Thread Rating:
  • 90 Vote(s) - 3.47 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance মন ২ - কাহিনীর নাম- শিবের শিব প্রাপ্তি- সমাপ্ত
আগের পর্বের কিছু অংশ.........

রাকা ব্যাগ টা এক লাথি তে কোথায় পাঠিয়ে দিল কে জানে। আমি আন্টি কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি ডুকরে ডুকরে। আন্টিও তাই। কাঁদতে কাঁদতেই দেখছি, ওরা বেরিয়ে গেল ধীর পায়ে বাড়ি থেকে এক এক করে। তীব্র চিৎকার করে উঠলাম আমি,

-     রাকা দাঁড়া!!!!!! রাকা চলে যাস না!!! আমি কোন দিন আসবো না তোর কাছে!!!! রাকা আ আ আ আ আ আ আ আ আ আ আ!!!!!!!!!!!                                                       
                                                                  পর্ব পঁচিশ
 
মনেও নেই আমার তারপরের ছয় মাস কি ভাবে কেটেছে আমার। ফোন টা তাশির জলে ফেলে দিয়েছিলাম আমি। কিম্বা জানিনা কোথায় ছুঁড়ে দিয়েছিলাম আমি ফোন টা আমার। শুধু মনে পরে, সন্ধ্যে পেরিয়ে গেলেও আমি আর আন্টি উঠনে বসে কেঁদেছিলাম শুধু। দুজনের বুক থেকেই হারিয়ে যাবার যন্ত্রণা। একজন নিজের সন্তান কে বাড়ি থেকে বের করে দেবার যন্ত্রণায় কাঁদছিল, আর একজন কাঁদছিল, যাকে সর্বস্ব মানত তার হৃদয় থেকে সমূলে উৎপাটিত হয়ে যাবার ব্যাথায়।

হ্যাঁ তবে প্রথম মাস খানেক আমি আন্টির বাড়ি যাই নি। নিজেকে সামলে ছিলাম। কিন্তু ওই একটু ঠিকঠাক হতেই আন্টির বাড়ি আমি নিয়মিত যেতাম। কেউ রাকা প্রসঙ্গ তুলতাম না। কিন্তু মাঝে মাঝেই দুজনে কাঁদতাম। আমার ফাইনাল এর রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল। কিন্তু ততটা না কারন শেষ দিক টা কম পড়াশোনা করলেও সেটা যথেষ্ট ছিল আমার গোল্ড মেডেল পাবার জন্য। এম এস সি তে ভর্তি হয়ে গেছিলাম আমি। ইচ্ছে ছিল, এর পরে বি এড করে নেব। আর টিচিং এর এক্সাম গুলো দেব। আমি অপেক্ষা না করে, ফর্ম তুলতে শুরু করে দিয়েছিলাম।

মেলামেশা একেবারে কমিয়ে দিয়েছিলাম। ফোন তো আর ব্যবহার করতাম না কারন ইচ্ছে করত না। ফোনে ফেসবুক হোয়াটসেপ ছিল। বন্ধুরা নানা প্রশ্ন করত। রাকা অঞ্জনার বিয়ে নিয়ে রুদ্রপুরে বিশাল কিছু হলো। অঞ্জনার বাবা খুব বড়লোক। সেই রকম তো হবেই। আন্টি আর আঙ্কল, চলে গেছিলেন ওনাদের গ্রামে সেই দিন। অঞ্জনার মা আর বোন এসেছিল আমাদের বাড়ি নিমন্ত্রন করতে। আমার বাপি কে আর মা কে অনেক কথা শুনিয়ে চলে গেছিলেন। আর আমার বাপি অতো কথা শুনেও গেছিল উপহার নিয়ে। বাপি বলেছিল, নিমন্ত্রন রাখা একটা দায়িত্ব। খাওয়া দাওয়া না করে, উপহার টা দিয়ে বাপি চলে এসেছিল। শুনেছিলাম, রাকা নাকি বাপি কে অনেক করে দুটি খেয়ে আসতে বলেছিল। বাপি ওকে আশির্ব্বাদ করে চলে এসেছিল।

