26-04-2022, 05:42 PM
(This post was last modified: 26-04-2022, 05:45 PM by bourses. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
৩২
পাড়ি (গ)
চলে এলাম লন্ডন…
আমি টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিয়েছিলাম মামাকে আমার আসার খবর… সেই মত এয়ার পোর্ট থেকে বেরিয়ে একটু এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলাম একটি ছেলে… এই বছর এগারো বারো হবে, আমার নাম লেখা একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে… বুঝলাম আমার জন্যই এসেছে আমায় নিতে… একটু খেয়াল করতে ছেলেটির সাথে দেখলাম আরো বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে… দু-জন পুরুষ, দুজন মহিলা, আর তাদের সাথে আরো দুটি মেয়ে, আমারই বয়সি হবে মোটামুটি… বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার, যে এরা আমার দুই মামা, দুই মামী আর তাদের ছেলে মেয়েরা… সবারই প্রায় সোনালী চুল… নীল চোখের তারা… আর সেই সাথে মায়ের মতই গায়ের রঙ… মামাদের মুখে মায়ের আদলের বেশ মিল… সকলেই এসেছে আমায় নিতে… দেখে সত্যি বলতে ভিষন ভালো লাগলো ওদের এই আতিথেয়তায়… আমি ওদের লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম…
আমায় দেখতে পেয়ে হই হই করে এগিয়ে এলো মেয়েদুটি… জড়িয়ে ধরল আমাকে… ওরাও আমায় প্রথম দেখছে… আমিও ওদের… কিন্তু ওদের ব্যবহারে সেটা মনেই হোল না আমার… যেন কতদিনের পরিচয় আমাদের মধ্যে… কি নির্ভেজাল স্বাভাবিক ব্যবহার প্রত্যেকের… আমি হাসি মুখে তাকালাম মামা মামীদের দিকে… ওরাও এগিয়ে এসে আমার পীঠে হাত রাখল… কুশল জিজ্ঞাসা করল বাড়ির সকলের… খোঁজ নিল বাবার… তারপর আমায় নিয়ে এগিয়ে গেল গাড়ি রাখার জায়গার দিকে… দেখি একটা বিশাল নীল রঙের ভোক্স দাঁড়িয়ে রয়েছে… আমাদের আসতে দেখে সসব্যস্ত হয়ে একজন স্যফয়র এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে ধরল… আমরা উঠে বসলাম গাড়িতে… রওনা হলাম ব্র্যাডফিল্ডস্ এর দিকে…
সারা রাস্তা কলকলিয়ে কথা বলে গেলো আমার তিন মামাতো ভাই বোনেরা মিলে… রাস্তায় তাই একঘেয়েমি লাগলো না এতটুকুও…
বাড়ির দেউড়ি পেরিয়ে গাড়ি থামতে নেমে তো আমি রীতিমত তাজ্জব… অট্টালিকাসম বাড়ি দেখে… এই বাড়ির মেয়ে আমার মা? এত বড় বিশাল সাম্রাজ্যের রাজকন্যা ছিল আমার মা? ভাবতে গিয়ে আমার চোখের কোলে জল চলে এসেছিল… কি ভিষণ ভাবেই না নিজের স্বামীকে মা ভালোবাসত, যে এই এত বিত্ত সম্পত্তি আর প্রাচুর্য এক কথায় ছেড়ে দিয়ে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিল… ইচ্ছা করছিল সেই মুহুর্তে মা কে পেলে জড়িয়ে ধরতে… আদরে আদরে পাগল করে দিতে…
আমার পীঠের উপরে সস্নেহের হাতের পরশ পেতে সম্বিত ফেরে আমার… বড়মামা গাঢ় স্বরে বলে, “লেটস্ গো ইন্সাইড… মম্ ইজ ওয়েটিং টু সি হার গ্র্যান্ডডটার… কাম ডার্লিং… লেটস্ গো…”
