Thread Rating:
  • 31 Vote(s) - 3.39 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
HORROR ভৌতিক সংকলন ২- গোলাপী মনি - সংগৃহীত- লেখনী - অনাহুত- সম্পূর্ণ
#17
                                                   গোলাপী মণি

                                               লেখক-  অনাহূত
 
সময় টা গরম কাল। যেমন তেমন গরম ভেব না যেন। বোশেখের শেষাশেষি হবে হয়ত বা। নদী ,নালা, পুকুর, খাল, বিল সবাই খানিক জলের আশায় আকাশের পানে চেয়ে দিন গুনছে। মানুষজন এর খাবার জলের টান পড়েছে বিস্তর। এই হেন তীব্র গরমে মাঝে মাঝেই পশ্চিমে কালো মেঘের দর্শন পাওয়া যায় প্রায়। তা দেখতে পাওয়া যাচ্ছেও। কিন্তু মেঘ , বৃস্টি হয়ে ঝরে নি এখনো অব্দি। গরম খানা তাই বেশ ভয়ানক রূপ নিয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু মানুষ তো আর বসে থাকবে না! কাজ আছে, আপিস আছে , চাষ বাস আছে, হাট আছে বাজার আছে। সব আছে।

এই তো, বিকেল গড়িয়ে সাঁঝ বেটি চুপি চুপি ঢুকে পড়ল বলে আমাদের কুশীপুরের হাটে। কিন্তু হাট এখনো জমজমাট। ভবেন কাকা এখনো, গোটা পঞ্চাশ তরমুজের গতি করতে পারে নি। রীতিমত গরম হয়ে হাঁকডাক করছে খদ্দের দের। ওদিকে সেলিম চাচা, নিজের পোলট্রির ভালো দেশী মুরগীর বড়াই করে ক্ষান্ত হচ্ছে না। গোটা দশেক সাঁরা এখনো খেলে বেড়াচ্ছে , জাল দিয়ে আপাদমস্তক ঘেরা জায়গা টাতে। বেচতে হবে তো! কালু শেঠ ফাঁকা গুড়ের টিন গুলো গোনার আদেশ দিয়ে, থুতু দিয়ে টাকা গুনছে। ময়না পিসির মুখ টা হাসি হাসি, কারন সব কটা লাউ বিক্রী হয়ে গেছে বোধ হয়। আর ফড়িং? তার সবে কলির সন্ধ্যে। এই হাটের প্রদীপ নিবু নিবু হবে সেই সময়েই তো , সারাদিন খাটা খাটনি করা লোকগুলো পুকুরে হাত মুখ ধুয়ে দুটি কিছু মুখে দেবে। মুখে দিয়ে , জল টি খেয়ে , যে যার ধামে রওনা দেবে। এই সময়ে ফড়িঙের তো চোখের পলক ফেলার সময় থাকে না। লুচি ভেজে ভেজে তার কাহিল অবস্থা হয়। তারপরে ধরুন গিয়ে, পটলা। সে চোর। তার তো দিনেমানে কোন কাজ নেই। আহা আছে , কিন্তু লোকের ট্যাঁক খানা ভারী তো এই সন্ধ্যে বেলাতেই হয়। হয় কিনা? তবে? এই নিবু নিবু হাটেই তার হাত চলে যেন মাখনের মতন। এই ধাক্কা লাগলো, দেখবেন ফতুয়ার পকেট খানা ফাঁকা।

সেদিন হাটের কাজ মিটিয়ে কাশী খানিক টাএগিয়ে গেলো নিজের গরু গুলোর দিকে। আহা সেই আট কোশ যাবে একনো, যাই একটু দেকা দিয়ে আসি গিয়ে নিজের মনে মনেই কথা গুলো ছুঁড়ে দিয়ে কাশী চলে এলো হাটের পশ্চিম দিকে , যেখানে সব গরুর গাড়ি সার দিয়ে দাড় করানো রয়েছে, সেই পানে।
 
হেই যে আমার কেতো আর গনা, আহা বাপ আমার বড্ড কস্ট না রে? আর এই টুকুনি ডাঁড়া বাবারা, আমার হয়ে এয়েছে বলে হাঁক পাড়লো
- বলি সুমুন্দি, শ্বশুরের পো ময়েশ, কেতো গনা কে খাবিয়েচিস বাপ?
 
