02-04-2022, 07:19 AM
বাতানুকূল যন্ত্র
---------------------------------
- শোন , আর তো পারা যাচ্ছে না । এবার একটা এসি না কিনলে গরমে এই ঘুপচি ফ্ল্যাটে আমি থাকব না বলে দিলাম ।
গিন্নী এক মগ চা মাথার কাছের টেবিলে রেখে প্রথম অস্ত্র নিক্ষেপ করল । সারা রাত গরমে হাঁসফাঁস করে ভোরের দিকে একটু ঘুমের আমেজ আসে । গিন্নীর কথায় আমেজের বারোটা বেজে গেল । এখুনি নিজেকে বাঁচাতে হবে । বললাম
- এসি পোষার খরচ জানো ?
- তোমার মত হাড়কিপটের কাছে খরচ টা বেশি বলেই মনে হবে । কিন্তু আমরা আর থাকতে পারছি না । পাড়ায় সব বাড়িতে এসি আছে । কেবল তুমি ব্যতিক্রম । যত খরচই হোক এবার এসি লাগাতেই হবে বলে দিলাম ।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে দুম দুম করে পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল । বুঝলাম যুদ্ধ শুরুর আগেই পরাজিত হয়ে বসে আছি ।
সবে ঘুম থেকে উঠেছি । সকালে এই এক মগ চা আর কাগজের হেডলাইনে রাজনীতির খবর পেটে গেলে তবেই পাকস্থলী ঠিকঠাক কাজ করে । না হলে সারাদিনের অস্বস্তি । হবে হবে অথচ হচ্ছে না । সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার । আজ বোধহয় আর হল না ।
জোগীরাজ থেকে গুরুজন – সবাই বলেন এই ব্রাহ্ম মুহূর্ত দিনের সবচেয়ে দামী সময় । এই সময়ে একটু যোগাসন , নিদেনপক্ষে প্রাণায়াম বা ভাল মন্ত্র কিছুক্ষণ শুনলে চিত্ত শান্ত হয় । বাজারে মাছ ওয়ালা বেশি দাম চাইলে রাগের বদলে ক্ষমার প্রবণতা বেশি করে প্রকাশ পায় । নিজের অক্ষমতা কে ‘ যা ছেড়ে দিলাম ’ জাতীয় স্তোকবাক্যে ভুলিয়ে রাখা যায় । কিন্তু আমার মত ছাপোষা মধ্যবিত্তের সে সুযোগ নেই ।
সকালে উঠে গান চালানো শুরু করেছিলাম । দ্বিতীয় দিন চোখ বুজে লো ভল্যুমে ভজন শুনছি “প্রভু জী তুম চন্দন হাম.......” ফট করে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল ।
- কি শুরু করলে বল তো ? পাশের বাড়ির মেয়েটার মাধ্যমিক , সে খেয়াল আছে ?
যা ব্বাবা ! তেমন জোরে তো শুনছিলাম না ? আসলে ওর যা পছন্দ নয় তা এ বাড়িতে চলবে না । কম্যুনিস্ট বাড়ির মেয়ে । ইন্টার ন্যাশনাল বাজালে হয়ত আপত্তি করত না ।
গরম আমারও পছন্দের কাল নয় । বিশেষত: ঘাম আর ঘামাচির জ্বালায় আমি অস্থির হয়ে উঠি । কিন্তু তাই বলে এসি ? আগেও এ নিয়ে আমাদের মধ্যে রসালাপ হয়েছে । একবার তো সুর চড়ে যাওয়ায় পাড়ার অমল কাকু জানলা দিয়ে ডেকেই ফেলেছিলেন
- কি বৌমা ? কি নিয়ে হচ্ছে ? মিষ্টি হেসে আমার বৌয়ের উত্তর
- দেখুন না কাকাবাবু , আমাদের বাড়িতে এসি নেই বলে ও জামাইষষ্ঠীতে যাবে না বলছে ।
মেয়েরা যে কখন কাকে কেস খাইয়ে দেয় তার ঠিক নেই । কাকা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন
- এ সব কি শুনছি হে ? তোমার কাছ থেকে এমন কথা আশা করি নি ।
কান এঁটো করা হাসি হেসে সেবার রেহাই পেয়েছিলাম । কিন্তু গিন্নীর হাত থেকে এত সহজে আমার নিষ্কৃতি নেই । পরের দিন কলেজ থেকে ফিরে কোলে একটা কাগজ মোড়া বস্তু ফেলে দিল
- নাও মুরোদ যখন নেই তখন এটা দিয়ে কাজ চালাও । কাগজের মোড়ক খুলে দেখি অ্যালুমিনিয়ামের হ্যান্ডেল দেওয়া একটা প্লাস্টিকের হাত । শুধু একবার বলেছিলাম
- ও গো , পিঠে একটু পাউডার লাগিয়ে দেবে ?
