04-04-2022, 02:12 PM
![[Image: 275560705_chapter-29.png]](https://img70.pixhost.to/images/61/275560705_chapter-29.png)
২৯
ডন সে মুলাকাৎ
সেদিনই ডায়রিটা রাতে নিয়ে বসেছিল পর্ণা, তারপর কি ভেবে আবার রেখে দিয়েছিল আলমারির মধ্যে… নাহ! এক সাথে এ ডায়রি পড়া সম্ভব নয় ভেবে বোধহয়… তারপর আর সময় বের করতে পারে নি সে, বেশ কিছু দিন, দৈনন্দিন কাজে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, যে আর পড়া হয় নি তার… তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় হপ্তাহ খানেক… শেষে এক রবিবারের দুপুর দেখে খাওয়া দাওয়ার শেষে নিশ্চিন্তে ডায়রি খুলে বসে সে আবার… পাতা ওল্টায় যত্ন সহকারে… তারপর শেষ পড়া পাতায় পৌছে একবার মুখ ফিরিয়ে দেখে নেয় পাশেই ঘুমন্ত স্বামী সন্তানের দিকে… ওদের ঘুমাতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ডুব দেয় ডায়রির পাতায় সে… সেই মার্চএর পর অনেকদিনের বা বলা যেতে পারে বেশ অনেক মাসের ব্যবধান লেখার… হয়তো সময় পায় নি কিছু লেখার, বা এমনও হতে পারে, সেই রকম কোন ঘটনা ঘটেনি চন্দ্রকান্তা জীবনে এই ক’টা মাসের ব্যবধানে, তাই লেখেনি সে আর… ভাবতে ভাবতে আটকে যায় পর্ণার চোখ পরের পৃষ্ঠায়…
.
.
.
২১শে ডিসেম্বর, বুধবার
গতপরশু একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে গেলো আমার জীবনে… এটা কি বলবো, বা কি ভাবে এর ব্যাখা দেওয়া উচিত জানি না… তাই এখন লিখে রাখছি… যদি ভুলে যাই পরে… অবস্য এ ঘটনা সহজে ভোলার নয় যদিও…
হ্যা… গত পরশু পড়িয়ে ফিরছিলাম যখন, তখন মোটামুটি প্রায় সাড়ে নয়টা দশটা হবে… শীতের রাত, বেশ ফাঁকাই হয়ে এসেছে এদিকটা ততক্ষনে… দিনের বেলা এখানে যতটা ব্যস্তময়তার ছাপ থাকে, সন্ধের পর থেকে ধীরে ধীরে কোলকাতা বদলাতে থাকে কি দ্রুততায়… তখন এই সব অঞ্চল অনেকটাই ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আসে, যতটা না ধর্মতলার দিকটা হয়… ও দিকে রাত বাড়লে যেন মানুষের উপস্থিতি আরো বেশি করে দেখা যায়, কিন্তু আমাদের এই হোস্টেলের আশপাশটা মোটামুটি ন’টার পর থেকেই বেশ সুনসান হয়ে আসে… তার উপরে সেদিন হুট করে কোথা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সন্ধ্যে থেকে… প্রথমটা বেশ ঝমঝমিয়ে হলেও, আমার ফেরার সময়ে অতটা বৃষ্টির বেগ না থাকলেও, টিপটিপ করে পড়েই যাচ্ছিল সমানে… শীতকালের বৃষ্টি, আর তাই বোধহয় আরো বেশি করে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল পুরো রাস্তাঘাট… প্রায় সুনসান, জনমানব শূণ্যই বলা চলে… হয়তো আরো একটু আগেই ফিরতে পারতাম, কিন্তু বাসের অপেক্ষায় অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলার ফলে দেরীটা আরো হয়ে গিয়েছিল আমার… শেষে বাসের অপেক্ষায় আর না দাঁড়িয়ে হাঁটা লাগিয়ে দিয়েছিলাম…
