28-06-2022, 06:13 PM
পর্ব নয়
ততক্ষণে, মহাদেবের বাড়ি থেকে ডাক আসায়, মহাদেব চলে গেল। নগেন বেশ খানিকক্ষণ বসে রইল মণ্ডপের উঁচু রোয়াকে। রাধাচুড়া গাছের মিষ্টি ছায়ার তলায়। দেখল বেশ কিছুক্ষণ রাস্তা দিয়ে লোকের আনাগোনা। তারপরে খানিক এদিক সেদিক করে নগেন ভোলা যেদিকে গেছে, সেই দিক অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। খানিক টা যেতেই দেখল, রাস্তার ধারে মহাদেবের বাড়ির মাটির পাঁচিলের দিকে ভোলা এক মনে তাকিয়ে আছে। নগেন মনে মনে ভাবল এই এতোক্ষন ধরে ভোলা এখানে দাঁড়িয়ে? নগেন রাস্তায় পা দিতেই ভোলা ও মহাদেবের বাড়ির পিছন দিকের গলি তে ঢুকে পরল, যেদিকে কিছু টা গেলেই পুকুর টা আছে। ও এগিয়ে গেল। কারন ওই দিকে পুকুরের ধার ধরে নগেনের বাড়িও যাওয়া যায়। ও গলির ভিতরে ঢুকে দেখল একটু দূরে ভোলা ঠিক মহাদেবের বাড়ির খিড়কি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের ঘটি থেকে জল নিচ্ছে আর মহাদেবের বাড়ির গায়ে ছেটাচ্ছে। আর বিড়বিড় করে কিছু বলছে। কুকুরের মতন মহাদেবের বাড়ির পিছনের দেওয়ালে শুঁকছে ভোলা। নগেনের পায়ের তলায় একটা কাঠি পড়তেই পট করে আওয়াজ হলো। আর তাতেই ভোলা চেয়ে দেখল নগেনের দিকে।
কিন্তু একী? এ কার মুখ? এমন বিশ্রী ভাবে ভোলা তাকিয়ে আছে কেন? যেন কোন কাজে বাধা দিলো নগেন। ভাব লেশ হীন মৃত মানুষের মুখ যেমন হয় ঠিক তেমন। কিন্তু মুখে একটা বীভৎস হিংসা। চোখে নির্লিপ্ততা। উফ নগেনের সারা শরীর মনে হচ্ছে কাঁপতে কাঁপতে থেমে যাবে এবারে। নগেন মহাদেবের মাটির দেওয়াল ধরে কোনরকমে নিজেকে সামলাল। আর ভোলা হিস হিস করে চাপা আওয়াজে বলে উঠলো,
- কি!!! লুকিয়ে লুকিয়ে আমার পিছু নেওয়া হচ্ছে নাকি?
নগেন এমনিতেই ভয় পেয়ে গেছিল ভোলার নজরে। এখনো মনে হচ্ছে লাল চোখ দুখানা।এবারে এই নির্জন গলি তে গলার আওয়াজেও ভয় পেয়ে গেল। কেমন চোখ বড় বড় করে ঘাড় নেড়ে ভোলা মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি এনে জিজ্ঞাসা করল কথাটা। ভোলার গলার আওয়াজ তো আছেই, সাথে মনে হচ্ছে অন্যের আওয়াজ ও রয়েছে ভোলার গলার আওয়াজের পিছনে। কেমন গম্ভীর সেই আওয়াজ। ভলার নিরীহ আওয়াজের পিছনে সেই বাজখাই আওয়াজে নগেনের বুদ্ধিও হাল ছেড়ে দিল বোধ করি। কিন্তু খেই হারালে চলবে না এখন নগেনের। ভুল ও হতে পারে নগেনের। ভোলা হয়ত কোন কাজেই এসেছিল এদিকে। হয়ত পুকুরেই এসেছিল । ধীরে ধীরে সাহস টা খানিক ফিরে এলো নগেনের এবারে। আমতা আমতা করে বলে উঠলো নগেন।
- না না ভোলা, আমার বাড়ি তো এদিক দিয়েও যাওয়া যায়। তাই যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে। আর তোর পিছু কেন নেব বাপ আমার? তুই কত ভাল কীর্তণ করিস। সেই কথাই হচ্ছিল বুঝলি, মহাদেবের সাথে।
অনেক টা সামলে নিল নগেন। বয়েস হয়েছে এখন। প্রতিটা কাজ ই একটু ধীর লয়ে করতে হয় নগেন কে। ভোলা কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে গলি জুড়ে। কেমন একটা অবিশ্বাসের নজর ভোলার। কুতকুত নজরে তাকিয়ে নগেনের দিকে। আবার সেই রকম হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
- ও, তা দাঁড়িয়ে কেন? বিদেয় নেওয়া হোক।
মুখের মধ্যে একটা তীব্র কাঠিন্যের সাথে জিঘাংসা ভোলার চোখে। নগেন বুঝতে পারল, ভোলার কান্ডকারখানায় ভয় পেয়েছে সেটা বোঝালে চলবে না।যতটা সম্ভব নিজেকে একেবারে নির্লিপ্ত প্রমাণ করতে হবে ভোলার সামনে। আবার ভোলা কে পেরিয়ে যেতেও পারছে না। দেখতে ছোটখাটো ভোলা কিন্তু মনে হচ্ছে গলি টা পুরো টাই আগলে দাঁড়িয়ে আছে সে। কেমন একটা গা ছমছম করছে নগেনের। তাই অন্য দিকেই চোখ রেখে কথা ঘোরালো। বলল,
- তা কি করছিস বাপ? পুকুরে মাছ ধরতে এসেছিস? এই দুপুরে? সকালে আর যাস না তো আমাদের বাড়ির পিছনে। আগে তো রোজ যেতিস।
