11-04-2022, 03:59 PM
৩০
মুঝসে পাঙ্গা মাৎ লেনা
পাতা ওল্টায় পর্ণা… গুঁজে রাখা বুক মার্ক বের করে নিয়ে…
১২ই ফেব্রুয়ারি… মঙ্গলবার
আজকে লিখছি ঠিকই, কিন্তু ঘটনাটা কিছুদিন আগের ঘটে যাওয়া… সময়াভাবে আর লিখে উঠতে পারি নি… এখন একটু হাতে সময় পেয়েছি, তাই ডায়রিটা খুলে বসলাম… যাক… শুরু করি…
সেদিন ভোরে সবে মাত্র ঘুমটা ভেঙেছে… তখনও ব্রাশও করে উঠতে পারিনি… দেখি নন্দ, মানে আমাদের হোস্টেলের সেই ছেলেটি… এসে হাজির…
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে দাঁত বের করে দিল…
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি রে? হটাৎ করে এই ভোরবেলা উদয় হলি?”
আমার প্রশ্নে মাথা চুলকে বলল, “দিদি, নিচে তোমার ফোন এয়েচে…”
এই অসময় ফোন? ফোন ব্যাপারটা ভোরে আর রাতে এলেই কেমন বুকের মধ্যেটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে যেন… তাও আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কে ফোন করেছে?”
মাথা নাড়ায় আমার প্রশ্নে নন্দ… “তা আমি কি করে বলবো? আমায় তোমায় খবর দিতে বলল, তাই এলাম… তা চলো, নিচে চলো…” বলে আর দাঁড়ায় না সে… যেমন হুট করে এসেছিল, তেমনই চলে গেলো সে…
ততক্ষনে সুচরীতা আর সুজাতাও উঠে পড়েছে নন্দর গলা পেয়ে… ওরা বিছানার উপরেই উঠে বসে আমায় বলে, “যা না… দেখ গিয়ে… কারুর কোন বিপদ আপদ হলো কি না বাড়িতে… এই ভাবে এমন ভোরবেলা আবার ফোন আসবেই বা কেন!”
ওদের কথায় মাথা নাড়ি আমি… ভাঁজ পড়ে কপালে… সত্যিই তো… এত ভোরে… ভাবতে ভাবতে হাত বাড়িয়ে হাউস কোটটাকে পরণের ম্যাক্সির উপরে জড়িয়ে নিলাম… তারপর মাথার চুলগুলো একটা হাত খোঁপায় বেঁধে নিয়ে সিড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে গেলাম নিচে, অফিস ঘরের দিকে…
রিসিভার তুলে কানে দিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে শুনি দাদুর গলা… “তিতাস মা?”
দাদুর গলা বেশ ধরা মনে হলো আমার… তাতে দুশ্চিন্তা যেন আরো বেড়ে গেলো… “কি হয়েছে দাদু? তোমার গলাটা এমন কেন লাগছে? বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো?” প্রবল দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে প্রশ্ন করি আমি…
“হ্যা রে মা, বাড়ির সবাই ঠিকই আছে… শুধু…” বলতে বলতে থেমে যায় বৃদ্ধ… বুঝতে পারি গলা বুজে আসে ওনার…
“কি হয়েছে দাদু… বলো…” আমি নিজের গলাটাকে যথা সম্ভব ঠান্ডা রেখে প্রশ্ন করি…
“রঘুটা চলে গেলো… বুঝলি মা…” ধরা গলার উত্তর আসে ফোনের মধ্যে থেকে…
“চলে গেলো? মানে?” আমার ঠিক বোধগম্য হয় না দাদুর কথায়…
“চলে গেলো মানে চলেই গেলো… অনেক চেষ্টা করলাম আমরা ওকে ধরে রাখার… কিন্তু হলো না রে… অনেকদিন সাথে ছিল তো!...” বলে ওঠে দাদু…
এবার আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না দাদুর কথার মানে… শুনে আমার গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে ওঠে যেন… রঘুকাকা… সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখছি মানুষটাকে… দাদুর ছায়াসঙ্গি বলা চলে তাকে… কত স্মৃতি সাথে সাথে ভীড় করে আসে আমার চোখের সামনে… নিষ্পাপ মুখটা ভেসে ওঠে মনের মধ্যে… চোখে জল চলে আসে আমার… অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে জিজ্ঞাসা করি… “কখন?”