যাই হোক আমার মা রাকার উপরে যথেষ্ট রেগে গেছিল। কিন্তু আন্টির সাথে খুব যোগাযোগ রেখেছিল মা। আমার মুখ থেকে সেদিনে ঘটনা শোনার পরে মা ও মাঝে মাঝে আমার সাথে আন্টির কাছে যেত। মনে হয়েছিল আমার, যতদিন না আন্টি আবার রাকা কে বুকে টেনে নেন, আন্টির সন্তানের দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হবে। চাকরি পেতে হবে আমাকে খুব তাড়াতাড়ি। ভাবলাম, যা হবার হয়ে গেছে। আমি তো মেয়ে হতে চেয়েছিলাম, মেয়ে হব বলে। মাঝে রাকার ভালোবাসা আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। ভেবেছিলাম পুরুষ রা বুঝি এমন ই সরল হয়। এমন ভাবেই ভালবাসে। সেই সব যখন মিটে গেছে আর ভেবে কি লাভ। ধীরে ধীরে আমি পুরোন অবস্থায় ফিরে গেলাম। রাকা জন্য যা যা রূপ চর্চা করতাম সে সব বন্ধ করে দিলাম। একেবারে সাধারন হয়ে থাকতাম আমি।

কিন্তু রূপ কি আর এই ভাবে আটকানো যায়? মা লক্ষ্মীর রূপ যেমন চোখে টানে সবার, সতীর যোগিনী রূপ ও তো শিব কে টলিয়েছিল। কাজেই যেখানেই যাই মায়ের সাথে আমার রূপের প্রশংসা থামল না। নানান ভাবে মায়ের কাছে সম্বন্ধ আসতে শুরু করেছিল আমার জন্য। আমিও ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম শুনে শুনে। আর যতবার কোন ছেলে আমাকে রূপের প্রশংসা করত আমার রাকার কথা মাথায় ঘুরত। নিজের উপরেই একটা ঘেন্না তে আমি একেবারে সিটিয়ে যেতাম। একেবারে চুপ করে গেছিলাম আমি। কিন্তু সময় ধীরে ধীরে সব কিছুর উপরেই প্রলেপ দিয়ে দেয়। সেটা সে জয়গর্বে মদমত্ত হস্তীর ক্ষমতার উপরে বয়সের ভার চাপিয়ে দেওয়াই হোক বা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া রাজার, সুস্থ হয়ে সমরাঙ্গনে ফিরে আসাই হোক। আমার ও ক্ষতে প্রলেপ পরতে শুরু করল সময়ের। আর আমার কাছে ছিল আমার বই আর গীটার। মাঝে মাঝে বাপি বন্ধুর ক্লাবে গিয়ে বল নিয়ে নানান প্র্যাক্টিস করা হোক বা বরুন কাকুর অনুরোধে একেবারে কচি গুলো কে শেখানোই হোক। আর রোজ সন্ধ্যে বেলায় রাকার মায়ের কাছে থেকে আমার ও দিন কাটতে লাগল নদীর স্রোতের মতন।

সেদিনের পর থেকে রনি র সাথে আমি আর কোন যোগাযোগ ই রাখিনি আমি। আহা ছেলেটা মার অব্দি খেল আমার জন্য। মুখ টা বার বার মনে পরে ওর। ঠোঁটের কষে রক্ত আর জল ভরা চোখ। ছিঃ রাকা, এমনি ভাবে তুই রনি কে কষ্ট দিতে পারলি? একদিন আমি স্কুটি টা নিয়ে ওর বাড়ি চলে গেলাম। কাকিমা মানে রনির মা আমাকে বিশেষ পছন্দ করতেন না। না মানে সবাই আমার মতন মানুষ দের পছন্দ করে না। আমার বাপি ই করত না, আর বাকি দের কি বলব। আমার তাতে কষ্ট হতো না। বাড়িতে রনি ছিল না। আমাকে দেখেই কাকিমা একটু থমকে গেলেন। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মনে হয়। আসলে, গেছিলাম প্রায় বছর আড়াই আগে রনির বাড়ি।তখন অন্য রকম ছিলাম আমি একটু।  তারপরে এই প্রথম এলাম। আমাকে চিনতে পারেন নি। মুখ টা কিছু টা বদলে গেছিল। আওয়াজ বদলে গেলেও আমার বলার ধরনে মনে হয় বুঝতে পারলেন আমাকে। হেসে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। ভাবছিলাম এই রে, আবার কিছু না বলে দেন আমাকে।  কিন্তু এসে ভালভাবেই কথা বললেন আমার সাথে। বললেন, রনি একটা দোকান করেছে তাশির তিন মাথার মোড়ে।