তবে আমার এসব ফাঁকা টাকা কোন ব্যাপার মনে হয় না… আমি এখন যথেষ্টই অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি এই সব রাস্তায় রাত দুপুরে ফিরতে ফিরতে… এখানকার গলিঘুঁজি এখন আমার প্রায় নখদর্পনে বলা যেতে পারে… বরং শর্টকাটে ফিরলেই অনেকটা পথ চলা বাঁচে আমার কাছে… তাই একটু জোরে পা চালাচ্ছিলাম একটা গলির মধ্যে দিয়ে… বড় রাস্তাটাকে বাঁ দিকে ফেলে রেখে… মাথার মধ্যে তখন একটাই চিন্তা, হোস্টেলে একটু তাড়াতাড়ি না ফিরতে পারলে খেতে পাবো না রাতে, কারন তার দিন কয়েক আগেই আমার দুই রুমমেট, সুজাতা আর সুচরিতা, দুজনেই বাড়ি ফিরে গিয়েছে, তাই কেউ আমার জন্য খাবার তুলে রাখবে না আর…
বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছি, গলি পথে কয়েকটা ল্যাম্প পোস্টে বাতি রয়েছে, আবার কয়েকটা কোন অদৃশ্য কারণে অনুপস্থিত, যার ফলে কিছুটা রাস্তা আলোকিত থাকলেও, বেশ কিছুটা যথেষ্ট অন্ধকারচ্ছন্ন… পথ চেনা না হলে ঠোক্কর খাওয়া থেকে কেউ বাঁচাবে না… রাস্তাও তেমনই… কোথাও খানা, কোথাও খন্দ, দিনের আলো ছাড়া আর পথ চেনা না থাকলে বোঝা খুবই দুষ্কর…
গলির মাঝামাঝি পৌছাতেই একটা আওয়াজ কানে এলো… ফটাস্… এটাতো গুলির আওয়াজ! বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার… আর সেটাও খুবই কাছ থেকে… আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম… সামনেই গলিটা একটা বাঁক নিয়ে ডানদিকে ঘুরে গিয়েছে… ওই দিকটা যথেষ্টই অন্ধকার… অন্ধকার অবস্য আমিও যেখানটায় দাঁড়িয়ে পড়েছি, সেখানটাতেও… মাঝে শুধু একটা ল্যাম্পপোস্টের আলো টিমটিম করে জ্বলছে… তা সে না জ্বলার মত করেই… কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলাম আমি… আওয়াজটা কোথা থেকে এলো সেটারই একটা হদিস লাগাবার চেষ্টায়…
‘ফটাস্…” আবার একটা গুলির শব্দ হলো… এবার বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার, শব্দটা ঠিক পাশের গলি থেকেই এসেছে বলে… আর গুলির শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই একটা চাপা আর্তনাদ… কোন পুরুষ কন্ঠের…
আমি একবার চট করে পেছন ফিরে তাকালাম… অনেকটা পথ চলে এসেছি ততক্ষনে… এখন ফেরা সম্ভব নয় কোন মতেই… আর সামনে এগুবো, সেটাও যে সমীচিন হবে না, সেটা বুঝতে ভুল হয় না… কারন গলিটা বাঁক খেয়ে যেদিকে ঘুরেছে, আমার কান আর মন বলছে গুলির শব্দটা ওদিক থেকেই এসেছে…
আমি চট্ করে নিজের কাঁধে ঝোলানো সাইড ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলাম… সেবারে বেলাডাঙা থেকে ওই নরেশ সাহার সাথে মুখোমুখি হবার পর ফেরার সময় সাথে করে বাবার লুগারটা নিয়েই এসেছিলাম সবার অলক্ষ্যে… সেটা প্রায় সব সময়ই আমার সাথে, ব্যাগের মধ্যে রেখে দিই… কারন এই সময়টা কলকাতার রাস্তা ঘাট বিশেষ নিরাপদ নয় জানি… আর যখন সেবারে গিয়ে ওটা হাতে পেয়েই গেলাম, তাহলে শুধু শুধু ওটাকে ড্রয়ার বন্দী করে ফেলে রেখে আসতে মন চায় নি…
ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে চেপে ধরলাম লুগারটাকে… তারপর দ্রুত পায়ে সামনের বাতি না জ্বলা ল্যাম্পপোস্টের দিকে দৌড় দিলাম যতটা পারা যায় পা টিপে টিপে… সেখানে পৌছে অন্ধকারের মধ্যে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লাম পাশের বাড়ির দেওয়ালে গা সাঁটিয়ে দিয়ে… নিজেকে দৃষ্টির আড়ালে রেখে… ভাগ্যক্রমে সেই দিন একটা গাঢ় নীল রঙের কামিজ আর কালো সালোয়ার পরেছিলাম পরণে, তাই ওই আধো অন্ধকারের মধ্যে প্রায় অদৃশ্যই হয়ে রইলাম বলতে গেলে… তাকিয়ে রইলাম সামনের গলির বাঁকের দিকে… প্রচন্ড উৎকন্ঠায় বুকের মধ্যে তখন হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে যেন আমার… ঢিপঢিপ শব্দটা এতটাই জোরে হচ্ছে, যে মনে হচ্ছে সেটা এসে আমার কানের পর্দায় আঘাত হানছে বারে বার… ভিতু আমি নই মোটেই… কিন্তু এখন একলা এই পরিস্থিতিতে শুধু শুধু সাহস দেখিয়ে মরার ইচ্ছা আমার মোটেই নেই… কারন জানি আজকাল চতুর্দিকে পরিস্থিতি অনেকটাই অশান্ত… রাত বাড়লেই চাপা একটা আতঙ্ক যেন চেপে বসে শহরের প্রাণচঞ্চল মনষ্কের উপরে… আমি যতটা পারি নিজেকে গুড়ি মেরে নিচু রেখে বসে রইলাম ওখানে… একটা যে কিছু ঘটতে চলেছে, সেটা যেন আমার ভেতরের কেউ বার বার জানান দিচ্ছিল…
খুব বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হল না আমায়… দেখি গলির মুখের বাঁক থেকে একজন দীর্ঘদেহী পুরুষের আবির্ভাব ঘটল… কিন্তু সেটা স্বাভাবিক নয় মোটেই… প্রায় ফুট ছয়েকের বেশিই হবে উচ্চতা মানুষটার… তেমনিই স্বাস্থবান যে, সেটা প্রায় মিটার পঞ্চাশেক দূর থেকে বসে ওই আলো আঁধারির মধ্যেও বুঝতে ভুল হয় না আমার… কোন রকমে একটা পা টেনে হিঁচড়ে রাস্তার উপরে ঘষটাতে ঘষটাতে দেওয়াল ধরে কোন রকমে বেরিয়ে এলো এই দিক পানে… বুঝতে অসুবিধা হয় না যে লোকটা কিছু বা কারুর থেকে পালাতে চাইছে… কিন্তু নিজের পায়ের কোন চোট বা আঘাতের দরুন সেই অক্ষমতায় তার দ্রুত পলায়ণে বাধা সৃষ্টি করেছে… আর লোকটার পেছনে যেন মনে হয় আমার কিছু পায়ের দৌড়ে আসার আওয়াজ… দেখতে না পেলেও বুঝতে পারি তারা এই লোকটাকেই নিশ্চয়ই ধাওয়া করে এগিয়ে আসছে এই দিকেই…
