25-02-2022, 05:48 PM
আগের পর্বের কিছু অংশ ......
আমার ভাগ্যেই এই আবাল জুটেছে। জুটতে তো পারত বয়স্ক একটা লোক, যাকে এই সব বোঝাতে হতো না। ছেলে কে সামান্য দেওয়ালের দিকে সরিয়ে দিলাম। নিজে মাঝে এসে রাকার মাথার কাছে বসলাম। রাকাকে বললাম,
- কি ব্যাপার কি তোর? বার বার হাতে হাত দিচ্ছিলি কেন? তোর মনে হচ্ছে না, তুই এবারে বেশী চাইছিস আমার কাছে। আমি কেন এই গুলো মেনে নেব তুই আমাকে বল?
শেষ পর্ব (সাতাশ)
আমার দিকে ফিরে একেবারে উঠে বসে পরল। চুপ করে রইল। আমাকে দেখছিল ও হাঁ করে একপ্রকার। আমি জানিনা এটা ওর আমার উপরে ভালবাসা নাকি, সেদিনে সিনেমা হলে আমার দেখার মতন ভোগ বাসনা। যেটাই হোক, আজকে ও দুটো তেই বৈধতা অর্জন করেছে আমি সেটা জানি। কিন্তু আমাকে ওর সাথে কথা শেষ করতে হবে আজকে। ও তো চিরকাল ই আমাকে ইম্প্রেস করেছে। দেখি এবারে কি করে ও। আমিও ওর কাছে ইম্প্রেসড হবার মুডে নেই আর। ও অনেকক্ষণ পরে আমাকে বলল,
- প্লিস শিব মেনে নে না রে!
আমি ঠান্ডা ছিলাম। তৈরি হয়েই ছিলাম আমি। কারন আমি বুঝে গেছি, ওর সাথে এই ইগোর লড়াই এ আমি হেরে ভুত হয়ে গেছি। কারন আমার ছেলে। আমি যত ইগো দেখাব আমার ছেলে তত ভুগবে এখানে। আমি সব ভুলে যাব। ছেলের জন্যেই ভুলে যাব। কিন্তু আমাকে জানতে হবে, ও কত টা সিরিয়াস। না হলে আমি আবার জড়িয়ে পড়ব ওর সাথে। আবার আমাকে ও কষ্ট দেবে। তাই জিজ্ঞাসা করলাম
- কেন? কেন মানব? একটা কারন তো বল আমাকে তুই রাকা। দ্যাখ তোর নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ, প্রতিপত্তি কিছুতেই আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। বলতে তোকে কোন অসুবিধা আমার নেই যে, এই গুলো আমার কাঙ্খিত ছিল না। কোন দিন ই তোর অর্জনের উপরে আমার লোভ ছিল না। কিন্তু সেদিনের পরে আমি কেন এই গুলো মানব? আমি আজকে উত্তর চাই রাকা।
আবার ও চুপ করে গেল। আমি জানি ওর কাছে কোন উত্তর পাওয়া যাবে না। ও উঠে এসে পা ঝুলিয়ে বসল আমার পাশেই। বলল
- কেন চাস এই সবের উত্তর তুই শিব?
ও পাশে বসতেই সেই ঝিম ধরা গন্ধ টা আমার নাকে এসে লাগল। আমি ওর পাশ থেকে উঠে গেলাম। একটা চেয়ার এনে ওর সামনেই বসলাম চেয়ারে। আর ও বিছানায় মুখোমুখি বসে রইল আমার। চোখে জল এসে গেছে ততক্ষনে আমার। ঘরে নাইট ল্যাম্প জ্বলছে তাই, হয়ত এখনি ও আমার চোখের জল দেখতে পাবে না। বললাম,
- জানতে চাই আমি। এই জন্য জানতে চাই, যে ছেলেটা আমাকে কোন দিন সামান্য কষ্ট দেয় নি। সে সেদিনে আমাকে কি ভাবে অতো কষ্ট দিলো। কি হয়েছিল তার সেদিনে? এই রহস্য আমাকে ভেদ করতেই হবে।
রাকার মধ্যে এতক্ষন যে ছেলে মানুষি টা ছিল সেটা যেন উধাও হয়ে গেল একেবারে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
- কেন সেই বাজে দিন গুলোর কথা ভাবছিস শিব? শুধু এই টুকু মনে রাখ, সেদিনে হয়ত তোকে আমি তোর মতন করে ভালবাসিনি, কিন্তু আজকে সন্দেহ করিস না প্লিস।
কথাটা শুনে আমি কেঁপে গেলাম। আমি কোন দিন ও ওকে সন্দেহ করিনি। আর এটা আমার সন্দেহ নয়। এটা আমার জিজ্ঞাস্য। আমি এই সব স্টেজ পেরিয়ে এসেছি। ও যতই আমার বয়সী হোক, আমার মতন মনোবৃদ্ধ ও নয়। আমার যা উপলব্ধি, ওর সেই উপলব্ধি এখনো হয় নি। আজকে আমার আত্মা পুড়তে পুড়তে শেষে এসে গেছে। তাই জানি, ওকে আমি ভালবাসি। কাজেই ওর এই ভালবাসার উপলব্ধি টা কত খানি স্থায়ী সেটা আমাকে না বুঝলে চলবে কেমন করে? যতদুর আমি গত একমাসে খবর নিয়ে বুঝলাম,গত তিন বছর ও খুব বাজে খেলেছে। ওকে না বুঝতে পারলে, ওকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে না নিয়ে গেলে, ওর কেরিয়ার এই বছরেই শেষ। আর এটা ওর প্রাইম টাইম। আঠাশ বছরে একটা ফুটবলার, জীবনের সব থেকে বেস্ট শেপ এ থাকে। আগামী দু বছর ওর বেস্ট টা ওর ক্লাব আর দেশ দু পক্ষের ই পাবার কথা। ওর কথায় কেঁপে উঠেছিলাম আমি। না , আমি ওর তখন কার ভালবাসাতেও সন্দেহ করিনি, এখন কার ও করি না। বরং এখনকার থেকে আমার ছোট বেলার রাকার ভালোবাসা অনেক বেশি ছিল। হয়ত তাতে ভাবনা ছিল না, কিন্তু একটা নিখাদ ভালবাসা ছিল। কথায় কথায় ও শিবের জন্য ঝামেলায় জড়িয়ে পরত। বরং এখন ও অনেক কম এক্সপ্রেস করে। ওকে বললাম,
- না আমি কিছুই সন্দেহ করছি না রাকা। হয়ত এর পর থেকে আমি আর কোন দিন এই রকম সিরিয়াস কথা বলব না। আবার হয়ত ঝগড়া করব তোর সাথে। আমাদের ছেলেকে নিয়ে সংসার করব আমরা। আমি তোর বউ হয়ে যাব আর তুই আমার স্বামী। কিন্তু আজকে, সেই দিনের এক অসফল প্রেমিকা আর তাকে না চাওয়া প্রেমিক হয়ে কথা বলে নি?
রাকা শুনে চুপ করে গেল। হয়ত বুঝতে চেস্টা করছে আমি কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছি আলোচনা টা। কিন্তু আজকে ও পালাবার মুডে নেই। বরং রেডি হয়ে বুক পেতে দাঁড়ালো। হয়ত এই ঠান্ডা মানসিক যুদ্ধ টা আমার মতন ও ও নিতে পারছে না। আমাকে বলল,
- কেন বলবি না কেন সিরিয়াস কথা?
- কারন আমি তোকে মেনে নিয়েছি আমার জীবনে রাকা। তোকে কোন শর্ত রাখতে হবে না আর। কারন আমি মেনে নিয়েছি তুই যা চাইবি আমি তোকে দেব। ব্যস তুই ই আমার জীবনে প্রথম পুরুষ। আর তুই ই একমাত্র। মেয়ে হবার আগেও তুই ছিলিস আমার বন্ধু। মেয়ে হবার পরেও তুই একমাত্র বন্ধু, সখা,…
কথাটা শেষ ও হলো না রাকা বলতে শুরু করল
- আয়না, আমার আমি, ইশ্বর, কৃষ্ণ,সাথী, সাফল্য,দুঃখ আর সর্বস্ব।
চমকে উঠলাম আমি। এই গুল সেই কথা গুলো যেগুলো ওকে আমি বলেছিলাম যেদিনে ও আমাকে প্রপোজ করেছিল পোড়ো বাড়িতে। বুঝি আমি, ওর এই সব ছোট ছোট মুড়কি তেই আমি কাত হয়েছি সারাটা জীবন। আমি কিন্তু চুপ করলাম না। এই টুকু তে থেমে গেলে চলবে না আমার। আমি থামলাম না, শুরু করলাম,
- আমার মন শুধু তোকেই দিয়েছি আমি। মাঝে পুরুষ আসতে চায় নি এমন না রাকা। আমি চেস্টাও করেছিলাম রে। কিন্তু জানিনা কেন, মনে তোকে ছাড়া আমি কাউকেই জায়গা দিতে পারিনি। বুঝে গেছিলাম, মন জুড়ে তুই ই আছিস, নানা রূপে। কখনো আমাকে রক্ষা করছিস, কখনো ভালবেসে অন্ধকারে জাপটে ধরছিস, বা কখনো আমার শরীর টা ঘাঁটছিস ইচ্ছে মতন। আমার জীবনে তুই ছাড়া কেউ নেই রে! তুই শুধু আমাকে একটু মানিয়ে নিস।
এতো দূর শুনে রাকা যেন ছটফট করে উঠল। আমার এই অকপ্ট স্বীকারোক্তি যেনো ও নিতে পারছে না। আমার , মানিয়ে নেবার অনুরোধ যেন ও সহ্য করতে পারল না। বসেছিলো ও। ওর অনুতাপের আগুন ওকে চকিতে দাঁড় করিয়ে দিল। মুখে একটা শুধু বোবা আওয়াজ যেন। ছোট নালা দিয়ে বেরোনোর সময়ে বিশাল জলরাশির যা দশা হয়, রাকার ও অব্যক্ত কথার তুফান মুখ দিয়ে না বেরিয়ে চোখের জল দিয়ে বেরোল।কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ও আমার নীচে হাঁটু মুড়ে বসে। আমার কোমর টা কে জড়িয়ে ধরল ও সজোরে। কিন্তু আমি পারছি না ওর চুলে হাত দিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিতে। ইচ্ছে করছে,ওকে জড়িয়ে ধরি। ইচ্ছে করছে ভাবতে এটা রাকার ভালোবাসাই। ইচ্ছে করছে ওর চোখের জল মুছিয়ে বুকে টেনে নি আমি। কিন্তু মন মানছে না। ছেলে নামক একটি ভয়ানক স্রোত এই অনুতাপের জন্ম দেয় নি কে বলতে পারে? আমি তো ভগবান নই। কাজেই ছেলেই যদি এই অনুতাপের জন্মদাতা হয়, তাহলে রাকার সাথে আমি কেন এই ভালবাসার সংসার টা বাঁধব? ওকে বলে দেব, আমি ছেলের মা হয়েই থাকব। কিন্তু ওর কোন বাধা নেই জীবনে। ওকে ভালবাসলেও, মেনে নেব, ওকে পাওয়া আর এই জীবনে আমার হবে না। হাত দুটো কে ইচ্ছে করেই ওর মাথায় আমি দিলাম না। তুলে রইলাম। রাকার মাথা আমার কোলে। আমিও ঝুঁকে আছি। আমার খোলা এলো চুল সামনের দিকে এসে আমার মুখ ঢেকে রাকার পিঠে পরে রয়েছে। আমি বলতে শুরু করলাম,
- কিন্তু আমাকে জানতে হবে, সেদিনের কথা। আমি আজকেও বিশ্বাস করতে পারি না সেই দিন টা। আমি আজকেও ভাবি সেটা একটা দুঃস্বপ্ন। হয়ত তাই বিশ্বাস করতাম আমি, যে ওই দিন টা ওই সময় টা স্বপ্ন ই। কিন্তু মাঝে দেখলাম, আমার জীবন থেকে ছটা বছর নেই। কোথায় গেল রাকা এই গত ছটা বছর? তোর কি সত্যি ই মনে হয় আমি হিজড়ে? তোর কি সত্যি ই মনে হয় আমি এই সমাজের বোঝা?