ইশ কি বাজে ছেলে। একবার আমাকে বলল না? আমি আর অপেক্ষা না করে সোজা তাশির তিন মাথার মোড়ে। জমজমাট হয়ে গেছে মোড় টা। আমি রাকাদের বাড়ি যেতাম, কিন্তু সেটা ভিতর দিয়ে। বড় রাস্তা লোকজন এড়িয়ে চলতাম আমি। বিকাল বেলা। ঝলমল করছে যেন চারদিক। আমি দেখলাম, বেশ কিছুটা সরে এসে একটা ছোট রাস্তার মোড়ে ও একটা মাঝারী মাপের স্টল নিয়ে বসেছে। বেশ ভিড়। মোড় বলে যারা খাচ্ছে, ওদের স্কুটার, গাড়ি রাখার একটা বড় জায়গা পেয়ে গেছে রাস্তার ধারে। আমি আমার স্কুটি টা একটু দূরে পার্ক করে এগিয়ে যেতেই দেখি, বেচারী একেবারে হিমসিম খাচ্ছে। যে বানাচ্ছে সে তো বানাচ্ছে,তার তো অন্য দিকে মন দেবার সময় ও নেই।  আর রনি, কখনো প্লেট ধুচ্ছে, কখনো পয়সা নিচ্ছে যাদের খাওয়া হয়ে যাচ্ছে ওদের থেকে। আবার কখনো খাবার প্যাক করছে প্রয়োজনে।  আহা একেবারে পাগল হয়ে যাচ্ছে। পাশেই দেখলাম একটা বড় জায়গায় এঁটো প্লেট গুলো জরো করা। প্লেটের উপরে একটা মোটা দর্শনীয় টিস্যু রেখে তার উপরে ও খাবার দিচ্ছে। খাবার হয়ে গেলে টিস্যু গুলো ফেলে দিচ্ছে একটা গার্বেজ বক্স এ আর প্লেট গুলো কে ধুয়ে নিচ্ছে।

আমি এগিয়ে গেলাম। ওড়না টা কোমরে ভাল করে বাঁধলাম। ও তখন ধুচ্ছিল প্লেট গুল কে। পাশেই দেখলাম একটা প্লাস্টিকের গ্লাভস রাখা আছে। সেটা হাতে পরে নিলাম আমি। ওখানে গিয়ে ওকে ঠেলে আমি জলে হাত ডোবালাম। ও চমকে আমাকে দেখল। আমিও দেখলাম ওকে। বললাম,
-     তুই যা ওদিকে। আমি এদিক টা দেখে নিচ্ছি।

ও বেচারী কি বলবে, কি করবে খুঁজে পেল না। সবার সামনেই চিৎকার করে উঠল একেবারে
-     শিব!!!!!!!
-     ঊফ আস্তে চেঁচা। হ্যাঁ আমি। যা, অনেকে খেয়ে টাকা দিচ্ছে। নিয়ে নে কথা বলার সময় অনেক পাবি।
-     আরে !! না না আমি করব।

তারপরে আমার কানের কাছে এসে বলল,
-     এগুলো এঁটো প্লেট শিব। আমি করে নিচ্ছি তো

রেগে গেলাম আমি। ছেলে গুলো কিচ্ছু শুনতে চায় না। বললাম
-     আমি জানি। তুই যা এখন। আপাতত তো সামাল দেওয়া দরকার।

ও সরে গেলো কাউন্টারের দিকে। ওদিকে টা একটু সামলেই আমাকে নাটক করে বলল,
-     আমি তো ভাবতে পারছি না, মালিকায়ে রুদ্রপুর আমার দোকানে এসেছে আজকে!

