29-04-2022, 11:54 PM
পর্ব- পঁচিশ
পরদিন নিলয়কে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে দেয়। দিন পনের পর আবার এসে কিছু চেকআপ করাতে হবে। ঔষধ আর পুষ্টিকর খাবার খেতে বলেছে। তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে বারবার ঝাল আর মসলা কম দিয়ে। অটোতে করে দোলন আর তথার সাথে বাসায় ফিরে আসে নিলয়। বাসায় এসে নিজের রুমে গিয়ে গোছানো পরিপাটি দেখে বুঝতে পারে তথার স্পর্শ দুদিন আগেও অগোছালো রুম টা আবার সুন্দর দেখতে লাগছে। রান্নার খালা কে মোবাইল করে জানিয়ে দেয়া হয় দুপুর থেকে এসে রান্না করে যেতে৷ ঘরে রান্নার জন্য তেমন শাকসবজি, মাছ-ডিম কিছুই নেই তাই দোলন বের হয়ে যায় জিনিস গুলো কিনে আনতে। নিলয় জামাকাপড় বদলে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে যাবার সময় তথার রুমে উকি দেয়, একপাশে বড় একটা ব্যাগ রাখা। হয়তো ওটাতেই সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে তথা। নিজের রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখে তথা ওর জামা কাপড় গুলো নিয়ে যাচ্ছে।
-এগুলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছ। রেখে দাও আমি পড়ে ধুয়ে নেব নে।
-হাসপাতালের জামা কাপড় এভাবে ঘরে ফেলে রাখে নাকি কেউ। আর এ কটা জামা প্যান্ট আমি ধুয়ে নিতে পারবো। তোমার আর এ শরীরে আমার এত উপকার করতে হবে না।
তথা হনহন করে হেটে চলে যায়। নিলয় আর কথা বাড়ায় না, বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। ও জানে তথার মনের ভিতরে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি টগবগ করে ফুটছে, যে কোন সময় বিকট শব্দে অগ্নুৎপাত হতে পারে। তাই ওকে বেশি ঘাটাতে যায় না।
এ কদিন ধরে পুরো রেষ্টে আছে নিলয়। দোলন প্রতিদিন এসে সারাদিন থেকে বিকেলে চলে যায়। গত কয়েক দিনে তথা যেন হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছে। আগের মত ছটফটে ভাব টা আর নেই। নিলয় খেয়াল করে ওর দুচোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। খুব একটা নিলয়ে কাছে আসে না৷ দোলন থাকলে ওর হাত দিয়েই সব পাঠিয়ে দেয়। এরপরও যদি নিলয়ে ঘরে আসে তবে মাথা নিচু করে কাজ শেষ করে চুপচাপ চলে যায়। নিলয়ের মনে হয় তথা ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে। ওর দুচোখ নিলয়ের কাছ থেকে লুকাতে চাইছে। তথার এমন আচরণ টা নিলয় কে কুঁড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ও জানে তথা কে মানসিক ভাবে আঘাত করেছে, সেটা করে সে নিজেও ভাল নেই। কিন্তু তথার এমন চেহারা যেন ওকে আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে। সারাদিন দোলন সামনে থাকে তাই তেমন কিছু বলতেও পারে না আর বাকিটা সময় তথা তো নিজেকে রুমে একপ্রকার বন্দীই করে রাখে৷
আজ সন্ধ্যার দিকে বাইরে অনেক বাতাস বইছে। হয়তো কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাস টা খুব ঠান্ডা। নিলয় ছাদে গিয়ে চেয়ারে বসে থাকে। মূহুর্তেই ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে আসে। ভালই ঠান্ডা লাগছে নিলয়ের গায়ে কাটা দেয়। তথা চা নিয়ে নিলয়ের রুম ফাকা দেখে ছাদের দিকে যায়। চা হাতে তথাকে দেখে আরেকটা চেয়ার এগিয়ে দেয় বসার জন্য। নিলয়কে চা দিয়ে তথা চেয়ারে বসে অন্যদিকে মুখ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিরবতা ভাঙে নিলয়ের কথায়
-দুপুরে খাওয়া দাওয়া করেছো।
-(মুখে কিছু বলে না শুধু হ্যাঁ বোধক ভাবে মাথা নাড়ায়)
-আমি তো এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কার সাথে কথা বলছো। এদিকে তাকাও
-নিলয়ের দিকে ফিরে মাথা নিচু করে রাখে।
-(একটু উঁচু গলায়) আমার দিকে তাকাও।
মাথা তুলে নিলয়ের দিকে তাকায় তথা।
-নিজের কি অবস্থা করেছো তুমি একবার আয়নায় দেখেছো৷ ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছো না৷ নিজের খেয়াল না রেখে আমার জন্য এতসব কে করতে বলেছে।
-কেউ কিছু বলে নি। এতদিন তো আমার জন্য অনেক করেছো, আর যে কদিন আছি সে কদিন না হয় আমিই করলাম। পরে অন্য কেউ এসে দায়িত্ব নিবে৷(কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ায়, নিজের রুমের দিকে হাটতে থাকে৷)
নিলয় চেয়ে থাকে তথার প্রস্থানের দিকে।
পরদিন সকালে নিলয় একটু কাজ আছে বলে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। তথা বারবার না করছিলো কিন্তু নিলয় শোনে নি৷ কিছুক্ষণ পর দোলন আসে বাসায়। নিলয় কে রুমে না দেখে তথার রুমের দিকে যায়।
-নীলু কোথায়?
