28-04-2022, 11:06 PM
পর্ব- চব্বিশ
ট্রেন এসে ময়মনসিংহ স্টেশন পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। নিজের ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে আসে তথা৷ প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে হাজারো মানুষের ভীড়ে চোখ দুটো খুঁজে চলে পরিচিত মুখখানি৷ ও তো জানতো আজ ফিরে আসবে তথা, তবুও কেন নিতে আসলো না। হয়তো ব্যস্ততার কারণে ফোন বা ম্যাসেজ করতে পারেনি তাই বলে ওকে নেবার জন্য স্টেশনেও আসতে পারলো না৷ এতটাই ভুলো মন হয়ে গেছে নাকি ওকে ভুলেই গেছে। মাত্র দুদিনের ব্যবধানে সব কিছু পাল্টে গেল কি করে। এ দুটো দিন তো তথার কাছে দুবছরের মত মনে হয়েছে। তাহলে কি সত্যই ভুলে যেতে চাইছে, এড়িয়ে যেতে চাইছে সবকিছু। তথার আর কোন অস্তিত্ব নেই নিলয়ের কাছে৷ যদি এমনি হবার কথা ছিল তবে সেটা আরও আগেই হলো না কেন? কেন এত মায়ায় জড়িয়ে নিয়ে এভাবে দূরে সরিয়ে দিলো নিলয় ওকে। আগেই তো ভাল ছিল, দিব্যি চলছিলো সবকিছু৷ তবে কেন ওকে নিজের এত কাছে নিয়ে আবার ভুলে যেতে চাইলো। তবে কি তথা কখনোই নিলয়ের ছিল না। যেটা ছিল সেটা শুধুই দায়িত্বের বেড়াজাল৷ আজ সেই জালে পচন ধরে বন্ধন গুলো আগলা হয়ে গেছে। সারাটা সময় ভেবেছিল ট্রেন থেকে নেমেই হয়তো নিলয়কে দেখতে পারবে ওর জন্য অপেক্ষা করছে, নিলয়ের মুখটা দেখে দুদিনের সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে৷ কিন্তু কই নিলয় তো আসেই নি। তথা ভেবে চলে আচ্ছা নিলয় কোথায় এখন, এতক্ষণে তো কাজ থেকে চলে এসেছে। বাসায় আছে নাকি ঐ মেয়েটির সাথে ঘুরতে গেছে কোথাও। হয়তো নিলয় সেই মেয়েটির কাছেই ভাল থাকে, মেয়েটিকে ভালবাসে। তার জন্যই তথার কথা টা একদম ভুলে গেছে। ভুলে যাওয়াই ভাল, তথাও ভুলে যাবে সব কিছু ছেড়ে চলে যাবে দূরে অনেক দূরে৷ আর কখনো আসবে না এই শহরে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাবার সময় আরেকবার ফোন করে নিলয়ের নাম্বারে, সেই আগের উত্তরই আসে।
রাগ, অভিমান, অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে তথার হৃদয়ে। বাসায় এসে দেখে দরজায় তালা ঝুলছে, এর মানে নিলয় বাসায় নেই। সে যেখানে খুশি থাকুক তথার সেদিকে আর চিন্তা করার কিছুই নেই। সে চিন্তা করেই বা কি করবে সেই অধিকার তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বাসায় ঢুকে নিজের রুমে চলে যায় তথা৷ কেন জানি আজ এই ঘরটাতে তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। এতদিনের এই ঘরটা এখন আর তার নেই। এই ঘর কেন এই বাসা বাসার আরেকটা মানুষ কোন কিছুই তো আর তার নেই। ইচ্ছে হচ্ছে এখনি চলে যেতে, আর এক মূহুর্ত এখানে থাকাতে চাইছে না তার মন। প্রতিটা মূহুর্ত ত্রিশূল হয়ে বিঁধছে