26-06-2022, 08:15 AM
*রবীন্দ্ররচনাবলী ও একটি পুড়ে যাওয়া ব্রেসিয়ার*
*উ ত্ত ম দ ত্ত*
কলেজের সমস্ত পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি আমি। কলেজেও আগুন আগুন মার্কশিট ছিল। কাগজে, দূরদর্শনে কিছুদিন হৈচৈ হয়েছিল। তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্লাসরুমে কেউ ভালোবেসে আমার পাশে বসতে চায়নি একদিনও।
সমস্ত ফার্স্ট বেঞ্চ দখল করে বসে থাকত সোনালি মেয়েরা। ঠিক পিছনের বেঞ্চে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব বাতিস্তম্ভ ছিল। শুধু আমারই কোনো প্রেমিক ছিল না। কোনো বাতিঘর ছিল না।
কেবল একজন ছাড়া বাকি অধ্যাপকেরাও ছিলেন আশ্চর্য রূপমুগ্ধ। ফার্স্টবেঞ্চের বাইরে যেন আর কোনও ছাত্রছাত্রী নেই। আমার দিকে তাঁরা ফিরেও তাকাতেন না।
লাস্ট বেঞ্চের এক কোণে একা একা বসে থাকতাম আমি। ক্লাসনোট নিতাম। স্যারেরা বিরক্ত হবেন জেনেও মাঝে মাঝে দুটি একটি প্রশ্ন করতাম। আর কখনো মন খারাপ হলে ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে দেখতাম, দূরের পাহাড়, ঝাউবন... নীল কুয়াশায় ঢাকা আমাদের লিমা বস্তি।
মনে হত দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, ভুট্টাখেতে কাজ করছে আমার বাবা। চা বাগান থেকে ফিরে মা রাইশাক আর বুনো মাশরুম তুলে কোঁচড়ে বেঁধে রাখছে। ছোটো ভাই অর্জুন একপাশে গুলতি আর তীর-ধনুক নামিয়ে রেখে মাছিদের সঙ্গে
পান্তাভাত খাচ্ছে নিশ্চিন্ত আরামে।
সামনে কদমফুলের মতো ১১ টা ছোটো-ছোটো বাচ্চা নিয়ে চরে বেড়াচ্ছে লাইলং নামের চিনা মুরগিটা। ভাইয়ের একটাই ভয়, কখন বেজি অথবা চিল এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে ফুটফুটে বাচ্চাগুলোকে।
কালো রোগা বাংরি নদীর মতো নিরিবিলি সাঁওতাল মেয়ে আমি। স্তন নেই। ছোটোবেলায় জ্বলন্ত মাটির উনুনে পড়ে গিয়ে স্তনগ্রন্থি পুড়ে গিয়েছিল আমার। তিনদিন জ্ঞান ছিল না। মা বলত, তোর বুকে আর দুধ আসবে না।
আমি মায়ের কথায় হাসতাম। দুধ দিয়ে কী হবে মা? সে তো বাজারেই কিনতেই পাওয়া যায় ।
আমার কথা শুনে ঝাউবনের মাথায় বৃষ্টি নামত। লালঝুঁটি মোরগেরা মাটিতে ছিটিয়ে দেওয়া রেশনের গম খেতে খেতে একবার মুখ তুলে দেখত। তারপর : 'কঁকরো-ক্রো- ক্রোঁওওও' বলে ডানা ঝাপটে পাহাড়ের গায়ে প্রবল প্রতিধ্বনি তুলে দিত।
তখন কি জানতাম, মেয়েদের মাথার চাইতে স্তনের দাম এত বেশি? মেধার চাইতে গায়ের রঙ আর নিতম্বের গঠন এত গুরুত্বপূর্ণ? উজ্জ্বল মার্কশিটের চাইতে সুন্দর মুখশ্রী এত ম্যাগনেটিক?
