26-02-2022, 12:51 PM
(04-02-2022, 03:10 PM)bourses Wrote:
২৪
লেডিজ হস্টেল – ১
পৃষ্ঠা ওল্টায় পর্ণা ডায়রির… গতকাল যেখানটায় শেষ করেছিল, স্বভাব বশতঃ একটা কাগজের টুকরো গুঁজে রেখেছিল পড়া অবধি অংশে… সেটার থেকেই শুরু করে… তারিখটা আগের দিনের থেকে বেশ কিছুদিন পরের… তবে অনেকটা না, এই মাস খানেকের মধ্যেরই… তবে এটা বেশ বড় লেখা… অনেকগুলো পাতা নিয়ে…
২৪শে জানুয়ারি, রবিবার…
দু-দিন পরেই ২৬শে জানুয়ারি… অন্যান্য বছর বেশ ভালোই কাটে দিনটা… বাড়ির সকলের ছুটি থাকে… কোথা দিয়ে বয়ে যায় বোঝা যায় না… কিন্তু এবারে একেবারেই অন্য রকম কাটবে জানি এই দিনটা… আজ রবিবার, কাল মাঝে একটা দিন, তারপরে আবার একটা ছুটি, তাই অনেকেই এই ফাঁকে বাড়ি গেছে নিজেদের মানুষগুলোর সাথে সময় কাটাতে… আমার এই ঘরে রুমমেট দুজন… তারাও নেই… গতকালই বিকেলে ট্রেন ধরেছিল বাড়ি যাবার জন্য… আমায় বলেছিল, সাথে যেতে… এই দুটো দিন ওদের ওখান থেকে ঘুরে আসতে, কিন্তু আমিই রাজি হই নি… সদ্য আলাপ… আর তাছাড়াও, ভালোই লাগছিল না… মনটা ভিষনই উচাটানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে… দুম করে জেদের বসে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি এখানে, হোস্টেলে… কিন্তু যে বাড়িতে আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে, সেখানটা চট্ করে কি ভোলা যায়? অতঃ কিম্… কিছু করার নেই… আমি জানি, এটাই আমার সব থেকে বড় দোষের… কিছুতেই নিজের রাগ, নিজের জেদ আয়ত্তে রাখতে পারি না… রাগ হলে তখন যেন আমার কি একটা হয়… বোধহয় একেই বলে রাগের বশে বুদ্ধিভ্রংশ… এখন আর সে সব ভেবে লাভই বা কি? যেটা ঘটার সেটা ঘটে গিয়েছে, সেটা নিয়ে এখন আফসোস করার কোন যুক্তিই দেখি না… আর আফসোস করবই বা কেন? ভুল কি আমি করেছি নাকি? আমায় না খোঁচালে, আমার উপরে ওই ভাবে উনি, মানে ওই ভদ্রমহিলা, নিজের কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করলে কি আমি আসতাম এই হোস্টেলে থাকতে? কি ভাবে থেকেছি আমি, আর এখনে এসে কি ভাবে রয়েছি… নাহঃ… মোটেই ভুল করি নি… ঠিকই করেছি… আমি এমনই… তাতে যত কষ্টই হোক না কেন… বুঝতে কাউকেই দেব না… কি হয়েছে এই ভাবে আছি তো? হাজারটা মেয়ে এই ভাবে বছরের পর বছর ধরে হোস্টেলে থেকেই তো ডাক্তারী পাশ করে বেরিয়েছে… এই তো… আমার রুমমেটই দুজন… সেই কোথা থেকে… একজন মেদিনিপুর থেকে এসেছে, আর অন্য জন উত্তর বঙ্গ থেকে… আলিপুর দুয়ার না কোথায় যেন বাড়ি ওর বলেছিল… তাহলে? বাড়ির সবাইকে ছেড়ে তারাও তো এখানে দিব্বি আছে… তাহলে আমি কি এমন মহিয়শী? হ্যা… মানছি… বড় হয়েছি প্রাচুর্যে, আরামে… তো? তাতে কি হলো? এই আরাম, এই প্রাচুর্য তো ক্ষণস্থায়ী… কখন আছে, আর কখন নেই, তা কি কেউ বলতে পারে? আমরা এই জগতে কতটাই না তুচ্ছ… প্রকৃতির সামান্য এতটুকু অঙ্গুলি হেলনে কতশত লোকের প্রাণ নিমেশে খড়কুটোর মত হারিয়ে যায়… কত লক্ষ্য কোটির সম্পত্তি ধূলিস্যাত হয়ে যায় পলকের মধ্যে… সেখানে এ হেন কৃচ্ছসাধন বরং বলবো প্রয়োজন… এটা সকলেরই করার দরকার… কৃচ্ছসাধন না থাকলে সাফল্যের শির্ষে ওঠা যায় নাকি?
