25-03-2022, 09:47 AM
শুভমস্তু
গোবিন্দভোগ চালটা প্রায় আধঘন্টা আগেই ভিজিয়ে রেখেছিল ঈশানী। এবার গোটা গরম মশলা দিয়ে জল ফোটাচ্ছে। টগবগ করে ফুটলে চালটা দিয়ে দেবে... তারপর নিয়মমাফিক ঘি, ভিজিয়ে রাখা কাজু, কিসমিস...
গ্যাসের দিকে তাকিয়ে চোখে জল এলো ওর।
জলটা যেমন ফুটছে, তেমনি ওর মনটাও তো ফুটছে! অথচ... মুখে বলতে পারছে কই! বরং এই গরমে ঘুপচি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে বাসন্তী পোলাও বানাচ্ছে! এরপরে কষা মাংসের পালা!
সঞ্জয়ের দুই বন্ধু আজ দুপুরে এখানেই খাবে। অবশ্য, দুপুর না, খেতে খেতে বিকেল গড়িয়ে যাবে নির্ঘাত। ততক্ষণ ওকেও বসে থাকতে হবে! যতই মাতাল হোক, অতিথি তো, আপ্যায়ন করার দায় এবং দায়িত্ব দুইই তো ওরই!
ভাবতে ভাবতে চোখে জল এলো ঈশানীর।
গত পরশু অফিস থেকে ফিরে জুতো ছাড়তে ছাড়তে সঞ্জয় বলেছিল "অরিন্দম আর সুভাষকে দোলের দিন দুপুরে খেতে বলেছি। তুমি মাটনটা বানিয়ো।"
"দোলের দিন? আরতিদি আসবে না সেদিন। আমাকে একা সব কাজ করতে হবে"! বলেছিল ও।
"তাতে কি হয়েছে? দুজন এক্সট্রা খাবে এই যা!"
"শুধু দুপুরেই খাবে তো?"
"সকালে আসবে। একটু বসব আমরা একসাথে। অনেকদিন বসা হয়না। তারপর দুপুরে খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে বাড়ি যাবে।" বলেছিল সঞ্জয়।
'বসা' শুনেই মুখ শুকিয়ে গেছিল ঈশানীর।
দীপাবলীর সময়েও 'বসেছিল' ওরা। বোতল টোতল ভেঙে, বিছানায় মদ ফেলে একাকার কান্ড। সেই ঈশানীকেই সব পরিষ্কার করতে হয়েছিল। আবার দোলেও!
"প্লিজ প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করো। আমার খুব আনকমফোর্টেবল লাগে" মরিয়া হয়ে বলেছিল ও।
"আনকমফোর্টেবলের কি আছে? আমরা বেডরুমের দরজা বন্ধ করে বসব। তুমি এখানে থেকো।" মামলা খারিজ করার মতো করে বলেছিল সঞ্জয়।
সেই পরশু মানে দোল আজ! সকাল থেকেই ঈশানী রান্নাঘরে আর সঞ্জয় ওর দুই বন্ধুর সঙ্গে বেডরুমে। এত গরম... কষ্ট হচ্ছে ঈশানীর... ওই একটা ঘরেই তো এসি আছে...। কিন্তু যাবার উপায় নেই।
মাঝেমাঝে খুব একা লাগে ওর।
যতই 'ছেলে -মেয়ে সমান সমান' ভাবুক না কেন, ছোট ছোট কত ঘটনায় বোঝা যায়, এখনও অনেক লড়াই বাকি আছে!
"ঈশানী, একটু ঠান্ডা জল দিয়ে যাবে?" চেঁচিয়ে বলল সঞ্জয়।
ইচ্ছে করেই সাড়া দিল না ও।
"কি হল? ঠান্ডা জল দিতে বললাম যে?" সাড়া না পেয়ে নিজেই উঠে এসেছে সঞ্জয়।
"কিভাবে যাব? আমি তো রান্না করছি।"
"তো?"
"আর আমি নাইটি পরে আছি... এভাবে... ওই ঘরে যেতে লজ্জা লাগে।"
"লজ্জার কি আছে? ওরা সবাই আমার নিজের লোক। তোমাকে কত ভালবাসে! বৌদি বৌদি করে সারাক্ষণ। তাছাড়া..."
"তাছাড়া কি?"
"লজ্জার আছে টা কি? ওই তো আলুর বস্তার মতো ফিগার তোমার। ওরা কেউ ফিরেও তাকাবে না।" একরাশ বিষ উগরে দিয়ে চলে গেল সঞ্জয়।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঈশানী!
