Thread Rating:
  • 90 Vote(s) - 3.47 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance মন ২ - কাহিনীর নাম- শিবের শিব প্রাপ্তি- সমাপ্ত
আগের পর্বের কিছু অংশ.........

-     উফফ পারি না তোকে নিয়ে। এই বাজে বাজে খিস্তী গুলো দিস না শিব। লোকে ভুল বুঝবে।

-     বুঝুক। তোকে খিস্তী না দিলে তো সিধে হবি না কুত্তা।
-     বেশ ঘুমো এবারে। কালকে ম্যাচ নেই। ফোন করব আট টার দিকে।
-     উম্মম্ম। গুড নাইট
-     হুম গুড নাইট।
                                                                                 পর্ব সতেরো

এতো ব্যাথা ছিলো তখন আমার শরীরে, নিম্নাঙ্গে মনে হত শত শত সূচের যন্ত্রনা। দুটো পা কে আমি নড়াতেও আমার কষ্ট হতো। কিন্তু ওই তিন চার মাস আমার স্বপ্নের মতন কেটেছিল। রোজ রাকার সাথে কথা বলতাম। হারিয়ে যেতাম ওর সাথে নিজের স্বপ্নে। মনে হচ্ছিল, এই শারীরিক কষ্ট পাওয়া সার্থক হবে আমার। ছেলেদের নিয়ে যে একটা বিতৃষ্ণা ছিল সেটা রাকার বেলায় কাজ করত না। মনে হত কখন আসবে রুদ্রপুরে। কখন একসাথে ছাদে সময় কাটাব। মনে হতো ভাগ্যিস এই অরগ্যানোপ্লাস্টি টা করালাম। যদি রাকা আমাকে পছন্দ করে ফেলে? মনে মধ্যে অজস্র সুখ ভাবনা ছড়িয়ে পড়ত। কাউকে বলিনি আমি কোন দিন ও সেটা কিন্তু মনে মনে ভাবতে আর সেই ভাবনায় উড়তে ক্ষতি কি?

আসলে ওর ঐ সময় টা আগে এগিয়ে যাবার সময় ছিল। ওর প্রতিটা খেলা দেখতাম। ওর কোচ ওকে নানা পজিশন এ ট্রাই করছিল। অবশ্যই সব ম্যাচ এ না।  অবশেষে সেই ম্যাচ এলো যে ম্যাচ এ ও ও খেলল সি এ এম এ। মানে সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ড এ। তখন অলরেডি রাকা রা লীগের টেবিলে দু নম্বরে আছে। আর খেলা পরেছিল নর্থ ইস্ট এর সাথে। নর্থ ইস্ট লিগ টেবিলের নীচের দিকে ছিল। সেবারে কলকাতা খুব বাজে খেলছিল। কলকাতা ও ছয় নাম্বার এ নেমে গেছিল। নর্থ ইস্ট এর সাথে খেলাটা গুয়াহাটি তে হচ্ছিল। আমার এখান থেকে আট ঘন্টার জার্নি। কিন্তু আমার যা শরীরের হাল ছিল, আমি পারতাম না। না হলে চলে যেতাম।

খেলাটা আমি টি ভি তেই দেখলাম। শুধু রাকার টিমের খেলাই দেখতাম এমন না। সব খেলাই দেখতাম। রাকা কে ইনপুট দিতাম। যা বুঝতাম যত টুকু বুঝতাম সেটাই ওকে বলতাম। নর্থ ইস্ট এর দম ভাল খুব। বাইরের প্লেয়ার তেমন নেয় না ওরা। তাই ওদের স্কিল আর অভিজ্ঞতা কম ছিল। কিন্তু ওরাও পনের বছর খেলছে। তাই হালকা ভাবে নেওয়া তো ঠিক না। যদিও ভারতের এই লেভেলের ফুটবলে, সব দল ই কম বেশী সমান। কেই বা ভেবেছিল, আগের বারের চ্যাম্পিয়ন, কলকাতা এবারে ছয় নম্বর পজিশনে আসবে ফার্স্ট রাউন্ডের পরে? কাজেই সব টিম সমান। ভুল করলেই হারতে হবে। এই পর্যায়ে, দম ধরে রাখতে হবে। যাতে করে সেকেন্ড রাউন্ডে একটা পুরো দমের টিম খেলতে পারে।

