11-04-2022, 03:59 PM
ট্রেন ধরে বেলাডাঙা পৌছতে পৌছাতে প্রায় সাড়ে বারোটার মত বেজে গেলো… শীতটা ততদিনে বেশ কমে গিয়েছে… কলকাতার শীত আর কতদিন থাকে… মাঝরাতের পর থেকে ভোর অবধি একটা শিরশিরানির মত থাকে ঠিকই, কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে কমে যায় অনেকটাই… যদিও, এখনও তেমন গরমও পড়েনি… কিন্তু জানি যে গ্রামে ওই দিকে এখনও বেশ ঠান্ডা আছে… তাই একটা জিন্স আর তার উপরে একটা ফুল হাতা গেঞ্জি… আর সেই সাথে একটা লেদার জ্যাকেট চাপিয়ে নিয়েছিলাম যাতে রাতে ফেরার সময় ঠান্ডাটা না লাগে… এই রকম আবহাওয়ায় মোটামুটি আরামদায়ক… পায়ে পড়ে নিয়েছিলাম স্নিকার… কারণ ট্রেন জার্নিতে এই ধরণের জুতো অনেক সুবিধাজনক… শত তাড়াতাড়ি করেও এর চেয়ে আগে এসে পৌছাতে পারলাম না… হয়তো গাড়িতে আসলে এর অনেক আগেই পৌছে যেতে পারতাম ঠিকই… কিন্তু ওই যে… বাড়ির কোন কিছুই নেবো না… এত কিছুর মধ্যেও আমার সেই জেদ কিছুতেই টলে না… সে যাই হোক… কি আর করা যাবে!... আসলে হয়তো একটু আগে আরো পৌছানো যেত, যদি না স্টেশনে ঢোকার সময় আগের ট্রেনটা মিস করতাম… আর এই সময়টা উল্টো দিকের ট্রেন… স্বভাবতই বেশ দেরীতে পেয়েছিলাম পরের ট্রেনটা, অনেকটা সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল স্টেশনে দাঁড়িয়ে…
ট্রেন থেকে নামতেই দেখি প্ল্যাটফর্মের উপরেই ফকির আর কাজল অপেক্ষা করছে আমারই জন্য… ওদের চোখে মুখে একটা বিষন্নতার ছাপ ছেয়ে রয়েছে… আমায় দেখেই ফকির এগিয়ে আসে… আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলে, “দাদু মুকে পাঠায় দিলো… তুকে লিয়ে যেতি… চল্… ভ্যানটারে লিয়ে আসিছি…”
ছোট স্টেশন, একটু হেঁটেই বাইরে চলে এলাম আমরা… সামনের দিকে মুখ তুলে তাকাতে দেখি একটা ভ্যান রিক্সা দাঁড় করানো রয়েছে রাস্তার পাশে… এটা ফকিরেরই ভ্যান রিক্সা… দাদুই কিনে দিয়েছে ওকে… আগে ফকির জন খেটে বেড়াতো… আর সময় সুযোগে ওই সব বনে জঙ্গলে শিকার করতে যেত… একদিন দাদুর কাছে কষে ধমক খেয়েছিল, আর তারপর দাদু ওকে এটা কিনে দিয়ে বলেছিল, নিজের গতর খাটিয়ে নিজে রোজগার কর… ওই সব শিকার টিকার মাথা থেকে বাদ দে… দাদুর কথা অমান্য করে, বেলাডাঙায় কেউ জন্মায় নি… মাথা নিচু করে ফকিরও মেনে নিয়েছিল দাদুর কথা, আর তারপর থেকে জানি ও ভ্যানই চালায়… হয়তো কষ্টের কাজ ঠিকই, কিন্তু মাথা উঁচু করে বাঁচে সে এখন… কারুর কোন পরোয়া করার দরকার পড়ে না আর…
আমার ব্যাগটা নিয়ে ভ্যানের উপর রেখে ফিরে তাকায় আমার দিকে… “কোই রে… চল কেনে… উদিকে সক্কলে তোর তরে অপেক্ষা করছি তো…”
আমি ওর কথায় তাড়াতাড়ি পা চালাই… গিয়ে উঠে বসি ওর ভ্যান রিক্সায়… অন্য পাশে উঠে বসে কাজল… ফকির প্যাডেলে চাপ দেয়…
বাড়ি পৌছাতে খেয়াল করলাম পরিবেশ তখন যেন কেমন থমথমে হয়ে রয়েছে… চতুর্দিকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন চেপে বসে রয়েছে বাড়ির আবহাওয়ায়… আমি ইচ্ছা করেই, বাড়িতে ওঠার সিড়ির মুখে নিজের পায়ের জুতোটা খুলে ঢুকলাম… ভেতরে, বৈঠকখানাতেই শুইয়ে রাখা রয়েছে রঘুকাকাকে… পা থেকে বুক অবধি সাদা চাঁদরে ঢাকা… মুখটুকু বের করা… গলায় মালা দিয়ে দিয়েছে কেউ… চোখের পাতায় তুলসিপাতা বসানো… গলার কন্ঠিটা তখনও গলাতেই রয়েছে… ঘরে উপস্থিত সকলেই, বাপি, জ্যেঠু, পিমা, কাকা, জ্যেম্মা… কিন্তু কারুর মুখে কোন কথা নেই… মনে হলো আমার আমি যেন একটা প্রেত পুরীতে এসে ঢুকলাম… আমায় দেখে দাদু ধীর পায়ে এগিয়ে এলো… কাঁধে হাত রেখে নীচু স্বরে প্রশ্ন করলো, “রাস্তায় আসতে অসুবিধা হয় নি তো দিদিভাই?”