হ্যাঁ, থাইরয়েড, পি সি ও ডি র কল্যাণে মোটা হয়ে গেছে অনেকটাই। তাবলে এমনি ভাবে বলবে ওকে সঞ্জয়?
ছিঃ!
মাংসটা কষাতে কষাতে কদিন আগের কথা ভাবছিল। ইউটিউবে একটা ভিডিওতে একজন বলছিলেন "লাভ ইয়োরসেলফ দ্যা ওয়ে ইউ আর! নিজেকে তুমি যেমন, সেইভাবে ভালোবাসো।" সেটাই নাকি প্রকৃত নারীবাদ। আর আজ ওকে ওর সবচেয়ে কাছের মানুষটা এইভাবে বলল?
রান্না শেষ করে যখন বাইরে এলো ঈশানী, তখন প্রায় দেড়টা বাজে। সকালে উঠে বাসিকাজ সেরে স্নান করেছিল। কিন্তু এখন শরীর অস্থির লাগছে খুব। আবার স্নান করতে হবে।
স্নান সেরে বেরিয়ে একটা নতুন কুর্তি পরল ও। ওর ছোটবেলার পাড়ায় খুব বড় করে পুজো হত এইদিনে। মঠ-ফুটকড়াই প্রসাদ হত। আর ঠাম্মার সাথে কীর্তন শুনতে যেত ও। কীর্তনের পরে আবীর খেলা... মিষ্টিমুখ... ভোগপ্রসাদ নিয়ে বাড়ি ফেরা...এভাবেই দিন কাটত।
আর এখন!
চুল আঁচড়ে একবার দরজা ধাক্কা দিল ঘরের।
"হ্যাঁ..." অরিন্দমের গলা। দরজার বাইরে থেকেই মদ আর সিগারেটের একটা বোঁটকা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
"তোমরা কখন খাবে? দুটো বেজে গেছে।"
"বৌ...স্যরি... বৌদি, আমরা আরেকটু পরে খাব। এখন না।" জড়িয়ে যাওয়া গলায় উত্তর শুনে ফিরে আসে ঈশানী।
তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। অতিথিদের জন্য রাখা প্লেট আর বাটিতে নিজের খাবারটা তুলে নেয়। আর দেরি করবে না ও। পেট চুঁইচুঁই করছে।
"বরফ আছে ফ্রিজে?" বলতে বলতে বেরোয় সঞ্জয়। একটু টলতে টলতে। তারপরেই অবাক হয়ে বলে "একি, তুমি বসে গেলে?"
"কেন? আমার খিদে পেতে পারে না? তোমরা নাহয় চিপস, এটাসেটা খাচ্ছ, আমি তো সেই ব্রেকফাস্ট করেছি। আর, তুমিও এবার ঘর পরিষ্কার করে রুম ফ্রেশনার দাও। তারপর এখানে এসে বসো। খাবার রাখা থাকবে, বেড়ে খেয়ে নিও। সারা সপ্তাহ পরিশ্রম, আজ সকাল থেকে এত খাটনি... আমাকে এবার একটু শুতে দাও..." এতক্ষণের রিহার্সাল দেওয়া কথাগুলো বলে দেয় ঈশানী।
জীবনে এই প্রথম!
মিনিট পনেরো পরে চাদর পালটে বিছানায় শুতে যাবার আগে আয়নায় নিজের দিকে একবার তাকাল ঈশানী।
শুনেছিল, মৃধাসুর বা ম্রেধাসুরকে বধ করে শ্রীকৃষ্ণ ব্রজে ফেরার পরে তাঁকে দোলায় বরণ করে নেন ব্রজবাসীরা। সেই গোপ-গোপিনীদের রং থেকেই দোলযাত্রার সূচনা। ম্যাড়াপোড়ার, যার অপভ্রংশ ন্যাড়াপোড়া, তার সূচনা।
পায়ে পায়ে আয়নায় কাছে রাখা কুমকুমের শিশিটা হাতে তুলে নেয় ঈশানী।
সঞ্জয়ের এই এতদিনের "তুমি মেয়ে, সব কাজ তো তোমাকেই করতে হবে, সব কথা মানতে হবে" শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে গেছিল ও।
আজকের প্রতিবাদ - অসুর বধের চেয়ে কি কম কিছু?
একটু হাসে ঈশানী। তারপর আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে "শুভ দোলযাত্রা ঈশু! এবার জীবনেও রং আসুক...আসুক...আসুক..."
