Thread Rating:
  • 60 Vote(s) - 3.33 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance মায়া - আমরা সবাই বাঁধা যেখানে (সমাপ্ত)
পর্ব - আঠারো




আমরা সকাল থেকে রাত অব্দি এই যে এত গাধার খাটুনি খেটে যাই কিসের জন্য। দায়িত্বের চাপে মেরুদণ্ড গুলো হালকা বাঁকা হতে থাকে কিন্তু সেটাকেই আড়াল করে কেন মিথ্যে হাসির ফোয়ারা ছোটাই মুখে। হাতের তালুয় কড় ধরে যায়, পায়ের তালুতে বয়ড়া। সাংসারিক চাপ, সামজিক চাপ, পারিপার্শ্বিক চাপ সবই সয়ে যাই কিসের তরে??


একটুখানি সুখ। দিন শেষে প্রিয়জনের মুখে হাসির রেখা আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় সুখ। সেই সুখের জন্য মানুষ সব করতে পারে। সেই সুখে কারও জন্ম দিতে পারে আবার সেই সুখেই কারও মৃত্যুর কারণ হতেও দ্বিধা কাজ করে না। আমরা বারবার আমাদের সেই প্রিয় মুখ গুলোর মুখে হাসি খুঁজে ফিরি। নিজেদের সেই হাসির কারণ করাতে ভালবাসি। ছোট্ট একটা হাসি সারাদিনের ক্লান্তি, জীবনের গ্লানি, সমস্ত পাপবোধ সব কিছু ছাপিয়ে জীবনটাকে নতুন করে সাজায়। আরেকটা দিনের জন্য উদগীরণ করায় প্রাণবায়ু, আবারও বাঁচতে শেখায়। আর আমরা আরেকটা দিনের সূচনা ঘটাই।

মানুষ আজব প্রাণী। মানুষকে ঠিকমতো বুঝতে পারা অসম্ভব। এর জন্যই হয়তো সৃষ্টির সেরা জীবের তকমাটা জবরদখল করে রেখেছে এই মানুষ। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও মাঝে মাঝে কৌতূহলী হয়ে পড়ে সৃষ্টির সময় এমন কি উপদানে তৈরী করেছে মানুষ যার জন্য সৃষ্টি নিজেকে সষ্ট্রার উপরে নিয়ে যায়। শতাব্দীর পর শতাব্দীর বয়ে যায় এর বিশ্লেষণে। ক্লান্ত হয়ে পলায়নে কত মুনি ঋষি, মাথার ঝাকড়া চুল বিসর্জনে কত মনোবিশারদ। সত্যই তো মানুষ বড়ই আজব। শুধুই আজব নাকি সাথে বিশ্রী রকমের ভয়ংকর প্রাণীও বটে।

দুই দিন বাদে তথার ফাইনাল পরিক্ষা। আজ তথাকে নিয়ে একবার মন্দিরে যাবে ওর নামে পূজো দিতে৷ আগের দিন রাতে যখন নিলয় মন্দিরে যাবার কথা জানিয়েছে তখন থেকেই ওর মনে অন্যরকম উৎফুল্লতা কাজ করছে। কখন সকাল হবে কখন মন্দিরে যাবে সেই ভাবনায় রাতে ঠিকমত ঘুমোতে অব্দি পারে নি।

অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি সকালে উঠেই স্নান সেড়ে তথা তৈরি। ওদিকে নিলয় তখনো ঘুমের দেশে। তথা দু' এক বার ওর ঘরে উঁকি দিয়ে ফিরে এসেছে। মনে মনে ভাব আজ এখনো ঘুম থেকে উঠছে না কেন। নাকি আমিই একটু বেশি তাড়াতাড়ি করে ফেলেছি। অপেক্ষা করা কত কষ্টের সেটা যেন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে তথা। সময় যেন আজ কাটতেই চাচ্ছে না।
না আর বসে থাকতে না পেরে নিলয়ের রুমে যায় ওকে ডাকতে। প্রথমে আস্তে করে ডেকে যখন কর্ম সাধন হলো না তখন গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাক দেয়। নিলয়ের ঘুম ভেঙে গেলেও দুষ্টুমি করার জন্য আগের মতই বিছানায় পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে তথা কি করছে। এত ডেকেও ব্যর্থ হয়ে হয়ে বাচ্চাদের মত হাত পা ছুঁড়তে থাকে তথা। তথার এমন বাচ্চা সুলভ আচরণে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। হো হো করে হেঁসে উঠে নিলয়। হাসতে হাসতে উঠে বসে।

