06-06-2022, 10:29 PM
মেঘ রোদ্দুর
বসের রুমে পিনপতন নীরবতা, একটা বিশাল ফাইল টেবিলের উপর রাখা। আরেকটা ফাইল ম্যানেজার ম্যাডামের হাতে, সেটার উপর চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে।
-স্যার কি নিয়ে কথা বলবেন??
-শোন রুদ্র আশা করছি সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে একটা বড় প্রজেক্ট আমরা পেতে চলেছি। সেটার প্রেজেন্টেশন আগামী সপ্তাহে, আর আমি তো তুমি ছাড়া আর কারও উপর নির্ভর করতে পারি না সেটা তুমি ভাল করেই জানো।
-আমাকে প্রজেক্টের ফাইল গুলো দিয়ে দিবেন আর ক্লাইন্ডদের ক্রাইটেরিয়া গুলো বলবেন তাহলেই হবে। আর স্যার আরেকটা আবদার আছে?
-কি আবদার বলো?
-আমাকে একটা টিম দিতে হবে। আমি চাই নিজের মত একটা টিম করে নিতে।
-এ ব্যাপারে ম্যানেজার ম্যাডাম তোমার সাথে কথা বলবে, তোমার যা যা লাগবো সবকিছুই রিদ্ধিমা তোমাকে প্রোভাইড করবে।
ম্যানেজার ম্যাডাম কিছু একটা বলতে যাবে তখনি রুদ্রর ফোনটা বেজে উঠে।
-এক্সকিউজ মি, প্লিজ ফোন টা এটেন্ড করে নিই আগে তারপর কথা বলছি।
ম্যানেজার ম্যাডাম রুদ্রর এমন ব্যাবহারে খুব একটা খুশি হয়নি সেটার তার মুখের অভিব্যক্তি থেকেই বুঝা যাচ্ছে। সেটার দিকে মনোযোগ না দিয়ে সে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে দেখে রুপালির ফোন এসেছে।
-হ্যাঁ বলো, অপারেশনের কি অবস্থা?
-এইতো আধঘন্টা আগে ওটি তে নিয়েছে। আমার খুব টেনশন হচ্ছে।
-টেনশন করার কিছুই নেই। ডাক্তার আমার পরিচিত আছে তার সাথে সব কথা হয়েছে। এরপরও আমি অফিস শেষে হাসপাতাল হয়ে যাবো।
-তোমাকে একবার আসতে হবে, আমার তো এসবে অভিজ্ঞতা নাই সব কেমন গুবলেট হয়ে যাচ্ছে।
-আচ্ছা আমি আসবো আর টাকা লাগলে বলো কিন্তু। এখন রাখি একটা মিটিং এ আছি, বাই।
ফোনটা টেবিলে রেখে সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো দু জোড়া চোখ দৃষ্টিকটু ভাবেই ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
-এটা কোন ধরণের অভদ্রতা মি. রুদ্র। আমরা একটা মিটিংয়ে আছি আর সেখানে আপনি ব্যক্তিগত কল এ্যাটেন্ড করছেন। আমরা কি এখানে আড্ডা দিতো আসছি নাকি?
-স্যরি ম্যাম। কল টা ইম্পর্ট্যান্ট ছিলো।
-এর মানে আমরা যেটা নিয়ে আলোচনা করছি সেটা ইম্পর্ট্যান্ট না? আপনরার সাখে এ বিষয়ে কথা বলে লাভ নেই। আচ্ছা যে বিষয়ে কথা বলছিলাম, সামনের প্রজেক্ট টা আমাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে। মার্কেটে আমাদের নতুন ইমেজ ক্রিয়েট করবে। তাই আমি ও বস দুজনেই চাই আপনি সেটা ভালভাবে দেখভাল করেন।
-আমার সর্বোচ্চ টা দেবার চেষ্টা করবো। তবে আমার টিম টা আমি নিজেই সিলেক্ট করতে চাই৷
-সরি এটা সম্ভব না সেটা আমিই সিলেক্ট করে দিবো, তবে ভয়ের কিছু নেই যাদের দেব তারা সবাই ভাল তাদের সেক্টরে। এই নিন তাদের নামের লিস্ট।
ফাইলটাতে চোখ বুলাতে বুলাতে রুদ্রের মন যারপরনাই হতাশ হচ্ছে কোন মেয়ের নামই নেই। কোথায় ভেবেছিল তনয়া কিংবা নতুন কোন মেয়েকে নিয়ে কাজ করতে পারবে। নতুন মাংসের স্বাদ নিবে এখন দেখছে সব কেমন নিরামিষ হয়ে যাচ্ছে।
-ম্যাম একদুজন কি আমার চয়েজে নেয়া যায় না? নিজের কাজে কমফোর্টেবল ফিল করতাম।
-সেটা পরে দেখা যাবে, এখানে একজনের নাম নেই সে তোমাকে এসিস্ট করবে।
-কে সে?