উত্তর এলো ততোধিক জোরে,
- হ্যাঁ গো হ্যাঁ, ময়েশ কতার খেলাপ করে নে কো, এমন তোয়াজ করেচি, দেকো। চার ঘন্টার পথ দু ঘণ্টায় না পেরলে আমার নামে কুত্তা পুষো ক্ষণ।
 
মহেশের কথায় কাশী হেসে ফেলল
- হ্যাঁ রে , সেই কুত্তাই দেকতেচি, কোন টা তোর নামে পুষতে পারি। অনেক বুগনী দিছিস বাপ, এবারে দেকি, পেটে কিচু দি দুজনে মিলে।
 
ততক্ষণে ছোট একটা মাচা ঘরের পিছন থেকে বেড়িয়ে এলো মহেশ। এক গাল হেসে বলল
- জানো কাশী কাকা, তুমি মানুষ টা বড্ড ভাল। কেউ আমারে কিসুই দেয় না, কিন্তু তুমি আমারে না খাইয়ে হাট থেকে যাবে না আমি জানি। তুমি না এলে আমার ভালো লাগে নে কো।
- হয়েছে হয়েছে এবারে। দুটি দি কিছু পেটে।
 
এই বলে দুজনে পুকুর ঘাটে গেল হাত মুখ ধুতে। গলার গামছা খানা নামিয়ে জলে ভিজিয়ে ভালো করে নিংড়ে নিজের মুখ হাত পিঠ মুছতে লাগলো কাশী। সম্পন্ন চাষী সে। হাটে আসে প্রতি মঙ্গলবার, নিজের জমির ফসল, পুকুরের মাছ, বাগানের সব্জী, সওদা করতে। ভালো মানুষ কাশীর হাতের গুনে তার সব জমি আর গাছ -গাছালি যেন কথা কয়। নিজের সব ভালবাসা উজাড় করে দেয় কাশী ওদের উপরে। আর জমি গুলো নিরাশ করে না কাশী কে। কাশীর ভালবাসা ওরা বোঝে। কাশী কাছে গেলেই, গাছ গুলো তো হালকা হাওয়াতেই মাথা নেড়ে জানান দেয় তারা খুশী।
এই গুন টা কাশী পেয়েছে ওর দাদু হারানের কাছ থেকে। গ্রামের লোক বলে, হারানের জমিতে গাছ গাছালী কথা কইত। যেমন টি হারান চাইত ঠিক তেমন টি হত। একবার তো , ভীষণ তর্ক বাঁধল নবীন কেশের সাথে। নবীনের দাবি ছিল এই এঁটেল মাটির দেশে কেমন করে হারান মিষ্টি ল্যাংড়া ফলাতে পারে দেখি?, ফুঃ, সব জমির কৃপা বুঝলে! হারানের এখানে কোন কৃতিত্ব নেই। যে জমির যে ফসল। তা হারান ফলাক দেখি মিষ্টি ল্যাংড়া!