এতো প্রশ্ন একসাথে শুনে, ভোলা মনে হলো রেগেই গেল। এগিয়ে এলো হন হন করে নগেনের দিকে। নগেন পিছিয়ে এলো কিছু টা ভয়েই। ধাক্কা খেলো কারর সাথে। পিছনে কে দেখার সময় ও পেল না। কিন্তু ভোলা ভারী অবাক আর কিছু টা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল, গিয়ে আগে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। এদিক ওদিক দেখতে লাগল ভোলা। আর পিছন ফিরে নগেন তাকিয়ে দেখল, রহিম দাঁড়িয়ে কাঁধে লাঙল চাপিয়ে। উন্মুক্ত বক্ষে, কাঁধে একটা লাঙল নিয়ে, সারা গায়ে কাদা ধুলো মেখে রহিম দাঁড়িয়ে। কাঁধে একটা গামছা। ধরে প্রাণ এলো নগেনের। এই দুপুরেও এমন গা ছম ছম করবে নগেন ভাবে নি। গা ছমছমানি টা হুশ করে চলে গেল। সাহস টা একেবারে গলা অব্দি ফিরে এসেছে এখন। ততক্ষণে ভোলা পুকুরের দিকে এগিয়ে গেছে, মহাদেবের খিড়কি দরজা ছেড়ে। কিন্তু নগেন যেন শুনতে পেল মনে হলো ভোলার মুখ থেকে। বিড়বিড় করে বলছে বটে ভোলা কিন্তু শুনতে পেল নগেন।
- অ্যাঁ? এও আছে এখানে? এ কোথা থেকে এলো? একা আছে? সে কোথায়? হুম সেও আছে। আছে। আছে। সে ও আছে। ভেঙ্গে দোব বিষ দাঁত আমি তোর। ভেঙ্গে দেব।
মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝল না কিন্তু বুঝতে পারছে, ভয়ের জাল আস্তে আস্তে বিস্তার লাভ করছে। ভয়ে অন্তর শুকিয়ে যাবার জোগাড় হলো নগেনের। ভোলা এগিয়ে গেল সামনে দিকে। নেমে গেল পুকুরের ঘাট বরাবর। নগেন রহিম এর দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছিল তখনো। রহিম নগেন কে দুই হাতে ধরে বলল,
- দাদু নিজেকে সামলাও। বিকালে আমরা দেখা করব কচুবনে আবার। তুমি চলে এস। আমি বরং একবার পিছু নি ভোলার।
নগেন বেশ ভয়ের সাথেই বলল রহিম কে,
- রহিম তুই ভোলার চোখ দুটো দেখলি? কেমন মরা মাছের মতন না?
থর থর করে কাঁপছিল নগেন। সেটা দেখেই আবার রহিম নগেন কে বলল,
- দাদু সামলাও এখন নিজেকে একটু। কাউকে বলতে যেও না এ কথা। বিকালে আমরা আবার কথা বলব। এখন তুমি ঘরে যাও। আমি যাই ওর পিছনে, কোথায় যায় দেখি।
রহিম বেশ দ্রুত এগিয়ে গেল ভোলার পিছনে।রহিম একটু এগিয়ে যেতেই মহাদেবের বাড়ির খিড়কী দরজা খুলে যে বেড়িয়ে এল তাকে দেখেও চমকে গেল নগেন। দেখল হীরা খালি গায়ে একটা বারমুডা পরে বেড়িয়ে এসেছে খিড়কী দরজা দিয়ে। হীরা কালো নগেন জানে। কিন্তু এই রকম তীব্র বর্ষার দুপুরে এই রকম একটা ভয়ের পরিবেশে হীরার গায়ের রঙ নীল বলে মনে হলো নগেনের। নগেনের হাত পা কাঁপতে শুরু করল বলতে গেলে। কারন ওর কাছে হীরার কাজ কর্ম ও কম সন্দেহ জনক নয়। কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছিল নগেনের। একটা অন্যরকম হাসি যেন হীরার ঠোঁটে লেগে রয়েছে। দেখলেই নগেনের মনে হয়, যেন কত জন্মের অকৃতজ্ঞতা জমে আছে নগেনের ভিতরে। নগেনের বোধ হয়, প্রচুর ঋণ তার জীবনে। নিজের পিতার কাছে, নিজের মায়ের কাছে, ভগবানের কাছে। সেই ঋণ সে শোধ করতে পারছে না। জানেনা নগেন হীরা কে দেখলেই তার এমন অনুভব আসে কেন? হয়ত নগেন ওখানে বসেই পড়ত। কিন্তু ততক্ষণে রহিম ছুটে এল ঘাটের সামনে থেকে। এসেই বলল,
- না গো দাদু কোথাও দেখতে পেলাম না তো।
নগেন রহিম কে দেখে ততক্ষণে একটু সাবলীল হয়েছে। রহিমের এলেম দেখেছে নগেন আগেই। তাই মুখে বুলি ফুটল একটু। বলল,
- দুটো গলি আছে তো। অন্য টায় গেছে হয়ত।
- না গো না, দুট গলি ই দেখলাম তো। অতো তাড়াতাড়ি দুটো গলির কোন টাই পার হতে পারবে না ও। জলেও দেখলাম। ভাবলাম হয়ত মাছ ধরতে নেমে পরেছে। কিন্তু নাহ সেখানেই নেই।
হীরা শুনছিল কথা ওদের দুজনার ই। নগেনের দিকে হেসে বলল এবারে,
- কি গো তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে? বাড়ির পিছনে কেন? বাড়িতে এস।
রহিম এক গাল হেসে বলল,
- না রে যাব না। কি রে, খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলো তোর।
- হ্যাঁ গো রহিম দা। কিন্তু তোমরা এখানে কি করছ? যতদুর জানি এই রাস্তা দিয়ে তো কেউ যাতায়াত করে না। এ তো ঘাটে যাবার রাস্তা।
নগেন ইতস্তত করলেও রহিম বলেই দিল,
- না রে, এদিকে ভোলা কাকা কে যেতে দেখলাম দুজনেই। তাই দেখছিলাম কোথায় যায়। কিন্তু আর দেখতেই পেলাম না। ভোজবাজীর মতন উবে গেল যেন।
- ও। তা না যাবার কি আছে? এদিক দিয়ে অনেকের ঘাটেই যাওয়া যায়। ভোলা কাকু তো এদিক দিয়ে যায় আসে। আমি অনেক বার দেখেছি। মাছ ধরতে যায় মনে হয়।
- অ্যাঁ? – নগেন চমকে উঠল কথা টা শুনে।
রহিম একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল হীরা কে।
- তুই ঠিক জানিস?