লোকটা বেরিয়ে আসার বোধহয় কয়েক সেকেন্ড, নাকি মিনিট খানেক… কে জানে… সেটা খেয়াল করি নি ওই অবস্থায়… তবে প্রায় সাথে সাথেই ওর পেছন পেছন আরো দুটো ছেলের আবির্ভাব ঘটল গলির বাঁক থেকে… এতক্ষন তার মানে এরাই দৌড়চ্ছিল… সামনে লোকটিকে দেখে থেমে গেলো তারা… বন্ধ করে দিলো তাদের দৌড়… এখন যেন চোখের সামনে শিকারকে দেখে বোধহয় আর দৌড়বার দরকার বোধ করে না… অতি ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে লাগলো আহত লোকটাকে অনুসরণ করে… ওদের হাঁটার ধরণই বলে দেয় যেন তারা তাদের শিকার পেয়ে গিয়েছে… এখন তাদের হাত থেকে লোকটার পালিয়ে যাবার কোন উপায় নেই… এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা… কাজ শেষ করার… আমি দম বন্ধ করে চুপ করে বসে দেখতে থাকি ওদের দিকে চোখ রেখে… এই মুহুর্তে আমার কি করণিয় সেটাই বুঝে উঠতে পারি না… হাতের মুঠোয় চেপে ধরি লুগারটাকে… হাত ঘামে ওই শীতের ঠান্ডা আবহাওয়ের মধ্যেও… উবু হয়ে বসে থাকা সত্তেও আমার পাদুটো যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে কোন এক অজানা উৎকন্ঠায়…
আমি ভালো করে দেখার চেষ্টা করি প্রথমে আহত লোকটিকে… তারপর ছেলে দুটিকে…
লোকটার বয়স বেশ অনেকটাই… ওই আধো অন্ধকারেও যা মনে হলো, প্রায় পঞ্চান্ন ষাট তো হবেই… আগেই বলেছি, দীর্ঘ দেহী… চেহারাও যথেষ্ট পেশিবহুল… পরণের সাদা পায়জামা পাঞ্জাবীতেও বাহু বা হাতের কব্জি দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট শক্তিধর… কিন্তু এখন বেক্ষাপায় পড়ে আহত বাঘের মত অবস্থা তার… সেই তুলনায় ছেলেদুটি বেশ ল্যাকপ্যাকে… ওই বিশাল দেহী মানুষটা কেন ছেলেদুটিকে ভয় পাচ্ছে, সেটাই বোধগম্য হলো না আমার… চাইলে তো ধরে প্রায় ছুঁড়েই ফেলে দিতে পারে মানুষটা ছেলেদুটিকে অবলিলায়… তাহলে? আমি চোখ সরু করে আরো ভালো করে চেষ্টা করি দেখার… আর তখনই চোখে পড়ে আমার… রাস্তার ওই টিমটিমে আলোতেও ছেলেদুটির হাতে চকচক করে ওঠে যেটা, সেটা আর কিছুই নয়… রিভলভার… নিশ্চয়ই দেশিই হবে, তবে বেশ চকচকে… তারমানে তাদের হাতের দুটোই সচল… জং পড়া মাল নয়…
এবার পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই যেন… কেন লোকটা এতটা ভীত, আর ওই পাতলা চেহারার ছেলেদুটির এত বীরত্ব কোথায়… হাতে আগ্নেয়স্ত্র থাকলে তো নিজেকে বীরপুঙ্গব মনে হবেই… আর তার মানে এটাও বুঝতে পারি যে এই লোকটা একেবারেই নিরস্ত্র… তাই দীর্ঘদেহী হওয়া সত্তেও ওদের ভয়ে ভীতপ্রায়…
আমি লোকটার পায়ের দিকে তাকাই একবার… যে ভাবে লোকটা পা টেনে টেনে চলার চেষ্টা করছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে ইতিমধ্যেই গুলি খেয়েছে সে… হয়তো পায়েতেই… আর তাই সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতাটাও এখন আর নেই… কোন রকমে চাইছে ছেলেদুটির নাগাল থেকে নিজেকে বাঁচাবার… আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না, আমি এখানে বসে একটা মার্ডারের শাক্ষী হতে চলেছি… একটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার, এটা পুরো আন্ডার