আমার ততক্ষনে সব কটা প্লেট ধোয়া হয়ে গেছিল। স্টলের কাছে এনে, মুছে উপরে টিস্যু লাগিয়েই রাখছিলাম। যাতে সময় কম লাগে রনির। হেসে ফেললাম আমি রনির কথা বলার ধরনে। বললাম,
-     হ্যাঁ রে এলাম । তুই তো ডাকিস নি।  তোর সাথে তো কথা নেই আমার।
একজন কে সার্ভ শেষ করে আমাকে বলল
-     কেন কেন আমি কি করলাম?
-     এতো ভালো একটা খবর আমাকে দিস নি কেন তুই?

রনি চুপ করে গেল। করুন ভাবে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে আমার দিকে। আর নিজের কাজ ও করছে। হয়ত যে কথা টা বলবে সেটা সবার সামনে বলতে পারছে না। গলা নামিয়ে বলতেও পারছে না, কারন যা চিৎকার চেঁচামেচি চলছে ওতে গলা নামিয়ে বললে শোনাই যেত না। এদিকে আমিও চুপ করে বসে নেই। টিস্যু লাগানো হয়ে গেলে, প্লেট কিছু পরে ছিল সেগুল ও ধুয়ে নিলাম আমি। ঘন্টা খানেক পরে ভিড় অনেক টাই হালকা হলো। এই সন্ধ্যে টা মারাত্মক ভিড় থাকে বুঝলাম। বাস তারপরে দেখলাম যে ভিড় টা রইল সেটা সামলানো যায় দুজনে। একটু হালকা হতেই বলল
-     তোর কাছে যাই কোন মুখে বলত?  কোন ছেলেকে তুই কি আর সহ্য করতে পারতিস?

তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। সেদিনে রাকার কাজে কথায় রনির লজ্জা বেশী হয়েছিল বুঝলাম। ওকে বললাম,
-     ধুর বোকা, তুই কি করবি? তোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আর তোকে কেন সহ্য করতে পারব না রে? আমার তো আর কোন বন্ধু নেই রে রনি তুই ছাড়া। বরং আমি চাই নি আর বেরোতে। আশে পাশের আলোচনা আর সহ্য করতে পারছিলাম না আমি। এখন আবার ঠিক হয়ে গেছি।

রনি আমাকে দেখছিল হাঁ করে। হয়ত বুঝছিল কিছু। ওকে বললাম ওর বাড়ি গেছিলাম আমি। ওর মা আমার সাথে ভালো ব্যবহার করলেন। ও শুনে যেন স্বস্তি পেল মনে হলো। রনি কিছু বলল না, কিন্তু আমাকে খাবার অফার করল ও,
-     খাবি কিছু?
-     নাহ খিদে নেই। তবে আসব এবার থেকে আমি তোর দোকানে। খাব তো বটেই। কিন্তু এখন আর খিদে নেই। কি রে আসতে দিবি তো?
-     কি যে বলিস? ফালতু বকিস না। এই তুই আজকে এলি, এতো ভিড় জীবনে হয় না আমার। মালকায়ে রুদ্রপুর, প্লেট ধুয়ে দিচ্ছে, এতেই মনে হয় সবাই ভিড় করেছে জানলি? তবে একটা শর্ত আছে আমার তোর এখানে আসা নিয়ে।
-     উফ কি যে বলিস না। আমি যা পারি তাই করেছি।
-     না না কাল থেকে তুই বসবি ক্যাশ এ। আর আমি বাকি কাজ গুলো করব।
-     ওরে বাবা , আমি কোন কালেই পয়সা পত্র বুঝি না। যেটা পারি সেটাই করব। প্লিস রনি!
-     ধ্যাত কি যে করিস না তুই। কোনদিন কাকু মানে তোর বাপি দেখলে আমাকে বকাঝকা করবে না?
-     আরে না না। আমি আজকে গিয়েই বাপি কে বলে দেব। তোকে কিচ্ছু বলবে না। আর বাপি কে এটাও বলে দেব, যাতে এরপর থেকে বাড়ির জন্য, তোর দোকান থেকেই কিনে নিয়ে যায়। আজকে আমাকে একটা প্যাক করে দিস। পয়সা নিবি কিন্তু। আন্টি আর আঙ্কল এর জন্য নিয়ে যাব।

