27-03-2022, 08:50 PM
(This post was last modified: 10-01-2023, 12:00 PM by Bumba_1. Edited 6 times in total. Edited 6 times in total.)
.. আদি খন্ডের সূচনা ..
(১)
এবার আমরা ডেকে নেবো ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষার প্রথম স্থানাধিকারী ছাত্র অনির্বাণকে। তিনটি সেকশন মিলিয়ে দেড়'শ জন ছাত্রের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেছে ও .. সবাই করতালি দিয়ে উৎসাহিত করুন অনির্বাণকে। হাততালিতে ফেটে পড়লো কলেজের সমগ্র অডিটোরিয়াম। মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে আছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিশীথ বটব্যাল। স্টেজে উঠে তাঁর হাত থেকেই পুরস্কার গ্রহণ করে সব ছাত্র। এক'পা এক'পা করে তার দিকে এগোচ্ছে অনির্বাণ .. ঠিক সেই মুহুর্তে "গোগোল এই গোগোল, ওঠ এবার, আট'টা বাজতে চললো। এই এক মাস গরমের ছুটিতে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে আমার ছেলেটার। আগে কি সুন্দর ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তো। আর এখন ঘুম ভাঙতে রোজ দেরি হয়ে যাচ্ছে। সোয়া ন'টায় কিন্তু গাড়ি আসবে। আজ নতুন ক্লাসের প্রথম দিন, লেট করলে চলবে না। তাড়াতাড়ি ওঠ সোনা, স্নান করে খেয়েদেয়ে বেরোতে হবে তো .."
ঘুম ভেঙে গেলো গোগোলের। ওহো, এবারও একটুর জন্য তার ফার্স্ট প্রাইজ নেওয়া হলো না। ইশশ .. মা যদি আর একটু দেরিতে ডাকতে আসতো .. তাহলেই তার স্বপ্ন সফল হতো। মুখ ভার করে, আড়মোড়া ভেঙে, চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানায় উঠে বসলো গোগোল।
★★★★
অনির্বাণ মুখার্জি .. ডাকনাম গোগোল। এই কাহিনীতে আমরা বেশিরভাগ সময় অনির্বাণের ডাকনামটাই উল্লেখ করে কথা বলবো .. কেমন! ফর্সা এবং গোলগাল চেহারার, কটা চোখযুক্ত, লাল আপেলের মতো টুসটুসে দুই গালের গোগোলকে এতটাই মিষ্টি দেখতে, যে কয়েক বছর আগেও তাকে নিয়ে রাস্তায় বের হলে অচেনা অনেক ব্যক্তি তার মাতৃদেবীকে বলতো "বৌদি আপনার মেয়ের মুখশ্রী কিন্তু খুব সুন্দর।" এই ধরনের কথা যদিও গোগোলের একেবারেই পছন্দ হতো না। সে ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করতো। তৎক্ষণাৎ তার পছন্দসই কিছু উপহার বা ক্যাডবেরি দিয়ে তার মন ভোলাতে হতো।
গুরুকুল বিদ্যামন্দিরে পড়ে গোগোল। গঙ্গানগর এলাকার মস্ত বড় কলেজ এটি .. ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের অন্তর্গত হলেও ইংরেজি মাধ্যম কলেজ। গত মাসে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছে সে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মর্নিং সেকশন ছিলো গোগোলদের। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ওদের ডে' সেকশন। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো আমাদের গোগোল। ক্লাশে প্রথম না হলেও, প্রথম পাঁচের মধ্যে এযাবৎকাল তার র্যাঙ্কিং থেকে এসেছে। পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার সময় গোগোল তৃতীয় হয়েছে।
গোগোলের বাবা অনিরুদ্ধ মুখার্জি গঙ্গানগরের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কর্মরত একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। ফ্যাক্টরি সংলগ্ন বিশাল কম্পাউন্ডের একটি একতলা বাংলোতে তাদের বসবাস। বাবার অফিসের নীল রঙের একটি এম্বাসেডর গাড়ি করেই কলেজে যাতায়াত করে গোগোল।