হীরা ততক্ষণে, বাড়ির মাটির দেওয়ালে লেগে থাকা, প্রায় শুকিয়ে যাওয়া, ভোলার ছুঁড়ে দেওয়া জলের বিন্দু গুলো কে দেখতে লাগল একেবারে কাছে গিয়ে। সেইগুলো দেখে, মিষ্টি হাসি হেসে বলল,
- হ্যাঁ গো হ্যাঁ, আমি জানি। আমি যাই এবারে। একটু ঘুমোব। দুপুরে ঘুম টা আমার দরকার।
রহিম একটু অন্যমনস্ক ছিল হীরার কথা শুনে। ভোলা এদিক দিয়ে রোজ যায়? কিন্তু এদিকে ওর কি কাজ। মাছ তো ধরে না পুকুরে ও এখন। এদিকে ওর কি কাজ। রহিম হীরার দিকে তাকাল। দেখল চোখে আর মুখে তীব্র মিষ্টতা নিয়ে হীরা তাকিয়ে আছে রহিমের দিকে। রহিম বলল হীরা কে,
- আচ্ছা তুই শুতে যা আমি যাই বাড়ি, দুপুর হয়ে এলো।
তারপরে নগেনের দিকে তাকিয়ে বলল,
- চলো গো জ্যাঠা, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দি।
- হুম চল।
খানিক রাস্তা চলে আসার পরে হীরা পিছন থেকে বলে উঠলো,
- গলি মানে তো গলি ই। দেখতে গেলে গলির মানে হলো, বড় রাস্তার পরিবর্তে ব্যবহৃত ছোট পায়ে চলা রাস্তা। গলি দুরত্ব, সময় আর দুটোই বাঁচায় গো দাদু!! আর নিজেকে অন্যের চোখের আড়াল ও করা যায়।
রহিম আর নগেন পিছন ফিরে দেখল হীরা কথা টা বলেই ঢুকে পরেছে ভিতরে। দরজা টা বন্ধ। দরজার সামনের কড়া টা হালকা নড়ছে। নগেন ভাবছে, “গলির মানে বোঝাল মহাদেবের ব্যাটা? না হয় পড়াশোনায় ভালই। তা বলে গলির মানে বলে দেবে? আমি কি জানি না নাকি গলির মানে? ”
নগেন বাড়ি ঢোকার সময়ে উঠোনে রাধামাধবের মন্দিরের দিকে তাকিয়ে দেখল। দেখতে পেল রাধা ঠিক আছে, কিন্তু মাধবের পরনে একটা বারমুডা আর খালি গা। অবিকল মহাদেবের ব্যাটা। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে আছে, ও যখন প্রনাম করে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে মাধবের পরনে হলুদ পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা ছিল। আর রাধার পরনে শাড়ি। পরেশের বেটি মানে লালি কত বার জিজ্ঞাসা করেছে, গোটা গ্রামের মন্দিরে মন্দিরে কৃষ্ণ হলুদ ধুতি আর খালি গায়ে আর রাধা ঘাঘড়া পরে থাকে। আর এখানে এমন অদ্ভুত বেশ কেন? নগেন ভাসা ভাসা জানে কিছু টা উত্তর। শুনেছিল তাদের কোন পূর্বপুরুষ কে দেখা দিয়ে ছিল কৃষ্ণ এই বেশেই। তাই সেই থেকে মন্দিরে কৃষ্ণের এই বেশ। কাজেই বাড়ির মাধবের এই বেশ নিয়ে নগেনের কোন সন্দেহ নেই। এদিকে রান্না ঘর থেকে দুই বউমা আর নাতি নাতনীর কোলাহল ভেসে আছে। একটু দুরেই বাড়ির বারান্দায় ছায়া তে বসে আছে ছোট ছেলে নগেনের। গল্প করছে ঘরে বসে থাকা নগেনের , স্বর্গত দাদার স্ত্রী মানে জেঠির সাথে। বিশাল বাঁধানো উঠোনে , চমচমে রোদে নগেন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু নিজেকে মনে হচ্ছে একেবারে একা। বুঝতে পারছে নগেন এবারে হয়ত ধড়াম করে পরে যাবে সান বাঁধানো উঠোনে। একী দেখছে সে? এও কি সম্ভব নাকি নগেনের মাথা ঘুরছে? নাকি কালকের ঘটনা নগেন কে এতোটাই মোহিত করে রেখেছে যে নগেন ভুল দেখছে এবারে? কাউকে ডাক তে যাবে ভয়ে বিস্ময়ে , কিন্তু তার আগে চোখ টা একবার কচলে তাকিয়েই দেখল, কই, হলুদ পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা ই তো পরে আছে মাধব।
নাহ, সত্যি বুড়ো হয়ে গেছে নগেন। আর তা না হলে গত তিন চারদিনের ঘটনা ওকে বিহ্বল করে দিয়েছে একেবারে। অভ্যাস মতন প্রণাম করে ঘরে এসে স্নান করে খেয়ে দেয়ে একটু বিছানায় গড়াল। মনের মধ্যে মহাদেবের ছেলের গলির মানে বোঝানো টা ঘুরপাক খাচ্ছে। নগেন জানে মহাদেবের ছেলে পড়াশোনায় সাংঘাতিক রকম ভাল।
“ কিন্তু তা বলে গলি কথার মানে কেন বলল? ওই ছেলে তো কথা বলেই না তেমন। গায়ে পরে এই গলি কথার মানে বোঝানোর কি দরকার ছিল। নাহ সবাই যেমন ভাবে ওকে ব্রিলিয়ান্ট। তেমন কিছু না। নগেন ভুলে যেতে চাইল কথাটা, হীরা কে বাচ্ছা ছেলে ভেবেই। কিন্তু………। নাহ কিছু তো আছে। কেন বলল ও ওই কথাটা? আচ্ছা, হীরা বলল, ও ভোলা কে প্রায় ই দেখে ওই রাস্তায় যাতায়াত করতে। মিথ্যে নিশ্চই বলছে না ও। ওই রাস্তায় ভোলা কি করে? মাছ তো ধরে না। তাহলে?