ওয়ার্লডের কেস… সামান্য রাগ বচসার ব্যাপার নয়… কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না তখন কিছুতেই… জানি, আমার উপস্থিতি যদি এতটুকুও বুঝতে পারে ছেলেদুটি, তাহলে আমারও নিস্তার নেই… কোন শাক্ষী ওরা রাখবে না… আমাকেও শেষ করে দেবে ওই লোকটার সাথে… আমার তখন যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভয় লাগছে… যদি ওরা নিঃশ্বাসএর আওয়াজও শুনতে পায়? যদিও জানি আমার হাতে লুগারটা রয়েছে, কিন্তু ওরা প্রফেশনাল কিলার… হয়তো আমার নিজেকে প্রস্তুত করার আগেই ওরা কাজ সেরে ফেলবে…
আমার ভাবনার মধ্যেই আহত লোকটা ততক্ষনে আরো খানিকটা এগিয়ে এসেছে আমারই দিকে… আমার সামনের জ্বলা ল্যাম্প পোস্টার ঠিক নীচে… ওই ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়েছে লোকটার মুখের উপরে… মুখে কাঁচা পাকা দাড়ি… বেশ ফর্সা রঙ গায়ের… আর যেটা আমার চোখে পড়ে, সেটা হলো লোকটার মুখটা… ওই আলোআঁধারির মধ্যেই দেখে কেমন যেন অদ্ভুত লাগল আমার… একটা প্রচন্ড সাহসী মানুষ, কিন্তু সেই মুহুর্তে অবস্থার পরিস্থিতিতে একটা প্রচন্ড আতঙ্ক যেন সারা মুখটায় ছেয়ে রয়েছে… অথচ সে আতঙ্কের মধ্যেও যেন মনের ভিতরের দৃঢ়তা প্রকাশ পাচ্ছে মৃত্যুর পূর্বমুহুর্ততে দাঁড়িয়েও… হয়তো এটা আমার মনের ভুলই হবে, বা ওই পরিস্থিতিতে তখন সেটাই আমার মনে হচ্ছিল, কিন্তু তখন সেই মুহুর্তে যেন আমার মনে হয় লোকটা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের লোক হলেও, মনে মনে নিশ্চয় খুব সাচ্চা আদমী… কেন মনে হলো, সেটা বলতে পারবো না সঠিক ব্যাখ্যা করে, কিন্তু আমার মন যেন সেটাই বলে উঠল… আর সেটা ভাবতেই আমার ভেতরে যেন একটা কেমন ঝটকা লাগলো… না!... আগে তো কখনও দেখি নি এই মানুষটাকে… চিনিও না একে… সত্যিই মানুষটা কেমন, কোন ধারনাই নেই আমার… কিন্তু… কিন্তু তাও… এই ভাবে চোখের সামনে মানুষটাকে মরতে দেখতে পারবো না আমি… একে মরতে দেওয়া যাবে না… এর নিশ্চয়ই একটা সাচ্চা দিকও আছে… অন্তত একবার চেষ্টা করে দেখবোই… যা থাকে কপালে…
আমার ভাবার মধ্যেই ততক্ষনে লোকটা আর এগোতে পারে নি… হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছে রাস্তার উপরে… আর ছেলেদুটিও এসে ঘিরে ধরেছে তাকে… দুই পাশ থেকে… হাতের বন্দুক উঠে এসেছে লোকটার দিকে তাক করে… মানে আর কয়েক মুহুর্ত… তারপরেই লোকটার ভবলিলা সাঙ্গ করে দেবে দুই জনে দুই পাশ থেকে… ঝাঁঝড়া করে ফেলে রেখে যাবে বডিটাকে রাস্তার মধ্যে…