তার বুকে। যদি পারতো এখনি চলে যেত কিন্তু নিলয়ের কাছ থেকে শেষ বিদায় টা তো নিতে হবে। কলেজে ক্লাস শুরু হতে এখনো মাস দুয়েক বাকি। আগের পরিবেশটা থাকলে এই সময়টা কতটা আনন্দে কাটতো তথার৷ কিন্তু সেই তথা আজ পালিয়ে যেতে চাইছে। টেবিলে বসে সেই কখন থেকে দুচোখে ঝর্ণা ধারা বয়ে চলেছে। এই রুম টা এই বাসাটা, নিলয়ের মায়ায় আটকে গেছিলো সব। আর আজ সব শেষ কিচ্ছু নেই। না এভাবে বসে থাকলে তো আর চলবে না, তার সব কিছু গুছিয়ে তো নিতে হবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, পুরো ঘরটাতে চোখ বোলায়। গলাটা শুকিয়ে আসে, ঘরে জল নেই জল খাবার জন্য বাইরের রুমটাতে আসে।
রান্নার জায়গাটাতে এসে অবাক হয় তথা। বাসনপত্র কেমন অগোছালো অপরিষ্কার হয়ে পড়ে আছে। রান্নার খালা কি আজ আসে নি? ভাতের পাত্রের ঢাকনা সরাতেই বিকট দুর্গন্ধের বমি আসার উদ্রেক হয়। ভাত পঁচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে তাড়াতাড়ি ঢাকনাটা আবার চাপিয়ে দেয়। তথা ভেবে পায় না এমন অবস্থা কেন এখানের। দুশ্চিন্তা উকি দেয় কৌতূহলী মনে। বোতল থেকে একটু জল গলায় ঢেলে নিলয়ের রুমে দিকে যায়। রুমে ঢুকে সেই পুরনো ঘরটাকে দেখতে পায়। জামাকাপড় সব এদিক ওদিক ছিটানো, অগোছালো টেবিল। টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় তথা শেষবারের মত টেবিল টা গুছিয়ে দেবার জন্য এরপর হয়তো অন্যকারও হাতের স্পর্শে আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। হঠাৎ চোখ পড়ে টেবিলের কোনে, একটা ট্রেনের টিকিট। হাতে নিয়ে দেখে ঐ দিনেরই একই ট্রেনের টিকিট টা, সীট নাম্বারটা তথার পাশের সীটের। তথা ভাবে, টিকিট কাটলো নিজের জন্য তবুও সাথে গেল না কেন নিলয়। রাগ হয় নিলয়ের এমন আচরণের। টেবিল গুছিয়ে বিছানায় এসে বসে, কিছুই ভাল লাগছে না তথার। এতক্ষণ হয়ে গেল নিলয় এখনো বাসায় আসলো না। বিমর্ষ বদনে নিলয়ের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মাথা টা বালিশ স্পর্শ করার পর শক্ত কিছু একটার উপলব্ধি হয়। বালিশটা সরাতেই দেখে নিলয়ের মোবাইল বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। দুশ্চিন্তা গ্রাস করে তথার মন কে। কি ঘটে চলেছে কিছুই বুঝতে পারে না। নিলয়ের মোবাইল বাসায়, রান্না ঘরে পঁচা খাবার পরে আছে, কিন্তু নিলয় বাসায় নেই। তাহলে ও কোথায় গেল, মোবাইল ছাড়া তো কোথাও যায় না নিলয়।
এভাবে আর বসে থাকতে পারে না তথা। যে করেই হোক নিলয়ের খবর তো নিতে হবে কিন্তু কি করে খবর নিবে৷ তেমন কাউকে তো চেনা না সে। নিলয়ের মোবাইলেও চার্জ নেই, না হলে ওর মোবাইল থেকে কারও নাম্বারে ফোন করে খবর নিতো৷ অনেক ভেবে বাড়িওয়ালার কাছে যাবে চিন্তা করে৷ সেখানে গিয়ে যদি কোন খবর নিতে পারে। তথা দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে দোতলায় বাড়ির মালিকে বাসায় যায়। কলিং বেল বাজাতেই আন্টি এসে দরজা খোলে।