তবে এখানে আসার পর বেশ একটা মজার ব্যাপার ঘটে গিয়েছে… ঘটনাটা ঘটেছে এই কিছুদিন আগে অবস্য… কিন্তু সেটার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল এখানে আসার দিন থেকেই… একটু বিশদেই লিখি বরং...
আমি যখন এসে হোস্টেলে হাজির হলাম, তখন সেমেস্টার শুরু হয়ে গিয়েছে বেশ ক’মাস আগেই… আগে তো বাড়ি থেকেই আসা যাওয়া করছিলাম… কিন্তু ওই যে… আগে যেটা বললাম… রাগ আর জেদ… তার ফল স্বরূপ এখানে এসে ওঠা… সাধারণতঃ এই সময়টা হোস্টেলে রুম পাওয়া ভাগ্যের কথা… হয়ও না বোধহয় সচারাচর… কিন্তু দাদুর দৌলতে, মন্ত্রী আর আমলার সাথে হৃদ্যতা থাকার কারণে, আমার রুম পেতে অসুবিধা হলো না…
এখানে লাগেজ পত্তর নিয়ে এসে হাজির হয়ে দেখলাম আমার রুম অ্যালটেড হয়েছে তিন তলায়… করিডোর ধরে একেবারে শেষের রুমটা… তবে খারাপ না… বেশ খোলা মেলা… এক দিকে বেশ বড় বড় জানলা রয়েছে দুটো… ওটা দিয়ে বাইরের ব্যস্ত রাস্তার লোকজনের আনাগোনা দেখা যায় বেশ… যখন এসে পৌছেছিলাম, তখন প্রায় বিকেল হবে… তাই জানলার বাইরে তখন শহরের বুকে পড়ন্ত শীতের সন্ধ্যে ঘনাবার তোড়জোড় শুরু হয়েছে… দিগন্ত থেকে সূর্যদেব তার দিনের মত শেষ রশ্মিকিরণ ছড়াবার চেষ্টায় রত… গরমটা তখনও সেই অর্থে পড়েনি… একটা বেশ সিরসিরানি আবেশ…
তা নীচে অফিসঘরে যাবতীয় রীতিটিতি সারা হলে হোস্টেল সুপারিন্টেন্ড স্যর বেল বাজাতে একটা বাচ্ছা মত ছেলে এসে হাজির হয় ঘরে… দেখে খুব বেশি হলে এই চোদ্দ কি পনেরো হবে… রোগা পাতলা চেহারা… মুখটা বেশ মিষ্টি… সারল্যে ভরা… পরে জেনেছিলাম যে ওর নাম নন্দ, ও এই হোস্টেলেরই রাধুনির ছেলে…
তা সে যাই হোক… ছেলেটি এসে একবার আমায় পা থেকে মাথা অবধি জরিপ করে নিল যেন… ওর চোখ দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে বছরের এই সময় নতুন আগুন্তুক সম্ভবত সে দেখেনি এখানে, তাই হটাৎ করে নতুন অতিথির আগমনে একটু উৎসুক বলা যেতে পারে… আমি ওর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি গায়ে মাখলাম না… ফর্মে যেখানে যেখানে আর সব সই করা বাকি, সেগুলো সেরে ফেলতে থাকলাম…
সারা হলে উঠে দাঁড়াতে নন্দ আমার পাশে এসে দাড়ায়… “দিদি! তুমি এখানে থাকবে?”
মাথা নাড়ি আমি… “হু… কেন?” ঘুরিয়ে প্রশ্ন করি তাকে…
সেও আমার কথায় মাথা নাড়ে দুই পাশে… “না না… এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম…” তারপর ফিরে সুপারিন্টেন্ডের দিকে প্রশ্ন করে, “দিদিকে কোন রুমে নিয়ে যাব?”