রনি অবাক হল। বলল,
-     মানে রাকার বাবা মা?
-     হুম
-     তুই যাস এখনো?
-     হ্যাঁ আমি রোজ যাই। তোকে আমি বলেছিলাম না, রাকা যাই করুক আমার সাথে, ওনাদের সাথে আমার সম্পর্ক কোন দিন বদলাবে না। হ্যাঁ আন্টি না চাইলে যেতাম না। কিন্তু উনি আমাকে কত ভাবে যে সাহস দেন তোকে বলতে পারব না। সাহস দেবার ব্যাপার টা রাকা, আন্টির কাছেই পেয়েছিল মনে হয়।

রনি আমার দিকে চেয়ে রইল হাঁ করে জাস্ট। ওকে আমি বললাম, সেদিনের ঘটনা যেটা ও চলে আসার পরে হয়েছিল।তারপরে বেশ কিছু কাস্টমার চলে এসেছিল। দুজনাই ব্যস্ত হয়ে পরলাম আবার। সেগুলো মিটে যেতেই আমাকে বলল,
-     আমিও একদিন যাব রে আন্টির কাছে। ভয় লাগে আসলে, ভয় লাগে, সেদিনে যা হয়েছিল তারপরে আন্টি আমাকে ক্ষমা করতে পারবেন কিনা।

আমি বললাম
-     ধুর পাগলা, আন্টি তোর কথা জিজ্ঞাসা করেন খুব। যাক তুই এক প্লেট চাউমিন আমাকে বানিয়ে দে। পয়সা নিবি কিন্তু। আমার বাপি আর মায়ের জন্য নিয়ে গেলে না হয় না নিস। কিন্তু এটা নিস। আন্টি আনন্দ পাবে শুনলে তোর দোকানের খাবার।

আমার যেন একটা জায়গা হলো। বিনা কথায় সময় কাটানোর। মা কে বলেছিলাম। বাপি কেও বলে দিলাম। বাপি আর মা দুজনাই রনি কে পছন্দ করে। কারন সেদিনে রাকার বাড়িতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই আমি মা কে বলেছিলাম। কিছু বাদ দিয়েছিলাম। রাকার আমার গায়ে হাত তোলা টা চেপে গেছিলাম। সেটা একমাত্র আমি আর আন্টি জানি। রনিও জানে না। আমি রুদ্রপুরে থাকলেই রনির দোকান আর তারপরে আন্টির সাথে সময় কাটানো এই ছিল আমার রুটিন।

