15-04-2022, 08:30 PM
উঠে বসলাম ল্যাপটপটা নিয়ে তনুকে একটা মেইল করলাম। ওকে ভাসা ভাসা সব জানালাম। এও বললাম আমি কয়েকদিন কলকাতায় থাকবোনা। তোমার মেইল চেক করতে পারবোনা। তোমার কিছু মেইল করার থাকলে করবে। আমি সময় মতো খুলে দেখে নেবো।
ফোনটা বেজে উঠলো। দেখলাম মিত্রার ফোন।
উঠে বসে ধরলাম। বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। ঘরের লাইট জ্বাললাম। বারান্দায় এসে ছগনলালকে দেখতে পেলাম ওর দেশোয়ালী ভাইদের সঙ্গে বসে গল্প করছে। আমায় দেখে ফিরে তাকালো ইশারায় বললাম একটু চা খাওয়াবে। ও হেসে ফেললো।
-কোথায় তুই?
-বাসুর বাড়িতে।
-কে নিয়ে এলো।
-বাসু এগিয়ে দিয়ে গেলো।
-খবর কি?
-কোনখান দিয়ে শুরু করি বলতো।
কথা শুনে মনে হচ্ছে মিত্রা বেশ খুশিতে আছে। ওর কোনো টেনসন নেই।
-তোর থেকে শুরু কর।
-তুই কোথায়?
-বাড়িতে
একা?
-আমার জন্য খুব কষ্ট পেলি আজকে।
-তা একটু পেয়েছি।
-তার সঙ্গে আমাকে যে পেলি।
-তোকে তো আগেই পাওয়া হয়ে গেছে।
-সেটা সম্পূর্ণ ছিল না। আজকে সম্পূর্ণ হলো। আজকে আমার থেকে সুখী এ পৃথিবীতে কেউ নেই।
-একথা বলছিস কেনো!
-তুই আজকে ওই বাস্টার্ডটাকে মেরে রক্ত বার করে দিয়েছিস। তুই যদি মেরে ফেলতিস আমি আরো আনন্দ পেতাম।
ভাবলাম কতটা জ্বালা এতদিন ও বুকে নিয়ে ঘুরেছে। কেউ ওর পাশে ছিলো না যে ওর কথা শুনে ওকে একটু সাহায্য করবে। যা কিছু করেছে নিজের বুদ্ধিতে। হাতাশাগ্রস্ত হয়ে রাতের বেলা আকণ্ঠ মদ গিলেছে। তারপর নিজের প্রতি ঘেন্নায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে। যা হয় হোক। শেষ পরিণতি কি আছে মৃত্যু। এর বেশিতো কিছু নয়।
-কিরে চুপ করে গেলি।
-না। এমনি।
-আজ এখানে কি হয়েছে জানিস।
-কি।
-চিকনা বললো।
-কি বললো।
-তুই নাকি ক্লাস টেনে পরার সময় ওকে একবার বেধড়ক মেরেছিলি। তারপর কাউকে এইরকম মারলি। তুই যে রেগে যেতে পারিস। তুই যে কাঁচা কাঁচা গালাগাল দিতে পারিস এটা ওরা প্রথম জানলো।
-তুই।
-কলেজে তোর মুখ থেকে দু’একটা শুনতাম। তারপর আমি হারিয়ে গেলাম।
-তোরা সব শুনেছিস।
-তোর ঘরে মাল ফিট করা ছিলো। তুই ধরতে পারিসনি।
-তখন আমার মনের অবস্থা সেরকম ছিলোনা।
-সেই সময় ইসলাম ভাইকে দেখলে তোর মাথা খারাপ হয়ে যেতো।
-কেনো।
-হাতগুলো কেমন করছিলো কেমন এ্যাবনরমাল ভাব। চোখগুলো কেমন ঘোলাটে। তারপর তুই যখন মারলি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো। ছোটমা কতো বোঝালো। কান্না থামানো যায় না। পরে রতনকে যা বললোনা। আমার শুনে আত্মারাম খাঁচাছাড়া।
-বড়মারা কেউ ছিলোনা।
-না।
-ইসলাম ভাই আজ আমাকে নিয়ে আড়ালে আড়ালে ঘুরেছে। আমাকে প্রশ্ন করেছে আমি উত্তর দিয়েছি। আর ফোন করে করে খালি মিলিয়ে নিয়েছে।
-কোথায় ফোন করছিলো।
-বম্বেতে। ঠাট উর্দুতে কথা বলছিলো। ইসলাম ভাই কি দারুন উর্দু বলেরে। আমি কিছু বুঝতে পারিনি।
-তোর কি মনে হয় কোথায় ফোন করছিল।
-আমার কাছে টোডির ব্যাপারে জানতে চেয়েছে। আমি যতটা জানতাম বলে দিয়েছি। তারপর দামিনীমাসি ফোন করেছিলো।
-তোর সঙ্গে কথা বলেছে।
