15-04-2022, 02:43 PM
-------------- জোয়ার - ভাঁটা --------------
"মা, বাবা কখন আসবে? আমার খিদে পেয়ে গেছে।" বুকানের অস্থির প্রশ্নের উত্তরে মল্লিকা কী বলবে ভেবে না পেয়ে একটু শুষ্ক হাসিই ফিরিয়ে দেয়।
মনে মনে ভাবে, খিদের আর কী দোষ! ওইটুকু ছ'বছরের বাচ্চা, এই বয়সেই তো খিদে পাবে। আজ আবার তার উপর জন্মদিন বলে কথা, ভালোমন্দ দুটো পদ বাড়তিই হয়েছে রান্না। সেই দেখে বুকান কী আর স্থির থাকতে পারে! আজকের দিনে বাকিদের মত জন্মদিন মানেই ঢাউস একটা কেক এনে দশটা লোক নেমন্তন্ন করে, ফটো তুলে, হই-হুল্লোর করার মানসিক ও আর্থিক বিলাসিতা আজ আর মল্লিকার অন্তর থেকে আসেনা। ওই পাড়ায় থাকতে প্রথম কয়েকটা বছর করেছিল সাধ্যমত আশেপাশের ক'টা বাচ্চা আর তাদের মায়েদের নিয়ে। বিগত দু'বছরে জীবনটাকে একটু বেশীই দেখেছে। ওই পাড়াও ছেড়ে দিয়ে এই ঠাকুর কলোনীতে বাসা নিয়েছে ওঁরা।
- "কী গো?" বুকানের তাড়ায় মল্লিকার সম্বিৎ ফেরে।
- "জানিস তো, রবিবার নাইট করে সোমবার ফিরতে তোর বাবার একটু দেরীই হয়। এসে যাবে এক্ষুণি, বারোটা তো বাজতে চলল।"
বলতে বলতেই দরজায় রুপমের আওয়াজ পাওয়া গেল, "এসে গেছি। আর এই দেখো কী এনেছি।"
মল্লিকা দেখে রুপম একটা প্যাকেট হাতে এসেছে। বের করতে দেখে একটা কেকের বাক্স।
- "তুমি আবার শুরু করলে!" মল্লিকা কিছুটা বিরক্তি সহকারেই বলে।
- "আরে, ঠিক আছে। ছোট দেখেই এনেছি। সন্ধ্যেবেলায় কাটবে।এখন তো পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল। তাই ভাবলাম নিয়েই আসি।"
- "আজ স্থিতিশীল, অস্থির হতে কতক্ষণ! যাক গে, তাড়াতাড়ি স্নান করে এসো। আরেকজনের খাবারের গন্ধ পেয়েই খিদে পেয়ে গেছে আজ।"
- "হ্যাঁ, বাবি, এসো তাড়াতাড়ি।"
রুপম হেসে চলে যায়।
স্নান করে এসে দেখে দু'টো আসন পাতা রয়েছে, বুকান একটায় বসে আছে। দু'টো থালায় ভাত আর কয়েকটা বাটিতে অনেকরকম পদ সাজানো। মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, আলু-পটলের তরকারি, কাতলা মাছের ঝোল, খাসির মাংস, চাটনি আর পায়েস। বুকানের আর দোষ কী, রুপমেরই দেখে খিদে পেয়ে গেল।
- "মলি, তুমিও নিয়ে এসো। আবার বসে থাকবে কেন!"
