18-02-2022, 05:59 PM
ট্রলি থেকে নেমে সঞ্জুকে দেখতে পেলাম। এগিয়ে এলো।
-কিরে তুই এখানে।
একগাল হাসি।
-সকাল থেকে তোর কোনো পাত্তা নেই ব্যাপার কি?
চিকনার দিকে তাকালো। চিকনা তোকে কিছু বলে নি!
-বলেছে। যা বলেছে তাতে তোর এখানে থাকার কথা নয়। বুঝেছি নিউজটা তোর কাছে আসতে গিয়ে মাঝে ব্রেক করে আর এক জায়গায় চলে গেছে।
-বড়মা তোকে ডাকছে। অনাদি বললো। আমি বড়মার দিকে তাকালাম, পাঁচজনে কিছু শলা পরামর্শ করছে। দূরে একটা বাইক তীর বেগে ছুটে আসছে, তার আলোটা একবার রাস্তার ওপর আছাড় খাচ্ছে আর একবার দূরে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে।
আমি পায়ে পায়ে বড়মার দিকে এগিয়ে গেলাম, চারদিকে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে। তার রূপলি আলোর ছটা চারিদিকে ছড়িয়ে পরেছে। আমি বড়মার কাছে এলাম, বড়মার চোখের ভাষা আমি পড়তে পারছি না।
-যাবি না?
-চলো।
আমি আগে আমার একপাশে বড়মা একপাশে মিত্রা পছনে ইসলাম ভাই নীপা ছোটমা ভজু। তার পেছনে অনাদিরা। আমরা সেই বড় অশ্বত্থ তলায় এলাম, পুকুরের জল শুকিয়ে গেছে, মাঝে কিছুটা রয়েছে।
-জানো বড়মা এই পুকুরের জল আমি কোনোদিন শুকোতে দেখিনি। অনাদিদের জিজ্ঞাসা করো। এ তল্লাটের সব পুকুরের জল শুকিয়ে পুকুর ফেটে চৌচির হয়ে যায়, কিন্তু এই পুকুরের জল তুমি এখন যেমন দেখছো তেমনি থাকবে, বর্ষাকালে অবশ্য ভরে যায়।
-দিদি গো আমি এসে গেছি।
-নিরঞ্জনদার গলা না!
-হ্যাঁ।
-আমরা এখানে জানলো কি করে?
-বাড়িতে গেছিলো ওরা বলেছে।
পেছনে পচাকে দেখতে পেলাম।
-কিরে পেচো। সকাল থেকে পাত্তা নেই, নিরঞ্জনদাকে কোথা থেকে ধরে আনলি।
-কেনো চক থেকে। আমি তো চকে বসেছিলাম। আমার তো ওখানে ডিউটি ছিল। অনাদি তোকে কিছু বলে নি।
-আমি ঠিক সময় এসে গেছি দিদি অন্যায় নিও না পার্টি করা কি যে ফ্যাচাং।
মিত্রা আমার একটা হাত ধরে আছে। ওর হাতটা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। বড়মা আমার আর একটা হাত ধরে আছে।
-মুন্না ভাই এই ঘাসের ওপরে সকলে বোসো। একদিন এই গাছটার তলায় আমার বাবা একজন ফর্সা মতো লোককে দেখতে পেয়েছিলেন, তার সাদা ধবধবে দাড়ি পরনে সাদা আলখাল্লা। এই গ্রামের মানুষের মুখে মুখে যেটা বহু দিন ধরে প্রচলিত হয়ে চলে আসছে, একদিন হয়তো আমার মুখের কথায় আরো একজন অনি এসে তাঁকে খোঁজার চেষ্টা করবে, পাবে কিনা বলতে পারবে না। তবে গাছটার ডাল পালা কেউ কাটে না। ঝড়ে ভেঙে পরতে দেখেছি। শুনেছি, দেখিনি- এর ডালে কুঠারের কোপ মারলে তার মৃত্যু হয়েছে। আমি প্রায় এখানে আসতাম যখন গ্রামে থাকতাম। এখনো গ্রামে পা রাখলে একবার অন্ততঃ আসবো। দেখতে পাচ্ছো চারিদিক, তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে এই কলেজটা ছাড়া কোনো জনমানব নেই। আমি অমাবস্যার রাতে একা এখানে আসি। ভীষণ ভালো লাগে, তোমাকে বোঝাতে পারবো না, পুকুরের ওই পাড়টায় বসে থাকি ঘন্টাখানেক, তারপর চলে যাই। এখানে এলে আমি নিজের মধ্যে নিজে থাকি না। আমার বিপদে আপদে এই গাছটা আমায় ভীষণ সাহায্য করে, তোমরা বিশ্বাস করতে পারো আবার নাও করতে পারো। আমার যা কিছু চাওয়া পাওয়া এই গাছের কাছে।