-হ্যাঁ। ইসলাম ভাই বললো আমার সঙ্গে আছে। কথা বলবে। কথা বললাম। তুইতো নিয়ে গেলিনা। দামিনী মাসি বলেছে আমাকে নিয়ে যাবে। ওরে দামিনী মাসি ইসলাম ভাই দুজনেই বড় খেলোয়াড়।
-আজ বুঝলি।
-বুঝলাম।
-বড়মা, ছোটমা।
-নো টেনসন ডু ফুর্তি। ওরা এসব ঘটনা জানেই না। তুই একা একা মনটা খারাপ লাগছে।
-তোরা সবাই ঠিক আছিস।
-তোকে একেবারে ভাবতে হবেনা। নীপা আসছে এখন রাখি। রাতে কথা বলবো। জেগে থাকবি।
-আচ্ছা।
মিত্রার সঙ্গে কথা বলার পর মনটা একটু হাল্কা হলো বলে মনে হচ্ছে। ভাবছিলাম ওকে একবার জিজ্ঞাসা করি ভিডিও’টার সম্বন্ধে। তারপরে ভাবলাম না থাক। ওর কাছে যখন যাবো তখন ওকে জিজ্ঞাসা করবো। ওর মুখ থেকে ব্যাপারটা শোনার দরকার আছে।
ছগনলাল চা নিয়ে এলো। আমি ওর হাত থেকে চায়ের কাপ নিলাম।
-ছোটবাবু রাতে কি খাবে।
-আমি যা বলবো তুমি খাওয়াবে ?
-হ্যাঁ।
-তুমি যে মাঝে মাঝে ছাতুর ছোটো ছোটো লেট্টি বানাও আজ একটু বেশি করে বানাও। চাটনি পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে খাবো।
-আমাদের খাবার আপনি খেতে পারবেন!
মনে মনে হাসলাম। ছগনলাল তুমি সুদূর বিহারের এক অজ গ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছো পেটের সন্ধানে। আমিও তোমার মতো গ্রামের মানুষ। কতদিন কলকাতার রাস্তায় তোমার দেশোয়ালী ভাইয়ের কাছে ছাতুমাখা তেঁতুলের টক দিয়ে মেখে খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। শেষে লোটা ভরা জল খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিয়েছি। একশো গ্রাম ছাতুর দাম তখন পঞ্চাশ পয়সা ছিলো।
ছগনলাল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
-তুমি তৈরি করো আমি খাবো।
উঠে গিয়ে মানি পার্টস থেকে টাকা বার করলাম।
-না ছোটোবাবু টাকা লাগবেনা। বড়বাবু টাকা দিয়ে গেছেন।
-তাহলে তুমি একটু বেশি করে করো। যদি কেউ আসে তাদেরও খাওয়াবো।
ছগনলাল হো হো করে হেসে ফেললো।
-না ছোটবাবু আপনার মন চাইলো আপনাকে খাওয়াবো। অন্যেরা আমার বানানো লেট্টি খাবেনা।
-আচ্ছা তুমি করোনা। আমিতো বলছি।
ছগনলাল নাচতে নাচতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম। মেইল বক্স খুলতেই দেখলাম তনু অনলাইনে আছে। আমি অনলাইন হতেই ও চ্যাট শুরু করে দিলো। হায়।
-আমার মেইল পেয়েছো।
-পেলাম।
-কি বুঝলে।
-প্রথমে বলো তুমি কেমন আছো।
-পড়ে কি বুঝলে? আমি ভালো আছি।
-একেবারে না।
-দেখালাম তনু লিখছে। আমি অপেক্ষা করলাম।
-মিত্রাদির জন্য মনটা খুব খারাপ লাগছে।
-শুধু তোমার একার নয় সবার। যারা শুনছে তাদেরই খারাপ লাগছে। লিপিড ইট।
তনু লিখছে।
-তোমায় খুব মিশ করছি। এখানে কাজের মধ্যে যখন থাকি তোমার কথা বিশেষ মনে পরেনা। তবে যখন ফ্ল্যাটে চলে আসি তখন তোমার কথা ভীষণ ভাবে মনে পরে।
-তুমি আমার অবস্থাটা জানো তনু। তোমাকে নতুন করে কিছু বলার নেই।
-হুঁ।
তনু লিখছে। আমি অপেক্ষা করলাম।
-ডাক্তার ব্যানার্জী মোটেই সুবিধার লোক নয়। যেখানে উনি থাকতেন আমি সেখানে খোঁজ খবর নিয়েছিলাম। ওনার চরিত্রে নুন দেওয়ার জায়গা নেই।
তনু লিখছে।