কথা গুলো শেষ ও হল না। রাকা আমার কোমর টা একেবারে জোরে ভীষণ ভাবে আঁকাড় করে ধরল। আমার দুই উরুর মাঝে, মুখ টা রেখে জোরে জোরে নিজের না বলতে লাগল ঘাড় টা এদিক ওদিক করে। শাড়ি ভেদ করে ওর চোখের জল আমার উরু দুটো ভিজিয়ে দিচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি থামলাম না। ভাবলাম ও হয়ত আন্টির ভয়ে অনেক না মানা কথা মেনে নিচ্ছে। কিন্তু আমাকে তো বুঝতে হবে ও কিসে আনন্দ পাবে? কি করলে ও নতুন ভাবে ফিরতে পারবে খেলায়। ওকে বললাম,
- না এড়িয়ে যাস না রাকা। তোকে বলতে হবে আজকে। তুই যে আবার আমাকে সমাজের কীট ভাববি না, হিজড়ে বলে সম্বোধন করবি না কি করে জানব বল? সেই বিশ্বাস তো আমার ভেঙ্গে গেছে। না হলে আমি কেমন করে তোর সাথে থাকব? দ্যাখ শিভের জন্য ভেবেছিলাম তোকে বিয়ে করলে ছেলেটা আমার হয়ে যাবে। বিশ্বাস কর শিভের জন্য আমি এতো টাই দুর্বল ছিলাম যে মাথায় আসে নি, এই ফাঁকে তুই আমার স্বামী হয়ে যাবি। আমার উপরে তোর অধিকার হয়ে যাবে। ভেবেছিলাম, ছেলেকে আমার কাছে রেখে দেব আর তুই তোর মতন থাকবি। বিয়ের পর থেকে অনেক কিছু ঘটল, যা আমাকে বুঝিয়ে দিল সেটা সম্ভব না।
রাকা ঠিক তেমন ভাবেই আমাকে আঁকাড় করে চেপে ধরে রইল। আমি সামনে দিকে চলে আসার চুল গুলো কে কানের নীচে গুঁজে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম,
- আমার কাছে উপায় নেই তোকে স্বামী হিসাবে মেনে নেওয়া ছাড়া। কিন্তু স্ত্রী হিসাবে আমি তোকে পূর্ণ অধিকার দিচ্ছি, তুই অন্য মেয়ে নিয়ে ভাবতে পারিস রাকা। তোকে এতোটাই ভালোবাসি যে, তোর জন্য এটাও আমি মেনে নেব। কিন্তু তোর কাছ থেকে কোন দিন আর ওই সব শুনলে, আমি বলে কাউকে আর কোন দিন ও তুই পাবি না। জানিনা কি করে ফেলব সেদিনে আমি। তাই বলছি অনেক গুলো জীবনের প্রশ্ন রাকা। আমার ছেলে আবার মা হারাবে। আমার বাপি মা তাদের মেয়ে হারাবে। তুই আবার ভেঙ্গে পড়বি।
রাকা প্রায় ভাঙ্গা গলায় বলল এবারে। তেমন ভাবেই ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে। মনে হলো জোরে জোরেই কাঁদছে ও।
- না না না না, কেন বলছিস আমাকে এসব তুই শিব? আমি সহ্য করতে পারছি না।
তারপরে মুখ টা তুলে আমার দিকে চেয়ে রইল রাকা। আলো আঁধারি ঘরে ওর মুখ টা তো দেখতে পাচ্ছি না আমি, কিন্তু চোখের জল আমি বুঝতে পারছি। নীলচে আলোর নীল প্রতিফলন ওর চোখের জলে। কথা বললেই ওর কান্না আমার বুকে বাজছে। আমিও কি কাঁদছি না? ওর কান্না দেখে আমি কি নিজেকে স্থির রাখতে পেরেছি? চোখে আমার ও জল। কিন্তু আমাকে যে জানতেই হবে! না হলে ওর খেলা, ওর জীবন, আমার ছেলের জীবন সব তছনছ হয়ে যাবে। কাঁদতে কাঁদতেই আমাকে বলল,
- ভাবিস না তুই আমাকে এখন এই সব বলছিস বলে আমি কাঁদছি। আমি কাঁদছি, আজকে আমার তোর কথায় এত কষ্ট হচ্ছে, কারন আমি জানি, আমি তোকে কতটা ভালোবাসি। জানিনা সেদিনে তুই কি ভাবে আমার দেওয়া অতো কষ্ট কি ভাবে সহ্য করেছিলি, যখন জানতিস, তুই আমাকে সব থেকে বেশী ভালবাসিস।
আর বলতে পারল না রাকা। একেবারে ভেঙ্গে পরল ও কাঁদতে কাঁদতে। জড়িয়ে ধরল আমার কোমর টা নিজের দু হাতে। ওই ভাবেই বলল ও
- আজকে আমি তোকে পাচ্ছি। সেদিনে তো তুই কাউকে পাস নি নিজের কাছে। আমাকে তুই ক্ষমা করে দে শিব। এতো কষ্ট আমি আর নিতে পারছি না। কেন আমার এতো কষ্ট হচ্ছে তোর কত কষ্ট হয়েছিল ভেবে। আআআআহহহহহহহহহ। নিতে পারছি না আমি নিতে পারছি না। আমাকে একটু বুকে টেনে নে শিব প্লিস!!!!
উফ মনে হচ্ছে আমাকে চেপে মেরেই ফেলবে ও। ওর কষ্ট টা আমি হয়ত উপলব্ধি করছি। কিন্তু আমার যে আরো কথা পরে আছে। না বললেই নয়। আন্টি বলেছিল, ছেলেরা বড্ড ঠুনকো। ভালোবাসার জোয়ারে কোন পারে ওঠে তার ঠিক কি? ওকে বললাম আমি,
- এখনো সময় আছে রে। আমার কাছে সব কিছু সত্যি বলে, তুই আপনার থাক তোর মতন। আমি কিচ্ছু মনে করব না। শুধু আমার শিভ কে আমার থেকে আলাদা করে দিস না , তোর পায়ে পড়ছি আমি। দ্যাখ, আমি তো তোর বন্ধু। তুই আমাকে সব কথা খুলে বলতেই পারিস। আসলে আমি সেদিনে তোর বাড়ি গেছিলাম, তোকে মানিয়ে ফিরিয়ে আনব বলেই। কিন্তু অঞ্জনা কে দেখে ভেবেই নিয়েছিলাম, আমার জীবন ও তো সরল না। রাকা না হয় অঞ্জনা বিয়ে করেই সুখে থাকুক, আর আমি রাধা হয়ে কাটিয়ে দিলাম জীবন টা। আমি আন্টি কেও সেই কথাই বলেছিলাম রে। জিজ্ঞাসা করিস আন্টি কে একবার। সব ঠিক ছিল, কিন্তু সেদিনের অপমান টা আসলে আমাকে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। আমি তো ভাবিও নি তুই আমার মতন একটা হিজড়ে কে বিয়ে করবি। আজকেও মানি, তুই ও বাধ্য হয়েছিস। কিন্তু তুই একেবারে মুক্ত। আমি তোকে ভালোবাসি। আজকে মানি , ভালোবাসলে ফিরতেই হবে। তোকে পেয়েওছি। কিন্তু অঞ্জনার মূল্যে চাইনি আমি কোনদিন। কিন্তু এই পাওয়ার তো কোন মানে নেই। আবার জীবন থেকে এমন একটা মূল্য দেবার থেকে ভাল, তুই ভাল করে ভাব। ভেবে আমাকে বলিস। কিচ্ছু মনে করব না আমি। বরং খুশি হব। জানব আমার রাকা , যেমন সাহসী আগে ছিল, এখনো আছে।
রাকা ততোধিক জোরে মাথা নাড়াতে নাড়াতে কোলে মুখ গুঁজে রইল। আমি রাকা কে বললাম
- রাকা আমার কাছে লজ্জা করিস না আর। তুই চাস না, আমরা তিনজনায় সুখে থাকি আনন্দে থাকি?
