26-06-2022, 08:17 AM
বাড়ি ফিরে এক একদিন আমার মরে যেতে ইচ্ছে করত। রাতের অন্ধকারে নির্জন পাহাড়ের খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকতাম একা একা। নীচে দূরে জোনাকির মতো আলো জ্বলছে ছোটো ছোটো টোলায় ও বস্তিতে। পাহাড়ের খাঁঁজে খাঁজে সজল অতিথির মতো মেঘের টুকরো থমকে আছে। মৃত্যুর সাত সেন্টিমিটার দূরে দাঁড়িয়ে আমার মনে পড়ত সেই মার্কিন কবির কথা, যিনি লিখেছিলেন :
'Danger hides in beauty and beauty hides in danger.'
এভাবেই আমার আর মরা হয় না। কতবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার কোনো না কোনো কবিতার কথা মনে পড়ে গেছে। পাহাড় থেকে নীচের ঝর্ণায় ঝাঁপ দিতে গিয়ে সহসা পাহাড়ি জ্যোৎস্নার অলৌকিক রূপ থেকে থমকে দাঁড়িয়েছি।
ভেবেছি, কেন মরব আমি? একটা পতঙ্গও তো বাঁচতে চায়। জিপের চাকায় থ্যাঁৎলানো একটা বনবেড়ালও বেঁচে থাকতে চায়। সাংলিং টোলার পঁচাশি বছরের কুষ্ঠরোগাক্রান্ত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীটিও আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে চায়।
তাহলে আমি কেন বারবার মরে যেতে চাইছি এভাবে? শুধু দুটো স্তন নেই বলে? মানুষের মৃত্যুর আগেই যে বস্তুটি যাবতীয় ঐশ্বর্য হারিয়ে মরে যায়!নাকি শুধু গায়ের রং কালো বলে? শুধু দেখতে ভালো নই বলে? শুধু এক অন্ত্যজ অনার্য মেয়ে বলে?
নাকি দিনের পর দিন কয়েকজন ক্লিন্ন রুচির অশিক্ষিত অসুস্থ সহপাঠীর বিকৃত বিদ্রূপের শিকার হয়েছি বলে?
ভাই এসে প্রতিবার মৃত্যুর মুখ থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় আমাকে। মা ব্যাকুল হয়ে জানতে চায় : কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোকে?
তারপর মারাংবুরুর থান থেকে দুটো ফুল নিয়ে এসে আমার মাথায় ছুঁইয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে স্বস্তিমন্ত্র উচ্চারণ করে।
বাবা ঘরের এক কোণে আগুনের পাশে বসে বিষণ্ণ গম্ভীর মুখে মদ খেতে খেতে গলায় ঝোলানো রুপোর ক্রুশে একবার চুম্বন করে, একবার আমাকে দেখে।
পরদিন শুক্রবার। মা বলল : কাল যেতে হবে না ক্লাসে। বাড়িতে শুয়ে থাক। দুটো দিন বিশ্রাম নে। শরীর, মন ভালো হলে যাস।
মা জানে আমার পিরিয়ড চলছে। আজ সেকেন্ড ডে। এসময় প্রচন্ড ব্যথা হয় আমার তলপেটে। কিন্তু কাল আমি ক্লাসে যাবই। বি এম স্যারের ক্লাস আছে। ১০২ জ্বর নিয়েও তাঁর ক্লাসে গেছি আমি।
মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি : গত একবছর ধরে এত বিষণ্ণ অন্ধকারেও আমি যে মরতে পারিনি, সে কি শুধু ওই তরুণ অধ্যাপকের জন্য?
পরদিন শরীর খারাপ নিয়েই ক্লাসে গেলাম। মা একটা কাচের বোতলে ভেষজ ওষুধ মেশানো গরম জল ভরে দিয়েছে। এতে ব্যথা কমে।
দুপুর দেড়টায় বি এম স্যার এলেন। হাতে একটা লম্বা কাগজের তালিকা। গত সপ্তাহে আমাদের ইন্টারনাল এসেসমেন্ট আর ডিসার্টেশান এগজাম হয়েছিল। স্যার এসেই ঘোষণা করলেন : তোমাদের পঁয়ষট্টি জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে জাগরী হেম্বরম। আমাদের কৃষ্ণকলি।
সমস্ত ক্লাস তখন আমার দিকে তাকিয়ে। স্যার নীচে নেমে এসে আমার মাথা ছুঁয়ে খুব প্রশান্ত ভঙ্গীতে বললেন : God bless you. I' m really proud of you.