----★★★----
তথার মনে কি চলছে বুঝার উপায় নেই। কোনভাবে টাকার পার্সে মোবাইলটা ঢুকিয়ে দৌড়ে নেমে আসে বিল্ডিং থেকে৷ ওর হৃদপিণ্ডে কেউ যেন প্রাণপণে হাপর টেনে চলেছে। চোখ দুটো ছলছলে আর নিজেকে নিজে ধমকে যাচ্ছে ভুল ভাল চিন্তা ভাবনা করার জন্য। রিক্সায় চেপে বসে তাড়াতাড়ি যেতে বলে। চালক যতটুকু সম্ভব ততটাই জোরে চালাবার চেষ্টা করছে তারপরও তথার কাছে মনে হচ্ছে আরও তাড়াতাড়ি যাচ্ছে না কেন রিক্সা টা।
রিক্সা এসে থামে ময়মনসিংহ মেডিকেল এর গেটে। এত মানুষের ভীড়ে কোন দিক দিয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারছে না। তথাকে যেতে হবে তৃতীয় তলার মেডিসিন বিভাগের পুরুষ ওয়ার্ডে। দু একজনকে জিজ্ঞেস করে চলতে শুরু করে তথা। এর আগে হাসপাতালে আসেনি তথা। এত মানুষের ভীড় আর ভাড়ি আওয়াজে গমগম করছে চারদিক। ট্রলি নিয়ে ছোটাছুটি চলছে। কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, কেউবা আসছে হাসপাতালে ভর্তি হতে। একজন মহিলার কোলে তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো দিন চারেকের এক শিশু পেছেনের মেয়েটাই হয়তো বাচ্চাটার মা, তার হাত ধরে আছে আরেকজন সবার চোখে মুখে আনন্দের রঙিন ঢেই। হঠাৎ আহাজারি শব্দ শুনতে পায় তথা, ট্রলিতে কাপড়ে পেচানো একটা দেহ পাশেই স্বজনে কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। মেডিসিন বিভাগের সামনে এসে হতবাক হয়ে যায় তথা৷ এ কোথায় এলো সে, হাসপাতালের রুমের সামনের বারান্দাটুকুও রোগীতে পরিপূর্ণ। পা ফেলার জায়গাটুকু পাওয়া মুশকিল। এত রোগীর ভিড়ে নিলয়কে কোথায় খুঁজবে। হাসপাতালে এসে নতুন অভিজ্ঞতা হলো তথার, কেউ হাসছে তো কেউ কাঁদছে। অনেক কষ্টে পা টিপে টিপে ওয়ার্ডে ঢুকে এদিক ওদিক চোখ বোলায়। দুপাশে প্রায় ষাট খানা বেডে রোগীতে পূর্ণ। দুবেডের মাঝের ফাঁকা ফ্লোরেও রোগী আছে। বেডের সামনেও রোগীর জায়গা হয়েছে। খুজতে খুজতে নিলয়ের বেডের সামনে এসে পৌঁছায়। পাশের টোলে একটা মেয়ে বসা, সেদিনে সেই মেয়েটা। বেডের কাছে গিয়ে দাড়াতেই মেয়েটা মুখ তুলে তথার দিকে তাকায়৷ নিলয় বেডে শুয়ে আছে হয়তো ঘুমোচ্ছে। হাতে স্যালাইন চলছে।
তথাকে দেখে দোলন চিনতে পারে। নিলয়ের মোবাইলে ওর ছবি দেখেছে। ছবির থেকে বাস্তবে তথাকে আরও পরিণত আর সুন্দর দেখতে। দোলন মনে মনে ভাবে এই মেয়ের জন্য নিলয় তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। এর জন্যই নিলয় নিজের খেয়াল না রেখে ওর দেখভাল করে চলে। আজ সব রাগ উগড়ে দিবে তথার উপর।
-তোমার নাম তো তথা তাই না? কখন এসেছো চিটাগং থেকে?