-এইতো এখনি আসবে
বলতে না বলতেই একজন রুমের দরজাটা ঠেলে সরিয়ে ভিতরে ঢুকলো।
-এইতো রিতা এসে গেছে। এসো এসো ঐ চেয়ারটাই বসো। মি. রুদ্র রিতা আপনাকে এসিস্ট করবে।
রুদ্র পাশে ফিরে তাকাতেই দেখে পেষ্ট কালারের সালোয়ার কামিজ পড়া একটা মেয়ে ওর পাশে বসেছে। উজ্জল শ্যামলা রঙের গোলগাল চেহারার মেয়েটার খাড়া নাকটা আলাদা ভাবে নজর কাড়ে। চমশার আড়ালে কাজলে আকা চোখ। সাজ পোশাকে খুব আধুনিক মেয়ে বলা মুশকিল। মাঝারী গড়নের শরীরের উপরিবক্ষ ওড়নার নিচে সযতনে ঢাকা চাইলেও খুব বেশি পরিমাপ করা যাচ্ছে না। তবে শারীরিক গড়নের সাথে মানানসই স্তনজোড়া যথেষ্ট আকর্ষণীয় হবে সেটার জন্য রকেট সাইন্স জানতে হয় না নিশ্চয়ই।
-যাক নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।(নিচু স্বরে কথাটা হঠাৎ বলে ফেলে।
-কিছু বললেন?
-না না তেমন কিছু না।
আচ্ছা তাহলে এখন সবাই নিজের কাজে যাই বিকেলে কনফারেন্স রুমে দেখা হচ্ছে৷ একে একে সবাই রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। রিতার পিছু পিছু রুদ্রও রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ওর কাছে মুখটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছে কিন্তু মনে করতে পারছে না।
-মিস রিতা আপনি একটু পর আমার রুমে দেখা করবেন।
-ওকে স্যার।
ভাগ্যিস ঠিক সময়ে লোকটা এসেছিল, নইলে আজ ওদের সাহস যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন এমন সহ্য হয় নাকি, কলেজ শেষে বাসের জন্য অপেক্ষা টা প্রথমে যেমন রোমাঞ্চকর ছিল আজকাল সেটা বিভীষিকা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ছেলে গুলো দলবেঁধে এখানে এসে মেয়েদের টিজ করে চলে। আজেবাজে কথা বলার পাশাপাশি অশ্লীল আর কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে মেয়েদের দিকে। আশেপাশের মানুষ গুলো সঙের মত দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখে, কেউ কিচ্ছুটি বলে না। সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, ততক্ষণ পর্যন্ত হুশ হয়না যতক্ষণ না বিষয়টা নিজের সাথে না জড়ায়। কয়েকটা তো বাসে উঠেো পিছু নেয়, খুব বিরক্তিকর লাগে এসব কিছু। তবে আজ যে দাবড়ানি টা খেয়েছে তাতে কিছুদিনের জন্য হলেও ওদের উৎপাত টা কমবে সেটাই স্বস্তির।