সেই মুহূর্তে এক অপার্থিব আনন্দে আমার দুচোখ জলে ভরে উঠল। নীচু হয়ে বসে প্রণাম করলাম স্যারকে। মনে মনে ভাবছিলাম : কাল যদি আমি পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতাম তাহলে এই স্বর্গীয় মুহূর্তটি আর দেখা হত না। আমার স্বপ্নের অধ্যাপককেও পা ছুঁয়ে আর প্রণাম করা হত না।
ক্লাসের শেষে ভেরোনিকা আচার্য নামের একটি মেয়ে আমাকে খুব অবাক করে দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল : কংগ্রাচুলেশন!... কাল আমার জন্মদিন। বন্ধুরা সবাই আসবে বাড়িতে। তুমিও এসো। আগে বলা হয়নি তোমাকে। স্যরি।
আমি সচরাচর কারো বাড়িতে যাই না। কেউ ডাকেও না আমাকে। তবু পরদিন সন্ধ্যায় খুঁজে খুঁজে পৌঁছে গেলাম ভেরোনিকাদের বাড়িতে। বিশাল উঁচু প্রাসাদের মতো বাড়ি। দরজায় উর্দি পরা দারোয়ান। দুটো দামি গাড়ি। আলোয় ঝলমল করছে সারা বাড়ি।
ওর মা এসে আলাপ করল : 'তুমিই জাগরী! কী মিষ্টি মেয়ে তুমি! চোখদুটো কী সুন্দর! ওহ মাঃ, এত ঘন কালো এক ঢাল চুল তোমার! শুনেছি পড়াশোনাতেও খুব ব্রিলিয়ান্ট! এসো এসো ভেতরে এসো মা ... '
একটু পরেই ক্লাসের সবাই এসে গেল। সবাই খুব ভালো ব্যবহার করছে। মন্দিরা চ্যাটার্জি আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে খুব উঁচু গলায় বলল : 'এই যে ফার্স্ট গার্ল। তুমি তো ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হচ্ছই। একটু আমাদের দিকেও দেখো। তোমার স্পেশাল নোট-ফোটগুলো আমাদেরও একটু দিও।'
অমনি সবাই উৎসব ভুলে আমাকে ঘিরে ধরল সুসজ্জিত ডাইনিদের মতো। দুদিন আগেও এরা আমাকে পোকামাকড়ের মতো তাচ্ছিল্য করেছে। আর আজ...
আমি তবু সমস্ত অপমান আর বিষ-মাখানো তীরের আঘাত ভুলে গিয়ে বললাম : নিশ্চয়ই দেব। আমার চারটে খাতাই দিয়ে দেব তোমাদের। জেরক্স করে নিও।
সবাই খুব খুশি। শুরু হল নাচ গান হৈ চৈ বিলিতি মিউজিক... মস্ত বড় এক কেক কাটা হলো। ওড়ানো হলো অসংখ্য রঙিন বেলুন। সঙ্গে পান, ভোজন।
অবন্তী বলল : তুই একটু আদিবাসী নাচ করে দেখা। আমরাও তোর সঙ্গে...
আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। দুটি পোড়া মাটির ঘোড়া এনেছিলাম। সেগুলো ভেরোনিকার হাতে তুলে দিয়ে বললাম : চলিরে। অনেক রাত হয়ে গেছে। মা খুব চিন্তা করবে। আমার শরীরটাও আজ ...
