Poll: এই গল্প টা আপনাদের ভালো লাগলে নীচের অপশন এ ক্লিক করে জানান কেন ভালো লাগছে
You do not have permission to vote in this poll.
গল্পের কাহিনী
10.00%
2 10.00%
গল্পের গতি
0%
0 0%
গল্পের গতি এবং কাহিনী
85.00%
17 85.00%
গল্প টি ভালো লাগছে না
5.00%
1 5.00%
Total 20 vote(s) 100%
* You voted for this item. [Show Results]

Thread Rating:
  • 96 Vote(s) - 3.46 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Fantasy বাঘমুড়োর আতঙ্ক - সমাপ্ত
আগের পর্বের কিছু অংশ...... 

গ্রামের প্রায় সবাই এসে হাজির হলো মহাদেবের বাড়ির সামনে। বাচ্চা কে কোলে নিয়ে আছে উমা। অনেকের অনেক মতামত সামনে এল। কেউ বলল পুলিশে খবর দেওয়া উচিৎ, আর কেউ বলল, দরকার নেই এমন বাচ্চা ঘরে রেখে। কিন্তু মহাদেব উমার টলটলে জলে ভরা চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝে গেছিল, সে এই বাচ্চা নিজের কাছেই রাখতে চায়। সন্তান হীন মায়ের কাছে এর থেকে বেশী আর কি চাওয়ার থাকতে পারে। বোধ করি তিন বছর আগে এই গ্রামে আসা সাধুবাবার প্রথম ভবিষ্যৎ বানী ফলে গেল। তারপরে পুলিশ এসেছিল বাড়িতে মহাদেবের। অনেক খোঁজ ও চলেছিল আশে পাশের গ্রামে। কিন্তু দীর্ঘদিন কোন খোঁজ না পাওয়ায় সবাই এখন ভুলতে বসেছে সেই বাচ্চা টা মহাদেব আর উমার নয়।সেই ছেলের নাম রাখা হয়েছিল হৃষীকেশ। কিন্তু গ্রামের মধুসূদন যেমন মোদো হয়ে যায় তেমন ই সেই নাম কালের গর্ভে চলে গিয়ে ডাক নামেই পরিচিত হয়ে গেল সেই ছেলে, হীরা নামে।
 
                                                            পর্ব তিন
এখনো অনেকেই ভোরের বেলায় গ্রামের কাছাকাছি মাঠে গেলে শোনে গুরুগম্ভীর গলায় কৃষ্ণ নামের কীর্তন ভেসে আসছে জলার কাছ থেকে। সব দিন নয়। তবে তেমন ব্রাহ্ম মুহুর্তে যোগ তৈরি হলে শুনতে অনেকেই পেয়েছে। অনেকেই শেষ রাতে উঠে বাহ্যে করতে বেরিয়ে রাস্তায় কৃষ্ণ নামের আওয়াজ শুনেছে। কেউ বা জলার ধারে গোধুলি তে গরু খুঁজতে গিয়ে ভয় পেলেও শুনেছে কৃষ্ণনাম। আলো আঁধারি তে জলার কুয়াশা ভেদ করে ভেসে এসেছে সেই নাম গান। আর সে যেমন তেমন না। ভারী গলায়, কে যেন গায়, “হরি হরায় নম কৃষ্ণ যাদবায় নম, যাদবায় মাধবায় কেশবায় নম”। বা ভারী সুন্দর মিস্টি গলায় গান ভেসে আসে জলার মধ্য থেকে, “ জয় জয় রাধা রমণ হরি বোল, জয় জয় রাধা রমণ হরি বোল”। কে যে সেই নামগান করে কেউ জানে না। এমন অনেক অজানা রহস্য, গ্রামের নাচে কানাচে রয়েছে। সেই সবের খোঁজ কেউ করে না আর। কিন্তু সবাই এটা বোঝে বাঘমুড়ো কে যুগ যুগ থেকে আটকে রেখেছে এই কৃষ্ণ নাম। সবাই কৃষ্ণ কে এতো ভালোবাসে, এ নাম গান পেলেই হলো। কে করছে অতো মাথা কেউ ঘামায় না।