কোন রকমে চোখ মুছে মাথা ঝাঁকাই স্মিত হেসে… তারপর বড়মামার সাথে পা মেলাই বাড়ির পথে… মোরাম বেছানো পথ বেয়ে… আমার আগেই বাকিরা ততক্ষনে ঢুকে গিয়েছে বাড়ির মধ্যে… দিদিমাকে খবর দিতে আমার আগমনের…
দিদিমার দরজার সামনে এসে দাঁড়াই আমরা… দরজাটা ভিতর থেকে ভেজানো ছিল… মামা দুবার নক করতে দেখি দরজা খুলে এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন… মামাকে আমাকে দেখে সসভ্রমে পাশে সরে দাঁড়ালেন… দরজাটা খুলে মেলে ধরে… পোষাক দেখে বুঝলাম ইনি নিশ্চয়ই দিদিমার অ্যাটেন্ডেন্ট হবেন… বেশ সুন্দরী… পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন…
আমি ঘরে ঢুকলাম… বিশাল ঘরটা… চারিদিকের দেওয়ালে বড় বড় তৈলচিত্র দিয়ে সাজানো… ঘরের মধ্যে ছাদ থেকে একটা বেশ বড় ঝাড়বাতি ঝুলছে… তখন দিনের বেলা, তাই নেভানো… ঘরের দেওয়াল জোড়া বড় জানলা দিয়ে বাইরের আলো ভরে রয়েছে ঘরটায়… আর ঘরের ঠিক মধ্যিখানে একটা কাঠের পালঙ্ক… রীতিমত কাজ করা… অবস্য আমি এই ধরণের পালঙ্ক দেখে অভ্যস্থ… কিন্তু আমাদের বাড়ির পালঙ্কর সাথে বেশ অমিলও আছে, এটার গড়ণে… আর সেই পালঙ্কে চিৎ হয়ে শুয়ে এক শীর্ণকায়া ভদ্রমহিলা… গলা অবধি চাঁদর দিয়ে ঢাকা… সাগর নীল চোখে আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন… আমায় দেখেই তাড়াতাড়ি চাঁদরের ভিতর থেকে হাত বের করে বাড়িয়ে দিলেন… হাতছানি দিয়ে ডাকলেন আমায় ওনার দিকে…
সত্যি কথা বলতে এখানে এই ভাবে দিদিমার দরজায় এসে দাঁড়ানো আগের মুহুর্ত অবধি আমার দিদিমার প্রতি মনে মনে একটা বিতৃষ্ণা ছিলই… আর সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? যে ভাবে উনি আমার মাকে ত্যাজ্য করেছিলেন, যে ভাবে আমার মাকে অপমান করে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন… আমার মাকে তার পাওনা সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন… যার কারণে হয়তো মায়ের মনের মধ্যে একটা দুঃখ, একটা ক্ষোভ থেকেই গিয়েছিল শেষ দিন অবধি… সেখানে সেই মায়ের মেয়ে হয়ে এই রকম একজন কঠিন মনোভাবাপন্ন মহিলার প্রতি বিতৃষ্ণা না জন্মানোটাই তো বিষ্ময়ের… আর ঠিক সেই মনভাবটাই গড়ে উঠেছিল আমার মনের মধ্যে… তিল তিল করে… তাই লন্ডন আসাটা মামার চিঠি পাওয়ার পরেও আমার উদ্দেশ্য ছিল না দিদিমার ডাকে সাড়া দেওয়া… উদ্দেশ্য ছিল এখানে আমার ডাক্তারি পড়াটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার… সাথে… হ্যা… স্বীকার করবো, যে মামার ডাকটাও উপেক্ষা করতে পারিনি… ভেবেছি সেই যখন লন্ডন আসবই, তবে কেন না একবার এসে দাঁড়াবো একজন মৃত্যুপথযাত্রীর পাশে… তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে… আর সেই ভেবেই এসে দাঁড়ানো আমার…