এই ম্যাচ এ রাকা খেলল নিজের জায়গায়। বলেই তো ছিলাম , ও একটা ডার্লিং। এতোদিন, মুম্বাই খেলা ওঠাতো উইং ধরে। কখনো ডান দিকে বা কখনো বাম দিক ধরে। মাঝে ওদের সাত নাম্বার টা খেলত। সাত্যকি। বাঙ্গালী আর ভালো প্লেয়ার , কিন্তু ও রাকা নয়। রাকার মতন না আছে স্কোরিং এবিলিটি, না ডিস্ট্রিবিউশন আর না আছে ওই লেভেলের পুরো মাঠ বোঝার ক্ষমতা। সেদিনে সাত্যকি ছিল না মাঠে। রাকা খেলছিল। আর ওর খেলা দেখার মজাই আলাদা। এতো দিনে মুম্বই এর খেলায় একটা সার্টেইনিটি ছিল। ডান দিক দিয়ে উঠত ওরা। কারন সাত্যকি থেকে ডান উইঙ্গার টা বল নিত। এখানে ওরা কখনো ওদের রাইট ব্যাক টা কে উপরে তুলত। বা রাইট মিডফীল্ড যে ছেলেটা খেলত, দুজনায় ভাগ বাঁটোয়ারা করে উপরে উঠত।  এরা দম নেবার সময়ে বাম দিক এর সেট টা উঠত। তবে বাম দিকের থেকে ডান দিকের প্লেয়ার দুটো অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। সেই জন্য গত দুটো ম্যাচ এ, মুম্বাই জিততে পারে নি। দুটো ম্যাচ ই ড্র হয়েছিল। বিপক্ষ কোচ বুঝে গেছিল কি করতে হবে মুম্বই এর বিরুদ্ধে। ওরা ডান দিক টা ব্লক করে দিত।

কিন্তু এ ম্যাচ টা উল্টে দিল হিসাব। একেই নর্থ ইস্ট ধারে ভারে একটু কম। তারপরে রাকার ডিস্ট্রিবিউশন এ নর্থ ইস্ট খেই হারিয়ে ফেলছিল। রাকা বাম ডান কোন দিক কেই ছাড়ছিল না। দরকার পরলে একটা দুটো ডজ ওর কাছে কোন ব্যাপার না। বিপক্ষের ডিফেন্ডার দিয়ে ঘেরাও হবার আগেই ও বল রিলিজ করছিল ফাঁকা জায়গায়। আর কেউ না কেউ সেই বল টা পজেশন এ নিচ্ছিল মুম্বই এর। বুঝলাম রাকা কে মাঝে রেখে মুম্বই প্র‍্যাক্টিস করেছে ।রাকা শুধু বলটা দিচ্ছেই না, মাইক্রো ফোনের কাচা কাছি চলে আসলে বুঝছিলাম, ও পাস দিয়ে, বলে দিচ্ছে, বল টা ওকে ফেরত দিতে কিম্বা কত নম্বর কে বাড়াতে হবে। উফ , বলেছিলাম তো ও ডার্লিং। আমি তো পুরো মাঠ টা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু এই দেখলাম, ও বলটা নিয়ে উপরে উঠতে উঠতে ডীপে ফেরত দিল সহসা। আর ওদের আফ্রিকান সেন্ট্রাল ব্যাক টা, দুম করে উড়িয়ে দিল সামনে দিকে। ক্যামেরা ওদিকে যেতেই দেখলাম, গোলের ডান দিকে মুম্বই এর স্ট্রাইকারের কাছে বল পৌঁছে গেছে। ততক্ষনে রাকাও উঠে এসেছে বক্স এর ডি এর কাছে। বল রাকা পাসব্যাক  পেতেই বাম দিকের স্ট্রাইকার কে দিতে ই গোল। আসলে ও দেখে নেয়, কে ফাঁকা আছে। আর তার কাছে বিপক্ষের লোক পৌঁছতে কত সময় নিতে পারে। এটা ও নিজেই বুঝে যায়। খুব ফলো করে ও প্রথম পনের মিনিট খেলা টা। আজকেও প্রথম পনের মিনিট ও ওয়ান টাচ এ খেলল। বল রাখছিলই না নিজের কাছে। কমেন্টেটর তখন ওকে ক্রিটিসাইজ করছিল। কুড়ি মিনিট পর থেকে ফুল ফোটাতে শুরু করল ও। প্রথম পনের মিনিট ও জাস্ট বুঝছিল, বিপক্ষের কোথায় ফাঁক তৈরী হচ্ছে বা ওদের কে কত টা গতি তুলতে পারে।যেই বুঝে গেল তখন ই শুরু হয়ে গেছিল ওর আসল খেলা।  ৮৮ মিনিটে ওকে তুলে নিলো কোচ। কারন ৫ মিনিট ইনজুরি টাইম ডিক্লেয়ার্ড হলো। ভালো করেছে। না হলে লাস্ট মিনিট এ ইনজিওর হলে সমস্যা হতো। কে বলতে পারে, রাগে ওকে কেউ মারাত্মক ট্যাকেলে নিল। দরকার নেই আর। ততক্ষনে ওরা চার গোল এ এগিয়ে। আর চারটে গোলের এসিস্ট রাকার পা থেকে। ও যখন হাত তালি দিতে দিতে উঠে আসছিল, কেউ চিয়ার করল না। কেউ বুঝলই না ও কি করে দিয়ে গেল মাঠে। সবাই গোল দাতা দের নিয়ে লাফাবে। কিন্তু বুঝছিলাম, ওর কোচ নিশ্চয়ই বুঝবে, ও কি করে দিয়ে গেলো মাঠে আজকে। কিন্তু কমেন্টেটর রা বলছিল এই ছেলে ইন্ডিয়া খেলবেই খুব তাড়াতাড়ি। ওর দাপটে পুরো টিম টাই এমন খেলল , নর্থ ইস্ট কে মনে হচ্ছিল বি গ্রেডের কোন দল ।