-(মুখ ভার করে) ওহহ সজাগ থেকেও আমার সাথে এসব করা হচ্ছে। যাও আমি তোমার সাথে যাবই না।

-আরে বাবা এত রেগে গেলে কি করে হয়। একটু মজাও করতে পারবো না। এতো ভারি মুশকিল।

-আমি যে কখন থেকে রেডি হয়ে বসে আছি তার দিকে নজর নেই। এত ডাকাডাকি করে ঘুম ভাঙালাম। আর উনি সকাল সকাল মজা করতে লেগে গেল।

-এই যে কান ধরলাম, যাও তুমি আরেকটু সাজুগুজু করে নাও ততখনে আমি স্নান করে রেডি হয়ে যাবো।

স্নান করে রেডি হয়ে তথার রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় নিলয়। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিচ্ছে তথা৷ ভিজে চুল গুলো বাতাসে উড়ছে। স্নান করার পর মেয়েদের সৌন্দর্য বোধহয় অনেকগুন বেড়ে যায়। সদ্য ফোঁটা ফুলের মতই স্নিগ্ধ, কোমল আর পবিত্র। সকালের বাতাসের মতই নির্মল। সূর্যোদয়ের মতই নয়নাভিরাম।

-ও বাবা, ওখানে দাড়িয়ে কি দেখছো।

-(চোখ মুখে ধরা পড়ে যাবার ভয়) না, কি আর দেখবো। ভাবছি তোমার সাজুগুজু শেষ হতে আর কত সময় লাগে।

-(চোখ বড় বড় করে) আমি মোটেই তেমন সাজি না।

-(মিথ্যে বলে নি, ও আসলেই তেমন সাজে নি। তবুও অপূর্ব লাগছে) তাহলে আর কি। এবার চল তাহলে মন্দিরে যাই।

মন্দিরে সকালের বাল্য ভোগের আয়োজন চলছে। গর্ভগৃহের সামনে গিয়ে দুজনে রাধা মাধব বিগ্রহ কে মাথানত করে প্রণাম জানায়। সকালের অভিষেক শেষে অপূর্ব সব সাজসজ্জায় শৃঙ্গার করা হয়েছে বিগ্রহের। নানা রঙের নানা গন্ধের ফুলে শোভা বর্ধিত হচ্ছে বিগ্রহের কোমল অঙ্গ। অপরূপ রূপে মোহিত করছে সবার মন। এরূপে মন মজে যায় মুছে যায় সকল গ্লানি। পরিস্রুত হয়ে যায় মলিন মন। সেবায়েত মহাশয়ের কাছে পূজোর ভোগ দিয়ে আরতির অপেক্ষা করে। আজ অনেকদিন পর মন্দিরে আরতি দর্শন করছে দুজনে। ঘিয়ের সলতে জ্বালানো পঞ্চপ্রদীপ, কর্পূর আর ধুপের ধুপতি, ময়ূর পুচ্ছের পাখা, বিশাল চামড় দুলিয়ে আরতি হয়ে চলেছে সাথে ঘন্টা আর কাশি বাদ্য সকালটাই যেন মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। অন্যদিকে মৃদঙ্গ আর করতালের সুরে সমাবেত ভক্ত কন্ঠে আরতি সঙ্গীত।

‘‘মঙ্গল আরতি যুগলকিশোর।


জয় জয় করতহি সখীগণ ভোর।।


রতন-প্রদীপ করে টলমল থোর।


নিরখত মুখবিধু শ্যাম সুগোর।।


ললিতা বিশাখা সখী প্রেমে আগোর।


করত নিরমঞ্ছন দোঁহে দুহুঁ ভোর।।


বৃন্দাবন কুঞ্জহি ভুবন উজোর।


মুরতি মনোহর যুগলকিশোর।।


গাওত শুক-পিক নাচত ময়ূর।


চাঁদ উপেখি মুখ নিরখে চকোর।।


বাজত বিবিধ বাদ্যযন্ত্র ঘন ঘোর।


শ্যামানন্দ আনন্দে বাজায় জয় তোর।।


আরতি শব্দটা ছোট কিন্তু এর গভীরতা ব্যাপক।আ'' অর্থে ব‍্যাপ্তি; "রতি" অর্থে প্রেম, ভালোবাসা ও অনুরাগ । যে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রী বিগ্রহের নিজের প্রীতি বর্ধিত হয় অর্থাৎ তিনি ভক্তের প্রতি প্রসন্ন বা সন্তুষ্ট হন এবং ভগবানের প্রতিও ভক্তের প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, ভক্তি ও অনুরাগ বৃদ্ধি পায় তাকে আরতি বলে ।