-বললো কি কাজ আছে তাই বাইরে গেল।
-ও বললো আর তুমি যেতে দিলে। আটকাতে পারলে ন। ওর তো রেষ্টে থাকতে হবে আরও কিছু দিন।
-বলেছিলাম আমি কিছু শোনে নি। আপনার নাম্বার তো আমার কাছে নেই নয়তো তখনি ফোন করতাম।
-তোমার কথা শোনেনি মানে কি। ঘরে ওর বউ হয়ে বসে আছো আর ওকে আটকে রাখতে পারো না। তাহলে বউ হয়ে লাভ কি।
-(মাথা নিচু করে) আমি তো তেমন কেউ না। আর আমি তো কদিন পরেই চলে যাবো। কিন্তু ও আপনাকে খুব মানে, আপনার কথা শুনে চলে। আপনি ওকে আটকে রাখতে পারবেন।
(গত কয়েকদিনের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে দোলন ঠিকই আন্দাজ করতে পারছে। ওর কাছে নিলয়ের মনের অবস্থা আর তথার অবস্থাও অনেকটা স্পষ্ট হচ্ছে। দুজনের কারও হাবভাব তেমন ভালো ঠেকে না দোলনের কাছে। ওকে আরও ভাল করে জানতে হলে কথা বলতে হবে দুজনের সাথেই।)
-তুমি সত্যিই চলে যাবে এখান থেকে। থাকার ইচ্ছে নেই।
-চলেই যেতে হবে সেরকমটাই সবাই চায়।
-দেখো আমি তোমার বড় দিদির মতই। আপনে আজ্ঞে করার দরকার নেই। আর আমার সাথে সব কিছু খুলে বলো। দরকার হলে আমি কথা বলবো নীলুর সাথে।
-(ইতস্তত বোধ করে)না দিদি তেমন কিছু না
-তোমার বয়সি আমার ছোট বোন আছে। আমাকে যদি আপন না ভাবতে পারো তবে থাক আমি চলে যাই।
-(নরম মনে আঘাত হানে দোলনের কথা গুলো চোখের জল বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসে। কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে দোলনকে আর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে) দিদি।
-এ কিরে পাগলী মেয়ে কাঁদে কেন বোকার মত। কি হয়েছে৷ তুই কি এখানেই থাকতে চাস।
-(দোলনের মুখে তুই ডাক শুনে মন আরও গলে যায়) হুম দিদি, কিন্তু ও...
-তুই কি নীলুকে ভালবাসিস?