ভেবে এসেছিলাম যদিও সেটাই… কিন্তু সব কেমন গোলমাল হয়ে গেলো ওই অদূরে শায়িত শীর্ণকায়া মানুষটার হাতছানি দেখে… মনের ভেতরটা কেন জানি না হু হু করে উঠল… শুনেছি আমার দিদিমার বড় আদরের ছিল নাকি আমার মা… আর সেই মানুষটা আমাকে ডাকছেন… কাছে যেতে বলছেন… মুহুর্তের মধ্যে আমার মত এক পাষান হৃদয়ের মেয়েরও সমস্ত অভিমান, রাগ, বিতৃষ্ণা যেন গলে জল হয়ে গেলো… আমি এক দৌড়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম দিদিমার শয্যার পাশে… জড়িয়ে ধরলাম শীর্ণ দেহটাকে তাঁর… আমার বুকের মধ্যে… দুটো হৃদয় মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো আমাদের সেই মুহুর্তে…
আমার জন্যই বোধহয় দিদিমার প্রাণটা দেহের মধ্যে আটকে ছিল… তারপর আর মাত্র দুটো দিন… তারপরেই সব শেষ… যে ক’টা দিন পেয়েছিলাম, অনেক রাত অবধি দিদিমার পাশে বসে থাকতাম আমি… ওনার হাতটা আমার হাতের মধ্যে ধরে নিয়ে… মনে হতো যেন মায়ের হাতটাই ধরে রয়েছি… ওই শির্ণ হাতগুলোর মধ্যে দিয়ে ওনার ভেতরের সমস্ত ভালোবাসাগুলো আমার শরীরের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে চলেছে… তারপর… এক ভোর বেলা মামার ডাকে ঘুম ভাঙে… দৌড়ে যাই দিদিমার ঘরে… দেখি শান্ত শরীরে শুয়ে আছেন উনি… বিছানার উপরে… সারা মুখে যেন এক কি প্রশান্তি ছেয়ে রয়েছে… চোখ দুটি বন্ধ… নিশ্চল দেহে… চিরনিদ্রার জগতে চলে গিয়েছেন আমাদের ছেড়ে…
সেদিন আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারি নি আর… মা’য়ের মৃত্যুতে নিজেকে সামলে রাখতে হয়েছিল, বাপির জন্য… পরিবারের অন্য সকলের জন্য… কিন্তু মাত্র দুটো দিন মানুষটা যেন আমার মধ্যে কি এক জাদু করে দিয়েছিল… ওনার দিন ঘনিয়ে এসেছে, সেটা আমরা সকলেই জানতাম… ওটাই আমাদের শেষ দেখা হবে, সেটাও আশ্চর্যের কিছু নয়… তাও!... তাও ওনাকে চলে যেতে দেখে ভেতরটা যেন আবার নতুন করে ভেঙে দুমড়ে গেলো আমার… মায়ের অনুপস্থিতিটাকে আবার যেন নতুন করে উপলব্ধি করলাম সেই মুহুর্তে… যেন বড়ই তাড়াতাড়ি ওনাকে হারালাম আমি… আরো অনেক… অনেক গুলো দিন ওনাকে কাছে পেলে বড় ভালো হতো… মায়ের অভাবটা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারতাম… কিন্তু সেটা তো হবার নয়… নিজেকে যেন আবার নতুন করে বড় বেশি অসহায় মনে হচ্ছিল… মাতৃ বিয়োগের ব্যথা… ভিতর থেকে কয়েক শো কোটি যন্ত্রণা নিষ্ঠুরের মত মাথা খুঁড়ে পাগলের মত বুক-চিরে বেরিয়ে আসতে চায়… কিন্তু সেই চিৎকার আশে পাশে থাকা কোন মানুষ টের পায় না… তারা ঝাঁকিয়ে চলে… কথা বলে চলে… কিন্তু তারা চিৎকার শুনতে পায় না… ব্যাথা গুলো তখন “নড়ে চড়ে হাতের কাছে, খুঁজলে জনম ঘর মেলে না, কি কথা কয়-রে, দেখা দেয় না”… দেখা দেয় না…
দিদিমার পারলৌকিক সমস্ত ক্রিয়াকর্ম সারা হলে আমি বড় মামার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম একদিন… শান্ত গলায় বললাম তাকে, “মামা… এবার তো আমায় যেতে হবে… যার জন্য আসা, সেই যখন আর থাকলো না, তখন আমার এখানে আর থাকার কোন কারণ দেখছি না… এবার আমি যেতে চাই…”
শুনে প্রথমেই মামা আমায় কিছু বলল না… খানিক কি ভাবলো, তারপর বলল যে, “দাঁড়াও… তোমার সাথে আমাদেরও কথা আছে… তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি…” বলে আমায় ওই বসার ঘরে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে গেলো…
