17-06-2022, 03:00 PM
(This post was last modified: 17-06-2022, 03:03 PM by Bumba_1. Edited 2 times in total. Edited 2 times in total.)
~ খুঁজে ফিরি ~
অশ্বত্থামা মহাভারতের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। অশ্বত্থামা ছিলেন পাণ্ডব ও কৌরবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণের পুত্র। * পৌরাণিক কাহিনিতে দুটি অশ্বত্থামা নাম পাওয়া যায়। তার একজন হলেন এই দ্রোণ পুত্র অশ্বত্থামা এবং আরেকজন একটি হাতি। যাকে শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে গদাঘাতে হত্যা করেছিলেন ভীম এবং সেই হত্যার কথা যুধিষ্ঠির গিয়ে গুরু দ্রোণকে বললে তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাঁর অস্ত্র পরিত্যাগ করেন। অশ্বত্থামার মাতার নাম কৃপী। জন্মের সময় অশ্বত্থামা অশ্বের মত শব্দ করেছিলেন বলে তার এইরকম নামকরণ করা হয়। মহাভারতের এই ঘটনা আমাদের সকলের পড়া ও জানা। কিন্তু ওই মহকাব্যের সমস্ত কেন্দ্রীয় চরিত্র ও তাদের কার্য্যকলাপ আমরা যত মন দিয়ে অনুধাবন করে এসেছি, ঠিক ততটা মন দিয়ে যুধিষ্ঠিরের সংলাপ ‘অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ’ অনুধাবন করিনি। এই একটি ঘটনা ও তার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কালক্রমে দ্রোণ পুত্র অশ্বত্থামার জীবনটাই পালটে দেয়। কুরুক্ষেত্রের মহা যুদ্ধের ১৮ তম দিনে, বলা ভাল রাতে, যখন কুরু বংশের শেষ প্রদীপটিও নিভে যায় দুর্যোধনের মৃত্যুতে দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে, তখন অশ্বত্থামা (তিনি তখন কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে কৌরবদের শেষ সেনাপতি) আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি। ছলনা দ্বারা পিতার নির্মম মৃত্যুর ঘটনা অশ্বত্থামাকে পাণ্ডব বিরোধী ক্রোধে অন্ধ করে দিয়েছিল। আর তার ফলে তার সারা জীবনের সমস্ত সাধনা, শক্তি ও পুণ্যফল সব হারাতে হয়েছিল। একটু বিশদে বলি।
গুরু দ্রোণ যখন দেখতে পেলেন ধনুর্বিদ্যাতে অর্জুন বিশেষ দক্ষতা অর্জন করছেন, তখন তিনি তার ছেলে অশ্বত্থামাকেও সেরা ধনুর্বিদ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন। অর্জুনের মতোই অশ্বত্থামাও বহু গুপ্ত অস্ত্র প্রয়োগের কৌশল পিতার কাছ থেকে শিখেছিলেন। কিন্তু পিতা দ্রোণের থেকে গুরু দ্রোণ সবসময়ই এককদম এগিয়ে ছিলেন। যদিও মনে মনে এর জন্যে হয়তো দ্রোণের পরিতাপ থাকতে পারে। তাই প্রায় সমস্ত অস্ত্র প্রয়োগের কৌশল পুত্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ শিষ্যকে এক সঙ্গে শেখালেও, অস্ত্র ফিরিয়ে নেওয়ার কৌশল শুধু অর্জুনকেই শিক্ষা দেন। হয়তো এসবই হয়তো নিয়তির লিখন ছিল। অনেকে একে প্রারব্ধ কর্মফলও বলে থাকেন। যা অর্জুন আর অশ্বত্থামার জন্য আলাদা আলাদা ছিল। দ্রোণ অবশ্যই তা জানতেন না, কিন্তু বিষ্ণু অবতার শ্রীকৃষ্ণ তা অবশ্যই জানতেন। আর তারই ফল অশ্বত্থামা পেয়েছিল।