- "নিচ্ছি, নিচ্ছি। তোমরা শুরু করো। ভাত লাগবে, দিয়ে আমি নিয়ে আসব।"
বাপ-বেটা পরম তৃপ্তিতে খেতে লাগল। মল্লিকা একদৃষ্টিতে সেটাই মনের মণিকোঠায় ফ্রেমবন্দি করছে, এতে একটা আলাদা সুখ আছে। রোজকার একরাশ না পাওয়ার মাঝে এই পড়ে পাওয়া চোদ্দআনা সুখটা যে অমূল্য। একসাথে খেতে বসলে এই মূহুর্তগুলো কোথা দিয়ে পালিয়ে যেত টেরও পেত না।
স্মৃতির সরণী বেয়ে মল্লিকা আপন খেয়ালে এক'পা দু'পা করে পিছিয়ে চলল। রুপম আর বুকানকে নিয়ে একটা দিব্যি সাজানো সংসার ছিল। শহরের এক নামকরা রেঁস্তোরায় রুপমের চাকরিটাও বেশ স্থিতিশীল ছিল। আর পাঁচটা সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের মতই ওদের জীবনেও ছিল ছোট ছোট নানা খুশির সমাহার, এদিক সেদিক ঘুরতে যাওয়া, উৎসবের আবেশ, উপহার, কেনাকাটি। হঠাৎ করেই বিশ্বজুড়ে মহামারীর প্রকোপ আর একে একে তার করাল গ্রাসে পড়ল হোটেল - রেঁস্তোরা ব্যবসাতেও। একের পর এক ব্যবসা বন্ধ আর সাথে রুপমের মত লক্ষ মানুষের নতুন করে বেকার হওয়ার খবর অনেকাংশেই ঢাকা পড়ল মহামারীর প্রকোপ আর তা সুরাহার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের খবরে। চারপাশের চেনা-জানা হিসেব ওলোট-পালোট করে ভীষণ অচেনা হয়ে যাওয়া সেইসব দিনগুলো মনে পড়লে অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে। বেশ কয়েক মাস বেকারত্বের পর অবশেষে একদিন রুপম জানালো এই নতুন চাকরিটার কথা। একটা সফটওয়্যার কোম্পানীর ক্যান্টিনে। মাইনে মোটামুটি ভালোই হলেও দুটো বিষয় একটু আলাদা, চাকরিটা রাত্রিকালীন আর সাপ্তাহিক ছুটি সোমবার। তারপর থেকে আস্তে আস্তে সংসারটা আবার স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে।
- "মা, মাংসটা খুব ভালো খেতে হয়েছে।" বুকানের গলার আওয়াজে মল্লিকা বর্তমানে ফিরে আসে।
- "এই দাঁড়া, ভাত নিয়ে আসি।"
- "তোমারটাও নিয়েই এসো।" পাশ থেকে রুপম বলে ওঠে।
মল্লিকা মাথা নাড়িয়ে আনতে যায় বাকি সব একসাথেই। আরো আধঘন্টা যাবৎ খাওয়া-দাওয়া পর্ব চলার পরে শেষ হলে বুকান শুতে যায়, রুপম খবরের কাগজটা নিয়ে বসে আর মল্লিকা রান্নাঘরে সব পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সন্ধ্যেবেলা তিনজন মিলে মোমবাতি জ্বালায়, কিনে আনা কেকটা কাটে, নিজেদের মত করে ছেলের জন্মদিনটা পালন করে। অনেকদিন পর যেন সবকিছু আগের মত লাগছিল মল্লিকার। মনে মনে প্রার্থনা করে এই চাকরিটায় যেন কারোর নজর না লাগে।
পরদিন আর পাঁচটা দিনের মতই বেশ চলছিল। এগারোটা নাগাদ তিনটে লোক এসে জিজ্ঞাসা করল যে রুপম সরকার এখানেই থাকে কিনা। মল্লিকা হ্যাঁ বলতেই ওনারা নিজেদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে রুপমকে ডেকে দিতে বলে। পুলিশ।
রুপম ভিতর থেকে মল্লিকার ডাকে বেরিয়ে আসলে ওনাদের মধ্যে একজন এগিয়ে গিয়ে বলেন, "আপনিই রুপম সরকার, স্যরি, অ্যান্থনি?"