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, গায়ের রঙ অত্যধিক ফর্সা, দীর্ঘকায়, মাথায় কোঁকড়ানো ঘন কেশযুক্ত, স্বাস্থ্যবাণ, কটা চোখের অধিকারী (গোগোল বোধহয় কটা চোখের সৌন্দর্য তার বাবার কাছ থেকেই পেয়েছে), বছর চল্লিশের অনিরুদ্ধ বাবুর নাম রমণীমোহন হলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিলো না। এইরূপ উক্তির কারণ বুঝতে পারলেন না তো? ঠিক আছে বুঝিয়ে বলছি। আসলে অনিরুদ্ধ বাবুর রূপ এবং পার্সোনালিটি রমণীদের মোহিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিলো। যদিও কুহকিনীদের প্রশ্রয় দিয়ে নিজের পদস্খলন ঘটানোর কথা একবছর আগেও হয়তো তিনি ভাবতে পারেননি।
★★★★
বারো বছর আগে তাদের গ্রামের বাড়ি কনকপুরে সম্বন্ধ করে অরুন্ধতীর সঙ্গে বিয়ে হয় অনিরুদ্ধর। দুই পরিবারের মঙ্গল কামনার স্বার্থে পারিবারিক গুরুদেবের আদেশে বিবাহ স্থির হয় দু'জনের। বাবা অল্পবয়সে গত হয়েছিলেন। কোনোদিনই মায়ের অবাধ্য সন্তান ছিলেন না অনিরুদ্ধ। তাই যখন বিবাহের জন্য তার সম্মতির কথা জানতে চাওয়া হয়, তখন এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
জন্মের সময় মা'কে হারায় অরুন্ধতী। সেই শোকে কাতর হয়ে এক বছরের মধ্যেই গত হন তার বাবা। শৈশবকাল থেকেই পিতৃ-মাতৃহীন অরুন্ধতী মামার বাড়িতে মানুষ। মামা সর্বদা তার প্রতি স্নেহশীল থাকলেও, মামীর কাছ থেকে মায়ের অপত্য স্নেহ পাওয়া যাবে এই কথা মনে করাই বিলাসিতা। যদিও সংসারে কি এর ব্যতিক্রম নেই! অবশ্যই আছে .. তবে অরুন্ধতীর ভাগ্যে সেইরূপ ব্যতিক্রমী জিনিস কিছু ঘটেনি। দুই মামাতো ভাই বোনের সঙ্গে বড় হয়ে উঠলেও বেড়ে ওঠার জন্য যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা এবং স্বাধীনতা - কোনোটাই সেই অর্থে জোটেনি অরুন্ধতীর কপালে। লেখাপড়ায় বুদ্ধিমতী এবং চৌকস হওয়া সত্ত্বেও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর আর পড়াশোনা এগোয়নি তার। সেই ভাবে গান না শিখলেও চমৎকার গানের গলা অরুন্ধতীর। তবে ছোটবেলা থেকেই মামীর সঙ্গে বাড়ির সমস্ত ঘরকন্যার কাজে লিপ্ত হওয়ার দরুন গৃহকর্মে নিপুনা হয়ে উঠেছিল অরুন্ধতী। তার পিতৃদেবের রেখে যাওয়া সঞ্চিত অর্থ দিয়েই অরুন্ধতীর বিবাহের যাবতীয় ব্যয় বহন করা হয়। পরমা সুন্দরী না হলেও গভীর কালো চোখ, ঈষৎ বোঁচা নাক এবং হাসলে টোল পড়া গালে একটা অদ্ভুত মনোরম লাবণ্য আছে তার সমগ্র মুখমন্ডল জুড়ে। তার সঙ্গে আকর্ষণীয় দেহবল্লরী যে কোনো পুরুষ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য।
বাইরে কাজ করার সুবাদে বিয়ের আগে নিজের হবু স্ত্রীর ছবি দেখলেও তাকে সামনাসামনি দেখেননি অনিরুদ্ধ। ছাদনা তলায় সে প্রথম দেখে অরুন্ধতীকে। এমনিতেই বিয়ের সাজে সব কনেকেই অপরূপা লাগে। কিন্তু অরুন্ধতীর বর্ণময় রূপের ছটা মোহিত করে দিয়েছিল অনিরুদ্ধকে। ফুলশয্যার রাতে অরুন্ধতীর অপরূপ লাবণ্য এবং আকর্ষক দৈহিক সৌন্দর্য অবলোকন করে আদ্যোপান্ত সিরিয়াস এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুবাদে কারখানার মেশিনগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে ফেলা অনিরুদ্ধর মধ্যেও কবিত্বের ভাব প্রকাশ পেয়েছিল। নববধূর রূপ-যৌবনকে উদ্দেশ্য করে নারীদেহের গঠনশৈলী নিয়ে কালজয়ী কিছু উক্তি বেরিয়ে এসেছিলো তার মুখ দিয়ে।
কখনো নরেন্দ্র দেবের কথায় ..