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অশ্বত্থামা কৌরবদের পক্ষ অবলম্বন করেন। আর তার পিতা গুরু দ্রোণ তার ছেলে অশ্বত্থামার স্নেহের কারনে কৌরবদের পক্ষে থাকেন। এই কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে অশ্বত্থামারবিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি পাণ্ডবদের বহু সেনাদের হত্যা করেন। তাঁকে বধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দ্রোণাচার্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলে দ্রোণকে বধ করার জন্য পান্ডবগণ শ্রীকৃষ্ণের কাছে পরামর্শ করেন । আর তখন শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের বলেন কোনওভাবে যদি গুরু দ্রোণেরকানে যদি অশ্বত্থামারমৃত্যুর খবর পোঁছানো যায়, তাহলে সে সময় ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে হত্যা করবে। শ্রীকৃষ্ণেরপরামর্শ মতে ভীম বনের এক হাতিকে হত্যা করেন। আর সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন যুধিষ্ঠির। গুরু দ্রোণ যুধিষ্ঠিরের কথাকে বিশ্বাস করবেন। তাই যুধিষ্ঠির দ্রোণের উদ্দেশ্যে 'অশ্বত্থামা হতঃ- ইতি গজ' (অশ্বত্থামা -নামক হাতি নিহত হয়েছে) বাক্য উচ্চারণ করেন। ইতি গজ শব্দটি আস্তে বলাতে দ্রোণচার্য মনে করেন যে তাঁর পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হয়েছে। এরপর দ্রোণাচার্য অস্ত্র ত্যাগ করলে– ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে হত্যা করেন। আর তাতে অশ্বত্থামা ভীষণ ক্রোধিত হয়ে ওঠেন। অর্জুন দ্বারা কর্ণ এর মৃত্যুর পরে দুর্যোধন অশ্বত্থামাকে সেনাপতি নিয়োগ করেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ এ যখন দুর্যোধন সহ কৌরবদের সবাই মারা যায় তখন শেষ সময়ে এসে অশ্বত্থামা দুর্যোধ্নের কাছে জানতে চান, কী করলে দুর্যোধন মৃত্যুকালে খুশিতে মৃত্যু বরণ করতে পারবেন। তার উত্তরে দুর্যোধন বলেন তিনি পাণ্ডবদের বংশকে নিশ্চিহ্ন দেখতে চান। মিত্রের কথা রক্ষার জন্য অশ্বত্থামা সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডবদের শিবিরে গমন করেন। সেনাপতি পদ লাভ করার পর ইনি চিত্কার করতে করতে অগ্রসর হলে- কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা তাঁকে অনুসরণ করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সন্ধ্যার দিকে একটি বনে প্রবেশ করেন। একটি প্রকাণ্ড গাছের নীচে কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা ঘুমিয়ে পড়লেও পাণ্ডবদের প্রতি ক্রোধের কারণে অশ্বত্থামা ঘুমাতে পারলেন না। সেই সময় ইনি দেখলেন যে- একটি বিশাল পেঁচা রাত্রির অন্ধকারে অসংখ্য ঘুমন্ত কাককে হত্যা করছে। এ দৃশ্য দেখার পর ইনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, রাত্রের অন্ধকারে পাণ্ডবশিবিরে প্রবেশ করে এইভাবে পাণ্ডবদের হত্যা করবেন । এই কাজের জন্য ইনি কৃপাচার্য ও কৃতবর্মাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তাঁর কাজে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করলেন। প্রথমে এঁরা রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত ইনি তাঁদেরকে তাঁর অনুগামী হতে বাধ্য করলেন। উল্লেখ্য, এই সময় পঞ্চপাণ্ডব, কৃষ্ণ ও সাত্যকি