আরতি শেষে সেবায়তে ওদের কে ডাকলো ভোগ কার উদ্দেশ্যে নিবেদন হবে আর কি নামে হবে সেটার জন্য। তথার উৎসাহ যেন সবার চেয়ে বেশি। দৌড়ে গিয়ে সেবায়েত কে সব বলতে শুরু করলো। সেবায়ত জিজ্ঞেস করে তথার সাথে উনি কে। কি জানি কি বলল তথা, সেবায়ত মহাশয় দু হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন ওদের দুজনকে জনম জনম সুখী হবার। প্রসাদ নিয়ে বাসায় ফিরে আসে ওরা। সারাটা সকাল তথাকে যেন একটা বাচ্চার মত নিজের জগতে উড়তে দেখছে নিলয়। কিন্তু নিলয় জানে সামনের বাস্তবতা বড়ই কঠিন, সেটার জন্য আগেই তথাকে নিজেকে সামলাতে শিখতে হবে।

                              

                                ---★★★---




[Image: sVAVOnMj_t.jpg]




সেই কখন থেকে সার্কিট হাউজের খেলার মাঠের পাশে বেঞ্চে বসে আছে দোলন, ওদিকে নিলয়ের আসার খবর নেই। এই ছেলেটা কে নিয়ে আর পারা যায় না। সেই কলেজ লাইফ থেকেই ও নিজের প্রতি বড্ড বেখেয়ালি। সেই ক্লাস থ্রি থেকে ওকে দেখে আসছে। ছেলেটার নিজেকে নিয়ে নিজে কখনো ভাবে না, নিজেকে একটু সময়ও দেয় না। তবে দোলনের কাছে ও বাধ্য সন্তানের মত। দোলনকে ও বরাবরই নিজের মেন্টর হিসেবেই জানে, দোলন অন্ত প্রাণ।

হঠাৎ করে বাবার বদলি হলো। নতুন এলাকা, নতুন কলেজ নতুন বন্ধু বান্ধব সেই নিয়ে শৈশবের রোমাঞ্চে ভাসছে দোলন। বছরের মাঝখানে কলেজে ভর্তি হওয়া দারুণ কষ্টের কাজ। অনেক হ্যাপা কাটিয়ে ভর্তি করা হয় দোলন কে। গ্রামের প্রাইমারী কলেজে তখন শিক্ষার্থীর অভাব নেই। মাসে মাসে উপবৃত্তির টাকা আর দুপুরের খাবারের জন্য হলেও বাবা-মা রা তাদের সন্তানদের কলেজে ঠিকি পাঠায়।

কানায় কানায় ভর্তি তৃতীয় শ্রেণীর কক্ষ। দুজনের বেঞ্চে তিনজনও বসে আছে। এক ম্যাডাম দোলন কে নিয়ে ক্লাসে ঢুকে পরিচয় করিয়ে দেয়। কিন্তু একি দোলন বসবে কোথায়। ক্লাস তো কানায় কানায় পূর্ণ। হঠাৎ একটা ছেলে উঠে দাড়িয়ে বললো, এই তুই কি এখানে বসবি। ফাঁকা জায়গা পেয়ে ব্যাগ নিয়ে দোলন বসতে চলে যায়।

-তুমি আমাকে তুই করে ডাকলে কেন?

-বা রে স্যার বলে সহপাঠী সবাই বন্ধু। তাহলে তুই তো আমার বন্ধু তাই নয় কি? আমি কিন্তু বন্ধু হতে রাজি।

-তাই বুঝি। আমার আগের কলেজে তো এভাবে কেউ বলে নি। আজ থেকে আমরা বন্ধু। তোমার নাম কি?