এর মাঝে রনি একদিন আমাকে প্রপোজ করে ফেলল। ছেলে মাত্রেই শিয়ালের মতন। দ্বিতীয় কোন চিন্তা ভাবনা করে না। এক বছরের মধ্যেই রনি স্টল থেকে একটা হোটেল বানিয়ে নিল। আমি যেতাম। কিন্তু তখন গিয়ে ক্যাশেই বসতে হতো। রনি তখন পাগলের মতন এদিক ওদিক ঘুরত।কোথায় কম দামে কাঁচামাল পাবে। ওকে বুঝিয়েছিলাম সেটা। ও পাহাড়ে চলে যেতো। কম দামে মুরগী, ছাগল, সব্জি, খুঁজে বেড়াত। যাই হোকে হোটেলের একটু লাভ বেশী হবে!  আমার তখন মাস্টার্স শেষ হয়ে গেছিল। বি এড আর এস এস সি র প্রেপ চলছিল আমার। দোকানে বসলেও আমার পড়াশোনা চলত। ভিড়ের সময় টা হতো না পড়াশোনা। সকালের দিকে যেতাম। দুপুর টা সামলে দিতাম। রনি কোন দিন থাকত, কোন দিন আমি আছি বলে বেরিয়ে যেত কোথাও। আমি তখন ক্যাশেই বসে থাকতাম। দোকান টা সাজাতাম। ও সন্ধ্যে থেকে থাকত। ও এলে ওর হাতে ক্যাশ বুঝিয়ে আমি আন্টির বাড়ি চলে যেতাম। সেখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মার্কেট থেকে নতুন রকম প্লেট, লাইটিং খুঁজে বেড়াতাম। মানে আমি যা পারতাম আরকি। সেই রকম ই একবার দূর্গাপুজোর সময়ে, পঞ্চমীর দিনে জানতাম দেরী হবে। আমি বাড়িতে বলে গেছিলাম। সেদিনে এতো ভিড় হয়েছিল রেস্টুরেন্ট এ যে টিকিট কেটে দিতে হচ্ছিল বাইরে যারা অপেক্ষা করছেন ওদের জন্য। এর ফাঁকে ছিল অর্ডার এর মাল পাঠানো। সব আমি করছিলাম এগুলো। আর রনি খাবারের দিক টা দেখছিল। প্রায় রাত বারোটা নাগাদ দোকান বন্ধ করে আমি আর ও হেঁটে ফিরছিলাম।
ভেবেছিলাম, কিছু হাঁটি। তারপরে যে যার বাড়ি। দোকান এ দুজন কর্মচারী শুয়ে থাকে। রনির ক্যাশ ও ভাই কে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় দোকান বন্ধ করার আগেই। আমার স্কুটি টা রনি টানছে আর আমি রাস্তায় এদিক সেদিক করে আসছিলাম। কখনো, নদির ধারে গিয়ে পা ভিজিয়ে নিচ্ছিলাম। রাস্তায় অনেক লোক। ঠাকুরের প্যান্ডাল সব খুলে গেছে। সবাই ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে। রনি বলল,
-     ক্ষেপে গেলি নাকি?

আমি হাসলাম, বললাম
-     কেন আনন্দে মানুষ এমন করে না?
-     হ্যাঁ তা করে। জানিস আজকে, কত টাকা প্রফিট করেছি আমি?

এমনি খেলার ছলেই বললাম
-     কত?
-     প্রায় পঞ্চাশের উপরে।
-     ওয়াও। দোকান টা বড় কর এবারে বুঝলি?

রনি সাড়া দিল না আমার কথার। অন্য কথা বলল
-     জানিস শিব! আমার যা উন্নতি হলো এই এক বছরে, তোর যোগদান তাতে কিছু কম নেই।

অবাক হলাম এবারে। সামান্য সাথে থাকা, প্লেট ধুয়ে দেওয়া,ক্যাশে বসা, দোকান সাজিয়ে দেওয়া যদি যোগদান ভাবে ও কি বা বলার আছে। বললাম
-     বাজে বকিস না তো। আমি না থাকলেও তুই এই উন্নতি টা করতিস। এখানে আমার কোন যোগদান নেই। পুরো টা তোর পরিশ্রম।

রনি মনে হলো সিরিয়াস হয়ে গেল। বলল না রে
-     তুই আমার ক্যাশ দেখেছিস। তাই আমি এই গুলো করতে পেরেছি। অন্য কেউ হলে শেষ করে দিত। শুধু কি তাই? কত বড় সাহস তুই আমার। আমাকে দরকারে অদরকারে কত সাজেশন দিয়েছিস তুই, তার হিসাব আছে নাকি?

আমি হেসে উঠলাম জোরে। বললাম,
-      আমি যে ক্যাশ থেকে সরাই নি তুই জানলি কি করে?

এবারে রনি হেসে উঠল, বলল
-     যে গত দেড় বছর শপিং করে নি। এবারের পুজোতেও কিছু নিসনি আমি জানি। যে একটা সাজের জিনিস কেনে না। গত দেড় বছর কোন ফোন কেনে নি। যার সখ আহ্লাদ কিছু নেই, সে সরিয়েই বা কি করবে?