সহ গঙ্গাতীরে অবস্থান করছিলেন। এরপর কৃপাচার্য ও কৃতবর্মাকে দ্বার রক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করে ইনি পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করে প্রথমেই ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করেন। এরপর খড়্গাঘাতে- উত্তমৌজাঃ, যুধামনু্যকে হত্যা করলে, অন্যান্য পাণ্ডব-বীরেরা জেগে উঠেন এবং তাঁরা অশ্বত্থামাকে আক্রমণ করেন। কিন্তু অশ্বত্থামা পাল্টা আঘাতে সবাইকে হত্যা করতে সক্ষম হন। এরপর তিনি দ্রৌপদীর ঘুমন্ত পাঁচ পুত্রকে দেখে, পঞ্চ পাণ্ডব ভেবে তাদের নির্বিচারে হত্যা করেন। এই সময় যারা ভয়ে শিবির থেকে পলায়নের চেষ্টা করেন তাঁদেরকেও দ্বারের কাছে দন্ডায়মান কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা সরোষে হত্যা করেন। যদিও কৃতবর্মার অসতর্কতার কারণে এই সময় ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথি কোনও প্রকারে পালাতে সক্ষম হন।
অশ্বত্থামা এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর প্রথমে দুর্যোধনকে এই সংবাদ দান করলে, আনন্দে তিনি তাঁকে আশীর্বাদ করেন। ভাঙা উরু আর তীব্র শারিরীক যন্ত্রণা নিয়ে দুর্যোধন তখন মৃত্যুপথ যাত্রী। পাণ্ডবরা সমূলে ধ্বংস হয়েছে আর তার শেষ বংশধরও আর নেই এই কথা জেনে দুর্য্যোধন অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে যমলোকে গমন করেন। সেনাপতি হিসেবে কুরুরাজের কাছে নিজের কথা রাখতে পেরেছেন, একথা মনে করে অশ্বত্থামা আপাত খুশিই ছিলেন। কিন্তু রাত ভোরে যখন জানা জানি হল যে পাঁচ জনকে তিনি হত্যা করেছেন, তারা পঞ্চপাণ্ডব নয়, দ্রৌপদীর নির্দোষ পাঁচ সন্তান, তখন অত্যন্ত অনুতাপে ও মনোকষ্টে অশ্বথামা ভাগীরথীর তীরে ব্যাসদেবের কাছে যান। ওদিকে তাকে শাস্তি প্রদানের জন্য খুঁজতে খুঁজতে শ্রীকৃষ্ণের সহায়তায় (তিনি সর্বজ্ঞানী, সব দেখতে পান) যুধিষ্ঠির ভীম ও অর্জুন সেখানে উপস্থিত হলেন- অশ্বথামা যে মানসিক বেদনার মধ্যে এই মুনির আশ্রমে উপস্থিত হয়েছিলেন, পাঁচ ভাইকে আসতে দেখে নিমেষে তার মধ্য এ সেই পূর্বের ঘৃণা ও হিংসা ফিরে আসে। ভূমি থকে একটি তৃণ পত্র উচ্ছেদ করে মন্ত্রবলে তিনি তাকে ব্রক্ষ্মাস্ত্রে পরিবর্তন করেন ও শ্রীকৃষ্ণসহ পাণ্ডবদের ওপর তা নিক্ষেপ করতে উদ্যত হন। বেগতিক দেখে শ্রীকৃষ্ণ তখন অর্জুনকেও উপদেশ দেন ব্রক্ষ্মাস্ত্র উপযোগ করতে। দুই মহা যোদ্ধা পৃথিবীর সর্বধ্বংসী মহাযুদ্ধের পরে, একে অন্যের প্রতি চূড়ান্ত অস্ত্র প্রয়োগে উদ্যত হয়েছে। তাহলে কি আজ এই ধরিত্রীর শেষ দিন! মুনিবর বেদব্যাস এই যুযুধান মুর্তি প্রত্যক্ষ করে তার তপস্যালব্ধ বলে দেখতে পান পৃথিবীর শেষ পরিণতি। আগামী প্রজন্মের জন্য এই গ্রহের শেষ মুহূর্ত আর বেশি দূরে নেই। সব শেষ হতে চলেছে। অর্জুন আর অশ্বত্থামা দুজনের চক্ষু নির্গত তেজ এক হাজার সূর্য্যের চেয়েও তপ্ত আর জ্বলন্ত। দুজনেই তাদের অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। বেদব্যাস তখন তার সাধনা অর্জিত সমস্ত শক্তি দিয়ে দুই ব্রক্ষ্মাস্ত্রকে আকাশপথে থামিয়ে দিলেন। তারা একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা লাগার প্রাক মুহূর্তে। মুনি ঋষিবর শ্রীকৃষ্ণের নিকট অনুরোধ করলেন তিনি যেন অর্জুন আর অশ্বত্থামাকে তাদের নিজের নিজের অস্ত্র ফিরিয়ে নিতে আদেশ দেন। তাতেই পৃথিবীর লাভ। সমগ্র মনুষ্যজাতি আর একটা যুগ এই ভাবে আর শেষ হয়ে যেতে পারে না, যেখানে কুরুক্ষেত্রের পরে সমগ্র পৃথিবীর মানব ও পশু সংখ্যা ইদানীং ক্রমশ হ্রাসের মুখে। অর্জুন ব্রহ্মচর্য পালনের কারণে অস্ত্র প্রতিহারে সমর্থ হলেও, অশ্বত্থামা সদা সত্পথে না থাকায় ইনি তাঁর অস্ত্র প্রত্যাহার করতে পারলেন না। শ্রীকৃষ্ণের আদেশে অর্জুন তখনই তার অস্ত্র সংবরণ করে নেন ও মামুলি একটি তীর দিয়ে তা বদলে দেন। কিন্তু অশ্বত্থামা অস্ত্র প্রয়োগের রাস্তা জানলেও তাকে ফিরিয়ে নেবার বিদ্যা তাঁর জানা ছিল না। শ্রীকৃষ্ণ সেকথা জানতেন। তখন বেদব্যাস অশ্বত্থামাকে বলেন, ‘তোমার অস্ত্রকে তুমি এমন কোন গ্রহে বা গ্রহের অংশে নিক্ষেপ কর, যেখানে এখনও পর্যন্ত কোন প্রকার জীবনের আগমন ঘটেনি।’ পাপাত্মা ও ঘৃণাবোধে জর্জরিত অশ্বত্থামা সেই ব্রক্ষ্মাস্ত্রকে পান্ডবদের বংশ একেবারে শেষ করে দেবার ইচ্ছেয় অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরার গর্ভজাত শিশু পুত্রের ওপরে প্রয়োগ করেন ও উত্তরা গর্ভেই পুত্রহীনা হয়ে যান। অশ্বত্থামা নিশ্চিন্ত হন যে পান্ডব কুলকে তিনি শেষ করে দিতে পেরেছেন। তাদের অগ্রগতির রথকে তিনি কালের রাস্তা থেকে হটিয়ে দিতে পেরেছেন। পরে অবশ্য শ্রীকৃষ্ণ যোগবলে সেই শিশুকে জীবন দান দেন আর পরে রাজা পরিক্ষীত হিসেবে তিনি এই বংশে অনেক দিন রাজত্ব করেন। পরিক্ষীত শব্দের অর্থ হল যা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। এই ঘটনা পাণ্ডব সখা শ্রীকৃষ্ণের মনে তীব্রভাবে আঘাত করে।
আর তখনই ঘটে যায় অশ্বত্থামার জীবনের চূড়ান্ত পতন। শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে অভিশাপ দেন ‘এখন থেকে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের পাপের ভার তোমার কাঁধে থাকবে, তাই নিয়ে তুমি সারা ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে বেড়াবে, এক অশরীরি প্রেতের মত। কোন ভালোবাসা ও শান্তি তোমার জীবনে আর কখনও আসবে না। কলিযুগের শেষ পর্যন্ত তোমাকে এইভাবে থাকতে হবে। কোন ঘর, কোন আদর-আপ্যায়ন কিছুই আর তোমার জন্য নেই। তুমি নিশ্ছিদ্র একাকীত্বের মধ্যে জীবনপাত করবে। কোন মানুষ বা সমাজ তোমার বন্ধু হবে না। আর তোমার সারা শরীর জুড়ে এমন ব্যাধি ও ঘা হবে, যা কোনদিনও সারবে না। কোনও বৈদ্য কোনও দিন তা ঠিক করতে পারবে না’। এই অভিশাপ-প্রাপ্তি অশ্বত্থামা পূর্ব পাপকর্মের দ্বারা আরব্ধ শাস্তি স্বরূপ।