-নিলয়। তুমি করে বললে বন্ধু হবো না। আমার তুই করে বলতে ভাল লাগে।

-ঠিক আছে, কিন্তু তোকে আমি নীলু বলে ডাকবো।

সেই থেকে শুরু, এর পর এই দোলন নিলয়ের অন্ধের ষষ্ঠী। মন খারাপ দোলন কে বলতে হবে, ভাল লাগছে না দোলন কে জানাতে হবে, কিছু খেতে মন চাইছে ওর কাছে যাবে। এই পড়াটা মাথায় ঢুকছে না সেটা দোলন সলভ করবে, মন টা আজ ভালো সেটাও দোলন কে না জানালে নিলয়ের ভাত হজম হয় না। নিলয়ও দোলনের ছায়া সঙ্গী, সবসময়ই দোলনকে আগলে রেখেছে সবকিছুতে। দোলনের বাড়িতে নিলয়ের অবাধ যাতায়াত। ওর বাড়ির সবাইও নিলয়কে খুব ভালবাসে। দোলনের যেবার বোন জন্ম নিলো সেকি খুশি নিলয়ের। যেন ওর নিজের বোন হয়েছে। বড় হবার পর সেই বোনটাও নিলয়কে নিজের দাদার মতই ভালবাসতো। দাদাভাই বলে ছোটে আসতো ওরদিকে।

দুটো হাত দোলনের চোখ চেপে ধরে।

-এতক্ষণে আসার সময় হলো।

-জ্যামে ফেঁসে গিয়েছিলাম। এই নে তর জন্য আনলাম।(একটা র‌্যাপিং করা প্যাকেট এগিয়ে দেয়)

-(প্যাকেট টা খুলে) মিমি চকলেট। তর এখনো মনে আছে।

-তর প্রিয় জিনিস আর আমার মনে থাকবে না। এখন তো পাওয়াই যায় না। অনেক স্টোর খোঁজে আজ পেলাম।

-(নিলয় কে জড়িয়ে ধরে) তুই ছাড়া আমার পছন্দ গুলো কারও মনে থাকে না।

-(মুখের সামনে চলে আসা চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে) আমি মনে রাখবো না তো কে রাখবে? নাকি অন্য কাউকে জুটিয়ে নিয়েছিস।

-(আলতো করে ঘুসি দিয়ে) তোর জায়গাটা ছেড়ে দিলে তো আরেকজন কে জুটাবো।

-আমার জন্য কি আনলি?

-চিড়ের পোলাও, তর ফেবারিট।

-(আপ্লুত হয়ে) ওয়াও। দিল খুশ কর দিয়া। আয় তোকে একটা চুমো দেই।

-(মুচকি হেসে)কুত্তা তর কি লজ্জা সরম নেই এত মানুষের সামনে, থাক এত আদরের দরকার নেই। হা কর আমি খাইয়ে দিচ্ছি।

-লজ্জার কি হলো, আমি কি অন্য কাউকে চুমো দিতে যাচ্ছি নাকি। চিড়ে পোলাও দে তাড়াতাড়ি কতদিন তর হাতের রান্না খাই না। খিদে তে পেট চু চু করছে। তুই মুখে তুলে দিলে স্বাদটা আরও বেড়ে যায় বুঝলি।

-(হাসি মুখে) বুঝেছি বুঝেছি আর মন গলানো কথা বলতে হবে ন। খেয়ে নে তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।

পাশের মাঠে ক্লাবের ছেলে মেয়ে গুলো খেলছে। বড় কড়ই গাছটার মগডালে কতকগুলো চিল পাখি বসে আছে। মাঝে মাঝে দু পাখা মেলে উড়তে থাকে বিশাল আকাশের বুকে। ঝিরিঝিরি বাতাসে গাছের পাতা গুলো ঝরে পড়ে সবুজ বিছানার মত লাগছে। উত্তরে কোণে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। বক পাখি গুলো দল বেঁধে ঘরে ফিরছে। ঝড় আসার সম্ভাবনা প্রবল।
Shy হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে, মন বাড়িয়ে ছুঁই।
 দুইকে আমি এক করি না, এক কে করি দুই।। Shy
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মায়া - আমরা সবাই বাঁধা যেখানে - by nextpage - 22-04-2022, 11:59 PM



Users browsing this thread: 23 Guest(s)