সন্ধ্যের পরে বাঘমুড়োর জঙ্গল দিয়ে কেউ যাতায়াত করে না। কিন্তু আজকে জানিনা কার মরন এসেছে। একজন পথিক বাঘমুড়োর জঙ্গল ভেদ করে বোধকরি বাঘমুড়ো গ্রামে আসছে। এ হল পরেশ। আকাশে চাঁদ তো আছে। পূর্ণিমার আগের দিন। বেশ বড় থালার মতন চাঁদ। রাস্তা একেবারে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে পরেশ।

পরেশের মা মারা যাবার একমাস পরে পরেশ গেছিল গঙ্গায়। পুরোন সেই গঙ্গা আর নেই। আছে একটা বিশাল ঘোড়ার ক্ষুরের মতন জলা। স্রোত নেই তাতে। কিন্তু জোয়ার ভাঁটা খেলে। যোগ আছে মা গঙ্গার সাথে এখনো। পলাশপাড়ার চড়ে যোগ টা আছে। সেখানে জোয়ার ছাড়া মা গঙ্গা আর এই খাল আলাদা হয়ে যায়। একটা বিশাল গঙ্গা মাটির চড়া থাকে মাঝে। আর জোয়ারে সেই চড়া ডুবে যায়। তাই গঙ্গা স্নানের প্রয়োজনে সবাই ওই জলা তেই স্নান করে ওই জলা কেই মা গঙ্গা মেনে। বাঘমুড়োর জঙ্গলের ধারে আগে গঙ্গা বইত। কিন্তু কালের নিয়মে বা সরে গেছে প্রায় পাঁচ কিমি দূরে। আর রেখে গেছে এই জলা কে মা গঙ্গা। সেইখানেই গঙ্গা চান করে আশে পাশে দশ টা গ্রামের লোকজন। পরেশ শহরে ছিল তাই মায়ের শ্রাদ্ধ হয়ে যাবার পরে , পরিবারের সকলের সাথে গঙ্গা চান করতে পারে নি । সেই কারনে আজকে কাজ কর্ম ফাঁকা থাকায় একলাই স্নান করতে গেছিল সে। চলেই আসত দুপুরে। কিন্তু অনেকদিনের পুরোন বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ায় তাকে তাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করেই আসতে হলো। তাতেও দেরী হতো না।পরেশ দিন থাকতে থাকতে বেড়িয়েও পরেছিল।  কিন্তু জঙ্গলের মাইল দেড়েক আগে,এমন তোড়ে বৃস্টি নামল অসময়ে যে পরেশ একটা টিনের চালের তলায় দাঁড়িয়ে পরতে বাধ্য হয়েছিল। বেশ খানিকক্ষণ সময় গাবিয়ে যখন বৃষ্টি একেবারে থামল তখন সুজ্জিমামা খেয়ে দেয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আর ততক্ষনে পরেশ কে দেরী করিয়ে দিয়ে এক খানা থমথমে রাতের আড়ালে মেঘ ও কেটে গেছে।