রাকা এবারে মাথা তুলল। উঠে বসল বিছানায়। আমার দিকে তাকাল। চোখে জল টা মুছল আমার শাড়ির আঁচল টা দিয়ে। চুপ করে বসে রইল। ক্ষনে ক্ষনেই, ভিতরের ফোঁপানি টা বেরিয়ে আসতে আসতে এক সময়ে, ও স্থির হয়ে গেল। উঠে দাঁড়াল এবারে ও। চলাফেরাতে একটা কনফিডেন্স এলো এবারে ওর। আমার দিকে চেয়ে বলল একেবারে স্বাভাবিক নিজের গলায়,
- নাহ, আর সাহস টা নেই আমার। আর সাহস নেই তোকে ছেড়ে থাকবার। গত ছয় বছরে বহুবার চেষ্টা করেছি তোর কাছে আসার। পারিনি। পারিনি কারন আমার সাহস হয় নি। মানতে পারিনি তোকে অন্য পুরুষের সাথে দেখব আমি। সহ্য হতো না সেটা। আমি জানিনা তোর কি মনের হাল, কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোকে ছাড়া কাউকেই ভালোবাসিনি। সেটা গত ছয় বছরে প্রতিদিন আমি বুঝেছি। ভাব একবার, ছেলে বউ নিয়ে আমার সংসার, তবু আমি কাউকে অনুভব করতে পারিনি কোন দিন। না না অঞ্জনা খুব ভাল মেয়ে ছিল, আমার খেয়াল রাখার চেষ্টা করত ও। কিন্তু ওর শরীর টা ও ভাল থাকত না। দুটো বছর খেলব কি, ওকে নিয়েই আমি ব্যস্ত ছিলাম। সেই সময়েই আমাদের ই ভুলে শিব এলো ওর পেটে। অঞ্জনার শরীরের কারনে শিব কে সাড়ে সাত মাসেই বের করে দিতে হয়েছিল। ভাবিনি ছেলে আমার বাঁচবে রে।
আমি আর শুনতে পারলাম না। উঠে এসে শিভ কে জড়িয়ে আঁকাড় করে ধরে রইলাম আমি। এ আবার কি কথা বাপ হয়ে তোর? রাকা বলে চলে,
- ছেলের জন্মের পরে অঞ্জনা জানিনা কি করে একটু সুস্থ হলো। মনে হয়েছিল, হয়ত তোকে ভুলে যেতে পারব আমি। কিন্তু চোখ বুঝলেই তোর কথা গুলো মনে পরত আমার- মেরে ফ্যাল আমাকে। উফফ, না পেরেছি ঘুমোতে, না পেরেছি খেতে, না পেরেছি খেলতে। জানিনা হয়ত আমার কেরিয়ার শেষের দিকেই। ভারেই কাটছে আমার ফুটবল জীবন। কনফিডেন্স ও আমার নেই একদম। সব শেষ। জাস্ট ছেলে ছাড়া আর কিছু জীবনে আমার লক্ষ্য নেই। ও একটা ভাল মানুষ হোক। আর হ্যাঁ জানিনা পাব কিনা, তোর কাছে ক্ষমা না পেলে আমি মরতেও পারব না। হ্যাঁ তুই যদি বলিস ক্ষমা করেছিস আমাকে, আমি মরে যেতে পারি এখনি। কারন আমার ছেলের মানুষ হওয়া নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই আর। জানি আমাকে যেভাবে তুই জীবনে দাঁড় করিয়েছিস, আমার ছেলেকেও তুই দাঁড় করিয়ে দিবি।
তারপরে আমার দিকে সরে এসে বলল,
- কি রে পারবি না আমি না থাকলে ছেলেকে মানুষ করতে?
কোন কথা বললাম না, ছেলের কাছ থেকে উঠে এসে সপাটে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলাম রাকার গালে আমি। জাস্ট গাল টা একটু নড়ল ওর। ওকে বললাম আমি,
- বললাম না তোকে, এখন ছেলে মা বাবা দুজন কে চায়। সাহস কি করে হয় তোর, এই সব আজে বাজে কথা বলার? আমি কোথায় সব কিছু ছেড়ে ওর সাথে থাকার চেষ্টায় আছি আর ও উল্টো পালটা কথা বলছে?
রাকা থাবড়া খেয়েও হাসছিল উজবুকের মতন। তখন ও লেগেছিল আমার পিছনে ক্ষমা নিয়ে,
- কি রে ক্ষমা করলি, না করলি না?
- না করলাম না ক্ষমা। ক্ষমার উত্তর যদি তোর ওই সব বাজে কথা হয় তবে কোন ক্ষমা নেই। শোন রাকা, আমার সাথে থাকা অতো সোজা না। আমি তোকে আমি ছাড়া কিছু চিন্তা করার অধিকার ও দেব না মাথায় রাখিস।
দাঁড়িয়ে ছিলাম দুজনেই। আমাকে একেবারে বুকে টেনে নিল উজবুক টা। ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পরতেই ঝিম ধরা গন্ধ টা আমাকে চেপে ধরল। ও আমাকে আঁকাড় করে ধরলেও আমি ওকে জড়িয়ে ধরতে পারলাম না। আমাকে ওই ভাবেই জড়িয়ে ধরে বলল,
- চাই ও না ভাবতে নিজে আর। একবার দেখেছি ভেবে। ছয় বছর নিজের থেকেই দূরে চলে গেছিলাম আমি। চাই না আর চাই না। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। আসলে সেদিনে নয়, তোর উপরে আমার ঘেন্না বীজ টা আগে থেকেই বড় হচ্ছিল। তার মূল কারন ছিল অঞ্জনার মা। আমি সেদিনে বুঝিনি, অঞ্জনা আমাকে ভালোবেসে নয়, আমার খ্যাতি , আমার নাম কে ভালোবেসেছিল। ছোট বেলার ক্রাশ যখন আমাকে প্রপোজ করল আমি আর না বলতে পারিনি। না না , দোষ আমার ছিল, গত ছয় বছরে আমি বুঝেছি, ভালোবাসা এক দিনে চলে আসে না। তোর সাথে সম্পর্ক টা কে বন্ধুত্ব ভাবতাম আমি। অঞ্জনার সাথে বিয়ের পরে বুঝলাম সেটা ভালবাসা ছিল। তুই ছাড়া কাউকেই আমি ভালবাসিনি রে শিব। সেদিনে আমার ভয় ছিল আমাদের চুমু খাবার কথা শুনে যদি অঞ্জনা আমাকে ছেড়ে দেয়? তোকে অপমানের সময়েও, ওর থেকে বেশী ভরসা তোর উপরে ছিল আমার, তুই আমাকে ছাড়বি না। আমাকে ক্ষমা করে দে , প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে।
ইশ ক্ষমা আবার কি কথা! ভুল তো আমিও করেছিলাম। নিজের ভালোবাসা কে ভেবেছিলাম ঐশ্বরিক। বুঝিনি, ভালোবাসা সব সময়েই ঐশ্বরিক। কিন্তু আমরা ঈশ্বর নই। ভালো বাসার ভুল হয় না। ভুল হয় আমাদের। সব দ্বিধা, ইগো ভুলে জড়িয়ে ধরলাম আমার মানুষ টা কে। ভাবলাম, তোকে আবার ভালো খেলতে হবে রাকা। আমি কোন এলেবেলে রাখহরির নয়, রাকা চ্যাটার্জীর বউ হয়েই মরতে চাই। তার জন্য এই এখন থেকে নিজের সর্বস্ব তোর জন্য দিলাম আমি। জানিনা তুই কি ভাবছিস আমাকে জড়িয়ে ধরে। হয়ত আমার মতই তুই কোন পন করছিস। তুই যা খুশি কর। আমি ঠিক করে নিয়েছি এবারে তোকে ভুল করতে দেব না। আমি বুঝে গেছি তুই একটা অতি জঘন্য ফ্রিকল মাইন্ডেড ছেলে। তোকে শাসনেই রাখতে হবে আমাকে। তুই ভুল করলে আমিও হাতে হুড়কো তুলে নেব। কিন্তু তোকে আর ভুল করতে দেব না আমি। আবার কাঁদছে দেখ বাচ্চাদের মতন? আমিও তাই ভেবেছিলাম, ও কোন কারনে বয়ে গেছিল। দোষ ওকে আমি কোনদিন দিই নি। কিন্তু ওই অপমান টা আমাকে …… যাক। এখন তো ওকে জড়িয়ে ধরি আমি। কতকাল পাই না এই বুক টা কে আমি। পন তো আমি করেই নিয়েছি, তোকে আর আমি কোন মতেই ছেড়ে দেব না। তুই শয়তান কে আমি ছাড়া কেউ কন্ট্রোলে রাখতে পারবে না।
আরেক প্রস্থ কান্না কাটির পরে যখন ঠিক হলো এবারে একটু ঘুমোন দরকার তখন মনে হয় তিনটে বেজে গেছে। আমার ছেলে টা মা আর বাপের দুজনের শান্তির গন্ধ পেয়ে গেছে ঘরে। বড্ড নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। রাকা বাথরুম গেছিল। সেই সময়ে ওর দিকে বিছানা টা গুঁটিয়ে গেছিল, সেটা ঠিক করে দিলাম আমি। বালিশ টা আর পাশ বালিশ টা ঠিক করে দিলাম আমি। করতে আর লজ্জা লাগছে না আমার। কিন্তু হয়ত ওর সামনে লজ্জাই লাগবে। আমি ছেলের পাশে শুলাম ছেলেকে মাঝে দিয়ে। রাকা এসে শুয়ে পরল। আমিও শুয়ে পরলাম।মিনিট দশ বাদে আমাকে ডাকল ও
- শিব!
- উম্ম
- ঘুমোলি নাকি?
- না কেন?