উফ অনেক প্রশ্ন মাথায় এখন নগেনের। চারিদিকে পরিস্থিতি এতো ভারী যে এখনি কিছু না করলে সর্বনাশ হতে দেরী নেই আর। প্রশ্ন গুলো কে সাজিয়ে ফেলল নগেন এক এক করে।
১) বাঘমুড়ো কেন হাজার হাজার বছর ধরে এখানে আছে? কবচ দিয়ে তো গ্রাম ঢাকা ছিল। বাঘমুড়ো অন্য কোথাও চলে যেতে পারত, হত্যালীলা চালাতে পারত। কিন্তু যায় নি এখানেই আছে। বাঘমুড়োর দরকারী কিছু আছে এখানে?
২) অনেক গ্রাম থাকতে এই গ্রাম কেই কেন কবচ দিয়ে ঢাকা হলো? তার মানে এই গ্রামেই কিছু আছে যেটা বাঘমুড়ো কে এখান থেকে নড়তে দেয় নি। গ্রামে কি আছে?
৩) কবচ ভাঙল কে? বাঘমুড়ো নিশ্চই নয়। তাহলে অনেক আগেই ভেঙ্গে দিতে পারত। হতে পারে বাঘমুড়ো এখন শক্তি পেয়েছে। কিন্তু কে দিল সেই শক্তি? রহিমের কথা ফেলে দেবার মতন নয়। পিছনে কেউ না কেউ আছে যে কবচ ভেঙ্গেছে। কে আছে বাঘমুড়োর পিছনে? কোন অপ্রাকৃতিক কিছু?
৪) এই তিনজন কে? রহিম অভি আর লালি তিনজন ই এই গ্রামে জন্মেছে। নগেন ওদের জন্মাতে দেখেছে। তিনজন নিরীহ ছেলে মেয়ের মধ্যে এমন ভয়ানক শক্তি কোথা থেকে এল?
৫) তার মানে এদের পিছনেও কেউ আছে। যতই এরা বাঘমুড়োর বিরুদ্ধে লড়ুক, এই তিনজন ও মহাশক্তিশালী। এদের পিছনে কে আছে। অন্য কোন পিশাচ?
৬) মহাদেবের ব্যাটাও কি কোন শক্তি? সেদিনে চন্ডীমণ্ডপে যা দেখেছিল নগেন, সেটা কি কোন মানুষ করতে পারে? হ্যাঁ অধ্যাবসায় এই প্রশ্নের একটা উত্তর। কিন্তু নগেন তো জীবনে হীরা কে ফ্লাইং ডিস্ক নিয়ে কোন প্র্যাক্টিস করতে দেখে নি। ওর জন্ম ও একটা রহস্য। নগেনের কেন জানিনা মনে হচ্ছে, এই লড়াই এ হীরা ও একটা অংশ। কিন্তু ও কে?
৭) ভোলার কি হয়েছে? ওকে কেমন মৃত মনে হয় নগেনের। দেখলে ভয় লাগে। কিন্তু কেন? কি হয়েছে ওর? ওর বোন ই বা কোথায় গেল?