তার প্রত্যুত্তরে এটা ! রাগের চোটে জিনিসটা নিয়ে পিঠে একটু জোরে ঘসতেই ছাল চামড়া উঠে গেল । প্লাস্টিকের আঙুলে প্রেম নেই কি করে বুঝব ? তবে আমিও কম যাই না । পরের দিনই মেঝেতে ঘসে ঘসে আঙুলগুলোকে ভোঁতা করে নিলাম । এখন অনেকটা বৌয়ের হাতের এফেক্ট আসে ।
যাক এসব পারিবারিক দুঃখের কথা । গিন্নীর মাথায় যখন ঢুকেছে তখন এসি কিনতেই হবে । এখন চৈত্র সেল চলছে । খবরের কাগজে প্রথম সোয়া দু পাতা জুড়ে শুধুই বিজ্ঞাপন । কোন কাগজ বোঝাই যায় না । একটা লম্বা পৌনে এক পাতা দিয়ে শুরু । এই কায়দাটা নতুন । প্রথম যেদিন দিয়েছিল সেদিন ভেবেছিলাম কি রে বাবা ! ছেঁড়া কাগজ দিয়ে গেল ? তারপর বুঝলাম ওটাই কায়দা । যারা খবর পড়তে ভালবাসেন তারা জানেন ঐ লম্বা কাগজের ফালিটাকে ম্যানেজ করা কত কঠিন ।
বিজ্ঞাপনে নানা রকম এসি দেওয়া আছে । আমার মত আকাটের পক্ষে কোন টা ভাল বোঝা নিতান্তই অসম্ভব । পাঁচজন কে জিজ্ঞাসা করে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল । এ বলে এটা ভাল তো ও বলে ধুর ! কারো কথা শুনিস না , ওটাই সবথেকে ভাল । আজকাল টিভি দেখে হাফ বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠেছি । ঠিক করলাম যেটা সবথেকে দামি সেটাই কিনব । মাসিক কিস্তির সুবিধে আছে , কোন চিন্তা নেই । এই একটা ব্যাপার মধ্যবিত্তকে বাঁচিয়ে রেখেছে । আজ যদি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একসঙ্গে বাকি ফেরৎ দিতে বলে তা হলে অধিকাংশ বাঙালির ফ্ল্যাট টিভি ফ্রিজ এসি সব চলে যাবে ।
কিন্তু এসি কিনতে হলে আগে বাড়ির মিটারের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ইলেকট্রিক অফিসে আবেদন করতে হবে । অন লাইনে আবেদনের সুবিধে আছে । কিন্তু অসুবিধেটা আমার । কম্পিউটার মুখে নিয়ে জন্মাই নি । ছেলে মেয়ে অবশ্য অভ্যস্ত কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ থামিয়ে বাবাকে সাহায্য করবে তেমন ফুরসৎ কই ? অগত্যা পাড়ার ইলেক্ট্রিশিয়ান গদাই কে ধরলাম ।
- তোমার লোড কত ?