আমি মাথা নাড়ি, না বলি… তারপর দাদুর পাশ দিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাই শায়িত রঘুকাকার দিকে… পায়ের কাছে দাঁড়াই মাথা নীচু করে… চুপ করে তাকিয়ে দেখতে থাকি মানুষটাকে… যে মানুষটা আমাকে সেই ছোট্ট থেকে কোলে পীঠে করে বড় করে তুললো… যে মানুষটা সর্বদা আমায় রক্ষাকর্তার মত আগলে রাখতো… যে মানুষটা আমার এক পরম আত্মীয় ছিল… আমি ধীরে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ি রঘুকাকার পায়ের সামনে… তারপর মাথা নীচু করে ঠেঁকাই আমার মাথাটাকে রঘুকাকার পায়ের উপরে… বুকের মধ্যেটায় তখন যেন কি ভিষন তোলপাড় চলছে… কিন্তু কিছুতেই চোখের কোনে জল আসে না… কেমন যেন সব কিছু শুকিয়ে গিয়েছে রঘুকাকাকে এই ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে… আসলে কোনদিন তো দেখিনি আমি… রঘুকাকাকে শুয়ে থাকতে… কখনো শুনিনি, রঘুকাকার কোনদিন শরীর খারাপ হয়েছে বলে… শীত গ্রীষ্ণ বর্ষা… সব সময়ই যেন রঘুকাকা একেবারে ফিট… কখনও কোনদিন কোন ব্যধি রঘুকাকাকে স্পর্শ করতে পারে নি… কিন্তু সেই মানুষটা… এই ভাবে হটাৎ… আমি মুখ তুলে ফিরিয়ে তাকাই দাদুর দিকে… আমার চোখের প্রশ্ন বুঝে এগিয়ে আসে দাদু ফের… “হটাৎ করেই… কাল রাতে… অনেক রাতও হয়েছিল… কিছু করার সুযোগই দিল না… তাও তো আমি ছিলাম এখানে… কিন্তু থেকেও কোন লাভ হল না…” বলতে বলতে গলার স্বর কেঁপে যায় দাদুর… বুঝতে পারি… দীর্ঘদিনের সঙ্গী হারানোর বেদনাটা কেমন… মুখ তুলে তাকাই দাদুর দিকে… চোখের কোলে এক ফোঁটা জল চিকচিক করছে সেখানে…
জ্যেঠু এগিয়ে এসে আমার হাতে একটা মালা দিয়ে বলে, “যা তিতাস… এটা রঘুদাকে পরিয়ে দে…”
আমি মুখ ফিরিয়ে তাকাই জ্যেঠুর দিকে… অমন মানুষটার মুখটাও কেমন বিষন্ন… আমি জ্যেঠুর হাত থেকে মালা নিয়ে উঠে দাঁড়াই… তারপর ঘুরে রঘুকাকার পাশে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ি মেঝের উপরেই… যত্ন সহকারে মালাটা গলায় পরিয়ে দিই… ততক্ষনে রিগর মর্টিস ধরে যাওয়া মাথাটাকে অতি কষ্টে সামান্য তুলে গলিয়ে দিই মালাটাকে ঘাড়ের মধ্যে দিয়ে… তারপর সেটা যত্ন করে বুকের উপরে সাজিয়ে দিই টেনে দিয়ে… হাত তুলে রাখি বরফ শীতল হয়ে থাকা রঘুকাকার গালের উপরে… হাত বোলাই পরম মমতায়… আরও একজন খুব কাছের মানুষকে হারিয়ে ফেললাম আমি… বুকের মধ্যেটা মুচড়ে ওঠে আমার…
আমার মাথায় সস্নেহের হাত রেখে জ্যেঠু বলে ওঠে, “তিতু মা… এবার ওঠ… অনেকক্ষন এই ভাবে রঘুদাকে শুইয়ে রেখেছি… এবার আমাদের যেতে হবে…”
হ্যা… এটাই বাস্তব… মানুষটা আর নেই… তাই এখন শুধু শুধু দেরি করার কোন মানেই হয় না… জানি, আমার জন্যই এই এতক্ষন আটকে থাকতে হলো রঘুকাকাকে… না হলে অনেক আগেই সে মিলিয়ে যেত আনন্দলোকের পথে… একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াই আমি… একটু সরে দাঁড়াই পাশে… ফকিররা এগিয়ে আসে…
আমি ধরা গলায় পিমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করি, “তরু? তরুকে দেখছি না!”