রুপমের মুখটা এইটুকু হয়ে গেছে মল্লিকার নজর এড়ায় না। কিন্তু অ্যান্থনি কথাটার মানে ও কিছুই বুঝতে পারে না।
- "চলুন আমাদের সাথে।"
- "কিন্তু ওঁর দোষটা কী আমাকে বলুন। চুরি, ডাকাতি, স্মাগলিং কিছু করেছে নাকি? দয়া করে আমাকে বলুন।" মল্লিকা কাতরকণ্ঠে অনুরোধ করে।
রুপম চুপচাপ ওদের সাথে বেরোনোর জন্য এগোয়।
- "কি গো, তুমি তো বলো, কী করেছো।" মল্লিকার কাতরতা দেখে ওই তিনজনের একজন কিছু বলতে গিয়ে দেখে বাচ্চাটা ভিতরের ঘরের দরজায় পরদাটা আঙ্গুলে নিয়ে পেঁচাচ্ছে।
- "আমাদের ওখানে পরে আসুন, সবটা জানানো হবে।" মল্লিকার উদ্দেশ্যে এটুকুই বলে উনি বাকিদেরকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় মল্লিকা আকাশ-পাতাল ভেবেও কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পেল না। বুকানকে ঘরে শান্ত হয়ে থাকতে বলে পোষাক পাল্টে কিছুক্ষণ পরে মল্লিকা বেরোল থানার উদ্দেশ্যে।
ঢুকে দেখল রুপমকে একটা কোণায় বসিয়ে রেখেছে। থানার অফিসারের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই ভারী গলায় উনি বলে ওঠেন, "উনি যা করেছেন তা ভারতীয় দণ্ডবিধান অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিছুদিন জেলের হাওয়া খেলেই সব শখ মিটে যাবে। আপনি চলে যান ম্যাডাম।"
- "কী করেছে তো বলুন।"
- "স্যার তো বলল আপনাকে চলে যেতে, কানে গেলো না!" পাশ থেকে এক উর্দিধারী বলে ওঠে।
- "আমাকে জানতে তো হবে আমার স্বামী কী করেছে!"
- "শুনতে চান? শুনুন তাহলে, আপনার স্বামী একটা জিগোলো।"
- "কী যা তা বলছেন!" মল্লিকা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না।
- "হ্যাঁ, বহুদিন যাবৎ অ্যান্থনি নামের আড়ালে উনিই জিগোলো হিসেবে কাজ করছেন। আমাদের কাছে খবর ছিল একটা বাগানবাড়িতে মাঝেমাঝেই অন্যরকম আসর বসাতো কয়েকজন বিত্তশালী মহিলা। অনেকদিন ধরে রেইকি করার পরে আমরা গিয়ে চার্জ করলে সব সত্যিই প্রকাশ হয়, তখন আরো দুজন সমেত ওনার নাম হাতে আসে। ওনার এটাই পেশা, শহরের বিভিন্ন তথাকথিত আধুনিকা, বিত্তশালী, নিঃসঙ্গ মহিলাদের দরকার মত চাহিদা পূরণ করা। রীতিমতো এজেন্ট মারফত যোগাযোগ করে দরাদরি হয় এবং এজেন্ট একটা অংশ নেওয়ার পরে উনি বাকি টাকাটা পান প্রতি রাতের মূল্য হিসেবে। আপনি জিজ্ঞাসা করে দেখুন ওনাকে।"
মল্লিকা ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রুপমের কাছে। কী বলবে বুঝে পায় না, নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকে রুপমের দিকে। দুজনের মাঝের একহাত দূরত্ব যেন কয়েকশো যোজনের ন্যায় এই মূহুর্তে।
রুপম অধোবদনে মৃদুস্বরে বলতে শুরু করে, "দীর্ঘদিন বেকার বসে থাকার পরে ওই রেঁস্তোরাতেই নিয়মিত আসতেন এমন একজন যখন প্রস্তাব দিলেন যে মনোরঞ্জনের বিনিময়েও টাকা উপার্জন সম্ভব, আমার কাছে আর কোনো পথ ছিল না। পারলে ক্ষমা করো।"
- "তুমি একটাবার জিজ্ঞাসা অবধি করলে না এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে!"
- "জিজ্ঞাসা করলেও কিছুই লাভ হত না। তুমি কখনোই রাজি হতে না আর আমাকেও করতেই হত। না খেয়ে মরতে তো দিতে পারতাম না!"