তো লাগলো সে বিষম তর্ক। এক গাঁ লোকের সামনে লাগানো হলো ছোট্ট চারা। হারান তো দিনরাত এক করে দিয়েছিল বুঝি সেই গাছের জন্য। সে কি আদর সেই ছোট্ট গাছ কে হারানের। কত্ত লোকে শুনেছে হারান গাছের সাথে কথা কইছে মান রাখিস বাপ আমার
পাক্কা তিন বচ্ছর পরে যেদিন ছোট্ট গাছ টিতে আম এলো, হারান সবার আগে নবীন কেই খাইয়েছিল। চারদিকে ধন্য ধন্য পরে গেছিলো। এমন সুগন্ধী আর মিষ্টি আম ভূ-ভারতে কোথাও পাওয়া যাবে নাকি সেই নিয়ে বহু তর্ক বিতর্ক হয়েছিল আশে পাশে দশ টি গ্রামে। 
এই হেন দাদুর নাতি হলো কাশী। কিছু গুন তো পাবেই। সেই গুনের সুবাদে, কাশীর আয় ব্যয় কিছু কম ছিল না। এই হাট ছিল তার কাছে লক্ষ্মী। জীবনে একা হয়ে যাবার পরে এই গাছ-গাছালি ছাড়া , কাশী আর কিচ্ছুটি ভাবে নি। হাটে থেকে দু পয়সা এসেওচে। আর তাই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কাশীর রোজগার। আশে পাশের দশটা গাঁয়ের সম্পন্ন ব্যবসাদার দের সুদে টাকা ধার দেয় কাশী। যে যেমন তার কাছে তেমন সুদ। আর গরীব গুর্বো রা তো মাগনা নিয়ে যায় ওর কাছ থেকে টাকা। কারোর মেয়ের বিয়ে তো কারোর মা বাপের শ্রাদ্ধ। মহেশ মাঝে মাঝে বলে কাশী কে
-     কাকা তোমার টাকা বারো ভুতেই খাবে দেকো তুমি।
কাশী হাসে। কি বা করবে সে। নেহাত ভালবাসে জমি টা কে আর গাছ গুনো কে। তাই না ওরা উজাড় করে দেয়? না হলে কাশীর কি বা আছে ? যা হয়েছে উপরওয়ালার কৃপায়। আর সে কৃপাতে যদি দশ টা লোকের উপকার হয় তা হোক না!
- কাকা পচিম কোন টা দেক একবার।
 
চমক ভাঙল কাশীর মহেশের কথায়। পিঠ টা টেনে টেনে গামছা দিয়ে মুছচ্ছিল কাশী। পশ্চিম কোন টা দেখে থেমে গেল তার পিঠ মোছা। বুক টা হিম করে দিয়ে, কালোর , তস্য কালো মেঘ জড়ো হয়েছে সামান্য। ঠিক যেমন ক্যারম এর পকেট, ঠিক তেমনি। মনে মনে ভাবনা আসে ,আট কোশ পথ বাইতে হবে এখন।
 
- হে রাম-কানাই , ঠাকুর রোজকেরের মতন আজকের মেগ টাও টলিয়ে দাও বাপ।
 
মহেশ বোধ করি শুনতে পেয়েছিল কাশির কথা গুলো। মুখ টা খুব গম্ভীর করে বলল
- কাকা আজকেরে মনে হচ্চে, রাম-কানাই তোমার কতা শুনবে না গো, ওই দেক,কেমন সাদা বক গুলো ফর ফর করচে পচিম কোনে। কাল বোশেখ , বউনি টা আজকেরেই করবে বুজলে কাকা। 
বাস্তবিক , ঝড় বৃষ্টির সব গুলো লক্ষন বর্তমান আজকের মেঘে। নাহ আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। হুড়োতাড়া করে ভেজা গামছা খানা কাঁধে ফেলে মহেশ কে বলল
- ময়েশ, বাপ গরু গুনো জোত দিকিনি। জুতে নিয়ে আয় ফড়িঙের দোকানে। আমি ওকানে কচুরি আর জিলিবি বলে রাকচি। দেরী করিসনি বাপ আর, আয় আয় তাড়াতাড়ি আয়। 
বলে আর অপেক্ষা না করে পুকুরের পাশ দিয়ে কাশী দৌড় দিলো ফড়িং এর দোকানের দিকে। দোকানে পৌঁছে গরম গরম কচুরী আর জিলাপী বলে দিল সে।
- ময়েশ আসে নাই রে কাশী?
- আসতেচে, তুমি ভাজ তাড়াতাড়ি ফড়িং দা
- হাঁ রে বাবা হাঁ, সে আসুক, আসার আগেই দেখবি দিয়ে দিচি আমি।
 