- বলছি, তুই তো আমার বউ।
- হুম তাই তো জানি।
- আমার কাছে , না মানে, মাঝে শোয়া যায় না।
হাসি পেয়ে গেলো ওর কথায়। লোভ যাবে না পার্ভার্ট টার। ও কেন বোঝে না, আমার একটু সময় লাগবে ওর সামনে উজার হতে। আমি নিজেও কনফিডেন্ট নই, ছেলে থেকে মেয়ে হবার পরে আমার শরীর ছেলে হিসাবে ওর ভালো লাগবে কিনা। সে এক আলাদা চিন্তা আমার। আমি জানি ও বিয়ে করেছে মানে, সত্যি কারের এক বিছানায় শোবার প্রতিটা ব্যাপার ও চাইবে। কিন্তু একটুও সময় দেবে না নাকি? এই আকুতি টাই থাকত আগে ওর মধ্যে। এখন কনফিডেন্স নেই তাই অনুমতি নিচ্ছে। না হলে আমাকেই টেনে নিয়ে যেতো নিজের কাছে। আমি ছেলের মাথার উপর দিয়ে নিজের হাত টা বাড়িয়ে দিলাম রাকার দিকে। ধরল আমার হাত টা ও। হাতে মুখ টা দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে চুমু খেল অনেক। আমার আঙ্গুল গুলো পালা করে মুখে নিল কুত্তা টা। দাঁত বসাচ্ছিল হালকা হালকা। আমার ভালো লাগছে খুব এটা। এমনি ভাবেই ও আমার কাঁধ ভিজিয়ে দিত। কুটুস করে কামড়ে দিত মাঝে মাঝে। আমি জানি উজবুক টা অন্ধকারে মুখ দেখতে পাচ্ছে না আমার। তাই মুখে হাসি নিয়েই, কিন্তু গম্ভীর আওয়াজে ওকে বললাম,
- না পাশে শোবার মতন ক্ষমা আমি করি নি এখনো।
বেচারী ওদিকে ফিরে আবার শুয়ে পরল। হাত টা ছাড়ল না কিন্তু। কষ্ট পেল হয়ত। হয়ত ঠোঁট টা ফুলিয়ে নিল ছোট বেলার মতন। সারা মনে, সারা শরীরে একটা আনন্দের বান ডাকল আমার। ছেলেকে বুকে টেনে নিলাম আমি। আর কি চাই? বুকে ছেলে আর হাতে রাকার হাত। এতো কিছু পেলে কি আর ঘুম আসতে চায়? জানিনা রাকার কি অবস্থা। আমার অবস্থা বেশ সঙ্গীন। মনে হলো, হাউ হাউ করে কেঁদে রাকা অনেক মুক্ত। আমি জানিনা, আমাকে ও ভবিষ্যতে হিজড়ে বলবে কিনা। কিন্তু এটা বুঝলাম, এই অপবাদ টা আমার কপালে লেখা হয়ে গেছে। হয়ত রাকা বলবে আমাকে কথা টা অনেকবার পরে, কিন্তু আমাকে ওকে আর ছেড়ে দিলে চলবে না। দরকারে ঝগড়া করতে হবে। কিন্তু আর এই নিয়ে আমাকে কোন ইগো রাখলে চলবে না। ছেলেটা আছে না? এখন আমার কাজ হলো, ওকে আবার আগের শেপ এ নিয়ে আসা। যে অবিশ্বাসের বীজ আমার মনে বপন হয়েছে, সহজে মিটে যাবার নয়। যাক দেখা যাবে কি করতে পারব আমি সামনের দিনে। আগে একটা রাকা ছিল, এখন তার ছোট সংস্করণ টাও আমার প্রানের থেকে বেশী হয়ে উঠেছে। আর সে ফুটবল টা বাপের থেকেও বেশী ভালোবাসে।
হয়ত ঘুমিয়ে পরেছিলাম আমি। ঘুম টা সহসা ভেঙ্গে গেল আমার। জানিনা কেমন একটা মানসিক দ্বন্দ্বে ঘুম টা ভাঙল। ছেলে তো আমার কাছেই আছে। তবে কীসের ভয় পেলাম আমি? রাকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও নেই বিছানায়। বুক টা উড়ে গেল আমার। কোথায় গেল। মনে শত প্রশ্নের ভিড়। কি সব বলছিল না তখন? ক্ষমা পেয়ে গেলেই ও মরতে পারে। থাবড়া খেল আমার কাছে একটা সেই জন্য! জাস্ট এক লাফে আমি দরজা খুলে বাইরে এলাম। উফ আরেকটু হলেই শাড়ি তে পা জড়িয়ে যাচ্ছিল আমার। বাথরুম এ তো নেই ও। কোথায় গেলি রাকা? বুকের ভিতর টা কেমন হচ্ছে এবারে তো!!!! তাড়াতাড়ি নীচে নামলাম আমি। না তো, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তবে কি ছাদ দিয়ে ও বেরিয়ে গেল? হে ভগবান। উর্ধশ্বাসে আমি ছাদে উঠলাম সিঁড়ি গুলো, দু টো তিনটে করে পেরিয়ে। ছাদের দরজা টা খোলা। হুরুম করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি ও রেলিং এ দাঁড়িয়ে আছে তাশীর দিকে তাকিয়ে।
উফফফফফফফ। উফ শান্তি!! আমাকে দেখে হাসল ও। যেন কোন ব্যাপার নেই। আর আমি পাগলের মতন ছুটে আসছি। শাড়ির আঁচল আধখোলা। কোনরকমে বুকে ধরে আছি আমি আঁচল টা। ওই ভাবেই বুকে হাত দিয়ে হাঁপাচ্ছি রীতিমত। আমাকে ওই ভাবে দেখে একটু অবাক হয়ে গেল ও। মুখ টা এমন ভাব করল যেন আমাকে বলতে চাইল
- কি হলো? এতো উদভ্রান্তের মতন লাগছে কেন তোকে।
শয়তান, জানে না যেন? ওর চোখের ইশারাতে আমিও হেসে বুঝিয়ে দিলাম – না কিছু না। আমারি ভুল হয়ে গেছিল। মনে হয়েছিল, আমাকে কত খানি ভালোবাসে বোঝাতে ও হয়ত ক্ষমা পেয়েই অন্য কিছু ভেবে, আমাকে ছেড়ে চলে গেল।গান্ডু তো। ছেলেরা ভালোবাসা বলতে বোঝে যে ওকে ওর মায়ের মতন শাসনে রেখে দেবে, খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছুর খেয়াল রাখবে আর বিছানায় শরীর টা কে ছিঁড়বে। এ ছাড়া কোন অব্যক্ত ভালবাসা ছেলে গুলো বোঝেই না। ধীরে ধীরে আমিও পাশে দাঁড়ালাম ওর। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। খোলা চুল উড়ছে আমার পাগলের মতন। মাঝে মাঝেই আমি সামনে টেনে নিয়ে আসছি আমার চুলের গোছ। হয়ত হালকা ফরসা হবে কিছু পরেই। ও সরে এলো আমার কাছে। আমার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। ওকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে যা শক্তিক্ষয় হয়েছিল আমার, ওকে পিছনে পেয়ে, ওর বুকে নিজেকে এলিয়ে দিলাম একেবারে। ও ধরে রইল আমাকে। বলল
- কি ভেবেছিলি? আমি আর নেই?
সাড়া দিলাম না আমি ওর কথার। মাথাটা ওর বুকে আরো এলিয়ে দিয়ে আমি কতটা নিশ্চিন্ত সেটা ওকে বোঝালাম। হাত দুটো আমার দুই হাতের তলা দিয়ে এসে আমার পেটের কাছে রয়েছে। ওর দুটো হাত কে আমি শক্ত করে ধরে রইলাম। আমার ও বলল,
- এখনি ফরসা হবে জানিস?
- হুম।
ওর বুকের ওম আমার সর্বাঙ্গে সঞ্চারিত হচ্ছে। খুব ভালো লাগছে আমার। কিন্তু ছেলে আছে নীচে একলা শুয়ে। ভয় পাবে ও ঘুম ভেঙ্গে গেলে। রাকা কে বললাম
- নীচে চল। ছেলে একা আছে। চা খাবি?
যেদিকে আমার চুলের গোছা টা ছিল সামনের দিকে করে, সেদিনে ও মুখ টা গুঁজে দিল। বলল,
- হুম খাব। চল।
আমি চুল টা খামচায় আটকে নীচে এলাম চা করতে আর রাকা ছেলের কাছে চলে গেল। চা বানিয়ে আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাব, দেখলাম আমার মা বাথরুম এ উঠেছে। আমাকে কাপ প্লেট হাতে নিয়ে দেখে অবাক হয়ে বলল,
- বাবাহ রাতে ঘুমোস নি নাকি দুটো তে? আবার বরের জন্য চা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মাঝ রাতে!!
কিছু বললাম না লজ্জা পেয়ে উঠে চলে এলাম। শুনতে পেলাম নীচে মা গজ গজ করছে।
- আজকাল কার ছেলে মেয়েদের কিছুই বুঝি না বাপু। এই এমন ঝগড়া করল, ছেলে কাঁদতে শুরু করল। আবার দেখি সারা রাত গল্প করেই কাটিয়ে দিল। ভগবান জানে এদের কি হবে।
লজ্জায় লাল হয়ে একেবারে ঘরে। দরজা টা লাগিয়ে ভাবলাম, মা মনে হয় আজকে সব থেকে খুশী। রাকাকে চা টা দিলাম। কিন্তু ও আমাকে দেখতেই থাকলে আমি যে কি করি? সবাই ভাবছে আমি নর্ম্যাল বউ। নই তো। এই ছেলেটা আমার বন্ধু ছিল। ছেলে থাকার সময়ে কত ম্যাচ খেলেছি এক সাথে। কতবার আমাকে জড়িয়ে ধরেছে ও তখন। কিন্তু এখন জড়িয়ে ধরলে আমার লজ্জা করবে না? তখন কি আমি মেয়েছিলাম? এখন হয়েছি। এখন ও আমার দিকে কামুক ভাবে তাকায়। জড়িয়ে ধরলে নিজের বুক দিয়ে আমার বুকে চাপ দেয়। আমার শরীরের এখানে সেখানে হাত দেয়। ফারাক নেই? সেই ব্যাপার টা কেউ বুঝতে চাইছে না। আমি শিভ কে দেওয়ালের দিকে সরিয়ে শোয়ালাম। নাহ এই খচ্চর ছেলেকে আর আলাদা করে শুতে দিলে হবে না। কখন কোথায় বেরিয়ে হাওয়া খেতে যাবে আর ভয়ে আমার প্রান বেরিয়ে যাবে।
নাহ আর একদম না। কোন ভাবেই ওকে আমার থেকে দূরে রাখা যাবে না। একেবারে নিজের সাথে ধরে রাখতে হবে। ভগবান এই রকম ছেলেদের একটা ব্যাপারেই সেরা করে পাঠান। বাকি সব ব্যাপারে এরা সাধারনের থেকেও সাধারন। খেলাতে হয় তো ও বিশাল কিছু, কিন্তু জীবনে ওকে কোন ভাবেই নিজের ইচ্ছে মতন চলতে দিলে হবে না। দরকারে ও যা চায় ওকে দিতে হবে। হয়ত আমার সমস্যা হবে। কিন্তু আমাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে ওকে ঠিক রাখতে হবে আর আমি আমার সমস্যা নিয়ে বাঁচব। আমি ভেবে নিয়েছি, ওকে ঠিক রাখব। আমি ছেলে ছিলাম এই ভাবনা টা মন থেকে একেবারে শেষ করে ফেলব আমি। বাস শুধু ওর বউ আমি। শিভের মা আমি।
বুঝে গেলাম আমার শিভ কে সব থেকে নিজের করে পাবার প্রথম কন্ডিশন ই ছিল ওর বাবাকে নিজের স্বামী হিসাবে মেনে নেওয়া। আর কোন কথা বললাম না আমি। চুপচাপ মাঝে গিয়ে শুলাম আমি ছেলের দিকে মুখ ফিরে। কেউ জানল না কেউ বুঝল না, কত দুঃখ, কত ইগো, কত ঘৃনা, কত রাগ নিজের মধ্যে চেপে রেখে আমি ছেলে আর ছেলের বাবার মাঝে শুলাম। হয়ত আমি আজকে সত্যি করে মেয়ে হলাম। সরে গেলাম ওর দিকে আমি। মিশে যাচ্ছি ওর ইচ্ছের সাথে। টানছে ও আমাকে ওর দিকে। ওর পুরোন বন্ধুর মধ্যে ও নিজের বউ কে পেয়েছে আজ। আমিও কি পাই নি, আমার রাকার মধ্যে আমার স্বামী কে? ওকে হারানোর ভয় টা এতো প্রবল, আজ যা কিছু করতে আমি রাজী। সব মেয়েরা ছোট থেকে মেয়ে হিসাবে বড় হয়, কত ব্রত করে, শিবরাত্রি করে।শুধু একটা মনের মতন সাথী পাবার আশায়। জানিনা তারা কেমন বর পায়। কিন্তু আমি পেয়েছি একটা অদ্ভুত জীব কে আমার বর হিসাবে। হয়ত সে অদ্ভুত, কিন্তু আমার। একেবারে আমার।কেননা, আমাকে জীবনের সব থেকে বড় উপহার টা সে আমাকে দিয়েছে। সে আমার ছেলে। আমার শিভ।নানান রকম মনের ভাবনা আমার আসছে আর ও আমাকে টানছে নিজের দিকে। টানুক। আমাকে একেবারে নিজের করে নিক ও।আর তো কিছু চাই নি আমি। ভগবান আমার মুখ রেখেছেন। জীবনে কোন ব্রত করিনি, শিব রাত্রি পালন করিনি।এসব না করেও জানিনা কি করে মেয়ে হয়ে গেলাম আমি কিন্তু আজকে আমার সত্যি করেই শিভের সাথে শিবের ও প্রাপ্তি হল।
পার্ট ১ সমাপ্ত
আমার ভাগ্যেই এই আবাল জুটেছে। জুটতে তো পারত বয়স্ক একটা লোক, যাকে এই সব বোঝাতে হতো না। ছেলে কে সামান্য দেওয়ালের দিকে সরিয়ে দিলাম। নিজে মাঝে এসে রাকার মাথার কাছে বসলাম। রাকাকে বললাম,
- কি ব্যাপার কি তোর? বার বার হাতে হাত দিচ্ছিলি কেন? তোর মনে হচ্ছে না, তুই এবারে বেশী চাইছিস আমার কাছে। আমি কেন এই গুলো মেনে নেব তুই আমাকে বল?