প্রথম প্রশ্নেই মেজাজ খিচড়ে গেল । আমার লোড সম্পর্কে তোর ধারণা কি রে ছোকরা ? ছেলের সেমিস্টারের খরচ , গলদঘর্ম হয়ে অফিস থেকে ফিরে মেয়েকে টিউশনে নিয়ে যাওয়া , মার জন্য বাজার থেকে ফুল ছাড়া শুধু বেলপাতা নিয়ে আসা , সারা অঞ্চল খুঁজে তোর বৌদির কেক বানানোর জন্য স্ট্রবেরি সেন্ট কেনা , অফিসে প্রতিনিয়ত ইউনিয়ন কি প্যাঁচে ফেলবে সে চিন্তায় কাঁটা হয়ে থাকা - আমার লোড স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নিতে পারবেন কি না বলা শক্ত ।
- ইলেকট্রিকের বিল টা দিও । ওটাতে লোড লেখা আছে । তার সঙ্গে ভোটার কার্ড এর এক কপি জেরক্স আর তোমার একটা পাসপোর্ট সাইজের ফটো ।
নাও , হয়ে গেল ! ফটো তোলাতে হবে । বিকেলে সুমিতের দোকানে গিয়ে বললাম
- একটা ফটো তুলে দে ।
- কি হল আবার ? কোথায় দরখাস্ত করছ ?
এই ফটোওয়ালাদের সব খবর জানতেই হবে । একে তো এসির খরচ এবং মাসে মাসে কত বিল আসবে তাই ভেবে আধমরা হয়ে আছি , তার মধ্যে এই কৌতূহল । মেজাজ বিগড়ে গেল । হেসে বললাম
- চাকরির চেষ্টা করছি , বিয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দেব , হারিয়ে গেলে তোর বৌদি কাগজে হারানো প্রাপ্তিতে দেবে – এর কোনটাই বিশ্বাস না হলে ধরে নে মারা গেলে বছরে একবার এই ফটো ছাপিয়ে নিচে লেখা হবে “তোমার মৃত্যুতে আমরা কষ্টে আছি । বাড়ির আজেবাজে কাজগুলো করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না ” ।
- তুমি একেবারে যা তা ! দাঁড়াও বৌদিকে বলে দেব ।
- যা যা! বল গে যা । আমি তোর বৌদিকে ভয় পাই নাকি ? মুখে বললেও মনে ভয় রয়ে গেল । এসব ইয়ার্কি ও একদম পছন্দ করে না ।
সপ্তাহ খানেক পরে একদিন দুপুরবেলা ইলেকট্রিক অফিস থেকে জনা চারেক লোক এসে উপস্থিত । গদাই আগে থেকে বলে রাখায় অফিস যাই নি । নতুন মিটার লাগাতে লাগাতে একজন বলল
- আপনার ওয়্যারিং এর অবস্থা তো খুব খারাপ । এসির জন্য আলাদা করে তার টানতে হবে । না হলে আগুন লেগে যেতে পারে । জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছিল কোথায় ? এসি তে না বাড়িতে ? কিন্তু পাশেই গিন্নী দাঁড়িয়ে আছে । স্মার্টলি বলল
- আপনারা আপগ্রেড করে দিয়ে যান । বাকি টা গদাই করে দেবে ।
- উঁ ! গদাই করে দেবে ! আর টাকাটা কে দেবে ? আমি মনে মনে বলি । এক এসি আমার সংসার খরচের ডিঙির তলা ফুটো করে দিয়ে চলে গেল ।
এরপর এসি কেনার পালা । ক্লাস ফাইভের জ্ঞান নিয়ে গেছি উচ্চমাধ্যমিকের এনট্রান্স দিতে । প্রথম প্রশ্নেই সব গুলিয়ে গেল
- দাদা ক টন ?
