26-06-2022, 08:19 AM
স্যারের কথা মনে পড়ে খুব। একদিন ক্লাসে তিনি বলেছিলেন : ' মেধা, শ্রম আর আত্মবিশ্বাস থাকলে একজন পঙ্গুও এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পারে। ... মনে রেখো, ঝড়ে-বাতাসে লতা নুয়ে পড়ে, কিন্তু পাহাড় থাকে অবিচল।... চোখের জল দিয়ে কিছু হয় না। ওটা জলের অপচয়।'
অনেকটা নীচে নেমে এসেছি। পথে কোনো অন্ধ রেপিস্ট চোখে পড়েনি। কেবল দুটি একটি টালমাটাল মদ্যপের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এখানকার পাহাড়, নদী, ঝর্ণা ও সারি সারি পাইনগাছের মতো এইসব মদ্যপ যুবা ও বৃদ্ধেরাও আমাকে চেনে। আমার চোখের ভাষা জানে। আমার শরীরের গন্ধকে ওরা সমীহ করে, ভালোবাসে।
অন্ধকারে হঠাৎ চোখে পড়ে একটা আলো পাহাড় বেয়ে দ্রুত উঠে আসছে উপরের দিকে। হ্যারিকেনের আলো। লোকটার হাতে ভোজালির মতো কী একটা অস্ত্র। আলোটা একেবারে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। অর্জুন!
ভাইটা আমার দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল। এই অন্ধকারে ভোজালি আর লন্ঠন নিয়ে এতটা পথ চলে এসেছে সে। পাছে দিদির কিছু হয়ে যায়! ওর এই ভালোবাসার কাছে পাহাড়ি চিতাও থাবা গুটিয়ে নেয়।
মনে পড়ে, বাড়িতে কেরোসিন বা মোমবাতি না থাকলে অর্জুন মাটির উনুনে একটা করে শুকনো ঝাউপাতা গুঁজে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখত, যতক্ষণ না আমার পড়া শেষ হয়। সেই আগুনের আলোয় আমি পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করতাম। আর ভাই চুপটি করে বসে থাকত আমার পাশে। বাবা মা দুজনেই তখন সারাদিনের পরিশ্রমের পর ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু আমার অনার্স পরীক্ষার আগে অর্জুনের চোখে কোনো ঘুম থাকত না। কখনো জল এনে দিত, কখনো দু একটি কলা, কখনো মুরগির ডিম সেদ্ধ। কিন্তু একটিও শব্দ করত না, পাছে আমার মনোযোগ নষ্ট হয়।
ভাই বলল, বাড়িতে কে একজন এসেছে। সাহেব সাহেব দেখতে। আমার সঙ্গে দেখা করবে বলে সন্ধে থেকে বসে আসে। অনেক বড়ো বড়ো বই এনেছে। মা তাকে চা আর ভুট্টাপোড়া খেতে দিয়েছে।
শুনে খুব অবাক হলাম আমি। মাথার মধ্যে নানা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। স্থানীয় পঞ্চায়েতের কেউ নয়ত? কোনো কাগজের রিপোর্টার এসেছে কি? আগে যেমন দু'একবার এসেছিল! হঠাৎ মাথার মধ্যে অন্য এক বিদ্যুৎ চমকালো। অসম্ভবের বিদ্যুৎ। সাহেব সাহেব দেখতে যখন বলছে ভাই ... স্যার নয়ত? কিন্তু স্যার কেনই বা আসবেন? কালই তো দেখা হল। কথাও হল। তাছাড়া বি এম স্যার আমার এই বস্তির বাড়ির ঠিকানাও জানেন না। তাহলে কে হতে পারে?
খুব দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে ঘরে ফিরতেই দরজার বাইরে চোখে পড়ল একজোড়া ঝকঝকে ডিপ ব্রাউন কালারের শ্যু। খুব চেনা আমার। কালই তো এই জুতোয় আমার দুহাতের দশ আঙুল ছুঁইয়ে প্রণাম করেছি।
ঘরে ঢুকে দেখলাম, আমাদের দড়ির খাটিয়ায় স্যার বসে আছেন। মা-বাবার সঙ্গে কথা বলছেন। যেন কতকালের চেনা। পাশে একটা বড় ব্যাগে অনেকগুলো বই।
স্যার এবার উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন :
'যাক তুমি এসে গেছ! আমি তো ভাবলাম দেখাই হবে না। তোমার বাবা-মা আর ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্প হল। অনেককিছু জানা হল। খুব ভালো লাগল। মনে হল, আমরা প্রত্যেকেই অন্য মানুষ সম্পর্কে কত কম জানি, অথচ পাশাপাশি রয়েছি দীর্ঘকাল।'
আমার তখন বুকের ভিতরে তোলপাড় চলছে। যেন ডিসেম্বরের সমস্ত পাহাড় জুড়ে তুষার-ঝড় শুরু হয়ে গেছে। আমি যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্যার নিজে এসেছেন আমাদের এই বিষণ্ণ-মলিন ভাঙাচোরা পাহাড়ি বস্তির ঘরে?