তন্বী তরুণী, শ্যামলিম তনু, শিখরোজ্জ্বল দশন পুট,
পক্ব বিম্ব অধর ওষ্ঠ, ক্ষীণ কটি তার, নাভিটি কূট,
চকিত-হরিণী নয়নের দিঠি, অলস গমনাশ্রোণীর ভারে;
কুচ চাপে নত যুবতী-যেন বা বিধাতে প্রথম সৃজিল তারে।
আবার কখনো বুদ্ধদেব বসুর আঙ্গিকে ..
তন্বী, শ্যামা, আর সুক্ষ্মদন্তিনী, নিম্ননাভি, ক্ষীণমধ্যা,
জঘন গুরু বলে মন্দ লয়ে চলে, চকিত হরিণীর দৃষ্টি
অধরে রক্তিমা পক্ক বিম্বের, যুগল স্তনভারে ঈষৎ-নতা,
সেথায় আছে সে-ই, বিশ্বস্রষ্টার প্রথম যুবতীর প্রতিমা।
পরবর্তীতে নীলমণি নন্দীর কথায় ..
জিজ্ঞাস যদ্যপি তুমি, কেমনে জানিবে,
কে আমার প্রিয়া, বলি শুন তবে তার
যেবা রূপ - দন্তপংক্তি যথা মণিপংক্তি,
ওষ্ঠাধর কিবা পক্কবিম্বসম, শ্যামা
মধ্যক্ষীণা, মৃগী-দৃষ্টি, সুগভীর নাভিঃ।
চারু পীন স্তন ভারে, ঈষৎ নম্রা, প্রিয়া,
অলস গমন তার দেখিবে হে তুমি
কিবা নিতম্বের ভরে, অম্বুধর! হায়!
যুবতী বিষয়ে প্রিয়া, বিধাতার আদি
সৃষ্টি.......................................।।
কখনো রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় ..
হীরকদশনা তন্বী পক্কবিম্বাধরা
শ্যামা মধ্যক্ষামা নিম্ননাভি মনোহরা।
চকিত হরিণী প্রায় চঞ্চল নয়না
নিবিড় নিতম্ব ভরে মন্থর গমনা।
স্তনভরে আছে দেহ স্তোক নম্র হয়ে
বিধিআদ্য সৃষ্টি তিনি যুবতী বিষয়ে।
কখনো আবার দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে ..
প্রিয়ারে পাইবে দেখা, গাময় লাবণ্যরেখা,
পয়োধরে ফুলিছে যৌবন।
তনু তার কলেবর, কটী তার ক্ষীণতর
স্তনভার করয়ে বহন।
বাঁধিবারে অনুরাগ, অধরে বিম্বের রাগ,
মৃগ-আঁখি প্রণয়ের আধার।
দেখিলে আকৃতি তার, মনে হয় সবাকার,
আদিসৃষ্টি বুঝি বা ধাতার।
সব কথা অক্ষরে অক্ষরে না বুঝলেও নিজের রূপ, লাবণ্য এবং দৈহিক সৌন্দর্যের বর্ণনা শুনতে শুনতে লজ্জায় রাঙা হয়ে যাচ্ছিলো সে - "আমি কিন্তু মোটেই শ্যামা নই .." খিলখিল করে হেসে বলে উঠেছিল অরুন্ধতী।
অরুন্ধতীর হাতে হাত রেখে নিজের জীবনের স্ট্রাগলের কথা অর্থাৎ ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর কিভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং অধ্যাবসায়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে অনিরুদ্ধ .. সেইসব স্মৃতিচারণের মাধ্যমে কথোপকথন শুরু হলো তাদের। ধীরে ধীরে পরস্পরের প্রতি সম্বোধন আপনি থেকে তুমি তে রূপান্তরিত হলো .. পরস্পরের কাছে সহজ এবং স্বাভাবিক হতে থাকলো তারা। অরুন্ধতীর ডান হাতটা আলতো ভাবে ধরেছিল অনিরুদ্ধ – অরুন্ধতী বাধা দেয়নি। “তোমার নামটা খুব দামী আর ভারী ঠিক তোমার এই ভারী গয়নাগুলোর মতো। তোমার তো ডাকনামও নেই, আমি তোমাকে ছোট্ট করে অরু বলে ডাকবো?” নববধূর নরম হাতটা নিয়ে খেলা করতে করতে প্রশ্ন করেছিলো অনিরুদ্ধ।
অরুন্ধতী কিন্তু লজ্জায় সিঁটিয়ে যায়নি, বরং স্বামীর দাবি মেনে উৎসাহ দিয়ে বলেছিল “আমি যখন আপনার, সরি তোমার হয়ে গিয়েছি তখন তোমার যা খুশি নাম দিও।” স্ত্রীর মধুর প্রশ্রয় অনিরুদ্ধ আরো লোভী হয়ে ওর হাতের চুড়িগুলো উপর দিকে তুলে এঁটে দিয়েছিল। তারপর অরুন্ধতীর ডান হাতটি নিজের দুই হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে নিজের হাতের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিল “এই হচ্ছে কারখানার শ্রমিকের হাত .. আঙুলগুলো ছড়ালে কুলোর সাইজ হয়ে যাবে.. কোনো কোমলতা নেই .. দু’এক জায়গায় কড়াও পড়েছে। আর এই হলো রূপকথার রাজকুমারীর হাত ..নরম তুলতুলে একটু ঠান্ডা একটু গরম।” প্রতুত্তরে অরুন্ধতী বলেছিল "এ মা .. তুমি শ্রমিক হলে কবে? আমি যে শুনেছিলাম তুমি ইঞ্জিনিয়ার.."