এই সন্ধ্যেবেলায় চল্লিশ কিমি উজিয়ে বাড়ি পৌঁছনর থেকে এই জঙ্গলের রাস্তা দিয়েই ফেরার চেষ্টা করল পরেশ। এই সন্ধ্যে তে সাধারণত ভয় থাকে না বললেই চলে। তাড়াতাড়ি ঢুকে পরতে পারলেই কেল্লা ফতে। কুড়ি কিমি উজিয়ে যেতে খুব বেশি হলে এক ঘন্টা লাগবে। তাই বেশ জোরেই সাইকেল প্যাডেল করছিল পরেশ। আর সাথে ছিল কৃষ্ণ নামের সাহস। বৃষ্টি থেমে এখন আকাশে বেশ একটা বড় চাঁদ উঠেছে। হালকা বাতাস। জোরে প্যাডেল করার জন্য ঘামছে পরেশ হালকা হালকা। নামেই জঙ্গল, কিন্তু আছে বিশাল ফাঁকা জলা। রাস্তার দুই দিকে ছোট ছোট গুল্ম ছাড়া আর কিছুই নেই। ডান দিকে বাম দিকে দুই দিকেই জলা আর জলার লম্বা লম্বা ঘাস। কখনো হাল্কা আর কোথাও দলবেঁধে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে। আর তার মাঝে মাঝে ফাঁক দিয়ে জলার কালো জলের উপরে প্রতিফলিত চন্দ্রমা। নির্জন আর নিস্তব্ধ। শুধু হালকা হাওয়ায় জলার  ঘাস বনের ফিসফিসানি। আর সাইকেলের প্যাডেলের আওয়াজ। ক্যাঁচ – ক্যাঁচ, ক্যাঁচ ---ক্যাঁচ।

জঙ্গল শেষে, অনেক দূরে নিজের গ্রামের শেষ প্রান্তের বাড়ি গুলো তে জ্বলা হ্যারিকেন বা প্রদীপের আলো দেখতে পাচ্ছে পরেশ। মনে আনন্দের একটা রেশ। এক হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল টা ধরে নিজের জামার বুকের বোতাম টা লাগাতে লাগাতে পরেশ বুঝতে পারল, কেমন যেন একটা শীতল অনুভূতি বাতাসে। বৃষ্টি হয়ে গেছে ভেবে, উলিপালি করে দুহাতের জামার হাতের বোতাম গুলো ও লাগিয়ে নিল পরেশ। কিন্তু এবারে যে হাড় হিম করা ঠাণ্ডা লাগছে ওর। প্যাডেল করতে করতেই জোরে পা চালালো পরেশ একটু গরম হবার আশায়। দুইদিকের জলে প্রতিফলিত চাঁদ আর উঁকি দিচ্ছে না। মনে হচ্চে, সাদা চাদরে ঢাকা কোন অজানা পিশাচ , দুই হাত বাড়িয়ে ধোঁয়ার আকারে উঠে আসছে জলা থেকে রাস্তায়। একটা তীব্র ঠান্ডা হাওয়া, যেন ফুসফুস কেও জমিয়ে দেবে প্রশ্বাসের সাথে। পরেশের মনে সহস্র ঝড়। সহসা আকাশে চোখ যেতেই দেখল চাঁদ যেন কেমন লাল বর্ণ ধারন করেছে। একটা মেটে ভাব চারদিকে। বাতাসে একটা ভারী অনুভূতি হলো পরেশের। আশে পাশে তাকিয়ে বুঝল ঘাস গুলো যেন স্থির হয়ে আছে। মাথা দোলানো খুশী টা আর ওদের মধ্যে নেই একেবারেই। থম হয়ে গেছে পরিবেশ টা নিমেষেই।