“এই তো… গতকাল… মাঝরাতে… এখানে, গ্রামের বাড়িতেই…” থেমে থেমে উত্তর দেয় দাদু… তারপর একটু থেমে বলে, “দিদিভাই! তুই আসবি একবার? বেলাডাঙায়? তোকে যে বড্ড ভালোবাসতো রঘুটা…”
“হ্যা হ্যা দাদু… নিশ্চয়ই আসবো… আসছি আমি… এখনই তৈরী হয়ে বেরোচ্ছি… তুমি চিন্তা করো না… আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌছে যাবো…” ব্যগ্র স্বরে বলে উঠি আমি… রিসিভারটাকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে, নিজেকে সামলে রেখে…
“আমি সূর্যকে বলে দিচ্ছি, তোর জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিতে…” ওপাশ থেকে বলে ওঠে দাদু…
ওই মুহুর্তেও আমার ভেতরের অহংবোধ মাথা তুলে দাঁড়ায়… আমি দৃঢ় স্বরে বলি, “না দাদু… তার দরকার হবে না… আমি এখুনি বেরিয়ে ট্রেন ধরে নিচ্ছি…” তারপর একটু থেমে বলি, “তুমি ভেবো না, আমি ঠিক পৌছে যাবো…”
দাদু আমার গলার স্বরে কি বোঝে জানি না, খানিক চুপ করে থেকে বলে ওঠে, “বেশ… দেখ কি করবি… তুই না আসা অবধি আমরা অপেক্ষা করবো…” বলে ফোনটা কেটে দেয় ওপাশ থেকে… আমি হাতে রিসিভারটা নিয়েই ধপ করে বসে পড়ি পাশের চেয়ারটাতে… কানে আসে ফোনের মধ্যে থেমে লাইন টেনে যাওয়ার কোঁ কোঁ আওয়াজ… কিন্তু সে আওয়াজ আমার কানে পৌছায় না তখন… মনের মধ্যে তখন ভীড় করে আসা রঘুকাকার স্মৃতিগুলো যেন ছায়া মেলে ধরেছে… আমার ছোটবেলা… রঘুকাকার ঘাড়ের উপরে চেপে ঘুরে বেড়ানো… আমার হাজার দৌরাত্ম দাদুর কাছে কি ভাবে রঘুকাকা আড়াল করে আমায় প্রশ্রয় দিত… মনে পড়ে যায় একদিন, তখন কতই বা বয়স আমার… এই ছয় কি সাত… হটাৎ করেই বায়না ধরেছিলাম এখুনি আমায় মেলায় নিয়ে যেতে হবে বলে… সেবার আমাদের পাশের গ্রামে একটা কিসের মেলা বসেছিল, কিন্তু সেদিনকেই দাদুরা সবাই মিলে কলকাতা চলে আসার কথা… আমার প্রস্তাব এক কথায় নাকচ করে দিয়েছিল মামনি… কিন্তু আমার জেদ… যখন মাথায় ঢুকেছে মেলায় যাবো, তো যাবোই… শেষে রঘুকাকা এগিয়ে আসে… আমায় কোলে তুলে নিয়ে মামনিকে বলে, “বৌরানি… তোমরা তো বিকালের দিকে যাবে… আমি বড়কুমারীকে চট করে মেলা দেখিয়েই নিয়ে চলে আসবো… তুমি কিচ্ছুটি ভেবো না…” রঘুকাকার মুখের উপরে কেউ কখনও কথা বলে নি কোনদিন, সে আমাদের বাড়ির পরিচারক বলে কখন তাকে কেউ ভাবত না… তাই রঘুকাকা যখন বলেছে, তখন মামনির আর কথা যে বলা চলে না সেটা জানে… আমিও নাচতে শুরু করে দিলাম তাতে… রঘুকাকার পীঠে চেপে চললাম মেলায়…
তারপর আর একদিন, সেদিন ফকিরদের সাথে গড়ের জঙ্গলের মধ্যে খেলার সময় কি করে যেন গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম… বোধহয় হাত ফসকেই হবে… গোড়ালি থেকে পা মচকে সে এক কান্ড… সাথে সাথে গোড়ালি ফুলে ঢোল… কাজল আর ফকির, দুজনে মিলে অনেক কষ্টে আমায় নিয়ে এসে হাজির বাড়িতে… বাবা দেখেই তো দেখি চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে… আমিও মনে মনে প্রমোদ গুনছি… আমায় ছেড়ে দিয়ে ফকির আর কাজল দিল দে ছুট… আমি বাড়ির বাইরের দালানে চুপ করে বসে… মাথা নিচু করে… জানি এবার আসতে চলেছে আমার উপর দিয়ে ঝড়… দাদুও সে দিন নেই বাড়িতে, যে এসে আমায় আড়াল করবে বাপির বকুনি থেকে… আর সেই সময়ই কোথা থেকে রক্ষাকর্তার ভূমিকা এসে হাজির রঘুকাকা… বাপি কিছু বলার আগেই দেখি হাতে চুন হলুদ নিয়ে এসে হাজির সে… কি করে খবর পেয়েছিল কে জানে… তাড়াতাড়ি আমার পায়ের কাছে বসে যত্ন নিয়ে পায়ের গোড়ালিতে চুন হলুদ লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল… বাপি কি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই প্রায় ধমকে উঠল বাবাকে, “দেখছ না, বড়কুমারীর পা ফুলে গিয়েছে… এখন কিছু বলার দরকার নেই তোমার… আমি দেখছি ব্যাপারটা…” অগত্যা বাবার প্রস্থান… আমার মুখে এক গাল হাসি…