-হুম আমিই তথা৷ এইতো সন্ধ্যার দিকে এসেছি, বাড়ির মালিকের কাছে জানতে পেরে এখানে আসলাম। আপনাকে আমি দেখেছি আগে কিন্তু নামটা জানা নেই।
-আমি দোলন, নিলয়ের সেই ছোট বেলার বন্ধু (একটু থেমে কিছু একটা ভেবে) শুধু বন্ধু না তার চেয়ে বেশি।
-(প্রতিত্তোরে কি বলবে ভেবে পায় না) কি হয়েছে ওর, সিরিয়াস কিছু যে হাসপাতালে আনতে হলো।
-(রেগে গিয়ে) ন্যাকামি করো না। কিছুই জানো না বুঝি। তোমার জন্যই তো আজ ওর এই অবস্থা। নীলু শুধু তোমারটাই ভেবে গেছে সবসময়। তোমার পড়াশোনা নিয়ে টেনশন করে গেছে। নিজের প্রতি একটু খেয়াল ও নেয় নি। এতদিন ধরে ও অসুস্থ আর তুমি সেটা জানো না সেটা আমাকে মেনে নিতে হবে। কয়েকদিন ধরে হয়তো আরো বেশি অনিয়ম করেছে তাই শরীরটা আরও খারাপ করেছে। নইলে কেউ কি সাধে হাসপাতালে আসে। তোমার জন্য যদি আমার নীলুর কিছু হয় তাহলে আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়বো না।
-(চুপচাপ দাড়িয়ে চোখের জল ফেলতে থাকে তথার) সত্যিই আমি কিছু জানতাম না। আমাকে কখনো কিছু বলে নি। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম তখন বলেছিল একটু সমস্যা ছিল সেটা ভাল হয়ে গেছে।
-থাক আর কৈফিয়ত দিবে হবে না। এতদিন ধরে একসাথে আছো আর ওর খবর টুকুও রাখো না। মানুষটা কেমন আছে, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছে কিনা, শরীরটা ঠিক আছে কিনা সেসবের দিকে খেয়াল রাখলে না। নীলুর কাছ থেকে শুধু নিয়েই গেলে ওর দেখভাল টা অন্তত করতে পারতে। এসেছো যখন তবে এখানে বসো আমি ক্যান্টিন থেকে চা খেয়ে আসি। তোমার জন্য কিছু কি আনবো।
-(নীচু স্বরে) উহু লাগবে না।
টুল টা টেনে নিয়ে বেডের পাশে বসে তথা৷ নিজের দুহাতের মাঝে নিলয়ের হাতটা চেপে ধরে। নিজেকে নিজের আঘাত করতে ইচ্ছে করছে নিলয় কে ভুল বোঝার মত কাজ করার জন্য। সে কীভাবে পারলো নিলয় কে ভুল বুঝতে। যে মানুষটা তার জন্য এত কিছু করলো সে নাকি তার উপর অভিমান করলো। তবে তথার মাথায় আরেকটা কথাো ঘুরছে, দোলন বলেছিল "আমার নীলু" তাহলে কি নিলয়ের উপর তথার কোন অধিকার নেই। টপটপ করে চোখের জল ঝরছে। হাতটা ভিজে ঠান্ডা ভাব লাগায় ঘুম ভেঙে যায় নিলয়ের। চোখ খোলে তথা কে দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে।
-তুমি কখন এলে চিটাগং থেকে? হাসপাতালে কখন আসলে? কাঁদছো কেন বোকার মত?
-তুমি আমার সাথে এমন করলে কেন? এতোটা শরীর খারাপ তোমার একটাবার বললে না কখনো বুঝতে দিলে না। আমাকে বললে কি আমি খেয়াল রাখতাম না, তোমার দেখভাল করতাম না। আমি কি এতটাই পর? আমার জন্যই এমন হলো তোমার তাই না? আমার জন্য টেনশন করে, আমার পড়ালেখা, কোচিং, টিউশনের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে নিজের উপর এত চাপ নিতে গেলে কেন।
-এসব কে বলেছে তোমাকে? তোমার জন্য এমন হবে কেন। নিজের খেয়াল নিজেই রাখি নাই তাই এমন হয়েছে। দোলন কই গেল? ঐ পাগলীটা এসব বলেছে তাই না। ওর কথায় কিছু মনে করো না। আমার কষ্ট সহ্য করতে পারে না তো ওর তাই এমন করে বলেছে।( হাতের তালু দিয়ে তথার চোখ মুছে দেয়)
-আচ্ছা তুমি আমার জন্য এত কিছু করতে গেলে কেন?