স্যার তাঁর বইভর্তি ব্যাগ থেকে প্রায় একই আকৃতির সমস্ত বই একে একে বের করে আমাকে দেখিয়ে বললেন :
' শোনো জাগরী, আমার এই রবীন্দ্ররচনাবলীর পুরো সেটটা তোমাকে দিয়ে গেলাম।.... আর একটা কথা, সেটা অবশ্য তোমাকে কালই বলতে পারতাম... আমি আগামী সপ্তাহেই তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছি দিল্লিতে। ওখানকার একটা ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক এসেছে। ওটা আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়। Alma mater. অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়াসে দাঁড়িয়ে পড়াব।....
তোমার বাবার কাছে আমার সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর দিয়ে গেলাম। প্রয়োজন হলে ফোন কোরো। কোনো অসুবিধে হলে জানিও। আমি যতটা সম্ভব সলভ করার চেষ্টা করব।...
আমার ধারণা যদি খুব ভুল না হয়ে থাকে, তুমি ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাচ্ছো। আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো।'
স্যার স্বাভাবিক স্বরেই কথা বলছিলেন। কিন্তু আমি আর নিজেকে সংযত করে রাখতে পারছিলাম না। বুকের ভিতর থেকে পুঞ্জীভূত আবেগের বাষ্প আমার চোখের সমস্ত কূল ছাপিয়ে নোনা জল হয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল বুকের জামায়। স্যার সস্নেহে আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললেন : ' বোকা মেয়ে, তুমি তো এত দুর্বল নও। কাঁদছ কেন এভাবে? মনকে শক্ত করো। জীবনে এখনো অনেক পরীক্ষা বাকি তোমার। অনেক হার্ডলস। সব বাধা পার হতে হবে তোমাকে। অনেক বড় হতে হবে। অনেক উপরে উঠবে তুমি। আর সেটাই হবে তোমার সমস্ত অপমানের জবাব।'
সেই মুহূর্তে আমি মনে মনে বলছিলাম : 'আমি আর কোনো পরীক্ষায় বসব না স্যার। আমি আর বড় হতে চাই না। আপনি কেন চলে যাবেন আমাদের ছেড়ে... আমাকে ছেড়ে?'
কিন্তু স্যারকে এসব কিছুই বলতে পারিনি আমি। কী করে বলব : আপনি আমার সেই দেবতা, যিনি ঘন অন্ধকারের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে এসে আমার হাত ধরেছেন। আমাদের নিভে যাওয়া লন্ঠনে নতুন করে আলো জ্বেলে দিয়েছেন। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন।
ততক্ষণে বাবা-মাকে নমস্কার জানিয়ে অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তায় উঠে আমাদের দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছেন তিনি। আমি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি সেই হিমার্ত অন্ধকারের দিকে। তারপর ঝিম মেরে বসে থাকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রবীন্দ্ররচনাবলীর মাঝখানে।
আরো গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি মোমবাতির আলোর সামনে এক এক করে উল্টে যাই রচনাবলীর প্রতিটি খণ্ড। রাজর্ষি, গোরা, চার অধ্যায়, শেষের কবিতা, শ্যামা, চণ্ডালিকা, তাসের দেশ, সোনার তরী, মহুয়া, সভ্যতার সংকট... আহা কত প্রিয় সব লেখা।
কত কষ্ট করে এতদিন লাইব্রেরি থেকে চেয়েচিন্তে, স্যারদের কাছ থেকে ধার চেয়ে এসব বই পড়েছি আমি। আর আজ মেঘ না চাইতেই বন্যা। আজ সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ আমার হাতের মুঠোয়। আমার বুকের পাঁজরে, মনের মণিহর্ম্যে এসে ধরা দিয়েছেন সেই অচিন পাখির মতো, যাঁকে কখনো পুরোপুরি ধরা যায় না।... এই বইগুলোয় স্যারের সোনালি আঙুলের স্পর্শ লেগে আছে। তাঁর দু'চোখের নরম দৃষ্টি লেগে আছে।
অনেকটা নীচে নেমে এসেছি। পথে কোনো অন্ধ রেপিস্ট চোখে পড়েনি। কেবল দুটি একটি টালমাটাল মদ্যপের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এখানকার পাহাড়, নদী, ঝর্ণা ও সারি সারি পাইনগাছের মতো এইসব মদ্যপ যুবা ও বৃদ্ধেরাও আমাকে চেনে। আমার চোখের ভাষা জানে। আমার শরীরের গন্ধকে ওরা সমীহ করে, ভালোবাসে।
অন্ধকারে হঠাৎ চোখে পড়ে একটা আলো পাহাড় বেয়ে দ্রুত উঠে আসছে উপরের দিকে। হ্যারিকেনের আলো। লোকটার হাতে ভোজালির মতো কী একটা অস্ত্র। আলোটা একেবারে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। অর্জুন!