-(মাথা নিচু করে) জানি না দিদি। তবে ওকে ছাড়া থাকতে পারি না। ওকে না দেখলে কেমন জানি লাগতে থাকে। এই যে দুদিন দেখতে পারি নি কথা বলতে পারি নি তখন যে আমার কেমন যে অনুভব হয়েছে তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না।
-বুঝেছি বুঝেছি আর কিছু বলতে হবে না। এখন চোখ মুছে একটু হাসি দে দেখি। আর চিন্তা করতে হবে না। বাকিটা আমি দেখছি। আর শোন কিছু জিনিস নিজ থেকে আদায় করে নিতে হয়। এখন আমি আসি কাল আসবো নে। আমার নাম্বার টা নে, নীলু আসলে আমাকে জানাবি।
-(হাসি মুখে) আচ্ছা দিদি।
সিড়ি ধরে নেমে আসছে দোলন না দোলনের জীবন্ত লাশ। কে বলেছে শুধু পুরুষরাই শক্ত মনের হয় আজ তো দোলন দেখিয়ে দিল মেয়েরাও শক্ত মনে হয়। আজ নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে তথার জন্য ভাবতে হলো। অন্য কেউ হলে হয়তো ভাবতো না কিন্তু ও দেখেছে নীলুর চোখেও তথার প্রতি সেই টান, মায়া টা দেখেছে। নীলুও হয়তো তথাকেই চায়। কিন্তু বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। বিল্ডিং থেকে নেমে রিক্সায় উঠে দোলন। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভিজে উঠা চোখ টা মুছে নেয়।
----★★★----
বিকেল থেকেই মাথাটা কেমন ধরে আছে। আজ গরম টা খুব বেশি কড়া রোদ উঠেছে বাইরে৷ এর মাঝেই একটু বাইরে গিয়েছিল কাজে। সেই কারণেই হয়তো মাথাটা ধরেছে। সেদিন বাসায় ফেরার পর তথা যেভাবে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছে নিলয় তো অবাক। হঠাৎ করে কি হলো আগের দিনও যে মুখে কুলুপ এটে ছিল সে আজ এমন চড়াও হলো কেন। তথার পর দোলনও সেই একই সুরে কথা বলে গেল। শেষে যখন ওকে তথার কথা বললো তখন হাসির রোল পড়ে যায়। নিলয় বুঝতে পারে ও দুটো মিলে কিছু একটা ঘট পাকাচ্ছে। নিলয় তথা কে ডেকে চা এর জন্য বলে।
-(চোখ বড় বড় করে) এখন চা হবে না। দোলন দি বলেছে এখন হরলিক্স দিতে। পরে চা করে দিব।
-ভালো ভালো, দোলনের ন্যাওটা হয়েছো খুব দেখছি।
-(মুচকি হেসে) সেটা আমদের দু বোনের ব্যাপার।
-বুঝি না তোমাদের ব্যাপার স্যাপার।
তথা কিছুক্ষণ পর মগ ভর্তি হরলিক্স দিয়ে যায়। ওর হাসি মুখটা দেখে মন ভরে যায় নিলয়ের। চোখটা একটু লেগে আসছিলো তখনি তথার ডাকে তন্দ্রা ভাবটা কেটে যায়।
-চা খাবে।
-হুম, মাথাটা খুব ধরে আছে।
-কপালে কি মাসাজ করে দিবো।
-আগে চা টা খাই তারপর।
চা খেয়ে চোখবন্ধ করে শুয়ে আছে নিলয়, তথা পাশে বসে কপালে দুপাশে আঙুল টিপে ধরে মাসাজ করে দিচ্ছে।
-তোমার ক্লাস কবে থেকে শুরু হবে।
-(মূহুর্তেই বিষাদে ছেয়ে গেছে মুখ) এইতো আরও মাসখানেক পরে।
-কবে যাবে তুমি। টিকিট করতে হবে তো।
-(গোমড়া মুখে) আমি ওখানে পড়বো না।
-পড়বো না মানে কি৷ কি বলতে চাও।
-আমি ওখানে গিয়ে পড়বো না। সেটাই বললাম।
-তাহলে কি করতে চাও। তোমার ইচ্ছে কি?
-আমার একটা কথা রাখবে?
