Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
# পাগলামি


স্ত্রী কুমুদিনী মারা যাওয়ার পর থেকেই  অনাথবাবু কেমন যেন গুম মেরে গেছেন পঁয়তাল্লিশ বছরের দাম্পত্য জীবন কুমুদিনীদেবী ভীষণই নরম আর চাপা স্বভাবের ছিলেন নিজের প্রয়োজনের কথা কোনদিনও মুখ ফুটে বলেননি গলা উঁচু করে কথা বলা, বরের সাথে ঝগড়া করে রাগের মাথায় বাপের বাড়ি চলে যাওয়া---এসব কোনকিছুই কুমুদিনীদেবীর ব্যাকরণে ছিল না তবে অনাথবাবু কোনদিন স্ত্রীকে অবহেলা করেননি সাধ্যমতো সব প্রয়োজন মিটিয়েছেন তিনি স্ত্রীবিয়োগের পর থেকেই অনাথবাবুর মনে হয়েছে, কুমুদিনীকে তিনি প্রতারণা করেছেন ছেলেমেয়ে মানুষ করতে গিয়ে স্ত্রীকে দিয়ে অনেক কিছু ত্যাগ করিয়ে নিয়েছেন কুমুদিনীর জীবনে আরো অনেক কিছু প্রাপ্য ছিল
  দিন যত গড়াল অনাথবাবু মানসিক দিক থেকে তত ভেঙে পড়তে শুরু করলেন দেখতে দেখতে কয়েক মাসের মধ্যে তিনি মানসিক রোগীতে পরিণত হলেন তিন ছেলে আর এক মেয়ে অনাথবাবুর প্রতি মাসে পালা করে ছেলেরা বাবাকে নিজের কাছে রাখে পাছে রোগের খরচ তাকেই বহন করতে হয়, এই ভেবে কোন ছেলেই মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে নারাজ অবশেষে বড়ছেলে মৃনাল একদিন বাবাকে এক সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে নিয়ে গেল
   ডাক্তার দেখানো হলো ওষুধ দিলেন কিন্তু কাজ হল না ঠিকঠাক অনাথবাবু এতদিন বেশিরভাগ সময় চুপচাপই থাকতেন, ইদানিং বকাবকি শুরু করলেন অর্থহীন প্রলাপ শুনতে শুনতে ছেলে এবং ছেলের বউরা রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠল অবশেষে তিন ছেলে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে অনাথবাবুকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে রেখে আসা হল তিন ভাই মিলে খরচাপাতি ভাগাভাগি করে নিল অনাথবাবু আপত্তি করেছিলেন তাঁর আপত্তি ধোপে টেকেনি আসলে অচল মুদ্রার মতো অচল মানুষও একদিন অর্থহীন হয়ে পড়ে
*
সুবীরবাবুর সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠল অনাথবাবুর পাঁচবছর  ধরে তিনি এই অ্যাসাইলামে আছেন বেশিরভাগ সময়ই তিনি সুস্থ স্বাভাবিক থাকেন তবে মাঝে মাঝে আচমকা ভীষণ রকমের পাগলামি শুরু করেন স্বাভাবিক অবস্থায় খুব কম কথা বলেন দুই বৃদ্ধের জীবনের গল্প মোটামুটি এক অনাথবাবু ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন কথার ছলে  একদিন অনাথবাবু বললেন, আপনাকে দেখে আমার খুব খারাপ লাগে এতদিন ধরে আপনার চিকিৎসা চলছে অথচ এখনও সুস্থ স্বাভাবিক হতে পারলেন না
সুবীরবাবু হাসলেন এরপর বললেন, সুস্থ হয়ে কী লাভ! বেশ তো আছি
---এরকম কেন বলছেন?
---আচ্ছা অনাথবাবু আপনার তো কাল ছুটি, তাই না?
---হ্যাঁ, বড় ছেলে মৃনাল কাল আসবে
সুবীরবাবু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, জানেন অনাথবাবু বছর খানেক আগে আমিও সুস্থ হয়েছিলাম বাড়িতে খবরও দেওয়া হয়েছিল কিন্তু....
কিন্তু কী? অনাথবাবু ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলেন ---কেউ নিতে আসেনি পুরোনো, ক্ষয়ে যাওয়া, অসমর্থ, বৃদ্ধ বাবাকে তারা তাদের প্রগতিশীল জীবনে আর ফিরিয়ে নিতে চায়নি অগত্যা...