গোবিন্দভোগ চালটা প্রায় আধঘন্টা আগেই ভিজিয়ে রেখেছিল ঈশানী। এবার গোটা গরম মশলা দিয়ে জল ফোটাচ্ছে। টগবগ করে ফুটলে চালটা দিয়ে দেবে... তারপর নিয়মমাফিক ঘি, ভিজিয়ে রাখা কাজু, কিসমিস...
গ্যাসের দিকে তাকিয়ে চোখে জল এলো ওর।
জলটা যেমন ফুটছে, তেমনি ওর মনটাও তো ফুটছে! অথচ... মুখে বলতে পারছে কই! বরং এই গরমে ঘুপচি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে বাসন্তী পোলাও বানাচ্ছে! এরপরে কষা মাংসের পালা!
সঞ্জয়ের দুই বন্ধু আজ দুপুরে এখানেই খাবে। অবশ্য, দুপুর না, খেতে খেতে বিকেল গড়িয়ে যাবে নির্ঘাত। ততক্ষণ ওকেও বসে থাকতে হবে! যতই মাতাল হোক, অতিথি তো, আপ্যায়ন করার দায় এবং দায়িত্ব দুইই তো ওরই!
ভাবতে ভাবতে চোখে জল এলো ঈশানীর।
গত পরশু অফিস থেকে ফিরে জুতো ছাড়তে ছাড়তে সঞ্জয় বলেছিল "অরিন্দম আর সুভাষকে দোলের দিন দুপুরে খেতে বলেছি। তুমি মাটনটা বানিয়ো।"
"দোলের দিন? আরতিদি আসবে না সেদিন। আমাকে একা সব কাজ করতে হবে"! বলেছিল ও।
"তাতে কি হয়েছে? দুজন এক্সট্রা খাবে এই যা!"
"শুধু দুপুরেই খাবে তো?"
"সকালে আসবে। একটু বসব আমরা একসাথে। অনেকদিন বসা হয়না। তারপর দুপুরে খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে বাড়ি যাবে।" বলেছিল সঞ্জয়।
'বসা' শুনেই মুখ শুকিয়ে গেছিল ঈশানীর।
দীপাবলীর সময়েও 'বসেছিল' ওরা। বোতল টোতল ভেঙে, বিছানায় মদ ফেলে একাকার কান্ড। সেই ঈশানীকেই সব পরিষ্কার করতে হয়েছিল। আবার দোলেও!
"প্লিজ প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করো। আমার খুব আনকমফোর্টেবল লাগে" মরিয়া হয়ে বলেছিল ও।
"আনকমফোর্টেবলের কি আছে? আমরা বেডরুমের দরজা বন্ধ করে বসব। তুমি এখানে থেকো।" মামলা খারিজ করার মতো করে বলেছিল সঞ্জয়।
সেই পরশু মানে দোল আজ! সকাল থেকেই ঈশানী রান্নাঘরে আর সঞ্জয় ওর দুই বন্ধুর সঙ্গে বেডরুমে। এত গরম... কষ্ট হচ্ছে ঈশানীর... ওই একটা ঘরেই তো এসি আছে...। কিন্তু যাবার উপায় নেই।
মাঝেমাঝে খুব একা লাগে ওর।
যতই 'ছেলে -মেয়ে সমান সমান' ভাবুক না কেন, ছোট ছোট কত ঘটনায় বোঝা যায়, এখনও অনেক লড়াই বাকি আছে!
"ঈশানী, একটু ঠান্ডা জল দিয়ে যাবে?" চেঁচিয়ে বলল সঞ্জয়।
ইচ্ছে করেই সাড়া দিল না ও।
"কি হল? ঠান্ডা জল দিতে বললাম যে?" সাড়া না পেয়ে নিজেই উঠে এসেছে সঞ্জয়।
"কিভাবে যাব? আমি তো রান্না করছি।"
"তো?"
"আর আমি নাইটি পরে আছি... এভাবে... ওই ঘরে যেতে লজ্জা লাগে।"
"লজ্জার কি আছে? ওরা সবাই আমার নিজের লোক। তোমাকে কত ভালবাসে! বৌদি বৌদি করে সারাক্ষণ। তাছাড়া..."
"তাছাড়া কি?"
"লজ্জার আছে টা কি? ওই তো আলুর বস্তার মতো ফিগার তোমার। ওরা কেউ ফিরেও তাকাবে না।" একরাশ বিষ উগরে দিয়ে চলে গেল সঞ্জয়।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঈশানী!