- ঠিক বলতে পারব না , তবে এমন একটা দেবেন যেন একজনই খুলে নামাতে পারে । আমি ভবিষ্যতের খরচের কথা ভেবেই বলি । বৌ কনুইয়ে একটা রাম চিমটি কাটল, তারপর সেলস ম্যান ছেলেটাকে মিষ্টি করে বলল
- ভাই , বারো বাই চোদ্দ ঘরে কত লাগবে ? সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র । ছেলেটা আমাকে পাত্তা না দিয়ে বৌদিকে নিয়ে পড়ল ।
- দেড় টন হলেই হয়ে যাবে । কপার না অ্যালুমিনিয়াম ? আমি ফেকলু পার্টির মত দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি কপার সস্তা না অ্যালুমিনিয়াম । ভাগ্যিস ছেলে মেয়ে সঙ্গে আসে নি ! বাবার বোকামি তে ওরা প্রেস্টিজে পড়ে যেত । অবশেষে ম্যানেজার গোছের এক ভদ্রলোক আমার অবস্থা দেখে এগিয়ে এসে জলের মত এসির ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন । আমিও সাদা কাগজের মত সব বুঝে গেলাম ।
এক শুভ দিনে ছোট হাতিতে করে এসি এলো । তার দিন তিনেক পর কোম্পানি থেকে লোক এসে ফিট করে দিয়ে গেল । আমি গামছা পরে ইয়াব্বড় থার্মোকোল আর প্যাকিং বাক্সটা লফটে ঢোকালাম । ওটা নাকি মেয়ের প্রজেক্টের কাজে লাগবে ।
এখন আমার রাতের ঘুম গেছে । ওরা নিশিন্তে ঘুমোয় আর আমি এসি বন্ধ করব বলে জেগে বসে থাকি । রিমোট দিয়ে টাইমার লাগিয়ে নাকি বন্ধ করা যায় কিন্তু ঘুম চোখে কি টিপতে কি টিপব তার ঠিক নেই । তাই ও সব গণ্ডগোলে না গিয়ে পাতি বাংলা পদ্ধতিতে ঘড়ি ধরে মাঝরাতে রোজ সুইচ অফ করে ফ্যান চালিয়ে দিই । আপনারা হয়ত ভাবছেন রাত জেগে জেগে আমার হার্টের অসুখ হবে । না , সে চিন্তা নেই । কত টাকা সাশ্রয় করতে পারলাম ভেবে আমি রাত জাগার সার্থকতা খুঁজে পাই । তবে কোনদিন যদি নিজে ঘুমিয়ে পড়ি – এই টেনশনে সুগারটা সামান্য বেড়েছে ।
---------------------------------
- শোন , আর তো পারা যাচ্ছে না । এবার একটা এসি না কিনলে গরমে এই ঘুপচি ফ্ল্যাটে আমি থাকব না বলে দিলাম ।
গিন্নী এক মগ চা মাথার কাছের টেবিলে রেখে প্রথম অস্ত্র নিক্ষেপ করল । সারা রাত গরমে হাঁসফাঁস করে ভোরের দিকে একটু ঘুমের আমেজ আসে । গিন্নীর কথায় আমেজের বারোটা বেজে গেল । এখুনি নিজেকে বাঁচাতে হবে । বললাম
- এসি পোষার খরচ জানো ?
- তোমার মত হাড়কিপটের কাছে খরচ টা বেশি বলেই মনে হবে । কিন্তু আমরা আর থাকতে পারছি না । পাড়ায় সব বাড়িতে এসি আছে । কেবল তুমি ব্যতিক্রম । যত খরচই হোক এবার এসি লাগাতেই হবে বলে দিলাম ।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে দুম দুম করে পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল । বুঝলাম যুদ্ধ শুরুর আগেই পরাজিত হয়ে বসে আছি ।
সবে ঘুম থেকে উঠেছি । সকালে এই এক মগ চা আর কাগজের হেডলাইনে রাজনীতির খবর পেটে গেলে তবেই পাকস্থলী ঠিকঠাক কাজ করে । না হলে সারাদিনের অস্বস্তি । হবে হবে অথচ হচ্ছে না । সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার । আজ বোধহয় আর হল না ।
জোগীরাজ থেকে গুরুজন – সবাই বলেন এই ব্রাহ্ম মুহূর্ত দিনের সবচেয়ে দামী সময় । এই সময়ে একটু যোগাসন , নিদেনপক্ষে প্রাণায়াম বা ভাল মন্ত্র কিছুক্ষণ শুনলে চিত্ত শান্ত হয় । বাজারে মাছ ওয়ালা বেশি দাম চাইলে রাগের বদলে ক্ষমার প্রবণতা বেশি করে প্রকাশ পায় । নিজের অক্ষমতা কে ‘ যা ছেড়ে দিলাম ’ জাতীয় স্তোকবাক্যে ভুলিয়ে রাখা যায় । কিন্তু আমার মত ছাপোষা মধ্যবিত্তের সে সুযোগ নেই ।
সকালে উঠে গান চালানো শুরু করেছিলাম । দ্বিতীয় দিন চোখ বুজে লো ভল্যুমে ভজন শুনছি “প্রভু জী তুম চন্দন হাম.......” ফট করে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল ।
- কি শুরু করলে বল তো ? পাশের বাড়ির মেয়েটার মাধ্যমিক , সে খেয়াল আছে ?