ভেরোনিকা বলল : তোমার জন্য একটা রিটার্ন গিফট আছে। সবার জন্যই কিছু না কিছু আছে।
বলে একটা রঙিন কাগজে মোড়া প্যাকেট আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল : সাবধানে যেও। অন্ধকার রাস্তা। তোমাকে তো আবার বাস থেকে নেমে অনেকটা পথ পাহাড় বেয়ে নীচে নামতে হবে হেঁটে।'
মন্দিরা তার পার্লার-চর্চিত মুখে বিস্তর বিস্ময় ফুটিয়ে বলল : 'এত রাত্রে ওই অন্ধকার পাহাড়ি বস্তিতে ফিরবে! বি কেয়ারফুল বেবি। আজকাল যা রেপ টেপ হচ্ছে চারদিকে... '
আমি তখন ডোরম্যাটের পাশে রাখা আমার মলিন জুতোর ফিতে বাঁধছিলাম নীচু হয়ে। হঠাৎ কানে এল, বিম্বিসার সেনগুপ্ত নামের একটি বেঁটেখাটো গোলগাল ছেলে মন্দিরার কানে কানে নীচুস্বরে বলছে : 'আরে ভয় নেই তোর, অন্ধ আর পাঁড় মাতাল ছাড়া কেউ ওকে রেপ করবে না।'
বলে দুজনেরই সে কী হাসি। সেই অশ্লীল হাসিতে মুহূর্তেই নোংরা হয়ে গেল জন্মদিনের উল্লাস ও আনন্দ। খুব মনখারাপ হয়ে গেল আমার। অপমানিত কালো শরীরটা টানতে টানতে বাসস্টপে এসে দাঁড়ালাম।
বাস থেকে নেমে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অন্ধকার পথ ধরে বস্তির দিকে যেতে যেতে হঠাৎ কী এক অবরুদ্ধ আবেগে আর যন্ত্রণায় আমার সারা শরীর চাবুক-খাওয়া বোবা বালিকার মতো আর্তনাদ করে উঠল।
বিম্বিসারের কথাগুলো মনে পড়ছিল। তার আর মন্দিরার সেই অশ্লীল বিদ্রূপের হাসি যেন ঝাউবনের বাতাসে চক্রাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। ডানহাতের তালু দিয়ে দুচোখের জল মুছে নিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করি : নির্জন রাস্তায় আজীবন রেপড হতে পারার সম্ভাবনা বয়ে বেড়ানোটাও কি মেয়েদের যোগ্যতার মধ্যে পড়ে? যা আমার নেই?
জীবনের প্রতি মুহূর্তে কামুক ও রূপমুগ্ধ লম্পট পুরুষের লালা ঝরতে দেখাটাও কি মেয়েদের কাছে খুব গৌরবের বিষয়? যে গৌরব আমার নেই!
এসব ভাবতে ভাবতে চোখের জল শুকিয়ে আসে। ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসের মধ্যেও দু-চোখ দিয়ে আগুনের হলকা বেরোতে থাকে আমার। সেই আগুনের মধ্যে থেকে উড়ে আসে হাজার হাজার রাতচরা পাখি, যাদের এক চোখে ঘৃণা, অন্যচোখে করুণা।
'Danger hides in beauty and beauty hides in danger.'
এভাবেই আমার আর মরা হয় না। কতবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার কোনো না কোনো কবিতার কথা মনে পড়ে গেছে। পাহাড় থেকে নীচের ঝর্ণায় ঝাঁপ দিতে গিয়ে সহসা পাহাড়ি জ্যোৎস্নার অলৌকিক রূপ থেকে থমকে দাঁড়িয়েছি।
ভেবেছি, কেন মরব আমি? একটা পতঙ্গও তো বাঁচতে চায়। জিপের চাকায় থ্যাঁৎলানো একটা বনবেড়ালও বেঁচে থাকতে চায়। সাংলিং টোলার পঁচাশি বছরের কুষ্ঠরোগাক্রান্ত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীটিও আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে চায়।
তাহলে আমি কেন বারবার মরে যেতে চাইছি এভাবে? শুধু দুটো স্তন নেই বলে? মানুষের মৃত্যুর আগেই যে বস্তুটি যাবতীয় ঐশ্বর্য হারিয়ে মরে যায়!নাকি শুধু গায়ের রং কালো বলে? শুধু দেখতে ভালো নই বলে? শুধু এক অন্ত্যজ অনার্য মেয়ে বলে?
নাকি দিনের পর দিন কয়েকজন ক্লিন্ন রুচির অশিক্ষিত অসুস্থ সহপাঠীর বিকৃত বিদ্রূপের শিকার হয়েছি বলে?
ভাই এসে প্রতিবার মৃত্যুর মুখ থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় আমাকে। মা ব্যাকুল হয়ে জানতে চায় : কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোকে?