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম, তারপরও আসছে না দেখে উঠে দাঁড়ালাম আমি… ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম দেওয়াল জোড়া বিশাল জানলাটার সামনে… বাইরে তখন বসন্তের আগমনী সুর প্রকৃতিতে ভেসে বেড়াচ্ছে… গাছগুলোর পাতায় মন ভালো করে দেওয়া নবীনতার ছোঁয়া…
জানলা থেকে সরে এসে দাঁড়াই ঘরের মধ্যে… দাদু অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন… তার বিশাল একটা তৈল্যচিত্র স্থান পেয়েছে দেওয়ালের উপরে… পরিবারের অন্য আর সব অতীত হয়ে যাওয়া পূর্বপুরুষদের ছবির পাশে… আর দাদুর ছবির পাশে নতুন করে টাঙানো হয়েছে দিদিমারও একটা ছবি… আমি মহিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম ছবিটার দিকে… কি অপূর্ব তুলির টান সেখানে… যেন দিদিমার সজীব চোখে আমারই দিকে তাকিয়ে রয়েছেন এক রাশ স্নেহ ভরা চোখে… এই শৈল্পকর্মের জন্যই বাবাকে অবজ্ঞা, মায়ের সাথে মনমালিন্য… অথচ সেই শিল্পীর ছোঁয়াতেই মৃত্যুর পরেও জীবন্ত উপস্থিতি ওনার…
“ইয়েস ইয়েস… শী ইজ হেয়ার… আই হ্যাভ আস্কড হার টু ওয়েট…” মামার গলার স্বরে মুখ ফিরিয়ে তাকাই আমি দরজার দিকে… দেখি মামা শুধু একা নয়… তার সাথে ছোট মামা আর দুই মামীও এসে ঢুকেছেন ঘরে… মামার পেছন পেছন… আমায় চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলে ওঠে মামা, “বোসো কান্টা… তুমি বোসো… তোমার সাথে আমাদের কিছু খুব জরুরী কথা আছে…”
মামা প্রথম দিনেই বলেছিল যে তার পক্ষে আমার পুরো নাম নিয়ে ডাকা সম্ভব নয়… ওটা বড়ই খটমট নাকি, তাই… আর সেই জন্যই আমায় কান্তা বা কান্টা বলেই ডাকতে শুরু করেছিলো… আর সেই শুনে বাকিদের কাছেও আমি কান্টাই হয়েই গিয়েছি…
“আমার সাথে আবার কিসের জরুরী কথা?” অবাক গলায় চেয়ারে বসতে বসতে বলি আমি… বিশ্মিত চোখে তাকাই ঘরের বাকি সবার দিকে… আমার বিশ্ময়ের উত্তর কেউ দেয় না… সকলেই চুপ করে মিটিমিটি হাসে দেখি… বড় মামা আমার উল্টোদিকের চেয়ারে এসে বসে আমার দিকে একটা ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে… “আমি তোমায় অপেক্ষা করতে বলেছিলাম এটার জন্য… নাও এটা… এটা তোমার…”
“কি এটা?” অবাক চোখে কাগজটার দিকে তাকিয়ে মুখ তুলে প্রশ্ন করি আমি…
আমার প্রশ্ন হাসে মামা… “এটা আমার মায়ের শেষ ইচ্ছা বলতে পারো…” তারপর একটু থেমে বলে, “মা নিজের উইল করে দিয়ে গিয়েছেন অনেকদিন আগেই… যদি তুমি না আসতে, তাহলে আমরাই কিছু একটা ব্যবস্থা করতাম এটা তোমার কাছে পৌছে দেবার জন্য… তা যাই হোক… তুমি যখন নিজে স্বশরীরে এসেছ… তখন সে হ্যাপা আমাদের আর পোহাতে হলো না… এটা ভগবানের অশেষ করুণা বলা যেতে পারে…”
আমার বিশ্ময় যেন তখনও যায় না… “উইল? দিদিমার?” আমি ফের আরো একবার নজর করি কাগজের মোড়কটার দিকে… তারপর মামার দিকে তাকিয়ে বলি… “কি আছে এ’তে?”