লোকটা আগে কোন দিন এলো না কেন সেটাই আফসোস হচ্ছে৷ আজ আবার তাকে পৌঁছেও দিচ্ছে বাসায়। মেয়েদের মনে সহজে জায়গা করে নেয়ার জন্য এমন পদক্ষেপ যথেষ্ট। পোশাকে যতটুকু বুঝা যাচ্ছে তাতে তো মনে হয় চাকরি করে নয়তো বড় ক্লাসে পড়ে ইউনিভার্সিটি হবে হয়তো। ছেলে গুলোকে যখন ধমকাচ্ছিলো তখন লোকটার চোখ মুখের মাঝে একটা অদ্ভুত হিংস্রতা ছিল কিন্তু এখন আবার একদম শান্ত৷ চেহারা বলতে গেলে তেমন কোন ড্যাশিং হিরোর মত না তবে একটা মায়াবী ভাব আছে এই শান্ত অভিব্যক্তি তে। মেয়েদের পটতে এটাই অনেক, যেমন সে নিজেই অনেকাংশে পটে আছে। ধুর বাবা কখন থেকে কি সব ভেবে যাচ্ছে সে, এখনি যদি একটা থমক দেয় তবেই কেঁদে কেটে এক করে দিবে সে।আর বয়সের ফারাকটাও তো অনেক। মেয়েরা অনেক কিছু সহ্য করতে পারে কিন্তু যার কাছে মন দুর্বল হয়ে পড়ে তার একটুখানি রাগ ভাবও হৃদয়ে আঘাত করে চোখ ভেজায় ঝর্ণা ধারায়। সেটা খুব অল্পেই সহ্যের বিপদসীমা অতিক্রম করে চলে যায়, তখন মস্তিষ্ক কাজ করে কম হৃদয়ের প্রভাব থাকে বেশি।
-এখন কোন দিকে যেতে হবে?
লোকটার ডাকে সম্বিত ফিরে মেয়েটার। কিসব আবোল তাবোল ভাবছে সেই কখন থেকে। এই বয়সেই কত কি ভেবে ফেলেছে সে, এ জন্যই মা বলে সে ইঁচড়েপাকা হয়ে গেছে।
-এই সামনে বা দিকে যে রাস্তা টা।
-মে আই কাম ইন
দরজার দিকে তাকিয়ে,
-আমি এই অফিসের বস নই সাধারণ কর্মচারী মাত্র তোমাদের মতই, তাই এসব পারমিশনের দরকার নেই, সোজা চলে আসবে যখনি প্রয়োজন।
-মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে রুমের টেবিলের ওপাশে এসে দাড়ায় রিতা।
-এখন কি বসার জন্য অনুমতি চাইবে??(মুচকি একটা হাসি দেয় রুদ্র)
-যেভাবে বলছেন এখন যদি অনুমতি চাই তবে সেটা আর ভালো দেখায় না। (চেয়ার টেনে বসে পড়ে)
-একসাথে যেহেতু কাজ করতে হবে তবে আগে থেকেই ফ্রি মাইন্ডসেটে থাকলে কাজের অগ্রগতি হয় এটাই আমার থিউরি। তোমার কি মনে হয়?
-আপনি শিক্ষাগত যোগ্যতা হোক কিংবা কাজের ক্ষেত্রে সিনিয়র সব দিক থেকেই তাই আমিও সেটাই ফলো করবো।
-সিনিয়র টিনিয়র বুঝি না, আর এসব আপনে আজ্ঞে আমার পুষায় না। আমার একটা নাম আছে সেটা ধরে ডাকলেই খুশি হবো।
-ওকে।
-আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?(কথাটা বলতে বলতে নিজের চেয়ার ছেড়ে রিতার পাশের চেয়ার টা টেনে বসে রুদ্র)
-কি কথা?
-জানি না তুমি কিভাবে নিবে ব্যাপার টা, তবে তোমাকে আমার কেমন চেনা চেনা লাগছে। কোথাও যেন দেখেছি তোমাকে আগে, কিন্তু মনে পড়ছে না।
-(মুচকি হাসি দিয়ে) কোথায় দেখবেন আবার? আজই প্রথম দেখা৷ তা কেন এমন মনে হলো। এটা কি কোন ট্রিক ফ্লার্ট করার নাকি সত্যিই?