৭) গলির কথা হীরা বলল কেন? আর কাউকে যেতে দেখে না ও। কিন্তু ভোলা কে দেখেছে। ও কি ভোলার উপরে নজরে রেখেছে? কারন ওই গলি দিয়ে অনেকেই যাতায়াত করে। লালিও ওই গলি দিয়ে একশ বার যায়। তার মানে হীরা বোঝালো, ভোলা ওই গলি দিয়েই যাতায়াত করে। কিন্তু কেন? ওই গলি তে ভোলার কি আছে? গলি গলি গলি গলি…
উফ এবারে মাথা টা ফেটে যাবে নগেনের। এতো প্রশ্ন? আর উত্তর কই? নেই। উত্তর নেই।খানিক এপাশ ওপাশ করে নগেন উত্তেজনায় উঠে বসল বিছানাতেই। ভাবল,
- আচ্ছা, ওই গলি তেই রহস্য লুকিয়ে নেই তো? হ্যাঁ, তাই হবে। ওই গলি তেই রহস্য আছে । অনেক অনেক রহস্য। সেদিনেও ওই গলি দিয়েই যাবার সময়ে ওরা অন্য কম্পাঙ্কে পৌঁছে গেছিল বাঘমুড়োর পিছু নিতে গিয়ে। হ্যাঁ, তাই তো!! নাহ ওই তিন জনের সাথে এক্ষনি আলোচনা করতে হবে। এক্ষনি ।
রহস্য এমন ই জিনিস, সবাই মাথা ঘামাতে পারে না। কিন্তু যে ঘামায় সে বেড়িয়ে আসতে পারে না কোন ভাবেই। এই যেমন নগেনের হয়েছে এখন। কিন্তু সমস্যা হলো, রহস্য যে ভেদ করে, সেই ভেদীর দিকেও অনেকের নজর থাকে, যারা সেই রহস্যের সাথে জড়িত। ভেদীর কাছে তাদের উপস্থিতি রহস্যের জট ছাড়ানোর কাজে লাগে। ভেদী বুঝতে পারে , কত জন কুশী লব জড়িয়ে আছে। রহস্যে জালের বুনোট কে ধীরে ধীরে ছাড়াতে সুবিধা হয় তখন।
নগেন আর অপেক্ষা করল না। বেড়িয়ে এল বাড়ি থেকে রাধা মাধব কে প্রণাম করে। গ্রামের দুপুর। শুনশান চারিদিক। পাখি গুলো ও ঝিমোচ্ছে। আওয়াজে ক্লান্তির আভাষ। বাড়ির কুকুর টা ঠিক বাড়ির সামনেই গুটুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে ছায়ায়। নগেন পাশ দিয়ে এল, কোন ভ্রূক্ষেপ ই করল না। পাশেই ছোট পুকুর থেকে, কড়াই এ ইট ঘষে পরিষ্কার করার আওয়াজ ভেসে আসছে নগেনের কানে। একে বর্ষা কাল। তারপরে চমচমে রোদ। গা যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে নগেনের। ভিজে গামছা টা গায়ে চড়িয়ে লালির বাড়ির দিকে রওনা দিল নগেন। এক সময়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছুল চার মাথার মোড়ে। অস্বাভাবিক শান্ত জায়গা। চার মাথার চার রাস্তা চলে গেছে চার দিকে। একটা পূব দিকে লালি দের বাড়ি। একটা উত্তর পূর্ব, যে দিকে নগেনের বাড়ি। একটা পশ্চিমে বামুন পাড়া। আর একটা দক্ষিণ পশ্চিম দিকে রহিম দের বাড়ি। নগেন কে যেতে হতো লালি দের বাড়ি। কিন্তু ঠিক মোড়ের মাথায় এসে মনে হলো চারিদিক অস্বাভাবিক শান্ত। কেউ কোথাও নেই। বলতে গেলে এক লহমা আগেও বাড়ি বাড়ি থেকে আওয়াজ আসছিল। এখন যেন দুম করে সব থেমে গেল। অসহ্য লাগছে নগেনের। এত একা জীবনে কোন দিন ও লাগে নি নগেনের। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সাথী, নগেনের স্ত্রী মারা যাবার পরেও নগেনের এতো একা লাগে নি। ভয় লাগছে নগেনের ভীষণ।
চার মাথার মোড়ে একটা মন্দির আছে। মন্দির নয় ঠিক, সেখানে দোলের সময়ে, রাধামাধব, নিজের মন্দির থেকে বেড়িয়ে দোল খেলতে খেলতে, এখানে বিশ্রাম নেন। ছোট্ট একটা উঁচু, চার টে থাম দিয়ে বানানো, মাথায় চুড়ো নিয়ে একটা মন্দিরের ক্ষুদ্র সংস্করণ মাত্র। বেশ উঁচু। প্রায় ফুট সাতেক বেদী। তার উপরে মন্দির খানা। ওখানে রাধা মাধব বসেন। মাহাত্ব্য বিবেচনা করে, সেই মন্দির কেই প্রণাম করে নিল নগেন এই ভয় থেকে রক্ষা পেতে। এতোই ভয় পেয়ে আছে যে এক পা এগোতে পারছে না লালিদের বাড়ির দিকে এই ভরা দুপুরেও। ভয়ের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখল, লালিদের বাড়ির দিকের রাস্তায়, ঠিক পঁচিশ হাত দূরে একটা বাড়ির সামনের রোয়াকে ভোলা বসে। ভোলা নিজের মাথাটা নীচের দিকে করে, ঠিক নগেনের দিকেই তাকিয়ে আছে ভাব লেশ হীন মুখে। মুখে একটা পৈশাচিক হাসি। যেন অপেক্ষা করছিল। একে বয়েস হয়েছে তারপরে ভোলা কে ওই ভাবে দেখে নগেন ওই খানেই বসে পরল। হাঁটু দুটো মারাত্মক কাঁপছিল নগেনের। নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না আর। উফ এই টানাপোড়েন আর নিতে পারছে না নগেন। এ তো প্রাণ সংশয়!!