মামা বলে, “মায়ের ইচ্ছা অনুসারে আমাদের এই সমস্ত প্রপার্টি তিনটি সমান ভাগে ভাগ হয়েছে… একটা ভাগ পেয়েছে রিচার্ডস… এক ভাগ আমি… আর তৃতীয় ভাগ অলিভীয়া… কিন্তু যেহেতু অলিভীয়া আর ইহজগতে নেই, তাই মা তার মেয়ের ভাগটা তার নাতনীর নামে লিখে দিয়েছেন… তাই এই কাগজটি সেই উইলেরই কপি… আমরা তোমার হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম এবার… এটাই মায়ের ইচ্ছা ছিল…”
মামার কথা শুনে খানিকটা বাকরূদ্ধ হয়ে বসে রইলাম আমি চুপ করে… তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম সোজা হয়ে… শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম মামার দিকে… ওনার হাতে কাগজের বান্ডিলটা তুলে দিয়ে গাঢ় স্বরে বললাম… “আমি দিদিমার ইচ্ছার পূর্ণ মর্যাদা দিয়েই বলছি মামা, এটা আমি নিতে পারবো না… আমি একান্ত দুঃখিত…”
আমার কথাটা প্রথমে বোধহয় বুঝে উঠে পারে না কেউ… তারপর যখন বোঝে, তখন প্রায় হাঁ হাঁ করে ওঠে ঘরে উপস্থিত দুই মামা আর মামী… ওরা তো কিছুতেই মানবে না আমার সিদ্ধান্ত… আমাকে নিতেই হবে এ সম্পত্তির ভাগ… এটা দিদিমার আদেশ…
ওরাও মানবে না, আর আমিও নেবো না… এই নিয়ে বেশ খানিকক্ষন টানা পড়েন চলল… তারপর আমি শেষে বললাম, “বেশ… আমি নিচ্ছি… কিন্তু আমি নিয়ে তারপর আমি কি করবো সেটা হবে আমার সিদ্ধান্ত… সেটা নিয়ে কারুর কোন দ্বিমত থাকবে না আশা করি…”
আমার কথাটা ঠিক বোধগম্য যে হলো না ওদের, সেটা ওদের মুখ দেখেই বুঝতে পারি আমি… তাই হেসে ওদের বুঝিয়ে বলি, “দেখো মামা… দিদিমা চেয়েছে, তাই আমি গ্রহণ করলাম তোমাদের এই বিশাল ঐশর্যের ভাগ… কিন্তু সেটা আমি নিজে ভোগ করবো না কোন ভাবেই… কারণ যেখানে মা নিজের সম্পত্তি উপভোগ করতে পারলো না, সেখানে সেই সম্পত্তির অধিকারিনী আমি হতে চাই না… তাই দিদিমার ইচ্ছানুসারে আমি এই সম্পত্তি নিয়ে আমার দুই মামী আর তাদের তিন সন্তানের মধ্যে ভাগ করে দিতে চাই… এবারে আশা করি তোমরা আর কিছু বলবে না…”
আমার কথা শুনে খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো মামারা… তারপর ছোটমামা এগিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, “দিস ইজ ইট… তুমি সত্যিই প্রকৃত আমাদের বোনের মেয়ে… আজ আরো একবার প্রমাণ করে দিলে…” তারপর একটু থেমে বলল, “বেশ… যখন এটাই চাইছ, আমরা তোমার সে ইচ্ছার সন্মান করবো… কিন্তু সব নয়… তুমি যেমনটা চাইবে তেমন ভাবেই তোমার অংশ তুমি ভাগ করে দিতে পারো… এতে পরিবারের মধ্যেই সব কিছু থেকে যাবে… আর এর পর থেকে এই প্রপার্টির যা কিছু টাকা পয়সা আছে, তার অর্ধেক তোমার থাকবে… যখন খুশি তুমি তখন সেখান থেকে তোমার নিজের জন্য নিয়ে নিতে পারো… আমরা কখনও কেউ কোনদিন সে ব্যাপারে কোন কথা বলবো না… আর শুধু আমরা নই… আমাদের উত্তরসুরিরাও সেটা সসন্মানে মেনে চলবে… এ ছাড়াও… তোমার থাকার বা পড়াশুনার সমস্ত খরচ এই ব্র্যাডফিল্ডস্ এস্টেট বহন করবে… এবার রাজি তো?”