পিমা কিছু বলার আগেই আমার কাঁধে একটা হাতের চাপ উপলব্ধি করে ঘুরে তাকাই পাশে… দেখি রঘুকাকার ছেলে তরুন এগিয়ে এসেছে আমার দিকে… আমি গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি… ওর বুকে মাথা রাখি… ও আমার মাথার চুলে হাত বোলায়… যেন ওর পিতৃবিয়োগ হয় নি… আমার হয়েছে… এমন ভাবে সস্নেহে শান্তনা দিতে থাকে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে…
খালের পাড়ে, পারলৌকিক কাজ মিটতে মিটতে প্রায় বেশ রাতই হয়ে গেলো… প্রায় নয়টা সাড়ে ন’টা তো হবেই… শহরে হয়তো ন’টা-টা কোন রাতই নয়, কিন্তু গ্রামে সেটা অনেকটাই… বাড়ি ফিরে সকলে যারা যারা শ্মশানে গিয়েছিল, সকলে আগুন হাত ছুঁয়ে টুকটাক লৌকিকতা সম্পন্ন করে নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফিরে যাবার তোড়জোড় করতে শুরু করে দিল… সেদিনই ফিরতে হবে সকলকে… কারন কলকাতার বাড়িতে প্রায় কেউই নেই… তাই ইচ্ছা থাকলেও কারুর থেকে যাওয়া সম্ভব নয়… দাদু যাবে না বলে দিল… রঘুকাকার বাকি কাজ শেষ করেই ফিরবে কলকাতা… জ্যেঠু, বাবা আর কাকা ফিরে আসবে, গাড়ি তো সাথে আছেই… আমায় ডেকে জ্যেঠু বলল, “তিতু মা… তুই নিশ্চয়ই ফিরে যাবি… তাহলে আমাদের সাথেই ফিরে চল… আমি তোকে তোর হোস্টেলে নামিয়ে দেবো…”
প্রথমটা আমি কোন উত্তর দিই না… চুপ করেই থাকি… দেখে দাদু এগিয়ে আসে, আমার মাথায় হাত রেখে বলে, “যা না মা, বাবাদের সাথেই ফিরে যা… আর জেদ করিস না…”
দাদুকে বলি আমি, “না… আমি এখন যাবো না… ওরা চলে যাক…”
পিমা এসে আমার হাতটা ধরে… শান্ত গলায় বলে, “দেখ তিতাস… এত জেদ ভালো নয়… যতই হোক… এই সময়টা অন্তত নিজের জেদটাকে একটু সরিয়ে রাখ সোনা…”
আমি মুখ তুলে তাকাই পিমার দিকে… চোখে চোখ রেখে ধীর গলায় বলি, “কি পেয়েছ তুমি? এই ভাবে সব কিছু মেনে নিয়ে? তাতে তুমি কি ভালো আছো?”