-হুম বলো রাখার মত হলে ঠিকি রাখবো।
-প্লিজ রাখবে বলো আর কিচ্ছু চাইবো না।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-আমি এখানে থেকেই পড়তে চাই। প্লিজ প্লিজ তুমি না করো না। কথা দিচ্ছি আর কোন দিন কিচ্ছু চাইবো না৷ শুধু এ বাসায় ঐ রুমটাতে থাকতে দিও তাহলেই হবে। কোন দিন কোন কিছু আবদার করবো না, জেদ করবো না। তুমি যা বলবে চুপচাপ মানবো। রাগারাগি ও করবো না। তবুও প্লিজ আমাকে এখানে থাকতে দিও।
এতক্ষণ চোখ বন্ধ করেই কথা বলছিল। এখন চোখ মেলে তাকায় নিলয়। তথার চোখে চোখ রাখে। নিলয় নিজেও তো আর চায় না তথাকে দূরে পাঠাতে। মাত্র দুদিনের জন্য চোখের আড়াল হতেই যে অবস্থা হয়েছিল নিজের সেটা আর কখনো হতে দিবে না। তথাকে চোখের আড়াল করতে পারবে না। তথা চাইলেও ওকে যেতে দিতো না। যেভাবেই হোক তথাকে সে নিজের কাছেই রেখে দিবে। আর তথা তো নিজেই চায় এখানে থাকতে। বেচারা মেয়েটাও তো এ কতদিন ধরে অনেক কষ্টে আছে। না না ও কে আর যেতে দেবে না।
-(অনেকক্ষণ ধরে নিলয়কে চুপ থাকতে দেখে) কি হলো। তুমি রাখবে না আমার কথা টা। তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে দূরে যেতে বলো না। (শেষের দিকে কান্নার সুর)
-আবার কাঁদে কেন কথায় কথায় কাঁদতে হয় নাকি। আবার কান্নাকাটি করলে কোন কথা শুনবো না।
-ঠিক আছে কাদবো না।
-মনে থাকে যেন। এখন যাও ঘুমোও গিয়ে পরে ভেবে তোমাকে জানাবো ঠিক আছে।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে তথা নিজের ঘরে চলে যায়।
নিলয় বিছানা ছেড়ে উঠে ছাদে কোনে গিয়ে দাড়ায়, চাঁদের আলোতে চারপাশ ঝলমল করছে। ভিতরে গুন গুন করে আওয়াজ তুলে
অবাক চাঁদের আলোয় দেখো
ভেসে যায় আমাদের পৃথিবী
আড়াল হতে দেখেছি তোমার
নিষ্পাপ মুখখানি
ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়
পরদিন নিলয়কে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে দেয়। দিন পনের পর আবার এসে কিছু চেকআপ করাতে হবে। ঔষধ আর পুষ্টিকর খাবার খেতে বলেছে। তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে বারবার ঝাল আর মসলা কম দিয়ে। অটোতে করে দোলন আর তথার সাথে বাসায় ফিরে আসে নিলয়। বাসায় এসে নিজের রুমে গিয়ে গোছানো পরিপাটি দেখে বুঝতে পারে তথার স্পর্শ দুদিন আগেও অগোছালো রুম টা আবার সুন্দর দেখতে লাগছে। রান্নার খালা কে মোবাইল করে জানিয়ে দেয়া হয় দুপুর থেকে এসে রান্না করে যেতে৷ ঘরে রান্নার জন্য তেমন শাকসবজি, মাছ-ডিম কিছুই নেই তাই দোলন বের হয়ে যায় জিনিস গুলো কিনে আনতে। নিলয় জামাকাপড় বদলে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে যাবার সময় তথার রুমে উকি দেয়, একপাশে বড় একটা ব্যাগ রাখা। হয়তো ওটাতেই সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে তথা। নিজের রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখে তথা ওর জামা কাপড় গুলো নিয়ে যাচ্ছে।
-এগুলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছ। রেখে দাও আমি পড়ে ধুয়ে নেব নে।
-হাসপাতালের জামা কাপড় এভাবে ঘরে ফেলে রাখে নাকি কেউ। আর এ কটা জামা প্যান্ট আমি ধুয়ে নিতে পারবো। তোমার আর এ শরীরে আমার এত উপকার করতে হবে না।