মল্লিকা চুপ করে দাড়িয়েই থাকে। একটা মহামারী যে এভাবে একের পর এক নানা উপায়ে ওর সমস্ত আকাশটাকে ছিঁড়েখুড়ে ফর্দাফাই করতে পারে, কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। রুপমের কথাগুলো শুনে ও পরবর্তী কিছু কর্মকাণ্ড ঠিক করে নেয়। এগিয়ে যায় অফিসারের সাথে কথা বলতে।
- "স্যার, আমি সবটাই জানি এখন। গর্হিত অপরাধ জেনেও আমি এটুকুই বলতে চাই যে, ও যা করেছে পরিস্থিতির শিকার হয়ে করেছে। যা করেছে পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য করেছে। সংশোধনের একটা সুযোগ তো দেওয়া উচিত। নারী বা পুরুষ কেউই সচরাচর স্বেচ্ছায় কারো লোলুপতার ভোগ্যপণ্য হতে চায় না। নারীদের যারা এই পেশায় আছেন, তাদের সমস্যাটা আজ বহুল প্রচারিত হওয়ার সুবাদে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এগিয়ে আসে তাদের প্রয়োজনে। কিন্তু কোনো পুরুষ আর এই পেশা, তা তো ভাবতেও পারে না সমাজ। সেখানে সমস্যা, তার সমাধান, সে সব তো দূরস্ত।"
থানার অফিসার এক দৃষ্টিতে মল্লিকার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর শান্তভাবে বললেন, "ম্যাডাম, আপনার ভাবনা-চিন্তার প্রশংসা না করে পারছি না। সংশোধনই আমাদেরও লক্ষ্য, লাঠিপেটা করে ক্ষমতা প্রদর্শন না। কিন্তু, একেবারেই ছেড়ে দেওয়া তো যায় না এভাবে।"
- "আর এরকম হবে না, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলে যাচ্ছি। আমাদের একটা ছ'বছরের ছেলে আছে। আমি চাইনা এই ঘটনাটার কথা জানতে পেরে সারাজীবনের জন্য বুকানের চোখে ওর বাবা এতটুকুও ছোট হয়ে যাক।"
- "আমি বুঝতে পারছি। আপনি এক কাজ করুন। একজন উকিল নিয়ে কালকে আসুন, আমি বাকিটা দেখছি।"
মল্লিকা অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে রুপমের কাছে যায়। রুপম বাকরুদ্ধ অবস্থায় মল্লিকার দিকে তাকিয়ে থাকে।
- "চিন্তা করো না। কাল সব হয়ে যাবে। আর একটা কথা, আমার কাছে তুমি আজও আগের রুপমই আছো। কিচ্ছু বদলায়নি।" বলে মল্লিকা ওর গালটা আলতো ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল।
প্রাথমিক খারাপ লাগার মেঘটা কেটে গিয়ে কখন যে একটা স্বস্তির রোদ্দুর উঁকি মেরেছে, এতক্ষণে টের পেল মল্লিকা। কিছু কিছু হেরে যাওয়া অনেক গোপন জিতের সুলুক সন্ধান দেয়, আজও।
-------- (সমাপ্ত) --------
Collected
"মা, বাবা কখন আসবে? আমার খিদে পেয়ে গেছে।" বুকানের অস্থির প্রশ্নের উত্তরে মল্লিকা কী বলবে ভেবে না পেয়ে একটু শুষ্ক হাসিই ফিরিয়ে দেয়।
মনে মনে ভাবে, খিদের আর কী দোষ! ওইটুকু ছ'বছরের বাচ্চা, এই বয়সেই তো খিদে পাবে। আজ আবার তার উপর জন্মদিন বলে কথা, ভালোমন্দ দুটো পদ বাড়তিই হয়েছে রান্না। সেই দেখে বুকান কী আর স্থির থাকতে পারে! আজকের দিনে বাকিদের মত জন্মদিন মানেই ঢাউস একটা কেক এনে দশটা লোক নেমন্তন্ন করে, ফটো তুলে, হই-হুল্লোর করার মানসিক ও আর্থিক বিলাসিতা আজ আর মল্লিকার অন্তর থেকে আসেনা। ওই পাড়ায় থাকতে প্রথম কয়েকটা বছর করেছিল সাধ্যমত আশেপাশের ক'টা বাচ্চা আর তাদের মায়েদের নিয়ে। বিগত দু'বছরে জীবনটাকে একটু বেশীই দেখেছে। ওই পাড়াও ছেড়ে দিয়ে এই ঠাকুর কলোনীতে বাসা নিয়েছে ওঁরা।
- "কী গো?" বুকানের তাড়ায় মল্লিকার সম্বিৎ ফেরে।
- "জানিস তো, রবিবার নাইট করে সোমবার ফিরতে তোর বাবার একটু দেরীই হয়। এসে যাবে এক্ষুণি, বারোটা তো বাজতে চলল।"
বলতে বলতেই দরজায় রুপমের আওয়াজ পাওয়া গেল, "এসে গেছি। আর এই দেখো কী এনেছি।"
মল্লিকা দেখে রুপম একটা প্যাকেট হাতে এসেছে। বের করতে দেখে একটা কেকের বাক্স।
- "তুমি আবার শুরু করলে!" মল্লিকা কিছুটা বিরক্তি সহকারেই বলে।
- "আরে, ঠিক আছে। ছোট দেখেই এনেছি। সন্ধ্যেবেলায় কাটবে।এখন তো পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল। তাই ভাবলাম নিয়েই আসি।"
- "আজ স্থিতিশীল, অস্থির হতে কতক্ষণ! যাক গে, তাড়াতাড়ি স্নান করে এসো। আরেকজনের খাবারের গন্ধ পেয়েই খিদে পেয়ে গেছে আজ।"
- "হ্যাঁ, বাবি, এসো তাড়াতাড়ি।"
রুপম হেসে চলে যায়।
স্নান করে এসে দেখে দু'টো আসন পাতা রয়েছে, বুকান একটায় বসে আছে। দু'টো থালায় ভাত আর কয়েকটা বাটিতে অনেকরকম পদ সাজানো। মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, আলু-পটলের তরকারি, কাতলা মাছের ঝোল, খাসির মাংস, চাটনি আর পায়েস। বুকানের আর দোষ কী, রুপমেরই দেখে খিদে পেয়ে গেল।
- "মলি, তুমিও নিয়ে এসো। আবার বসে থাকবে কেন!"