 কি আর বলব, মুগ্ধ হয়ে দেখলাম ওকে আমি সারা টা ম্যাচ। এই না হলে প্লে মেকার? মাঝে মাঝেই ক্লোস-আপ আসছে ওর মুখে। ঠাণ্ডা মিষ্টি মুখ। কোন ক্লান্তি ছিল না। জানতাম, ও নিজের পজিশন এ খেললে ওর ক্লান্তি আসবে না। এই রকম খেললে, পরের বছরে ও অনেক দাম পাবে আর আরো কোন ভালো দল ওকে নিয়ে নেবে। হয়ত বা জাতীয় দলেও ও ডাক পেয়ে গেল। নিজের আনন্দে নিজেই একটু চিয়ার করতে গিয়ে, কোমরের নীচে ব্যাথা টা চিনচিন করে উঠল আমার।

এমন একটা সময় আসে যখন জীবনের প্রতি টা সময় খুব ভালো লাগে। সেই সময় টা আমার তেমন ই ছিল। রাকা বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছিল। তাই রুদ্রপুরে আগের মতন ঘুরতে বেরোত না। মানে পারত না ঘুরতে। ছেঁকে ধরত অনেকেই। লীগ টা শেষ হলেই ও রুদ্রপুর এলো। সেই বারেই আন্টি কে বলে ও, আগের পুরোন বাড়ি টা ভেঙ্গে, দু টো ঘরের একটা বাড়ি করল। মায়ের জন্য, জল , বাথরুম সব করল, সাথে একটা বিশাল উঠোন। আমার খুব ভালো লেগেছিল। সে যে কি আনন্দ বলে বোঝাতে পারব না। ওর সব কথাতেই আমার কথা থাকত। কেমন করে ওকে আমি জোর করে পাঠিয়েছিলাম কলকাতা তে ক্যাম্প এ সেই কথা। কথায় কথায় আমার উপরে ওর এই নিয়ে কৃতজ্ঞতার সাথে ভাল লাগা জড়িয়ে থাকত।