নাহ!... খবরটা শোনার পর আমার মুখে আর হাসি ছিল না… চেয়ারের উপরে থম মেরে বসেছিলাম চুপ করে… চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল উষ্ণ অশ্রুধারা… কাঁদছিলাম আমি… নিঃশব্দে… এক সজন হারার বেদনায়…
শুধু আমার জন্যই রঘুকাকা এই ভাবে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা নয়… আমি জানি, শুনেছিলাম কার মুখ থেকে যেন… এখন ঠিক খেয়াল পড়ছে না… আমার পিমা… মানে আমার পিসিমা, রত্নকান্তা… তাকে প্রায় নিজের মেয়ের মত স্নেহ করতো রঘুকাকা… তাকেও এই ভাবেই আগলে রাখতো দাদুর ক্রোধ থেকে বরাবর… পিমা আর সেই ছেলেটি, ফায়েদ্… ওর সাথে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যা নিয়ে আমাদের পরিবারে একটা সময় তুমুল অশান্তির ঝড় বয়ে গিয়েছিল বলে শুনেছি… শুধু অশান্তিই বা বলি কেন… হটাৎ করে তো ফায়েদ্ কেমন যেন উধাওই হয়ে গেলো একেবারে… যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো ছেলেটি… সেই তখন, এই রঘুকাকাই দাদুকে লুকিয়ে খুঁজেছিল অনেক করে ছেলেটিকে… পরে নাকি পেয়েওছিল খোঁজ, কিন্তু বলতে পারে নি নাকি পিমাকে সেটা… বলেই বা কি করতো… তখন দাদুরও রক্ত গরম… এখনের মত এত ঠান্ডা হয়ে যায় নি দাদুর প্রতাপ… পিমা জানতে পারলেও তার কিছুই করার ছিল না সেই সময়… হয়তো এখন কার দিন হলে বেরিয়ে আসতো বাড়ি থেকে… নিজের ভালোবাসার মানুষটার জন্য… কিন্তু সেই সময় পিমার পক্ষে সম্ভব ছিল না নিশ্চয়… বা হয়তো আমার মত এতটা জেদী… এতটা বেপরোয়া ছিল না বলেই… চুপ করে মেনে নিয়েছিল নিজের ভবিতব্য… বুক চাপা দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল নিজের ভালোবাসাটাকে…
কখন পেছনে নন্দ এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি… ও পাশে এগিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে ওঠে, “দিদি… তুমি কাঁদছ?”
ওর কথায় সম্বিত ফেরে আমার… তাড়াতাড়ি হাতের উল্টো পীঠ দিয়ে চোখ মুছে তাকাই ওর দিকে… “না রে… ওই আর কি!...”
নন্দ যেন ভাবতেও পারে না, ওর ডাক্তার দিদি কাঁদতে পারে বলে… এগিয়ে এসে আমার কাঁধের উপরে হাত রেখে বলে, “কি হয়েছে দিদি? ফোনে কোন খারাপ খবর পেয়েছ?”
ওর গলার স্বরে তখন যেন আপনজনের উৎকন্ঠা… ওর এহেন উৎকন্ঠায় ভেতরটা যেন আরো হুহু করে ওঠে… আমি ঘুরে ওর গালের উপরে হাত রেখে বলি, “হ্যা রে… আমার খুব কাছের একজন চলে গেছে… তাই মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছে…”
“চলে গিয়েছে? কোথায়?” অবাক চোখে প্রশ্ন করে নন্দ…
ওর প্রশ্নে ওই কষ্টের মধ্যেও আমি ম্লান হেসে ফেলি… বলি, “এ যাওয়া সে যাওয়া নয়… এ একেবারে চলে যাওয়া…”
কি বুঝলো জানি না আমার কথায়… মাথা নাড়ে বিজ্ঞের মত… “ভেবো না দিদি… সব ঠিক হয় যাবে…”
… সব ঠিক হয়ে যাবে… কথাটা কতই না সহজে বলে ফেলল কিশোর নন্দ… হয়তো জানেও না, সজন হারানোর বেদনাটা… বা এখনও সে মানসিকতাই আসে নি সজন হারিয়ে গেলে কতটা নাড়া দিয়ে যায় মনের মধ্যেটায়…
.
.
.