নন্দকে বলে দেন সুপারিন্টেন্ড… শুনে মাথা হেলায় নন্দ… “ও হ্যা… ওখানে তো একটা বেড খালিই আছে… দুটো দিদি আছে এখন… তাই তো?” তারপর আমার দিকে ফিরে বলে, “চলো দিদি… তোমায় পৌছে দিয়ে আসি…” বলেই আমার কিছু বলার আগেই আমার পাশে থাকা লাগেজগুলো থেকে একটা ব্যাগ মাথায় তুলে নিলো, একটা ঝোলালো কাঁধে, একেবারে অভ্যস্থ ভঙ্গিতে… বুঝলাম ওই এই ভাবে এখানকার হোস্টেলের বোর্ডারদের ঘরে পৌছে দিয়ে আসে… তাই কি কখন করতে হবে, সেটা বলে দিতে হয় না আর…
আমি বাকি ব্যাগের একটা পীঠে নিলাম, আর আরেকটা হাতে ঝুলিয়ে ওর পেছন পেছন সিড়ি বেয়ে উঠে এলাম উপরে… তখনও বোধহয় ক্লাস চলছিল, তাই হোস্টেলে খুব একটা বোর্ডারদের ভীড় চোখে পড়লো না আমার… দুই একজন রয়েছে এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে… শুধু দেখলাম যারা রয়েছে, তারা চোখ দিয়ে ভালো করে মেপে নিচ্ছে আমায়… দুই একজন আমারই ব্যাচের, তাই চোখাচুখি হতে ঘাড় নাড়ে তারা মৃদু হাসে, আমিও প্রত্যুত্তরে হাসি তাদের দিকে তাকিয়ে, পথ চলতে চলতে নন্দ নামক ছেলেটির পিছু পিছু…
বারান্দার একেবারে শেষ মাথায় আমার রুম…দরজাটা ভিতর থেকে ভেজানো ছিল… সাধারনতঃ আমরা কি করি? দরজা ভেজানো থাকলে বাইরে থেকে একটা নক করি, সেটাই তো ভদ্রতা বলেই জানি… কিন্তু নন্দ দেখলাম সে সবের কোন ধার ধারলো না… সোজা দরজা খুলে ঢুকে পড়লো ঘরের মধ্যে… ওর কান্ড দেখে আমিই বরং একটু অস্বস্থিতে পড়ে গেছি… ভাগ্য ভালো যে ঘরে সেই মুহুর্তে কেউ নেই… তবে এটাও অবাক কান্ড… ঘরে কেউ নেই, অথচ দরজায় লক নেই? একটু আশ্চর্যই হলাম আমি…
ঘরের মধ্যে সর্বসাকুল্যে তিনটি খাট পাতা… খাট না বলে কাঠের তক্তপোষ বললেই ঠিক বলা হয়… তাতে দেখে যা বুঝলাম দুটিতে দুই জনের দখলে রয়েছে…একটি তক্তপোষ খালি… প্রতিটা তক্তপোষের মাথার কাছে একটি করে কাঠের আলমারীর মত বস্তু… তার পাল্লাগুলো প্রায় খুলে বেরিয়ে আসার জোগাড়… একটা করে কাঠের ২ ফুট বাই ৩ ফুটের টেবিল আর সেই সাথে একটা কাঠের রঙ চটা চেয়ার, টেবিলের দুই পায়ের মাঝে ঢুকিয়ে রাখা… মাথার উপরে দুটি ফ্যান আর দেওয়ালে একটি টিউব লাইট… তবে একটা জিনিস দেখে ভালো লাগলো, বিছানার চাদরটা বেশ পরিষ্কার… টানটান করে পাতা… তবুও ভালো যে অন্তত শোয়াটা যাবে একটু ভালো করে…
নন্দ আমার ব্যাগগুলো কাঠের টেবিলটার উপরে রেখে ঘুরে দাঁড়ালো… “তুমি থাকো… অন্য দিদিরা নিশ্চয়ই বাইরেই আছে, এখুনি এসে পড়বে… আমি চললাম…” বলে চলে যাবার উপযোগ করে সে…
আমি তাড়াতাড়ি হাত তুলে তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করি, “আচ্ছা নন্দ… তুমি যে এই ভাবে দুম করে ঘরের দরজা না নক্ করেই ঢুকে পড়লে, যদি কেউ থাকতো? মানে যতই হোক, মেয়েদের ঘর…”
আমার কথা শেষ করতে দেয় না নন্দ, তার আগেই সব কটা দাঁত বের করে হেসে ওঠে সে, “হে হে… দরজা ভিজানো রয়েছে, অথচ ঘরে তালা নেই, মানেই তো ঘরে কেউ নেই… এটা কি বুঝতে হবে নাকি নতুন করে?” তারপর একটু থেমে বলে, “আর থাকলেই বা! আমি ঢুকে পড়লে দিদিরা কিছু মনে করে না…”
আমি ওর কথায় অবাকই হই… “মানে? মনে করে না?”