আমার ভিতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল… ‘তিতাস… কিছু একটা কর… এই ভাবে মানুষটাকে শেষ হয়ে দিতে দিস না…” আমি শক্ত করে লুগারটাকে চেপে ধরে ওখানে বসেই তুলে তাক করি আমার দিকে ডান পাশে থাকা ছেলেটির হাতের দিকে… মোটামুটি ওই আমার কাছে রয়েছে… অন্য ছেলেটি অপর দিকে দাঁড়িয়ে… নিজের বুদ্ধি বলছে, আমি যদি গুলি চালাই, তাহলে প্রথমে ওরা নিশ্চয় একটু হলেও হকচকিয়ে যাবেই… কারন ওদের মাথাতেই নেই যে এই ভাবে অন্য কেউ ওদের দিকে গুলি চালাতে পারে বলে… আর গুলি চললে একটু সময় নেবেই আমায় খুঁজে বের করার… আর তার মধ্যেই আমায় কাজ সারতে হবে… ওই সময়টুকুর মধ্যেই আমায় অপর ছেলেটিকে উড়িয়ে দিতে হবে…
দম বন্ধ করে দিলাম চালিয়ে… তাক করে রাখা ছেলেটার কাঁধে লাগলো গুলিটা… আর্তনাদ করে উঠল যন্ত্রনায়… ওর হাত থেকে বন্দুকটা ছিটকে পড়ল পাশের নর্দমায়… অন্য হাতে নিজের কাঁধ চেপে ধরে শুয়ে পড়েছে রাস্তার উপরেই… আমার বাঁ দিকের ছেলেটাও তখন চমকে উঠেছে… সে চেষ্টা করে দেখার কোথা থেকে গুলিটা এলো বলে, তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে অদৃশ্য আততায়ীকে খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলো… কিন্তু তার পক্ষে ওই অন্ধকারের মধ্যে আমায় খুঁজে পাওয়া সেই মুহুর্তে সম্ভব হল না, আর আমিও সেই সুযোগটাই কাজে লাগালাম ফের… ওই দ্বিতীয় ছেলেটির কাঁধ লক্ষ্য করে আবার ফায়ার করলাম… অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ… তার হাত থেকেও ছিটকে পড়লো বন্দুকটা মাটির উপরে… সেও দেখি হাত দিয়ে নিজের কাঁধটা চেপে ধরেছে নিমেশে… ভয় ওদের চোখে মুখে স্পষ্ট… শিকার করতে এসে নিজেরা শিকার হয়ে যাবে, সেটা বোধহয় ভাবতে পারে নি ওরা… আর তাতেই যেন আতঙ্ক চেপে বসে ওদের মধ্যে… নিশ্চয়ই ভেবেছে যে ওই লোকটার কোন সঙ্গি সাথীরাই গুলি চালাচ্ছে বলে… তারা ক’জন সেটা বুঝতে পারে না কিছুতেই… আর সেটা না বুঝেই যেন আরো ভয়ে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়ে… তখন তারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত… মারতে এসে নিজেরা না মরে ভেবে…
ততক্ষনে আমার ভেতরের ভয় দ্বিধা যেন কর্পুরের মত উবে গিয়েছে… আমি চট করে নিজের ওড়নাটাকে খুলে জড়িয়ে নিলাম আমার মুখের চারপাশে… শুধু মাত্র চোখদুটোকে ফাঁক করে খুলে রাখলাম… এমন ভাবে জড়ালাম, যাতে আমায় ওরা কোন ভাবেই না চিনতে পারে, এখন অথবা পরেও… কারন এই ধরণের আন্ডার ওয়ার্ল্ডএর লোকজনকে কোন বিশ্বাস করা উচিত নয়… এরা সাপের থেকেও ভয়ঙ্কর… এখন যদি ফিরে যায় বেঁচে, ঠিক আবার খুঁজে বের করে নেবে আমায়… ওদের কাজে বাধা দেওয়ার ফল স্বরূপ আমায় খুন করতেও দুবার ভাববে না… আর সেটা বুঝেছি বলেই নিজেকে যতটা সম্ভব আড়াল করার চেষ্টায় ভালো করে ওড়নাটাকে জড়িয়ে নিলাম আমার মুখের চারপাশে…
এরপর আমি নিজের লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে এলাম আসতে আসতে… এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ওদের সামনে… দুজন মাটিতে শুয়ে… আর একজন উবু হয়ে বসে… তিন জনেই আহত… কারুরই নড়ার ক্ষমতা নেই সেই মুহুর্তে… আমি লুগারটাকে তুলে তাক করে রাখলাম ওদের দিকে…
