07-05-2022, 04:41 PM
(20-04-2019, 03:54 PM)anangadevrasatirtha Wrote: আগন্তুক পুরুষের প্রতি তাহার এইরূপ অকপট ঔদার্য দেখিয়া কিছু বিস্মিত হইলাম। তবু বিনা বাক্য ব্যায়ে, কী জানি কীসের আকর্ষণে, তাহাকে নীরবে অনুসরণ করিলাম। মেয়েটি একটি ভগ্ন ভিটার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। এই রাতের আঁধারে ভাঙা বাড়িটাকে ভৌতিক-গৃহ বলিয়া মনে হইতেছে। গৃহটি যে বহু-বহুকাল পূর্বে মাটি, খড়, খাপড়া ইত্যাদি দ্বারা নির্মিত হইয়াছিল, কোনো এককালে যে এ স্থলে বনেদী গৃহস্থের বাস ছিল, সে কেবল অনুভূতি দ্বারাই বুঝা যায়, চোখে ধরা পড়ে না।
মেয়েটি বলিল: “আসুন!” আমি অভ্যন্তরে ঢুকিয়া আসিলাম। মেয়েটি প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করিয়া আমার সম্মুখে ফিরিয়া আসিল। এইবার আমি চমকাইয়া ফিরিয়া তাকাইলাম। আমার মুখ হইতে আপনা হতেই বাহির হইয়া আসিল: “শৈলবালা! তুমি?”
শৈল হাসিয়া কহিল: “আমি কিন্তু একবার দেখেই আপনাকে চিনেছি।… তা বলি, এক মুখ দাড়ি, চুলে তেল নেই, চোখের নীচে কালি, গায়ে ছেঁড়া জামা – এসব কী ব্যাপার? সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়েছেন বুঝি?”
আমি চোখ নামাইয়া কহিলাম: “সে আর হতে পারলাম কই!... ওলাউঠোয় মেয়ে-বউকে খেলো… সেই ইস্তক পথে-পথে ঘুরে মরছি। মনে আমার কোনো শান্তি নেই।…”
শৈল আমার কথা শুনিয়া মলিন হাসিল; মুখে কিছু বলিল না। তারপর কোথা হইতে এক-বাটি চিড়ে ও গুড় লইয়া আসিয়া আমার সম্মুখে স্থাপন করিল: “খান, খেয়ে নিন। মুখখানা তো একদম শুকিয়ে গেছে দেখছি।…”
অনেকদিন পর নারীকন্ঠের এইরূপ মধুর সংলাপ শুনিয়া আমার মনটা দ্রব হইয়া উঠিল। আমি হাতে-মুখে জল দিয়া আসিয়া কাঁসর বাটিখানা কোলের উপর টানিয়া লইলাম। শৈল উঠানের অপরপ্রান্তে চুলা জ্বালাইতে-জ্বালাইতে বলিল: “রাতে কিন্তু ভাত আর হিঞ্চেশাকের ঝোল ছাড়া আর কিছু খাওয়াতে পারব না। মাছ খেতে হলে, কাল ঘোষ-গিন্নীর কাছে সকালে হত্যে দিতে হবে।…”
আমি ওর কথা শুনে, মনে-মনে অবাক হইয়া যাইলাম। যে মেয়েটিকে একদিন আমরা তাহার চরম বিপদের মুখে বিন্দুমাত্র সাহায্য না করিয়া, অতি-তৎপরতার সঙ্গে বিদায় করিয়া দিয়াছিলাম, সে-ই আজ কেমন এক-লহমায় আমাকে আপন করিয়া লইয়াছে। সেইদিনের কথা চিন্তা করিয়া মনে-মনে দুঃখিত হইলাম। ওই বিপদের দিনেও আমি শৈলর শরীরের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলাম।…
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া ভাঙা কুটীরের চারদিকে তাকাইতে লাগিলাম। বাড়িটা মূল গ্রাম থেকে ছাড় হইয়া একটা সবেদা-বাগানের এক-পার্শ্বে অবস্থিত। এইটাই যে উপানন্দ বাঁড়ুজ্জের পৈতৃক-ভিটা এবং সেই বৃদ্ধ জ্যাঠার আবাসভূমি ছিল, বুঝিতে সংশয় হইল না। বাড়িময় আগাছার জঙ্গল বাড়িয়া উঠিয়াছে। ভাঙা গোয়ালে দুইটি শীর্ণ গরু নিশ্চল দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। আমি, শৈল ও ধেনু দুইটি ব্যাতীত গৃহে কোনো পঞ্চম জীবিত প্রাণীর সাড়া পাইলাম না। আমি কৌতুহলী হইয়া প্রশ্ন করিলাম: “তোমার ছেলেমেয়েরা সব কই?”