ব্যাপার হয়ে গেছিল, ও এই লেভেলের খেলা শুরু করার পরে, ওকে আমি একলা পেতাম না আর। ও আসলে, টানা এক মাস থাকত, আবার চলে যেত, আসত আবার সেই সাত আট মাস পরে। কিন্তু প্রথমবার আসার পরে মাস দুয়েক ছিলো রুদ্র পুরে। কিন্তু ও বেরোলেই অনেকেই ঘিরে ধরত ওকে। শুধু রুদ্রপুরের সব কলেজ ওকে সংবর্ধনা দিয়ে দিল। বাপির বন্ধুর ক্লাব যেখানে আমিও খেলতাম, তাদের ওখানেও অনেক বড় অনুষ্ঠান হয়ে গেলো , ওকে নিয়ে। আর সবাই আমাকে বলত, ওকে রাজী করাতে। কিন্তু আমি ওকে বলতাম না। মনে হতো ও থাকুক আড়ালে। এখনো ওর এই সবের সময় হয় নি। তারপরে আমি চাইতাম ওকে একটু একলা। হয়ত আমার বাড়াবাড়ি ছিল এই ব্যাপার টা। তবে এই বাড়াবাড়ি টা ও আমাকে পরে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু একটা সময় অব্দি ও প্রশ্রয় দিয়েছিল আমাকে যাতে আমি এই বাড়াবাড়ি টা করি।

আমি তখন ও সুস্থ হই নি, যেবারে ও প্রথম এলো, তাই আমার আবদারে ও আর রনি আমাদের বাড়িতেই আড্ডা দিতে আসত। রাতে আমি শুতে যাবার সময়ে ওকে কল করতাম। জানিনা কি ছিল তখন। আর কেন জানিনা, রাকাও অপেক্ষা করত আমার ফোনের। আমার দেরী হল হয়ত। ঘরে মা আছে, কিম্বা কোন রুটিন ডায়ালেশন চলছে, নিজেই ফোন করে দিতো। ঘরে মা তাই ফোন টা কেটে দিতাম। আর মা কে শুনিয়ে বলতাম, কি যে কোম্পানী এতো রাতেও ফোন করে কে জানে। আর মা আড়চোখে আমাকে দেখত, মুখে মিটি মিটি হাসি লেগে থাকত মায়ের।
 
রাতে রাকা ফোন রাখার পরে ভাবতাম, আমি কি ওকে ভালো বাসছি? কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। আমি যেদিন মেয়ে হবার জন্য হরমোন থেরাপী শুরু করেছিলাম, সেদিনে ই ঠিক করে নিয়েছিলাম, এই সব সম্পর্কে আমি থাকব না। ভগবান কোন মানুষের জীবনে দুর্বলতা দিলে, সেই মানুষ কে খুব বোধ দিয়ে পাঠান। কাজেই আমি আমার জীবনে আমার জেন্ডার নিয়ে যত দুর্বল হয়েছি, ততই আমার মধ্যে বোধ বেড়েছে।নিজের সম্পর্কে বোধ, সমাজ সম্পর্কে বোধ। মানুষ চিনে যাবার ক্ষমতা। কথার মধ্যে, গভীরে লুকিয়ে থাকাএ শ্লেষ ও বুঝতে আমার সময় লাগত না। আর  সেই বোধ থেকেই আমি জেনে গেছিলাম যে, বন্ধুত্ব টা সারাজীবনের। ওই সব সম্পর্ক করে আমি ওর সাথে কোন ভাবেই নষ্ট করব না আমাদের বন্ধুত্ব। কারন আমার মতন ছেলে থেকে হওয়া মেয়েকে কেউ নিজের জীবন সঙ্গিনী হিসাবে পছন্দ করতে পারে না সেই বিশ্বাস টা আমার মধ্যে হয়ে গেছিল। কিন্তু রাকার ক্ষেত্রে এই ব্যাপার টা কাজ করত না।

অন্য সবাই আমার রূপের প্রশংসা করলে আমার তৎক্ষণাৎ মনে পরে যেত আমি আসলে কি। কি আমার পরিচয়। আমি মেয়ে না এই টা মনে পরে গেলেই আমার কারোর প্রশংসা আর গায়ে নিতাম না। বিশেষ করে আমার রূপ সম্পর্কিত প্রশংসা। রনি তো সব সময়েই বলত। কিছু মনে হত না আমার। কিন্তু  রাকা যেদিনে বলত আজ তোর রূপে পুড়ে যাব মনে হচ্ছে, সেদিনে একটা হায়া, একটা লজ্জা আমাকে গ্রাস করত।মনে মনে বলতাম ওকে, থাম তুই, তোর নজর আমাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। পুরো শরীর টা মনে হতো জ্বলছে। মন জ্বলছে। মনে লোভ হতো। কেমন ফাঁকা হয়ে যেত আমার মনের ভিতর টা। মেয়ে না হয়েও, মেয়ের মতন নিজেকে ভাবতে ইচ্ছে করত তখন। জানিনা কি দুর্মতি হয়েছিল আমার। বেশ পর পর কয়েকটা ঘটনা আমাকে বাধ্য করেছিল রাকার সম্পর্কে ভাবতে, যেটা আমি কোন দিন ভাবতে চাই নি। আজকে বুঝি দোষ আমার ছিল।