ইসলাম ভাই আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমার হাতটা ধরে বললো
-আজ আমি এখানে তোর জন্য নামাজ পরবো, তারপর তোর কাছ থেকে কিছু চাইবো, তুই দিবি।
-আমার ক্ষমতা সীমিত, আমার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে যদি থাকে তোমাকে অবশ্যই দেবো।
-সঞ্জু ফুল নিয়ে এসেছিস, বাবা।
-হ্যাঁ বড়মা।
আমার পাশে মিত্রা দাঁড়িয়ে আছে আমার হাতটা ধরে। ও আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, ওরা সবাই পুকুর ঘাটে নেমে গেলো। যে যার মতো করে হাত-পা ধুলো মুখে-হাতে জল দিলো। গাছের তলায় সবাই একসঙ্গে বসলো। ইসলাম ভাই তার মতো নামাজ পরতে শুরু করলো। আমি মিত্রা দুজনে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
-চল আমরা পুকুর ঘাটে যাই। মিত্রার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোলো না। জুতো খুলে, দুজনে পুকুর ঘাটে নামলাম। ভালো করে হাতে-মুখে জল দিলাম।
-ভয় করছে?
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের ইশারায় কথা বললো, না।
আমরা উঠে এলাম। দেখলাম ওরা দাঁড়িয়ে আছে। বড়মা এগিয়ে এলেন। গাছের তলায় ফুলের পাহাড়, ওরা যে যার মতো অঞ্জলি দিয়েছে। আমার বিশ্বাসে ওরাও সামিল হয়েছে। বড়মা আঁচলের গিঁট খুললো। একটা মলিন সোনার চেইন গিঁটের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো। চিনতে পারলাম এটা মায়ের গলার চেইন, একদিন নিভৃতে একাকী ঘরে মিত্রার গলায় পরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, সেদিন মিত্রা আমার হাত থেকে ওটা পরতে চায় নি। বলেছিলো ওটা রেখে দে আমি সময় হলে তোর কাছ থেকে পরবো, আমায় কথা দে এই হার তুই কাউকে দিবি না। ওটাতে আমার অধিকার। আমি কথা দিয়েছিলাম।
আমি বড়মার মুখের দিকে তাকালাম, বড়মার চোখ দুটো ছলছলে। চোখে কিসের আর্তি। ইসলাম ভাই আমার কাছে এগিয়ে এলো আমার হাতটা ধরলো, নিরঞ্জনদা এগিয়ে এলো, ছোটোমা তার পাশে, একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি কোনো কথা বললাম না কেমন যেন হয়ে গেলাম, আমি বড়মার হাত থেকে হারটা নিয়ে মিত্রার গলায় পরিয়ে দিলাম। আমি কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছি, মিত্রার হাত ধরে সেই অশ্বত্থ তলায় নিয়ে গিয়ে একসঙ্গে প্রণাম করলাম, গাছের গোড়ায় রাখা ফুলের থেকে একমুঠো ফুল নিয়ে মিত্রার হাতে দিলাম, তারপর মিত্রাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। কেনো জানি না।
বড়মা এগিয়ে এলন, আমি মিত্রাকে ছেড়ে বড়মার বুকে মুখ লোকালাম। ছোটোমা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ইসলাম ভাই, নিরঞ্জনদা পাশে দাঁড়িয়ে আছে, ওরা ছজন আমাদের থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