শেষ পর্ব (সাতাশ)
আমার দিকে ফিরে একেবারে উঠে বসে পরল। চুপ করে রইল। আমাকে দেখছিল ও হাঁ করে একপ্রকার। আমি জানিনা এটা ওর আমার উপরে ভালবাসা নাকি, সেদিনে সিনেমা হলে আমার দেখার মতন ভোগ বাসনা। যেটাই হোক, আজকে ও দুটো তেই বৈধতা অর্জন করেছে আমি সেটা জানি। কিন্তু আমাকে ওর সাথে কথা শেষ করতে হবে আজকে। ও তো চিরকাল ই আমাকে ইম্প্রেস করেছে। দেখি এবারে কি করে ও। আমিও ওর কাছে ইম্প্রেসড হবার মুডে নেই আর। ও অনেকক্ষণ পরে আমাকে বলল,
- প্লিস শিব মেনে নে না রে!
আমি ঠান্ডা ছিলাম। তৈরি হয়েই ছিলাম আমি। কারন আমি বুঝে গেছি, ওর সাথে এই ইগোর লড়াই এ আমি হেরে ভুত হয়ে গেছি। কারন আমার ছেলে। আমি যত ইগো দেখাব আমার ছেলে তত ভুগবে এখানে। আমি সব ভুলে যাব। ছেলের জন্যেই ভুলে যাব। কিন্তু আমাকে জানতে হবে, ও কত টা সিরিয়াস। না হলে আমি আবার জড়িয়ে পড়ব ওর সাথে। আবার আমাকে ও কষ্ট দেবে। তাই জিজ্ঞাসা করলাম
- কেন? কেন মানব? একটা কারন তো বল আমাকে তুই রাকা। দ্যাখ তোর নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ, প্রতিপত্তি কিছুতেই আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। বলতে তোকে কোন অসুবিধা আমার নেই যে, এই গুলো আমার কাঙ্খিত ছিল না। কোন দিন ই তোর অর্জনের উপরে আমার লোভ ছিল না। কিন্তু সেদিনের পরে আমি কেন এই গুলো মানব? আমি আজকে উত্তর চাই রাকা।
আবার ও চুপ করে গেল। আমি জানি ওর কাছে কোন উত্তর পাওয়া যাবে না। ও উঠে এসে পা ঝুলিয়ে বসল আমার পাশেই। বলল
- কেন চাস এই সবের উত্তর তুই শিব?
ও পাশে বসতেই সেই ঝিম ধরা গন্ধ টা আমার নাকে এসে লাগল। আমি ওর পাশ থেকে উঠে গেলাম। একটা চেয়ার এনে ওর সামনেই বসলাম চেয়ারে। আর ও বিছানায় মুখোমুখি বসে রইল আমার। চোখে জল এসে গেছে ততক্ষনে আমার। ঘরে নাইট ল্যাম্প জ্বলছে তাই, হয়ত এখনি ও আমার চোখের জল দেখতে পাবে না। বললাম,
- জানতে চাই আমি। এই জন্য জানতে চাই, যে ছেলেটা আমাকে কোন দিন সামান্য কষ্ট দেয় নি। সে সেদিনে আমাকে কি ভাবে অতো কষ্ট দিলো। কি হয়েছিল তার সেদিনে? এই রহস্য আমাকে ভেদ করতেই হবে।
রাকার মধ্যে এতক্ষন যে ছেলে মানুষি টা ছিল সেটা যেন উধাও হয়ে গেল একেবারে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
- কেন সেই বাজে দিন গুলোর কথা ভাবছিস শিব? শুধু এই টুকু মনে রাখ, সেদিনে হয়ত তোকে আমি তোর মতন করে ভালবাসিনি, কিন্তু আজকে সন্দেহ করিস না প্লিস।
কথাটা শুনে আমি কেঁপে গেলাম। আমি কোন দিন ও ওকে সন্দেহ করিনি। আর এটা আমার সন্দেহ নয়। এটা আমার জিজ্ঞাস্য। আমি এই সব স্টেজ পেরিয়ে এসেছি। ও যতই আমার বয়সী হোক, আমার মতন মনোবৃদ্ধ ও নয়। আমার যা উপলব্ধি, ওর সেই উপলব্ধি এখনো হয় নি। আজকে আমার আত্মা পুড়তে পুড়তে শেষে এসে গেছে। তাই জানি, ওকে আমি ভালবাসি। কাজেই ওর এই ভালবাসার উপলব্ধি টা কত খানি স্থায়ী সেটা আমাকে না বুঝলে চলবে কেমন করে? যতদুর আমি গত একমাসে খবর নিয়ে বুঝলাম,গত তিন বছর ও খুব বাজে খেলেছে। ওকে না বুঝতে পারলে, ওকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে না নিয়ে গেলে, ওর কেরিয়ার এই বছরেই শেষ। আর এটা ওর প্রাইম টাইম। আঠাশ বছরে একটা ফুটবলার, জীবনের সব থেকে বেস্ট শেপ এ থাকে। আগামী দু বছর ওর বেস্ট টা ওর ক্লাব আর দেশ দু পক্ষের ই পাবার কথা। ওর কথায় কেঁপে উঠেছিলাম আমি। না , আমি ওর তখন কার ভালবাসাতেও সন্দেহ করিনি, এখন কার ও করি না। বরং এখনকার থেকে আমার ছোট বেলার রাকার ভালোবাসা অনেক বেশি ছিল। হয়ত তাতে ভাবনা ছিল না, কিন্তু একটা নিখাদ ভালবাসা ছিল। কথায় কথায় ও শিবের জন্য ঝামেলায় জড়িয়ে পরত। বরং এখন ও অনেক কম এক্সপ্রেস করে। ওকে বললাম,
- না আমি কিছুই সন্দেহ করছি না রাকা। হয়ত এর পর থেকে আমি আর কোন দিন এই রকম সিরিয়াস কথা বলব না। আবার হয়ত ঝগড়া করব তোর সাথে। আমাদের ছেলেকে নিয়ে সংসার করব আমরা। আমি তোর বউ হয়ে যাব আর তুই আমার স্বামী। কিন্তু আজকে, সেই দিনের এক অসফল প্রেমিকা আর তাকে না চাওয়া প্রেমিক হয়ে কথা বলে নি?
রাকা শুনে চুপ করে গেল। হয়ত বুঝতে চেস্টা করছে আমি কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছি আলোচনা টা। কিন্তু আজকে ও পালাবার মুডে নেই। বরং রেডি হয়ে বুক পেতে দাঁড়ালো। হয়ত এই ঠান্ডা মানসিক যুদ্ধ টা আমার মতন ও ও নিতে পারছে না। আমাকে বলল,
- কেন বলবি না কেন সিরিয়াস কথা?
- কারন আমি তোকে মেনে নিয়েছি আমার জীবনে রাকা। তোকে কোন শর্ত রাখতে হবে না আর। কারন আমি মেনে নিয়েছি তুই যা চাইবি আমি তোকে দেব। ব্যস তুই ই আমার জীবনে প্রথম পুরুষ। আর তুই ই একমাত্র। মেয়ে হবার আগেও তুই ছিলিস আমার বন্ধু। মেয়ে হবার পরেও তুই একমাত্র বন্ধু, সখা,…
কথাটা শেষ ও হলো না রাকা বলতে শুরু করল
- আয়না, আমার আমি, ইশ্বর, কৃষ্ণ,সাথী, সাফল্য,দুঃখ আর সর্বস্ব।
চমকে উঠলাম আমি। এই গুল সেই কথা গুলো যেগুলো ওকে আমি বলেছিলাম যেদিনে ও আমাকে প্রপোজ করেছিল পোড়ো বাড়িতে। বুঝি আমি, ওর এই সব ছোট ছোট মুড়কি তেই আমি কাত হয়েছি সারাটা জীবন। আমি কিন্তু চুপ করলাম না। এই টুকু তে থেমে গেলে চলবে না আমার। আমি থামলাম না, শুরু করলাম,
- আমার মন শুধু তোকেই দিয়েছি আমি। মাঝে পুরুষ আসতে চায় নি এমন না রাকা। আমি চেস্টাও করেছিলাম রে। কিন্তু জানিনা কেন, মনে তোকে ছাড়া আমি কাউকেই জায়গা দিতে পারিনি। বুঝে গেছিলাম, মন জুড়ে তুই ই আছিস, নানা রূপে। কখনো আমাকে রক্ষা করছিস, কখনো ভালবেসে অন্ধকারে জাপটে ধরছিস, বা কখনো আমার শরীর টা ঘাঁটছিস ইচ্ছে মতন। আমার জীবনে তুই ছাড়া কেউ নেই রে! তুই শুধু আমাকে একটু মানিয়ে নিস।
এতো দূর শুনে রাকা যেন ছটফট করে উঠল। আমার এই অকপ্ট স্বীকারোক্তি যেনো ও নিতে পারছে না। আমার , মানিয়ে নেবার অনুরোধ যেন ও সহ্য করতে পারল না। বসেছিলো ও। ওর অনুতাপের আগুন ওকে চকিতে দাঁড় করিয়ে দিল। মুখে একটা শুধু বোবা আওয়াজ যেন। ছোট নালা দিয়ে বেরোনোর সময়ে বিশাল জলরাশির যা দশা হয়, রাকার ও অব্যক্ত কথার তুফান মুখ দিয়ে না বেরিয়ে চোখের জল দিয়ে বেরোল।কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ও আমার নীচে হাঁটু মুড়ে বসে। আমার কোমর টা কে জড়িয়ে ধরল ও সজোরে। কিন্তু আমি পারছি না ওর চুলে হাত দিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিতে। ইচ্ছে করছে,ওকে জড়িয়ে ধরি। ইচ্ছে করছে ভাবতে এটা রাকার ভালোবাসাই। ইচ্ছে করছে ওর চোখের জল মুছিয়ে বুকে টেনে নি আমি। কিন্তু মন মানছে না। ছেলে নামক একটি ভয়ানক স্রোত এই অনুতাপের জন্ম দেয় নি কে বলতে পারে? আমি তো ভগবান নই। কাজেই ছেলেই যদি এই অনুতাপের জন্মদাতা হয়, তাহলে রাকার সাথে আমি কেন এই ভালবাসার সংসার টা বাঁধব? ওকে বলে দেব, আমি ছেলের মা হয়েই থাকব। কিন্তু ওর কোন বাধা নেই জীবনে। ওকে ভালবাসলেও, মেনে নেব, ওকে পাওয়া আর এই জীবনে আমার হবে না। হাত দুটো কে ইচ্ছে করেই ওর মাথায় আমি দিলাম না। তুলে রইলাম। রাকার মাথা আমার কোলে। আমিও ঝুঁকে আছি। আমার খোলা এলো চুল সামনের দিকে এসে আমার মুখ ঢেকে রাকার পিঠে পরে রয়েছে। আমি বলতে শুরু করলাম,
- কিন্তু আমাকে জানতে হবে, সেদিনের কথা। আমি আজকেও বিশ্বাস করতে পারি না সেই দিন টা। আমি আজকেও ভাবি সেটা একটা দুঃস্বপ্ন। হয়ত তাই বিশ্বাস করতাম আমি, যে ওই দিন টা ওই সময় টা স্বপ্ন ই। কিন্তু মাঝে দেখলাম, আমার জীবন থেকে ছটা বছর নেই। কোথায় গেল রাকা এই গত ছটা বছর? তোর কি সত্যি ই মনে হয় আমি হিজড়ে? তোর কি সত্যি ই মনে হয় আমি এই সমাজের বোঝা?