তারপর মারাংবুরুর থান থেকে দুটো ফুল নিয়ে এসে আমার মাথায় ছুঁইয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে স্বস্তিমন্ত্র উচ্চারণ করে।
বাবা ঘরের এক কোণে আগুনের পাশে বসে বিষণ্ণ গম্ভীর মুখে মদ খেতে খেতে গলায় ঝোলানো রুপোর ক্রুশে একবার চুম্বন করে, একবার আমাকে দেখে।
পরদিন শুক্রবার। মা বলল : কাল যেতে হবে না ক্লাসে। বাড়িতে শুয়ে থাক। দুটো দিন বিশ্রাম নে। শরীর, মন ভালো হলে যাস।
মা জানে আমার পিরিয়ড চলছে। আজ সেকেন্ড ডে। এসময় প্রচন্ড ব্যথা হয় আমার তলপেটে। কিন্তু কাল আমি ক্লাসে যাবই। বি এম স্যারের ক্লাস আছে। ১০২ জ্বর নিয়েও তাঁর ক্লাসে গেছি আমি।
মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি : গত একবছর ধরে এত বিষণ্ণ অন্ধকারেও আমি যে মরতে পারিনি, সে কি শুধু ওই তরুণ অধ্যাপকের জন্য?
পরদিন শরীর খারাপ নিয়েই ক্লাসে গেলাম। মা একটা কাচের বোতলে ভেষজ ওষুধ মেশানো গরম জল ভরে দিয়েছে। এতে ব্যথা কমে।
দুপুর দেড়টায় বি এম স্যার এলেন। হাতে একটা লম্বা কাগজের তালিকা। গত সপ্তাহে আমাদের ইন্টারনাল এসেসমেন্ট আর ডিসার্টেশান এগজাম হয়েছিল। স্যার এসেই ঘোষণা করলেন : তোমাদের পঁয়ষট্টি জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে জাগরী হেম্বরম। আমাদের কৃষ্ণকলি।
সমস্ত ক্লাস তখন আমার দিকে তাকিয়ে। স্যার নীচে নেমে এসে আমার মাথা ছুঁয়ে খুব প্রশান্ত ভঙ্গীতে বললেন : God bless you. I' m really proud of you.
সেই মুহূর্তে এক অপার্থিব আনন্দে আমার দুচোখ জলে ভরে উঠল। নীচু হয়ে বসে প্রণাম করলাম স্যারকে। মনে মনে ভাবছিলাম : কাল যদি আমি পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতাম তাহলে এই স্বর্গীয় মুহূর্তটি আর দেখা হত না। আমার স্বপ্নের অধ্যাপককেও পা ছুঁয়ে আর প্রণাম করা হত না।
ক্লাসের শেষে ভেরোনিকা আচার্য নামের একটি মেয়ে আমাকে খুব অবাক করে দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল : কংগ্রাচুলেশন!... কাল আমার জন্মদিন। বন্ধুরা সবাই আসবে বাড়িতে। তুমিও এসো। আগে বলা হয়নি তোমাকে। স্যরি।
আমি সচরাচর কারো বাড়িতে যাই না। কেউ ডাকেও না আমাকে। তবু পরদিন সন্ধ্যায় খুঁজে খুঁজে পৌঁছে গেলাম ভেরোনিকাদের বাড়িতে। বিশাল উঁচু প্রাসাদের মতো বাড়ি। দরজায় উর্দি পরা দারোয়ান। দুটো দামি গাড়ি। আলোয় ঝলমল করছে সারা বাড়ি।
ওর মা এসে আলাপ করল : 'তুমিই জাগরী! কী মিষ্টি মেয়ে তুমি! চোখদুটো কী সুন্দর! ওহ মাঃ, এত ঘন কালো এক ঢাল চুল তোমার! শুনেছি পড়াশোনাতেও খুব ব্রিলিয়ান্ট! এসো এসো ভেতরে এসো মা ... '
একটু পরেই ক্লাসের সবাই এসে গেল। সবাই খুব ভালো ব্যবহার করছে। মন্দিরা চ্যাটার্জি আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে খুব উঁচু গলায় বলল : 'এই যে ফার্স্ট গার্ল। তুমি তো ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হচ্ছই। একটু আমাদের দিকেও দেখো। তোমার স্পেশাল নোট-ফোটগুলো আমাদেরও একটু দিও।'
অমনি সবাই উৎসব ভুলে আমাকে ঘিরে ধরল সুসজ্জিত ডাইনিদের মতো। দুদিন আগেও এরা আমাকে পোকামাকড়ের মতো তাচ্ছিল্য করেছে। আর আজ...