অনিরুদ্ধর জীবনের কথা শুনতে শুনতে অরুন্ধতী নিজের অবশিষ্ট দুর্বলতাটুকু অতিক্রম করলো। ক্রমে ঘনিষ্ঠ হলো তারা। অরুন্ধতী ধীরে ধীরে অনুভব করলো .. অন্তিম দুর্বলতাটুকু জয় করতে পেরেছে বলেই জানতে পারছে শরীরে এত সুধা ছিলো, এত শিহরণ লুকিয়ে ছিলো, শরীরের ক্ষুধা এবং তা যথাযথভাবে প্রশমন করার উপায়।
এই রোমাঞ্চকর শরীরি যাত্রায় গা ভাসাতে পেরেছে বলে শরীরের অব্যবহৃত রত্নসমূহ অনিরুদ্ধর হাতে সঁপে দিয়ে, অন্ধ অতল জোয়ারে - কখনো পরম যত্নবান হয়ে আবার কখনো করাতের মতো চিরে চিরে অনিরুদ্ধ যখন খেলছিলো তার নব বিবাহিতা স্ত্রীর শরীর নিয়ে , অরুন্ধতী বিস্ময়াবিষ্ট হচ্ছিলো শরীরের অনৈসর্গিক সুখের পূর্ণতায়। শরীরি সঙ্গমে মনে হচ্ছিলো সে যেন একটা স্কেলে বাঁধা হারমোনিয়াম .. আর তার শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ যেন এক-একটা রীড, সেই রীডগুলির এদিক ওদিক চাপে ওর শরীরে যেন সঙ্গীতের মূর্ছনা ফুটে উঠছে। শুদ্ধস্বরের মাঝে কখনো কোমল "রে" , কখনো কোমল "গা" , কখনো করি "মা" , আবার কখনো কোমল "ধা" অথবা কোমল "নি" ব্যবহার করে তার শরীরে বিলাবল, খাম্বাজ, কাফী, আশাবরী, ভৈরব হয়ে কল্যাণ, মারওয়া, ভৈরবী, পূর্বী, তোড়ীর .. সম্মিলিত আরোহন অবরোহন হচ্ছে। সুখের আবেশে হারিয়ে যেতে থাকলো অরুন্ধতী।
সুখের আবেশে ভেসেও কিন্তু হারিয়ে যায়নি দু'জনে, হাঁপিয়ে ওঠেনি, ব্যস্তও হয়নি .. কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলো, এই যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার আদিম আকাঙ্ক্ষা.. তা অনেকটা রাসায়নিক বিপ্লবের মতো - ল্যাবরেটরিতে যে মিলনের চূড়ান্তে পৌঁছে পদার্থ নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলে, যে বিপ্লবের পরে পুরানোকে আর পাওয়া যায় না, নিজেকে নিঃশেষ করে সে নূতনের জন্ম দেয়। এক বছরের মাথায় জন্ম হলো গোগোলের। ঠাকুমা অন্নপূর্ণা দেবী মা-বাবার নামের সঙ্গে মিলিয়ে তার একমাত্র নাতির নাম রাখলেন অনির্বাণ।
★★★★
অর্ধনারীশ্বর কথাটির প্রকৃত উদাহরণ বিয়ের পর এক বছর পর্যন্ত অনিরুদ্ধ এবং অরুন্ধতীকে যারা দেখেছে তারা অবশ্যই বুঝতে পারবে। স্ত্রীর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসার জন্যই হোক বা শারীরিক আকর্ষণের জন্যই হোক অরুন্ধতীকে চোখে হারাতো অনিরুদ্ধ। স্ত্রীকে নিয়ে নিজের কাছে রাখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পৌঢ়া মায়ের সেবা-শুশ্রূষা এবং বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য কনকপুরে শশুরের ভিটেতে শাশুড়ি মা অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে থাকতো অরুন্ধতী। সেই সময় বর্ধমানের কাছে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কাজ করতো অনিরুদ্ধ। রবিবার ছুটি থাকতো .. নিয়ম করে প্রতি শনিবার অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা কনকপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হতো সে। রবিবার সারাদিন ওখানে কাটিয়ে আবার সোমবার ভোরবেলা বেরিয়ে পরতো অফিসে আসার জন্য।