পিমা কেমন অবাক চোখে তাকায় আমার দিকে… বোধহয় ভাবতেও পারেনি আমার কাছ থেকে এই রকম একটা প্রশ্ন ছুটে আসতে পারে বলে… সকলের সামনে যেন ভিষন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে পিমা… ঝটিতে একবার নিজের বাবামশায়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে চাপা গলায় আমায় বলে ওঠে, “ওরে, চুপ কর… এই সব কথা সবার সামনে বলতে নেই…”
সবার সামনে নিজের মনটা পিমা কোনদিনই খুলে মেলে ধরতে পারে নি… তাই নিজের ভালোবাসাও হারিয়ে ফেলেছে ওই জেদটা দেখাতে না পেরে… কিন্তু আমি তো পিমা নই… আমি, আমিই… যেটা ঠিক বলে ভেবেছি, সেটাই মেনে থাকবো… সেখান থেকে আমায় টলানো সহজ ব্যাপার নয়… আমার মন যেটা বলে, সেটাই আমি শুনি… তাতে যদি পৃথিবীর আবর্তন থেমেও যায়, তাতেও আমার কিছু করার নেই… আমি পিমার মত করেই গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে বলি, “না পিমা… আমি জানি, তুমি মেনে নিয়েছ সব কিছু নিজের জীবনের সমস্ত সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে… মেনে নিয়ে তুমি আজ নিঃস্ব… কিন্তু আমি সেটা হতে দেবো না… যখন আমি স্থির করেই ফেলেছি, ওই বাড়ির সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখবো না, মানে রাখব নাই… আমায় প্লিজ… এই ভাবে বোল না বারেবার…”
কখন আমার পেছনে বাপি এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করিনি… চমকে পেছন ফিরে তাকাই কাঁধের উপরে হাতের স্পর্শে… মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি বাপি… চোখ ভর্তি এক রাশ ভালোবাসা… দেখে সত্যি বলতে আমার মনটা ভিষন হু হু করে উঠল যেন… আমি মুখ কিছু না বলে বাপিকে জড়িয়ে ধরে মুখটা গুঁজে দিই বাপির বুকের মধ্যে… আমার মাথায় হাত রাখে বাপি… মাথার চুলের মধ্যে একটা চুমু খেয়ে বলে, “ভালো আছিস তিতাস মা… শরীর ঠিক আছে তো?”
আমি উত্তর দিতে পারি না… গলাটা কেমন বুজে আসে একটা চাপা কান্নায়… দুই হাতে আরো জোরে আঁকড়ে ধরি বাপিকে… মাথা নাড়ি বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখে…
“কাল সকালে যাবি?” ফের জিজ্ঞাসা করে বাপি…
এবারেও উত্তরে শুধু মাথা নেড়ে হ্যা বলি… চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারি না মুখ দিয়ে…
“সাবধানে ফিরিস… আর বেরোবার সময় খেয়ে নিস কিছু… কেমন!” পিতৃস্নেহ মাখা কন্ঠে বলে ওঠে বাপি… উত্তরে ফের মাথা নাড়ি আমি… আরো ঘন করে জড়িয়ে ধরি বাপির শরীরটাকে… সেই ছোটবেলার মত…
দেরি সত্যিই হয়ে যাচ্ছিল… দাদুই তাড়া দেয়… তাই আর সবাই সময় না নষ্ট করে গাড়িতে উঠে চুপচাপ বেরিয়ে যায় দাদুর সাথে টুকটাক কিছু কথা বলে… দাদুও আর কথা বাড়ায় না আমার যাওয়া নিয়ে… ওরা বেরিয়ে যেতে আমায় বলে, “দিদিভাই, আমি উপরে গেলাম… তুই গিয়ে কিছু মুখে দিয়ে নে… তারপর শুয়ে পড়… অনেক ধকল গেছে তোর সারাদিন…”
আমি জিজ্ঞাসা করি, “তুমি রাতে কিছু খাবে না?”
উত্তরে মাথা নাড়ে বুড়ো… “নাহ! রে… ভালো লাগছে না… রঘুটার জন্য বড্ড মনটা ভার হয়ে আছে… গলা দিয়ে আজ আর কিছু নামবে না… তুই যা মা… জামা কাপড় বদলে কিছু মুখে দে… তোরও তো সেই আসার পর থেকে আর কিছুই জোটে নি খাওয়া দাওয়া…” বলে আর দাড়ায় না দাদু… সিঁড়ি দিয়ে ধীর পদক্ষেপে উঠে যায় উপরে… নিজের ঘরের দিকে…
আমি আরো খানিক অপেক্ষা করি… তারপর যখন বুঝি যে বাবারা বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে ততক্ষনে, আমি ফকিরকে ডাক দিই… ও এলে আমি বলি, “ভ্যানটা নিয়ে আয়… আমায় একটু স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসবি…”
শুনে অবাক হয়ে যায় ফকির… কি বলবে বোধহয় বুঝে উঠতে পারে না সে… এই এত রাতে আমি একা ফিরবো… এদিকে যে আমায় বারণ করবে, সে হিম্মতও ওর নেই… ব্যাজার মুখে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে খানিক… ওকে এই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া লাগাই… “কি রে? বললাম… কানে গেলো না? ভ্যানটা আনতে বললাম তো!”