তথা হনহন করে হেটে চলে যায়। নিলয় আর কথা বাড়ায় না, বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। ও জানে তথার মনের ভিতরে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি টগবগ করে ফুটছে, যে কোন সময় বিকট শব্দে অগ্নুৎপাত হতে পারে। তাই ওকে বেশি ঘাটাতে যায় না।
এ কদিন ধরে পুরো রেষ্টে আছে নিলয়। দোলন প্রতিদিন এসে সারাদিন থেকে বিকেলে চলে যায়। গত কয়েক দিনে তথা যেন হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছে। আগের মত ছটফটে ভাব টা আর নেই। নিলয় খেয়াল করে ওর দুচোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। খুব একটা নিলয়ে কাছে আসে না৷ দোলন থাকলে ওর হাত দিয়েই সব পাঠিয়ে দেয়। এরপরও যদি নিলয়ে ঘরে আসে তবে মাথা নিচু করে কাজ শেষ করে চুপচাপ চলে যায়। নিলয়ের মনে হয় তথা ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে। ওর দুচোখ নিলয়ের কাছ থেকে লুকাতে চাইছে। তথার এমন আচরণ টা নিলয় কে কুঁড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ও জানে তথা কে মানসিক ভাবে আঘাত করেছে, সেটা করে সে নিজেও ভাল নেই। কিন্তু তথার এমন চেহারা যেন ওকে আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে। সারাদিন দোলন সামনে থাকে তাই তেমন কিছু বলতেও পারে না আর বাকিটা সময় তথা তো নিজেকে রুমে একপ্রকার বন্দীই করে রাখে৷
আজ সন্ধ্যার দিকে বাইরে অনেক বাতাস বইছে। হয়তো কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাস টা খুব ঠান্ডা। নিলয় ছাদে গিয়ে চেয়ারে বসে থাকে। মূহুর্তেই ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে আসে। ভালই ঠান্ডা লাগছে নিলয়ের গায়ে কাটা দেয়। তথা চা নিয়ে নিলয়ের রুম ফাকা দেখে ছাদের দিকে যায়। চা হাতে তথাকে দেখে আরেকটা চেয়ার এগিয়ে দেয় বসার জন্য। নিলয়কে চা দিয়ে তথা চেয়ারে বসে অন্যদিকে মুখ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিরবতা ভাঙে নিলয়ের কথায়
-দুপুরে খাওয়া দাওয়া করেছো।
-(মুখে কিছু বলে না শুধু হ্যাঁ বোধক ভাবে মাথা নাড়ায়)
-আমি তো এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কার সাথে কথা বলছো। এদিকে তাকাও
-নিলয়ের দিকে ফিরে মাথা নিচু করে রাখে।
-(একটু উঁচু গলায়) আমার দিকে তাকাও।
মাথা তুলে নিলয়ের দিকে তাকায় তথা।
-নিজের কি অবস্থা করেছো তুমি একবার আয়নায় দেখেছো৷ ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছো না৷ নিজের খেয়াল না রেখে আমার জন্য এতসব কে করতে বলেছে।
-কেউ কিছু বলে নি। এতদিন তো আমার জন্য অনেক করেছো, আর যে কদিন আছি সে কদিন না হয় আমিই করলাম। পরে অন্য কেউ এসে দায়িত্ব নিবে৷(কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ায়, নিজের রুমের দিকে হাটতে থাকে৷)
নিলয় চেয়ে থাকে তথার প্রস্থানের দিকে।
পরদিন সকালে নিলয় একটু কাজ আছে বলে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। তথা বারবার না করছিলো কিন্তু নিলয় শোনে নি৷ কিছুক্ষণ পর দোলন আসে বাসায়। নিলয় কে রুমে না দেখে তথার রুমের দিকে যায়।
-নীলু কোথায়?