কাশী বারংবার আকাশের দিকে চাইতে লাগলো। নেহাত এই ফড়িং এর দোকানের কচুরী আর জিলাপি কাশী ছাড়তে পারে না তাই, না হলে আজকে দেরী করা ঠিক হচ্ছে না। মেঘ ক্যারমের পকেট আর নেই। কালো হয়ে ধেয়ে আসছে যেন পৃথিবীর বুকে। মনে হচ্ছে ইন্দ্রদেব তার মহা মেঘ দের পাঠিয়েছে তাণ্ডব করতে আজকে। হাটে শশব্যস্ততা। আগাম প্রলয়ের ইশারা সকলেই পেয়ে গিয়েছে যেন। গগন খাস্তগীর প্রচুর শশা নিয়ে বসেছিল। বেচারী শশার বস্তা খান পিঠে ফেলে এমন পিঠটান দিল সে এক দেখবার দৃশ্য হল বটে। ভবেন কাকা শেষ কিছু তরমুজ ক্লান্ত শ্রান্ত গরু গুলোর মুখের কাছে রেখে চম্পট দিল। সেলিম চাচা এখনো মুর্গী গুলোর হিল্লে করতে না পেরে, সে গুলো কে ঝাঁকায় ভরে সাইকেলের কেরিয়ার বেঁধে নিয়ে গোলেমালে সাইকেলের চাবি টাই খুলতে ভুলে গেলো। আর প্যাডেল চাপ দিতেই হুমড়ি খেয়ে পপাত চ।
 - হেই হ্যাট, ডা হা ডা, হেই হেই থাম থাম থাম।
 
তাকিয়ে মহেশ কে গরুর গাড়ি নিয়ে আসতে দেখেই কাশী বলে উঠলো হেই বাপ তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। মেগ গুনো কিন্তু আজকেরে ছেড়ে কতা কইবে না মনে হচ্ছে রে। 
ফড়িং এর দোকান দেখে আবার মহেশের কেমন যেন একটা হয়ে যায়। মা বাপ মরা ছেলে ও। কত দিন পেটে ভাল কিচ্ছু টি পড়ে না। আজকে কাশীর দয়ায় দুটি পেট পুরে খাবে সে। তা খায় বটে দুজনে। দেখার মতন খাওয়া। ফড়িং তো বসে থাকে কখন দুই মক্কেল আসবে খেতে। না না পয়সার জন্য না। অমন খাওয়া দেখেও চোখ জুড়ায় কিনা! মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ধামা খানেক কচুরী আর গণ্ডা চারেক জিলিপী সাবাড় করে দিলো দুজনে। ওরা দুজনে খেতে বসলে কচুরী বেলতে বেলতে আর ভাজতে ভাজতে ফড়িং এর হাত ব্যাথা করে যায়। কিন্তু ফড়িং অখুশী হয় না। এমন মানুষ দের খাইয়েও সুখ। কাশী মানুষ টা ভাল আর মহেশ মা বাপ মরা ছেলে , বললেই অনেক কাজ করে। তা খাক। আরো এক ধামা কচুরীর সাথে গণ্ডা দুয়েক জিলিপী সাবাড় করে যখন ওরা রণে ভঙ্গ দিল , তখন মেঘ গুলো হাট পার করে অনেক টা দূরে বিস্তার লাভ করেছে। এক পেট জল খেয়ে যখন দুজনে মিলে গরুর ল্যাজ টা মুড়িয়ে দিয়ে গাড়ী ছোটাল তখন কালবোশেখী নেত্য করার প্রস্তুতি নিতে সুরু করে দিয়েছে।
[+] 2 users Like nandanadasnandana's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: ভৌতিক সংকলন ১- ভয় - সংগৃহীত- লেখনী - অনাহুত - by nandanadasnandana - 08-03-2022, 11:52 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)