- "নিচ্ছি, নিচ্ছি। তোমরা শুরু করো। ভাত লাগবে, দিয়ে আমি নিয়ে আসব।"
বাপ-বেটা পরম তৃপ্তিতে খেতে লাগল। মল্লিকা একদৃষ্টিতে সেটাই মনের মণিকোঠায় ফ্রেমবন্দি করছে, এতে একটা আলাদা সুখ আছে। রোজকার একরাশ না পাওয়ার মাঝে এই পড়ে পাওয়া চোদ্দআনা সুখটা যে অমূল্য। একসাথে খেতে বসলে এই মূহুর্তগুলো কোথা দিয়ে পালিয়ে যেত টেরও পেত না।
স্মৃতির সরণী বেয়ে মল্লিকা আপন খেয়ালে এক'পা দু'পা করে পিছিয়ে চলল। রুপম আর বুকানকে নিয়ে একটা দিব্যি সাজানো সংসার ছিল। শহরের এক নামকরা রেঁস্তোরায় রুপমের চাকরিটাও বেশ স্থিতিশীল ছিল। আর পাঁচটা সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের মতই ওদের জীবনেও ছিল ছোট ছোট নানা খুশির সমাহার, এদিক সেদিক ঘুরতে যাওয়া, উৎসবের আবেশ, উপহার, কেনাকাটি। হঠাৎ করেই বিশ্বজুড়ে মহামারীর প্রকোপ আর একে একে তার করাল গ্রাসে পড়ল হোটেল - রেঁস্তোরা ব্যবসাতেও। একের পর এক ব্যবসা বন্ধ আর সাথে রুপমের মত লক্ষ মানুষের নতুন করে বেকার হওয়ার খবর অনেকাংশেই ঢাকা পড়ল মহামারীর প্রকোপ আর তা সুরাহার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের খবরে। চারপাশের চেনা-জানা হিসেব ওলোট-পালোট করে ভীষণ অচেনা হয়ে যাওয়া সেইসব দিনগুলো মনে পড়লে অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে। বেশ কয়েক মাস বেকারত্বের পর অবশেষে একদিন রুপম জানালো এই নতুন চাকরিটার কথা। একটা সফটওয়্যার কোম্পানীর ক্যান্টিনে। মাইনে মোটামুটি ভালোই হলেও দুটো বিষয় একটু আলাদা, চাকরিটা রাত্রিকালীন আর সাপ্তাহিক ছুটি সোমবার। তারপর থেকে আস্তে আস্তে সংসারটা আবার স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে।
- "মা, মাংসটা খুব ভালো খেতে হয়েছে।" বুকানের গলার আওয়াজে মল্লিকা বর্তমানে ফিরে আসে।
- "এই দাঁড়া, ভাত নিয়ে আসি।"
- "তোমারটাও নিয়েই এসো।" পাশ থেকে রুপম বলে ওঠে।
মল্লিকা মাথা নাড়িয়ে আনতে যায় বাকি সব একসাথেই। আরো আধঘন্টা যাবৎ খাওয়া-দাওয়া পর্ব চলার পরে শেষ হলে বুকান শুতে যায়, রুপম খবরের কাগজটা নিয়ে বসে আর মল্লিকা রান্নাঘরে সব পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সন্ধ্যেবেলা তিনজন মিলে মোমবাতি জ্বালায়, কিনে আনা কেকটা কাটে, নিজেদের মত করে ছেলের জন্মদিনটা পালন করে। অনেকদিন পর যেন সবকিছু আগের মত লাগছিল মল্লিকার। মনে মনে প্রার্থনা করে এই চাকরিটায় যেন কারোর নজর না লাগে।
পরদিন আর পাঁচটা দিনের মতই বেশ চলছিল। এগারোটা নাগাদ তিনটে লোক এসে জিজ্ঞাসা করল যে রুপম সরকার এখানেই থাকে কিনা। মল্লিকা হ্যাঁ বলতেই ওনারা নিজেদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে রুপমকে ডেকে দিতে বলে। পুলিশ।
রুপম ভিতর থেকে মল্লিকার ডাকে বেরিয়ে আসলে ওনাদের মধ্যে একজন এগিয়ে গিয়ে বলেন, "আপনিই রুপম সরকার, স্যরি, অ্যান্থনি?"