ভয় লাগল পরেশের এবারে। বাড়ির কাছে চলে এসে আবার এই ভয়ের উপদ্রব কেন? ও শুনেছে জঙ্গলের এই শেষ ভাগ টাই নাকি সব থেকে বেশী বিপজ্জনক। সেটা ভেবেই পরেশের শীত ভাব টা যেন দশ গুন বেড়ে গেল। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল ও কিছু। অনেক জনের পিছনে কথা বলার আওয়াজ। কথা কি? নাকি কান্না। উফ এমন কান্না ও হয়? মনে হচ্ছে জীবনে কোন কালে খুশী ছিল না ও। আর না তো কোনদিন খুশী হয়ে বাঁচতে পারবে পরেশ। আর এই সব কান্নার ও পিছনে বেশ খানিক দূরে যেন জল সরানোর খুব ধীর লয়ের শব্দ অনবরত হয়ে চলেছে। মনের মধ্যে বুদবুদের মতন ভেসে উঠল পরেশের, এই জঙ্গলের ভয়ের নানান কাহিনী। আরো জোরে প্যাডেল এ চাপ দিলো পরেশ। এগোচ্ছেই না সাইকেল টা আর যেন। কিন্তু এগিয়ে তো যেতেই হবে। না হলে কেউ জানতেও পারবে না পরেশের কি হলো। না আসলেই হতো । ভয়ঙ্কর ঠান্ডা তেও ঘামতে শুরু করল এবারে পরেশ। বাঘমুড়ো নাকি? শুনেছে ও, সময় ও থেমে যায় সে সময়, যে সময়ে বাঘমুড়ো শিকার ধরে। ভুলেও পিছনে তাকাতে নেই একদম এই সময়ে । ও তাকালো ও না। জোরে প্যডেল করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকল। কিন্তু পারছে না। বলে সৎবিত ও হারিয়ে যায় বাঘমুড়োর খপ্পরে পরলে।

 কিন্তু ও কি? জলার শেষে, জঙ্গল থেকে বেরোনোর ঠিক সামনেই যে উঁচু ঢিবি টা আছে সেখানে ওর মা দাঁড়িয়ে। ও পরিষ্কার শুনতে পেল,

-      পরেশ এলি?  আর পারি না হাঁটতে, আমাকে তোর সাইকেলে চাপিয়ে নিবি বাবা? ও বাবা পরেশ , কই রে সাইকেলে চাপিয়ে নে না!

অ্যাঁ, মা নাকি? মা এমন করুণ করে ডাকলে সাড়া দেবে না আমন পাষণ্ড ছেলে পৃথিবী তে নেই বললেই চলে। আর পরেশ তো মা অন্ত প্রান ছিল। পরিস্থিতির ঘোরে তড়িঘড়ি করে, পরেশ সাইকেলের ব্রেক টা মারতে যাবে তখন ই মনে পরল, মা তো একমাস হলো মারা গেছে। সর্বনাশ, এ নিশ্চই বাঘমুড়ো। ও শুনেছে বাঘমুড়ো এই ভাবে পথ ভোলাতে পারে। নিজের লোকের নকল করে বাঘমুড়ো ডেকে নিয়ে গিয়ে জলায় ফেলে মাথা খুবলে নিয়েছে অনেক জনের। এখন থামলেই নির্ঘাত মৃত্যু। অনেকের মতন তার ও মাথা খুবলে নিয়ে চলে যাবে বাঘমুড়ো।কোন জীবিত মানুষের কাছে বাঘমুড়োর কাহিনী কেউ শুনতে পায় নি। যা শুনেছে কল্পকথা। গল্পকথা। অনেক মৃত্যু ও দেখেছে এই জলার প্রান্তে। কিন্তু সেগুলো সব মৃত্যু। মাথা ছিল না ধড়ে তাদের। ধড় দেখে বোঝার উপায় তো নেই, কত খানি যন্ত্রণায় মৃত্যু হয়েছিল ওদের। কিন্তু আজ পরেশ বুঝতে পারছে হাড়ে হাড়ে। এই রকম দুঃখী জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার তো কোন মানেই নেই।  প্রানভয়ে নয়, ও কৃষ্ণ নাম জপতে লাগল আর কোন দিন ও কৃষ্ণ নাম করতে পারবে না বলে। আর কিচ্ছু মনে নেই ওর। মেয়ে, বাড়ি কিছুই আর মনে নেই ওর। মনে আছে শুধু মৃত্যুর প্রবল ইচ্ছা আর মনের ভিতরে প্রবল কৃষ্ণ নাম। আর প্রায় কোন দিকে না তাকিয়ে সাইকেল নিয়ে উর্ধশ্বাসে গ্রামের দিকে চালাতে লাগল।