অশ্বত্থামা জন্মের সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতাসম্পন্ন মণি তার কপালের মধ্যে নিয়ে জন্মেছিলেন। যা নাকি স্যমন্তক মণির সমকক্ষ। এই মণির ক্ষমতায় কোণ রোগ, অসুখ, সর্পভয়, প্রেত-পিশাচ ভয় আর গন্ধর্ব-শয়তানের প্রকোপ থেকে তিনি রক্ষিত ছিলেন। ওই মণি ছিল তাঁর সমস্ত সত্তা ও শক্তির মূল ধারক ও বাহক। শ্রীকৃষ্ণ সেই মণি তার কাছ থেকে নিয়ে নেন। কপালের ভেতর থেকে সেই মণি বের করে দেবার পরে সেখানে একটা বিরাট গর্ত (জখম) তৈরী হয়, যা কোন দিন আর সারবে না বলে শ্রীকৃষ্ণ জানান। শুধু তাই নয় ওই ঘায়ের স্থান কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হবে আর তা থাকবে কলি কালের শেষ পর্যন্ত। মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণায় অশ্বত্থামা প্রতি মুহুর্তে মৃত্যু কামনা করবেন, কিন্তু মৃত্যু তাঁর কাছে কখনও ধরা দেবে না। পিতা দ্রোণের আশীর্বাদে অশ্বত্থামা অমরত্বের বর পেয়েছিলেন। এখন এই অভিশাপ প্রাপ্তির পরে সেই অমরত্বের প্রহসন নিয়ে বেঁচে থাকবেন তিনি যতদিন না কলি যুগের শেষে যুগাবতার কল্কির (ভগবান বিষ্ণুর অবতার রূপ) সঙ্গে তার দেখা না হচ্ছে। আর তিনি তখন তার উদ্ধার করবেন। সে দিন হবে তার মুক্তি। এই পর্যন্ত পড়ার পরে, অনেকেই আশ্চর্য হয়ে ভাবতে থাকবেন, এত ক্ষমতাশালী আর অলৌকিক মণিধারী অশ্বত্থামার আশীর্বাদ কী করে এমন ভয়ঙ্কর অভিশাপে পরিবর্তিত হয়ে গেল? কর্মফল অত্যন্ত শক্তিশালী ও ক্ষমতাশালী মানুষকেও তার নিয়তি নির্দিষ্টপথ থেকে সব সময় সরিয়ে আনতে পারে না, যদি বিশেষ করে সেই কর্ম সকল অন্যায় ও পাপবিদ্ধ হয়ে থাকে। ক্রোধ আর ক্ষমতার আস্ফালনে নির্দোষ মানব নিধন, ঘুমন্ত প্রাণীকে হত্যা ও সর্বোপরি গর্ভস্থিত জীবনকে নষ্ট করার অপরাধে মহান বীর যোদ্ধা, শাস্ত্র ও শস্ত্র জ্ঞানী দ্রোণ পুত্র অশ্বথামা জন্ম জাত ঈশ্বরীয় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যুগব্যাপী পীড়া ও শাস্তির যোগ্য বলে বিবেচিত হলেন। শ্রী অনন্থ আইয়ার তাঁর বই ‘ending of Mahabharat’ এ অশ্বত্থামার এই পরিবর্তিত জীবন ও তার কার্য্যকারণ সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছেন। উৎসাহী পাঠক খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।
দ্রোণ এবং তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা দু’জনেই ', হওয়া সত্ত্বেও ক্ষত্রিয় জীবন যাপন করেছেন। তারা সহজেই বনে বা পাহাড়ে সাধনা ও তপস্যা করে তাদের জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন। কিন্তু জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে তারা রাজনীতি ও রাজপরিবারের সঙ্গে জুড়ে যান। আর তারই ফলশ্রুতি হিসেবে তাদের উভয়কেই উদ্দিষ্ট জীবনযাপন থেকে ভিন্ন জীবন কাটাতে হয়েছে। আর মৃত্যু যা কিনা * শাস্ত্র ও বিশ্বাস অনুযায়ী চির মুক্তির পথ তাকেও পেতে হয়েছে শারীরিক চূড়ান্ত কষ্ট ও অপমানের মধ্য দিয়ে। যদিও আজও অনেকেই এই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করে চলেছেন যে সত্যিই কি মহাবীর অশ্বত্থামা এখনো পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছেন ? পুরাণ মতে * ধর্মে সাতজন চিরঞ্জিবী আছেন। পুরাকাল থেকে আজও তারা এই গ্রহে তাদের জীবন অতিবাহিত করছেন। তারা হলেন, অশ্বত্থামা(দ্রোণ পুত্র), মহাবলী(প্রহ্লাদের পৌত্র), ঋষি বেদব্যাস, শ্রী হনুমান (রামায়ণ খ্যাত), বিভীষণ (রাবণের ছোট ভাই), কৃপাচার্য্য (দ্রোণের শ্যালক, অশ্বত্থামার মামা), ভগবান পরশুরাম (বিষ্ণুর এক অবতার- যিনি এই পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করেছেন বার বার)।