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি রনির দিকে। বললাম
-     এতো বিশ্বাস করিস আমাকে।
-     হুম করি। নিজের থেকেও বেশী বিশ্বাস করি তোকে আমি।

সাড়া দিলাম না। রনির গলা টা অন্য রকম লাগছিল আমার। মনে হচ্ছিল, ও কি প্রেমে পরল নাকি আমার? কেমন আনমনা হয়ে গেলাম। রনির থেকে এগিয়ে গেলাম আমি সামনের দিকে একটু। বুক টা ধড়াস ধড়াস করছিল আমার তখন। ভাবছিলাম, হে ঠাকুর, আমার একজন ই কৃষ্ণ ছিল। তাকেই সব দিয়েছি। রনি যেন আমার থেকে কোন কষ্ট না পায়। কি করব ঠাকুর? দুজন তো বন্ধু ছিল আমার। একজন কে হারিয়েছি আমি, আরেক জন হারাতে চাই না আর। রনি বলে চলে আমার পিছনে,
-     শুধু আমি না, আমার মা, আন্টি, আমার দোকানের কর্মচারী, কুক সবাই মনে করে, তুই আছিস বলে আমার রেস্টুরেন্ট এতো উন্নতি করেছে।

ওকে ধমকে গেলাম,
-     খবর্দার রনি এই সব বাজে কথা ভাববি না। এই সাফল্য তোর। তবে এতেই থেমে যাস না। তোর কাস্টমার দের উপরে ব্যবহার ভালো। তুই ঠকাতে চাস না কাউকে। ফ্রেশ খাবার খাওয়াস। সেই জন্য কোথা থেকে না কোথা থেকে কাঁচামাল তুলে আনিস। এই গুলই কারন তোর উন্নতির। বোকা কোথাকার!
-     না রে আমি বোকা নই। এই যে কথা গুলো বললি, কই কেউ তো বলে না? একজন প্রকৃত সাথী ই এ কথা বলে। আমার দোকানের মালকিন হতে সমস্যা কীসের তোর। হ্যাঁ তোর মতন লেখা পড়া জানিনা। কিন্তু তুই পাশে থাকলে গ্র্যাজুয়েট আমি হয়েই যাব। আমি জানি রাকার মতন ভাগ্য করে আমি আসিনি।

রাকার নাম টা শুনে কেন জানিনা গা আমার জ্বলে উঠল এবারে। এতো দিন ওর নাম টা শুনলে মন টা কষ্টে ভরে যেত। কিন্তু আজকে কেন জানিনা আমার রাগ হলো। এটা ঠিক আমি আজকেও ওকে ছাড়া কাউকে ভাবি না। ওকেই মন দিয়েছি আমি। কিন্তু সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত। ওকে বললাম বেশ রেগেই আমি।
-     ওই নাম টা নিবি না আমার সামনে রনি।

রনি চুপ করে গেল। আর আমার রাগ টাও নেমে গেল একেবারে।আজকে ভালো একটা দিন। আজকের দিনে রনির উপরে রেগে থাকার কোন মানে হয় না। রনির বলা আগের কথা গুলো মনে পড়ল। ওকে বললাম
-     তুই কি আমাকে প্রপোজ করলি?
রনি মনে হয় ভয় পেয়ে গেছে একটু। তাও বলল
-     হ্যাঁ করলাম।

তাকালাম রনির দিকে। বড্ড মায়া হলো ছেলে টা কে দেখে আমার। ওকে দেখলেই মনে যায় রাকাদের বাড়িতে, ঠোঁটে রক্ত নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলছে, শিব আমি চললাম, আন্টি চললাম। বুক টা আমার যন্ত্রণায় ভরে গেল একেবারে। ওকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। ও বুঝল আমি কাঁদছি। আমি ওকে সরল ভাবেই জড়িয়ে ধরেছি। বন্ধুর মত। কিন্তু ও আমাকে বন্ধুর থেকেও বড় কিছু ভাবে। তাই সাহস করে জড়িয়ে ধরতে পারছে না। না ধরুক। আমি সেই জন্যেই জড়িয়ে ধরলাম ওকে। এটা বুঝতে যে ও ঠিক কি ভাবে আমাকে নিয়ে।

