলে ফেল এখানে তো আর বাইরের কেউ নেই।
-আন্টি আমি তোমাদের এখানে থাকতে চাই।
-থাকতে চাইলে থাকবি, তোকে কে না করছে।
-না মানে আন্টি, এভাবে না আমি একেবারেই তোমাদের এখানে থাকতে চাই।
কথাটা শুনে অবিনাশ বাবু একটু হকচকিয়ে উঠে, অঞ্জলি দেবীও ওনার দিকে তাকায়। পরস্পর পরস্পরের দিকে চোখে চোখে কিছু একটা বলে চলেছে৷ রাই মাথা নিচু করে প্লেটে আঁকিবুঁকি করে চলেছে, মাঝে মাঝে আড় চোখে রুদ্রের মা বাবার মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে। অঞ্জলি দেবী কিছু একটা ভেবে বলে উঠলো
-দেখ রাই তুই যেটা বলতে চেয়েছিস মানে যা বুঝাতে চেয়েছিস সেটা আমিও হয়তো বুঝেছি আর তোর আঙ্কেলও। তুই বড় হয়েছিস তোর নিজের পছন্দ অপছন্দের অধিকার আছে তবুও তোর মা বাবা এখনো তোর অভিভাবক আগে তাদের সাথে আলোচনা টা করে নেয়া ভাল হয় আমার মতে। তুই কি বলিস?
-(মাথা নিচু করেই প্লেট থেকে কিছু একটা মুখে পুড়ে নিয়েছে) তোমরা বড়, তোমরা যেটা সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই হবে। আমি শুধু আমার কথাটা বললাম। সত্যি করে বলবে? আমি তোমাদের পছন্দ নই না?
-এত বড় হয়ে বোকা বোকা কথা বলছিস। পছন্দ হবে না কেন? তোকে সেই ছোট থেকে দেখেছি, অপছন্দ করার মত তো কোন কারণ পাচ্ছি না। তারপরও বাবুর সাথে তো কথা বলতে হবে তো নাকি। আর তোর আঙ্কেল আছে তার সাথেও কথা বলি।
-শুনো অঞ্জলি আমার কোন সমস্যা নেই, আমার তরফ থেকে হ্যাঁ। কিন্তু এরপরও রাই তোমাকে বলছি যে তোমার মা বাবার সাথে আগে কথা বলি। তাদেরও তো কোন মত থাকতে পরে। টেনশন করার কিছু নেই, আমি বাবুর সাথে কথা বলবো মন খারাপ করার কিছু নেই।
-না না আঙ্কেল মন খারাপ করবো কেন। তুমি আছো আন্টি আছে তোমরা ঠিক ম্যানেজ করে নিবে।
-হয়েছো তো তোর আঙ্কেলও তোর পক্ষে। নে একটু হাসি মুখে এদিকে তাকা তো।
বাকিটা সময় হই হুল্লোড়ে কাটিয়ে রাই বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়।
★★★★
ওদিকে পার্টিতে বলতে গেলে একপ্রকার গ্র্যান্ড এন্ট্রি হয়ে তনু আর ছুটকির। দুজনের পড়নেই এক কালারের জম্পেশ পার্টি ফ্রকটা সবার দৃষ্টি কাটছে। অনেকেই দেখে হয়তো ভাবছে ওরা দুই জমজ বোন হয়তো সবাই যেন ওদের ঘিরে ধরেছে, অন্য মেয়ে গুলো জিজ্ঞেস করছে কোথা থেকে জামাটা নিলো কত পড়লো এসব। আর তখনি ওরা দুজনেই দূরে দাড়িয়ে থাকা রুদ্রের দিকে ইশারা করে বলে উঠে দাদাভাই গিফট করেছে। ছিমছাম ড্রেস আপেও রুদ্র কে দারুন লাগছে এশ কালারের জিন্সের সাথে ফরমাল সাদা শার্ট গালে খুঁচা খুঁচা দাড়ি তে একদম দক্ষিণী নায়কের মত লাগছে। এক দুজন তো দৌড়ে ওর দিকেই চলে আসলো, ওর পছন্দের তারিফ করতে কিংবা সাথে অন্য কিছুও৷ যাওয়ার পথেই অনেক কথা বলা হয়ে গেছে তনু আর ছুটকির মাঝে, এখন পার্টিতে ওদের হাবভাব দেখে কেউ বুঝতেো পারবে না একটু আগেই ওদের মাঝে ঠিকমত আলাপ হয়েছে এর আগে কেউ কাউকে চিনতো পর্যন্ত না।