সেবারে চলে যাবার পরে, আবার এল, হোলির সময়ে। হোলি তে ওখানে প্র্যাকটিস বন্ধ ছিল দিন দশেক মতন। ও চলে এসেছিল। আন্টি আর আঙ্কল ঠিক করেছিল, ওদের গ্রামের, কূলদেবতার হোলি তে যাবে সে বছর। হোলির এক দিন আগের সকালে, আমি ওদের বাড়ি তে ছিলাম। আন্টি আমাকে ডেকেছিল, সকালে আন্টির হাতের তৈরী ঘুঘনী খাওয়াবে বলে। এমনি রাকা না থাকলেও আমি যেতাম। অনেক কিছু আন্টি আমাকে খাওয়াতো ও। যাই হোক সেদিনে রাকার গ্রামের বাড়ি থেকে রাকার জেঠু কাকা রা এসেছিল। ওখানে গিয়ে শুনলাম, রাকারা হোলির দিনে থাকবে না, গ্রামের বাড়ি যাবে। আমি ভাবছি এ মা হোলি তো হয়ে গেল দু দিন আগেই। আবার কীসের হোলি। পরে জেনেছিলাম ওদের পঞ্চম দোল হয়। শোনা যায় শ্রী কৃষ্ণ, মথুরা তে হোলি খেলার পরে, পাঁচ দিনের দিন, বৃন্দাবনে গেছিলেন হোলি খেলতে। সেই টাই পালিত হয় রাকাদের বাড়িতে। 

আমার ভালো লাগে নি শুনে। মানে দুদিন ও থাকবে না, রুদ্রপুরে। রাকাও দেখলাম গ্রামের বাড়ি যেতে বিশেষ উৎসাহী নয়। তাই আন্টি যখন বলল ওনাদের যাবার কথা আমাকে, তখন ই আমার বিশেষ ভাল লাগে নি। আন্টি রান্না করছিল, আর আমরা দুজনে পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইশারায় কথা বলছিলাম। আন্টি বলছিলেন,

-     দ্যাখ শিব, আমার অনেক দিনের সাধ ছিল, রাকার ভাল কিছু একটা হলে, দোল যাত্রাতে যাব। আমাদের কুলদেবতা, গোবিন্দর দোল যাত্রা খুব ভাল হয় বুঝলি?

ততক্ষনে আমি মুখ বেজার করে রাকার দিকে তাকিয়ে আছি। রাকার মুখ ও তাই। বেচারী আন্টি কে কিছু বলতেও পারছে না। আমি ওকে ইশারা করছি, তোকে যেতে হবে না। আর ততধিক মুখ টা বিকৃত করে আমাকে ইশারা করছে, আন্টির দিকে হাত দেখিয়ে। যেন বলছে, আমি কি করব? দেখছিস না মা টেনে নিয়ে যাচ্ছে? এদিকে আন্টি আমাকে বলছে আগের কথার রেশ টেনে,
-     কি রে বুঝলি?
-     অ্যাঁ?
-     অ্যাঁ কি রে? বললাম, উপায় নেই যেতেই হবে বুঝলি?

আমার তো মন টা ভেঙ্গেই গেল প্রায়। আন্টির দিকে তাকাতেও পারছি না। আন্টি বুঝে যাবেন, যে আমি খুশী নই। আমি চুপ রইলাম। তখন রাকা খুব ভয়ে ভয়ে বলল,
-     ও মা আমি যাব না তোমরা যাও না।