-বললো কি কাজ আছে তাই বাইরে গেল।
-ও বললো আর তুমি যেতে দিলে। আটকাতে পারলে ন। ওর তো রেষ্টে থাকতে হবে আরও কিছু দিন।
-বলেছিলাম আমি কিছু শোনে নি। আপনার নাম্বার তো আমার কাছে নেই নয়তো তখনি ফোন করতাম।
-তোমার কথা শোনেনি মানে কি। ঘরে ওর বউ হয়ে বসে আছো আর ওকে আটকে রাখতে পারো না। তাহলে বউ হয়ে লাভ কি।
-(মাথা নিচু করে) আমি তো তেমন কেউ না। আর আমি তো কদিন পরেই চলে যাবো। কিন্তু ও আপনাকে খুব মানে, আপনার কথা শুনে চলে। আপনি ওকে আটকে রাখতে পারবেন।
(গত কয়েকদিনের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে দোলন ঠিকই আন্দাজ করতে পারছে। ওর কাছে নিলয়ের মনের অবস্থা আর তথার অবস্থাও অনেকটা স্পষ্ট হচ্ছে। দুজনের কারও হাবভাব তেমন ভালো ঠেকে না দোলনের কাছে। ওকে আরও ভাল করে জানতে হলে কথা বলতে হবে দুজনের সাথেই।)
-তুমি সত্যিই চলে যাবে এখান থেকে। থাকার ইচ্ছে নেই।
-চলেই যেতে হবে সেরকমটাই সবাই চায়।
-দেখো আমি তোমার বড় দিদির মতই। আপনে আজ্ঞে করার দরকার নেই। আর আমার সাথে সব কিছু খুলে বলো। দরকার হলে আমি কথা বলবো নীলুর সাথে।
-(ইতস্তত বোধ করে)না দিদি তেমন কিছু না
-তোমার বয়সি আমার ছোট বোন আছে। আমাকে যদি আপন না ভাবতে পারো তবে থাক আমি চলে যাই।
-(নরম মনে আঘাত হানে দোলনের কথা গুলো চোখের জল বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসে। কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে দোলনকে আর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে) দিদি।
-এ কিরে পাগলী মেয়ে কাঁদে কেন বোকার মত। কি হয়েছে৷ তুই কি এখানেই থাকতে চাস।
-(দোলনের মুখে তুই ডাক শুনে মন আরও গলে যায়) হুম দিদি, কিন্তু ও...
-তুই কি নীলুকে ভালবাসিস?
-(মাথা নিচু করে) জানি না দিদি। তবে ওকে ছাড়া থাকতে পারি না। ওকে না দেখলে কেমন জানি লাগতে থাকে। এই যে দুদিন দেখতে পারি নি কথা বলতে পারি নি তখন যে আমার কেমন যে অনুভব হয়েছে তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না।
-বুঝেছি বুঝেছি আর কিছু বলতে হবে না। এখন চোখ মুছে একটু হাসি দে দেখি। আর চিন্তা করতে হবে না। বাকিটা আমি দেখছি। আর শোন কিছু জিনিস নিজ থেকে আদায় করে নিতে হয়। এখন আমি আসি কাল আসবো নে। আমার নাম্বার টা নে, নীলু আসলে আমাকে জানাবি।
-(হাসি মুখে) আচ্ছা দিদি।
সিড়ি ধরে নেমে আসছে দোলন না দোলনের জীবন্ত লাশ। কে বলেছে শুধু পুরুষরাই শক্ত মনের হয় আজ তো দোলন দেখিয়ে দিল মেয়েরাও শক্ত মনে হয়। আজ নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে তথার জন্য ভাবতে হলো। অন্য কেউ হলে হয়তো ভাবতো না কিন্তু ও দেখেছে নীলুর চোখেও তথার প্রতি সেই টান, মায়া টা দেখেছে। নীলুও হয়তো তথাকেই চায়। কিন্তু বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। বিল্ডিং থেকে নেমে রিক্সায় উঠে দোলন। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভিজে উঠা চোখ টা মুছে নেয়।
----★★★----