“কিন্তু… তুই এতো রাতে…” আমতা আমতা করে সে…
“চিন্তা করিস না… এখন বেরোলে লাস্ট ট্রেনটা পেয়ে যাবো… ওটা আমাদের এখানে দশটা ছাপ্পান্নোয় আছে… আমি জানি…” নিজের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলি আমি…
“সে তো ঠিক আছি… কিন্তু কত্তা মশাই যদি জানতি পারে… তুই এতো রাতির বেলায় বেরোয়ছিস… তাইলে?” সভয়ে ফের প্রশ্ন করে ফকির…
আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলি, “দাদু এখন উপরে উঠে গেছে… আর রাতের মধ্যে নামবে না… কাল সকালে বলে দিস, আমি বেরিয়ে গিয়েছি রাতেই… আমার কাল একটা বিশেষ কাজ আছে কলেজে, তাই…”
তাও ওখানে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকায় ফকির… পা যেন কিছুতেই নাড়াতে পারে না সে… মন চায়না কিছুতেই ওই অত রাতে আমায় একলা ছেড়ে দিতে…
আমি এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখি… “ভাবিস না… আমার সাথে বাবার লুগারটা আছে… তাই আমার কিছু হবে না…” বলতে বলতে প্যান্টের পেছনের পকেটে গোঁজা লুগারটা বের করে দেখাই ওকে…
ওটা দেখে যেন কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয় ফকির… মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে যায় নিজের ভ্যান রিক্সাটা আনতে…
.
.
.
ট্রেন থেকে নামতেই দেখি প্ল্যাটফর্মের উপরেই ফকির আর কাজল অপেক্ষা করছে আমারই জন্য… ওদের চোখে মুখে একটা বিষন্নতার ছাপ ছেয়ে রয়েছে… আমায় দেখেই ফকির এগিয়ে আসে… আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলে, “দাদু মুকে পাঠায় দিলো… তুকে লিয়ে যেতি… চল্… ভ্যানটারে লিয়ে আসিছি…”
ছোট স্টেশন, একটু হেঁটেই বাইরে চলে এলাম আমরা… সামনের দিকে মুখ তুলে তাকাতে দেখি একটা ভ্যান রিক্সা দাঁড় করানো রয়েছে রাস্তার পাশে… এটা ফকিরেরই ভ্যান রিক্সা… দাদুই কিনে দিয়েছে ওকে… আগে ফকির জন খেটে বেড়াতো… আর সময় সুযোগে ওই সব বনে জঙ্গলে শিকার করতে যেত… একদিন দাদুর কাছে কষে ধমক খেয়েছিল, আর তারপর দাদু ওকে এটা কিনে দিয়ে বলেছিল, নিজের গতর খাটিয়ে নিজে রোজগার কর… ওই সব শিকার টিকার মাথা থেকে বাদ দে… দাদুর কথা অমান্য করে, বেলাডাঙায় কেউ জন্মায় নি… মাথা নিচু করে ফকিরও মেনে নিয়েছিল দাদুর কথা, আর তারপর থেকে জানি ও ভ্যানই চালায়… হয়তো কষ্টের কাজ ঠিকই, কিন্তু মাথা উঁচু করে বাঁচে সে এখন… কারুর কোন পরোয়া করার দরকার পড়ে না আর…
আমার ব্যাগটা নিয়ে ভ্যানের উপর রেখে ফিরে তাকায় আমার দিকে… “কোই রে… চল কেনে… উদিকে সক্কলে তোর তরে অপেক্ষা করছি তো…”
আমি ওর কথায় তাড়াতাড়ি পা চালাই… গিয়ে উঠে বসি ওর ভ্যান রিক্সায়… অন্য পাশে উঠে বসে কাজল… ফকির প্যাডেলে চাপ দেয়…
বাড়ি পৌছাতে খেয়াল করলাম পরিবেশ তখন যেন কেমন থমথমে হয়ে রয়েছে… চতুর্দিকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন চেপে বসে রয়েছে বাড়ির আবহাওয়ায়… আমি ইচ্ছা করেই, বাড়িতে ওঠার সিড়ির মুখে নিজের পায়ের জুতোটা খুলে ঢুকলাম… ভেতরে, বৈঠকখানাতেই শুইয়ে রাখা রয়েছে রঘুকাকাকে… পা থেকে বুক অবধি সাদা চাঁদরে ঢাকা… মুখটুকু বের করা… গলায় মালা দিয়ে দিয়েছে কেউ… চোখের পাতায় তুলসিপাতা বসানো… গলার কন্ঠিটা তখনও গলাতেই রয়েছে… ঘরে উপস্থিত সকলেই, বাপি, জ্যেঠু, পিমা, কাকা, জ্যেম্মা… কিন্তু কারুর মুখে কোন কথা নেই… মনে হলো আমার আমি যেন একটা প্রেত পুরীতে এসে ঢুকলাম… আমায় দেখে দাদু ধীর পায়ে এগিয়ে এলো… কাঁধে হাত রেখে নীচু স্বরে প্রশ্ন করলো, “রাস্তায় আসতে অসুবিধা হয় নি তো দিদিভাই?”