আন্টি রাকার দিকে বেশ রাগের চোখেই তাকালেন। কিন্তু আমি রাকার কথার জের টেনে এক নিঃশ্বাসে বলে দিলাম,
-     হ্যাঁ হ্যাঁ , আন্টি, তোমরা যাও। ও থাকুক। ওর জন্য কোন চিন্তা নেই তোমার। ও আমাদের বাড়িতে খেয়ে নেবে। আমাদের বাড়িতেই শুয়ে পড়বে। তারপরে, দোলের দিনে কে রং দেবে, আবির মাখাবে ওকে। চোখে লেগে গেলে সমস্যা হবে। ওর তো সবে শুরু। তারপরে ধর ও যাবে বাস এ করে ট্রেনে করে, সামনেই ওনেক খেলা ওর, কোথাও লেগে যেতে পারে। পরে গিয়ে ব্যাথা পেতে পারে। ও বরং থাক এখানে। ওর থাকা খাওয়ার আমি দায়িত্ব নিলাম। আর দোলের দিনে যদি বল যে কোন দেবতার পুজো দিতে, আমি মা কে বলে সেই ব্যবস্থা ও করে দেব। তুমি বরং ওকে রেখে যাও এখানে। প্লিস প্লিস প্লিস প্লিস…

আমি আরো বলে যেতাম কিন্তু আন্টি আমাকে থাকিয়ে দিলেন,
-     ওরে থাম থাম। তুফান মেলের মতন তো বকবক করেই যাচ্ছিস। উফ।

আন্টি আমাকে থামিয়ে দিয়ে, হাঁ করে দেখছিলেন। আমি প্রায় হাঁপাচ্ছিলাম। কিন্তু আন্টি আমাকে খুব নিরাশ করে দিয়ে বললেন,
-     হ্যাঁ সেটা উপায় ছিল, যে রাকা তোদের বাড়িতে থাকবে। কিন্তু সে উপায় আর নেই।

আমার মনের মধ্যে আশার আলো দেখা দিল আন্টির কথা শুনে। মনে হলো যে, কি জানি উপায় বের হতেও পারে। আমি আবার লাফিয়ে উঠলাম,
-     কেন, কেন আন্টি। প্লিজ তুমি না বোল না। ও থাকুক না!
-     আরে হবে না। কারন যাদের বাড়ি থাকবে তুই বলছিস, তারাও তো যাবে মনে হয়।

আমি প্রায় চমকে উঠলাম। মানে, মা যাবে? আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি আবার আন্টি কে জিজ্ঞাসা করলাম,
-     মানে বাপি আর মা যাবে?

আন্টি রান্না করছেন। কিন্তু আমার সাথে কথাও বলছেন। আমাকে ওই ভাবেই খুন্তী নাড়াতে নাড়াতে বললেন
-     হুম তাই তো জানি!

আমি লাফিয়ে উঠলাম একেবারে আনন্দে। মানে আমিও যাব? আমি আন্টি কে বলে উঠলাম
-     কই আমাকে মা কিছু বলে নি তো?
-     বলবে কি করে? আমি তো একটু আগেই কথা বললাম , তোর মায়ের সাথে।
-     ওয়াও!!!!

আমি বোকার মতো আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম একেবারে। আন্টি কে বলে দিলাম
-     ও, আমরা যাব আগে বললেই পারতে?

আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আমাকে বলল।
-     ও তাহলে, আর চোখে, আবির, রং লাগবে না বল? বা ট্রেনে বাসে করে গেলে ওর খেলার কোন ক্ষতি হবে না, তাই না?

লজ্জায় মনে হচ্ছিল, এক ছুটে আন্টির কাছ থেকে আমি পালাই। কিন্তু পারছি না, আমার পা দুটো যেন, মনে হচ্ছে জমে গেছে মেঝের সাথে। ততক্ষনে রাকা পালিয়েছে রান্না ঘর থেকে। ইশ আন্টি কি ভাবল কে জানে। না পারছি পালাতে, আর না পারছি আমি থাকতে। কারন আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, মুখে হাসি টা নিয়ে। বড় স্নেহ ছিল সেই নজরে। কিন্তু আমি তাকাতে পারছিলাম না আন্টির দিকে। কোন রকমে- জানিনা, বলে আমি এক ছুটে বাইরে চলে এলাম রান্না ঘর থেকে।

মনের মধ্যে শত শত দামামা। আন্টি কেন ওমনি করে তাকিয়ে ছিলেন? আমার মনের ভিতর টা কি উনি বুঝছেন? মেয়ে আমি র মন টা উনি পড়ে নিচ্ছেন? নাহ সাবধানে থাকতে হবে। কিন্তু আমি যেন উড়ছিলাম আনন্দে। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, রাকা বল টা নিয়ে ওদের উঠোনে খেলছে আর আমাকে দেখছে। তাকালাম ওর দিকে। মনে হলো, ও যেন এটাই চাইছিল।
 
পরের দিন ট্রেনেই গেলাম আমরা। আন্টি আমার মায়ের সামনেই বলল মাকে,

-     দিদি ট্রেন এ করে যাচ্ছি, একজন তো নাকি ট্রেনে বাসে চাপলে আর খেলতে পারব না। শিব কে বলি নাকি, খেয়াল রাখতে?  