এর মাঝেই কেক কাটার সময় এসে গেল, অনেক হই হুল্লোড়ের মাঝে কেক কাটা হলো সাথে একে অন্যের গালেও একটু আধটু কেক মাখিয়ে দিয়ে মজা নিচ্ছে। এই ফাঁকে কয়েকটা মেয়ে এসেছিলো রুদ্রের দিকে ওকে কেক মাখানোর জন্য কিন্তু তনু আর ছুটকির কড়া পাহারার মাঝে কেউ তেমন হালে পানি পায় নি। ওদের দুটোর কান্ড কারখানা দেখে ও মুচকি মুচকি হাসছে, কোথায় ও এসেছে ওদের পাহারা দিতে এখন ওরাই ওকে পাহারা দিচ্ছে। কেক কাটার পর্ব শেষে নাচানাচি আর গানের ছোট্ট আয়োজন হয়েছে তনু আর ছুটকির তাতে পার্টিসিপ্যাইট করার মাঝে উৎসাহের কমতি নেই। প্রথমেই "প্রেমের বাক্স" নামের একটা হিট গানে ওরা দুজনে দারুন নাচলো। নাচ শেষে সবাই তুমুল করতালি দিয়ে ওদের উৎসাহ দিলো সেই সাথে অনেকেই Once More Once More বলে চিয়ার্স করতে লাগলো। সবার অনুরোধে তনু আর ছুটকি "মানভা লাগে" গানটাতেও দারুন নাচে। দেখে মনে হচ্ছিলো দুটো পরী একসাথে নাচছে এখানে, রুদ্র দুটো নাচই মোবাইলে রেকর্ড করেছে। কয়েকজন দারুন দারুন সব গান পরিবেশন করলো, অনুষ্ঠানের শেষের দিকে ওরা দুটো এসে রুদ্র কেউ চেপে ধরে ওদের সাথে নাচার জন্য, রুদ্র প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না কিন্তু ওদের চাপাচাপি তে রাজি হতেই হলো ওকে। শেষমেশ ওরা তিনজনে একটা ম্যাশআপ গানের তালে নাচতে শুরু করলো, একদম মঞ্চ কাপানো পারফরম্যান্স চারদিকে গোল করে দাড়ানো বাকিদের মাঝে মেয়েগুলো উদ্দীপনা যেন তুঙ্গে। ওরা চিৎকার করে আর করতালিতে পুরোটা সময় মুখরিত করে রেখেছিল। নাচটা শেষ হতেই কয়েকজন যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল রুদ্রের উপর, কেউ কেউ তো অটোগ্রাফ চাওয়ার মত বাড়বাড়ন্ত অবস্থা একটা মেয়ে তো মোবাইল নাম্বারও চেয়ে বসলো। সাথে সাথে ছুটকি আর তনু যেন তেড়ে গেল ঐ মেয়ের দিকে, ওরা গিয়ে ওদের বান্ধবী কে একটু ধমকের সুরেই বললো, " ওটা আমার দাদা বুঝলি, তোর চেয়ে কত বড় জানিস তুই যে লাইন মারতে চলে এলি"। রুদ্র এগিয়ে গিয়ে ওদের দুটোকে টেনে নিয়ে আসে আর ঐ মেয়ে টিকে সরি বলে। ছুটকি আর তনুকে হালকা বকা দেবার মত করে বলতে বলতে খাওয়ার জায়গার দিকে এগিয়ে যায়। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে একে একে সবাই বিদায় নিতে শুরু করে রাত প্রায় এগারো টা বাজতে চলেছে আর দেরি করা ঠিক হবে না তাই রুদ্রও ছুটকি আর তনু কে তাড়া দেয় বাসায় চলে যাবার জন্য।
বাইরে বের হয়ে হঠাৎ ছুটকি বায়না ধরলো আজ রাতটা তনুকে ওদের বাসায় থাকার জন্য, তনুও যে আগে থেকেই রাজি হয়ে আছে সেটা ওর হাবভাবেই বুজতে পারে। তবে ওর বাসায় তো চিন্তা করবে এমনিতেই রাত তো অনেক হয়েছে। দুই পক্ষের আর্গুমেন্ট শেষে ঠিক হলো বাসায় গিয়ে ছুটকি মা কে দিয়ে তনুর বাসায় কথা বলিয়ে দিবে তাতেই তো হলো। অগত্যা রুদ্রকে রাজি হতেই হলো, রাতে রাস্তা ফাঁকা বললেই চলে তাই বাইকে স্পিড তুলে তাড়াতাড়িই বাড়িতে পৌঁছে গেল। বাসায় এসে কলিং বেল বাজাতেই অঞ্জলি দেবী এসে দরজা খুলে দেয়, তিনি যে ঘরে পায়চারি করছিলেন সেটা বুঝাই যাচ্ছে। চলতি পথে কয়েকবারই রুদ্রের ফোনটা বেজে উঠেছিল আর ফোনটা যে মা করছিলো সেটা ওর জানা। রুদ্র ছুটকির সাথে তনু কে দেখে একটু অবাক হয় অঞ্জলি দেবী
-তোদের সাথে আবার কাকে নিয়ে আসলি আবার?