কিন্তু এবারে আর সড়সড় নয়। বুঝতে পারল দুটো পা নিয়ে উর্ধশ্বাসে কেউ দৌড়ে আসছে তার দিকে পিছন থেকে।এই দৌড়নোর আওয়াজ পরেশ চেনে। পদভারে যেন কাঁপছে রাস্তা। মনে হয় পৃথিবীটাই কাঁপছে তার। সে জানে বাঘমুড়ো যে সে কেউ নয়। ঠিক সেই সময়ে পিছনের কেরিয়ার এ কেউ ধাক্কা দিল। ধাক্কার জোর এতোই ছিল যে, পরেশ সাইকেল নিয়ে পরে গেল হুড়মুড়িয়ে। বৃস্টি তে ভিজে যাওয়া রাস্তায় পরে গিয়ে , কাদায় মাখামাখি হয়ে, মারাত্মক ভয়ে কোনরকমে সোজা হয়ে দেখল এক বীভৎস দৃশ্য। বিশালাকৃতি এক পুরুষের মাথায় একটা বিশাল বাঘের মাথা। পরেশের থেকে মাত্র এক গজ দূরে রয়েছে। মুখ দিয়ে লালা পরছে আর অনবরত গোঁ গোঁ একটা অপ্রাকৃতিক আওয়াজ মুখ থেকে বেড়িয়ে আসছে পিশাচ টার। ঠান্ডায় জমে যাবে পরেশ এবারে। ঠকঠক করে কাঁপছে পরেশ। এই পিশাচের হাতে মৃত্যু না হলেও, ঠাণ্ডায় জমে , মৃত্যু হবে পরেশের। কিম্বা দুঃখে আত্মহনন করে নেবে সে। পানসে চাঁদের আলোয় নিজের মুখ থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখল পরেশ। বাঘমুড়ো নিজের বিশাল একটা পা পরেশের ছাতি তে রাখতেই পরেশের মনে হল এই পায়ের আঘাতেই তার মরন হবে।এতো ভারী সেই পা। বুকের উপরে লালা ঝড়ে পরতে লাগল পরেশের। হিংস্রতার চরমে পৌঁছে ,কটা চোখ দিয়ে যেন বাঘ টা ওকে দেখছে যেন পুড়িয়েই ফেলবে এবারে। জিঘাংসা কি ভয়ংকর চেয়াহার নিয়ে সামনে আসতে পারে পরেশের ধারনা হল। কিন্তু ধারনা বেশীক্ষন থাকবে না আর। মরণের দেরী নেই। উফ এই ভাবে মরন হবে তার? হে ঠাকুর এমন বীভৎসতা তো কল্পনা ও করা যায় না। হয়তো পরেশের চোখে মরণ ভয় দেখল বাঘমুড়ো। এটাই তো ওই পিশাচ চায়। মৃত্যুভিক্ষা।

বিশাল হাঁ করে পরেশের মাথা টা নিজের মুখে নেবে এমন সময়ে মনে হলো একটু গরম যেন চার পাশ টা। ঠাণ্ডায় মরন হবে এমন ভাবটা যেন নিমেষে সরে গেল। আর পিছন থেকে একটা আওয়াজ পেল পরেশ, মনে হলো কোন বড় জন্তু এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে। গরররররররররর…। সেই আওয়াজে একটা চাপা ভয়ানক ক্রোধ আর সাথে আতঙ্ক। বাঘমুড়ো যেন পিছু হটল একটু। বুকের থেকে মারাত্মক ভারী পা টা একটু সরে গেল। আবার সেই আওয়াজ টা পেল পরেশ। গরররররররররররররররররররররর………।