ইশ, আমি সাড়া দিলাম না। আন্টি টা না খুব এমবেরাস করতে পারে। উল্টো দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাকা একটু দূরে বসে আছে। ভাবছিলাম। ও বাঁদর কে কেউ চেনে না এখন। চিনলে এই ভাবে ও আর ট্রেনে করে যেতে পারত না। আমার স্বপ্ন ও সেটাই। যে এতো নাম করুক যেন চারদিকে ওর নামের জয়ধ্বনি ওঠে।

আমরা গেছিলাম চাঁচরের দিন। ওদের গ্রামের বাড়ি বেশ বড়। ছাড়া ছাড়া ঘর। কিছু ঘর মাটির, আর কিছু ঘর দালান। মাঝের উঠোন টা বিশাল বড়। ঘর গুলো উঠোন কে ঘিরে বানানো। একটা বিশাল সদর দরজা। বাড়ি ঢোকার আগে, ঢোকার রাস্তার দুই দিকে বেশ ফাঁকা জায়গা। সেখানে শুনলাম, ধান ঝাড়া হয়। বড় বড় দুটো খড়ের পালা। দুটো ট্রাক্টর দাঁড় করানো। রাকাদের দাদু রা তিন ভাই এখনো একসাথেই থাকেন। বিশাল বড় পরিবার, প্রায় চল্লিশ জন সদস্যের পরিবার। কেউ বাইরে থাকেন , কেউ গ্রামেই চাস বাস করেন। যেমন রাকার বাবা বাইরে আছেন। রাকার বাবার বড় দাদা আছেন, উনি থাকেন গ্রামে। এমন অনেকেই গ্রামে থাকেন। আবার অনেকেই বাইরে কাজ ও করেন। সবাই আসতে পারে নি এবারে এই হোলি তে। তাও যা মনে হল, পঁচিশ জন তো হবেই আমাদের কে নিয়ে।

আমরা গেছিলাম, পরিবারের বাইরের মানুষ। কিন্তু আমাদের স্বাগতম বেশ উষ্ণ হলো। ওমা কি সুন্দর মেয়েটি গোছের মন্তব্য প্রায় সবাই করল। আমার বোন ও অসাধারন দেখতে। দুই বোনের রূপের ছটায় আমার মা একেবারে মধ্যমনি হয়ে উঠল রাকাদের বাড়িতে। শুধু রাকা বলল,
-     ও শুধু দেখতেই ভাল না, ও কলেজে ফার্স্ট হতো। এখন ফিজিক্স অনার্স নিয়ে পড়ছে। আর ফার্স্ট ইয়ার এ ইউনিভার্সিটি তে টপ করেছে।

ব্যস আর পায় কে আমাকে। আমার বোনের তাতে একটু দুঃখ হল বটে। কিন্তু আমার ওখানে বেশ আলাপ জমে উঠল। আমার ভাই ওখানে ওর বয়সী ছেলেদের সাথে খেলতেও শুরু করে দিল তখনি। বেশ আলাপী পরিবার। বাড়ির চারিদিকে, অনেক গাছের জঙ্গল বললেও অত্যুক্তি হয় না। এমনি তেই ডুয়ার্স এ গাছের আধিক্য বেশি। আর ওদের গ্রামে মনে হলো, ছোট রুদ্রপুরের জঙ্গল টা উঠে এসেছে। নিজেদের পুকুর জমি মিলে রাকাদের গ্রামের অবস্থা মন্দ না।