অশ্বত্থামা বেঁচে আছেন বলে একটা বিশ্বাস ও কিছু প্রবাদ (ঘটনা ও রচনা), যা কিনা তার নিজের ও মহাভারতের অস্তিত্বকে সত্যের কঠিন কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার অপেক্ষায় রয়েছে। সততা ও ধৈর্য্য সহকারে এই অভিযানের ব্যাবস্থা ও চালনা করা যেতে পারে। একটা বিরাট সময়ের লাফ আমরা দিতে পারি ও মহাভারতের সময় ও কথা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানতে পারি যদি একবার কোন ভাবে অশ্বত্থামার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যায়। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝখনের যে ধোঁয়া ধোঁয়া অধরা পর্দাটুকু আছে, আসুন বিজ্ঞানের বিচারে আর অতীতের শাস্ত্র-পুঁথি আর পারম্পরিক জ্ঞানের একত্র সহযোগীতায় তাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করি। আমার মনে হয়, যাদের মন মুক্ত তারা আমার এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হবেন। যেখানে হারানোর কিছু নেই, কিন্তু পাবার সম্ভাবনা অঢেল সেখানে এই প্রকার অভিযানের উদ্দেশ্য ও বিধেয় দুটোই সমান উপযোগী।
এক্ষেত্রে অন্তত স্পষ্ট যে অশ্বত্থামা এক নাতিদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ থেকে সাধু মহাত্মা ও বিশেষ জ্ঞানী লোকেদের দেখা দিয়েছেন। অথবা এটা বলা যায়, ঈশ্বরীয় পথে যারা কিছুটা এগিয়ে গেছেন বা নেহাতই সৎ সাধারণ মনুষ্য তারা এই মহামানবের দেখা পেয়েছেন। সে কথা তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের রচিত বা রক্ষিত কোন না কোন রচনা বা প্রকারান্তারে ভবিষ্যতের মানুষের জন্য রেখে গেছেন। এই দেখাশোনা নিয়ে তারা যতটা বলতে চেয়েছেন অশ্বত্থামা জীবিত আছেন বলে, তার থেকে অনেক বেশি অনুচ্চারিত রয়ে গেছে এই মুলাকাতকে এক সুবিশাল ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসাবে দাখিল করতে। যারা এই কাজ করেছেন, তারা কেউ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এমন কাজ করেছেন বলে মনে করার কোন সুযোগ নেই। তাই খোলা মনে এই ঘটনাগুলির আলোচনা এবং সম্ভাবনা নিয়েই আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আর আমার এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্যও তাই। এরা কেউ অবাক হননি, বা দ্বাপরের শেষ মানুষ হিসাবেও এই ঘটনাকে কোন আলাদা মাত্রা দিতে চাননি। তারা কেবল ঘটনার উল্লেখ নিজ নিজ ভাবে করে রেখে গেছেন- বিচার ও সাব্যস্ত করার দায় ও দায়িত্ব আমাদের কিংবা আগামী প্রজন্মের। অশ্বত্থামা দর্শনের নানা উল্লেখ ও তার প্রমাণ নিয়ে যদি কারো কোন সংশয় জাগে বা কেউ আরো দৃঢ়তার সঙ্গে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চান তাহলে তারা ডাঃ নারায়ণ দত্ত শ্রীমালি-র সুযোগ্য শিষ্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। উনি যোধপুরে থাকেন। তারা এই ঘটনাক্রমের সমস্ত বিবরণ প্রমাণ সাপেক্ষে বলবে।
এই অদ্ভুত প্রত্নতত্ত্বে বা ইতিহাসে আরো কিছুটা উৎসাহী করার জন্য আমি ওপরের ঘটনাগুলি সংক্ষেপে আপনাদের জানাচ্ছি।