-মজা করছি না সত্যি বলছি তোমার মুখটা বিশেষ করে চোখ দুটো খুব চেনা লাগছে।
-এটা আপনার মনে ভুল হয়তো।
-এতটা ভুল হবার কথা না।
চশমার জন্য তোমার চোখ গুলো ঠিক করে ধরা দিচ্ছে না। দাঁড়াও চশমাটা খুলে নেই
হাত বাড়িয়ে চশমাটা খুলছে নিবে তখনি দরজা টা খোলার হালকা শব্দ হয়। দরজার দিকে তাকাতেই দেখে এক জোড়া চোখ ভয়ানক ভাবে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে। সঙ্গে সঙ্গেই আবার দরজা টা বন্ধ হয়ে গেল। রুদ্র চশমাটা রিতার হাতে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
তনয়া দাড়াও, প্লিজ আমার কথাটা শুনো বলে পিছন থেকে তনয়ার হাত টা ধরে নেয়। পিছন ফিরে হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু শক্তিতে পেরে উঠে না। ওর মুখটা কেমন লাল হয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণের মাঝে। রুদ্র ওকে শান্ত করানোর চেষ্টা করে।
-প্লিজ ঠান্ডা হয়ে একটু দাড়াও, আমার কথাটা তো শুনবে।
-কি শুনবো আর, যা দেখার তা তো দেখেছি।
-পাগল হলে নাকি তুমি, এখানে এসব বলার জায়গা নাকি। সবাই চেয়ে আছে সেটা দেখেছো।
-(চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে) না আমি কোথাও যাবো না। আমার কিছু শোনার নেই(আবার হাত টা টেনে নিতে চেষ্টা করে)
-তুমি রেগে আছো তাই এমন করছো, চলো ক্যান্টিনে গিয়ে বসি আগে মাথা টা তো ঠান্ডা হোক।
হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে তখনি ম্যানেজার ম্যাডাম উল্টো দিক থেকে আসতে থাকে ওদের দিকে। ওদের কাছে এসে রুদ্রের তনয়ার হাত ধরে রাখা, তনয়ার মুখ অবয়ব দেখে কি বুঝেছে সেটা সে নিজেই জানে।
-কি ব্যাপার মি রুদ্র? আপনি অফিসে এতজনের সামনে একটা মেয়ের হাত ধরে এভাবে টানাটানি করছেন কেন? এটা কি ধরণের অভদ্র ব্যবহার আপনার। আপনি জানেন আপনি ওনাকে মলেস্ট করছেন, চাইলে কিন্তু আপনাকে পুলিশে দিতে পারি।
কথাটা শুনে রুদ্রের মাথাটা গরম হয়ে যায়। বিষয়টাতে ম্যাডামের নাক গলানো টা ওর তেমন পছন্দ হলো না। রাগের মাথায় ও তনয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে ম্যানেজারের দিকে এগিয়ে যায়।
-আপনাকে এখানে নাক গলাতে কে বলেছে? আমাদের দুজনের ব্যাপার দুজনে বুঝে নিবো। অফিসে চাকরি করে বলে সবকিছুতে আপনি নাক গলাবেন সেটা মানবো না। আর আপনি পুলিশে দেবার কে? আমি যদি মলেষ্ট করে থাকি তবে সে নিজেই তো বলতে পারে, দরকার হলে সে পুলিশ ডাকুক, কথাটা শেষে করে তনয়ার দিকে তাকায় রুদ্র।
ঘটনার আকস্মিকতায় তনয়া ঠকঠক করে কাঁপছে, ও খেয়াল করে শুধু রুদ্র নয় যেন ফ্লোরের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যানেজার ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বুঝলো ম্যাডাম ওকে অভয় দিচ্ছে সত্যি বলার জন্য, কি করবে এখন সেটা বুঝে উঠতে পারে না। রুদ্রের দিকে হেলে পড়া নারী সহজে তাকে হারাতে চায় না। আর সত্য বলতে রুদ্র ঐ রকম কোন বাজে আচরনও করে নি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠে
-না ম্যাডাম তেমন কিছু হয় নি, এটা জাস্ট ভুল বুঝাবুঝি। আমরা নিজেরাই ঠিক করে নেব অন্য কোন এ্যাকশনে যাবার দরকার নেই। এমন ঘটনার জন্য আমি রিয়েলি সরি। প্লিজ ম্যাডাম বিষয় টা এখানেই শেষ করি।
-তুমি সরি বলছো কেন, সরি বললে ম্যাডাম কে বলতে হবে।(শাসিয়ে উঠে রুদ্র)
-আর কোন কথা নয় চলো এখান থেকে( রুদ্রের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে)
ম্যানেজার ম্যাডাম কে পাশ কাটার সময় ম্যাডাম রুদ্র কে লক্ষ্য করে নিচু স্বরে বলে উঠে
-তুমি কখনোই বদলাবে না।
তনয়া রুদ্রকে নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে যেতে থাকে। এতক্ষণে সবটাই দূরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিলো রিতা। একটু আগে ওর সামনে বসা রুদ্র আর ম্যানেজার ম্যাডামের সামনের রুদ্রের মাঝে বিশাল একটা ফারাক সেটা তার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। সে ভাবতে থাকে মানুষের ন্যাচার কত অদ্ভুত তাই না? একটু আগের শান্ত স্বভাবের লোকটাই হঠাৎই কতটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলো নিজের উপর একটা এ্যালিগেশন আসতেই।
বাসায় ফিরে নিজের রুমে ঢুকেই দেখে বিছানার একপাশে ওর বাসার পোশাক আগে থেকেই বের করে রাখা, সেগুলো নিয়ে বাথরুমে চলে গেল রুদ্র। মিনিট পাঁচেক পর ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখে টেবিলে গ্লাস ভর্তি জুস রাখা৷ আজকের এমন আথিতেয়তা দেখে একটু অবাকই হলো সে, তোয়ালে টা বিছানার দিকে ছুড়ে দিয়ে গ্লাস থেকে এক চুমুকে জুস টা সাবাড় করে ফেলে। খুব তেষ্টা পেয়েছিল সেটা বলার অবকাশ রাখে না।
-ভেজা তোয়ালে টা বিছানায় কেউ রাখে? তোকে নিয়ে আর পারি না। আমি না থাকলে তোর যে কি হবে সেটা নিয়ে ভেবে ভেবে আমার চুল পেকে গেল।
-তাই বুঝি দেখি তো কতগুলো চুল পাকলো?
বলেই ছুটকির দিকে এগিয়ে যায় সে।
-আমার অনেক কাজ আছে তোর মত বসে বসে খাই না। আমার পাকা চুল গুনতে হবে না।
-তা কি করে হয়, আমার চিন্তায় তোর চুল পেকে যাচ্ছে বিষয় টা আমার দেখতে হবে না। এত কি চিন্তা তোর।
ছুটকি তে একট হাতে ধরে আরেক হাতে ওর চুল গুলো এলো মেলো করে দেয়।
-ছাড় দাদা ভাল হবে না কিন্তু, মাত্র চুল গুলো আচড়িয়ে এলাম তুই সব আবার ঘেটে দিলি। মা তো সেই আমাকেই বকবে।
ছুটকি কে খাটে বসিয়ে ওর কুলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে রুদ্র
-সে আমি মাকে বলে দেব নে, তার আগে বল ঘটনাটা কি? আজ একটু খাতির দাঁড়ি বেশি হচ্ছে যে?
-কিসের ঘটনা হবে আবার আমি কি এমনিতে তোর দেখভাল করি না? অস্বীকার করতে পারবি?
-না না তুই ছাড়া আর কে আছে বাসায় যে আমার দিকে খেয়াল রাখে। এখন বল কি চাই তোর??