- হে রাধামাধব রক্ষা কর আমাকে। সারা জীবন তুমি ছাড়া কিছুই বুঝিনি আমি। হে প্রভু, আমাকে মারতে হলে মেরে ফেল, কিন্তু আমাকে দেখে যেতে দাও , আমার এই গ্রাম সব দিক থেকে শান্তি তে আছে। হে মাধব, হে হৃষীকেশ, হে মধুসূদন, রক্ষা কর।
আর রক্ষে আছে কি? না নেই। ভোলা এখন উঠে এগিয়ে আসছে নগেনের দিকেই। নাহ আর কোন আশা নেই। মরণ নিশ্চিত। কোন সুদুর থেকে ভেসে আসছে, কি মিষ্টি একটা বাঁশীর সুর। কান দিয়ে ঢুকে একেবারে প্রানের ভিতরে সেদিয়ে যাচ্ছে সেই সুর। সামনে মরণ। মরণ কি এই ভাবেই হয়? এমন ভয় লাগে মরণের আগে? এতো সুন্দর বাঁশী বাজে কানে? এ তো সুখের মরণ হবে ওর! ভুলে গেল নগেন মরণের কথা। বাঁশীর আওয়াজ যেন ওকে মোহিত করে দিচ্ছে। অবশ হয়ে যাচ্ছে ওর শরীর। মরণের ভয় টা চলেই গেল বলতে গেলে। মরণের দিকে আর খেয়াল নেই। শুধুই বাঁশী শুনছে নগেন আর ভাবছে এ নিশ্চই পৃথিবীর সুর নয়। এ স্বর্গের সুর। নগেন ওই চার মাথার মোড়ে হাঁটু মুড়ে বসে দুই হাত বাড়িয়ে দিল মরণের দিকে। ভোলা এগিয়ে আসছে নগেনের দিকে কেমন হাতড়াতে হাতড়াতে। যেন দিনেও অন্ধ।
কিন্তু কি যে হল, সহসা ভোলা এদিক ওদিক দেখল। আর সেই দেখার মধ্যে ভয়ের সাথে আতঙ্ক ছিল। আর নগেন দেখল, চারিপাশ টা বদলে গেল। ভোলা মনে হলো ছুটে পালালো লালিদের বাড়ির দিক বরাবর। মুহুর্তে চারিদিক থেকে আগের আওয়াজ ভেসে এলো নগেনের কানে। মনে হলো সুর টা কানের পাশেই বাজছে। নগেন বসেই রইল ওখানে হাঁটু মুড়ে। কি মিষ্টি, কি মিষ্টি। কতক্ষন কেটেছে নগেন জানেই না। শুনতে পেল ওই মন্দিরের বেদী থেকে কেউ একজন বলছে,
- কি গো দাদু, রাস্তার মাঝে ওই ভাবে বসে কেন?
নগেনের যেন ধ্যান ভাঙল। দেখল ভোলা নেই আশে পাশে। পাখির আওয়াজ, আশে পাশের বাড়ি থেকে নানান কোলাহল আবার ভেসে আসছে নগেনের কানে। আগে রাস্তায় একটা লোক ও ছিল না সেখানে দেখল দূরে দূরে লোকজন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। আর মন্দিরের বেদীর উপরে গালে হাত দিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে হীরা। অন্য হাতে একটা বাঁশী। নগেন দাঁড়িয়ে পরল। জিজ্ঞাসা করল,
- বাঁশী তুই বাজাচ্ছিলি?
- ধুর আমি তো বাজাতেই পারি না। এই দেখ।
নগেন দেখল হীরা দু তিন বার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু আজগুবি আওয়াজ ছাড়া কিছুই বের হলো না। বুঝে গেল হীরা বাঁশী বাজায় নি। বলল,
- তুই এখানে কখন এলি?
- কেন ডাকলে যে আমাকে?
নগেন ভারী অবাক হল।
- আমি কখন ডাকলাম তোকে?
হীরার চোখে তখন হাসি। বলল,
- ও হবে হয়ত। আমি তো শুনতে পেলাম তুমি ডাকছিলে। বেশ তবে তাই হোক। এলাম তবে।
নগেন দেখল, সাত ফুট উঁচু মন্দিরের বেদী থেকে মনে হল পা পেয়ে গেল নীচে অব্দি হীরা। কোন আওয়াজ হলো না। নেমেই বলল,
- মায়া বড় খারাপ জিনিস গো দাদু। মায়া কোথা থেকে আসে জান? লোভ। লোভ থাকলে মায়া কে মানুষ বশ করতে পারে না। মায়ার ঢাকা সংসার। শোননি কোনদিন কথাটা?
কথা খানা বলতে বলতেই লালিদের বাড়ির দিকে রাস্তায় হাঁটা দিল। কারন ওই দিকেই ওদের ও বাড়ি। নগেন আর দেরী করল না। মনে এক রাশ চিন্তা আর হতভম্ভতা নিয়ে হীরার পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করল নগেন লালি দের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মনে মনে ঘুরতে লাগল হীরার কথা গুলো। দুপুরে গলি আর এখন মায়া। মায়া??
সন্ধ্যে বেলায় নগেন আর তিন মুর্তি বসে ছিল জলার মাঠের ধারে অশ্বত্থ গাছের নীচে। এতক্ষনে নগেন নিজের চিন্তা ভাবনা আর প্রশ্নের ডালি মেলে ধরেছিল তিন মূর্ত্তির সামনে। শুধু হীরার ব্যাপার টা চেপে গেছিল লালির সামনে। বলে নি হীরার ব্যাপারে কোন কথা। দুপুরে চার মাথার মোড়ের ঘটনা ও বলে নি লালির সামনে। নগেন বোঝে হীরার উপরে লালির বিশেষ দুর্বলতার ব্যাপার টা। তাই কিছু বলে নি। হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা আছে তাতে। লালি হয়ত বিগড়ে গেল। যাক, সে সব ভাবলে এখন চলবে না। বরং গলির ব্যাপার টা খোলসা করতে হবে এখানে। দুপুরে হীরাদের বাড়ির পিছনের ঘটনা সব টাই বলল নগেন তিনজন কে। আর নিজের বিশ্লেষণ ও সব টা জানাল। সব কিছু শুনে লালি বলল,
- দাদু, হীরার কথা যদি সত্য হয় তবে, ভোলা ওই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করে। ওখানে নিশ্চই কোন পোর্ট কী আছে।
- হ্যাঁ আমার ও তাই মনে হচ্ছে। আর তোদের কে বলি, আমার মনে হলো হীরা যেন এটাই বোঝাতে চাইল আমাকে। এমন ভাবেই বোঝালো যেন ও কিছু বোঝে না। কিন্তু ওর ওই গলির মানে উদ্ধার করতে গিয়ে মনে হলো, ওই খানে পোর্ট কী থাকা স্বাভাবিক। তাই ভোলা ওই রাস্তা নেয়।
নগেনের বাক্য শেষ হতে না হতেই রহিম বলল,
- ঠিক বলেছ দাদু। মাথায় আসে নি ব্যাপার টা। সেদিনেও তো আমরা ওই গলি দিয়েই পৌঁছে গেছিলাম লড়াই এর জায়গায় তাই না?