আওয়াজ টা ততক্ষন হতেই থাকল যতক্ষন না বাঘমুড়ো পিছু হটল। বাঘমুড়ো সামান্য পিছু হটতেই দেখল পিছন থেকে একটা বিশাল কিছু সামনে লাফ দিয়ে এসে পড়ল পরেশ কে ডিঙিয়ে। দেখল একটা দাগ হীন সাদা কুকুর। নিশ্চই নেকড়ে না হলে এতো বড় কুকুর হয় নাকি?  অত নিখুঁত সাদা আর বড় কুকুর হয় কিনা সন্দেহ। কিছু না হলেও একটা গরুর সমান উচ্চতা আর লম্বায় ততটাই। লেজ ধরলে আরো লম্বা। রাগে লেজ টা ফুলে গেছে নেকড়ে টার আর সাথে মুহুর্মুহু গর্জন। যেন বলছে তফাত যাও, তফাত যাও। ভারতবর্ষে নেকড়ে? তাও এতো বড়? এদিকে, বাঘমুড়ো পিছু হটছে আর নেকড়ে টা এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েক পলক পরেই দেখল বাঘমুড়ো তীব্র গতিতে দৌড়ে গিয়ে উঁচু মাটির ঢিবির ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ভেবলে গেছিল পরেশ। কিন্তু সৎবিত ফিরে পেতেই বুঝল, ঠান্ডা ভাব টা একদম নেই আর। বরং প্রানভয়ে সাইকেল চালানোর দৌলতে গরম টা বেশী করতে শুরু করল পরেশের। নেকড়ে টা তাকিয়ে রইল বাঘমুড়োর দিকে। হালকা গর্জন টা থামলই না। নেকড়ে টা তাকিয়েই রইল আর গর্জন করতে থাকল আগের মতন। তারপরেই পরেশের দিকে তাকিয়ে শীতল চাঁদের আলোয়, উপরের দিকে গলা উঁচু করে আউউউউউউউউউউ করে নাগারে হুঙ্কার দিতে লাগল নেকড়ে টা। উফফ কি ভয়ানক, যেন ভিতর থেকে হৃৎপিণ্ড টা বেড়িয়ে আসবে এবারে ভয়ে। কি করুণ ভাবে, ডাকল নেকড়ে টা দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে। কানে হাত চাপা দিল পরেশ। সহ্য করতে পারছিল না, আওয়াজ টা। নেকড়ে টা ততক্ষন ওই রকম কান্না মেশানো হুংকার করতে থাকল যতক্ষন না মেটে চাঁদ সরে রূপোর চাঁদ সামনে এল।

ঘটনার ধাক্কায় পরেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে একেবারে। ভয়ে ওর প্রান শুকিয়ে গেছে। এক বিপদ থেকে বাঁচার পরে আরেক বিপদ। নেকড়ে টা তাকে বাঁচাতেই এসেছে। কিন্তু এতো বড় নেকড়ে এই গ্রামে কোথা থেকে এলো? নেকড়ে টা ঘুরে পরেশের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে আবার একটা হালকা গর্জন করতেই পরেশ বুঝতে পারল এ গর্জন তাকে চলে যেতে বলার আদেশ মাত্র। চাঁদের আলোয় মনে হল নেকড়ে টির দাঁতের রাশি ঝলকে উঠল।

আর দেরী করল না পরেশ। পা দুটো যেমন আটকে গেছিল মনে হয়েছিল, সেই অবশ ভাব টা আর নেই। নেকড়ে টা গর্জন করছে বটে, কিন্তু অমন শান্ত স্নিগ্ধ মুখ মনে হয় না ও কোন পশুর আগে দেখেছে বলে। মনে হলো একটা প্রণাম করতে। কিন্তু অমন তেজের কাছে পৌঁছন তারপক্ষে সম্ভব না, যতই ওই নেকড়ে তার জীবন বাঁচাক। আর দেরী করল না ও।