-মুখ তোল অনি। কাঁদিস না। আমি তোর মুখ দেখিনি তোর বুকটা দেখেছিলাম। আমি যে তোর মা। আমার আগে তোর ছোটোমা তোর বুকটা দেখেছিলো।
আমার কান্না থামছে না। মার কথা বার বার মনে পরে যাচ্ছে, চোখ বন্ধ করেও তাকে দেখতে পাচ্ছি না।
-অনি জানিস তো বিয়েটা একটা উপলক্ষ মাত্র। ভালোবাসার বন্ধন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন্ধন। যে কথা তোকে এতদিন বলিনি, সেই কথা তোকে আজ বলি....। আমি বড়মার কাঁধে মুখ গুঁজে না না বলছি।
-তোকে শুনতে হবে অনি, বড়মা তোর কাছে কনফেস করবে বলেছিলো। তোর দাদার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় নি। কিন্তু ভালোবাসার অধিকারে, তার সঙ্গে তিরিশটা বছর কাটিয়ে দিলাম, আমাদের ভালোবাসায় কোনোদিন চির ধরে নি। আমার বাবা বসিরহাটের বিশাল জমিদার, কলকাতায় এক আত্মীয় বাড়িতে থেকে বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ি। কলকাতা তখন উত্তাল, সত্তরের দশক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়, দুজনে এক কলেজে পরতাম, তোর দাদা আমার থেকে এক বছরের সিনিয়র, চুটিয়ে পার্টি করে কলেজের জিএস। নিরঞ্জন আমার থেকে এক বছরের জুনিয়র, তোর দাদার থেকে দু বছরের। ও তোর দাদার সাগরেদ, বিয়ের রাতে তোর দাদা নিরঞ্জনকে পাঠিয়েছিলো সঙ্গে একটা চিরকুট। বিয়ে হওয়ার পর বাসর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম বাথরুম যাওয়ার নাম করে, তারপর তোর দাদার হাত ধরে কলকাতায়। এসে নিরঞ্জনের মেসে ছিলাম এক মাস। তখন থেকে ও আমার ভাই, আমি ওর দিদি, অনেক ঝড় ভাই-বোনে কাটিয়েছি। তোর দাদা তার আঁচও পায় নি, পেতে দিই নি। তাহলে তোর দাদাকে আজ হয়তো পেতিস না। অনেক বার তোকে বলতে চেয়েছি পারি নি! মনে মনে ঠিক করেছিলাম, তোর বিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে তোকে সব কথা বলবো। নিরঞ্জনকে তাই আজ ডেকে নিয়েছি, তোর দাদার খুব আসার ইচ্ছে ছিলো, পারে নি তাই নিরঞ্জনকে সাক্ষী মানলাম।
-সেদিন সেই রাতে কলকাতায় আসতে আসতে তোর দাদার কাছ থেকে দুটো কথা আদায় করেছিলাম। যে আমায় সিঁথিতে সিঁদুর পড়িয়ে দিয়েছে, তার তো কোনো দোষ নেই, তার জন্য এই সিঁদুরটা থাক, তোমার জন্য আমার ভালোবাসা রইলো। আর একটা কথা তোর দাদার কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিলাম, আমাকে কোনো দিন মা হতে অনুরোধ করবে না, তখন বয়েসটা কম ছিলো, একটা আবেগের তাড়নায় বলে ফেলেছিলাম, আজ বুঝতে পারি কতো বড় ভুল করেছিলাম। আমার হাত দুটো ধরে বললো