-মা তোমাকে বলেছিলাম না তনুর কথা, ঐ যে আমাদের সাথেই যাবে। ও সেই তনু৷
-(তনুর দিকে এগিয়ে যায় অঞ্জলি দেবী, দু হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়) ভারী মিষ্টি লাগছে তোমাকে। তা তুমি যে এত রাতে এখানে এলে তোমার বাসায় জানিয়েছো?
-(পাশ থেকে ছুটকি বলে উঠে) না মা, তুমি একটু ওর মায়েে সাথে কথা বলে নাও না। তুমি বললে ওনারা কিছু বলবে না।
-আন্টি মা হয়তো মানবে কিন্তু দিদি খুব রাগী ও ঠিকি বকাবকি করবে। তুমি একটু মা কে বুঝিয়ে বলো যেন দিদিকে ম্যানেজ করে নেয়।
-(মুচকি হাসতে হাসতে) ঠিক ঠিক আছে তুমি নাম্বার টা দাও আমি কথা বলে নিচ্ছি, দিদি কে নিয়ে এত টেনশন করতে হবে না। যা ছুটকি ওকে ঘরে নিয়ে যা, যাও চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও। কিরে বাবু তোকে কি আলাদা করে বলতে হবে নাকি।
সোফায় বসে থাকা রুদ্র নিজের রুমের দিকে চলে যায় আর ছুটকি তনুকে নিয়ে ওর রুমের দিকে চলতে থাকে। দুজনেই খুব খুশি, পার্টিতেও অনেক আনন্দ করেছে ওরা ছুটকির ড্রেস তনুও গায়ে হয়ে যাবে তাই আর তেমন কোন টেনশন নেই৷ ওরা জামাকাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হতে বাথরুমে চলে যায়। বাইরে অঞ্জলি দেবী ফোনে তনুর মা দেবীকা চৌধুরীর সাথে কথা বলে তনুর তাদের বাসায় থাকার কথাটা জানিয়ে দেয় সেই সাথে যেন তারা টেনশন না করে সেটাও জানিয়ে দেয়।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ওরা দুজনে গল্পে মজে যায়, হঠাৎই তনু বলে উঠে ছুটকিদের ফ্যামিলি অ্যালবাম টা আনতে দুজনে মিলে ওদের ছোটবেলার ছবি গুলো দেখবে। ছুটকি দৌড়ে গিয়ে মা বাবার রুম থেকে অ্যালবাম টা নিয়ে আসে, দুজনে মিলে বিছানার উপর উপুড় হয়ে বসে ছবি দেখায় মন দেয়। এক এক করে পাতা উল্টাতে থাকে আর ছুটকির মা বাবার বিয়ের ছবি গুলো দেখতে থাকে মাঝে মাঝে তখনকার সময়ের ছবি তোলার ভঙ্গিমা গুলো দেখে হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে। একটা ছবিতে তনুর চোখ আটকে যায়, ছবিটা অনেক পুরনো তাতে দুটো ছেলে আরেকটা মেয়ে কলেজ ড্রেস পড়া ছবি না না ঐ তো অন্য পাতা গুলোতে ওদের আরও ছবি আছে সবগুলোতে কলেজ ড্রেস পড়া নেই বেশিরভাগ ছবিতেই নরমাল জামাকাপড় পড়া৷ কয়েকটা ছবিতে শুধু দুজনই আছে, ছবির মুখ গুলো খানিকটা পরিচিত লাগে তনুর কাছে, ছুটকি কে জিজ্ঞেস করে ছবি গুলোর ব্যাপারে
-কিরে এই ছবি গুলো কার?