কোথা থেকে একটা রোখ চেপে বসল। কিছুক্ষন আগে বেঁচে থাকার যে ইচ্ছে টা চলে গেছিল সেটা ফিরে এলো নিজের ভিতরে। মনে মনে ভাবল নাহ বাড়িতে মেয়েটা আছে। দ্রুত চেপে বসল সাইকেলে। চাপ দিল প্যাডেল এ। পিছনে নেকড়ে টা আবার গলা উঁচিয়ে কেঁদে উঠল পরেশের হাড় সুদ্দু ভয়ে কাঁপিয়ে দিয়ে। কিন্তু সেই কান্নার মাঝেই কান খাড়া করে শুনতে পেল, পিছনে জলার দিক থেকে, দূরে খুব দূরে কোথাও কাঁসর ঘন্টা বাজছে। এই রাতেও কাঁসর ঘন্টা বাজছে? গায়ে কাঁটা দিল পরেশের। সাইকেলের হ্যান্ডেল ছেড়ে একটা হাত আপনার থেকেই কপালে উঠে গেল তার। প্রণাম করল মধুসূদন কে সে। এ শোনার ভাগ্য সবার যে হয় না !!   
 


 
-      ধাপ্পা!!!!!!!
এমনিতেই ভয়ে হাত পা কাঁপছিল পরেশের তারপরে এই ধাপ্পায় চমকে উঠে, সাইকেল সুদ্দু উল্টো দিকে পরে গেল পরেশ। রেগে গেলেও পরক্ষনেই ওর মাথা একদম শান্ত হয়ে গেল। কি করবে? দেখল লালি ধাপ্পা দিয়েছিল বটে মজা করার জন্য, কিন্তু বাবা পড়ে যেতেই সেও ঘাবড়ে গেছে একেবারে। ভয়ে আর ঘাবড়ে যাওয়া এই মা মরা মেয়েটা কে দেখেই যে ওর সব রাগ জল হয়ে গেল। কপট রাগ এনে বলল,

-      উফ লালি!!!! আর কি তুই বাচ্চা আছিস নাকি? যে বাবাকে ধাপ্পা দিচ্ছিস?

পরেশ সামলে নিতেই , লালি হেসে উঠল নিজের স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গী তে। বড্ড মিষ্টি করে হাসে মেয়েটা। গজদাঁতের ফাঁকে অমন হাসি দেখা একজন বাবার কাছে যে কত প্রিয়, সে শুধু বাবাই জানে। ততক্ষনে, পরেশের সাইকেলে বাঁধা থলি টা নিয়ে নিয়েছে লালি হাতে। কে বলবে ও এই বছরে চব্বিশে পরল। একেবারে বাচ্চাদের মতন কান্ড। বাবা এলে কিছু না কিছু আনতেই হবে যেন ওর জন্য। পরেশ আনেও। মেয়ের পছন্দের খাবার জিনিস, চকলেট, ফল সব ই আনে। আর মেয়ের ও বিশাল কিছু লাগে না। বাবা কিছু আনলেই ও খুশী। কিন্তু আজকে লালি থমকে গেল। দেখল পরেশের মুখে, গায়ে, জামায়, প্যান্টে কাদার দাগ।এখনো শোকায় নি। মানে গঙ্গা মাটি নয়। রাস্তায় পরে গেছে পরেশ সেটা বুঝতে পারল লালি। ভয় পেয়েই জিজ্ঞাসা করল বাবাকে,

-      কি হয়েছে তোমার বাবা? পরে গেছ নাকি কোথাও? লাগে নি তো। দেখি দেখি।
-      উফ না রে মা! তবে আজকে বড় বিপদ হতে পারত বুঝলি? বিপদ কি? আজকে জানিনা কোন জন্মের পূন্যে আমি ফিরে এলাম আবার।

তখনো কাঁপছে পরেশ। ঘটনার রেশ যায় নি মন থেকে। লালি প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে জিজ্ঞাসা করল পরেশ কে ,

-      কি বলছ তুমি? এমন সব কথা কেন বলছ বাবা? কি হয়েছে তোমার?