শুনলাম, বেশ কিছু বছর আগে, রাকার বাবা, দাদার সাথে কথাকাটি করে চলে গেছিলেন। সেই থেকে নিজের সংসার নিজেই চালান। বাড়ি থেকে কোন সাহায্য নেন না। আন্টিও কাজ করেন। রাকার বাবার সেই সিদ্ধান্ত কে সম্মান জানিয়েছিলেন আন্টি। রাকার জেঠু পরে ভুল বুঝতে পেরে অনেক চেষ্টা করেও রাকার বাবাকে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারেন নি। তাই মাঝে মাঝেই, চাল, মাছ, বাড়ির দুধ, ভাই এর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। যদিও রুদ্রপুরের বাড়িটা রাকার বাবার পৈতৃক বাড়ি। সেখানেও অনেক সম্পত্তি। কিন্তু সে তো কারোর একার নামে নয়। তাই রাকাদের অবস্থা খারাপ সে তূলনায়।

পুরো দিন টাই কেটে গেল আমার মা, আন্টি জেঠিমাদের সাথে। রাতে শুনলাম চাঁচর পোড়াতে যাওয়া হবে। সন্ধ্যে বেলায় আমি বাড়ির সামনের খামারে একটা খড়ের স্তুপের উপরে বসেছিলাম। হালকা ঠান্ডা। একটা নীল রঙের স্কার্ট পরে আছি আমি। আর সাদা লম্বা কুর্তা।চুল টা খোলা। একটা নীল ওড়না দিয়ে আমি মাথা টা ঢেকে রেখেছিলাম। একটা কুকুর, তার বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছিল। আমি বাচ্চা গুলো কে নিয়ে খেলছিলাম, কোলে নিচ্ছিলাম, আদর করছিলাম। সে সময়ে রাকা কোথা থেকে এসেই ওদের মা কে তাড়িয়ে দিল। সাথে বাচ্চা গুলো ও পালাল মায়ের পিছু পিছু। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম একেবারে,
-     কি রে? কি নির্মম তুই!  তাড়িয়ে দিলি ওদের কে? অসভ্য একেবারে।
-     ধুর ছাড় তো। মেয়ে হবার পরে তোর মধ্যে এই সব ব্যাপার গুলো বেড়েছে দেখছি।
-     ফালতু বকিস না তো, এই সব আমি আগেও করতাম।
-     আচ্ছা আচ্ছা, আজকে রাতে যাবি তো আমার সাথে?
-     কোথায়?
-     চাঁচর পোড়াতে?
-     হুম যাব। কিন্তু তোর সাথে কেন? জানিস না আমি এখন মেয়ে। তোর সাথে যাওয়া মানা।
-     ইহহ ও নাকি মেয়ে!
-     এই, বাজে কথা বলবি না।  
-     কেন নাটক করছিস। যাবি কিনা বল? দারুন হয়। ন্যাড়া পোড়ে, বাজী পোড়ে।

আমি ওর দিকে তাকিয়েই ছিলাম। যাব তো আমি বটেই আমি জানি। ও একটা বারমুডা পরে রয়েছে। উপরে একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। আজকাল আমি এই সব খুব দেখি। ওকে বললাম
-     যাব, কিন্তু তুই মা কে বলবি। আমাকে যদি যেতে না দেয়?
-     আরে না না সবাই যাবে। বাড়ির সবাই যায়। কিন্তু আমি আর তুই ওদের সাথে যাব না।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। সে, ও আমাকে যেখানে খুশী সেখানে নিয়ে যাক। ওর উপরে আমার নির্ভরতার কোন সীমা নেই। তাই ওকে আমি চোখ বুজে বিশ্বাস করি। অবাক হলাম এই কারনে যে, ওর চোখে আমাকে একলা পাবার আকুতি ছিল। এই আকুতি সেই রাতে পেয়েছিলাম, যে রাতে ও আমার ছাদে চলে এসেছিল রাতে। কিন্তু আমার এতো আকুতির কারন বুঝিনা। আমি ই কি চাইছি, নাকি আমার সেকেন্ড টাইম ইস্ট্রোজেন চলছে বলে ওর গন্ধ, ওর সঙ্গ আমার ভালো লাগছে। আমি ওকে বললাম
-     একা একা? মা বকবে জানলে।
-     আরে জানবে নাকি? সে আমি ম্যানেজ করে নেব।
-     আচ্ছা যাব।
[+] 10 users Like nandanadasnandana's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মন ২ - কাহিনীর নাম - শিবের শিব প্রাপ্তি অধ্যায় তিন- নতুন পর্ব ১৬ - by nandanadasnandana - 13-02-2022, 12:05 PM



Users browsing this thread: 13 Guest(s)