-ওহ এগুলো, দাদা আর তার কলেজ ফ্রেন্ডদের। ওরা একসাথে কলেজে পড়তো ভালো বন্ধু ছিল। পরে একেকজন একেক জায়গায় চলে গেছে।
-রুদ্র দা কোনটা? আর বাকি গুলো কে কে তুই চিনিস?
-বা পাশের টা দাদার ছবি আর ঐ যে মাঝখানের মেয়েটা ওর বান্ধবী নামটা কি জানি মনে পড়ছে না(খানিকটা মাথা চুলকে) মনে পড়েছে ওটা রাই দি আর ডান দিকের টা জয় দা। আমি তাদের কাউকেই দেখিনি, দাদার মুখে নাম শুনেছি শুধু। আর মা বলতো আগে কলেজে থাকতে আমাদের আগের বাসায় তারা প্রায়ই আসতো।
-(এতোক্ষণ ছুটকির সব কথায় তনুর মনোযোগ ছিল না ও কিছু একটা ভাবছে) একটা কথা বলবো তোকে?
-কি কথা বল।
-এমন দু তিনটে ছবি আমি আমাদের বাসায় দেখেছি।
-তোদের বাসায়? ওখানে কি করে যাবে? অন্য ছবির সাথে গুলিয়ে ফেলছিস হয়তো।
-নারে, বাসায় বলতে দিদির ড্রয়ারে একটা ডায়েরি আছে ওটাতে, হুবহু একই ছবি। একই রঙের কলেজ ড্রেস ঐ ছবি গুলোতেও। আর আমার দিদিকে তো বাসায় বাবা মা রাই বলেই ডাকে ওটা দিদির ডাকনাম। তুই বলছিস রুদ্র দার কলেজ বন্ধুর নামও রাই। আচ্ছা তোরা আগে কোথায় থাকতিস?
-আমি তখন খু্ব ছোট তেমন কিছু মনে নেই সেই জায়গা টার কথা তবে আমরা গোপালপুর নামে একটা মফস্বলের মত জায়গায় থাকতাম।
-আরি ব্যাস এইতো এটাও মিলে গেল, আমি বাসায় শুনেছি আগে আমরাও গোপালপুরে থাকতাম তবে আমার জন্মের আগেই শহরে চলে এসেছিল।
-তাহলে তুই কি বলতে চাইছিস?
-ওটাই যেটা তুই ভাবছিস, রুদ্র দা আর আমার দিদি কলেজ ফ্রেন্ড।
-তা হলে এতদিনেও ওদের কাউকেই তো আসতে দেখলাম না কিংবা দাদার মুখেও কোন কথা শুনলাম না।
-সেটাই তো ভাবছি, দিদিও তো কখনো এই ব্যাপারে কথা বলে নি। আর ছবি গুলো দিদি কখনো আমাকে দেখায় নি কিছু বলবে তো দূরের কথা। কিছু একটা তো ঘটনা আছে।
-কি বলছিস এখন তো আমরই সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এখন ঘুমোতে চল পরে ওটা নিয়ে কথা বলতে হবে, বিষয়টা ঠান্ডা মাথায় ক্লিয়ার করা দরকার।
-বিষয়টা ক্লিয়ার না হলে ঘুম আসবে না তো। চল না একবার রুদ্র দাকে জিজ্ঞেস করি।
-মাথা খারাপ নাকি তোর, দাদা কে গিয়ে এত রাতে কি জিজ্ঞেস করবি। বকুনি ছাড়া আর কিচ্ছু পাবি না, দাদার ঐ রূপটা তো দেখিস নি তাই।
-তবে আর কি, আমাদেরই গোয়েন্দা গিরি করতে হবে আর ব্যাপার টা খোলাসা করতে হবে।