লালির চোখ দুটো যেন কিছু খুঁজছে ওর বাবার চোখ থেকে। পরেশ কোনরকমে সাইকেল টা রেখে কলতলায় গিয়ে হাত পা ধুতে লাগল। চান না করলে যাবে না কাদার দাগ। আর বাঘমুড়ো ছুঁয়েছে, স্নান না করলে হয় নাকি? কি জানি কি রোগ বাধে আবার। জামা খুলতে গিয়ে বুকের মাঝে একটা টনটনে ব্যাথা অনুভব করল পরেশ। একটু হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল,

-      বলছি বলছি। দাঁড়া স্নান করে আসছি আমি!

ততক্ষনে লালি রান্না ঘরে গিয়ে বাবার জন্য গ্লাসে জল আর একটা ছোট রেকাবী তে চারটে বাতাসা নিয়ে বেরিয়ে এলো। পরেশ গামছায় মাথা, হাতমুখ মুছে লুঙ্গি আর জামা পরে নিল। মেয়ের হাত থেকে বাতাসা টা নিয়ে খেয়ে, ঢকঢক করে জল টা খেয়ে একটু শান্ত হলো। তারপরে বলল,

-      হ্যাঁ রে তোকে না উমা কাকি কত করে বলেছে, সন্ধ্যে বেলায় চুল খুলে এমন করে ঘুরে বেড়াবি না। তুই কি বড়দের একটা কথাও শুনবি না?
-      ইশ আমি কি বাইরে গেছি নাকি? আমি তো বাড়িতেই ছিলাম।
-      ভারি সত্যি বলিস তুই আমাকে। কোথায় কোথায় ঘুরে বেরাস আমি কি জানিনা বলতে চাস?
-      আচ্চা বাবা আর এমন করব না। আজকে হীরা ছিল যে সাথে। এখন বল দেখি, তুমি পরে গেলে কি করে সাইকেল থেকে?
-      বলচি। দুটি মুড়ি দে দেখি খাই।

মুড়ি খেতে খেতে ঘটনা টা বলল পরেশ লালি কে। লালির মুখের অভিব্যক্তি তেই বোঝা যাচ্ছিল কি মারাত্মক ভয় ও পেয়েছে। নিজেও একবার মধুসুদনের নামে কপালে হাত জোড় করে প্রণাম করে নিল সে বাবার অলক্ষ্যেই। পরেশ কে ঘটনা টা বলতে হবে সবাই কে। বেঁচে হয়ত সে ফিরেছে, কিন্তু ব্যাপার টা ভাবনার বেশ। হয়ত এই কয়েক সহস্র বছরের ইতিহাসে এটাই প্রথম, বাঘমুড়োর কবল থেকে কেউ বেঁচে ফিরল। এটা ভালো না খারাপ, পরেশ নিজেই বুঝতে পারছে না। নগেন জ্যাঠা কে না বললে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। হয়ত জ্যাঠা কিছু বলতে পারবে এই সম্পর্কে। আজ পর্যন্ত, বাঘমুড়োর শিকার কেউ আটকাতে পারে নি। যদিও গত দশ বছর বাঘমুড়ো শিকার ধরেও নি। কিন্তু ব্যাপার টা চিন্তার। অতো বড় সাদা কুকুর ই বা কোথা থেকে এলো গ্রামে। কই কেউ তো দেখেনি কোনদিন? কি জানি রাধামাধবের কি লীলা।

খেয়ে দেয়ে, পরেশ বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। তখনো হাত পা কাঁপছিল পরেশের। লালি, রান্না ঘরের জানালা দিয়ে দেখল , ওর বাবা পড়তে পড়তে সামলে নিল নিজেকে সদর দরজার একটা কপাট ধরে নিয়ে। হালকা বলিরেখা ফুটে উঠল লালির ছোট্ট কপালে।
Like Reply


Messages In This Thread
RE: বাঘমুড়োর আতঙ্ক - শুরু- পেইজ ৩ থেকে- পর্ব ২- পেইজ ৫ - by nandanadasnandana - 11-06-2022, 06:36 PM



Users browsing this thread: 12 Guest(s)