ভাইটা আমার দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল। এই অন্ধকারে ভোজালি আর লন্ঠন নিয়ে এতটা পথ চলে এসেছে সে। পাছে দিদির কিছু হয়ে যায়! ওর এই ভালোবাসার কাছে পাহাড়ি চিতাও থাবা গুটিয়ে নেয়।
মনে পড়ে, বাড়িতে কেরোসিন বা মোমবাতি না থাকলে অর্জুন মাটির উনুনে একটা করে শুকনো ঝাউপাতা গুঁজে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখত, যতক্ষণ না আমার পড়া শেষ হয়। সেই আগুনের আলোয় আমি পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করতাম। আর ভাই চুপটি করে বসে থাকত আমার পাশে। বাবা মা দুজনেই তখন সারাদিনের পরিশ্রমের পর ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু আমার অনার্স পরীক্ষার আগে অর্জুনের চোখে কোনো ঘুম থাকত না। কখনো জল এনে দিত, কখনো দু একটি কলা, কখনো মুরগির ডিম সেদ্ধ। কিন্তু একটিও শব্দ করত না, পাছে আমার মনোযোগ নষ্ট হয়।
ভাই বলল, বাড়িতে কে একজন এসেছে। সাহেব সাহেব দেখতে। আমার সঙ্গে দেখা করবে বলে সন্ধে থেকে বসে আসে। অনেক বড়ো বড়ো বই এনেছে। মা তাকে চা আর ভুট্টাপোড়া খেতে দিয়েছে।
শুনে খুব অবাক হলাম আমি। মাথার মধ্যে নানা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। স্থানীয় পঞ্চায়েতের কেউ নয়ত? কোনো কাগজের রিপোর্টার এসেছে কি? আগে যেমন দু'একবার এসেছিল! হঠাৎ মাথার মধ্যে অন্য এক বিদ্যুৎ চমকালো। অসম্ভবের বিদ্যুৎ। সাহেব সাহেব দেখতে যখন বলছে ভাই ... স্যার নয়ত? কিন্তু স্যার কেনই বা আসবেন? কালই তো দেখা হল। কথাও হল। তাছাড়া বি এম স্যার আমার এই বস্তির বাড়ির ঠিকানাও জানেন না। তাহলে কে হতে পারে?
খুব দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে ঘরে ফিরতেই দরজার বাইরে চোখে পড়ল একজোড়া ঝকঝকে ডিপ ব্রাউন কালারের শ্যু। খুব চেনা আমার। কালই তো এই জুতোয় আমার দুহাতের দশ আঙুল ছুঁইয়ে প্রণাম করেছি।
ঘরে ঢুকে দেখলাম, আমাদের দড়ির খাটিয়ায় স্যার বসে আছেন। মা-বাবার সঙ্গে কথা বলছেন। যেন কতকালের চেনা। পাশে একটা বড় ব্যাগে অনেকগুলো বই।
স্যার এবার উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন :
'যাক তুমি এসে গেছ! আমি তো ভাবলাম দেখাই হবে না। তোমার বাবা-মা আর ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্প হল। অনেককিছু জানা হল। খুব ভালো লাগল। মনে হল, আমরা প্রত্যেকেই অন্য মানুষ সম্পর্কে কত কম জানি, অথচ পাশাপাশি রয়েছি দীর্ঘকাল।'
আমার তখন বুকের ভিতরে তোলপাড় চলছে। যেন ডিসেম্বরের সমস্ত পাহাড় জুড়ে তুষার-ঝড় শুরু হয়ে গেছে। আমি যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্যার নিজে এসেছেন আমাদের এই বিষণ্ণ-মলিন ভাঙাচোরা পাহাড়ি বস্তির ঘরে?