লালি চিন্তায় পরে গেল একটু। ভাবছিল, এটা কি হীরা জেনে বলেছে না ব্যস এমনি ই নিজের বিদ্যে জাহির করেছে। ও বলল,
- হ্যাঁ রহিম দা। ঠিক বলেছ। বাঘমুড়ো ওই দিক দিয়েই ঢোকে গ্রামে। আর এই পোর্ট কী র জন্যেই কবচ টা ভাঙছে। কিন্তু ভোলা কাকার কি হলো?
নগেন বেশ চিন্তা নিয়ে বলল,
- হুম ওটাই চিন্তায় ফেলেছে আমাকে। ভোলার রহস্য উদ্ধার করতেই হবে। তা না হলে কিছুই বোঝা যাবে না। সব শেষ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে এক এক করে বাকি প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে আমাদের। সবার আগে ভোলা কে? আর ওর সাথে বাঘমুড়োর কি সম্পর্ক? ওরা কেনই বা এখানে? বাঘমুড়োই কি ওই পোর্ট কী দিয়ে ঢোকে নাকি অন্য কেউ? বুঝলি??? অনেক কথা পরে আছে। উত্তর চাই । না হলে কিছুই করতে পারব না আমরা।
সবাই চুপ করে ছিল, কারণ এই প্রশ্নের উত্তর কারোর কাছেই নেই। সবাই অল্প বয়সী, শারীরিক ক্ষমতায় বেশ পারদর্শী, কিন্তু বুদ্ধির দৌড়ে এখানে বুড়ো নগেন ই ভরসা। প্রথমে নগেন ই বলল কথা,
- দ্যাখ আমার মনে হচ্ছে আমাদের পোর্ট কী দিয়ে যাওয়া উচিৎ। দেখা দরকার কে যাতায়াত করছে ওই পোর্ট কী দিয়ে? যে আসছে সেই কি বাঘমুড়ো কে সাহায্য করছে? নাকি অন্য কেউ।
অভি চুপ করেছিল অনেকক্ষণ। এবারে প্রথম কথা বলল,
- আমার মনে হয় দাদু ঠিক বলেছে। আমাদের যেতেই হবে না হলে বুঝতে পারব না। তবে আমাদের মনে হয় আমাদের দল টা ভাগ হলে ভাল হয়। রহিম দা দাদু কে নিয়ে থাকুক আর আমি আর লালি দি। আমরা বরং পোর্ট কী ধরে যাই আর রহিম দা আর দাদু থাকুক গ্রামের ভিতরে।
রহিম সব শুনে বলল,
- এটাই ঠিক হবে। তোরা যা। কিন্তু বিপদে আমাদের জানাবি কি করে?
লালি বলল,
- না গো রহিম দা। খুব সন্তপর্নে যেতে হবে আমাদের। কোন লড়াই এ জড়ালে চলবে না। কারণ, বাঘমুড়ো এই গ্রামে এলে তোমাকে থাকতে হবে। দাদু ঠিক বলেছে। কিছু তো আছে এই গ্রামে। সেটা নিতেই ওরা আসছে। আর এখন কবচ ভেঙ্গে গেছে। বাঘমুড়ো ঢুকে পরতে পারে যে কোন সময়ে। আমাদের আর অপেক্ষা করা যাবে না। এখনি যেতে হবে। কালকে জন্মাষ্টমী। বের হতে পারব না আমি বাড়ি থেকে।
তখন নগেন বলল লালি কে,
- না রে দিদি ভাই, তবে আজকে থাক। আমার মন সায় দিচ্ছে না। বরং কালকের দিন টা পার হয়ে যাক।
- হ্যাঁ লালি দি সেই ভাল।
চার জন অসম বয়সী নর নারী নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল, জলার ধারে অশ্বত্থ গাছের নীচে। আর সন্ধ্যের সময়ে গ্রাম থেকে ভেসে আসছিল, শঙ্খের আওয়াজ। গৃহস্থের বাড়িতে সন্ধ্যে দিচ্ছে যে গৃহবধু রা। নগেন তাকিয়ে দেখল পূব আকাশে হালকা চাঁদ। আর পশ্চিম আকাশে জ্বলজ্বল করছে সন্ধ্যা তারা।
অধ্যায় দুই
মাঝে মাঝেই আমার মনে ভেসে ওঠে এই সমস্ত ঘটনা। বুঝিও না ছাই কোথা থেকে আসে এই সব দৃশ্য আর কেনই বা আসে। আমি দেখতে পাচ্ছি একটি কিশোর বালক কে একটি বাগানের মতন মনোরম জায়গা তে। আহা কি নেই সেই বাগানে। আম থেকে শুরু করে ছোট বড় নানান বৃক্ষ। ম ম করছে চারিদিক সুগন্ধি আম এবং অন্যান্য ফলের গন্ধে। ইতিউতি গরুর দল দূর্বা ঘাস এ মজে। যমুনার জল যেন পারে এসে ছুঁতে চাইছে বালক টির পা। ছলাক ছলাক করে পারে ধাক্কা দিচ্ছে জলের ঢেউ। আপনা হতেই ফুল ঝরে পরছে উপর থেকে যেখানে বালক টি দাঁড়িয়ে। আর