বিয়ের এক বছরের মাথায় অরুন্ধতী একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জন্ম দিলো। ঘর আলো করে এলো মুখার্জি পরিবারের বংশ প্রদীপ। স্ত্রীর প্রতি অনিরুদ্ধর মোহ, প্রেম, ভালোবাসা - ক্রমশ মায়ায় রূপান্তরিত হলো। সন্তানের প্রতি এক অমোঘ এবং অপত্য স্নেহের মায়া, তার সঙ্গে সন্তানের মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা মিশ্রিত মায়া।
শুক্রবার রাতের পর থেকে কর্মক্ষেত্রে আর মন টিকতে চাইতো না অনিরুদ্ধর। সন্তানকে দেখার জন্য আকুলি-বিকুলি করে উঠতো তার মন। কখন শনিবার হবে, কখন অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা তাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে গোগোলের মুখটা দেখতে পাবে .. এই ভেবে সন্তানের প্রতি রক্তের টানের অদ্ভুত একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করতো অনিরুদ্ধ। বিছানায় চিৎ অবস্থায় থাকতে থাকতে প্রথম উল্টানো শেখা, হঠাৎ করে মাঝেমধ্যে বিচিত্র রকমের শব্দ করে ওঠা যা প্রত্যেকের বোঝার পক্ষে দুর্বোধ্য, কিংবা নতুন দাঁত ওঠা, এক বছরের মাথায় হামাগুড়ি দেওয়া, তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে শেখা - প্রাকৃতিক নিয়ম মেনেই গোগোলের ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার এইসব ঘটনাপ্রবাহ অরুন্ধতী তার চোখের সামনে ঘটতে দেখলেও, অনিরুদ্ধ সপ্তাহান্তে এসে তার সন্তানের একেক বার একেক রকম পরিবর্তন দেখে অতিমাত্রায় রোমাঞ্চিত হয়ে যেত।
এভাবেই বছর চারেক কেটে গেলো। ছেলে, বৌমা এবং একমাত্র নাতিকে এই ধরাধামে রেখে চিরতরে বিদায় নিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। আকস্মিক এরকম ঘটনায় সেই সময় কিছুটা থমকে গিয়েছিলো অনিরুদ্ধ এবং তার পরিবারের জীবন। কর্মক্ষেত্রেও নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছিলো। ওই অফিসে থাকলে তার কর্মজীবনের উন্নতি হওয়া সম্ভবপর নয় এটা বেশ বোঝা যাচ্ছিলো। একদিন হঠাৎ করেই তার করা আবেদন-পত্রে সাড়া দিয়ে গঙ্গানগরের একটি নামজাদা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম থেকে ইন্টারভিউয়ের ডাক এলো অনিরুদ্ধর। এমনিতে তো পূর্বে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং ডিগ্রির ওজন ছিলোই, তার ওপর বুদ্ধিমান অনিরুদ্ধ তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জোরে ইন্টারভিউ টেবিলে তার উচ্চপদস্থ কর্তাদের মন জয় করে নিলো। ফলস্বরূপ, কয়েকদিনের মধ্যেই এই ফার্মে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে জয়েনিং এর নিয়োগপত্র গেলো অনিরুদ্ধর কাছে।
★★★★