ছেলে বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত আড়ালে। যেদিন শুধু কচুর শাক খেয়ে ক্লাসে আসতাম সেদিনও ওরা আমার গায়ে ইঁদুর-পোড়া গন্ধ পেত। যেদিন শুধু ঘাটো সেদ্ধ খেয়ে অথবা উপোস করে ক্লাসরুমে গিয়ে বসতাম সেদিনও ওরা আমার ওড়নায় সাপের মাংস আর বাসি হাঁড়িয়ার দুর্গন্ধ পেত।
আড়চোখে একবার আমার ফ্ল্যাট বুক দেখে নিয়ে
চর্যাপদের প্যারডি করে বলত : 'নীচু নীচু পাবত তহি বসহি শবরী বালি।'
শুধু ওই এক তরুণ অধ্যাপক, ধর্মে ক্রিশ্চিয়ান, দেবতাদের মতো রূপবান পুরুষ, একমাথা ঈষৎ সোনালি আর কোঁকড়ানো চুল, শুধু শুক্রবারেই যাঁর ক্লাস থাকত, আমার সহপাঠিনীরা প্রতিদিন যাঁর প্রেমে পড়ত, তিনি ক্লাসে এসেই একেবারে শেষ থেকে শুরু করতেন : ' কৃষ্ণকলি, আজ কেমন আছো? গত শুক্রবার কোনখানে শেষ করেছিলাম, মনে আছে?'
আমি উঠে দাঁড়িয়ে স্যারের প্রশ্নের উত্তর দিতাম। আর সমস্ত ক্লাসের চোখ ঘাড় বাঁকিয়ে আমাকে দেখত। কেউ মুচকি হাসত, কেউ চোখ মেরে অসভ্য ইঙ্গিত করত।
স্যার আমাকে কৃষ্ণকলি বলে ডাকলে আমার ভীষণ লজ্জা করত। ভালোও লাগত। মনে মনে গেয়ে উঠতাম :
'এমনি করে কালো কাজল মেঘ
জৈষ্ঠ্যমাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ়্মাসে নামে তমাল বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।'
ক্লাসের শেষে মেয়েরা টিপ্পনি কাটত :
গরুর গাড়ির আবার হেডলাইট!
জাঙিয়ার আবার বুকপকেট!
গুপ্তকেশের আবার ইউ ছাঁট!
ছেলেরা সেসব শুনে হাসতে হাসতে ঘাসের উপরে গড়িয়ে পড়ে বলত :
লেজ নাই কুত্তির টাইগ্রেস নাম!
আরশোলা আবার পাখি!
নিমাইয়ের নাম কৃষ্ণকলি!
বাঁজার ভ্যানিটি ব্যাগে আবার কনডোম!
*উ ত্ত ম দ ত্ত*
কলেজের সমস্ত পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি আমি। কলেজেও আগুন আগুন মার্কশিট ছিল। কাগজে, দূরদর্শনে কিছুদিন হৈচৈ হয়েছিল। তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্লাসরুমে কেউ ভালোবেসে আমার পাশে বসতে চায়নি একদিনও।
সমস্ত ফার্স্ট বেঞ্চ দখল করে বসে থাকত সোনালি মেয়েরা। ঠিক পিছনের বেঞ্চে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব বাতিস্তম্ভ ছিল। শুধু আমারই কোনো প্রেমিক ছিল না। কোনো বাতিঘর ছিল না।
কেবল একজন ছাড়া বাকি অধ্যাপকেরাও ছিলেন আশ্চর্য রূপমুগ্ধ। ফার্স্টবেঞ্চের বাইরে যেন আর কোনও ছাত্রছাত্রী নেই। আমার দিকে তাঁরা ফিরেও তাকাতেন না।
লাস্ট বেঞ্চের এক কোণে একা একা বসে থাকতাম আমি। ক্লাসনোট নিতাম। স্যারেরা বিরক্ত হবেন জেনেও মাঝে মাঝে দুটি একটি প্রশ্ন করতাম। আর কখনো মন খারাপ হলে ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে দেখতাম, দূরের পাহাড়, ঝাউবন... নীল কুয়াশায় ঢাকা আমাদের লিমা বস্তি।
মনে হত দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, ভুট্টাখেতে কাজ করছে আমার বাবা। চা বাগান থেকে ফিরে মা রাইশাক আর বুনো মাশরুম তুলে কোঁচড়ে বেঁধে রাখছে। ছোটো ভাই অর্জুন একপাশে গুলতি আর তীর-ধনুক নামিয়ে রেখে মাছিদের সঙ্গে