---অগত্যা কী সুবীরবাবু?
---পাগলামির অভিনয় শুরু করলাম ভাবলাম, বাকি জীবনটা পাগলামি করে কাটিয়ে দিতে পারলে অন্ততপক্ষে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তো পাওয়া যাবে
সুবীরবাবুর জীবনের করুন গল্প শুনে অনাথবাবুর দু'চোখ ঝাপসা হয়ে এলো
সুবীরবাবু অনাথবাবুর দুহাত ধরে অনুরোধ করলেন, কথা কাউকে বলবেন না প্লিজ 
অনাথবাবু আশ্বস্ত করে বললেন, আমার যদি সামর্থ্য থাকত আপনাকে আমি আমার সাথে নিয়ে যেতাম কিন্তু আমিও তো ছেলেদের উপর নির্ভরশীল উপার্জনের সব টাকা সংসারের খরচ টানতে টানতে আর ছেলেমেয়েদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতেই শেষ হয়ে গেল নিজের জন্য কিছুই জমিয়ে রাখতে পারলাম না 
*
সুবীরবাবু এখন আগের মতোই একা বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ থাকেন আর মাঝে পাগলামির অভিনয় করেন মাস ছয়েক পর একদিন হঠাৎ তিনি দেখলেন এক  উন্মাদ পাগলকে দড়ি দিয়ে বেঁধে অ্যাসাইলামে আনা হচ্ছে নতুন কিছু নয় এরকম দৃশ্য তিনি পাঁচ-'বছরে অনেক দেখেছেন সুবীরবাবু প্রথমে আমল দিলেন না তারপর কি মনে করে উঠে গেলেন সেই পাগলকে দেখতে ফতুয়া পরা, গোঁফ দাড়ি না কমানো সেই বৃদ্ধকে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেললেন সুবীরবাবু বিড়বিড় করে বলে উঠেলন, অনাথবাবু!
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি খুব ভাল করে লক্ষ্য করলেন অনাথবাবুকে তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, অনাথবাবুর চোখদুটো যেন কাউকে খুঁজছে সুবীরবাবু আড়াল হয়ে পড়লেন
তিনদিন পর অনাথবাবু একটু শান্ত হলে ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে সুবীরবাবু দেখা করতে গেলেন তাঁর সঙ্গে
  সুবীরবাবু অনাথবাবুর পাশে এসে বসলেন অনাথবাবু দুদিন ধরে যেন তাঁকেই খুঁজছিলেন চোখে মুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠল
সুবীরবাবু অনাথবাবুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, পাঁচ বছর ধরে পাগলামির অভিনয় করে চলেছি কোনটা সত্যিকারের পাগলামি আর কোনটা পাগল হওয়ার অভিনয়, সেটা খুব ভাল করেই বুঝি ছেলেদের সংসারে জায়গা হল না বুঝি?
    কোন কথা বললেন না অনাথবাবু শুধু
অনাথবাবুর মরীচিকাময় জীবনে কোথা থেকে চেরাপুঞ্জির দু'খন্ড মেঘ এসে জমল দুই চোখে 
দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা মেশানো অশ্রু ঝরে পড়ল কয়েক ফোঁটা 
করতল দিয়ে দু'চোখ মুছতে মুছতে অনাথবাবু বললেন, অচল নোট একবার পকেট থেকে বেরিয়ে গেলে কেউ কি আর ফেরত নিতে চায়? মিথ্যেই  নিজেকে এতকাল শেকড় ভেবে এলাম বীজ ভেবে এলাম 
  দুই বৃদ্ধ পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন বাইরের ব্যস্ত, প্রগতিশীল সমাজ কিচ্ছুটি টের পেল না শুধু এই গোপন, বেদনাদায়ক, ঘটনার নীরব সাক্ষি হয়ে থাকল অ্যাসাইলামের পলেস্তরা খসে পড়া, নোনাধরা, স্যাঁতসেঁতে  ঘুপচি ঘরের চার দেয়াল

                            ©সন্তু সাহা

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 26-03-2022, 09:36 AM



Users browsing this thread: 18 Guest(s)