সত্যি… এরপর আর কোন কথা চলে না… আমি মাথা নীচু করে ঘাড় হেলাই… মেনে নিই মামাদের কথা…
বড় মামা এরপর বলে, “আর শুধু তাই না… এতদিন অলিভীয়ার লন্ডনের যে ফ্ল্যাট ছিল, সেটা আমি দেখাশুনা করতাম, আজ থেকে সে ফ্ল্যাট তোমার… তুমি সেখানে থেকেই তোমার পড়াশুনা চালাবে… অন্য কোথাও তোমার থাকার চিন্তা করতে হবে না… কারণ আমরা জানি, লন্ডনে থেকে পড়াশুনা করার খরচ অনেক, তাই সেটা নিয়েও তোমায় কখনও ভাবতে হবে না… আমি কালকেই ওই ফ্ল্যাট তোমার নামে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি…”
মামাদের কথায় সত্যিই আমার মাথা থেকে একটা বিরাট চিন্তার বোঝা নেমে গেলো যেন… এটা তো ঠিকই যে আমি কোথায় থাকবো, কি করবো, সেটা নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা ছিলই… সেটা এই ভাবে এত সহযে মিটে যাবে, সত্যি ভাবি নি… আমি স্মিত হেসে মাথা হেলাই… “বেশ… তাই হবে…”
তারপর যেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে দিনগুলো কেটে গেলো… আমার রেসাল্ট ভালোই ছিল, তাও, যেহেতু দিদিমা কাউন্টেস ছিলেন, তাই সহজেই লন্ডনের কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম আমি… মায়ের ফ্ল্যাটে থেকেই শুরু করলাম আমার ডাক্তারী পড়ার দ্বিতীয় অধ্যায়… শেষ করলাম কলেজ… নিউরোলজি নিয়ে স্পেশিয়ালাইজেশন… কিন্তু শুধু মাত্র নিউরোলজি নিয়ে পাশ করে মন ভরল না যেন… মামাদের সাথে কথা বলে এবার সার্জারির উপরেও মেজর করলাম… তাতে টপ করলাম পরীক্ষায়… ফার্স্ট গ্রেড নিয়ে পাশ করলাম…
চিন্তায় পড়লাম এবারে… এবার তাহলে কি? এবার কি আবার দেশেই ফিরে যাবো? কিন্তু এখনই দেশে ফিরে যাতে মন চাইল না… একবার যখন দেশের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি তখন আর সেখানে, ওই নতুন মায়ের সামনে গিয়ে আর দাঁড়াতে মন শায় দিল না কিছুতেই… হয়তো ওই বাড়িতে উঠবো না আমি কিছুতেই… কিন্তু তাও… দেশ তো সেই একই… আমার মন যেখানে একবার বিষিয়ে গিয়েছে, সেখানে আবার ফিরে যাওয়ার পক্ষপাতি আমি নই… তাই ভাবতে থাকলাম এই লন্ডনেই থেকে যাবো? নাকি অন্য কোথাও অ্যাপ্লাই করবো বলে… তারপর ভাবলাম লন্ডন তো বেশ কিছুদিন হলো… তাহলে এবার একবার ইয়ুরোপের অন্য দেশে চেষ্টা করলে ক্ষতি কি? যদি হয়ে যায় ভালো, না হলে তো লন্ডন আছেই… আমার মায়ের দেশ… এখানে কোন হস্পিটালে জয়েন করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না একেবারেই… আর সেই সাথে আমার রেসাল্টও যথেষ্ট ভালো…
ভাবতে ভাবতে কয়েকটা দেশের একটা লিস্ট বানালাম… প্রথমে রাখলাম জার্মানী… কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম যে জার্মানীর সমস্ত হস্পিটাল যথেষ্ট হাই এন্ড… সেখানে আমার রেসাল্ট ভালো হলেও আমি একেবারে ফ্রেশার… সবে সার্জারীতে পাশ করেছি, ওখানে আমায় খুব একটা এন্টার্টেন নাও করতে পারে… ওখানে চট করে কিছু সুবিধা করা যাবে না… পরে না হয় একটু হাত পাকিয়ে নিলে আবার জার্মানীতে অ্যাপ্লাই করে শিফট করার কথা ভাবব… তাই ইচ্ছা থাকলেও জার্মানীর কথাটা সেই মুহুর্তের জন্য তুলে রাখলাম শিকেয়… এর পর বাকি দেশ গুলোতে অ্যাপ্লাই করতে শুরু করলাম… ফ্রান্সএর হস্পিটালে দুটো… ইতালীতে একটা আর স্পেনে একটা… কয়েক দিনের মধ্যেই দেখি চারটে হস্পিটাল থেকেই কল এসে হাজির… আমি সত্যিই ভাবতে পারিনি যে চারটের থেকেই কল আসবে বলে… তাতে পড়লাম মুস্কিলে… কোনটাতে যাবো?