হ্যাঁ, থাইরয়েড, পি সি ও ডি র কল্যাণে মোটা হয়ে গেছে অনেকটাই। তাবলে এমনি ভাবে বলবে ওকে সঞ্জয়?
ছিঃ!
মাংসটা কষাতে কষাতে কদিন আগের কথা ভাবছিল। ইউটিউবে একটা ভিডিওতে একজন বলছিলেন "লাভ ইয়োরসেলফ দ্যা ওয়ে ইউ আর! নিজেকে তুমি যেমন, সেইভাবে ভালোবাসো।" সেটাই নাকি প্রকৃত নারীবাদ। আর আজ ওকে ওর সবচেয়ে কাছের মানুষটা এইভাবে বলল?
রান্না শেষ করে যখন বাইরে এলো ঈশানী, তখন প্রায় দেড়টা বাজে। সকালে উঠে বাসিকাজ সেরে স্নান করেছিল। কিন্তু এখন শরীর অস্থির লাগছে খুব। আবার স্নান করতে হবে।
স্নান সেরে বেরিয়ে একটা নতুন কুর্তি পরল ও। ওর ছোটবেলার পাড়ায় খুব বড় করে পুজো হত এইদিনে। মঠ-ফুটকড়াই প্রসাদ হত। আর ঠাম্মার সাথে কীর্তন শুনতে যেত ও। কীর্তনের পরে আবীর খেলা... মিষ্টিমুখ... ভোগপ্রসাদ নিয়ে বাড়ি ফেরা...এভাবেই দিন কাটত।
আর এখন!
চুল আঁচড়ে একবার দরজা ধাক্কা দিল ঘরের।
"হ্যাঁ..." অরিন্দমের গলা। দরজার বাইরে থেকেই মদ আর সিগারেটের একটা বোঁটকা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
"তোমরা কখন খাবে? দুটো বেজে গেছে।"
"বৌ...স্যরি... বৌদি, আমরা আরেকটু পরে খাব। এখন না।" জড়িয়ে যাওয়া গলায় উত্তর শুনে ফিরে আসে ঈশানী।
তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। অতিথিদের জন্য রাখা প্লেট আর বাটিতে নিজের খাবারটা তুলে নেয়। আর দেরি করবে না ও। পেট চুঁইচুঁই করছে।
"বরফ আছে ফ্রিজে?" বলতে বলতে বেরোয় সঞ্জয়। একটু টলতে টলতে। তারপরেই অবাক হয়ে বলে "একি, তুমি বসে গেলে?"
"কেন? আমার খিদে পেতে পারে না? তোমরা নাহয় চিপস, এটাসেটা খাচ্ছ, আমি তো সেই ব্রেকফাস্ট করেছি। আর, তুমিও এবার ঘর পরিষ্কার করে রুম ফ্রেশনার দাও। তারপর এখানে এসে বসো। খাবার রাখা থাকবে, বেড়ে খেয়ে নিও। সারা সপ্তাহ পরিশ্রম, আজ সকাল থেকে এত খাটনি... আমাকে এবার একটু শুতে দাও..." এতক্ষণের রিহার্সাল দেওয়া কথাগুলো বলে দেয় ঈশানী।
জীবনে এই প্রথম!
মিনিট পনেরো পরে চাদর পালটে বিছানায় শুতে যাবার আগে আয়নায় নিজের দিকে একবার তাকাল ঈশানী।
শুনেছিল, মৃধাসুর বা ম্রেধাসুরকে বধ করে শ্রীকৃষ্ণ ব্রজে ফেরার পরে তাঁকে দোলায় বরণ করে নেন ব্রজবাসীরা। সেই গোপ-গোপিনীদের রং থেকেই দোলযাত্রার সূচনা। ম্যাড়াপোড়ার, যার অপভ্রংশ ন্যাড়াপোড়া, তার সূচনা।
পায়ে পায়ে আয়নায় কাছে রাখা কুমকুমের শিশিটা হাতে তুলে নেয় ঈশানী।
সঞ্জয়ের এই এতদিনের "তুমি মেয়ে, সব কাজ তো তোমাকেই করতে হবে, সব কথা মানতে হবে" শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে গেছিল ও।
আজকের প্রতিবাদ - অসুর বধের চেয়ে কি কম কিছু?
একটু হাসে ঈশানী। তারপর আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে "শুভ দোলযাত্রা ঈশু! এবার জীবনেও রং আসুক...আসুক...আসুক..."