পান্তাভাত খাচ্ছে নিশ্চিন্ত আরামে।
সামনে কদমফুলের মতো ১১ টা ছোটো-ছোটো বাচ্চা নিয়ে চরে বেড়াচ্ছে লাইলং নামের চিনা মুরগিটা। ভাইয়ের একটাই ভয়, কখন বেজি অথবা চিল এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে ফুটফুটে বাচ্চাগুলোকে।
কালো রোগা বাংরি নদীর মতো নিরিবিলি সাঁওতাল মেয়ে আমি। স্তন নেই। ছোটোবেলায় জ্বলন্ত মাটির উনুনে পড়ে গিয়ে স্তনগ্রন্থি পুড়ে গিয়েছিল আমার। তিনদিন জ্ঞান ছিল না। মা বলত, তোর বুকে আর দুধ আসবে না।
আমি মায়ের কথায় হাসতাম। দুধ দিয়ে কী হবে মা? সে তো বাজারেই কিনতেই পাওয়া যায় ।
আমার কথা শুনে ঝাউবনের মাথায় বৃষ্টি নামত। লালঝুঁটি মোরগেরা মাটিতে ছিটিয়ে দেওয়া রেশনের গম খেতে খেতে একবার মুখ তুলে দেখত। তারপর : 'কঁকরো-ক্রো- ক্রোঁওওও' বলে ডানা ঝাপটে পাহাড়ের গায়ে প্রবল প্রতিধ্বনি তুলে দিত।
তখন কি জানতাম, মেয়েদের মাথার চাইতে স্তনের দাম এত বেশি? মেধার চাইতে গায়ের রঙ আর নিতম্বের গঠন এত গুরুত্বপূর্ণ? উজ্জ্বল মার্কশিটের চাইতে সুন্দর মুখশ্রী এত ম্যাগনেটিক?
ছেলে বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত আড়ালে। যেদিন শুধু কচুর শাক খেয়ে ক্লাসে আসতাম সেদিনও ওরা আমার গায়ে ইঁদুর-পোড়া গন্ধ পেত। যেদিন শুধু ঘাটো সেদ্ধ খেয়ে অথবা উপোস করে ক্লাসরুমে গিয়ে বসতাম সেদিনও ওরা আমার ওড়নায় সাপের মাংস আর বাসি হাঁড়িয়ার দুর্গন্ধ পেত।
আড়চোখে একবার আমার ফ্ল্যাট বুক দেখে নিয়ে
চর্যাপদের প্যারডি করে বলত : 'নীচু নীচু পাবত তহি বসহি শবরী বালি।'
শুধু ওই এক তরুণ অধ্যাপক, ধর্মে ক্রিশ্চিয়ান, দেবতাদের মতো রূপবান পুরুষ, একমাথা ঈষৎ সোনালি আর কোঁকড়ানো চুল, শুধু শুক্রবারেই যাঁর ক্লাস থাকত, আমার সহপাঠিনীরা প্রতিদিন যাঁর প্রেমে পড়ত, তিনি ক্লাসে এসেই একেবারে শেষ থেকে শুরু করতেন : ' কৃষ্ণকলি, আজ কেমন আছো? গত শুক্রবার কোনখানে শেষ করেছিলাম, মনে আছে?'
আমি উঠে দাঁড়িয়ে স্যারের প্রশ্নের উত্তর দিতাম। আর সমস্ত ক্লাসের চোখ ঘাড় বাঁকিয়ে আমাকে দেখত। কেউ মুচকি হাসত, কেউ চোখ মেরে অসভ্য ইঙ্গিত করত।
স্যার আমাকে কৃষ্ণকলি বলে ডাকলে আমার ভীষণ লজ্জা করত। ভালোও লাগত। মনে মনে গেয়ে উঠতাম :
'এমনি করে কালো কাজল মেঘ
জৈষ্ঠ্যমাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ়্মাসে নামে তমাল বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।'
ক্লাসের শেষে মেয়েরা টিপ্পনি কাটত :
গরুর গাড়ির আবার হেডলাইট!
জাঙিয়ার আবার বুকপকেট!
গুপ্তকেশের আবার ইউ ছাঁট!
ছেলেরা সেসব শুনে হাসতে হাসতে ঘাসের উপরে গড়িয়ে পড়ে বলত :
লেজ নাই কুত্তির টাইগ্রেস নাম!
আরশোলা আবার পাখি!
নিমাইয়ের নাম কৃষ্ণকলি!
বাঁজার ভ্যানিটি ব্যাগে আবার কনডোম!