আমি মাথা নাড়ি, না বলি… তারপর দাদুর পাশ দিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাই শায়িত রঘুকাকার দিকে… পায়ের কাছে দাঁড়াই মাথা নীচু করে… চুপ করে তাকিয়ে দেখতে থাকি মানুষটাকে… যে মানুষটা আমাকে সেই ছোট্ট থেকে কোলে পীঠে করে বড় করে তুললো… যে মানুষটা সর্বদা আমায় রক্ষাকর্তার মত আগলে রাখতো… যে মানুষটা আমার এক পরম আত্মীয় ছিল… আমি ধীরে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ি রঘুকাকার পায়ের সামনে… তারপর মাথা নীচু করে ঠেঁকাই আমার মাথাটাকে রঘুকাকার পায়ের উপরে… বুকের মধ্যেটায় তখন যেন কি ভিষন তোলপাড় চলছে… কিন্তু কিছুতেই চোখের কোনে জল আসে না… কেমন যেন সব কিছু শুকিয়ে গিয়েছে রঘুকাকাকে এই ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে… আসলে কোনদিন তো দেখিনি আমি… রঘুকাকাকে শুয়ে থাকতে… কখনো শুনিনি, রঘুকাকার কোনদিন শরীর খারাপ হয়েছে বলে… শীত গ্রীষ্ণ বর্ষা… সব সময়ই যেন রঘুকাকা একেবারে ফিট… কখনও কোনদিন কোন ব্যধি রঘুকাকাকে স্পর্শ করতে পারে নি… কিন্তু সেই মানুষটা… এই ভাবে হটাৎ… আমি মুখ তুলে ফিরিয়ে তাকাই দাদুর দিকে… আমার চোখের প্রশ্ন বুঝে এগিয়ে আসে দাদু ফের… “হটাৎ করেই… কাল রাতে… অনেক রাতও হয়েছিল… কিছু করার সুযোগই দিল না… তাও তো আমি ছিলাম এখানে… কিন্তু থেকেও কোন লাভ হল না…” বলতে বলতে গলার স্বর কেঁপে যায় দাদুর… বুঝতে পারি… দীর্ঘদিনের সঙ্গী হারানোর বেদনাটা কেমন… মুখ তুলে তাকাই দাদুর দিকে… চোখের কোলে এক ফোঁটা জল চিকচিক করছে সেখানে…
জ্যেঠু এগিয়ে এসে আমার হাতে একটা মালা দিয়ে বলে, “যা তিতাস… এটা রঘুদাকে পরিয়ে দে…”
আমি মুখ ফিরিয়ে তাকাই জ্যেঠুর দিকে… অমন মানুষটার মুখটাও কেমন বিষন্ন… আমি জ্যেঠুর হাত থেকে মালা নিয়ে উঠে দাঁড়াই… তারপর ঘুরে রঘুকাকার পাশে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ি মেঝের উপরেই… যত্ন সহকারে মালাটা গলায় পরিয়ে দিই… ততক্ষনে রিগর মর্টিস ধরে যাওয়া মাথাটাকে অতি কষ্টে সামান্য তুলে গলিয়ে দিই মালাটাকে ঘাড়ের মধ্যে দিয়ে… তারপর সেটা যত্ন করে বুকের উপরে সাজিয়ে দিই টেনে দিয়ে… হাত তুলে রাখি বরফ শীতল হয়ে থাকা রঘুকাকার গালের উপরে… হাত বোলাই পরম মমতায়… আরও একজন খুব কাছের মানুষকে হারিয়ে ফেললাম আমি… বুকের মধ্যেটা মুচড়ে ওঠে আমার…
আমার মাথায় সস্নেহের হাত রেখে জ্যেঠু বলে ওঠে, “তিতু মা… এবার ওঠ… অনেকক্ষন এই ভাবে রঘুদাকে শুইয়ে রেখেছি… এবার আমাদের যেতে হবে…”
হ্যা… এটাই বাস্তব… মানুষটা আর নেই… তাই এখন শুধু শুধু দেরি করার কোন মানেই হয় না… জানি, আমার জন্যই এই এতক্ষন আটকে থাকতে হলো রঘুকাকাকে… না হলে অনেক আগেই সে মিলিয়ে যেত আনন্দলোকের পথে… একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াই আমি… একটু সরে দাঁড়াই পাশে… ফকিররা এগিয়ে আসে…
আমি ধরা গলায় পিমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করি, “তরু? তরুকে দেখছি না!”