যা ব্বাবা ! তেমন জোরে তো শুনছিলাম না ? আসলে ওর যা পছন্দ নয় তা এ বাড়িতে চলবে না । কম্যুনিস্ট বাড়ির মেয়ে । ইন্টার ন্যাশনাল বাজালে হয়ত আপত্তি করত না ।
গরম আমারও পছন্দের কাল নয় । বিশেষত: ঘাম আর ঘামাচির জ্বালায় আমি অস্থির হয়ে উঠি । কিন্তু তাই বলে এসি ? আগেও এ নিয়ে আমাদের মধ্যে রসালাপ হয়েছে । একবার তো সুর চড়ে যাওয়ায় পাড়ার অমল কাকু জানলা দিয়ে ডেকেই ফেলেছিলেন
- কি বৌমা ? কি নিয়ে হচ্ছে ? মিষ্টি হেসে আমার বৌয়ের উত্তর
- দেখুন না কাকাবাবু , আমাদের বাড়িতে এসি নেই বলে ও জামাইষষ্ঠীতে যাবে না বলছে ।
মেয়েরা যে কখন কাকে কেস খাইয়ে দেয় তার ঠিক নেই । কাকা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন
- এ সব কি শুনছি হে ? তোমার কাছ থেকে এমন কথা আশা করি নি ।
কান এঁটো করা হাসি হেসে সেবার রেহাই পেয়েছিলাম । কিন্তু গিন্নীর হাত থেকে এত সহজে আমার নিষ্কৃতি নেই । পরের দিন কলেজ থেকে ফিরে কোলে একটা কাগজ মোড়া বস্তু ফেলে দিল
- নাও মুরোদ যখন নেই তখন এটা দিয়ে কাজ চালাও । কাগজের মোড়ক খুলে দেখি অ্যালুমিনিয়ামের হ্যান্ডেল দেওয়া একটা প্লাস্টিকের হাত । শুধু একবার বলেছিলাম
- ও গো , পিঠে একটু পাউডার লাগিয়ে দেবে ?
তার প্রত্যুত্তরে এটা ! রাগের চোটে জিনিসটা নিয়ে পিঠে একটু জোরে ঘসতেই ছাল চামড়া উঠে গেল । প্লাস্টিকের আঙুলে প্রেম নেই কি করে বুঝব ? তবে আমিও কম যাই না । পরের দিনই মেঝেতে ঘসে ঘসে আঙুলগুলোকে ভোঁতা করে নিলাম । এখন অনেকটা বৌয়ের হাতের এফেক্ট আসে ।
যাক এসব পারিবারিক দুঃখের কথা । গিন্নীর মাথায় যখন ঢুকেছে তখন এসি কিনতেই হবে । এখন চৈত্র সেল চলছে । খবরের কাগজে প্রথম সোয়া দু পাতা জুড়ে শুধুই বিজ্ঞাপন । কোন কাগজ বোঝাই যায় না । একটা লম্বা পৌনে এক পাতা দিয়ে শুরু । এই কায়দাটা নতুন । প্রথম যেদিন দিয়েছিল সেদিন ভেবেছিলাম কি রে বাবা ! ছেঁড়া কাগজ দিয়ে গেল ? তারপর বুঝলাম ওটাই কায়দা । যারা খবর পড়তে ভালবাসেন তারা জানেন ঐ লম্বা কাগজের ফালিটাকে ম্যানেজ করা কত কঠিন ।