-বুড়ীমাসির কাছে আমি সব খোঁজ নিয়ে মিত্রাকে তোর হাতে আজ সঁপে দিলাম। ওরও একটা জীবন আছে। আমি তোকে আমার মতো প্রতিজ্ঞা করতে বারণ করবো। মিত্রা তোকে ভালোবাসে, তুই মিত্রাকে ভালোবাসিস। তোদের ভালোবাসর ফল আমাদের দিস, আমরা মানুষ করবো, তোরা দুটোতে যেমন আছিস তেমন থাকিস, তোর বড়মার আগে ছোটোমা সব জেনেছে মিত্রার কাছ থেকে, মিত্রা কোনো কথা অস্বীকার করে নি। আমি তোর দাদার মতামত নিয়েছি, সে আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, মিত্রার বাবা চেয়েছিলো তোকে, তার মা চায় নি, আজ মিত্রা তোকে চাইছে। তোর বড়মা ডাকাবুকো, সহজ সরল বড়মার পেছনে একজন বিদ্রোহীনি লুকিয়ে আছে, একদিন আবিষ্কার করলাম আমি তোর মধ্যে তোর দাদাকে খুঁজে পাচ্ছি, বরং একটু বেশি, আমি তোর দাদাকে তোর মতো দেখতে চেয়েছিলাম, পারি নি। তোর ছোটোমারও একি অবস্থা আমার মতো। তবে…….।
আমি বড়মার মুখ চেপে ধরলাম, ঘার দুলিয়ে না না করছি। ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছু বলতে গেলো, আমি ছোটোমার মুখ চেপে ধরলাম, মিত্রা পাসে এসে দাঁড়ালো
-বুবুন তুই কাঁদিস না। তোকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি, এর থেকেও তুই অনেক বড় বড় ব্যাপার সামলেছিস, আমি কেঁদেছি, তুই শক্ত থেকেছিস। তুই আমার কথাটা একবার ভাব। আমারও তোর কাছে কিছু চাওয়ার আছে। আমি ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরে আছি, মিত্রাও ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরলো, আমি সামনে মিত্রা পেছনে। ছোটোমাও কাঁদছে। শেষ পযর্ন্ত ছোটোমা বলে উঠলো তোদের দুজনার চাপে আমি তো দমবন্ধ হয়ে মরে যাবো।
বড়মা আবার বলতে শুরু করলো
-ছোটোমার কথা একবার ভাব, কত কষ্ট বুকে নিয়ে বসে আছে। তুই ভাবছিস নিরঞ্জন কিছু জানে না, নিরঞ্জন সব জানে, মুন্নার ব্যাপারটাও। তোর ছোটোমা গাড়িতে আসতে আসতে সব কনফেস করেছে নিরঞ্জনের কাছে, তোর দাদা নিরঞ্জনকে সব বলেছে, ওরে ও যে আমাদের ঘরের লোক।
নিরঞ্জনদা আমার কাছে এগিয়ে এলো,
-নারে অনি তুই ঠিক করেছিস, তোর ডিসিসন পারফেক্ট ডিসিসন। তোর জায়গায় আমি থাকলেও তাই করতাম, আমি তোকে ঠিকমতো চিনি না তুই আমাকে ঠিকমতো চিনিস না, কেনো তুই ওপেন করবি নিজেকে, আগে দুজনের বোঝা-পড়ার পালা শেষ হোক, তাই না। আমি নিরঞ্জনদার দিকে তাকালাম।
-তুই সত্যি আমাদের গর্ব, দাদাকে জিজ্ঞাসা করিস, নার্সিং হোমে তোকে দেখেই আমি দাদাকে বলেছিলাম, রাইজিং সান খুব সাবধানে অপারেট কোরো, নাহলে পুরে ছাই হয়ে যাবে। দাদা মাঝে মাঝে আমার কথা শোনে, এই কথাটা রেখেছিলো। ছোটো ওটা দেতো, এই ফাঁকে পরিয়ে দিই।
ছোটোমা নীপাকে ডাকলো, নীপার ব্যাগ থেকে একটা অরনামেন্টের বাক্স বার করে নিরঞ্জনদার হাতে দিলো। নিরঞ্জনদা বললো দে মিত্রাকে পরিয়ে দে। আমি মিত্রাকে পরিয়ে দিলাম। আমি মিত্রা নিরঞ্জনদাকে প্রণাম করলাম।
-বুঝলি অনি আমি এখনো কুমার থেকে গেলাম, তোর বড়মা ছোটোমাকে বলে বলে আমার মুখটা একেবারে হেজে গেছে, দেখতো মিত্রার মতো একটা মেয়ে খুঁজে পাস কিনা, তাহলে এই বুড়ো বয়সে একবার বিয়ের পিঁড়িতে বসি।
-মরণ, রস দেখো না। বড়মা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো। সবাই হেসে উঠলো। আমিও না হেসে পারলাম না।