-(কিছুক্ষণ চুপ থেকে)দায়িত্ববোধ থেকে।
-শুধুই দায়িত্ববোধ? আচ্ছা তোমার দায়িত্ববোধ কি বলে আমার সম্পর্কে।
-সবসময় সুখী দেখতে চায়, ভাল রাখতে চায়, হাসিখুশি দেখতে চায়।
-আর তোমার মন কি বলে, আমি কিসে সুখী থাকবো, কিসে ভাল থাকবো, কিভাবে হাসিখুশি থাকবো।
নিলয় কিছু বলে না শুধু তথার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তথার ছলছল করা দুচোখ অনেক কিছুই বলে যায়।
ট্রেন এসে ময়মনসিংহ স্টেশন পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। নিজের ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে আসে তথা৷ প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে হাজারো মানুষের ভীড়ে চোখ দুটো খুঁজে চলে পরিচিত মুখখানি৷ ও তো জানতো আজ ফিরে আসবে তথা, তবুও কেন নিতে আসলো না। হয়তো ব্যস্ততার কারণে ফোন বা ম্যাসেজ করতে পারেনি তাই বলে ওকে নেবার জন্য স্টেশনেও আসতে পারলো না৷ এতটাই ভুলো মন হয়ে গেছে নাকি ওকে ভুলেই গেছে। মাত্র দুদিনের ব্যবধানে সব কিছু পাল্টে গেল কি করে। এ দুটো দিন তো তথার কাছে দুবছরের মত মনে হয়েছে। তাহলে কি সত্যই ভুলে যেতে চাইছে, এড়িয়ে যেতে চাইছে সবকিছু। তথার আর কোন অস্তিত্ব নেই নিলয়ের কাছে৷ যদি এমনি হবার কথা ছিল তবে সেটা আরও আগেই হলো না কেন? কেন এত মায়ায় জড়িয়ে নিয়ে এভাবে দূরে সরিয়ে দিলো নিলয় ওকে। আগেই তো ভাল ছিল, দিব্যি চলছিলো সবকিছু৷ তবে কেন ওকে নিজের এত কাছে নিয়ে আবার ভুলে যেতে চাইলো। তবে কি তথা কখনোই নিলয়ের ছিল না। যেটা ছিল সেটা শুধুই দায়িত্বের বেড়াজাল৷ আজ সেই জালে পচন ধরে বন্ধন গুলো আগলা হয়ে গেছে। সারাটা সময় ভেবেছিল ট্রেন থেকে নেমেই হয়তো নিলয়কে দেখতে পারবে ওর জন্য অপেক্ষা করছে, নিলয়ের মুখটা দেখে দুদিনের সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে৷ কিন্তু কই নিলয় তো আসেই নি। তথা ভেবে চলে আচ্ছা নিলয় কোথায় এখন, এতক্ষণে তো কাজ থেকে চলে এসেছে। বাসায় আছে নাকি ঐ মেয়েটির সাথে ঘুরতে গেছে কোথাও। হয়তো নিলয় সেই মেয়েটির কাছেই ভাল থাকে, মেয়েটিকে ভালবাসে। তার জন্যই তথার কথা টা একদম ভুলে গেছে। ভুলে যাওয়াই ভাল, তথাও ভুলে যাবে সব কিছু ছেড়ে চলে যাবে দূরে অনেক দূরে৷ আর কখনো আসবে না এই শহরে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাবার সময় আরেকবার ফোন করে নিলয়ের নাম্বারে, সেই আগের উত্তরই আসে।
রাগ, অভিমান, অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে তথার হৃদয়ে। বাসায় এসে দেখে দরজায় তালা ঝুলছে, এর মানে নিলয় বাসায় নেই। সে যেখানে খুশি থাকুক তথার সেদিকে আর চিন্তা করার কিছুই নেই। সে চিন্তা করেই বা কি করবে সেই অধিকার তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বাসায় ঢুকে নিজের রুমে চলে যায় তথা৷ কেন জানি আজ এই ঘরটাতে তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। এতদিনের