শৈল উনানে কড়াই চাপাইয়া খন্তা নাড়িতেছিল। আমার প্রশ্নে তাহার হাত থামিয়া যাইল। সে ঈষৎ সময় লইয়া বলল: “তারা সব মরেছে।… ওই কলেরাতেই…”
ছোট্টো দুটো কথা; তারপরই আবার শৈল স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়া যাইল। কিন্তু আমি নড়িয়া যাইলাম। অবাক বিস্ময়ে, নিশ্চল হইয়া উহার দিকে তাকাইয়া রইলাম। কী অসামন্য প্রাণশক্তি মেয়েটির। স্বামী মরিয়াছে, সন্তানরা কেহ বাঁচে নাই, দেশে মড়ক লাগিয়া সকলকে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে, তবু ও কেমন ক্ষুদ্র তারকার মতো অফুরাণ প্রাণশক্তিতে মহাকাশের বিশালতায় বাচিয়া আছে! কোনো প্রলয়ই টলাইতে পারে নাই উহার ক্ষীণ বেতসলতার ন্যায় জীবনীশক্তিকে। ভূতুড়ে শ্বশুরের ভিটাটাকে আঁকড়াইয়া ধরে, শৈল একা মেয়েমানুষ হইয়া যে জীবন-সংগ্রাম চালাইতেছে, তাহা আমার পক্ষে কল্পনা করাও দুষ্কর। আমি মনে-মনে ওকে প্রণাম না করিয়া পারিলাম না। বলিলাম: “তবে তোমার এখন আছে কে?”
ও আমার কথা শুনিয়া ফিরিয়া তাকাইল। মলিন হাসিয়া বলিল: “কেউ না।… জ্যাঠা-শ্বশুর তো সেই কবেই মরেছেন। তাপ্পর গেল ছেলেমেয়েগুলো… এখন এই লোকের বাড়ি ধান ভাঙি, ঘুঁটে দি। আর বাস্তুর লাগোয়া সবেদা-বাগানটা থেকে ফল-টল বেচে কোনো রকমে চলে যাচ্ছে। লোকে বলে, স্বোয়ামিকে খেয়েছি, ছেলেমেয়েদের খেয়েছি, ডাইনি আমি একটা! কিন্তু তাও রাত-বিরেতে পাঁচিলে সিঁধ দিয়ে, একা মেয়েমানুষের ঘরে লোক ঢুকে আসতে কসুর করে না কেউ! কুকুরের জাত সব! আমিও হেঁসোটায় ধার দিয়ে, মাথার কাছে নিয়ে শুই রাতে। একবার খগেন ঘড়ুই-এর ঘাড়ে এক-কোপ বসিয়ে দিয়েছলুম!... সেই থেকে ঢ্যামোনের জাতরা এ পথ মাড়াতে ভয় পায়।…”
কথাগুলো বলিবার সময় উনানের তাপে শৈলর মুখখানা রক্তাভ, স্বেদাক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। ওকে তখন কল্যানীয়া গিরি-তনয়া নয়, প্রকৃতার্থেই অসুরদলনী দশভূজা বলিয়া ভ্রম হইতেছিল আমার!...
অসাধারণ...