কথা গুলো শেষ ও হল না। রাকা আমার কোমর টা একেবারে জোরে ভীষণ ভাবে আঁকাড় করে ধরল। আমার দুই উরুর মাঝে, মুখ টা রেখে জোরে জোরে নিজের না বলতে লাগল ঘাড় টা এদিক ওদিক করে। শাড়ি ভেদ করে ওর চোখের জল আমার উরু দুটো ভিজিয়ে দিচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি থামলাম না। ভাবলাম ও হয়ত আন্টির ভয়ে অনেক না মানা কথা মেনে নিচ্ছে। কিন্তু আমাকে তো বুঝতে হবে ও কিসে আনন্দ পাবে? কি করলে ও নতুন ভাবে ফিরতে পারবে খেলায়। ওকে বললাম,
- না এড়িয়ে যাস না রাকা। তোকে বলতে হবে আজকে। তুই যে আবার আমাকে সমাজের কীট ভাববি না, হিজড়ে বলে সম্বোধন করবি না কি করে জানব বল? সেই বিশ্বাস তো আমার ভেঙ্গে গেছে। না হলে আমি কেমন করে তোর সাথে থাকব? দ্যাখ শিভের জন্য ভেবেছিলাম তোকে বিয়ে করলে ছেলেটা আমার হয়ে যাবে। বিশ্বাস কর শিভের জন্য আমি এতো টাই দুর্বল ছিলাম যে মাথায় আসে নি, এই ফাঁকে তুই আমার স্বামী হয়ে যাবি। আমার উপরে তোর অধিকার হয়ে যাবে। ভেবেছিলাম, ছেলেকে আমার কাছে রেখে দেব আর তুই তোর মতন থাকবি। বিয়ের পর থেকে অনেক কিছু ঘটল, যা আমাকে বুঝিয়ে দিল সেটা সম্ভব না।
রাকা ঠিক তেমন ভাবেই আমাকে আঁকাড় করে চেপে ধরে রইল। আমি সামনে দিকে চলে আসার চুল গুলো কে কানের নীচে গুঁজে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম,
- আমার কাছে উপায় নেই তোকে স্বামী হিসাবে মেনে নেওয়া ছাড়া। কিন্তু স্ত্রী হিসাবে আমি তোকে পূর্ণ অধিকার দিচ্ছি, তুই অন্য মেয়ে নিয়ে ভাবতে পারিস রাকা। তোকে এতোটাই ভালোবাসি যে, তোর জন্য এটাও আমি মেনে নেব। কিন্তু তোর কাছ থেকে কোন দিন আর ওই সব শুনলে, আমি বলে কাউকে আর কোন দিন ও তুই পাবি না। জানিনা কি করে ফেলব সেদিনে আমি। তাই বলছি অনেক গুলো জীবনের প্রশ্ন রাকা। আমার ছেলে আবার মা হারাবে। আমার বাপি মা তাদের মেয়ে হারাবে। তুই আবার ভেঙ্গে পড়বি।
রাকা প্রায় ভাঙ্গা গলায় বলল এবারে। তেমন ভাবেই ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে। মনে হলো জোরে জোরেই কাঁদছে ও।
- না না না না, কেন বলছিস আমাকে এসব তুই শিব? আমি সহ্য করতে পারছি না।
তারপরে মুখ টা তুলে আমার দিকে চেয়ে রইল রাকা। আলো আঁধারি ঘরে ওর মুখ টা তো দেখতে পাচ্ছি না আমি, কিন্তু চোখের জল আমি বুঝতে পারছি। নীলচে আলোর নীল প্রতিফলন ওর চোখের জলে। কথা বললেই ওর কান্না আমার বুকে বাজছে। আমিও কি কাঁদছি না? ওর কান্না দেখে আমি কি নিজেকে স্থির রাখতে পেরেছি? চোখে আমার ও জল। কিন্তু আমাকে যে জানতেই হবে! না হলে ওর খেলা, ওর জীবন, আমার ছেলের জীবন সব তছনছ হয়ে যাবে। কাঁদতে কাঁদতেই আমাকে বলল,
- ভাবিস না তুই আমাকে এখন এই সব বলছিস বলে আমি কাঁদছি। আমি কাঁদছি, আজকে আমার তোর কথায় এত কষ্ট হচ্ছে, কারন আমি জানি, আমি তোকে কতটা ভালোবাসি। জানিনা সেদিনে তুই কি ভাবে আমার দেওয়া অতো কষ্ট কি ভাবে সহ্য করেছিলি, যখন জানতিস, তুই আমাকে সব থেকে বেশী ভালবাসিস।
আর বলতে পারল না রাকা। একেবারে ভেঙ্গে পরল ও কাঁদতে কাঁদতে। জড়িয়ে ধরল আমার কোমর টা নিজের দু হাতে। ওই ভাবেই বলল ও
- আজকে আমি তোকে পাচ্ছি। সেদিনে তো তুই কাউকে পাস নি নিজের কাছে। আমাকে তুই ক্ষমা করে দে শিব। এতো কষ্ট আমি আর নিতে পারছি না। কেন আমার এতো কষ্ট হচ্ছে তোর কত কষ্ট হয়েছিল ভেবে। আআআআহহহহহহহহহ। নিতে পারছি না আমি নিতে পারছি না। আমাকে একটু বুকে টেনে নে শিব প্লিস!!!!
উফ মনে হচ্ছে আমাকে চেপে মেরেই ফেলবে ও। ওর কষ্ট টা আমি হয়ত উপলব্ধি করছি। কিন্তু আমার যে আরো কথা পরে আছে। না বললেই নয়। আন্টি বলেছিল, ছেলেরা বড্ড ঠুনকো। ভালোবাসার জোয়ারে কোন পারে ওঠে তার ঠিক কি? ওকে বললাম আমি,
- এখনো সময় আছে রে। আমার কাছে সব কিছু সত্যি বলে, তুই আপনার থাক তোর মতন। আমি কিচ্ছু মনে করব না। শুধু আমার শিভ কে আমার থেকে আলাদা করে দিস না , তোর পায়ে পড়ছি আমি। দ্যাখ, আমি তো তোর বন্ধু। তুই আমাকে সব কথা খুলে বলতেই পারিস। আসলে আমি সেদিনে তোর বাড়ি গেছিলাম, তোকে মানিয়ে ফিরিয়ে আনব বলেই। কিন্তু অঞ্জনা কে দেখে ভেবেই নিয়েছিলাম, আমার জীবন ও তো সরল না। রাকা না হয় অঞ্জনা বিয়ে করেই সুখে থাকুক, আর আমি রাধা হয়ে কাটিয়ে দিলাম জীবন টা। আমি আন্টি কেও সেই কথাই বলেছিলাম রে। জিজ্ঞাসা করিস আন্টি কে একবার। সব ঠিক ছিল, কিন্তু সেদিনের অপমান টা আসলে আমাকে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। আমি তো ভাবিও নি তুই আমার মতন একটা হিজড়ে কে বিয়ে করবি। আজকেও মানি, তুই ও বাধ্য হয়েছিস। কিন্তু তুই একেবারে মুক্ত। আমি তোকে ভালোবাসি। আজকে মানি , ভালোবাসলে ফিরতেই হবে। তোকে পেয়েওছি। কিন্তু অঞ্জনার মূল্যে চাইনি আমি কোনদিন। কিন্তু এই পাওয়ার তো কোন মানে নেই। আবার জীবন থেকে এমন একটা মূল্য দেবার থেকে ভাল, তুই ভাল করে ভাব। ভেবে আমাকে বলিস। কিচ্ছু মনে করব না আমি। বরং খুশি হব। জানব আমার রাকা , যেমন সাহসী আগে ছিল, এখনো আছে।
রাকা ততোধিক জোরে মাথা নাড়াতে নাড়াতে কোলে মুখ গুঁজে রইল। আমি রাকা কে বললাম
- রাকা আমার কাছে লজ্জা করিস না আর। তুই চাস না, আমরা তিনজনায় সুখে থাকি আনন্দে থাকি?