এই ঘরটা এখন আর তার নেই। এই ঘর কেন এই বাসা বাসার আরেকটা মানুষ কোন কিছুই তো আর তার নেই। ইচ্ছে হচ্ছে এখনি চলে যেতে, আর এক মূহুর্ত এখানে থাকাতে চাইছে না তার মন। প্রতিটা মূহুর্ত ত্রিশূল হয়ে বিঁধছে তার বুকে। যদি পারতো এখনি চলে যেত কিন্তু নিলয়ের কাছ থেকে শেষ বিদায় টা তো নিতে হবে। কলেজে ক্লাস শুরু হতে এখনো মাস দুয়েক বাকি। আগের পরিবেশটা থাকলে এই সময়টা কতটা আনন্দে কাটতো তথার৷ কিন্তু সেই তথা আজ পালিয়ে যেতে চাইছে। টেবিলে বসে সেই কখন থেকে দুচোখে ঝর্ণা ধারা বয়ে চলেছে। এই রুম টা এই বাসাটা, নিলয়ের মায়ায় আটকে গেছিলো সব। আর আজ সব শেষ কিচ্ছু নেই। না এভাবে বসে থাকলে তো আর চলবে না, তার সব কিছু গুছিয়ে তো নিতে হবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, পুরো ঘরটাতে চোখ বোলায়। গলাটা শুকিয়ে আসে, ঘরে জল নেই জল খাবার জন্য বাইরের রুমটাতে আসে।
রান্নার জায়গাটাতে এসে অবাক হয় তথা। বাসনপত্র কেমন অগোছালো অপরিষ্কার হয়ে পড়ে আছে। রান্নার খালা কি আজ আসে নি? ভাতের পাত্রের ঢাকনা সরাতেই বিকট দুর্গন্ধের বমি আসার উদ্রেক হয়। ভাত পঁচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে তাড়াতাড়ি ঢাকনাটা আবার চাপিয়ে দেয়। তথা ভেবে পায় না এমন অবস্থা কেন এখানের। দুশ্চিন্তা উকি দেয় কৌতূহলী মনে। বোতল থেকে একটু জল গলায় ঢেলে নিলয়ের রুমে দিকে যায়। রুমে ঢুকে সেই পুরনো ঘরটাকে দেখতে পায়। জামাকাপড় সব এদিক ওদিক ছিটানো, অগোছালো টেবিল। টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় তথা শেষবারের মত টেবিল টা গুছিয়ে দেবার জন্য এরপর হয়তো অন্যকারও হাতের স্পর্শে আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। হঠাৎ চোখ পড়ে টেবিলের কোনে, একটা ট্রেনের টিকিট। হাতে নিয়ে দেখে ঐ দিনেরই একই ট্রেনের টিকিট টা, সীট নাম্বারটা তথার পাশের সীটের। তথা ভাবে, টিকিট কাটলো নিজের জন্য তবুও সাথে গেল না কেন নিলয়। রাগ হয় নিলয়ের এমন আচরণের। টেবিল গুছিয়ে বিছানায় এসে বসে, কিছুই ভাল লাগছে না তথার। এতক্ষণ হয়ে গেল নিলয় এখনো বাসায় আসলো না। বিমর্ষ বদনে নিলয়ের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মাথা টা বালিশ স্পর্শ করার পর শক্ত কিছু একটার উপলব্ধি হয়। বালিশটা সরাতেই দেখে নিলয়ের মোবাইল বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। দুশ্চিন্তা গ্রাস করে তথার মন কে। কি ঘটে চলেছে কিছুই বুঝতে পারে না। নিলয়ের মোবাইল বাসায়, রান্না ঘরে পঁচা খাবার পরে আছে, কিন্তু নিলয় বাসায় নেই। তাহলে ও কোথায় গেল, মোবাইল ছাড়া তো কোথাও যায় না নিলয়।