রুপমের মুখটা এইটুকু হয়ে গেছে মল্লিকার নজর এড়ায় না। কিন্তু অ্যান্থনি কথাটার মানে ও কিছুই বুঝতে পারে না।
- "চলুন আমাদের সাথে।"
- "কিন্তু ওঁর দোষটা কী আমাকে বলুন। চুরি, ডাকাতি, স্মাগলিং কিছু করেছে নাকি? দয়া করে আমাকে বলুন।" মল্লিকা কাতরকণ্ঠে অনুরোধ করে।
রুপম চুপচাপ ওদের সাথে বেরোনোর জন্য এগোয়।
- "কি গো, তুমি তো বলো, কী করেছো।" মল্লিকার কাতরতা দেখে ওই তিনজনের একজন কিছু বলতে গিয়ে দেখে বাচ্চাটা ভিতরের ঘরের দরজায় পরদাটা আঙ্গুলে নিয়ে পেঁচাচ্ছে।
- "আমাদের ওখানে পরে আসুন, সবটা জানানো হবে।" মল্লিকার উদ্দেশ্যে এটুকুই বলে উনি বাকিদেরকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় মল্লিকা আকাশ-পাতাল ভেবেও কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পেল না। বুকানকে ঘরে শান্ত হয়ে থাকতে বলে পোষাক পাল্টে কিছুক্ষণ পরে মল্লিকা বেরোল থানার উদ্দেশ্যে।
ঢুকে দেখল রুপমকে একটা কোণায় বসিয়ে রেখেছে। থানার অফিসারের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই ভারী গলায় উনি বলে ওঠেন, "উনি যা করেছেন তা ভারতীয় দণ্ডবিধান অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিছুদিন জেলের হাওয়া খেলেই সব শখ মিটে যাবে। আপনি চলে যান ম্যাডাম।"
- "কী করেছে তো বলুন।"
- "স্যার তো বলল আপনাকে চলে যেতে, কানে গেলো না!" পাশ থেকে এক উর্দিধারী বলে ওঠে।
- "আমাকে জানতে তো হবে আমার স্বামী কী করেছে!"
- "শুনতে চান? শুনুন তাহলে, আপনার স্বামী একটা জিগোলো।"
- "কী যা তা বলছেন!" মল্লিকা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না।
- "হ্যাঁ, বহুদিন যাবৎ অ্যান্থনি নামের আড়ালে উনিই জিগোলো হিসেবে কাজ করছেন। আমাদের কাছে খবর ছিল একটা বাগানবাড়িতে মাঝেমাঝেই অন্যরকম আসর বসাতো কয়েকজন বিত্তশালী মহিলা। অনেকদিন ধরে রেইকি করার পরে আমরা গিয়ে চার্জ করলে সব সত্যিই প্রকাশ হয়, তখন আরো দুজন সমেত ওনার নাম হাতে আসে। ওনার এটাই পেশা, শহরের বিভিন্ন তথাকথিত আধুনিকা, বিত্তশালী, নিঃসঙ্গ মহিলাদের দরকার মত চাহিদা পূরণ করা। রীতিমতো এজেন্ট মারফত যোগাযোগ করে দরাদরি হয় এবং এজেন্ট একটা অংশ নেওয়ার পরে উনি বাকি টাকাটা পান প্রতি রাতের মূল্য হিসেবে। আপনি জিজ্ঞাসা করে দেখুন ওনাকে।"
মল্লিকা ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রুপমের কাছে। কী বলবে বুঝে পায় না, নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকে রুপমের দিকে। দুজনের মাঝের একহাত দূরত্ব যেন কয়েকশো যোজনের ন্যায় এই মূহুর্তে।
রুপম অধোবদনে মৃদুস্বরে বলতে শুরু করে, "দীর্ঘদিন বেকার বসে থাকার পরে ওই রেঁস্তোরাতেই নিয়মিত আসতেন এমন একজন যখন প্রস্তাব দিলেন যে মনোরঞ্জনের বিনিময়েও টাকা উপার্জন সম্ভব, আমার কাছে আর কোনো পথ ছিল না। পারলে ক্ষমা করো।"
- "তুমি একটাবার জিজ্ঞাসা অবধি করলে না এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে!"