মামাদের সাথে আলোচনা করলাম… কারন ওদের গাইডেন্স এখানে বিশেষ প্রয়োজন… আমি লন্ডনে কাটিয়েছি বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে ঠিকই… কিন্তু বাকি দেশ? তাই মামাদের শরণাপন্ন হলাম গিয়ে… বড় মামা প্রথমেই ইতালীকে ক্যান্সেল করে দিলো… কারন ওদের অফার প্রাইস এই চারটের মধ্যে সব চেয়ে কম ছিল… মামা বলল যে প্রথমেই যদি কম অফারে শুরু করো তাহলে পরে সেটা বাড়াতে অসুবিধা হবে… ঠিক… মেনে নিলাম মামার কথা… সে দিক দিয়ে সব চেয়ে অফার দিয়েছিল স্পেনএর থেকে… কিন্তু সেখানেও একটা বিশাল কিন্তু রয়েছে… অ্যাপ্লাই তো করেছিলাম ঠিকই… তবে স্প্যানিশ তো আমি বুঝিই না বিন্দু বিসর্গ… আর বলা তো অতি দূর অস্ত… সেটা শিখতে শিখতেই যা সময় লেগে যাবে ততদিনে নির্ঘাত আমায় দূর করে দেবে স্পেন থেকে… হি হি… অতঃকিম স্পেনও বাদ… হাতে রইল ফ্রান্সের দুটো হস্পিটাল… আমি ততদিনে লন্ডনে থাকতে থাকতে ফ্রেঞ্চ ভাষাটা বেশ ভালোই শিখে নিয়েছিলাম… জার্মানটাও অল্প বিস্তর চালিয়ে নিতে পারি… তাই ফ্রান্সএ যেতে আমার খুব অসুবিধা হবার নয়… তাই বসলাম দুটো হস্পিটালের অফার লেটার নিয়ে… সেখানে দেখলাম যে মার্সেইএর সেন্ট ক্লেয়ার হস্পিটাল বেশ ভালো অফার করেছে, অন্তত অন্যরটা থেকে অনেক বেশি… তাই আর দ্বিতীয়বার ভাবলাম না… রিপ্লাই করে দিলাম এখানেই…
তার মানে এবার ফ্রান্স…
.
.
.
ডায়রি নিয়ে খানিক থম হয়ে বসে থাকে পর্ণা… এই ভাবে এক নিশ্বাসে পুরোটা পড়ে যেন সেও হাঁফিয়ে উঠেছে… চোখের সামনে তখনও যেন পরতে পরতে দৃশ্যগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে তার… যেন একটা সিনেমা দেখে উঠল সে…
ক্রমশ
বিশেষ চার পাঁচ জন ছাড়া বাকি আর কোন পাঠক বা পাঠিকা তাদের মহামূল্য সময় অপচয় করে কোন মতামত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না জানি, তাও যদি বোঝেন যে একটু কিছু লিখে বা অন্তত লাইক বাটনে ক্লিক করে লেখককে উৎসাহিত করা সম্ভব, তাহলে ওইটুকু কষ্টর জন্য বাধিত থাকবো...