বিজ্ঞাপনে নানা রকম এসি দেওয়া আছে । আমার মত আকাটের পক্ষে কোন টা ভাল বোঝা নিতান্তই অসম্ভব । পাঁচজন কে জিজ্ঞাসা করে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল । এ বলে এটা ভাল তো ও বলে ধুর ! কারো কথা শুনিস না , ওটাই সবথেকে ভাল । আজকাল টিভি দেখে হাফ বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠেছি । ঠিক করলাম যেটা সবথেকে দামি সেটাই কিনব । মাসিক কিস্তির সুবিধে আছে , কোন চিন্তা নেই । এই একটা ব্যাপার মধ্যবিত্তকে বাঁচিয়ে রেখেছে । আজ যদি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একসঙ্গে বাকি ফেরৎ দিতে বলে তা হলে অধিকাংশ বাঙালির ফ্ল্যাট টিভি ফ্রিজ এসি সব চলে যাবে ।
কিন্তু এসি কিনতে হলে আগে বাড়ির মিটারের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ইলেকট্রিক অফিসে আবেদন করতে হবে । অন লাইনে আবেদনের সুবিধে আছে । কিন্তু অসুবিধেটা আমার । কম্পিউটার মুখে নিয়ে জন্মাই নি । ছেলে মেয়ে অবশ্য অভ্যস্ত কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ থামিয়ে বাবাকে সাহায্য করবে তেমন ফুরসৎ কই ? অগত্যা পাড়ার ইলেক্ট্রিশিয়ান গদাই কে ধরলাম ।
- তোমার লোড কত ?
প্রথম প্রশ্নেই মেজাজ খিচড়ে গেল । আমার লোড সম্পর্কে তোর ধারণা কি রে ছোকরা ? ছেলের সেমিস্টারের খরচ , গলদঘর্ম হয়ে অফিস থেকে ফিরে মেয়েকে টিউশনে নিয়ে যাওয়া , মার জন্য বাজার থেকে ফুল ছাড়া শুধু বেলপাতা নিয়ে আসা , সারা অঞ্চল খুঁজে তোর বৌদির কেক বানানোর জন্য স্ট্রবেরি সেন্ট কেনা , অফিসে প্রতিনিয়ত ইউনিয়ন কি প্যাঁচে ফেলবে সে চিন্তায় কাঁটা হয়ে থাকা - আমার লোড স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নিতে পারবেন কি না বলা শক্ত ।
- ইলেকট্রিকের বিল টা দিও । ওটাতে লোড লেখা আছে । তার সঙ্গে ভোটার কার্ড এর এক কপি জেরক্স আর তোমার একটা পাসপোর্ট সাইজের ফটো ।
নাও , হয়ে গেল ! ফটো তোলাতে হবে । বিকেলে সুমিতের দোকানে গিয়ে বললাম
- একটা ফটো তুলে দে ।
- কি হল আবার ? কোথায় দরখাস্ত করছ ?