রাকা এবারে মাথা তুলল। উঠে বসল বিছানায়। আমার দিকে তাকাল। চোখে জল টা মুছল আমার শাড়ির আঁচল টা দিয়ে। চুপ করে বসে রইল। ক্ষনে ক্ষনেই, ভিতরের ফোঁপানি টা বেরিয়ে আসতে আসতে এক সময়ে, ও স্থির হয়ে গেল। উঠে দাঁড়াল এবারে ও। চলাফেরাতে একটা কনফিডেন্স এলো এবারে ওর। আমার দিকে চেয়ে বলল একেবারে স্বাভাবিক নিজের গলায়,
- নাহ, আর সাহস টা নেই আমার। আর সাহস নেই তোকে ছেড়ে থাকবার। গত ছয় বছরে বহুবার চেষ্টা করেছি তোর কাছে আসার। পারিনি। পারিনি কারন আমার সাহস হয় নি। মানতে পারিনি তোকে অন্য পুরুষের সাথে দেখব আমি। সহ্য হতো না সেটা। আমি জানিনা তোর কি মনের হাল, কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোকে ছাড়া কাউকেই ভালোবাসিনি। সেটা গত ছয় বছরে প্রতিদিন আমি বুঝেছি। ভাব একবার, ছেলে বউ নিয়ে আমার সংসার, তবু আমি কাউকে অনুভব করতে পারিনি কোন দিন। না না অঞ্জনা খুব ভাল মেয়ে ছিল, আমার খেয়াল রাখার চেষ্টা করত ও। কিন্তু ওর শরীর টা ও ভাল থাকত না। দুটো বছর খেলব কি, ওকে নিয়েই আমি ব্যস্ত ছিলাম। সেই সময়েই আমাদের ই ভুলে শিব এলো ওর পেটে। অঞ্জনার শরীরের কারনে শিব কে সাড়ে সাত মাসেই বের করে দিতে হয়েছিল। ভাবিনি ছেলে আমার বাঁচবে রে।
আমি আর শুনতে পারলাম না। উঠে এসে শিভ কে জড়িয়ে আঁকাড় করে ধরে রইলাম আমি। এ আবার কি কথা বাপ হয়ে তোর? রাকা বলে চলে,
- ছেলের জন্মের পরে অঞ্জনা জানিনা কি করে একটু সুস্থ হলো। মনে হয়েছিল, হয়ত তোকে ভুলে যেতে পারব আমি। কিন্তু চোখ বুঝলেই তোর কথা গুলো মনে পরত আমার- মেরে ফ্যাল আমাকে। উফফ, না পেরেছি ঘুমোতে, না পেরেছি খেতে, না পেরেছি খেলতে। জানিনা হয়ত আমার কেরিয়ার শেষের দিকেই। ভারেই কাটছে আমার ফুটবল জীবন। কনফিডেন্স ও আমার নেই একদম। সব শেষ। জাস্ট ছেলে ছাড়া আর কিছু জীবনে আমার লক্ষ্য নেই। ও একটা ভাল মানুষ হোক। আর হ্যাঁ জানিনা পাব কিনা, তোর কাছে ক্ষমা না পেলে আমি মরতেও পারব না। হ্যাঁ তুই যদি বলিস ক্ষমা করেছিস আমাকে, আমি মরে যেতে পারি এখনি। কারন আমার ছেলের মানুষ হওয়া নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই আর। জানি আমাকে যেভাবে তুই জীবনে দাঁড় করিয়েছিস, আমার ছেলেকেও তুই দাঁড় করিয়ে দিবি।
তারপরে আমার দিকে সরে এসে বলল,
- কি রে পারবি না আমি না থাকলে ছেলেকে মানুষ করতে?
কোন কথা বললাম না, ছেলের কাছ থেকে উঠে এসে সপাটে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলাম রাকার গালে আমি। জাস্ট গাল টা একটু নড়ল ওর। ওকে বললাম আমি,
- বললাম না তোকে, এখন ছেলে মা বাবা দুজন কে চায়। সাহস কি করে হয় তোর, এই সব আজে বাজে কথা বলার? আমি কোথায় সব কিছু ছেড়ে ওর সাথে থাকার চেষ্টায় আছি আর ও উল্টো পালটা কথা বলছে?
রাকা থাবড়া খেয়েও হাসছিল উজবুকের মতন। তখন ও লেগেছিল আমার পিছনে ক্ষমা নিয়ে,
- কি রে ক্ষমা করলি, না করলি না?
- না করলাম না ক্ষমা। ক্ষমার উত্তর যদি তোর ওই সব বাজে কথা হয় তবে কোন ক্ষমা নেই। শোন রাকা, আমার সাথে থাকা অতো সোজা না। আমি তোকে আমি ছাড়া কিছু চিন্তা করার অধিকার ও দেব না মাথায় রাখিস।
দাঁড়িয়ে ছিলাম দুজনেই। আমাকে একেবারে বুকে টেনে নিল উজবুক টা। ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পরতেই ঝিম ধরা গন্ধ টা আমাকে চেপে ধরল। ও আমাকে আঁকাড় করে ধরলেও আমি ওকে জড়িয়ে ধরতে পারলাম না। আমাকে ওই ভাবেই জড়িয়ে ধরে বলল,
- চাই ও না ভাবতে নিজে আর। একবার দেখেছি ভেবে। ছয় বছর নিজের থেকেই দূরে চলে গেছিলাম আমি। চাই না আর চাই না। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। আসলে সেদিনে নয়, তোর উপরে আমার ঘেন্না বীজ টা আগে থেকেই বড় হচ্ছিল। তার মূল কারন ছিল অঞ্জনার মা। আমি সেদিনে বুঝিনি, অঞ্জনা আমাকে ভালোবেসে নয়, আমার খ্যাতি , আমার নাম কে ভালোবেসেছিল। ছোট বেলার ক্রাশ যখন আমাকে প্রপোজ করল আমি আর না বলতে পারিনি। না না , দোষ আমার ছিল, গত ছয় বছরে আমি বুঝেছি, ভালোবাসা এক দিনে চলে আসে না। তোর সাথে সম্পর্ক টা কে বন্ধুত্ব ভাবতাম আমি। অঞ্জনার সাথে বিয়ের পরে বুঝলাম সেটা ভালবাসা ছিল। তুই ছাড়া কাউকেই আমি ভালবাসিনি রে শিব। সেদিনে আমার ভয় ছিল আমাদের চুমু খাবার কথা শুনে যদি অঞ্জনা আমাকে ছেড়ে দেয়? তোকে অপমানের সময়েও, ওর থেকে বেশী ভরসা তোর উপরে ছিল আমার, তুই আমাকে ছাড়বি না। আমাকে ক্ষমা করে দে , প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে।
ইশ ক্ষমা আবার কি কথা! ভুল তো আমিও করেছিলাম। নিজের ভালোবাসা কে ভেবেছিলাম ঐশ্বরিক। বুঝিনি, ভালোবাসা সব সময়েই ঐশ্বরিক। কিন্তু আমরা ঈশ্বর নই। ভালো বাসার ভুল হয় না। ভুল হয় আমাদের। সব দ্বিধা, ইগো ভুলে জড়িয়ে ধরলাম আমার মানুষ টা কে। ভাবলাম, তোকে আবার ভালো খেলতে হবে রাকা। আমি কোন এলেবেলে রাখহরির নয়, রাকা চ্যাটার্জীর বউ হয়েই মরতে চাই। তার জন্য এই এখন থেকে নিজের সর্বস্ব তোর জন্য দিলাম আমি। জানিনা তুই কি ভাবছিস আমাকে জড়িয়ে ধরে। হয়ত আমার মতই তুই কোন পন করছিস। তুই যা খুশি কর। আমি ঠিক করে নিয়েছি এবারে তোকে ভুল করতে দেব না। আমি বুঝে গেছি তুই একটা অতি জঘন্য ফ্রিকল মাইন্ডেড ছেলে। তোকে শাসনেই রাখতে হবে আমাকে। তুই ভুল করলে আমিও হাতে হুড়কো তুলে নেব। কিন্তু তোকে আর ভুল করতে দেব না আমি। আবার কাঁদছে দেখ বাচ্চাদের মতন? আমিও তাই ভেবেছিলাম, ও কোন কারনে বয়ে গেছিল। দোষ ওকে আমি কোনদিন দিই নি। কিন্তু ওই অপমান টা আমাকে …… যাক। এখন তো ওকে জড়িয়ে ধরি আমি। কতকাল পাই না এই বুক টা কে আমি। পন তো আমি করেই নিয়েছি, তোকে আর আমি কোন মতেই ছেড়ে দেব না। তুই শয়তান কে আমি ছাড়া কেউ কন্ট্রোলে রাখতে পারবে না।
আরেক প্রস্থ কান্না কাটির পরে যখন ঠিক হলো এবারে একটু ঘুমোন দরকার তখন মনে হয় তিনটে বেজে গেছে। আমার ছেলে টা মা আর বাপের দুজনের শান্তির গন্ধ পেয়ে গেছে ঘরে। বড্ড নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। রাকা বাথরুম গেছিল। সেই সময়ে ওর দিকে বিছানা টা গুঁটিয়ে গেছিল, সেটা ঠিক করে দিলাম আমি। বালিশ টা আর পাশ বালিশ টা ঠিক করে দিলাম আমি। করতে আর লজ্জা লাগছে না আমার। কিন্তু হয়ত ওর সামনে লজ্জাই লাগবে। আমি ছেলের পাশে শুলাম ছেলেকে মাঝে দিয়ে। রাকা এসে শুয়ে পরল। আমিও শুয়ে পরলাম।মিনিট দশ বাদে আমাকে ডাকল ও
- শিব!
- উম্ম
- ঘুমোলি নাকি?
- না কেন?