পিমা কিছু বলার আগেই আমার কাঁধে একটা হাতের চাপ উপলব্ধি করে ঘুরে তাকাই পাশে… দেখি রঘুকাকার ছেলে তরুন এগিয়ে এসেছে আমার দিকে… আমি গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি… ওর বুকে মাথা রাখি… ও আমার মাথার চুলে হাত বোলায়… যেন ওর পিতৃবিয়োগ হয় নি… আমার হয়েছে… এমন ভাবে সস্নেহে শান্তনা দিতে থাকে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে…
খালের পাড়ে, পারলৌকিক কাজ মিটতে মিটতে প্রায় বেশ রাতই হয়ে গেলো… প্রায় নয়টা সাড়ে ন’টা তো হবেই… শহরে হয়তো ন’টা-টা কোন রাতই নয়, কিন্তু গ্রামে সেটা অনেকটাই… বাড়ি ফিরে সকলে যারা যারা শ্মশানে গিয়েছিল, সকলে আগুন হাত ছুঁয়ে টুকটাক লৌকিকতা সম্পন্ন করে নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফিরে যাবার তোড়জোড় করতে শুরু করে দিল… সেদিনই ফিরতে হবে সকলকে… কারন কলকাতার বাড়িতে প্রায় কেউই নেই… তাই ইচ্ছা থাকলেও কারুর থেকে যাওয়া সম্ভব নয়… দাদু যাবে না বলে দিল… রঘুকাকার বাকি কাজ শেষ করেই ফিরবে কলকাতা… জ্যেঠু, বাবা আর কাকা ফিরে আসবে, গাড়ি তো সাথে আছেই… আমায় ডেকে জ্যেঠু বলল, “তিতু মা… তুই নিশ্চয়ই ফিরে যাবি… তাহলে আমাদের সাথেই ফিরে চল… আমি তোকে তোর হোস্টেলে নামিয়ে দেবো…”
প্রথমটা আমি কোন উত্তর দিই না… চুপ করেই থাকি… দেখে দাদু এগিয়ে আসে, আমার মাথায় হাত রেখে বলে, “যা না মা, বাবাদের সাথেই ফিরে যা… আর জেদ করিস না…”
দাদুকে বলি আমি, “না… আমি এখন যাবো না… ওরা চলে যাক…”
পিমা এসে আমার হাতটা ধরে… শান্ত গলায় বলে, “দেখ তিতাস… এত জেদ ভালো নয়… যতই হোক… এই সময়টা অন্তত নিজের জেদটাকে একটু সরিয়ে রাখ সোনা…”
আমি মুখ তুলে তাকাই পিমার দিকে… চোখে চোখ রেখে ধীর গলায় বলি, “কি পেয়েছ তুমি? এই ভাবে সব কিছু মেনে নিয়ে? তাতে তুমি কি ভালো আছো?”
পিমা কেমন অবাক চোখে তাকায় আমার দিকে… বোধহয় ভাবতেও পারেনি আমার কাছ থেকে এই রকম একটা প্রশ্ন ছুটে আসতে পারে বলে… সকলের সামনে যেন ভিষন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে পিমা… ঝটিতে একবার নিজের বাবামশায়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে চাপা গলায় আমায় বলে ওঠে, “ওরে, চুপ কর… এই সব কথা সবার সামনে বলতে নেই…”
সবার সামনে নিজের মনটা পিমা কোনদিনই খুলে মেলে ধরতে পারে নি… তাই নিজের ভালোবাসাও হারিয়ে ফেলেছে ওই জেদটা দেখাতে না পেরে… কিন্তু আমি তো পিমা নই… আমি, আমিই… যেটা ঠিক বলে ভেবেছি, সেটাই মেনে থাকবো… সেখান থেকে আমায় টলানো সহজ ব্যাপার নয়… আমার মন যেটা বলে, সেটাই আমি শুনি… তাতে যদি পৃথিবীর আবর্তন থেমেও যায়, তাতেও আমার কিছু করার নেই… আমি পিমার মত করেই গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে বলি, “না পিমা… আমি জানি, তুমি মেনে নিয়েছ সব কিছু নিজের জীবনের সমস্ত সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে… মেনে নিয়ে তুমি আজ নিঃস্ব… কিন্তু আমি সেটা হতে দেবো না… যখন আমি স্থির করেই ফেলেছি, ওই বাড়ির সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখবো না, মানে রাখব নাই… আমায় প্লিজ… এই ভাবে বোল না বারেবার…”
কখন আমার পেছনে বাপি এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করিনি… চমকে পেছন ফিরে তাকাই কাঁধের উপরে হাতের স্পর্শে… মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি বাপি… চোখ ভর্তি এক রাশ ভালোবাসা… দেখে সত্যি বলতে আমার মনটা ভিষন হু হু করে উঠল যেন… আমি মুখ কিছু না বলে বাপিকে জড়িয়ে ধরে মুখটা গুঁজে দিই বাপির বুকের মধ্যে… আমার মাথায় হাত রাখে বাপি… মাথার চুলের মধ্যে একটা চুমু খেয়ে বলে, “ভালো আছিস তিতাস মা… শরীর ঠিক আছে তো?”