আমি তবু সমস্ত অপমান আর বিষ-মাখানো তীরের আঘাত ভুলে গিয়ে বললাম : নিশ্চয়ই দেব। আমার চারটে খাতাই দিয়ে দেব তোমাদের। জেরক্স করে নিও।
সবাই খুব খুশি। শুরু হল নাচ গান হৈ চৈ বিলিতি মিউজিক... মস্ত বড় এক কেক কাটা হলো। ওড়ানো হলো অসংখ্য রঙিন বেলুন। সঙ্গে পান, ভোজন।
অবন্তী বলল : তুই একটু আদিবাসী নাচ করে দেখা। আমরাও তোর সঙ্গে...
আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। দুটি পোড়া মাটির ঘোড়া এনেছিলাম। সেগুলো ভেরোনিকার হাতে তুলে দিয়ে বললাম : চলিরে। অনেক রাত হয়ে গেছে। মা খুব চিন্তা করবে। আমার শরীরটাও আজ ...
ভেরোনিকা বলল : তোমার জন্য একটা রিটার্ন গিফট আছে। সবার জন্যই কিছু না কিছু আছে।
বলে একটা রঙিন কাগজে মোড়া প্যাকেট আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল : সাবধানে যেও। অন্ধকার রাস্তা। তোমাকে তো আবার বাস থেকে নেমে অনেকটা পথ পাহাড় বেয়ে নীচে নামতে হবে হেঁটে।'
মন্দিরা তার পার্লার-চর্চিত মুখে বিস্তর বিস্ময় ফুটিয়ে বলল : 'এত রাত্রে ওই অন্ধকার পাহাড়ি বস্তিতে ফিরবে! বি কেয়ারফুল বেবি। আজকাল যা রেপ টেপ হচ্ছে চারদিকে... '
আমি তখন ডোরম্যাটের পাশে রাখা আমার মলিন জুতোর ফিতে বাঁধছিলাম নীচু হয়ে। হঠাৎ কানে এল, বিম্বিসার সেনগুপ্ত নামের একটি বেঁটেখাটো গোলগাল ছেলে মন্দিরার কানে কানে নীচুস্বরে বলছে : 'আরে ভয় নেই তোর, অন্ধ আর পাঁড় মাতাল ছাড়া কেউ ওকে রেপ করবে না।'
বলে দুজনেরই সে কী হাসি। সেই অশ্লীল হাসিতে মুহূর্তেই নোংরা হয়ে গেল জন্মদিনের উল্লাস ও আনন্দ। খুব মনখারাপ হয়ে গেল আমার। অপমানিত কালো শরীরটা টানতে টানতে বাসস্টপে এসে দাঁড়ালাম।
বাস থেকে নেমে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অন্ধকার পথ ধরে বস্তির দিকে যেতে যেতে হঠাৎ কী এক অবরুদ্ধ আবেগে আর যন্ত্রণায় আমার সারা শরীর চাবুক-খাওয়া বোবা বালিকার মতো আর্তনাদ করে উঠল।
বিম্বিসারের কথাগুলো মনে পড়ছিল। তার আর মন্দিরার সেই অশ্লীল বিদ্রূপের হাসি যেন ঝাউবনের বাতাসে চক্রাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। ডানহাতের তালু দিয়ে দুচোখের জল মুছে নিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করি : নির্জন রাস্তায় আজীবন রেপড হতে পারার সম্ভাবনা বয়ে বেড়ানোটাও কি মেয়েদের যোগ্যতার মধ্যে পড়ে? যা আমার নেই?
জীবনের প্রতি মুহূর্তে কামুক ও রূপমুগ্ধ লম্পট পুরুষের লালা ঝরতে দেখাটাও কি মেয়েদের কাছে খুব গৌরবের বিষয়? যে গৌরব আমার নেই!
এসব ভাবতে ভাবতে চোখের জল শুকিয়ে আসে। ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসের মধ্যেও দু-চোখ দিয়ে আগুনের হলকা বেরোতে থাকে আমার। সেই আগুনের মধ্যে থেকে উড়ে আসে হাজার হাজার রাতচরা পাখি, যাদের এক চোখে ঘৃণা, অন্যচোখে করুণা।