- বলছি, তুই তো আমার বউ।
- হুম তাই তো জানি।
- আমার কাছে , না মানে, মাঝে শোয়া যায় না।
হাসি পেয়ে গেলো ওর কথায়। লোভ যাবে না পার্ভার্ট টার। ও কেন বোঝে না, আমার একটু সময় লাগবে ওর সামনে উজার হতে। আমি নিজেও কনফিডেন্ট নই, ছেলে থেকে মেয়ে হবার পরে আমার শরীর ছেলে হিসাবে ওর ভালো লাগবে কিনা। সে এক আলাদা চিন্তা আমার। আমি জানি ও বিয়ে করেছে মানে, সত্যি কারের এক বিছানায় শোবার প্রতিটা ব্যাপার ও চাইবে। কিন্তু একটুও সময় দেবে না নাকি? এই আকুতি টাই থাকত আগে ওর মধ্যে। এখন কনফিডেন্স নেই তাই অনুমতি নিচ্ছে। না হলে আমাকেই টেনে নিয়ে যেতো নিজের কাছে। আমি ছেলের মাথার উপর দিয়ে নিজের হাত টা বাড়িয়ে দিলাম রাকার দিকে। ধরল আমার হাত টা ও। হাতে মুখ টা দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে চুমু খেল অনেক। আমার আঙ্গুল গুলো পালা করে মুখে নিল কুত্তা টা। দাঁত বসাচ্ছিল হালকা হালকা। আমার ভালো লাগছে খুব এটা। এমনি ভাবেই ও আমার কাঁধ ভিজিয়ে দিত। কুটুস করে কামড়ে দিত মাঝে মাঝে। আমি জানি উজবুক টা অন্ধকারে মুখ দেখতে পাচ্ছে না আমার। তাই মুখে হাসি নিয়েই, কিন্তু গম্ভীর আওয়াজে ওকে বললাম,
- না পাশে শোবার মতন ক্ষমা আমি করি নি এখনো।
বেচারী ওদিকে ফিরে আবার শুয়ে পরল। হাত টা ছাড়ল না কিন্তু। কষ্ট পেল হয়ত। হয়ত ঠোঁট টা ফুলিয়ে নিল ছোট বেলার মতন। সারা মনে, সারা শরীরে একটা আনন্দের বান ডাকল আমার। ছেলেকে বুকে টেনে নিলাম আমি। আর কি চাই? বুকে ছেলে আর হাতে রাকার হাত। এতো কিছু পেলে কি আর ঘুম আসতে চায়? জানিনা রাকার কি অবস্থা। আমার অবস্থা বেশ সঙ্গীন। মনে হলো, হাউ হাউ করে কেঁদে রাকা অনেক মুক্ত। আমি জানিনা, আমাকে ও ভবিষ্যতে হিজড়ে বলবে কিনা। কিন্তু এটা বুঝলাম, এই অপবাদ টা আমার কপালে লেখা হয়ে গেছে। হয়ত রাকা বলবে আমাকে কথা টা অনেকবার পরে, কিন্তু আমাকে ওকে আর ছেড়ে দিলে চলবে না। দরকারে ঝগড়া করতে হবে। কিন্তু আর এই নিয়ে আমাকে কোন ইগো রাখলে চলবে না। ছেলেটা আছে না? এখন আমার কাজ হলো, ওকে আবার আগের শেপ এ নিয়ে আসা। যে অবিশ্বাসের বীজ আমার মনে বপন হয়েছে, সহজে মিটে যাবার নয়। যাক দেখা যাবে কি করতে পারব আমি সামনের দিনে। আগে একটা রাকা ছিল, এখন তার ছোট সংস্করণ টাও আমার প্রানের থেকে বেশী হয়ে উঠেছে। আর সে ফুটবল টা বাপের থেকেও বেশী ভালোবাসে।
হয়ত ঘুমিয়ে পরেছিলাম আমি। ঘুম টা সহসা ভেঙ্গে গেল আমার। জানিনা কেমন একটা মানসিক দ্বন্দ্বে ঘুম টা ভাঙল। ছেলে তো আমার কাছেই আছে। তবে কীসের ভয় পেলাম আমি? রাকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও নেই বিছানায়। বুক টা উড়ে গেল আমার। কোথায় গেল। মনে শত প্রশ্নের ভিড়। কি সব বলছিল না তখন? ক্ষমা পেয়ে গেলেই ও মরতে পারে। থাবড়া খেল আমার কাছে একটা সেই জন্য! জাস্ট এক লাফে আমি দরজা খুলে বাইরে এলাম। উফ আরেকটু হলেই শাড়ি তে পা জড়িয়ে যাচ্ছিল আমার। বাথরুম এ তো নেই ও। কোথায় গেলি রাকা? বুকের ভিতর টা কেমন হচ্ছে এবারে তো!!!! তাড়াতাড়ি নীচে নামলাম আমি। না তো, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তবে কি ছাদ দিয়ে ও বেরিয়ে গেল? হে ভগবান। উর্ধশ্বাসে আমি ছাদে উঠলাম সিঁড়ি গুলো, দু টো তিনটে করে পেরিয়ে। ছাদের দরজা টা খোলা। হুরুম করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি ও রেলিং এ দাঁড়িয়ে আছে তাশীর দিকে তাকিয়ে।
উফফফফফফফ। উফ শান্তি!! আমাকে দেখে হাসল ও। যেন কোন ব্যাপার নেই। আর আমি পাগলের মতন ছুটে আসছি। শাড়ির আঁচল আধখোলা। কোনরকমে বুকে ধরে আছি আমি আঁচল টা। ওই ভাবেই বুকে হাত দিয়ে হাঁপাচ্ছি রীতিমত। আমাকে ওই ভাবে দেখে একটু অবাক হয়ে গেল ও। মুখ টা এমন ভাব করল যেন আমাকে বলতে চাইল
- কি হলো? এতো উদভ্রান্তের মতন লাগছে কেন তোকে।
শয়তান, জানে না যেন? ওর চোখের ইশারাতে আমিও হেসে বুঝিয়ে দিলাম – না কিছু না। আমারি ভুল হয়ে গেছিল। মনে হয়েছিল, আমাকে কত খানি ভালোবাসে বোঝাতে ও হয়ত ক্ষমা পেয়েই অন্য কিছু ভেবে, আমাকে ছেড়ে চলে গেল।গান্ডু তো। ছেলেরা ভালোবাসা বলতে বোঝে যে ওকে ওর মায়ের মতন শাসনে রেখে দেবে, খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছুর খেয়াল রাখবে আর বিছানায় শরীর টা কে ছিঁড়বে। এ ছাড়া কোন অব্যক্ত ভালবাসা ছেলে গুলো বোঝেই না। ধীরে ধীরে আমিও পাশে দাঁড়ালাম ওর। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। খোলা চুল উড়ছে আমার পাগলের মতন। মাঝে মাঝেই আমি সামনে টেনে নিয়ে আসছি আমার চুলের গোছ। হয়ত হালকা ফরসা হবে কিছু পরেই। ও সরে এলো আমার কাছে। আমার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। ওকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে যা শক্তিক্ষয় হয়েছিল আমার, ওকে পিছনে পেয়ে, ওর বুকে নিজেকে এলিয়ে দিলাম একেবারে। ও ধরে রইল আমাকে। বলল
- কি ভেবেছিলি? আমি আর নেই?
সাড়া দিলাম না আমি ওর কথার। মাথাটা ওর বুকে আরো এলিয়ে দিয়ে আমি কতটা নিশ্চিন্ত সেটা ওকে বোঝালাম। হাত দুটো আমার দুই হাতের তলা দিয়ে এসে আমার পেটের কাছে রয়েছে। ওর দুটো হাত কে আমি শক্ত করে ধরে রইলাম। আমার ও বলল,
- এখনি ফরসা হবে জানিস?
- হুম।
ওর বুকের ওম আমার সর্বাঙ্গে সঞ্চারিত হচ্ছে। খুব ভালো লাগছে আমার। কিন্তু ছেলে আছে নীচে একলা শুয়ে। ভয় পাবে ও ঘুম ভেঙ্গে গেলে। রাকা কে বললাম
- নীচে চল। ছেলে একা আছে। চা খাবি?
যেদিকে আমার চুলের গোছা টা ছিল সামনের দিকে করে, সেদিনে ও মুখ টা গুঁজে দিল। বলল,
- হুম খাব। চল।
আমি চুল টা খামচায় আটকে নীচে এলাম চা করতে আর রাকা ছেলের কাছে চলে গেল। চা বানিয়ে আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাব, দেখলাম আমার মা বাথরুম এ উঠেছে। আমাকে কাপ প্লেট হাতে নিয়ে দেখে অবাক হয়ে বলল,
- বাবাহ রাতে ঘুমোস নি নাকি দুটো তে? আবার বরের জন্য চা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মাঝ রাতে!!
কিছু বললাম না লজ্জা পেয়ে উঠে চলে এলাম। শুনতে পেলাম নীচে মা গজ গজ করছে।
- আজকাল কার ছেলে মেয়েদের কিছুই বুঝি না বাপু। এই এমন ঝগড়া করল, ছেলে কাঁদতে শুরু করল। আবার দেখি সারা রাত গল্প করেই কাটিয়ে দিল। ভগবান জানে এদের কি হবে।
লজ্জায় লাল হয়ে একেবারে ঘরে। দরজা টা লাগিয়ে ভাবলাম, মা মনে হয় আজকে সব থেকে খুশী। রাকাকে চা টা দিলাম। কিন্তু ও আমাকে দেখতেই থাকলে আমি যে কি করি? সবাই ভাবছে আমি নর্ম্যাল বউ। নই তো। এই ছেলেটা আমার বন্ধু ছিল। ছেলে থাকার সময়ে কত ম্যাচ খেলেছি এক সাথে। কতবার আমাকে জড়িয়ে ধরেছে ও তখন। কিন্তু এখন জড়িয়ে ধরলে আমার লজ্জা করবে না? তখন কি আমি মেয়েছিলাম? এখন হয়েছি। এখন ও আমার দিকে কামুক ভাবে তাকায়। জড়িয়ে ধরলে নিজের বুক দিয়ে আমার বুকে চাপ দেয়। আমার শরীরের এখানে সেখানে হাত দেয়। ফারাক নেই? সেই ব্যাপার টা কেউ বুঝতে চাইছে না। আমি শিভ কে দেওয়ালের দিকে সরিয়ে শোয়ালাম। নাহ এই খচ্চর ছেলেকে আর আলাদা করে শুতে দিলে হবে না। কখন কোথায় বেরিয়ে হাওয়া খেতে যাবে আর ভয়ে আমার প্রান বেরিয়ে যাবে।
নাহ আর একদম না। কোন ভাবেই ওকে আমার থেকে দূরে রাখা যাবে না। একেবারে নিজের সাথে ধরে রাখতে হবে। ভগবান এই রকম ছেলেদের একটা ব্যাপারেই সেরা করে পাঠান। বাকি সব ব্যাপারে এরা সাধারনের থেকেও সাধারন। খেলাতে হয় তো ও বিশাল কিছু, কিন্তু জীবনে ওকে কোন ভাবেই নিজের ইচ্ছে মতন চলতে দিলে হবে না। দরকারে ও যা চায় ওকে দিতে হবে। হয়ত আমার সমস্যা হবে। কিন্তু আমাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে ওকে ঠিক রাখতে হবে আর আমি আমার সমস্যা নিয়ে বাঁচব। আমি ভেবে নিয়েছি, ওকে ঠিক রাখব। আমি ছেলে ছিলাম এই ভাবনা টা মন থেকে একেবারে শেষ করে ফেলব আমি। বাস শুধু ওর বউ আমি। শিভের মা আমি।
বুঝে গেলাম আমার শিভ কে সব থেকে নিজের করে পাবার প্রথম কন্ডিশন ই ছিল ওর বাবাকে নিজের স্বামী হিসাবে মেনে নেওয়া। আর কোন কথা বললাম না আমি। চুপচাপ মাঝে গিয়ে শুলাম আমি ছেলের দিকে মুখ ফিরে। কেউ জানল না কেউ বুঝল না, কত দুঃখ, কত ইগো, কত ঘৃনা, কত রাগ নিজের মধ্যে চেপে রেখে আমি ছেলে আর ছেলের বাবার মাঝে শুলাম। হয়ত আমি আজকে সত্যি করে মেয়ে হলাম। সরে গেলাম ওর দিকে আমি। মিশে যাচ্ছি ওর ইচ্ছের সাথে। টানছে ও আমাকে ওর দিকে। ওর পুরোন বন্ধুর মধ্যে ও নিজের বউ কে পেয়েছে আজ। আমিও কি পাই নি, আমার রাকার মধ্যে আমার স্বামী কে? ওকে হারানোর ভয় টা এতো প্রবল, আজ যা কিছু করতে আমি রাজী। সব মেয়েরা ছোট থেকে মেয়ে হিসাবে বড় হয়, কত ব্রত করে, শিবরাত্রি করে।শুধু একটা মনের মতন সাথী পাবার আশায়। জানিনা তারা কেমন বর পায়। কিন্তু আমি পেয়েছি একটা অদ্ভুত জীব কে আমার বর হিসাবে। হয়ত সে অদ্ভুত, কিন্তু আমার। একেবারে আমার।কেননা, আমাকে জীবনের সব থেকে বড় উপহার টা সে আমাকে দিয়েছে। সে আমার ছেলে। আমার শিভ।নানান রকম মনের ভাবনা আমার আসছে আর ও আমাকে টানছে নিজের দিকে। টানুক। আমাকে একেবারে নিজের করে নিক ও।আর তো কিছু চাই নি আমি। ভগবান আমার মুখ রেখেছেন। জীবনে কোন ব্রত করিনি, শিব রাত্রি পালন করিনি।এসব না করেও জানিনা কি করে মেয়ে হয়ে গেলাম আমি কিন্তু আজকে আমার সত্যি করেই শিভের সাথে শিবের ও প্রাপ্তি হল।
পার্ট ১ সমাপ্ত