এই ফটোওয়ালাদের সব খবর জানতেই হবে । একে তো এসির খরচ এবং মাসে মাসে কত বিল আসবে তাই ভেবে আধমরা হয়ে আছি , তার মধ্যে এই কৌতূহল । মেজাজ বিগড়ে গেল । হেসে বললাম
- চাকরির চেষ্টা করছি , বিয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দেব , হারিয়ে গেলে তোর বৌদি কাগজে হারানো প্রাপ্তিতে দেবে – এর কোনটাই বিশ্বাস না হলে ধরে নে মারা গেলে বছরে একবার এই ফটো ছাপিয়ে নিচে লেখা হবে “তোমার মৃত্যুতে আমরা কষ্টে আছি । বাড়ির আজেবাজে কাজগুলো করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না ” ।
- তুমি একেবারে যা তা ! দাঁড়াও বৌদিকে বলে দেব ।
- যা যা! বল গে যা । আমি তোর বৌদিকে ভয় পাই নাকি ? মুখে বললেও মনে ভয় রয়ে গেল । এসব ইয়ার্কি ও একদম পছন্দ করে না ।
সপ্তাহ খানেক পরে একদিন দুপুরবেলা ইলেকট্রিক অফিস থেকে জনা চারেক লোক এসে উপস্থিত । গদাই আগে থেকে বলে রাখায় অফিস যাই নি । নতুন মিটার লাগাতে লাগাতে একজন বলল
- আপনার ওয়্যারিং এর অবস্থা তো খুব খারাপ । এসির জন্য আলাদা করে তার টানতে হবে । না হলে আগুন লেগে যেতে পারে । জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছিল কোথায় ? এসি তে না বাড়িতে ? কিন্তু পাশেই গিন্নী দাঁড়িয়ে আছে । স্মার্টলি বলল
- আপনারা আপগ্রেড করে দিয়ে যান । বাকি টা গদাই করে দেবে ।
- উঁ ! গদাই করে দেবে ! আর টাকাটা কে দেবে ? আমি মনে মনে বলি । এক এসি আমার সংসার খরচের ডিঙির তলা ফুটো করে দিয়ে চলে গেল ।
এরপর এসি কেনার পালা । ক্লাস ফাইভের জ্ঞান নিয়ে গেছি উচ্চমাধ্যমিকের এনট্রান্স দিতে । প্রথম প্রশ্নেই সব গুলিয়ে গেল
- দাদা ক টন ?
- ঠিক বলতে পারব না , তবে এমন একটা দেবেন যেন একজনই খুলে নামাতে পারে । আমি ভবিষ্যতের খরচের কথা ভেবেই বলি । বৌ কনুইয়ে একটা রাম চিমটি কাটল, তারপর সেলস ম্যান ছেলেটাকে মিষ্টি করে বলল
- ভাই , বারো বাই চোদ্দ ঘরে কত লাগবে ? সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র । ছেলেটা আমাকে পাত্তা না দিয়ে বৌদিকে নিয়ে পড়ল ।
- দেড় টন হলেই হয়ে যাবে । কপার না অ্যালুমিনিয়াম ? আমি ফেকলু পার্টির মত দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি কপার সস্তা না অ্যালুমিনিয়াম । ভাগ্যিস ছেলে মেয়ে সঙ্গে আসে নি ! বাবার বোকামি তে ওরা প্রেস্টিজে পড়ে যেত । অবশেষে ম্যানেজার গোছের এক ভদ্রলোক আমার অবস্থা দেখে এগিয়ে এসে জলের মত এসির ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন । আমিও সাদা কাগজের মত সব বুঝে গেলাম ।
এক শুভ দিনে ছোট হাতিতে করে এসি এলো । তার দিন তিনেক পর কোম্পানি থেকে লোক এসে ফিট করে দিয়ে গেল । আমি গামছা পরে ইয়াব্বড় থার্মোকোল আর প্যাকিং বাক্সটা লফটে ঢোকালাম । ওটা নাকি মেয়ের প্রজেক্টের কাজে লাগবে ।
এখন আমার রাতের ঘুম গেছে । ওরা নিশিন্তে ঘুমোয় আর আমি এসি বন্ধ করব বলে জেগে বসে থাকি । রিমোট দিয়ে টাইমার লাগিয়ে নাকি বন্ধ করা যায় কিন্তু ঘুম চোখে কি টিপতে কি টিপব তার ঠিক নেই । তাই ও সব গণ্ডগোলে না গিয়ে পাতি বাংলা পদ্ধতিতে ঘড়ি ধরে মাঝরাতে রোজ সুইচ অফ করে ফ্যান চালিয়ে দিই । আপনারা হয়ত ভাবছেন রাত জেগে জেগে আমার হার্টের অসুখ হবে । না , সে চিন্তা নেই । কত টাকা সাশ্রয় করতে পারলাম ভেবে আমি রাত জাগার সার্থকতা খুঁজে পাই । তবে কোনদিন যদি নিজে ঘুমিয়ে পড়ি – এই টেনশনে সুগারটা সামান্য বেড়েছে ।