এভাবে আর বসে থাকতে পারে না তথা। যে করেই হোক নিলয়ের খবর তো নিতে হবে কিন্তু কি করে খবর নিবে৷ তেমন কাউকে তো চেনা না সে। নিলয়ের মোবাইলেও চার্জ নেই, না হলে ওর মোবাইল থেকে কারও নাম্বারে ফোন করে খবর নিতো৷ অনেক ভেবে বাড়িওয়ালার কাছে যাবে চিন্তা করে৷ সেখানে গিয়ে যদি কোন খবর নিতে পারে। তথা দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে দোতলায় বাড়ির মালিকে বাসায় যায়। কলিং বেল বাজাতেই আন্টি এসে দরজা খোলে।
----★★★----
তথার মনে কি চলছে বুঝার উপায় নেই। কোনভাবে টাকার পার্সে মোবাইলটা ঢুকিয়ে দৌড়ে নেমে আসে বিল্ডিং থেকে৷ ওর হৃদপিণ্ডে কেউ যেন প্রাণপণে হাপর টেনে চলেছে। চোখ দুটো ছলছলে আর নিজেকে নিজে ধমকে যাচ্ছে ভুল ভাল চিন্তা ভাবনা করার জন্য। রিক্সায় চেপে বসে তাড়াতাড়ি যেতে বলে। চালক যতটুকু সম্ভব ততটাই জোরে চালাবার চেষ্টা করছে তারপরও তথার কাছে মনে হচ্ছে আরও তাড়াতাড়ি যাচ্ছে না কেন রিক্সা টা।
রিক্সা এসে থামে ময়মনসিংহ মেডিকেল এর গেটে। এত মানুষের ভীড়ে কোন দিক দিয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারছে না। তথাকে যেতে হবে তৃতীয় তলার মেডিসিন বিভাগের পুরুষ ওয়ার্ডে। দু একজনকে জিজ্ঞেস করে চলতে শুরু করে তথা। এর আগে হাসপাতালে আসেনি তথা। এত মানুষের ভীড় আর ভাড়ি আওয়াজে গমগম করছে চারদিক। ট্রলি নিয়ে ছোটাছুটি চলছে। কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, কেউবা আসছে হাসপাতালে ভর্তি হতে। একজন মহিলার কোলে তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো দিন চারেকের এক শিশু পেছেনের মেয়েটাই হয়তো বাচ্চাটার মা, তার হাত ধরে আছে আরেকজন সবার চোখে মুখে আনন্দের রঙিন ঢেই। হঠাৎ আহাজারি শব্দ শুনতে পায় তথা, ট্রলিতে কাপড়ে পেচানো একটা দেহ পাশেই স্বজনে কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। মেডিসিন বিভাগের সামনে এসে হতবাক হয়ে যায় তথা৷ এ কোথায় এলো সে, হাসপাতালের রুমের সামনের বারান্দাটুকুও রোগীতে পরিপূর্ণ। পা ফেলার জায়গাটুকু পাওয়া মুশকিল। এত রোগীর ভিড়ে নিলয়কে কোথায় খুঁজবে। হাসপাতালে এসে নতুন অভিজ্ঞতা হলো তথার, কেউ হাসছে তো কেউ কাঁদছে। অনেক কষ্টে পা টিপে টিপে ওয়ার্ডে ঢুকে এদিক ওদিক চোখ বোলায়। দুপাশে প্রায় ষাট খানা বেডে রোগীতে পূর্ণ। দুবেডের মাঝের ফাঁকা ফ্লোরেও রোগী আছে। বেডের সামনেও রোগীর জায়গা হয়েছে। খুজতে খুজতে নিলয়ের বেডের সামনে এসে পৌঁছায়। পাশের টোলে একটা মেয়ে বসা, সেদিনে সেই মেয়েটা। বেডের কাছে গিয়ে দাড়াতেই মেয়েটা মুখ তুলে তথার দিকে তাকায়৷ নিলয় বেডে শুয়ে আছে হয়তো ঘুমোচ্ছে। হাতে স্যালাইন চলছে।
তথাকে দেখে দোলন চিনতে পারে। নিলয়ের মোবাইলে ওর ছবি দেখেছে। ছবির থেকে বাস্তবে তথাকে আরও পরিণত আর সুন্দর দেখতে। দোলন মনে মনে ভাবে এই মেয়ের জন্য নিলয় তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। এর জন্যই নিলয় নিজের খেয়াল না রেখে ওর দেখভাল করে চলে। আজ সব রাগ উগড়ে দিবে তথার উপর।
-তোমার নাম তো তথা তাই না? কখন এসেছো চিটাগং থেকে?