স্যার তাঁর বইভর্তি ব্যাগ থেকে প্রায় একই আকৃতির সমস্ত বই একে একে বের করে আমাকে দেখিয়ে বললেন :
' শোনো জাগরী, আমার এই রবীন্দ্ররচনাবলীর পুরো সেটটা তোমাকে দিয়ে গেলাম।.... আর একটা কথা, সেটা অবশ্য তোমাকে কালই বলতে পারতাম... আমি আগামী সপ্তাহেই তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছি দিল্লিতে। ওখানকার একটা ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক এসেছে। ওটা আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়। Alma mater. অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়াসে দাঁড়িয়ে পড়াব।....
তোমার বাবার কাছে আমার সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর দিয়ে গেলাম। প্রয়োজন হলে ফোন কোরো। কোনো অসুবিধে হলে জানিও। আমি যতটা সম্ভব সলভ করার চেষ্টা করব।...
আমার ধারণা যদি খুব ভুল না হয়ে থাকে, তুমি ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাচ্ছো। আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো।'
স্যার স্বাভাবিক স্বরেই কথা বলছিলেন। কিন্তু আমি আর নিজেকে সংযত করে রাখতে পারছিলাম না। বুকের ভিতর থেকে পুঞ্জীভূত আবেগের বাষ্প আমার চোখের সমস্ত কূল ছাপিয়ে নোনা জল হয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল বুকের জামায়। স্যার সস্নেহে আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললেন : ' বোকা মেয়ে, তুমি তো এত দুর্বল নও। কাঁদছ কেন এভাবে? মনকে শক্ত করো। জীবনে এখনো অনেক পরীক্ষা বাকি তোমার। অনেক হার্ডলস। সব বাধা পার হতে হবে তোমাকে। অনেক বড় হতে হবে। অনেক উপরে উঠবে তুমি। আর সেটাই হবে তোমার সমস্ত অপমানের জবাব।'
সেই মুহূর্তে আমি মনে মনে বলছিলাম : 'আমি আর কোনো পরীক্ষায় বসব না স্যার। আমি আর বড় হতে চাই না। আপনি কেন চলে যাবেন আমাদের ছেড়ে... আমাকে ছেড়ে?'
কিন্তু স্যারকে এসব কিছুই বলতে পারিনি আমি। কী করে বলব : আপনি আমার সেই দেবতা, যিনি ঘন অন্ধকারের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে এসে আমার হাত ধরেছেন। আমাদের নিভে যাওয়া লন্ঠনে নতুন করে আলো জ্বেলে দিয়েছেন। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন।
ততক্ষণে বাবা-মাকে নমস্কার জানিয়ে অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তায় উঠে আমাদের দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছেন তিনি। আমি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি সেই হিমার্ত অন্ধকারের দিকে। তারপর ঝিম মেরে বসে থাকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রবীন্দ্ররচনাবলীর মাঝখানে।
আরো গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি মোমবাতির আলোর সামনে এক এক করে উল্টে যাই রচনাবলীর প্রতিটি খণ্ড। রাজর্ষি, গোরা, চার অধ্যায়, শেষের কবিতা, শ্যামা, চণ্ডালিকা, তাসের দেশ, সোনার তরী, মহুয়া, সভ্যতার সংকট... আহা কত প্রিয় সব লেখা।
কত কষ্ট করে এতদিন লাইব্রেরি থেকে চেয়েচিন্তে, স্যারদের কাছ থেকে ধার চেয়ে এসব বই পড়েছি আমি। আর আজ মেঘ না চাইতেই বন্যা। আজ সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ আমার হাতের মুঠোয়। আমার বুকের পাঁজরে, মনের মণিহর্ম্যে এসে ধরা দিয়েছেন সেই অচিন পাখির মতো, যাঁকে কখনো পুরোপুরি ধরা যায় না।... এই বইগুলোয় স্যারের সোনালি আঙুলের স্পর্শ লেগে আছে। তাঁর দু'চোখের নরম দৃষ্টি লেগে আছে।