-(রুদ্রের চুলে বিলি কাটতে কাটতে) দাদা সামনে আমার এক বান্ধবীর বার্থডে পার্টি সেটাতে যেতে চাই। তুই নিয়ে যাবি কি?? আরেক টা ড্রেস দেখে এসেছি ওটা চাই।
-ড্রেস টা ব্যাপার না তবে পার্টিতে নিয়ে যেতে হবে কেন?
-পার্টি তো রাতে, বাবা তো পারমিশন দিবে না, তুই সাথে গেলে তবু রাজি হতে পারে।
-ওরে শয়তান বাবার সামনে আমাকে ঢাল দাঁড় করাচ্ছিস। আমি এসবে নেই, নতুন ড্রেস চাই সে এনে দেব।
-প্লিজ দাদা প্লিজ প্লিজ প্লিজ তুই আমার সোনা দাদা লক্ষী দাদা রাজি হয়ে যা না।
-(মুচকি হাসতে হাসতে) এত তেলবাজি করতে হবে না। যা আগে পারমিশন নিয়ে আয়।
-আমার সোনা দাদা আমি জানি তো তুই আমাকে কখনো না করবি না।
রুদ্রের দু গালে চুমু দিয়ে নাচতে নাচতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
রাতের খাবার শেষে সবকিছু গুছিয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে থাকে অঞ্জলি দেবী। ঘরে ঢুকে টেবিলের দিকে নজর দিতেই দেখে জগটা খালি হয়ে আছে। জগটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হবার সময় স্বামীর দিকে চোখ ঘুরায়। অবিনাশ বাবু বিছানায় হেলান দিয়ে বস অবস্থায় হাতে থাকা বইয়ের পাতায় মগ্ন।
-বইয়ের পাতায় যেভাবে বিভোর হয়ে আছো, ঘরে যে একটুকু জল নেই সেটার দিকেও একটু খেয়াল দিতে তবে তো আমার একটু হা পাতা গুলো বিশ্রাম দেবার সুযোগ হতো। সেটা কি আর আমার কপালে আছে? এ সংসারে আসার পর থেকে বাপ ছেলে মেয়ের দেখভাল করতে করতেই দিন কেটে যায়, একদন্ড ফুসরতের আশা নেই। আমার হলো পুড়া কপাল।
-(বইটা হালকা নিচে নামিয়ে, সামনের দিকে তাকিয়ে হালচাল বুঝার চেষ্টা করে) জগটা রাখো ওখানে আমি জল নিয়ে আসছি।
-থাক এখন আর এত আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না, যা করছিলে সেটাই করো এতবছর জল আনতে পেরেছি আজও পারবো।(হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়)
জল এনে, গুড নাইট লিকুইড মেশিন টা চালু করে বিছানা কাছে এসে বড় বাতি সুইটা অফ করে ডিম লাইট টা অন করে শুয়ে পড়ে। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসবে তখনি দরজায় টুকা পড়ে।
-কে?
-মা ঘুমিয়ে পড়েছো? ভিতরে আসবো?