- "জিজ্ঞাসা করলেও কিছুই লাভ হত না। তুমি কখনোই রাজি হতে না আর আমাকেও করতেই হত। না খেয়ে মরতে তো দিতে পারতাম না!"
মল্লিকা চুপ করে দাড়িয়েই থাকে। একটা মহামারী যে এভাবে একের পর এক নানা উপায়ে ওর সমস্ত আকাশটাকে ছিঁড়েখুড়ে ফর্দাফাই করতে পারে, কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। রুপমের কথাগুলো শুনে ও পরবর্তী কিছু কর্মকাণ্ড ঠিক করে নেয়। এগিয়ে যায় অফিসারের সাথে কথা বলতে।
- "স্যার, আমি সবটাই জানি এখন। গর্হিত অপরাধ জেনেও আমি এটুকুই বলতে চাই যে, ও যা করেছে পরিস্থিতির শিকার হয়ে করেছে। যা করেছে পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য করেছে। সংশোধনের একটা সুযোগ তো দেওয়া উচিত। নারী বা পুরুষ কেউই সচরাচর স্বেচ্ছায় কারো লোলুপতার ভোগ্যপণ্য হতে চায় না। নারীদের যারা এই পেশায় আছেন, তাদের সমস্যাটা আজ বহুল প্রচারিত হওয়ার সুবাদে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এগিয়ে আসে তাদের প্রয়োজনে। কিন্তু কোনো পুরুষ আর এই পেশা, তা তো ভাবতেও পারে না সমাজ। সেখানে সমস্যা, তার সমাধান, সে সব তো দূরস্ত।"
থানার অফিসার এক দৃষ্টিতে মল্লিকার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর শান্তভাবে বললেন, "ম্যাডাম, আপনার ভাবনা-চিন্তার প্রশংসা না করে পারছি না। সংশোধনই আমাদেরও লক্ষ্য, লাঠিপেটা করে ক্ষমতা প্রদর্শন না। কিন্তু, একেবারেই ছেড়ে দেওয়া তো যায় না এভাবে।"
- "আর এরকম হবে না, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলে যাচ্ছি। আমাদের একটা ছ'বছরের ছেলে আছে। আমি চাইনা এই ঘটনাটার কথা জানতে পেরে সারাজীবনের জন্য বুকানের চোখে ওর বাবা এতটুকুও ছোট হয়ে যাক।"
- "আমি বুঝতে পারছি। আপনি এক কাজ করুন। একজন উকিল নিয়ে কালকে আসুন, আমি বাকিটা দেখছি।"
মল্লিকা অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে রুপমের কাছে যায়। রুপম বাকরুদ্ধ অবস্থায় মল্লিকার দিকে তাকিয়ে থাকে।
- "চিন্তা করো না। কাল সব হয়ে যাবে। আর একটা কথা, আমার কাছে তুমি আজও আগের রুপমই আছো। কিচ্ছু বদলায়নি।" বলে মল্লিকা ওর গালটা আলতো ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল।
প্রাথমিক খারাপ লাগার মেঘটা কেটে গিয়ে কখন যে একটা স্বস্তির রোদ্দুর উঁকি মেরেছে, এতক্ষণে টের পেল মল্লিকা। কিছু কিছু হেরে যাওয়া অনেক গোপন জিতের সুলুক সন্ধান দেয়, আজও।
-------- (সমাপ্ত) --------
Collected