বালক টি দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল গুলঞ্চ বৃক্ষের তলায়। বিশাল হলেও গাছের ডালপালা যেন নীচে থেকেই বিস্তার লাভ করেছে। আর ছেলেটি তেমন এক বিশাল ডালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দুটো পা কে কাঁচির মতন করে বাঁশী বাজাচ্ছে। যেন জগত ভোলা। আহা পা দুখানি দেখে মনে হয়ে যেন জড়িয়ে ধরি। নীল পদযুগল। রক্তিম পদতল। আলতা পরা পা দু খানি। কার ছেলে কে জানে? সেই মা হয়ত পরম মমতায় ছেলের পা দুখানি আলতায় রাঙ্গিয়ে দিয়েছে। দু খানি রূপোর বালা পায়ের পাতার উপরের অংশে শোভা পাচ্ছে। হলুদ ধুতি পরে আছে বালক টি। তাতে লাল বর্ডার। সামনের কোঁচা টা ময়ূরের পেখমের মতন পায়ের পাতার উপরে দোল খাচ্ছে। কতই বা বয়েস হবে ছেলেটির। ষোল সতের। নীল কমনীয় শরীর। ক্ষীনকায়া নয় বালক টি আবার স্থুল ও নয়। নীল শরীরের পেশী না দেখা গেলেও, সামর্থের শেষ নেই সেটা বোঝাই যাচ্ছে । হুম বুঝেছি। জগতের আরাধ্য, দিন কয়েক আগেই, কংস কে বধ করে গোকুলে ফিরেছে আমাদের নয়নের মনি, যশোদার হৃদপিণ্ড , আর আমারও আরাধ্য স্বয়ং কৃষ্ণ। কে বলবে তার এই সুরের মুর্ছণা শুনে যে, কয়েক দিন আগেই, এই বালক কংস কে হত্যা করেছে? তাও শুধু হাতে? আর সুর তো নয় যেন কথা বলছে ওর বাঁশী। যেন ডাকছে সবাই কে। কেউ কি আছে এই গোকুল এ, এই বাঁশী শুনে নিজেকে সমর্পণ করে দেবে না ওই পায়ের তলায়? কে বলে রাধা পাগল ছিল বাঁশীর জন্য? সুর শুনে তো মনে হচ্ছে, বাঁশী ই আকুল হয়ে রাধা কে ডাকছে।
আর হয়ত ও থাকবে না ও এই বৃন্দাবনে। সমগ্র বৃন্দাবন, গত মাস থেকে কি যে দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত, তা বলে বোঝাতে পারা যাবে না। ছেলে আমাদের গেছিল মথুরা তে। মহারাজ কংস ডেকে পাঠিয়েছিলেন যে। ছেলেও এক ডাকেই চলে গেছিল। তারপরে তো যা হয়েছে, না জানি কত লক্ষ বছর ধরে মানব ইতিহাসে এই ঘটনা লেখা হয়ে থাকবে উজ্জ্বল হয়ে। খেলার ছলে বিশালাকার, মহাবীর, কংস কে সম্মুখ দ্বন্দ্ব যুদ্ধে হত্যা করেছে এই বালক। কে বলবে সেটা এখন ওকে দেখে, যে এই বালক ই সংহার করেছে কংস কে। তাই সেই আনন্দে, গত কাল, মথুরায় হোলি খেলার পরে, ঠিক পাঁচ দিনের দিন সে মথুরা থেকে ফিরে হোলি খেলেছে সমস্ত বৃন্দাবনে। সকাল থেকে রাত অব্দি। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দুষ্টুমি করেছে। প্রতিটা রাস্তায়, প্রতিটা অলিতে গলি তে, প্রতিটা পুকুরের ঘাটে, প্রতিটা গাছের পাতায় আবিরের রং লেগে এখনো। সমগ্র বৃন্দাবণে ছেলের স্পর্শ। আহা খেলার পরে গোকুলের কেউ স্নান ও করে নি। কেউ যে মুছে ফেলতে চায় না তাদের কানাই এর শেষ স্মৃতি টুকু। আর দেখ, যাকে নিয়ে এই পাগলামী , সে সকাল সকাল স্নান করে এসে এই গাছে তলায় দাঁড়িয়ে। হয়ত সে চায় না এই বৃন্দাবনের স্মৃতি নিয়ে মথুরাতে ফিরতে। হয়ত সে চায় না তার পরবর্তী জীবন এর সাথে আর বৃন্দাবন কে জড়াতে। কি জানি, কি লীলায় মেতেছে দুষ্টু টা। এই দেখনা , গোটা বৃন্দাবন এখন শোকে মগ্ন, আর ইনি এখানে এসে হাজির। কারোর অপেক্ষায় বাঁশী বাজাচ্ছে। ডাকছে তাকে করুণ ভাবে। কে সেই ভাগ্যবান যার অপেক্ষায় স্বয়ং সময়? বা কে সেই জন যার অপেক্ষায় শেষ বাঁশী বাজিয়ে নিচ্ছেন সর্বশক্তিমান এই পুরুষ?