আমি উত্তর দিতে পারি না… গলাটা কেমন বুজে আসে একটা চাপা কান্নায়… দুই হাতে আরো জোরে আঁকড়ে ধরি বাপিকে… মাথা নাড়ি বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখে…
“কাল সকালে যাবি?” ফের জিজ্ঞাসা করে বাপি…
এবারেও উত্তরে শুধু মাথা নেড়ে হ্যা বলি… চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারি না মুখ দিয়ে…
“সাবধানে ফিরিস… আর বেরোবার সময় খেয়ে নিস কিছু… কেমন!” পিতৃস্নেহ মাখা কন্ঠে বলে ওঠে বাপি… উত্তরে ফের মাথা নাড়ি আমি… আরো ঘন করে জড়িয়ে ধরি বাপির শরীরটাকে… সেই ছোটবেলার মত…
দেরি সত্যিই হয়ে যাচ্ছিল… দাদুই তাড়া দেয়… তাই আর সবাই সময় না নষ্ট করে গাড়িতে উঠে চুপচাপ বেরিয়ে যায় দাদুর সাথে টুকটাক কিছু কথা বলে… দাদুও আর কথা বাড়ায় না আমার যাওয়া নিয়ে… ওরা বেরিয়ে যেতে আমায় বলে, “দিদিভাই, আমি উপরে গেলাম… তুই গিয়ে কিছু মুখে দিয়ে নে… তারপর শুয়ে পড়… অনেক ধকল গেছে তোর সারাদিন…”
আমি জিজ্ঞাসা করি, “তুমি রাতে কিছু খাবে না?”
উত্তরে মাথা নাড়ে বুড়ো… “নাহ! রে… ভালো লাগছে না… রঘুটার জন্য বড্ড মনটা ভার হয়ে আছে… গলা দিয়ে আজ আর কিছু নামবে না… তুই যা মা… জামা কাপড় বদলে কিছু মুখে দে… তোরও তো সেই আসার পর থেকে আর কিছুই জোটে নি খাওয়া দাওয়া…” বলে আর দাড়ায় না দাদু… সিঁড়ি দিয়ে ধীর পদক্ষেপে উঠে যায় উপরে… নিজের ঘরের দিকে…
আমি আরো খানিক অপেক্ষা করি… তারপর যখন বুঝি যে বাবারা বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে ততক্ষনে, আমি ফকিরকে ডাক দিই… ও এলে আমি বলি, “ভ্যানটা নিয়ে আয়… আমায় একটু স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসবি…”
শুনে অবাক হয়ে যায় ফকির… কি বলবে বোধহয় বুঝে উঠতে পারে না সে… এই এত রাতে আমি একা ফিরবো… এদিকে যে আমায় বারণ করবে, সে হিম্মতও ওর নেই… ব্যাজার মুখে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে খানিক… ওকে এই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া লাগাই… “কি রে? বললাম… কানে গেলো না? ভ্যানটা আনতে বললাম তো!”
“কিন্তু… তুই এতো রাতে…” আমতা আমতা করে সে…
“চিন্তা করিস না… এখন বেরোলে লাস্ট ট্রেনটা পেয়ে যাবো… ওটা আমাদের এখানে দশটা ছাপ্পান্নোয় আছে… আমি জানি…” নিজের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলি আমি…
“সে তো ঠিক আছি… কিন্তু কত্তা মশাই যদি জানতি পারে… তুই এতো রাতির বেলায় বেরোয়ছিস… তাইলে?” সভয়ে ফের প্রশ্ন করে ফকির…
আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলি, “দাদু এখন উপরে উঠে গেছে… আর রাতের মধ্যে নামবে না… কাল সকালে বলে দিস, আমি বেরিয়ে গিয়েছি রাতেই… আমার কাল একটা বিশেষ কাজ আছে কলেজে, তাই…”
তাও ওখানে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকায় ফকির… পা যেন কিছুতেই নাড়াতে পারে না সে… মন চায়না কিছুতেই ওই অত রাতে আমায় একলা ছেড়ে দিতে…
আমি এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখি… “ভাবিস না… আমার সাথে বাবার লুগারটা আছে… তাই আমার কিছু হবে না…” বলতে বলতে প্যান্টের পেছনের পকেটে গোঁজা লুগারটা বের করে দেখাই ওকে…
ওটা দেখে যেন কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয় ফকির… মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে যায় নিজের ভ্যান রিক্সাটা আনতে…
.
.
.