“করে নাই-ই তো… আর করবেই বা কেন? আমায় দেখে দেখে ওদের অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই কিছু মনে করে না আর…” সপাট উত্তর দেয় নন্দ…
ততক্ষনে আমার মাথা বেশ গুলিয়ে গিয়েছে… নারী সুলভ কিছু প্রশ্ন তখন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু এর পর আর কি প্রশ্ন করা যায় কি না সেটা ভাবতে ভাবতেই দেখি নন্দ ততক্ষনে দরকার ওপারে পৌছে গিয়েছে, তাই আমিও আমার প্রশ্নে ছেদ টেনে নিজের খাটের দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম… কোথা থেকে কি ভাবে শুরু করবো, সেটাই দাঁড়িয়ে ভাবার চেষ্টায়…
একটা বেশ ভালো জিনিস পেয়েছি দেখলাম, সেটা হলো আমার বিছানার ঠিক মাথার কাছেই একটা বেশ বড় জানালা… বাইরের রাস্তার দৃশ্যটা বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে… সেই সময় বিকালের ব্যস্ত কলকাতার রাস্তার শব্দ আছড়ে পড়ছে ঘরের মধ্যে জানালা গলে… কোন দিক হবে এটা? উত্তর নাকি পূর্ব?
আন্দাজ করার আগেই পেছন থেকে গলার শব্দে সম্বিত পাই আমি, “আচ্ছা… তুমিই নতুন বোর্ডার আমাদের ঘরের?”
ঘুরে দেখি দুটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের মধ্যে… খুব একটা লম্বা নয়, আমার থেকে বরং অনেকটাই বেঁটে বলা যেতে পারে, কিন্তু বেশ সাধারণ মিষ্টি মিষ্টি মুখ, দুজনেরই… পরনে দুজনেরই সালোয়ার কামিজ… গায়ের উপরে আড়াআড়ি করে রাখা ওড়না… দেখি আমায় আপাদমস্তক দেখছে তারা দুজনে… আমার পরনের জিন্স আর লুজ শার্টএ যেন আমিই বরং মনে হচ্ছে কোন গ্রহ থেকে এলাম… কারন সাধারনতঃ মেয়েরা জিন্স শার্ট পরে থাকে না এখানে… সেটা বুঝেইছি আমি… তাই, আমার পোষাক আষাক যে ওদের কাছে একটু অন্য ধরণের ঠেঁকেছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না… তার উপরে মাথার চুলগুলোকে একটা উঁচু করে পনিটেলে বেঁধে রেখেছি… মুখে প্রসাধনের কোন লেশমাত্র নেই… আর সেই সাথে আমার শরিরী কাঠামো বা উচ্চতা, সেটা অনেকের কাছেই যে ঈর্ষণীয়, সেটা তো জানতামই…
ওদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে নিজের বিছানায় বসল, অপরজন তখন দাঁড়িয়েই রইল… যে বসল, সে আমার দিকে ফিরে প্রশ্ন করল, “নাম কি তোমার?”
“চন্দ্রকান্তা… চন্দ্রকান্তা চৌধুরী…” উত্তর দিই আমি…
“হুম… বাড়ি?” এবারের প্রশ্নটা অপর মেয়েটির…
“এই কলকাতাতেই…” চুপ চাপ প্রশ্নের উত্তর দিই ফের…
কলকাতা শুনে ভ্রূ কোঁচকায় দুজনেরই… “কলকাতায় বাড়ি, অথচ মেসে? কেন?”