বিকেল থেকেই মাথাটা কেমন ধরে আছে। আজ গরম টা খুব বেশি কড়া রোদ উঠেছে বাইরে৷ এর মাঝেই একটু বাইরে গিয়েছিল কাজে। সেই কারণেই হয়তো মাথাটা ধরেছে। সেদিন বাসায় ফেরার পর তথা যেভাবে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছে নিলয় তো অবাক। হঠাৎ করে কি হলো আগের দিনও যে মুখে কুলুপ এটে ছিল সে আজ এমন চড়াও হলো কেন। তথার পর দোলনও সেই একই সুরে কথা বলে গেল। শেষে যখন ওকে তথার কথা বললো তখন হাসির রোল পড়ে যায়। নিলয় বুঝতে পারে ও দুটো মিলে কিছু একটা ঘট পাকাচ্ছে। নিলয় তথা কে ডেকে চা এর জন্য বলে।
-(চোখ বড় বড় করে) এখন চা হবে না। দোলন দি বলেছে এখন হরলিক্স দিতে। পরে চা করে দিব।
-ভালো ভালো, দোলনের ন্যাওটা হয়েছো খুব দেখছি।
-(মুচকি হেসে) সেটা আমদের দু বোনের ব্যাপার।
-বুঝি না তোমাদের ব্যাপার স্যাপার।
তথা কিছুক্ষণ পর মগ ভর্তি হরলিক্স দিয়ে যায়। ওর হাসি মুখটা দেখে মন ভরে যায় নিলয়ের। চোখটা একটু লেগে আসছিলো তখনি তথার ডাকে তন্দ্রা ভাবটা কেটে যায়।
-চা খাবে।
-হুম, মাথাটা খুব ধরে আছে।
-কপালে কি মাসাজ করে দিবো।
-আগে চা টা খাই তারপর।
চা খেয়ে চোখবন্ধ করে শুয়ে আছে নিলয়, তথা পাশে বসে কপালে দুপাশে আঙুল টিপে ধরে মাসাজ করে দিচ্ছে।
-তোমার ক্লাস কবে থেকে শুরু হবে।
-(মূহুর্তেই বিষাদে ছেয়ে গেছে মুখ) এইতো আরও মাসখানেক পরে।
-কবে যাবে তুমি। টিকিট করতে হবে তো।
-(গোমড়া মুখে) আমি ওখানে পড়বো না।
-পড়বো না মানে কি৷ কি বলতে চাও।
-আমি ওখানে গিয়ে পড়বো না। সেটাই বললাম।
-তাহলে কি করতে চাও। তোমার ইচ্ছে কি?
-আমার একটা কথা রাখবে?
-হুম বলো রাখার মত হলে ঠিকি রাখবো।
-প্লিজ রাখবে বলো আর কিচ্ছু চাইবো না।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-আমি এখানে থেকেই পড়তে চাই। প্লিজ প্লিজ তুমি না করো না। কথা দিচ্ছি আর কোন দিন কিচ্ছু চাইবো না৷ শুধু এ বাসায় ঐ রুমটাতে থাকতে দিও তাহলেই হবে। কোন দিন কোন কিছু আবদার করবো না, জেদ করবো না। তুমি যা বলবে চুপচাপ মানবো। রাগারাগি ও করবো না। তবুও প্লিজ আমাকে এখানে থাকতে দিও।
এতক্ষণ চোখ বন্ধ করেই কথা বলছিল। এখন চোখ মেলে তাকায় নিলয়। তথার চোখে চোখ রাখে। নিলয় নিজেও তো আর চায় না তথাকে দূরে পাঠাতে। মাত্র দুদিনের জন্য চোখের আড়াল হতেই যে অবস্থা হয়েছিল নিজের সেটা আর কখনো হতে দিবে না। তথাকে চোখের আড়াল করতে পারবে না। তথা চাইলেও ওকে যেতে দিতো না। যেভাবেই হোক তথাকে সে নিজের কাছেই রেখে দিবে। আর তথা তো নিজেই চায় এখানে থাকতে। বেচারা মেয়েটাও তো এ কতদিন ধরে অনেক কষ্টে আছে। না না ও কে আর যেতে দেবে না।
-(অনেকক্ষণ ধরে নিলয়কে চুপ থাকতে দেখে) কি হলো। তুমি রাখবে না আমার কথা টা। তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে দূরে যেতে বলো না। (শেষের দিকে কান্নার সুর)
-আবার কাঁদে কেন কথায় কথায় কাঁদতে হয় নাকি। আবার কান্নাকাটি করলে কোন কথা শুনবো না।
-ঠিক আছে কাদবো না।
-মনে থাকে যেন। এখন যাও ঘুমোও গিয়ে পরে ভেবে তোমাকে জানাবো ঠিক আছে।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে তথা নিজের ঘরে চলে যায়।
নিলয় বিছানা ছেড়ে উঠে ছাদে কোনে গিয়ে দাড়ায়, চাঁদের আলোতে চারপাশ ঝলমল করছে। ভিতরে গুন গুন করে আওয়াজ তুলে
অবাক চাঁদের আলোয় দেখো
ভেসে যায় আমাদের পৃথিবী
আড়াল হতে দেখেছি তোমার
নিষ্পাপ মুখখানি
ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে, মন বাড়িয়ে ছুঁই।
দুইকে আমি এক করি না, এক কে করি দুই।।