-ঘুমোতে দিলি কোথায়? রাত হলেই তোদের কি যে হয়। আয় ভেতরে আয়।
দরজা টা ঠেলে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে আবার চাপিয়ে দেয় ছুটকি। বিছানার কাছে এসে ধীরে ধীরে বাবা কে ডিঙিয়ে মা বাবার মাঝখানে এসে বাবাকে হালকা করে ঢেলে দেয়।
-বাবা ঐদিকে চাপ একটু আমি এখানে শুবো।
-একটু শান্তি মত কি ঘুমাতেও দিবি নাকি রে ছুটকি? (হালকা সুরে ঝাঝিয়ে উঠে অঞ্জলি দেবী)
অবিনাশ বাবু নিজের দিকে সরে গিয়ে নিজের ডান হাত টা মেলে দিয়ে মেয়েকে ডাকে।
-মারে আয় এদিকে চুপচাপ শুয়ে পড় তোর মায়ের আজ মেজাজ টা একটু গরম। মনে হয় মাথায় তেল দেয় নি আজ।
-তাই নাকি, জানো যেহেতু তাহলে তুমি তেল দিয়ে দিতে পারতে।
-আর বলিশ না আমাকে তো একদম সহ্যই করতে পারে না। শুধু ঝাড়ির উপরে রাখে(ফিস ফিস করো বলতে থাকে)
-আমার কানে কিন্তু সব কথায় আসছে মেয়ের কান ভাঙানো হচ্ছে আমার নামে। আমি তাহলে অন্য রুমে চলে যাই তোমরা ইচ্ছে মত নিন্দা করো।
সাথে সাথে পাশ ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরে ছুটকি, ঘাড়ের কাছে মাথা টা গুজে দিয়ে
-ও মা তুমি রেগে যাও কেন? বাবা তো তোমাকে রাগাতেই ইচ্ছে করেই এমন কথা বলে। তুমি বাবার কথায় কান দিও না।
-(পাশ থেকে অবিনাশ বাবু বলে উঠে) আমার কথায় কতই বা কান দেয় তোর মা সে তো জানা। আমার কোন দামই নেই এই বাসায়।
-দেখলি তো তোর বাবা কি শুরু করে এই রাত বিরাতে। চুপ করতে বল তোর বাবাকে।
-(মায়ের গালে চুমু দিয়ে গাল ঘসতে ঘসতে) আমি বাবাকে আচ্ছা করে বকে দেব ঠিক আছে।
বাবা তুমি যদি আবার মা কে নিয়ে কিছু বলো তবে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।(এদিক ফিরে বাবার বুকে মাথা রাখে)
-(মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে) তা আমার মামনির কি আবদার সেটা শুনি এখন।
-বাবা, কিছুদিন পর আমার বান্ধবীর বার্থডে পার্টি, আমি যেতে চাই ছিলাম।
-অনুষ্ঠান দিনে না রাতে?
-রাতে।
-মা রাতে তো তোমাকে একা ছাড়া যাবে না। আর এখন তো তোমার মা কিংবা আমারো যাবার মত সময় নেই।
-জানি তো, তাই দাদাকে বলেছি যেতে।
-এর মাঝে দোসর জুটিয়ে নিয়েছো। তা সে কি সময় বের করতে পারবে তোর জন্য।
-আমার ছেলে কে বাজে কথা বলবে না(শাসিয়ে উঠে অঞ্জলি দেবী)
-সে যদি তোমার সাথে আসা যাওয়া অব্দি থাকে তবে আমার বলার কিছু নেই, যেতে পারো। তা পার্টির নতুন ড্রেসের জন্য টাকা লাগবে কি?
-আমার আগেই পছন্দ করা আছে, দাদা কিনে দিবে বলেছে।
-ও এর মাঝে দাদাকে পটানো হয়ে গেছে। তুই দিন দিন খুব শয়তান হয়ে যাচ্ছিস রে ছুটকি( মেয়ের বিনুনি করা চুল হালকে টেনে দিয়ে বলে উঠে অঞ্জলি দেবী)
মা বাবার মাঝে খানে শুয়ে থাকা ছুটকি ছোট বাচ্চাদের মত হা পা ছুড়ে হাসতে থাকে। মেয়ের হাসির শব্দে মা বাবার মুখেও হাসির রেখা ফুটে উঠে।
-আরেক জন যে দরজার ওপাশে আড়ি পেতে আছে সে ঘরে আসছে না কেন?
মায়ের কথা শুনে দরজা খুলে ভিতরে এসে মায়ের পাশে দাড়ায় রুদ্র। একটু সরে গিয়ে ছেলেকে শুবার জায়গা করে দেয় মা। অল্প জায়গাতেই আঁটোসাটো হয়ে শুয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। এক হাতে ছেলের পিঠে হাত বুলাতে থাকে অন্য হাতে বাবার বুকে শুয়ে থাকা মেয়ের চুলে বিলি কাটতে থাকে। সবার মুখজুড়ে প্রশান্তির অভিব্যক্তি।
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে, মন বাড়িয়ে ছুঁই।
দুইকে আমি এক করি না, এক কে করি দুই।।