“আসলে বাড়ির একটু অসুবিধা ছিল, তাই বাধ্য হয়েই এখানে উঠে আসা…” শান্ত গলায় উত্তর দিই আমি ওদের…
শুনে মাথা নাড়ে দুজনেই… তারপর যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল… সে দু পা এগিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়… স্মিত হেসে বলে, “ভালোই হলো, আর একজন বন্ধু পেলাম আমরা…” বলতে বলতে আমার কাঁধে হাত রাখে সে, “আমি, সুজাতা… মেদিনিপুরে বাড়ি…” তারপর অপর মেয়েটির দিকে আঙুল তুলে দেখি বলে, “আর ও… সুচরিতা… আলিপুর দুয়ার, নর্থ বেঙ্গল…”
আমি দুজনের দিকেই হেঁসে মাথা দোলাই…
“কোন ইয়ার তোমার?” প্রশ্ন করে ফের সুজাতা নামের মেয়েটি…
“এই তো… ফার্স্ট ইয়ার…” উত্তর দিই আমি…
“আমাদের দুজনেরই সেকেন্ড ইয়ার চলছে… বেশ… ভালোই হল… আমরাও তোমার সিনিয়র ঠিকই… কিন্তু যেহেতু আমরা একই ঘরে থাকবো, তাই আজ থেকে আমরা সবাইই বন্ধু… ঠিক আছে?” পাশ থেকে সুচরিতা বলে ওঠে…
আমিও নিশ্চিন্ত হই ওদের কথায়… নতুন জায়গায় এসে ঠিকঠাক রুম মেট পাওয়াও ভাগ্যের কথা… ওদের দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার, যে ওরা সত্যিই ভালো মেয়ে… আমার বরং অনেকটাই সুবিধা হলো ওদেরকে আমার রুম মেট পেয়ে…
“নাও… তোমার আলমারিটা গুছিয়ে নাও… পরে কথা হবে’খন…” বলে ওঠে সুচরিতা… আমিও মাথা নেড়ে ঘুরে নিজের ব্যাগে হাত দিই…
“এখানে চন্দ্রকান্তা বলে কে আছে?” মেয়েলি গলার আওয়াজ পাই পেছন থেকে… ঘুরে দেখি আর একটি মেয়ে ঢুকেছে ঘরে, তারও পরণে সালওয়ার কামিজই রয়েছে… মোটা, কালো… দেখতেও বদখত যাকে বলে আর কি… গলার স্বরটাও সেই মতই কেমন বিচ্ছিরি ফ্যাঁসফ্যাসে…
সুচরিতারা কিছু বলার আগেই আমি উত্তর দিই মেয়েটির প্রশ্নে… “আমি… আমি চন্দ্রকান্তা…” তারপর ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করি ফিরিয়ে, “কেন?”
মেয়েটি আমার প্রশ্ন দেখি বেশ বিরক্ত হয়… চোখে মুখে সে বিরক্তির প্রকাশ ঢাকার কোন চেষ্টাই করে না সে… আমার সুঠাম দেহটাকে আপদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় একরাশ অবজ্ঞা মেশানো দৃষ্টিতে… তারপর তাচ্ছিল্লের মুখে উত্তর দেয়… “চল্… নিরাদি ডাকছে… একবার দেখতে চেয়েছে তোকে…”
ওর মুখের অভিব্যক্তির কোন গুরুত্বই দিইনা আমি… সোজা ওর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করি, “কে নিরাদি? আর আমাকেই বা ডাকছে কেন?”
আমায় এ ভাবে প্রশ্ন করতে দেখে এবার অবাক হবার পালা যেন ওরই… চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে মুখ ফেরায় সুচরিতাদের দিকে… “এটা কে রে? কোন ভাগাড় থেকে এসেছে? নিরাদি কে, সেটা জিজ্ঞাসা করছে?”
বিছানায় বসা সুচরিতা তাড়াতাড়ি উঠে এসে দাঁড়ায় মেয়েটির সামনে, “না না শর্মিলাদি… ও আসলে এই আজকেই এসেছে তো… মানে সবেই বলতে পারো, তাই এখনও আমরা ওকে জানাই নি সব কিছু…” তারপর একটু থেমে বলে, “ও তুমি ভেবো না, আমরা ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি নিরাদির কাছে… তুমি যাও, ও আসছে…”
সুচরিতাকে একবার দেখে নিয়ে মুখ ফেরায় আমার দিকে, তারপর আমায় ফের মাথা থেকে পা অবধি চোখ দিয়ে মেপে নিয়ে বলে ওঠে, “হ্যা… বলে দিস কে নিরাদি… আর একটু বুঝিয়ে পাঠাস… নিরাদি আমি নই যে এই সব আংসাং কথা হজম করে নেবে…” বলে আর দাঁড়ায় না… একটা জলহস্তির মত থপথপ করতে করতে বেরিয়ে যায় ঘরের থেকে…
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সুচরিতার পানে… ও আমাকে তাকাতে দেখে এগিয়ে আসে আমার দিকে, “ও, শর্মিলা… থার্ড ইয়ার…”
আমি মাথা নাড়ি, “সেতো না হয় হল, কিন্তু এই নিরাদিটা কে?” প্রশ্ন করি আমি সুচরিতাকে…
সুচরিতা একটা বড় শ্বাস টেনে বলে, “ওও আমাদের সিনিয়র দিদি… বলতে পারিস এখানে মানে এই হোস্টেলে নিরাদি আর সুমিদির কথাতেই চলে সব কিছু… ওরাই নিজেদের বস্ মনে করে এখানে… তাই যারাই প্রথম আসে, তাদের ওদের কাছে গিয়ে দেখা করে আসতে হয়…”
“কেন?” আমি ঠিক ঠাওর করতে পারি না ওর কথার মানে… “হটাৎ করে ওদের সাথেই বা আমায় গিয়ে দেখা করতে হবে কেন? আমি তো এখানে এসেছি থেকে পড়াশুনা করার জন্য… তার মধ্যে ওদের কি মতলব আছে?”