-হুম আমিই তথা৷ এইতো সন্ধ্যার দিকে এসেছি, বাড়ির মালিকের কাছে জানতে পেরে এখানে আসলাম। আপনাকে আমি দেখেছি আগে কিন্তু নামটা জানা নেই।
-আমি দোলন, নিলয়ের সেই ছোট বেলার বন্ধু (একটু থেমে কিছু একটা ভেবে) শুধু বন্ধু না তার চেয়ে বেশি।
-(প্রতিত্তোরে কি বলবে ভেবে পায় না) কি হয়েছে ওর, সিরিয়াস কিছু যে হাসপাতালে আনতে হলো।
-(রেগে গিয়ে) ন্যাকামি করো না। কিছুই জানো না বুঝি। তোমার জন্যই তো আজ ওর এই অবস্থা। নীলু শুধু তোমারটাই ভেবে গেছে সবসময়। তোমার পড়াশোনা নিয়ে টেনশন করে গেছে। নিজের প্রতি একটু খেয়াল ও নেয় নি। এতদিন ধরে ও অসুস্থ আর তুমি সেটা জানো না সেটা আমাকে মেনে নিতে হবে। কয়েকদিন ধরে হয়তো আরো বেশি অনিয়ম করেছে তাই শরীরটা আরও খারাপ করেছে। নইলে কেউ কি সাধে হাসপাতালে আসে। তোমার জন্য যদি আমার নীলুর কিছু হয় তাহলে আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়বো না।
-(চুপচাপ দাড়িয়ে চোখের জল ফেলতে থাকে তথার) সত্যিই আমি কিছু জানতাম না। আমাকে কখনো কিছু বলে নি। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম তখন বলেছিল একটু সমস্যা ছিল সেটা ভাল হয়ে গেছে।
-থাক আর কৈফিয়ত দিবে হবে না। এতদিন ধরে একসাথে আছো আর ওর খবর টুকুও রাখো না। মানুষটা কেমন আছে, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছে কিনা, শরীরটা ঠিক আছে কিনা সেসবের দিকে খেয়াল রাখলে না। নীলুর কাছ থেকে শুধু নিয়েই গেলে ওর দেখভাল টা অন্তত করতে পারতে। এসেছো যখন তবে এখানে বসো আমি ক্যান্টিন থেকে চা খেয়ে আসি। তোমার জন্য কিছু কি আনবো।
-(নীচু স্বরে) উহু লাগবে না।
টুল টা টেনে নিয়ে বেডের পাশে বসে তথা৷ নিজের দুহাতের মাঝে নিলয়ের হাতটা চেপে ধরে। নিজেকে নিজের আঘাত করতে ইচ্ছে করছে নিলয় কে ভুল বোঝার মত কাজ করার জন্য। সে কীভাবে পারলো নিলয় কে ভুল বুঝতে। যে মানুষটা তার জন্য এত কিছু করলো সে নাকি তার উপর অভিমান করলো। তবে তথার মাথায় আরেকটা কথাো ঘুরছে, দোলন বলেছিল "আমার নীলু" তাহলে কি নিলয়ের উপর তথার কোন অধিকার নেই। টপটপ করে চোখের জল ঝরছে। হাতটা ভিজে ঠান্ডা ভাব লাগায় ঘুম ভেঙে যায় নিলয়ের। চোখ খোলে তথা কে দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে।
-তুমি কখন এলে চিটাগং থেকে? হাসপাতালে কখন আসলে? কাঁদছো কেন বোকার মত?
-তুমি আমার সাথে এমন করলে কেন? এতোটা শরীর খারাপ তোমার একটাবার বললে না কখনো বুঝতে দিলে না। আমাকে বললে কি আমি খেয়াল রাখতাম না, তোমার দেখভাল করতাম না। আমি কি এতটাই পর? আমার জন্যই এমন হলো তোমার তাই না? আমার জন্য টেনশন করে, আমার পড়ালেখা, কোচিং, টিউশনের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে নিজের উপর এত চাপ নিতে গেলে কেন।
-এসব কে বলেছে তোমাকে? তোমার জন্য এমন হবে কেন। নিজের খেয়াল নিজেই রাখি নাই তাই এমন হয়েছে। দোলন কই গেল? ঐ পাগলীটা এসব বলেছে তাই না। ওর কথায় কিছু মনে করো না। আমার কষ্ট সহ্য করতে পারে না তো ওর তাই এমন করে বলেছে।( হাতের তালু দিয়ে তথার চোখ মুছে দেয়)
-আচ্ছা তুমি আমার জন্য এত কিছু করতে গেলে কেন?
-(কিছুক্ষণ চুপ থেকে)দায়িত্ববোধ থেকে।
-শুধুই দায়িত্ববোধ? আচ্ছা তোমার দায়িত্ববোধ কি বলে আমার সম্পর্কে।
-সবসময় সুখী দেখতে চায়, ভাল রাখতে চায়, হাসিখুশি দেখতে চায়।
-আর তোমার মন কি বলে, আমি কিসে সুখী থাকবো, কিসে ভাল থাকবো, কিভাবে হাসিখুশি থাকবো।
নিলয় কিছু বলে না শুধু তথার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তথার ছলছল করা দুচোখ অনেক কিছুই বলে যায়।
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে, মন বাড়িয়ে ছুঁই।
দুইকে আমি এক করি না, এক কে করি দুই।।