ওদের মুখ দেখে তখন আমারই হাসি পাচ্ছে… একেবারে ভড়কে গেছে আমায় দেখে… বোধহয় ভেবেছিল কোন লোক বা ছেলে হবে… কিন্তু একটা মেয়ে, তাও বন্দুক হাতে ওদের দিকে তাক করে এসে দাঁড়িয়েছে… তিনজনেই যেন ভ্যাবলার মত তাকিয়ে রইল আমার দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে…
আমি আহত লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম হাতের লুগারের নলটাকে ওদের দিকে তাক করে রেখে… আমার হাতের ভর দিয়ে কোন রকমে উঠে দাঁড়ালো লোকটা… তখনও যেন ওর চোখ থেকে বিস্ময় যাচ্ছে না… আমি যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে ওই ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বললাম… “এই… কেটে পড় এখান থেকে… না হলে এবার আর হাতে নয়, একেবারে মাথায় গুলি চালাবো…”
একটা ছেলের পায়ের কাছেই পড়ে ছিল ওর বন্দুকটা, আমার নজর এড়িয়ে আস্তে করে চেষ্টা করছিল ওটা তোলার, তাতে আমি দেখেই খ্যাঁক করে উঠলাম প্রায়… “উহু… একদম না… ওটা ভুলেও চেষ্টা করতে যেও না… তাহলে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না তোমায়…”
আমার শাসানিতে হাত গুটিয়ে নিল ছেলেটা… তারপর মুখ তুলে তাকালো তার সাথীর দিকে… দুজনেই বুঝেছে যে এখন তাদের আর কিছুই করার নেই… কিছু করতে গেলে শুধু শুধু আরো গুলি খাবে… তাই আর নিজের বন্দুক তোলার চেষ্টায় না গিয়ে দুজনেই কোন রকমে উঠে দাঁড়ালো সোজা হয়ে… হাত দিয়ে নিজেদের কাঁধ চেপে ধরে… সেই মুহুর্তে ওদের শরীরের যা অবস্থা, তাতে নতুন করে কিছু করার কথা আপাতত ওদের মাথায় নেই যে, সেটা ওদের মুখ দেখেই বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার… আমি বন্দুকের নল উঁচিয়ে ইশারা করলাম ফের ওদের দিকে, কেটে পরার জন্য… ওরাও আর সময় ব্যয় না করে নিজেদের ক্ষত হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখে কোন রকমে মারলো দৌড়… গলির বাঁক ঘুরে মিলিয়ে গেলো ওদের শরীর দুটো… আমি তাও বেশ খানিকক্ষন ওখানে দাঁড়িয়েই গলির বাঁকের দিকে বন্দুক তাক করে রইলাম… কিন্তু পায়ের শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে আসতে বুঝতে অসুবিধা হল না, ওরা এখন যেহেতু সম্পূর্ন নিরস্ত্র, তাই সত্যি সত্যিই নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গিয়েছে…
আমি লোকটাকে দেওয়াল ধরে দাঁড় করিয়ে রেখে আগে খুঁজে খুঁজে ছেলেগুলোর বন্দুক দুটো জোগাড় করে নিজের ব্যাগে ভরে নিলাম… তারপর ভালো করে তাকালাম তার দিকে…