-এখানকার হাসপাতালে একজন মহিলা পেসেন্টের উনি শ্লীলতাহানি করেছিলেন। সেই নিয়ে ওনার পানিশমেন্ট হয়। তাতে উনি ছ’মাস জেল খেটেছিলেন। তারপর ওনার সব কিছু কেড়ে নিয়ে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওনার নাম শুনে আমাকে কেউ প্রথমে এনটারটেইন করতে চায়নি। ভাগ্যিস আমি বিবিসির রিপ্রেজেন্টেটিভ তাই এনটারটেইন করে মেটেরিয়ালস দিয়েছে।
-সত্যি তনু তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
-এইতো হ্যাজানো শুরু করেদিলে।
-এটা হ্যাজানো হলো।
-তা নয়তো কি।
-তোমায় একটা রিকোয়েস্ট করবো।
-আবার।
-তাহলে কি বলবো।
-আদেশ করবে।
-তোমাকে আদেশ করার ক্ষমতা এখনো হয়নি।
-কাগজের মালিক হয়েছো আবার কবে হবে। এবার ঝেড়ে কাশোতো।
-আমার খুব ইচ্ছে ওখানে একটা ব্রাঞ্চ করবো। হেল্প করবে। তাহলে প্রায় ওখানে যাওয়া হবে আর…….।
-কি দুষ্টু বুদ্ধি তোমার। তারপর বলবে তনু তুমি বিবিসি ছেড়ে আবার এই হাউসে জয়েন করো। ওখানকার ব্রাঞ্চ সামলাও। দুষ্টু কোথাকার খালি মাথায় জিলিপির প্যাঁচ না।
-রাগ করছো কেনো। আমি কি তোমার ভালো বন্ধু নই।
-হুম। বুঝেছি।
-তাহলে রাজি।
-রাজি কিনা বলতে পারছিনা। কি করতে হবে বলো।
-ব্রাঞ্চ খুলতে গেলে জায়গা লাগবে।
-লাগবে।
-ভাড়া নেবো না। কিনবো।
-ওরে বাবা। সেতো অনেক টাকার দরকার।
-দেবো।
-তোমার এতো টাকা কোথায়।
-এইতো বললে কাগজের মালিক।
-হো হো হো।
-ঠিক আছে। আর।
-কিছু স্টাফ লাগবে।
-বুঝেছি আমাকে সব দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে তাইতো।
-এইতো লক্ষ্মী মেয়ের মতো কথা।
-আমি কি পাবো।
-তুমি বুরো চিফ হবে।
-এই টুকুতে আমার কিছু হবেনা।
-ঠিক আছে তোমার ডিমান্ড বলো।
-প্রত্যেক মাসে একবার এখানে আসতে হবে। পনেরোদিন থাকতে হবে।
-কথা দেবোনা।
-তাহলে হবেনা।
-তুমি আমাকে না করবে।
-ওই জন্যই মরেছি।
-হো হো হো।
-কাল আমি কলকাতার বাইরে চলে যাবো। যেখানে যাবো সেখানে পাওয়ার নেই অতএব নেট কানেকসন দূর অস্ত। আমি ফিরে আসবো নেক্সট সোমবার তখন কথা হবে।
-মিত্রাদি ওখানে।
-হ্যাঁ। হাওয়া চেঞ্জে পাঠিয়েছি।
-তার মানে।
-ডাক্তার বললো। আজকে ডাক্তার নিজে গেছে।
-কি হয়েছে মিত্রাদির তুমিতো বলোনি।
-সব কথা বলা যায়।
-বলো কি হয়েছে।
-নার্ভের প্রবলেম।
-তার মানে!
-গত ছয় সাত বছর দেহে ও মনে অনেক অত্যাচার হয়েছে। তার ফলস্বরূপ এই রোগ।
-কি বলছো তুমি!
-যার স্বামী এই রকম চরিত্রের হয়…….।
-তুমি মন খারাপ করোনা। দেখবে ঠিক হয়ে যাবে।
-ঠিক হওয়ার সম্ভবনা নেই। ডাক্তারদাদা বলেছেন। এর পর মনের ওপর স্ট্রেচ পরলে হয়তো পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।
-কি সব আজে বাজে বকছো।
-আমি তোমায় মিথ্যে কথা বলবোনা তনু। ও আজ পৃথিবীতে একা। আমি ছাড়া ওর আপনজন বলতে কেউ নেই।
-অনি!।
-হ্যাঁ তনু।
বাইরের গেটে গাড়ির হর্নের আওয়াজ পেলাম। মনে হয় কেউ এসেছে।
-দেখি তোমায় আবার কবে ধরতে পারি।
-আমি রেগুলার ইন্ডিয়ান টাইম ছটার পর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত থাকি।
-আচ্ছা। যা বললাম মনে রেখো।
-বাই।
-বাই।
তাড়াতাড়ি মেইল বক্স বন্ধ করে অন্য মেইল চেক করতে আরম্ভ করলাম।