তারপরে ছেড়ে দিলাম ওকে আমি। গাড়ীর উল্টো দিকে গিয়ে বললাম,
-     রনি, কি চাইছিস, এক সমস্যায়, আমার শেষ বন্ধু টাও সরে যাক আমার থেকে? আমার জীবনে অনেক কমপ্লিকেশন রনি। আমি আজকেও রাকা কেই ভালবাসি। আমি জানি কোনদিন আমার এই প্রেম পূর্নতা পাবে না আমার মেয়ে হবার মতই। কিন্তু তুই ও প্লিস রাকার মতন ফাঁদে পা দিস না।

রনি চুপ করে রইল। আমি আবার বললাম ওকে
-     আমি তোর জন্য পাশে থাকব না? আর সেটা আছি বলে তুই আমাকে তোর সব কিছু মালকিন হতে বলছিস? তোর কি মনে হয়, আমি মালকিন হবার আশায় এই সব করেছি? আচ্ছা একটা কথা বল তুই, আমি তোর জন্য এটা না করলে, কি করতাম? বন্ধুত্ব ত্যাগ করে বাড়িতে বসে থাকতাম? 

দুজনাই চুপ রইলাম বহুক্ষন। জানিনা কটা বাজে। অনেক পরে রনি বলল আমাকে,
-     একটা কথা দে, আজকের এই সময় টার জন্য আমাদের বন্ধুত্ব যেন নষ্ট না হয়? আমি সব সহ্য করতে পারব, তোর সাথে বন্ধুত্ব শেষ হয়ে গেলে জানিনা আমার কি হবে।

অবাক হয়ে তাকালাম আমি রনির দিকে। সেই এক চাওয়া তো আমিও চেয়েছিলাম রাকার কাছে। রাকা মেনে নেয় নি। আমি না হয় রনির টা মেনেই নিলাম। কষ্ট আমিও পাব, কারন আমি জানি আমি ওর সামনে গেলে ও কষ্ট পাবে এই ভেবে, যে ও আমাকে পাবে না। কিন্তু নেব আমি মেনে এটা। রনির জন্যেই নেব মেনে। হয়ত এই ব্যাপার টা ওর মন থেকে মিটে গেল একেবারে।

সেদিনের পর থেকে না জানি কতবার ও আমাকে প্রপোজ করেছে, আর রাকার উপরে আমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিয়েছে। আর আমি সব বার ই ওকে না বলেছি। একটা সময়ে আন্টি মানে রাকার মা ও আমাকে বলেছিল,
-     ওরে ভালবাসা এতো বার কারোর দরজায় আসে না। কেন রাকার ভালবাসায় যোগিনী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস তুই। রনি তোকে এতো ভালোবাসে, মেনে নিলে ক্ষতি কি?

তারপরে হয়ত ভেবেছেন, মেয়েরা একবার যাকে মন দিয়ে দেয়, আর তো কিছু ভাবতে পারে না। নিজে মেয়ে বলে বুঝেছিলেন আমার সমস্যা। রনির জন্য খারাপ লাগত আমার । কিন্তু এখন রনির বিয়ের ঠিক হয়ে যাওয়া তে অনেক টা মুক্ত আমি। মেয়ে টা বেশ ভালো। রনির একেবারে উপযুক্ত। রাকা আর রনি দেখতেই উপর থেকে টাফ। কিন্তু দুজনের ভিতর টাই মারাত্মক নরম। আমি জানি আমার থেকেও ওদের মন অনেক নরম। শুয়োর টার সাথে আমার বিয়ে হল, রনির আনন্দের যেন সীমা নেই। আমাকে বলে দিয়েছে, ও যা খরচা করেছে, সেটা নাকি ও অধিকারে করেছে। আমি যেন দাম দিতে না যাই। সব মিটে গেলে বাপি কে বলব ওর রেস্টুরেন্ট সব আত্মীয় এবং বন্ধু বান্ধব দের জন্য পার্টির অর্গানাইজ করতে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
[+] 11 users Like nandanadasnandana's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মন ২ - শিবের শিব প্রাপ্তি- অধ্যায় চার- নতুন পর্ব ২৪ - by nandanadasnandana - 23-02-2022, 12:53 PM



Users browsing this thread: 3 Guest(s)