“বোকার মত কথা বলিস না চন্দ্রা… এখানে থাকবি, আর সিনিয়রদের কাছে গিয়ে দেখা করবি না?” আমার বোকার মত প্রশ্ন দেখে বিরক্ত হয় সুচরিতা… “এখানে থাকতে গেলে ওদের কথা শুনে চলতে হয়… এটাই এখানের দস্তুর…”
এবার অনেকটাই যেন পরিষ্কার হয় আমার কাছে… বুঝতে পারি, যে এতদিন হোস্টেলের যে সব কার্যকর্মের কথা শুনে এসেছি, এটা সেটাই… সিনিয়রদের জুনিয়রদের উপরে খবরদারী… “বুঝেছি… ওরা আমায় rag করবে… তাই তো?”
কাঁধ ঝাঁকায় সুচরিতা… “যে ভাবে কথাটা ভাবিস তুই…” তারপর একটু থেমে বলে, “কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখিস, এখানে থেকে ওদের সাথে কোন পাঙ্গা নিতে যাস না… তোকে দেখে কিন্তু আমাদের যেটা মনে হল, যে তুই একটু টেঁটিয়া টাইপের মেয়ে… সেই টেঁটিয়াগিরি যদি এখানে দেখাতে যাস, তাহলে কিন্তু তোর জিনা হারাম করে ছেড়ে দেবে এরা… আর যদি একটু ওদের মত করে চলিস, তাহলে দেখবি কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে… বেশি ঘাঁটাবে না আর তোকে… এবার তোর যা উচিত বলে মনে হয়, করিস… তবে তোকে একটা কথা বলতে পারি, ওরা কিন্তু এমনি তে ভালো খুব, খুবই হেল্পফুল… কিন্তু ওই যে, যেটা বললাম, একটু ওদের কথা শুনে চলতে হবে প্রথম প্রথম, এই আর কি…”
সুচরিতার কথায় স্পষ্ট হয়ে গেলো আমার, যে সত্যিই আমি ragged হতেই চলেছি… আমি জানি, এই সব নিরা টিরা এক ফুৎকারে আমি উড়িয়ে দিতে পারি, কিন্তু এটাও ঠিক, যেটা সুচরিতা বলল, শুধু শুধু শত্রুতা বাড়িয়ে কাজ নেই এখানে পড়তে এসে… কারণ আমাকে থাকতে হবেই এখানে, আর এদের নিয়েই চলতে হবে… দেখিই না… কি করে আমায় নিয়ে ওরা… আমি সুচরিতাকে প্রশ্ন করলাম, “কখন যেতে হবে আমায়?”
ও নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এখন যাস না… ওরা সবে এসেছে, তুই একটু পরে, সন্ধ্যের দিকে যা… তাতে ওরাও একটু রেস্ট নিয়ে নেবে, বেশি ঘাটাবেও না তোকে… যা জিজ্ঞাসা করে, বলবি, যা করতে বলে করবি…” তারপর ফের একটু থেমে বলে, “মাথা ঠান্ডা রাখিস প্লিজ… মাথা গরম করিস না ওদের সাথে…”
আমি মাথা নাড়ি… “না… করবো না… চেষ্টা করবো মাথা ঠান্ডা রাখার…” বলি সেটা, কিন্তু শক্ত হয়ে ওঠে হাতের পেশিগুলো আপনা থেকে… ভেতর থেকে যেন দর্পনারায়ণের রক্ত মাথা চাড়া দেবার চেষ্টা করে ওঠে… নিজেকে সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি আমি ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে…
ক্রমশ…
নতুন শুরু। বেশ একটা থ্রিলার থ্রিলার ভাব পাচ্ছি