লম্বা মানে বেশই লম্বা… অন্তত ছয়ের উপরে হাইট তো হবেই… তার থেকে আরো খানিকটা বেশি হলেও অবাক হব না… সেই সাথে লোকটার সাস্থও দেখার মত… চওড়া কাঁধ… বলিষ্ঠ বাহু… চওড়া বুকের ছাতি… যদিও সেই মুহুর্তে নিজের আঘাতে যথেষ্টই নুহ্য সে… অবাঙালী যে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না… পরনের সাদা পাঞ্জাবীটা ধূলোয় আর রক্তে একেবারে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে… পাজামাটাও রক্তে ভরে গিয়েছে… পা খালি… সম্ভবত দৌড়ে পালাবার সময়ই পায়ের জুতো খুলে পড়ে গিয়েছে কোথাও… যন্ত্রনা ক্লিষ্ট মুখটার দিকে তাকিয়ে নীচু স্বরে প্রশ্ন করলাম, “আপনি একটু হেঁটে যেতে পারবেন তো?” তাকে প্রশ্ন করার ফাঁকেই মুখের উপর থেকে জড়ানো ওড়নাটাকে খুলে নিলাম… তারপর আরো একবার চলে যাওয়া ছেলেগুলোর পথের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিয়ে নিজের ওড়নাটা থেকে খানিকটা কাপড় ছিঁড়ে নিয়ে রাস্তায় ঝুঁকে বসে পড়ে একটা শক্ত বাঁধন দিয়ে দিলাম লোকটার আহত পায়ের উপরে, যাতে আপাতত ওই মুহুর্তে রক্তপাতটাকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় বলে…
আমার প্রশ্নে বার দুয়েক মাথা নাড়ায় সে উপর নীচে করে… তারপর অতিকষ্টে বলে ওঠে, “বেটি… আপ যো মেরে পর কুসুর কিয়া, উও মেয় কাভি ভুলুঙ্গা নেহি…”
লোকটার এই সময়েও ওই ধরণের কথায় হেসে ফেললাম আমি… ঠিকই ধরেছি… কে… জানি না ঠিকই, তবে এটা বুঝতে যে ভুল করিনি, লোকটা যেই হোক, ভেতরে একটা সাচ্চা দিলও আছে…
“না না… আপনি এখন এসব কি বলছেন!... আমি তো জাস্ট আপনাকে একটু বাঁচাবার চেষ্টাটুকুই করেছি…” ম্লান হেসে উত্তর দিই…
“নেহি বেটি নেহি… উয়ো লোগ ইতনি আসানিসে মুঝে ছোড়তে নেহি, আগর তুম বিচ মে নেহি আই জাতি তো… বহুত সুক্রিয়া বেটি… আল্লাহ তুঝে বহুত দুয়া দেগা…” অতি কষ্টে টেনে টেনে ফের বলে ওঠে লোকটা…
আমার কাছেও পরিষ্কার হয়ে যায়, লোকটা .… কিন্তু নিশ্চয় কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারেরই… কিন্তু সেই সাথে এটাও মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়… তবে ওরা কেন লোকটাকে মারতে চেয়েছিল?
ওখানে দাঁড়িয়ে তখন সেই উত্তর খোঁজা বৃথা, সেটা বুঝতে পারি… তাই লোকটার কাঁধের উপরে চাপ দিই হাত দিয়ে আলতো করে… “আপনি আমার সাথে আসুন… ওই বড় রাস্তা অবধি যেতে পারবেন তো?”
“জানে তো পড়েগাই মুঝে… ইয়াহ রাহেগা তো উয়ো লোগ ফিরসে ওয়াপাস আয়েগা মুঝে মারনে কে লিয়ে… আভি ডরসে মারে ভাগ গ্যায়ে, লেকিন ফির ওয়াপাস আয়েগাহি… ওউর, ইসবার যাদা আদমী লেকে আয়েগা…” অনেক কষ্টে কথা গুলো বলে উঠল সে… তারপর আমার কাঁধের উপরে একটা হাতের ভর রেখে একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, “চল, বেটি চল… মুঝে ওউর থোড়া রেহেম কর দে… বাকি ম্যায় সামাল লুংগা…”