তার মা অন্নপূর্ণা দেবীর অবর্তমানে নিজের স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে চলে এলো অনিরুদ্ধ। কিন্তু এই সময় একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো সে। অরুন্ধতীর হাজার বারণ করা সত্বেও তার পৈত্রিক ভিটে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাদের শরিকদের কাছে বিক্রয় করে দিয়ে চলে এসেছিলো। বিয়ের পরে মধ্যবিত্ত বাঙালির হানিমুনে যাওয়ার স্থান দিপুদা (অর্থাৎ দিঘা, পুরী, দার্জিলিং) এর মধ্যে দার্জিলিঙে যাওয়া এবং ওখানে দিন চারেক কাটানো ছাড়া অনিরুদ্ধ এবং অরুন্ধতী একসঙ্গে আটচল্লিশ ঘণ্টার বেশি বিয়ের পর থেকে কখনো কাটায়নি। এই প্রথম গঙ্গানগরের ফ্যাক্টরির ক্যাম্পাসের বাংলোতে স্বামী-স্ত্রীর প্রকৃত সাংসারিক জীবন শুরু হলো। ছোট্ট গোগোল গুরুকুল বিদ্যামন্দিরে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলো।
প্রথম কয়েক দিন স্বপ্নের মতো মনে হলেও ধীরে ধীরে অনিরুদ্ধর মনে হতে লাগলো 'যদি স্বামী-স্ত্রীর মনের মিল না থাকে, তাহলে শারীরিক আকর্ষণের মোহ বোধহয় খুব বেশিদিন থাকে না।' নাহ্, এক্ষেত্রে অরুন্ধতীর তরফ থেকে কিছু মনে হয়নি, বরং সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে গিয়েছে স্বামীর মন জুগিয়ে চলার। এইখানেই অনিরুদ্ধর আপত্তি .. এতদিনেও তার স্ত্রীর মধ্যে কোনো স্বতন্ত্রতা খুঁজে পায়নি সে। অরুন্ধতীকে ভীষণরকম পরনির্ভরশীল মনে হয়েছে তার। অর্থনৈতিক ভাবে, সেটা না হয় মানা গেলো .. কিন্তু মানসিকভাবে স্বামীর প্রতি অরুন্ধতীর এই নিবেদিত প্রাণকে একেবারেই মেনে নিতে পারেনি সে। পরবর্তীতে অনিরুদ্ধর মনে হয়েছে তার স্ত্রীর এই মানসিক বিকাশ না হওয়া হয়তো স্বল্প শিক্ষার জন্যই ঘটেছে। পূর্বের থেকে সামান্য কিছু পৃথুলা হয়ে যাওয়া অরুন্ধতীর প্রতি আর শারীরিক আকর্ষণও অনুভব করছিল না সে। কর্মক্ষেত্রে ক্রমশ উন্নতি করে এই কয়েক বছরের মধ্যেই সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাওয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী, উচ্চশিক্ষিত অনিরুদ্ধর wavelength যেন আর কিছুতেই মিলছিলো না স্বল্পশিক্ষিতা, গ্রাম্য অরুন্ধতীর সঙ্গে।
অসহায়, অপারগ অরুন্ধতী হাজার চেষ্টা করেও বুঝতে পারেনি তাদের স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের ক্রমশ দূরত্বের কারণ। ঘরকন্যার কাজ করা কি অন্যায়? স্বামী, সন্তানের মঙ্গল চেয়ে সংসারে নিবেদিতপ্রাণ হওয়া কি অন্যায়? কি করবে সে এখন? কিভাবে মন জিতে নেবে তার স্বামীর .. উদয়াস্ত ভেবেও এর কোনো প্রতিকার করতে পারছিল না সে। অনিরুদ্ধ মাছ খেতে ভালোবাসে বলে দুইরকম তিনরকমের মাছ ভিন্ন পদে রেঁধে খাওয়ানোর পর রাতে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে, "ওফ্ .. তোমার শাড়ি দিয়ে মাছের আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছে .. আই জাস্ট হেট দ্যাট স্মেল .. সরে শোও" বলে অনিরুদ্ধ যখন পাশ ফিরে শুয়ে পরতো, তখন প্রথম প্রথম অপমানে, দুঃখে, লজ্জায়, কান্নাতে বুক ফেটে আসেতো অরুন্ধতীর। এখন অবশ্য সবকিছু সয়ে গিয়েছে। পাঁচ বছরে অনেক কিছুই তো অভ্যেসে পরিণত হয় , এটাই হয়তো ভবিতব্য ছিলো তার .. এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে শিখে গিয়েছে অরুন্ধতী।
(ক্রমশ)
ভালো লাগলে লাইক এবং রেপু দিয়ে উৎসাহিত করবেন